লিখেছেনঃ জুলিয়ান বি. সরকার

একজন সেদিন বলছিলেন, বাংলাদেশে একমাত্র ভেজালমুক্ত খাবার (যদিও এটি খাদ্য নয়) আছে মাত্র একটি। জিজ্ঞেস করলাম কোনটি? উত্তরে বললেন, সিগারেট। কারণ ওটা এমনিতেই ভেজাল বা বিষযুক্ত। আরেকদিন আরেকজন বয়স্ক লোক বললো, বাংলাদেশের শিশুরা ভবিষ্যতে ‘সত্য’ বলে যে একটি শব্দ আছে/ছিলো তা ভুলে যাবে। কথাগুলো যে মোটেও অমূলক নয় তা বোধকরি সামান্য সচেতন মানুষও উপলব্ধি করতে পারবেন।

সত্যিই বাংলাদেশের এখন আর কোন খাদ্যই কেমিক্যাল/বিষমুক্ত নাই। বাংলাদেশে বর্তমান সর্বাধিক ভয়াবহ সমস্যা একটাই, তাহলো খাদ্যে ক্যামিক্যাল/বিষ প্রয়োগ! এ অবস্থা চলতে থাকলে বিকলাঙ্গ প্রজন্ম তৈরী হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। আমরা রাজনীতি বুঝি না, বুঝতে চাইও না। আমরা সুস্থ‎ভাবে বাঁচতে চাই। বিশেষ করে ভবিষ্যত প্রজন্মকেও বাঁচাতে চাই।

যাহোক, এই যে এতো সুস্বাদু ফল এতে কি একটি মাছিও বসতে দেখেছেন কখনো? কয়েক বছর পূর্বের কথা চিন্তা করুন, মাছের বাজারে দুর্গন্ধে ঢোকা যেতো না। মাছের বাজার ও ফলের বাজারে মাছি ভনভন করতো, জড়িয়ে ধরতো। কোথায় গেলো সেইসব মাছি? বিষাক্ত খাবারের ছড়া-ছড়িতে মাছি মরে সাফ, ভবিষ্যতে মাছি দেখতে জাদুঘরে বা চিড়িয়াখানায় যেতে হবে!

এবার বিভিন্ন পত্রিকার কাটিং থেকে কিছুটা দেখা যাক- কারবাইড, ফরমালিন, মিপসিন, মার্শাল, কারবোফুরান, ইথরিন ও ডাই-এলড্রিন-এর ঝাঁজে দেশি-বিদেশি আম, তরমুজ, আনারস, কাঁঠাল, পেঁপে, কলা, বাঙ্গি ও লিচু সময়ের আগেই লোভনীয় হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয় বিদেশি স্ট্রবেরী, আঙ্গুর, নাশপাতি ও আপেলের অবস্থাও প্রায় একই। গাছ থেকে এসব ফল নামিয়ে বাগানে রাখা অবস্থাই এক দফা ইথাইনিল, ইথরি ও কারবাইড সেপ্র করা হয়। ঢাকায় পৌছানোর পর আবারও মেশানো হয় একই রাসায়নিক। অতিমাত্রায় রাসায়নিক ব্যবহার করায় ফলগুলোর ঘ্রাণ ও স্বাদ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। পুষ্টির বদলে ফলগুলো পরিণত হয় বিষাক্ত খাদ্যে।

বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত লিচু খেয়ে দিনাজপুরে ১২ শিশুর মৃত্যু এছাড়া অনেক শিশু অসুস্থ হয়ে পড়েছে এবং ছবিটিতে দেখুন কিভাবে আমে বিষ দেয়া হচ্ছে।
poison
বিস্থারিত জানতে গত ২২/৬/১২ তারিখের সংবাদ পত্রিকাটি পড়ুন। লিংক
এছাড়া ১৯ ও ২১ জুন সমকাল পত্রিকা পড়ার জন্যও সকলকে অনুরোধ করছি- ফলের বাগানে কীটনাশক বিষক্রিয়ায় মরছে শিশু

ফরমালিন গ্রহণের ফলে শরীরে সৃষ্ট অন্যান্য বিরূপ প্রতিক্রিয়াগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ফুসফুসের সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি ও কার্যকারিতায় বিঘ্ন ঘটা, এজমা, লিভার সিরোসিস, ক্যানসার, কিডনির জটিলতা, বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম, মাথাব্যথা, চোখ জ্বালা-পোড়া ইত্যাদি। কেমিক্যাল মিশ্রিত ফল খেলে মানুষের দীর্ঘমেয়াদি নানা রকম রোগে বিশেষ করে বদহজম, পেটের পীড়া, পাতলা পায়খানা, জন্ডিস, গ্যাস্ট্রিক আলসার, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, লিভার ও কিডনি নষ্ট হওয়াসহ ক্যান্সারের মত জটিল রোগের সৃষ্টি হয়। এছাড়া মহিলারা এর প্রভাবে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দিতে পারে।

