শরতের ফুটফুটে আকাশ দেখে একমাত্র পাখিদেরই ভালো লাগার কথা। তারা নিশ্চয় উপর থেকে কাশবন দেখে, পাল তোলা নৌকা দেখে, সাঁঝবেলায় বাঁকা হয়ে নিস্তরঙ্গ নদীর ফাঁকা মাঠের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা দেখে। বাংলায় ছয়টা ঋতু আছে। আকাশে না উড়তে পারলে এতগুলো ঋতু যে আছে সেটা বুঝতে পারারই কথা নয়। সীসা আর বালির স্তর ভেদ করে ঋতু পরিবর্তনের ছোঁয়া মাটিতে এসে লাগবে, সে আশায় গুঁড়েবালি।

এত কিছু থাকতে শেহরীন আজ হঠাৎ করে কেন যে ঢাকা শহরের ঋতু নিয়ে অনুযোগ করা শুরু করলো সেটাই আঁচ করার চেষ্টা করছে রনিন। কোনো ধরণের কূল-কিনারা না করতে পেরে, ড্রাইভ করতে থাকা রনিন খানিকটা চুপ করে থেকে বলে উঠলো-ঢাকা শহরের মাঝে কাশবন আসবে কোত্থেকে? পাল তোলা নৌকাই বা আসবে কোত্থেকে? তোমার কথা শুনে লোকজনতো হাহামাযা।
-হাহামাযা? হাহামাযা কি?
-হাহামাযা মানে হাসতে হাসতে মারা যাবে
-এটা কি ধরণের ল্যাঙ্গুয়েজ?
-কেন, সমস্যা কোথায়?
-সমস্যা হচ্ছে, এই তোমাদের মত লোকদের জন্যই বাংলা ভাষার আজ এই দূরবস্থা।
-না, বাংলাভাষার দূরাবস্থা বলে কিছু নেই। আমাদের মত লোকরা কোনো সমস্যা না। এমনকি, তোমাদের মত লোকেরা, যারা এটা কি ধরণের ভাষা না বলে একটা ইংলিশ শব্দ মিশিয়ে বলে এটা কি ধরণের ল্যাঙ্গুয়েজ তারাও ভাষার জন্য সমস্যা না।
-মানে?
-মানে ভাষা তার নিজস্ব গতিতে চলবে। ভাষা সবসময় পরিবর্তনশীল। সেই পরিবর্তনটাকে গ্রহণ করতে হবে।
-তাই বলে, শুদ্ধ মার্জিত ভাষা থাকবে না?
-কোনটা শুদ্ধ আর কোনটা অশুদ্ধ তার মাপকাঠি কি?
-কিন্তু, শ্রুতিমধুরতা বলেতো একটা কথা আছে, না-কি?
-কেউতো শ্রুতিমধুর করে কথা বলতে তোমাকে নিষেধ করেনি। কিন্তু, তাই বলে কেউ যদি তথাকথিত শ্রুতিমধুর ভাষায় না-কথা বলে, তাকে নিষেধ করা হবে কেন?

-অযথা তর্ক করো না রনিন। তুমি তোমার থার্ড ক্লাশ শব্দ ব্যক্তিগত পর্যায়ে রাখলে কারো হয়তো কিছু বলার নেই। কিন্তু, সেটা যদি তুমি গণমাধ্যমে প্রচার করো, তাহলে সেটা দেশের বিশাল একটা অংশকে প্রভাবিত করতে পারে। বিশেষ করে তরুণ সমাজ।
-কিন্তু, কি এমন তোমার সেই ফার্স্ট ক্লাশ ভাষা, যেটা থার্ড ক্লাশ ভাষার দাপটে টিকে উঠতে পারছে না।
-দেখ বিকৃত বাংলা ভাষার প্রয়োগ এবং ব্যবহার কেউই মেনে নেবে না।
-কেউ মেনে নেবে না? তুমি নিশ্চিত।
-হুম্‌! অন্তত পক্ষে যাদের বিবেক এবং মস্তিস্ক আছে তারা মেনে নেবে না।
-তুমি কি বলতে চাইছো, আমার বিবেক নেই।
-না, আছে।
-তাহলে?
-বাকী অন্যটা নেই।

