শাহাদুজ্জামানের বই পড়া মানেই অন্যরকম একটা অনুভূতি, ভালোলাগাটার মধ্যেও এক ধরণের বিষণ্ণতা কাজ করে ভেতরে ভেতরে। সে যেন এক বিকারহীন রচয়িতা, অবাস্তব দ্বারা বাস্তবের কঠোর নির্মাতা। নির্বিকারভাবে বলে যান আমাদের ভেতরের কথাগুলো- আর পরতে পরতে উন্মোচিত করেন এমন এক ধরণের সত্য, যার সাথে আমরা যেন পরিচিত হয়েও পরিচিত না; ধরা দিয়েও অধরা থেকে যায় দীর্ঘশ্বাসের মতো। হুট করে চিরপরিচিত এক দৃশ্য হাজির করে নিয়ে আসেন, যা আমাদের পরিচিত, আমরাই অতিবাহিত হচ্ছি তার ভেতর দিয়ে- কিন্তু প্রখর জীবনদৃষ্টির আঁচড়ে অন্য কিছু উপস্থাপন করেন নির্মমভাবে। এই “অন্য কিছু” কী- তা ব্যাখ্যা করা দুরূহ নয়, কিন্তু তাঁর এই ব্যাখ্যা করার ধরণে এক ধরণের স্বাতন্ত্র্যবোধ কাজ করে- এবং সেটাই যে কেউ পারবে না। অনেকটা রবীন্দ্র যুগের রবির কবিতার মতো। হয়তো অনিবার্য অনুকরণ, আর অসম্ভব অনুকরণ। তিনি যা উপস্থাপন করেন সাবলীল গদ্যশৈলীতে- তা আমরা দেখতে চাই, কিন্তু মানতে চাই না- দেখতে গিয়েও দেখতে পারি না, কারণ আমাদের চোখ থেকে যায় জানালার কাঁচে, বাগানে নয়। অনেকটা তাঁর বইয়ের নামের মতো, “কেশের আড়ে পাহাড়”। কিন্তু সেই পাহাড়কেই তিনি আমাদের সামনে উপস্থাপন করেন তাঁর প্রখর জীবনদৃষ্টির মাধ্যমে। সেই বৃত্তের বন্দী তো আমরাও, শাহাদুজ্জামান নিজেও সে জন্যে সমব্যথী। কিন্তু গল্প বলার সময় তিনি সেই দুঃখের সাথে মেশেন না, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চালিয়ে দেন তার কলম।

“কেশের আড়ে পাহাড়” তাঁর তৃতীয় গল্পগ্রন্থ। এর আগে তাঁর দুটি গল্পগ্রন্থ “কয়েকটি বিহ্বল গল্প” আর “পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ” তাকে একজন সফল ছোটগল্পকার হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর ছোটগল্প “অগল্প” পড়ে বিশিষ্ট লেখক সৈয়দ শামসুল হক তাকে মুমূর্ষু বাংলা ছোটগল্পকে উদ্ধারের কাজে সহযাত্রী হবার আহ্বান করেছিলেন এবং নিশ্চিতভাবেই আমরা বলতে পারি, সৈয়দ হক সঠিক মানুষকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। আশির দশক এবং তাঁর পরবর্তী সময়ে যে-কজন ছোটগল্পকার সমৃদ্ধ করেছেন আমাদের সাহিত্যভাণ্ডারকে, শাহাদুজ্জামান তাঁদের মধ্যে একজন নিঃসন্দেহে। লৌকিক মিথের সাথে আধুনিক জীবনবোধের মিশেল তাঁর গল্পকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। কখনো একসুরে বেঁধেছেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে, আবার কখনো লৌকিক গল্পের ঢঙে বর্ণনা করেছেন রুপকধর্মী গল্প। বিষয় ও আঙ্গিকেও তিনি অনবদ্য এবং তাঁর বর্ণনারীতিরও অভিনব। একটা গল্পকে তিনি শুধু একদিকেই ধাবিত করেন না, তাঁর আশেপাশের সময়ের বিভিন্ন খণ্ড খণ্ড অপ্রাসঙ্গিক বয়ানকে তিনি তুলে নেন এবং গড়ে তুলেন ছোট ছোট চিত্রকল্প। সমকালীন জীবনবোধের উপস্থিতি, হতাশা, ব্যর্থতা, উল্লাস প্রভৃতি মানবিক বোধগুলো তাঁর গল্পে প্রবলভাবে ফুটে ওঠে। মাঝে মাঝে নৈরাশ্যবাদ তাঁর লেখায় প্রবল হয়ে উঠলেও নির্দিষ্ট কোন দর্শন বা মতবাদে তিনি আস্থা রাখেন না; আস্থা রাখেন মানবিকতায়, মানুষের কল্যাণে। পক্ষপাত তাঁর সেই মানুষের প্রতি- যে মানুষ কখনো একাকী, কখনো বিচ্ছিন্ন, কখনো সভ্যতার প্রবল চাপে নিষ্পেষিত। যেন খুঁজে বেড়ান একান্ত নিজস্ব জীবনবোধ। কখনো ঘিরে ধরে সমসাময়িক সমাজের প্রতি হতাশা, শুন্যতায় তিনি বিহ্বল হয়ে ওঠেন- যার জন্যে প্রথম গল্প “মহাশূন্যে সাইকেল” গল্পটা শুরু হয়েছে অনেকটা এভাবেঃ

“গল্প থেকে যাবতীয় রহস্য দূর করে দেবার জন্যে আরও কিছু তথ্য প্রথমেই দেয়া যেতে পারে। যেমন আমি একটি ওষুধ কোম্পানির ম্যানেজার এবং আমি নিয়মিত ডায়রি লিখি। আমার স্ত্রী একটা ব্যাঙ্কে চাকরি করে এবং সে একটা গোল অ্যাকুইরিয়ামে গোল্ড ফিশ পোষে। আমি তাকে জানিয়েছি যে পৃথিবীর বেশ কয়েকটা দেশে গোল অ্যাকুইরিয়ামে গোল্ডফিশ পোষা আইনত দণ্ডনীয়। গোল অ্যাকুইরিয়ামের ভেতর থেকে গোল্ড ফিশ পৃথিবীর একটা বিকৃত রূপ দেখে। প্রাণী স্বার্থরক্ষাকারীরা দাবী জানিয়েছেন যে গোল অ্যাকুইরিয়ামে গোল্ড ফিশকে এভাবে বিভ্রান্তিতে রাখা অপরাধ। আমি আমার স্ত্রীকে চতুষ্কোণ অ্যাকুইরিয়ামে গোল্ডফিশ রাখতে অনুরোধ করেছি। কিন্তু সে আমার কথা রাখে নি। রাতুল নামের আমার একটা দশ বছরের ছেলে আছে। সে যখন স্কুল থেকে ফেরে তখন আমি আর আমার স্ত্রী দুইজনেই অফিসে থাকি। স্কুল থেকে ফিরে ছেলে টেবিলে রাখা ডিম সেদ্ধ খায়। এ সময় প্রায়ই আমার ছেলের সঙ্গে একটা খেলা খেলি। আমি তাকে অফিস থেকে ফোন করে বলি-রেজাউল করিম সাহেব বাসায় আছেন?”