এছাড়াও বিভিন্ন ফলের জুসসহ শিশুখাদ্য, রং-বেরঙের নানা খাদ্য ও মিষ্টিতে খাবারের রঙের পরিবর্তে কাপড়ের রঙ এমন কি চামড়ার রঙও ব্যবহার করা হচ্ছে; যা আপনার শিশুর কিডনি, লিভারের মারাত্মক হুমকি স্বরুপ ও ক্যান্সারের কারণ। মাছ, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবারে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন। ভেজাল মুড়িতে সয়লাব বাজার। মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক ইউরিয়া ও হাইড্রোজ মেশানো মুড়ি দেদার বিক্রি হচ্ছে। এমনকি শুটকিও বাদ পড়ছে না এসব দস্যুদের হাত থেকে!

আপনার প্রিয় সন্তানের হাতে একটি ফল কিম্বা খাদ্য তুলে দেওয়ার অর্থই হচ্ছে তাজা বিষ তুলে দেওয়া। আপনি আপনার প্রিয় সন্তানকে তাজা বিষ খাওয়াতে পারেন কি? অতএব আসুন আজ থেকে আমরা সর্বপ্রকার বিষযুক্ত ফল ও খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকি এবং তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলি! সরকারকে জাতি ধ্বংসকারী এসব মহা-দুষ্কৃতিকারীদের ফাঁসির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে বাধ্য করি।

এ ব্যপারে সরকারের যে পদক্ষেপ তা মূলত অকার্যকর! কদাচিৎ ভ্রাম্যমান আদালতের দু-এক লক্ষ টাকা জরিমানা এবং কমন ফল নষ্ট করে ফেলায় তাদের তেমন কোন সমস্যা হয়না; ফলের দাম বাড়িয়ে প্রকারনে- উক্ত অর্থ জনগণের কাছ থেকেই আদায় করা হয়। তাছাড়া নিত্য যে চোর চুরি করে একদিন ধরা পড়েও ওই সামান্য অর্থের বিনিময়ে ছাড়া পাওয়াটা তার কাছে প্রেরণা বলেই গণ্য হয়। একটি ফলের বা মাছের আড়তে বছরে একবার-দুবার হানা দিয়ে কিছু টাকা জরিমানা করলে কী হবে, ওই আড়তদার তো প্রতিদিনই এরূপ কাজ করছে এবং জরিমানা দেয়ার পর তো আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে ফলের দাম, তার ফলাফলটা কী দাড়ালো, সব জারিমানা তো গিয়ে পড়লো জনগণের ঘাড়ে, তাই নয় কি? একদিন সম্ভবত এটিএন টেলিভিশনে এক আড়তদার বলছিলো, আনারসে কেমিক্যাল না দিলে একটি আনারস ২ দিনের বেশ রাখা যায় না, কেমিক্যাল দিলে রাখা যায় ১৫/২০ দিন। উল্টো ওই সাংবাদিককে আড়তদার প্রশ্ন করলো- এবার বলেন এতো লক্ষ লক্ষ টাকার ফল কি কেমিক্যাল না দিয়ে নষ্ট করে ফেলবো? আড়তদার আরো বলছিলো, এটা প্রশাসনের লোকের জানে তারা মাসে মাসে এসে মাসোহারা নিয়ে যায় তার কাছ থেকে। অতএব ফলে বিষ মেশানো বন্ধ হওয়া দূরের কথা বরং তা বিদ্যুৎ গতিতে বেড়েই চলেছে। সরকারের বর্তমান আইনের যতোটুকু প্রয়োগ করা উচিত ছিলো তাও ঘুষ ও দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের জন্য সঠিকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না। তাই এ আইনের পরিবর্তন প্রয়োজন, তবে কেবলমাত্র কঠোর আইন প্রণয়ন করলেই চলবে না তা প্রয়োগ করার জন্য যাদের নিয়োগ দেয়া হবে তারা যেন ঘুষখোর না হয় সেদিকেও সকলের বিশেষ করে সরকারের দৃষ্টি দেয়া একান্ত প্রয়োজন। কারণ এ সমস্যাটি শুধু ব্যক্তি বিশেষের নয়, সমগ্র জাতির।

