প্রায় শুনি, উচ্চশিক্ষার মান আরও ভালো করতে হবে। মেধাবীদের এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু যে শিশুটি সঠিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গেই সম্পৃক্ত হতে পারেনি, তার পক্ষে উচ্চশিক্ষায় সৃজনশীল কিছু করা কীভাবে সম্ভব। যে শিশু স্কুলে গিয়ে ভর্তি হওয়ার আগেই পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার মুখোমুখি হয়, তার বাকি জীবনের মনস্তাত্ত্বিক গঠন কেমন দাঁড়াবে? প্রতিবছর পাঠ্যসূচি পরিবর্তন, ভুল ইতিহাস পড়ানো, ভুল শিক্ষা কার্যক্রমে এই শিশুগুলো বড় হয়ে ভবিষ্যতে নিজের জন্যই বা কী করবে, সমাজকেই বা কী দেবে? এভাবে একদিকে শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে পাসের হার বাড়িয়ে বলা হচ্ছে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ দিয়ে নকল প্রতিরোধে সাফল্যের কথা রাজনৈতিক দলগুলো বলে থাকে। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠানে পুলিশ দিয়ে নকল প্রতিরোধ করতে হয়, সেখানে আদৌ শিক্ষার প্রয়োজন আছে কি না, তা ভেবে দেখার বিষয়। শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো আর পরীক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তন নকলকে এমনিই বন্ধ করে দিতে পারে।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিজ্ঞান আলোচনা করতে গিয়ে প্রশ্নপ্রতি প্রশ্নোত্তরের মধ্য দিয়ে নানা রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে বাস করেও সেই সুদূর সন্দ্বীপের মানুষও সমুদ্র ও মেঘনার ভাঙনের মধ্যে থেকেও এই বক্তৃতা শুনেছেন টিকিট কিনে। যদিও অনেকে বলেন মানুষের প্রয়োজনীয় বিষয় বক্তৃতা দেওয়ার কথা। আর এসব দূরবর্তী অঞ্চলে মানুষের সমস্যার তো শেষ নেই। কিন্তু প্রয়োজন তো অনুধাবন বা উপলব্ধির ওপরও নির্ভরশীল।
১৯০৫ সালে এই তত্ত্ব আবিষ্কৃত হলেও ভাবতে অবাক লাগে, আমাদের চিন্তা-চেতনা ও সংস্কৃতির মধ্যে এই তত্ত্বের নীতিমালা ও ফলাফলগুলো শতবর্ষেও অন্তর্ভুক্ত হয়নি। আসলে আমাদের সমাজে বিজ্ঞানের প্রসার ঘটেছে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে অত্যন্ত বিকৃতভাবে। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানকে আমরা গুলিয়ে ফেলছি। কোনোটির ঠিক উপস্থাপন হচ্ছে না। বিজ্ঞানকে আমরা যতটুকু জেনেছি, তা অনেকটা মজার ব্যাপার এবং ম্যাজিকের মতো করে। কোনো একটি বিষয়ে শুনলে তা যত অদ্ভুতই লাগুক না কেন, কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি না, বিস্ময়বোধের ছিটেফোঁটাও প্রকাশ করি না বা সে ক্ষমতা আমাদের গড়ে ওঠেনি। কোনো রকম যুক্তিতর্ক এবং চিন্তাভাবনা ছাড়াই আমরা বলি বিজ্ঞানের পক্ষে সবই সম্ভব। ব্ল্যাকহোল, ওয়ার্মহোল অথবা চমকপ্রদ শব্দ মুখস্থ করাটাই বিজ্ঞানচর্চা বলে গণ্য করি। ব্ল্যাকহোলকে বুঝে ফেলি আপেক্ষিকতত্ত্ব সম্বন্ধে কোনো কিছু না জেনেই, একইভাবে কসমোলজি বা মহাবিশ্বতত্ত্ব জানতে চাই। এসব ঘটনার পেছনে অনেক কারণই কাজ করছে, যেমন—শিক্ষার অস্বাভাবিক বাণিজ্যিকীকরণ ও নম্বর পাওয়ার মর্মান্তিক চেষ্টা তো আছেই।