এই গল্পের রেজাউল করিম আর কেউ নন, আমাদের চারপাশের কেউ একজন হয়তো। এই “ওষুধ কোম্পানির রেজাউল”, তাকে কেন বেছে নেয়া হোল এই গল্পে? কারণ আমাদের চারপাশেই তাঁরা দৃশ্যমান, স্বাভাবিক জীবন যাপন করে যাচ্ছেন। যিনি কী না কখনো ওষুধ কোম্পানির চৌকস ম্যানেজার, একজন পিতা, স্বামী এবং আরও অনেক পরিচয়ে অভ্যস্ত। কিন্তু এই পরিচয়ের ভেতরে লেখক সন্তুষ্ট থাকতে চান না, খুলে দেখাতে চান কারো ভেতরটা। তাই রেজাউল করিমের সাথে সাথে কথা বলার জন্যে শাহাদুজ্জামান আশ্রয় নেন অভিনব পন্থার। একদিন ফোন করে দেখা গেল আশলেই অইপাশ থেকে ফোন ধরেছেন আরেকজন রেজাউল করিম। অবাস্তব মনে হলেও এটাই সত্য। ফোন করা রেজাউল করিম বিভ্রান্ত হয়ে যান বাসায় উপস্থিত রেজাউল করিমের অস্তিত্বে। কিন্তু গল্পকার এই আশ্রয় নেন সত্যের স্পর্শ নিতে। তারপর একে একে তিনি বলে যান আমাদের মতো কারোর জীবনের গভীর অবসাদের কথা, স্বপ্নের কথা, দূরত্বের কথা, ক্লেদের কথা। বিভ্রান্ত রেজাউল করিম তাঁর দ্বৈত সত্ত্বার সাথে কথা বলে – আর আমরা পাঠকেরা দেখতে পাই, তিনি যে তাঁর ক্ষুদ্র এই গণ্ডির বাইরে থেকে অনুভব করেন সবকিছু থেকে আস্তে আস্তে সৃষ্টি হচ্ছে দূরত্ব, নিঃসঙ্গতা- একজন ম্যানেজার, বাবা, স্বামী হয়েও অনুভব করেন তাঁর যাপিত জীবনের পীড়া। আর তখনই তিনি আশ্রয় নেন কল্পনার, তাই বাস্তবমুখী রেজাউল করিমও ডায়রীতে লিখেন সেই গ্রহের কথা- যেখানে মহাসমুদ্র আবিষ্কার করা হয়েছে। তিনি টেলিফোনে কথা বলে যান আরেক রেজাউল করিমের সাথে, যে কী না তাঁর থেকেও বাস্তব আর বর্ণনা করে যান আন্তর বাক্যালাপ। একসময় গল্পকারের কলম দিয়ে রেজাউল করিম বলে ওঠেন, রক্ত মাংশে মানুষের প্রতি তাঁর অবিশ্বাস আর হতাশার কথা। এরা আসলেই রক্তমাংসের, কশাইয়ের সামনে যেমন থাকে শীতল একখানা মাংসপিণ্ড। গল্পের সারমর্ম বিধৃত করা যায় গল্পে লিখিত রামকৃষ্ণ পরমহংসের সেই বাণীর মতো, “সংসারে থাকবি ভ্রষ্টা নারীর মতো।” যে ভ্রষ্টা নারী পরপুরুষে আকৃষ্ট, কিন্তু ধরা পড়ার ভয়েই নিখুঁত থাকতে চায় সংসারে। তখনই লেখকের গল্পের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে ওঠে। আমরাও কি তাই না? খ্যাতি যশ প্রতিপত্তির পেছনে ছুটছি কেন? আমরাও ধরা পড়ে যাবো এর অন্তঃসারশুন্যতা দেখে? ক্রমাগত ফাঁকি দিয়ে চলছি নিজেদেরই? রেজাউল করিমের জীবনে তো দুঃখ থাকার কথা না, কিন্তু তাহলে কেন সে কল্পনায় পাখা বিস্তার করে? কারণ চলমান সমাজের এই প্রতিযোগিতা, ক্লেদ, অস্তিত্বে তিনি গোপনে গোপনে ধারণ করেন ভয়াবহভাবে অবিশ্বাস। মানুষ আছে, তবে হৃদয় নেই- এই কথাটাই সত্য হয়ে যায়। আমরা ছুটছি, কারণ আমরা আমাদের ভেতরে তাকাই না। ভেতরে তাকালে আমরা শূন্য, আমরা ক্লান্ত। বাইরের সবকিছু মিছে, সত্য শুধু আমাদের হৃদয়, যে হৃদয় দূর গ্রহের কোন সৈকতে সাইকেল চালাতে চায়। সে ক্লান্ত, তাই আশ্রয় নিতে চায় অলীক বাস্তবে। আমাদের তখন মনে পড়ে যায় জীবনানন্দ দাশের সেই কবিতাঃ

“মানুষ-মানুষীর অবিরাম সংকল্প ও আয়োজনের অজস্র আলেয়ার মতো
তারাও চলেছে ।
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই এসে বহন করুক : আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ।“

আমরা আসলে ভেতরে ভেতরে গভীরভাবে অচল, যেখানে বাহ্যিক উত্তেজনা আমাদের স্পর্শ করে না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর “বাংলা ছোটগল্প কি মরে যাচ্ছে” প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ছোটগল্প তাঁর জন্মলগ্ন থেকেই বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তির রোগ ও ক্ষয়কে নির্ণয় করে আসছে। এই ক্ষয় যেমন একরোখা নয়, তেমনি তাকে একটিমাত্র সমস্যা দিয়ে চিহ্নিত করাও বেশ অসম্ভব। এক্ষেত্রে শাহাদুজ্জামান যেন অর্জুনের পাখির মাথাটি খুঁজে পেয়েছেন, যেটা কী না অনায়াসে লক্ষ্যবস্তু হিশেবে ধরে নেয়া যায়। সমাজবাস্তবতায় মানুষের নিঃসঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতাবোধ এখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সেখানে বধু শুয়ে থাকে পাশে, তবুও আমরা জ্যোৎস্নায় ভূত দেখতে পাই- বিচ্ছিন্নতাবোধের ব্যধি আমাদের আক্রান্ত করে। এই জীবনদৃষ্টির কথাই বলছিলাম শাহাদুজ্জামানের গল্পে, যেটা বাস্তবের চেয়েও বড় বাস্তব, সত্যের চেয়েও বড় সত্য। আর একজন লেখকের পবিত্র দায়িত্ব সেই সত্য বের করে নিয়ে আসা। সেক্ষেত্রে তিনি কট্টোর রসকষহীন দার্শনিক নন, যদিও জীবনদর্শনে দার্শনিকের থেকে কোন অংশে কমও নন একজন লেখক। তাই আমরা আক্রান্ত হই, ভাবিত হই- তাহলে আমাদের এই জীবনের উদ্দেশ্য কী?