আমার প্রশ্ন, একজন সন্ত্রাসী কতজন মানুষ মারে, কিংবা মারতে পারে? তাকে যদি ফাঁসি কিংবা তথাকথিত ক্রসফায়ারে মারা হয় তবে একজন খাদ্যে এবং ফলে বিষপ্রয়োগকারীর কেন ক্রসফায়ার কিংবা ফাঁসি হবে না? তাই শ্লোগান তুলুন- প্রজন্ম হত্যাকারী এসব বিষপ্রয়োগকারীদের কেন ফাঁসি হবে না? আমরা কতিপয় অতি সাধারণ লোক এই মর্মে একটি রীট পিটিশন দায়ের করার চিন্তা করছিলাম, কিন্ত সময় ও অর্থভাবে এবং অনেকের দ্বিমত পোষণের কারণে সেটিও করা যাচ্ছে না। যদি কারো পক্ষে সম্ভব হয় তবে এটি করতে পারেন।

বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকসহ সকল স্তরের ভাই-বোনদের প্রতি বিনীত অনুরোধ, আপনারা খাদ্যে বিষক্রিয়া বন্ধের ব্যাপারে সোচ্চার হোন, জাতিকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে মুক্তি দিন। সাধারণ জনগণের নিকট আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা তারা যেন নিজ নিজ এলাকায় পোস্টার/লিফলেটের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করেন। বিশেষ করে সবাই যেন কিছুদিনের জন্য সর্বপ্রকার ফল কেনা ও খাওয়া থেকে বিরত থাকে তাহালে হয়তো ব্যবসায়ীদের কিছুটা হলেও আক্কেল হবে। ফল বিক্রি না হলে তারা বাধ্য হবে পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে। কারণ এসব অতি মুনাফা লোভী, জাতি ধ্বংসকারীদের মোকাবেলা করার জন্য আমাদের হাতে কোনো অস্ত্র না থাকলেও এসব খাবার বর্জন করে তাদের শায়েস্থা করা কঠিন নয় বলে আমি মনে করি। দু-এক সপ্তাহ এমনকি দু-এক বছর এসব ফল না খেলেও বাঁচবেন, কিন্তু‎ খেলে তাৎক্ষণিক না মরলেও বংশানুক্রমিক রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হবেন এটা নিশ্চিত। আপনার প্রিয় সন্তান স্লো-পয়জনিং-এর শিকার হয়ে মরণব্যাধি ক্যান্সারসহ নানা মারাত্মক রোগে ভুগবে –এটি হতে দেয়া যায় না। অতএব নিজেদের অধিকার আদায়ে নিজেরাই সচেতন হোন এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখুন।

ফুটপাথের একজন ফল ব্যবসায়ীর বা এক-দুজন আড়তদারকে জরিমানা করে এটা বন্ধ করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। এর উৎস কোথায় সরকার কি জানে না? বিজ্ঞজনেরা বলেন- ক্ষমতা না থাকলে সে নাকি অন্যায় করতে পারে না যদিও বাক্যটি সম্পূর্ণ সত্য নয় তথাপিও একথা স্পষ্ট যে, ক্ষমতাশালীদের সংম্পৃক্ততা ছাড়া অন্তত বড় বড় অন্যায় সংঘটিত হতে পারে না। আমরা জানি যে, এসব ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট অত্যন্ত‎ শক্তিশালী এবং রাজনীতিতেও তারা হয়তো প্রভাবশালী, অতএব এদের প্রতিহত করা আইন দ্বারা সম্ভব হবে বলে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ বিশ্বাস করলেও আমি বিশ্বাস করি না। কারণ এ নিয়ে প্রচুর বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিকসহ সকল স্তরের জনগণ প্রচুর লেখালেখি করেছেন কিন্তু‎ ফল যা তাতে দেখছি, এসব দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম না কমে বরং বেড়েই চলেছে। হয় এদের প্রতিহত করুন নতুবা মরুন। আমরা যে আইন চাই তা প্রয়োগ করলেও এটি প্রতিহত করা সরকারের পক্ষেও সম্ভব হবে বলে বিশ্বাস হয় না কিন্তু‎ আমাদের হাতে একটি অস্ত্র আছে যা প্রয়োগ করে আমরা কিছুটা হলেও এদের থমকিয়ে দিতে পারি; দিতে পারি বিশাল এক ধাক্কা। অতএব আসুন আমাদের অস্ত্রটি প্রয়োগ করে দেখি। এব্যাপারে সকলে একজোট হয়ে কাজ করতে হবে। আসুন সবাই মিলে আর না হোক এক সপ্তাহ সম্ভব হলে বছরের পর বছর এসব ফল খাওয়া বর্জন করি; যে পর্যন্ত‎ ওরা ফলে বিষ দেয়া বন্ধ না করে। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার যেমন- ভাত-তরকারি-রুটি, মাছ-মাংস ইত্যাদি বিষযুক্ত হলেও খেতেই হবে কিন্তু‎ ফল না খেয়ে থাকা যাবে না কেন? নিজেদের বাড়ির ফল বা স্থানীয় ফলগুলো খেতে পারেন। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।