রনিনকে দেখে বুঝতে পারা যায় না কখন সে রেগে থাকে আর কখন থাকে ফুরফুরে মেজাজে। তবে, তিনগুণ বেড়ে যাওয়া গাড়ীর গতি দেখে অনুমান করতে ভুল হয় না শেহরীনের। কিন্তু, সমস্য হলো, গাড়ির গতি তিনগুণ বাড়িয়েও কোনো লাভ নেই। তিন কদম দূরেই তিন মাইল দীর্ঘ ট্রাফিক জ্যাম।

আর অন্য পাঁচ-দশটা মেয়ে হলে রাগান্বিত মানুষের সাথে হয়তো নরম স্বরেই কথা বলতো। তাকে কিছুটা স্বাভাবিক হবার সময় দিত। কিন্তু, এই মেয়েটা অন্যরকম। রাগান্বিত মানুষের সাথে কথা বলতেই শেহরীনের সবচেয়ে ভালো লাগে। মিনমিন করে সে বলে উঠে- তোমার কি ধারনা এত নামী-দামী সব বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর অযথাই সতর্ক করছে?
-বিবেকের চেয়ে বড় কোনো প্রফেসর নেই, ঠান্ডা গলায় উত্তর দেয় রনিন।
-তার মানে তুমি বিকৃত বাংলা ভাষার পক্ষে।
-কোনটা বিকৃত আর কোনটা প্রমিত সেটা কেউই ঠিক করতে পারবে না। আজকের বাংলাভাষা আর কয়েক যুগ আগের বাংলা ভাষা এক নয়।
-তাই বলে রেডিও-টিভিতে এই সব চলে না।
-রেডিও টিভি বিনোদনের মাধ্যম, ওগুলো ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র নয়।
-তোমার কথা সঠিক নয়। দেশের রাষ্ট্রীয় রেডিও-টিভিতো ঠিকই প্রমিত ভাষা ব্যবহার করেই চলছে।
-সেটা যারা দেখছে, তাদের এক বিশাল অংশের কখনো প্রমিত ভাষা ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে না। আর যাদের প্রমিত ভাষা ব্যবহার করা উচিৎ তারা ও-সব দেখে না।
-কি-সব দেখে না?
-রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম।
-এমন ভাবে বলছো ও-সব দেখে না, মনে হচ্ছে ওগুলো কোনো নিষিদ্ধ দুষ্টু ছবি।
-দুষ্টু ছবি আবার কি জিনিস? ওগুলো নিষিদ্ধ না হলে বিশিষ্ট কিছুও নয়। শিষ্টতো নয়ই, মিষ্ট হওয়াতো দূরে থাক।

-বাদ দাও। তবে আমার মনে হয় এই বিকৃত উচ্চারণের ভাষার প্রসারের জন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েদের ভূমিকা খুবই প্রবল।
-তার আগে বলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে আলাদা একটা গ্রুপ মনে করার কি কারণ? স্টুডেন্টতো স্টুডেন্ট, তাদের সবারই স্বপ্ন এক, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া।
-না বড়লোক বাবার ছেলে-মেয়েরা পড়তে আসে না, শুধু নাম লেখাতে আসে।
-কথাটা সবার জন্য প্রযোজ্য না। আর যদি প্রযোজ্য হয়ও, বড়লোক বাবারা তাদের ছেলেমেয়েকে দেশের বাইরেও পাঠিয়েও দিতে পারে। সেটা না করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছে, তাতেতো দেশেরই লাভ। আমি বুঝতে পারি না, বড়লোক হওয়া কি অপরাধ না-কি? এদের ছেলে-মেয়েরাও সমস্ত জাতির প্রতিপক্ষ না-কি?
-প্রতিপক্ষ না। তবে সেখানে অনেকেই বিকৃত বাংলায় কথা বলে।
-তাহলে তর্কের খাতিরে বলেই ফেলি, কিছুটা হয়তো রূঢ় শোনাবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপক্ষে আশি ভাগ ছেলে-মেয়েতো বিকৃত বাংলায়ই কথা বলে। তারা বিকৃত আর করবেইটা কি?
-মানে কি এটার।
-মানে তারা আঞ্চলিক বাংলায় কথা বলে।
-আঞ্চলিক বাংলা আর বিকৃত বাংলা এক নয়।
-কিন্তু, কোনটিই শুদ্ধও নয়।