আমাকে কেউ যদি এই প্রশ্নটা করে, তাহলে আমি স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দিতাম- আমি জীবনের কোন উদ্দেশ্য দ্বারা তাড়িত হই না। তাই এই লেখাটা লেখার সময়েও বারান্দায় সিগারেট খেতে খেতে ভাবছিলাম, এই বৃষ্টির মধ্যে যদি আমি আটতলা ছাদ থেকে লাফ দেই, কী হবে তাতে? কিছুই না। এই “কিছুই না” বোধে তাড়িত হয়ে একবার মুঠো মুঠো ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলাম। তবে শাহাদুজ্জামান সম্ভবত সেই বিশ্বাসে তাড়িত নন, তাই আমার কথা বাদ থাক। হয়তো সত্যিকারেই আমরা জীবনের কোন উদ্দেশ্যবোধ দ্বারা তাড়িত হই না, তবুও যেন মিছে মিছে খেলা। তবে শাহাদুজ্জামান সম্ভবত সেই বিশ্বাসে তাড়িত নন প্রবলভাবে, অর্থাৎ তথাকথিত অর্থে তাকে নৈরাশ্যবাদীর তকমা দেয়া যায় না। যারা শাহাদুজ্জামান পড়েছেন, তাঁরা মাত্রই লক্ষ্য করেছেন বিশ্বব্যাপী সাম্যবাদী আন্দোলনের ব্যর্থতা নিয়ে খানিকটা হতাশা, খানিকটা আক্ষেপ তাঁর ভেতরে ভেতরে কাজ করে যায়। তাঁর একসময় আস্থা ছিল হয়তো সাম্যবাদী দর্শনে। সেই স্বপ্নভঙ্গের আমেজ ঘুরে বেড়ায় তাঁর কলমের ডগায়, সবসময় তাই “বন্ধুর নোটবুক” গল্পে তিনি বলে ওঠেনঃ

প্রায় সারারাত ধরে ওয়াজ শুনলাম। এই ওয়াজটার চমৎকার একটা ডিসকোর্স এনালাইসিস হতে পারে। এর ফাঁকফোকরগুলো চিহ্নিত করা যেতে পারে। তবে ওয়াজের ওরেটরশিপের প্রশংসা করতে হয়। বিপ্লবীদের এখান থেকে শিখবার আছে। এ অঞ্চলের মার্ক্সবাদীরা ধর্মের সাথে তাদের মোকাবিলার ঠিক পথটাই খুঁজে পেল না

আমি জানি, যাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে, মানবতার বিপর্যয়ে যারা হতাশ, পৃথিবীর অলীক দুর্বার গতিতে ব্যর্থতার ক্লান্তি ভর করেছে শরীরে, মনে- তাঁরাও তাদের আক্ষেপটা এভাবেই প্রকাশ করবেন। এই গল্পটার রফিক চরিত্রটা আমরা পেয়েছিলাম তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ “পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ”র “কাগজের এরোপ্লেন” গল্পটাতে। সেই গল্পে জীবনানন্দের “আট বছর আগের এক দিন” কবিতার ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এবারের গল্পে (কিংবা জর্নালে) তিনি আর আত্মহত্যাপ্রবণ নন, বরং তাঁর হতাশার বিভিন্ন কারণ তুলে ধরার প্রয়াস নিয়েছেন লেখক। হতাশা তাকে ক্লান্ত করেছে, তাই তিনি কিছুটা কল্পনার আশ্রয় নেন। সেই কল্পনাতেও ফিরে ফিরে আসে আঁধারের বিভীষিকা। তবুও কমলালেবুর মাঝেই খুঁজে পেতে চান জীবনানন্দ দাশকে-

একবার যখন দেহ থেকে বা’র হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসবো না আমি পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোন এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোন এক পরিচিত মুমূর্ষের বিছানার কিনারে।

কেন ফিরে আসতে চান তিনি? কারণটা হয়তো তাঁর পৃথিবীর প্রতি অপার ভালোবাসার জন্যেই। জীবনানন্দ বারবার ফিরে আসতে চেয়েছেন এই বাঙলায়, আবার দ্বিধাচ্ছন্ন থেকেছেন, বলেছেন, যা পেয়েছি তাঁর জুড়ি নেই- কিন্তু না আসলেও কী হতো! এখানে শাহাদুজ্জামান কবি নন, আশা করেন একটা সুন্দর পৃথিবীর। অবশ্য কবির চরিত্রের সাথে সুন্দর পৃথিবীর কোন বিরোধ নেই। তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে, “একটা সুস্থির সমুজ্জল পৃথিবী তাহলে ছিল না কোথাও, হবে না কখনো?” এই আকুলতা তো মানুষের জন্যে- যে মানুষ একজন রেজাউল করিম, আবার রেজাউল করিমও মানব জাতির অংশ। ব্যক্তির আশা হতাশা থেকে তিনি তখন গভীর দ্বন্দ্বে পড়ে যান জাতিগতভাবে মানুষের দুঃখ- কষ্ট নিয়ে। সেই প্রবণতাটা প্রকট হয়ে ওঠে “বুকশেলফে বাঘ” এ। এই গল্পটিতে প্রথমে তিনি দেখালেন প্রেয়সীকে হারানোর ব্যর্থতা, তারপর সেখান থেকে চলে গেলেন পৃথিবীর অশান্ত অবস্থায়। নিজের দুঃখকে ঢাকবার জন্যে পিঁপড়ার সাথে হাতির গল্পটির তুলনা দিলেন, যেন নিজের ব্যর্থতা নিয়ে বয়ানে সন্তুষ্ট নন এই যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীতে। তবে এই লেখাটিকে শুধুমাত্র একটা গল্প বলে বিচার করলে হয়তো মূল্যায়নটা সঠিক হবে না। কিছুটা গল্প, কিছুটা প্রবন্ধের রেশ রয়ে গিয়েছে মিশ্রভাবে। সচেতনভাবেই ভেঙে ফেলতে চেয়েছেন ছোটগল্পের সীমানাকে। কখনো লোকজ কাহিনী ধরে, কখনো আত্মকথা ধরে এগিয়ে গিয়েছেন আস্তে আস্তে আস্তে, তবে সেখানে আঙ্গিকটা ছোটগল্পেরই।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ থেকে অবলীলায় সভ্যতার ইতিহাসপাঠে নিয়ে আসেন ভুষণ্ডির কাককে, যে সত্যযুগের শম্ভু নিশম্ভুর যুদ্ধ দেখেছে, রাম রাবণের প্রলয়লীলা দেখেছে, আবার অর্জুনের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সাক্ষীও সে। মানুষের ইতিহাস স্থাপিত হয়েছে যুদ্ধ দ্বারা, কিন্তু যুদ্ধই কী সমাধান? না। অবশ্যই না। লেখক তা মানেন না, তাই “বুকশেলফে বাঘ”- এ ব্যঙ্গ করে বলে ওঠেন,