এ ছাড়া আছে পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে তুলকালাম করে একজন শিক্ষার্থীর মনোজগতে সমস্যা সৃষ্টি আর বাংলায় পদার্থবিজ্ঞানসহ অন্যান্য বিজ্ঞানের মূল নিয়মগুলো ব্যাখ্যা করার মতো ভালো বইয়ের অভাব। তত্ত্বগুলোর দুর্বোধ্যতার কথা বলে সাধারণের কাছ থেকে সব সময় দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। এর ফলে এমন একটি সমাজ তৈরি হচ্ছে যে সমাজের মানুষেরা বিজ্ঞানের অগ্রগতির উপজাত তার প্রাযুক্তিক সাফল্যকে ভোগ করছে বটে, কিন্তু যে বিজ্ঞানের কারণে এই সাফল্য, সে সম্পর্কে কিছুই জানছে না। ক্রমাগত মানুষের জ্ঞানগত অবস্থান পিছিয়ে পড়ছে এবং সংস্কৃতিতে বিজ্ঞানবোধের অভাব আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ করে তুলেছে। এ কারণেই প্রাযুক্তিক সাফল্যকেও ব্যবহার করছি বিপথগামী করে।
একটি বিজ্ঞানভিত্তিক সভ্যতার পরিবর্তে আমরা এমন এক দানবীয় সভ্যতা গড়ে তুলছি যে সভ্যতা চাহিদা ও জোগান বোঝে, বোঝে চিন্তাভাবনা ছাড়াই যেকোনো মূল্যে এক টুকরো জমি দখল করাই জীবনের সার্থকতা। কিন্তু সেই জমি কত ঠুনকো, তা আমরা ১৯৯৮ সালের বন্যার অভিজ্ঞতা থেকে কিছুটা হলেও বুঝতে পারি। সেই পর্যবেক্ষণ আমাদের দেখিয়েছিল: ডাঙার মুক্ত হাওয়া থেকে মানুষের ঘরে বন্দী হওয়া, তারপর ক্রমাগত ঘরের মেঝে থেকে খাটে, মাচা বাঁধতে চালে মাথা ঠেকে যাওয়া এবং শেষে গাছে—এ যেন বিবর্তনের উল্টো প্রক্রিয়ার এক নাটক শুরু হয়েছিল। মানুষের ৩৮ লাখ বছর সময় লেগে গিয়েছিল এই গাছ থেকে মাটিতে নেমে ঘর বানিয়ে আজকের পর্যায়ে আসতে, অথচ বন্যার পানি যেন আমাদের সেখানে ফিরে যেতে দুই মাসেই বাধ্য করেছিল।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, এখন গাছও নেই, নেই বিস্তৃত বনভূমিও। যুগ যুগ ধরে নদীর গভীরতা পলি পড়ে কমে যাওয়া, পরিকল্পনাহীন শহর তৈরি, পরিবেশকে ধ্বংস এবং বিজ্ঞানের অবদানগুলোর চরম অপব্যবহারের পাপ মানবসভ্যতাকে ঘিরে ফেলেছে। এটা একধরনের পাপের প্লাবনে ডুবে যাওয়ার ইঙ্গিত। এই ঘটনাগুলো যেন অনেকটাই অনুধাবন করাচ্ছে কেন সাংস্কৃতিক বিবর্তন জৈবিক বিবর্তনের তুলনায় বেগবান হওয়া প্রয়োজন। ধার করা প্রাযুক্তিক উৎকর্ষ দিয়ে বিজ্ঞানবোধহীন মানুষের প্রবৃত্তিগত লোভ জাগিয়ে তোলা এবং জানালার মধ্য দিয়ে বাইরের আকাশ দেখার স্বপ্নপূরণের প্রবণতা তৈরির বিপদটি কোথায়? বিজ্ঞানকে উপলব্ধি করা ছাড়া এ বিপদ থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই।
রচনাকাল: ২০০৮
ডিসকাশন প্রজেক্ট
আ. হাকিম চাকলাদার, একটু সংশধোন আছে, সূর্য স্থির নয়, সূর্যও ঘুরছে। এই মহাবিশ্বে কিছুই স্থির নয়। ধন্যবাদ।
সংশোধন
আমার উপরোল্লিত মন্তব্যটি হইবে
@সুষুপ্ত পাঠক
এডমিন —-এটা ঠিক করেদিন।
একেবারে সঠিক কথা বলেছেন। অনেক আগে স্কুলের একটি বিজ্ঞান ক্লাসে সেদিন শিক্ষকের পড়ানোর বিষয় বস্তুটা ছিল”সূর্য স্থির থাকে, পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরে”
