ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ুন আহমেদ আর নেই। কোলন ক্যান্সারের সাথে লড়াই করছিলেন তিনি, কিন্তু হেরেই গেলেন। তার পরিবার এ শোক সহ্য করার শক্তি লাভ করুক এই কামনা করছি।

হুমায়ুন আহমেদ ছিলেন তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তার শিখরে থাকা একজন লেখক। তার লেখালেখি, ব্যক্তিগত জীবন এসব নিয়ে তিনি আলোচনা সমালোচনার মাঝেই থেকেছেন সবসময়। হুমায়ুন আহমেদ শেষ পর্যন্ত অনেক হতাশার জন্ম দিয়েছিলেন আমাদের মত মানুষের মাঝে যারা শঙ্খনীল কারাগার, নন্দিত নরকে, কৃষ্ণপক্ষ, আকাশজোড়া মেঘ, গৌরীপুর জংশন, কোথাও কেউ নেই, বৃহন্নলা, পোকাসহ আরো অনেক চমৎকার বই( যার সবগুলোর নামও এখন মনে পড়ছেনা) পড়ে মোহিত, আলোড়িত হয়েছিলাম, হিমুকে, মিসির আলীকে, শুভ্রকে পাগলের মত ভালবেসেছিলাম এবং সেসব বইয়ের পাশে তার এখনকার বইগুলোকে রেখে তাকে দন্ডিত করছিলাম সেইরকম মোহময় বই না লেখার বা না লিখতে পারার অপরাধে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে দন্ডিত করতাম এই বলে ‘হুমায়ুন আহমেদের উপর আমার রাগ সবচেয়ে বেশি কারণ লোকটার প্রতিভা আছে, লেখার ক্ষমতা আছে কিন্তু সে সেটার এখন আর ব্যবহার করেনা।’ বলতাম ‘সে তার ইদানীংকালের বইগুলা মনে হয় বাথরুমে বসে লিখে, নইলে এত বাজে হয় কেম্নে?’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আর একই সাথে আমার কাছে থাকা তার পুরনো এবং আমার প্রিয় বইগুলো বারবার পড়তাম। হুমায়ুন আহমেদের সমালোচনা করতাম, তাকে নিয়ে ঝগড়া করতাম কিন্তু এটা অস্বীকার করতে পারতামনা তার মত মোহ ও মুগ্ধতা সৃষ্টি করতে পারে এমন লেখক এখন মনে হয় আর বাংলাদেশে নেই। এইত কিছুদিন আগে ‘কোথাও কেউ নেই’ বইটা পড়ে অঝোরে কাঁদছিলাম, জানতাম শেষটা কি হবে তবু শেষ লাইন পর্যন্ত আশায় আশায় ছিলাম হয়ত কোন একটা মিরাকল হবে, বাকের ভাই বেঁচে যাবেন, সারাদিন গুন্ডামি করে এসে ঘরে ফিরে মুনার সাথে একসাথে ভাত খাবেন… কিন্তু শেষে দেখি- কোথাও কেউ নেই। সে কি বুকভাঙা কষ্ট! তাও এমন মানুষদের জন্য বইয়ের পাতার বাইরে যাদের অস্তিত্ব নেই, ওহ না আছে। পাঠকের মনে! বাকের ভাইকে যখন ফাসি দেয়া হয়েছিল তখন নাকি হুমায়ুন আহমেদের বাসায় ভাঙচুর হয়েছিল। খুবই অন্যায় এবং ভয়াবহ ব্যাপার। কিন্তু আমার যখনই ঘটনাটা মনে হয় ভাবি, যখন হুমায়ুন আহমেদ দেখছেন তারই সৃষ্টি করা একটা চরিত্রের ফাসি হল বলে লোকে তার ঘরবাড়িও ভাঙতে এসেছে তখন তার কেমন অনুভূতি হয়েছিল? তখন কি তার একটু গর্বও হয়নি? গত বছর ফিন্যান্স ডিপার্ট্মেন্টের ফ্যাশন শোতে একটি ছেলে বাকের ভাই সেজেছিল, ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছিল ‘হাওয়া মে উড়তা যায়ে’ গানটা, নাটকের একটা চরিত্র আমাদের সামনে এসে দাড়িয়েছিল কয়েক সেকেন্ডের জন্য- তবু কি উন্মাদনা! বাকের ভাই! ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকটা নামাচ্ছিলাম দেখব বলে…