“ ভুষণ্ডির কাকের নিশ্চয়ই এখন খুব ব্যস্ত সময়। ও কোন জায়গা ছেড়ে কোন জায়গায় যাবে হয়তো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। রক্তের জন্যে তাকে শুধু ইরাক বা আফগানিস্থানে বসে না থাকলেও চলবে। চাইলে সে একফাকে সোমালিয়া উড়ে আসতে পারে, আসতে পারে বাংলাদেশেও।“

এক দিকে সভ্যতার পালাবদলে “এনলাইটেনমেন্ট” পরবর্তী সময় যেমন আধুনিক জ্ঞানে- বিজ্ঞানে মানুষের অসাধারণ উন্নতি হয়েছে- ঠিক তেমনি সভ্যতার ঘাড়ে প্রতিমুহূর্তে পড়ছে যুদ্ধের নিশ্বাস। দুই দুইটা বিশ্বযুদ্ধের ভয়াল স্মৃতি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে পৃথিবীবাসী, পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতায় প্রত্যেক মুহূর্তে আতঙ্ক যেন এই সময়ের মানুষের সঙ্গী। দার্শনিক নোয়াম চমস্কি তাঁর “নতুন জ্যোতির্ময়কাল”- এ বলেছিলেন,

“সমস্যা হলো এই আত্মপ্রসাদের কোরাসে সমস্বরে গাইতে গেলে অনেক অবাধ্য ও দুর্বিনীত তথ্যকে না দেখার ভান করতে হয়। সে সবের মধ্যে সবচেয়ে প্রথম এবং লক্ষণীয় তথ্য হলো যে বর্তমান সুপারপাওয়ার এবং তার মিত্রদেশগুলোর সুনির্দিষ্ট সমর্থনে সন্ত্রাস ও অপরাধমূলক নৃশংস কর্মকাণ্ডের তালিকা।…… আরেকটু পেছন দিকে তাকিয়ে আমরা দেখতে পাই লুকিয়ে চাপিয়ে রাখার মধ্যে বিগত সহস্রাব্দে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর প্রধান কর্মকাণ্ড যুদ্ধবিগ্রহের তথ্যও আমাদের ভুলে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে “কই তেমন কোনও ভয়ংকর কিছু তো হয় নাই”।

ভয়ংকর কিছু হয়েছে, সেটা গল্পকার জানেন- যেমন জানে আফগানিস্তান কিংবা সোমালিয়ার মানুষেরা। কিংবা জানত ওজালের অধিবাসী ওজি- যিনি বিচলিত হয়ে চলে গিয়েছিলেন পাহাড়ের চূড়ায়। এখনো পৃথিবীতে ফিরে আসলে তিনি আবারও বিচলিত হতে পারেন, কারণ এখনো জনগণের উপর শক্তি প্রয়োগ করে শোষণ করছে শক্তিমানেরা, যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিচ্ছে সাধারণ মানুষকে। আমরা আমাদের পুরাণেও দেখতে পাই, অর্জুন দিধাচ্ছন্ন ছিল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ নিয়ে, অর্জুন আর কৃষ্ণের মধ্যে উত্থাপিত বিতর্কে দ্রৌপদিরও ছিল কৃষ্ণের দিকে নৈতিক সমর্থন। কিন্তু আমাদের এখন নতুন করে ভাববার সময় হয়েছে, যুদ্ধ দিয়ে শান্তি সম্ভব নয়; তা শুধু অশান্তিই ডেকে নিয়ে আসতে পারে- এই ইঙ্গিত লেখকের কলমেও। আমাদের সবকিছুই মানুষের জন্যে, সেই মানুষকে হত্যার মুখে, যুদ্ধের মুখে, বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়ে কোন সমাধান হতে পারে না।

তবে একপেশে চিন্তাভাবনা কিংবা গোষ্ঠীবদ্ধ সহমর্মিতায়, অথবা গোলার্ধভিত্তিক চিন্তাভাবনা থেকে লেখক যে মুক্ত, এবং এই অস্থির সময়ে সব মানুষের জন্যেই তিনি সমব্যথী- তার প্রতিফলন দেখতে পাই “অন্ধ শাহজাহান” গল্পটিতে। বিষাদে ছেয়ে যায় মন, যখন তিনি কিছুটা হাহকার করে বলে ওঠেন,

“কিছুক্ষণ পর প্লেনের জানালায় কেবলই মেঘ।… প্লেনের জানালা দিয়ে মেঘ দেখতে দেখতে ভাবি এমন যদি করা যেত আমরা এই পৃথিবীর মানুষেরা একযোগে ছেড়ে দিলাম এই পৃথিবী, সবাই মিলে হাজির হলাম মহাকাশের নতুন একটা গ্রহে। সেই নতুন গ্রহে আমরা আমাদের সব ভুলগুলো শুধরে নিয়ে আবার নতুন করে শুরু করলাম জীবন?”