বিষয়টি উপযুক্ত প্রমান সহ বর্ণনা সত্বেও শিক্ষক আমাদের কে বার বার বলতেছিলেন, “তোমরা এগুলী শুধু পড়ে যাও, কখনো বিশ্বাষ করবেনা,তা হলে ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে,আর ঈমান নষ্ট হয়ে গলে তো জাহান্নামে যাইতে হইবে। কারণ,কোরান বলে ‘পৃথিবী স্থির থাকে ও সূর্য উদয় অস্ত হয়।’ আল্লাহর নিজস্ব বানী কোরান ই তো বেশী বিশ্বাষযোগ্য,আর আমরা তা মানতে বাধ্য।
আর ডার উইনের বিবর্তন মতবাদের তো প্রশ্নই উঠেনা। এটা তো একেবারে সরাসরি কোরানের বর্ণিত আদম হাওয়ার সৃষ্টিকেই আঘাত করে।
ধন্যবাদ
মজার ব্যাপার হচ্ছে বিজ্ঞান আমাদের দেশে ধর্মের মত করেই পড়ানো হয়।একজন বিজ্ঞানমনস্ক বিজ্ঞানকে ধর্মের মত করে বিশ্বাস করে।তারচেয়েও খারপ কথা হচ্ছে বিজ্ঞানের ছাত্ররাই এখন সবচাইতে বেশি বিজ্ঞান বিদ্বেষি।বিজ্ঞানকে তারা ভালো চাকরির মাধ্যম হিসেবে নিয়েছে।ডাক্তার, ইনঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্যই তাদের বাধ্য হয়ে বিজ্ঞান পড়তে হয়।তারা ডারউইনকে সাক্ষাৎ শয়তান বলে মনে করে।স্টেফিন হকিংকে তারা নাস্তিক (ভয়ানক গালি অর্থে) বলে খিস্তি করে।বিজ্ঞানের ক্লাশে বিজ্ঞানের শিক্ষক তার ঈমান ঠিক রাখতে পড়ানোর আগে ছাত্রদেরকে বলে দেন, এগুলো পড়ার জন্য পড়বে বিশ্বাস করবে না (ডারউইন তত্ত্বসহ অন্যান্য বিজ্ঞানের সূত্র সমূহকে)।এই যখন অবস্থা একটা জাতির, তখন তাদের কাছ থেকে আমরা আর কি আশা করতে পারি? মধ্যপাচ্যের টাকায় যে হারে কওমি মাদ্রাসা তৈরি হচ্ছে তাতে দরিদ্র জনগণের একটা বিশাল অংশ (যাদের পক্ষে ইংরেজি-বাংলা মাধ্যমে পড়া সম্ভব নয়) চরম অন্ধকারের মধ্যে পতিত হবে।দেশের এই অংশটাকে কিছুতেই উপেক্ষার করার যো নেই।কাজেই সামনে ভয়াবহ অবস্থা অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য।মসজিদে মসজিদে ধর্মের ছবক দেবার নামে মোল্লাতন্ত্র চালুর পক্ষে প্রচারণা চালানো হচ্ছে প্রকাশ্যে।যে দেশে শুক্রবারের পরিবর্তে রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি করা সম্ভব হয়নি (শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি মৌলবাদের প্রাণভ্রমরা) সে দেশে দিনকে দিন একটা বিজ্ঝানবিদ্বেষি সমাজ (যার মধ্যে যুবক সম্প্রদায়ই বেশি থাকবে) গড়ে উঠবে এ আর নতুন কি? তবু আসিফ ভাইয়ের মত যাঁরা এখেনা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের আমার নতমস্তকে অভিবাদন।টিমটিমে করে জ্বলা প্রদীপটা হয়ত একিদন দিকে দিকে আলোর শিখা ছড়িয়ে দিবে।আসিফ, আপনাকে ধন্যবাদ।
২০০৮ এর লেখা/বক্তৃতা ২০১২ সালে হুবহু প্রকাশ না করে বরং প্রাসঙ্গিক বক্তব্যগুলো বর্তমানের আলোকে তুলে ধরলে ভাল লাগতো। বিশেষ করে এখনকার পদ্ধতি আগের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন, সৃজনশীল প্রশ্ন নামে একটা জিনিস যোগ হয়েছে, যদিও বাস্তবে তা কতটা সৃজনশীল তা তর্কসাপেক্ষ। এই প্রাসঙ্গিকতাটুকু আসা দরকার ছিলো।