মিসির আলী ও শুভ্র ছিল আমার খুবই প্রিয় চরিত্র। যুক্তি ও হৃদয় দুইয়ের অসামান্য মিলনে তৈরি হয়েছিলেন মিসির আলী। আমার এক হুমায়ুন ভক্ত ভাই আছেন যার সাথে আমি হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে ঝগড়া করতাম। তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘হুমায়ুন আহমেদের সার্থকতা এখানেই, সে যখন তার বইয়ে কোন মেয়েকে অসম্ভব রূপবতী বলে তখন কিন্তু আসলেই আমাদের মনে হয় মেয়েটা অসম্ভব রূপবতী।’ খুব সাধারণ একটা উপমা বা কথা দিয়ে হুমায়ুন আহমেদ মোহ সৃষ্টি করতে পারতেন। দারুচিনি দ্বীপ পড়ে কার না সেখানে যেতে ইচ্ছে হয়েছে? মধ্যবিত্ত জীবনের ছোট ছোট আনন্দ, মানুষের মধ্যকার অসীম নিঃসংগতা, বিষাদ, রোমান্স, ভালবাসার উন্মাদনা, চুড়ির মত ভেঙে পড়া হাসি, মাতাল জ্যোৎস্না, বৃষ্টিতে ভেজা, চমক ইত্যাদি নানা অনুভূতি আমি পেয়েছিলাম হুমায়ুন আহমেদের বইয়ের পাতায়। হুমায়ুন আহমেদের বই থেকেই প্রথম আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বই দি ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সী এর নাম শুনে সেটা পড়েছি, দোলনায় বসে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কফি খেতে চেয়েছি, জ্যোৎস্না-বৃষ্টি-ভালবাসা-মাদকতা-হাসি-কান্না-একাকীত্ব কতকিছু অনুভব করেছি এখন বলতেও পারবনা।

বাংলাদেশের নাটক ও চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও এক ধরণের ট্রেন্ড তৈরি করেছিলেন তিনি। আগুনের পরশমণি, দুই দুয়ারী, ধ্রাবণ মেঘের দিন, দারুচিনি দ্বীপসহ আরো কত চলচ্চিত্র, কত নাটক, তিনি অনন্যতা তৈরি করেছিলেন এসব ক্ষেত্রে। তার চলচ্চিত্রে মূল আকর্ষণ ছিল গানগুলোকে, কি চিত্রকল্পে ভরা একেকটা গান। ‘চান্নি পসর রাইতে আমারে স্মরন করে, কে আইসা দাড়াইছে আজ আমার দুয়ারে, তাহারে চিনিনা আমি সে আমারে চিনে… চান্নি পসর রাইতে…’ গানের কথাগুলো হৃদয়ে গিয়ে লাগে, সুখের মাঝে বিষাদ, বিষাদের মাঝে সুখ এমনি অদ্ভুত সব বিপরীত অনুভূতি নিয়ে কারবার ছিল হুমায়ুন আহমেদের লেখার, গানের, নাটকের, চলচ্চিত্রের।

হুমায়ুন আহমেদের সমালোচনা করতাম, কিন্তু চাইনি তিনি চলে যান, চেয়েছিলাম একবার কোথাও কেউ নেই বা নন্দিত নরকের হুমায়ুন আহমেদকে। তিনি চলে গেছেন এ দুঃখের চেয়েও বড় দুঃখ হল সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের কোন উত্তরাধিকারী নেই। এত সহজ ভাষায় ভীষন মাদকতায় আর কে ভোলাবে? অনেক কিছু লিখতে চাইছিলাম। কিন্তু কি লিখব? সব গুছিয়েও উঠতে পারছিনা। অন্যদের ব্যাপার জানিনা, আমি আমার ভাললাগা হুমায়ুন আহমেদের বইগুলো বারবার পড়ব, মাদকে মজব, নিজেকে হারাবো আমার প্রিয় সেই ছবিগুলোতে যা সেই ছবিতে তিনি এঁকে গেছেন। য়ামার মনে হয় হুমায়ুন আহমেদ বেঁচে থাকবেন, কারণ বেঁচে থাকবার মত অনেক কাজ তার আছে যা কালের করাল ঢেউ পেরিয়ে টিকে যাবে… মনে হচ্ছে একটা যুগের সমাপ্তি হল হুমায়ুন আহমেদের সাথে সাথে।