এক এগারোর পর পশ্চিমা সভ্যতায় সাধারণ মানুষের মধ্যে যে নিরাপত্তাহীনতা লক্ষ্য করা যায়, লেখক তাঁর নিজস্ব জগতচিন্তা থেকে তা উল্লেখ করেছেন এই রচনায়। তিনি আবার বর্ণনা করেন-

“এখন লেভিনসন আতংকে থাকে। ওর জীবনে অনিশ্চয়তা বলতে তেমন কিছুই ছিল না। যে মেট্রোতে করে সে প্রতিদিন অফিসে যায় সেটা একেবারে ঠিক সময়ে এসে হাজির হয় প্রতিদিন। লং ড্রাইভের জন্যে তার গ্যারেজে সবসময় প্রস্তুত থাকে দুটো গাড়ি। লেভিনসন জানে যত দুরারোগ্য ব্যধিই হোক পৃথিবীতে লভ্য শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা করবার সামর্থ্য তার আছে। দুটো মেয়ে আর সজ্জন স্ত্রী নিয়ে সুন্দর সংসার তার। কিন্তু সেপ্টেম্বর এগারোর পর থেকে তার চোখের নিচে ফুটে উঠেছে ঐ ভয়, অনিশ্চয়তা। ওটা তার চোখে আগে দেখি নি কখনো”।

বলা যেতে পারে এই চিন্তা- যা কী না বৈশ্বিক একটা সূতা দিয়ে বাঁধা, সময়ের গভীর উদ্বেগ বাধ্য করেছে এই লাইনগুলো লেখানোর জন্যে। গল্পকারও কিছুটা অনিশ্চয়তায়, কিছুটা চিন্তাগ্রস্ত- যার উপাদান মানুষের প্রতি ভালোবাসা। প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নেয় সে দৃষ্টি, তাই আনাস্তাসিয়া আর লেভিনসনের সাথে সাথেই মানবিক দৃষ্টিতে ধরা পড়ে আরিচার অন্ধ শাহজাহান, জোসনার মা, সন্তান আর নিজের স্ত্রী।
“তারপর যেতে যেতে”- গল্পটা পড়ে মনে হয় সেটা মনে চলছিল, হুট করে আমরা ঢুকে পড়ি গল্পের মাঝে। এই গল্পটাতে খুব সম্ভবত কাফকার ‘মেটামরফসিস” উপন্যাসিকার সাথে একটা যোগসূত্র আছে। যোগসূত্র বলতে আমি অনুকরণ বা অনুসরণ বোঝাচ্ছি না, শুধুমাত্র অনুষঙ্গের কথা বোঝাচ্ছি। কাফকার মেটামরফসিসের গ্রেগর সামসা যেমন রূপান্তরিত হয় কুৎসিত কীটে, তেমনি এখানেও সিকান্দর রূপান্তরিত হয়ে যায় বাঘে। অতঃপর সিকান্দর নিজের ভাগ্যকে বরণ করে মেয়ের জন্যে উৎসর্গ করেন নিজের জীবন, কারণ গল্পকারের বর্ণনায় বাঘের মাংসেই সিকান্দরের মেয়ের আরোগ্য লাভ হবে। গ্রেগর সামসা যেমন মেনে নিয়েছিল পরিবারের জন্যে নিজের অস্তিত্ব বিসর্জন, একঘেয়েমি আর পৌনঃপুনিকতাকে, যা শেষ পর্যন্ত পর্যবসিত হয় আত্মহত্যায়- সিকান্দরও নিজেকে সেভাবে ধাবিত করেন স্বেচ্ছামৃত্যুতে। এখানে ম্যাজিক রিয়ালিজমের ব্যাপারটা কী সবচেয়ে চমৎকারভাবে উপস্থাপিত হয়েছে? একই সাথে গল্পকারের স্ত্রী শায়লা, আরব বিপ্লব আর ফেইসবুক টুইটারের ভূমিকা? সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে লেখকের বর্ণনাতে। সমাজের সাথে ব্যক্তিমানুষের ট্র্যাজিক সংঘাত, ছাঁচে ফেলে ধ্বংসের মন্ত্রণা- সেই সবকিছুই এখানে পরম সত্য হয়ে ওঠে অসাধারণ কল্পনার দ্বারা।

“ঠাকুরের সঙ্গে” গল্পটাতে শাহাদুজ্জামান দেখিয়েছেন আমাদের দেশের হিন্দু ধর্মানুসারীদের নিগ্রহের কথা, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সাম্প্রদায়িকতা আর দেশবিভাগ নিয়ে আমাদের উত্তরপ্রজন্মের অবস্থান। উপরোক্ত প্রত্যেকটা ঘটনার সাথেই জড়িত রাজনীতির আর তার নিয়ামক যেন সাধারণ মানুষ। রাজনীতির থেকে মানুষের ভ্রাতৃত্ববোধ সবসময়ই বড়। দেশবিভাগ নির্মম সত্য, ধুতি আর পাঞ্জাবিও ছিল সত্য- কিন্তু তার থেকেও বড় সত্য মানবিকতা। কিন্তু সেখানে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার দ্বিখণ্ডিত করেছিল এই উপমহাদেশকে। পরবর্তী সময়ে ধর্মনিরপেক্ষতার যে আশা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, তাও ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের প্রজন্ম দেশবিভাগ তো দূরের কথা,মুক্তিযুদ্ধও দেখে নি। দেশবিভাগের বেদনা আমরা তাই অনুভব করতে পারি না। পিনাকীর পূর্বসূরিরা এই ভূমি ছেড়ে গিয়েছিল ধর্মের জন্যে, সে নিজেও নিগৃহীত ধর্মের জন্যেই- কিন্তু সেটা যতো না ছিল ধর্ম, তার থেকে বেশী রাজনীতি। শেকড়ের টানে পিনাকীর ধুতি পরা জ্যাঠা যখন মুখোমুখি হলেন তারই বাল্যবন্ধু সোহরাবের সাথে, যিনি কী না আপাদমস্তক হুজুর- তাঁদের সম্প্রীতি যেন দেশবিভাগের নৃশংস সত্যকে মিথ্যা করে দিল, তাঁরা মেতে উঠলেন ষাট বছর আগের বেজি ধরার কাহিনী নিয়ে। আবার পিনাকী আর উত্তমপুরুষে বয়ানকারী কাহিনীকারের সখ্যতাও মিথ্যা প্রমাণ করলো সমসাময়িক সাম্প্রদায়িকতাকে। বন্ধুত্বের কাছে পরাজিত হলো রাজনীতির ধর্মীয় চাল, যা কী না মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়েও ব্যবহার করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। দেশবিভাগ নিয়ে গল্প ঢের আছে, কিন্তু আমরা এই গল্পে মাধ্যমে সামনাসামনি হই অন্যরকম এক সত্যের এবং তা লেখকের অনবদ্য ভঙ্গির জন্যেই। গল্পের ভেতরেও যেন গল্প, তার ভেতরেও আবার গল্প। সমাজসচেতনতা লেখকের গল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিশেবে আমরা ধরে নিতে পারি।