-এখানে পয়েন্ট সেটা না। তুমি কি তর্কের খাতিরে তর্ক করে যাবে না-কি? এখানে পয়েন্ট হচ্ছে, প্রাইভেটের ছেলে-মেয়েদের অনেকেই হয়তো চাইলেই শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারে। কিন্তু, তারা সেটা করে না। তারা মনে করে, বিকৃতভাবে কথা বলাটা স্মার্টনেস।
-একবার বোলছো সেটা থার্ড ক্লাস ভাষা, আবার বলছো সেটা স্মার্টনেস।
-তারা মনে করে সেটা স্মার্টনেস, অন্যরা মনে করে না।
-তাই না-কি? নিরপেক্ষ ভাবে ভেবে বলোতো দেখি। কখনো কারো বিয়ের জন্য পাত্র-পাত্রী দেখেছো?
-কি বলতে চাইছো তুমি? খুবই অরূচিকর কথাবার্তা।
-দুঃখিত! হতে পারে। অতটা ভেবে বলিনি।

-অত ভাবনার কিছু নেই। তোমার মনে রাখা উচিত, বাংলা ভাষার জন্য আমাদের দেশের মানুষ প্রাণ দিয়েছিলো।
-এ-সমস্ত সস্তা আবেগের কথা আমার কাছে বলতে যেয়ো না। তাদের প্রতি সন্মানের কোনো কমতি নেই। তাই বলে অযথার্থভাবে সেই রেফারেন্স টেনে আনার মানে হয় না। সেমিনারে গিয়ে চশমা পরা বুদ্ধিজীবীদের সাথে গিয়ে এ-সব আলাপ করো। অবশ্য, তার জন্য তোমাকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

-ফেব্রুয়ারির কথা যখন তুললেই, তখন ভুলে যেওনা বাংলা ভাষার জন্য একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক দিবস।
-না!
-না মানে?
-না মানে, বাংলা ভাষার জন্য না।
-তাহলে কি, তোমার হাহামাযা ভাষার জন্য?
-না-এর মানে হচ্ছে বাংলা ভাষার জন্য সেটি আন্তর্জাতিক দিবস না। মাতৃভাষার জন্য সেটি আন্তর্জাতিক দিবস। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাংলাভাষা আর মাতৃভাষা দু’টোর মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। তবে, বাংলাভাষা উপলক্ষ্য ছিলো এবং সেটিও কম গৌরবের বিষয় নয়।
-আমাদের জন্য মাতৃভাষা আর বাংলাভাষায় পার্থক্যটা কোথায়? কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ করে বলে উঠে শেহরীন।
আছে বলে গম্ভীর হয়ে থাকে রনিন।
-শেহরীন বলে উঠে, যেমন?
-শান্ত কণ্ঠস্বরে রনিন বলে, যে মেয়েটি আজকে বিকৃত বাংলায় কথা বলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সেই মেয়েটি একদিন মা হবে। তাহলে, তার যে সন্তান হবে, তাদের জন্য তার মায়ের বলা বিকৃত ভাষাটাই মাতৃভাষা। যেটা তোমাদের মতে প্রমিত বাংলা ভাষা না। তাহলে, তার সেই সন্তানেরা তাদের মাতৃভাষার জন্য কি প্রাণ বিসর্জন দিয়ে দেবে? যারা তাদের সেই ভাষার সমালোচনা করবে তারা কি তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াবে?

চুপ করে থাকে শেহরীন। চলন্ত গাড়ীর কাচ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে, শহরের এক প্রাচীরের গায়ে, ছোট্ট নির্জলা এক জায়গায় ফুটে আছে শরতের কাশফুল। না রনিন ঠিক বলেনি, ঢাকা শহরের মাঝেও কাশফুল আছে।

অন্যান্য পর্বসমূহের লিঙ্কঃ
দ্বিধালাপঃ প্রেম পর্ব

মইনুল রাজু (ওয়েবসাইট)
[email protected]