তৃতীয় বিশ্বের একজন মানুষের পাশ্চাত্যের প্রতি শতবছরের লালিত আকর্ষণ, তার দিকে দৃষ্টিপাত করেছেন অনেকেই। উত্তর-উপনিবেশবাদের তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করা হচ্ছে, কীভাবে দশকের পর দশক ধরে পাশ্চাত্যের প্রতি উপনিবেশিত মানুষের আকর্ষণকে বাড়িয়ে তোলা হয়েছে, উননিবেশিতের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধকে হেয় প্রতিপন্ন করে পাশ্চাত্য নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়ে রেখেছে। সেই চাকচিক্যে ভুলে আমাদের পূর্বসূরিরা যেমন অন্ধ ছিলেন, তেমন আমাদের এ প্রজন্মও সেই পাশ্চাত্যমোহ থেকে বেড়িয়ে আসতে পারে নি। বিশ্বায়নের প্রভাবে দুই গোলার্ধের যোগাযোগটা বেড়ে গেলেও পূর্ব থেকে পশ্চিমে যাওয়া কখনোই সুখকর অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে না বেশিরভাগের জন্যে। সেখানে পদে পদে তৈরি করা আছে বাঁধাবিঘ্ন। সামান্য যক্ষ্মার জীবাণু সন্দেহে কীভাবে উত্তর-উপনিবেশিত একটা দেশে একজন মানুষকে হেনস্তা করা হয়, তারই চিত্র ফুটে উঠেছে “আমি ও মাইকোবেকটেরিয়াম টিউবারকুলি” গল্পটিতে। এ এক প্রবল মানসিক যন্ত্রণা, যার মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করতে হয় অনুন্নত বিশ্বের মানুষের, এবং কখনো স্বীয় দেশের মানুষের দ্বারা, কখনো বা ওইসব দেশের আতঙ্কে। তাই গল্পের বয়ানদাতা যখন প্রবেশ করেন ইংল্যান্ডের মানচিত্রে, গভীর সন্দেহে আর শঙ্কা জেগে ওঠে তার মনে,

“এত আয়োজনের যে এক্স রে সেটা তাঁরা একবার দেখতেও চাইলো না কেন ভেবে বিভ্রান্ত হয়ে রইলাম। তবে কি যক্ষ্মা সংক্রান্ত আমার সার্টিফিকেটটাই যথেষ্ট ছিল, এই এক্সরেটা ছিল বাহুল্য, আমাদের স্বদেশী ডাক্তারের অতি উৎসাহের ফল? নাকি ক্লান্ত এয়ারপোর্ট কর্মচারী ঝামেলা এড়াবার জন্যে এক্সরে ব্যাপারটা উপেক্ষা করলো? কিংবা হয়তো এই শহরে আরও কোথাও চোরাগোপ্তা যক্ষ্মা পরিক্ষা কেন্দ্র আছে, যার মুখোমুখি আমাকে হতে হবে অচিরেই”।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখকের স্মৃতিচারণমূলক বড়গল্প “মাজার, টেবিল টেনিস, আসলি মোরগ”। মুক্তিযুদ্ধ লেখকের মানসপটে কীভাবে ধরা দিয়েছিল শৈশবে, তারই একটা ফিকশনাল রুপান্তর হিশেবে আমরা উল্লেখ করতে পারি এই রচনাটিকে। নানা দিক থেকে এই গল্পটাকে উল্লেখযোগ্য বলা যায়। মক্কিপুরের মধ্যে দিয়ে তিনি যেন বর্ণনা করতে চেয়েছেন একাত্তরের সারা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট। গল্পকারের ভাষায়, “বড় দেশের ভেতরে একটুকরো ছোট দেশ। সেখানে বড় কালের ভেতরে অন্য একটুকরো ছোট কাল।“
পাকিস্তানের সাথে আমাদের পার্থক্যের একটা বড় কারণ যে ছিল ভাষা, তিনি তাঁর খেলার সাথী আফসানার মাধ্যমেই বুঝাতে চাইলেন। পেশোয়ারের অফিসারের কন্যা আফসানার সাথে বয়ানদাতার শ্রেণীগত সম্পর্ক থাকলেও তিনি তাঁর সাথে মিশতে পারতেন না খুব ভালোভাবে, যেন তারা ভাষার দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকতেন- বলেছেন কথক। গভীর অন্তরঙ্গতার সখ্যতা তাঁদের কখনোই হয়ে ওঠে নি। যতোখানি হয়ে উঠেছে, তাও “টিলো এক্সপ্রেস” খেলার মাধ্যমে। সেই খেলাও যেন কোন ঔপনিবেশিক খেলা- এই লাইনটার মাধ্যমে সুসম্পর্কটাও হয়ে ওঠে অন্য মাত্রায় তাৎপর্যপূর্ণ। অপরদিকে তাঁর খেলার সাথী, তাঁদের ড্রাইভারেরই ছেলে, যে কী না একই সাথে সহপাঠী- তাঁর সাথে শ্রেণীগত পার্থক্য থাকলেও শেষপর্যন্ত পাকিস্তানি আক্রমণের মুখে বাঙালিরা যখন বিপর্যস্ত- তখন লেখক আমাদের দেখাচ্ছেন বোরহান কিংবা উত্তমপুরুষে বয়ানকারী- দুজনের পায়েই ধুলো। লেখক প্রথমে স্কুলের বর্ণনার সময় বলেছিলেন- “আমি হাফপ্যান্ট আর জুতা মোজা পরে স্কুলে যাই আর বোরহান স্কুলে আসে লুঙ্গি পরে। বোরহানের পায়ে লেগে থাকে ধুলা।“ আর শেষে পালানোর সময় তাঁর মুখ দিয়েই উচ্চারিত হলো,

“ আমার পাশে বোরহান। বোরহানের পায়ে বরাবরের মতো ধুলা, আজ ধুলা আমার পায়েও। সবার পায়ে পায়ে ধুলা উড়ে ধোঁয়াসা হয়ে উঠেছে চারদিক।……… চারদিকে ধুলা তখন প্রবলতর হচ্ছে।“

মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল সর্বস্তরের মানুষকে এক কাতারে নিয়ে আসা, যে অভিনব পন্থায় তিনি তা বর্ণনা করলেন তা অনবদ্য, হিলটপ আর পাতালের নারীরাও শ্রেণী ভুলে শুয়ে গেলেন একসাথে। আর চারদিকে ধুলার প্রবলতা যেন বাঙালির সামনের অনিশ্চয়তারই বর্ণনা দিচ্ছে। ধুলার প্রেক্ষাপটে বল্লম হাতে পাহারা দিতে দিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কমিউনিস্ট জাহিদ যেন আরেকটা রুপক হয়ে ধরা দেয়। হিন্দুরা যে ছিলেন সবার আগে নির্যাতিত, তার প্রমাণও পাই মহকুমা বাজারে রাধানাথ চক্রবর্তীর ধুতি পরা লাশের খবর পেয়ে। আর আসলি মোরগ দিয়ে তিনি রূপকার্থে যে বুর্জোয়া রাজনীতির প্রতিনিধিত্বকারী রাজনীতিবিদদের বুঝিয়েছেন- তা হয়তো আমরা একেবারে শেষের পৃষ্ঠায় এসে বুঝতে পারি। যে মোরগ লড়াকু, হারিয়ে এসেছে অন্য মোরগকে এবং একটি অমিীমাংসিত মোরগযুদ্ধ তার জন্যে তখনো অপেক্ষা করছে- যেটাকে কী না লেখক উল্লেখ করেছেন “উঁচুতলা আর নিচুতলার সংগ্রাম বলে।“ সেই সংগ্রাম অমীমাংসিত থেকে যায় আকস্মিক বিপদে এবং আমরা জানি সেই সংগ্রামটার নাম কী! সেই মোরগ কিংবা তার পালক শ্রেণী তখন অন্য বাস্তবতার মুখোমুখি হন, পাকচক্রে তাকে শ্রেণীসংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয় না। ঘটনাক্রমে মোরগের পেছনের এক পা চৌকির সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়, সামনের পা দৃঢ় হলেও পেছনের পা শুন্যে ঝুলে আছে- বিভ্রান্ত হয়ে তাকিয়ে থাকে গল্পকার আর মোরগ- দুজন দুইজনের দিকে। দুজনেই বিভ্রান্ত, কারোরই জানা নেই কী করতে হবে।
এখানে লেখক সম্পূর্ণ কৃতিত্বটা দেয়ার চেষ্টা করেছেন গণমানুষকে, যদিও গল্পে সেই প্রতিরোধের সূচনার কথা সরাসরি নেই- কিন্তু স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। বুর্জোয়া রাজনীতির নেতারা কিংবা সমাজের উঁচুতলার শ্রেণীরা যখন হতবিহব্বল হয়ে পড়েছেন, আক্ষরিক অর্থে গণমানুষই মুক্তি এনেছে আমাদের। সমাজের উঁচু আর নিচু মানুষের যে মিলন হয়েছিল একাত্তরে, তা যেন শুধু যুদ্ধের প্রয়োজনেই। বোরহান কিংবা তার শ্রেণীর মানুষের মুক্তি যে ৭১ এর মধ্যে দিয়ে হয় না, তার সূক্ষ্ম ইঙ্গিতে দিয়ে দেন গল্পের মাঝখানেই। যখন বলেন-

“আমার পকেটে পাইলট কলম আর বোরহান লেখে পেন্সিলে। আমার ঝরনা কলমের কালি ফুরিয়ে যায় বারবার। আমি জোরে জোরে কলম ঝাড়ি। ছোপ ছোপ নীল রক্তের মতো সে কালি লেগে থাকে ক্লাসের মেঝেতে। কলম ফুটো হয়ে আমার সার্টের পকেটে চিত্রিত হয়ে যায় অজানা কোন এক দেশের মানচিত্র। কিন্তু বোরহানের পেন্সিলের শিস ফুরায় না। ওর জামা থাকে কলঙ্কহীন।“

এই রুপকল্প যেন শোষিত মানুষের শোষণের দিকেই ইঙ্গিতে করে। রক্ত ঝরার মধ্যে দিয়ে উচ্চ শ্রেণীর লোকেরা পায় নতুন দেশ; কিন্তু শোষিত শ্রেণীর দুঃখ ঘুচে না, পেন্সিলের শিসও ফুরায় না।
লোকজ বিশ্বাসের সবচেয়ে চমৎকার ব্যবহার তিনি এই গল্পটিতেই করেছেন। তাঁর ছোটগল্পের একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এই যে- সেখানে চমৎকারভাবে লোকজ বিশ্বাসগুলো উপস্থাপন করা হয়। মক্কিবাবার গুপ্তধন, দাদার কাছে শোনা চাঁদ আর সূর্যের কাহিনী, প্রজাপতির কাহিনী- সবই বাস্তবিকভাবেই ফুটে উঠেছে। ভাষায়ও লক্ষ্য করা যায় আশ্চর্য রকমের মিষ্টি সাবলীলতা। মাছের কাঁটার মতো ইট বিছানো রাস্তা, শব্দের বিশাল সমুদ্রে শিশিরের মতো মিশে যাওয়া কণ্ঠস্বর, গিরগিটির মতো পতাকার উত্তোলন, গামছার উপর নিরিবিলি মুরগির ডিম, আগ্নেগিরির মতো উঁচু খোঁপা, সমুদ্রের বাতিঘরের মতো পাহাড়ের প্রান্তের একাকী ক্লাবঘর ইত্যাদি উপমাগুলো গল্পজুড়ে সৃষ্টি করেছে আকর্ষণীয় আবেশ। মোটকথা, মুক্তিযুদ্ধের উপর সাহিত্যকর্ম হিশেবে এই লেখাটি বাংলা সাহিত্যে অনবদ্য হয়ে থাকবে।
প্রচলিত অর্থে গল্পে কোন গভীর থিম নেই, শুধু বলে যাওয়ার জন্যে গল্প বলা- এমন একটা গল্প হচ্ছে “ঘাসে ওপর সবুজ বাতাস”। কিছুটা গ্রামীণ জীবনের আবেশের বর্ণনা আর বয়ঃসন্ধিজনিত আবেগের নিয়ন্ত্রণহারা এক কিশোরের গল্প শোনাতে চেয়েছেন আমাদের। ঘুঘু পাখি নিয়ে লোকজ বিশ্বাস এখানেও এসেছে চমৎকারভাবে। ফরিদ নামের চোদ্দ পনেরো বছরের ছেলে, যার বিয়ে হয় কী না এগারো বছরের নাজমার সাথে। বিয়ের প্রথম রাতে মিলনে ব্যর্থ হলে ব্যাপারটা সবার কাছে জানাজানি হয়ে যায়। কৈশোরের অপরিণত আবেগ হয়তো তাকে ভাবতে দেয় নি অন্যকিছু, তাই অপমানিত হয়ে পরের দিন তার লাশ পাওয়া যায় দক্ষিণ বিলের ধারে কৃষ্ণচূড়া গাছে। এই সময়টা বড় অদ্ভুত সময়, আবেগের আতিশয্য নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা কতোটা মর্মান্তিক করে তুলে- তা দেখানো হয়েছে। উল্লেযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, লোকজ চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে বর্তমানে বিশ্বজুড়ে যে গবেষণা হচ্ছে, সে সম্পর্কে সচেতন হয়েই এই গল্পে লেখক হয়তো উল্লেখ করেন আয়ুর্বেদের কথা। এটাও মোটা অর্থে উপনিবেশিক আমলের চিকিৎসাব্যবস্থার আগ্রাসনের কারণে লৌকিক চিকিৎসাপদ্ধতির বিলুপ্তির সাথে সম্পর্কযুক্ত, কারণ এইসব চিকিৎসাব্যবস্থাও আলোচিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। ওষুধ হয়তো শুধু আর ওষুধ থাকে না, সেটা হয়ে যায় বাণিজ্যের উপকরণ। আর তাইতো এইসব চিকিৎসাব্যবস্থাকে বিনা প্রমাণে বাতিল করে দেয়া হয়েছিল। সব হয়তো গ্রহণীয় নয়, কিন্তু সব বর্জনীয়ও নয়। এই কথাটা আমাদের আচরিত জীবনপদ্ধতি আর সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রেও খাটে। উত্তর-উপনিবেশবাদে বলা হচ্ছে, প্রাক উপনিবেশিক আমলের মূল্যবোধকে নতুনভাবে উপস্থাপন করতে, কিন্তু সেটা যেন মৌলবাদের দিকে ধাবিত না হয়।

তাই আবার আমি ফিরে আসতে চাই সেই পশ্চিমের দেশ, যার উৎকর্ষে আমরা বিহব্বল, তা নিয়েও গল্পকার প্রকাশ করেন গভীরতম শঙ্কা। “বন্ধুর নোটবুক”- এ তিনি লিখলেনঃ

ঐ যে সব দেশ, খুব ঝলমল, পশ্চিমের দেশ, ওরা একটা ট্রেনে চেপে রওনা দিয়েছে, একটা বিশেষ ট্রেনে ওরা পৌঁছাতে চায়। আমরা কি ঐ ট্রেনটা মিস করে আপসোস করছি? স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসে আছি ঐ লাইনেরই পরের ট্রেন ধরব বলে? নাকি আমাদের অন্য একটা ট্রেন ধরা উচিত, পৌঁছানো উচিত অন্য কোন ষ্টেশনে?

ইঙ্গিতটা খুব স্পষ্ট, আমিও; বা আমার মতো অনেকেই এই ইঙ্গিতটা অনুভব করেন গভীরে, ভেতরে ভেতরে। আমার কেন জানি মনে পড়ে যায় নিটশের অমর কিছু উক্তি। নিটশে অনেক আগেই অনুভব করেছিলেন ইউরোপীয় সংস্কৃতির ভিতরের চাপে প্রবল গতি- যা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে মহাবিপর্যয়ের দিকে। এই সংস্কৃতিকে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন আত্মজিজ্ঞাসায় পরান্মুখ আর পুনর্বিচারে অপারগ বলে এবং এর কাছে আশ্রয় খোঁজা মানে ভণ্ডামি। সেইসব ধারণাকে তিনি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে ধাপ্পাবাজি হিশেবে অভিহিত করেছিলেন। দুই শতাব্দী জুড়ে শূন্যতার যে নিশ্চিত আধিপত্যের ঘোষণা দিয়েছিলেন, শাহাদুজ্জামানের উল্লিখিত বাক্যগুচ্ছে আমরা সেই ইঙ্গিতই বোধহয় পাই। কিন্তু যে নিটশে আস্থা হারিয়েছিলেন মানবতায়, আতংকিত হয়ে ধারণা করেছিলেন, মানবতার সবগুণ মানবসৃষ্ট- আর মানুষ মাত্রই ভুল করে, কাজেই মানবতাই ভ্রান্ত। উনিশ শতকে নিটশে যা বলেছিলেন, আর মিশেল ফুকো কিংবা আরও কেউ যেভাবে ভ্রান্ত মানবতার স্বরূপ তুলে ধরেছেন- তার উপযুক্ত জবাব আমরা পাই রবীন্দ্রনাথেই। তিনি বলেন- মানুষের ওপর আস্থা হারানো পাপ। মনুষ্যত্বের জয় হবে।
কিন্তু কীভাবে?
এই শঙ্কা নিয়েই শেষ হয় শাহাদুজ্জামানের শেষ গল্পগ্রন্থ। যেখানে আসে প্রবলভাবে ধাবমান সমাজের অন্তঃসারশুন্যতার কথা; বৈশ্বিক অস্থিরতার কথা এবং তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক হিশেবে তাঁর মূল্যায়ন; সাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা এবং আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনের ব্যর্থতা; উপনিবেশিত দেশ হিশেবে উপনিবেশিত মানুষের সমাজবাস্তবতা ও পশ্চিমমুখী প্রবণতা; এক স্বাপ্নিক হতাশ যুবকের স্বপ্নভঙ্গের ইতিকথা; মার্ক্সবাদ দিয়ে ব্যর্থতা আর আশাভঙ্গের কথা ইত্যাদি নানা দিক থেকে আমরা বিবেচনা করতে পারি, ভাবতে পারি, বিহব্বল হতে পারি। অশান্ত এই সময়কে যেন চিত্রিত করেছেন মানবিক ক্যানভাসে। তাঁর প্রথম দুটি গল্পগ্রন্থের বৈশিষ্ট্য অনুসারে এখানে একটা বড় পার্থক্য হচ্ছে- প্রথম দুটিতে গ্রামীণ জীবন, বা আরও পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে, লেখকের কর্মজীবনের প্রথম দিকের যে অভিজ্ঞতা, তাঁর প্রয়োগ আর বেশী দেখা যায় না। একেবারে আসে নি তা নয়, কিন্তু পেশাগত কারণে পশ্চিমে অবস্থানের কারণেই দৃষ্টি পড়েছে অন্যদিকে। হয়তো সচেতনভাবেই এ-প্রস্থান, এবং তাতে লাভ বৈ ক্ষতি হয় নি তাঁর সৃষ্টিকর্মের। বর্তমান গ্রন্থের উপজীব্য বিষয়ে আশা আছে, নিরাশা আছে, নানান দিক থেকে সংকট নিয়ে ভাবনা আছে, কিন্তু সেই সমাধানের পথ জানা নেই। যেন কেশের আড়ে ঢাকা পড়েছে পাহাড়। লালনের ভাষায়ঃ

চক্ষু অন্ধ দেলের ধোঁকায়
কেশের আড়ে পাহাড় লুকায়
কি রঙ্গ সাঁই দেখছে সদায়
বসে নিগুম ঠাঁই।

লেখক আড়ালের পাহাড়টাকেই আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন কলমের দ্বারা। সংকট উত্তরণের দায় লেখকের নয়, ছোটগল্পের দায় সেই সমস্যা চিহ্নিত করা। সেই দায়িত্ব যে তিনি নিষ্ঠার সাথে পালন করতে পেরেছেন- এতে সন্দেহ নেই।