আকাশ মালিক

আজ বাংলা সাহিত্যাকাশের উজ্জল নক্ষত্র; বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধের আপোষহীন যোদ্ধা, দ্রোহ ও প্রেমের কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহর ৫৫তম জন্মবার্ষিকী। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জন্ম তাঁর পিতার কর্মস্থল বরিশাল জেলায়। তাঁর মূল বাড়ি বাগেরহাট জেলার মংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামে। রুদ্র মাত্র ৩৪ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে সাতটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও গল্প, কাব্যনাট্য, শতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন। ঢাকা ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল থেকে ১৯৭৩ সালে এসএসসি এবং ১৯৭৫ সালে এইচএসসি পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সসহ এমএ পাস করেন। ১৯৮১ সালে বহুল আলোচিত নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে বিয়ে করেন। ১৯৮৬ সালে তাদের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটে।

তার ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবনের সাথে আমি বিদ্রোহী নজরুলের এক আশ্চর্য মিল খুঁজে পাই। রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহকে জানতে গিয়ে যে দুটো চিঠি পড়েছি, আমার মনে হয় তাতেই ফুটে উঠেছে ব্যক্তি রুদ্রের পরিপূর্ণ পরিচয়। বিয়ের পর বাবার কাছে লেখা রুদ্রের চিঠি-

আব্বা,
পথে কোনো অসুবিধা হয়নি। নাসরিনকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গত পরশু ঢাকায় ফিরেছি। আপনাদের মতামত এবং কোনোরকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আমি বিয়ে করে বৌ বাড়ি নিয়ে যাওয়াতে আপনারা কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু আমি তো আমার জীবন এভাবেই ভেবেছি। আপনার সাথে আমার যে ভুল বোঝাবুঝিগুলো তা কখনই চ্যালেঞ্জ বা পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্ব নয়, স্পষ্টতই তা দুটো বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব। ব্যক্তি আপনাকে আমি কখনোই ভুল বুঝিনি, আমি জানি না আমাকে আপনারা কিভাবে বোঝেন। এতো চরম সত্য যে, একটি জেনারেশনের সাথে পরবর্তী জেনারেশনের অমিল এবং দ্বন্দ্ব থাকবেই। যেমন আপনার সাথে আপনার আব্বার অমিল ছিলো, আপনার সাথে আমার এবং পরবর্তীতে আমার সাথে আমার সন্তানদের। এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাত কোনোভাবেই রোধ করা সম্ভব নয়। আমরা শুধু এই সংঘাতকে যুক্তিসঙ্গত করতে পারি; পারি কিছুটা মসৃন করতে। সংঘাত রোধ করতে পারিনা। পারলে ভালো হতো কিনা জানিনা। তবে মানুষের জীবনের বিকাশ থেমে যেতো পৃথিবীতে।

আমার মনে পড়ে না। এই ছাব্বিশ বছরে একদিনও পিতা হিসাবে আপনার সন্তানদের আদর করে কাছে টেনে নেননি। আশেপাশে অন্য বাবাদের তাদের সন্তানদের জন্য আদর দেখে নিজেকে ভাগ্যহীন মনে হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে কখনো কষ্ট প্রকাশ করিনি। ছেলেবেলায় আমার খেলতে ভালো লাগতো। খেললে আমি ভালো খেলোয়াড় হতাম। আপনি খেলতে দিতেন না। ভাবতাম, না খেললেই বোধ হয় ভালো। ভালো মানুষেরা বোধ হয় খেলে না। আবার প্রশ্ন জাগতো, তাহলে আমার খেলতে ভালো লাগে কেনো? আমি কি তবে খারাপ মানুষ? আজ বুঝি, খেলা না খেলার মধ্যে মানুষের ভালো-মন্দ নিহিত নয়। কষ্ট লাগে। আমিও স্বপ্ন দেখতাম, আমি ডাক্তার হবো। আপনার চেয়ে বড় ডাক্তার হয়ে আপনাকে ও নিজেকে গৌরব দেবো। সন্তান বড় হলে পিতারই তো সুখ। আমি সেভাবে তৈরীও হচ্ছিলাম। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের পর কি যে এক বিরাট পরিবর্তন এলো ! একটি দেশ, একটি নতুন দেশের জন্ম হলো, নতুন চিন্তার সব হতে লাগলো। নতুন স্বপ্ন এলো মানুষের মনে। সবাই অন্যরকম ভাবতে শুরু করলো। আমিও আমার আগের স্বপ্নকে ধরে রাখতে পারিনি। তারচেয়ে বড় এক স্বপ্ন, তারচেয়ে তাজা এক স্বপ্ন, তারচেয়ে বেগবান এক স্বপ্নকে আমি কাছে টেনে নিলাম। আমি সিরিয়াসলি লিখতে শুরু করলাম। আগেও একটু আধটু লিখতাম, এবার পুরোপুরি। আমি আমার আগের সব চিন্তা-ভাবনার প্রভাব ঝেড়ে ফেলতে লাগলাম। চিন্তা থেকে, জীবন থেকে, বিশ্বাস-আদর্শ থেকে, অনেক কিছুর সঙ্গেই সংঘর্ষ হতে লাগলো। অনেক কিছুর সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির শুরু হলো। কখনো ক্ষোভে আমি অপ্রত্যাশিত কিছু করে ফেলতে লাগলাম। আপনার সাথে আমার সাথে বিশ্বাসের সাথে মিল এমন মানুষের দেখা পেলাম। তাদের সাথে সংঘাতও হলো। একি ! সবার সাথে সংঘর্ষ হয় কেন? মনে মনে আমি ভীষণ অস্থির হয়ে পড়লাম। তাহলে কি এপথ ভুল পথ? আমি কি ভুল পথে চলেছি? কখনো মনে হয়েছে, আমিই ঠিক, এই প্রকৃত পথ। মানুষ যদি নিজেকে ভালোবাসতে পারে তবে সবচেয়ে সুন্দর হবে। নিজেকে ভালোবাসতে গেলে সে তার পরিবারকে ভালোবাসবে। আর পরিবারকে ভালোবাসা মানেই একটি গ্রামকে ভালোবাসা। একটি গোষ্ঠীর মানুষকে ভালোবাসবে। আর একটি গ্রাম মানেই তো সারা পৃথিবী। পৃথিবীর সব মানুষ – সব মানুষ সুন্দর হয়ে বাঁচবে। পৃথিবীতে কত বড় বড় কাজ করেছে মানুষ। একটা ছো্‌ট্ট পরিবারকে সুন্দর করা যাবে না? অবশ্যই যাবে। একটু যৌক্তিক হলে, একটু খোলামেলা হলে কত সমস্যা এমনিতেই মিটে যাবে। সম্পর্ক সহজ হলে কাজ সহজ হয়। আমরা চাইলেই তা করতে পারি।
জানিনা এ চিঠিখানায় আপনি ভুল বুঝবেন কিনা। ঈদের আগে আগে বাড়ি আসবো। আম্মাকে বলবেন, যেন বড় মামার কাছ থেকে হাজার চারেক টাকা নিয়ে আমাকে পাঠায়। বাসায় রান্নার কিছুই কেনা হয়নি। বাইরের খাওয়ায় খরচ বেশী এবং অস্বাস্থ্যকর। আম্মার তদারকিতে দেওয়া সম্পত্তির এটুকুই তো রিটার্ন মাত্র। আপনার সেন্টিমেন্টে লাগতে পারে। লাগাটাই স্বাভাবিক। কারণ আপনার শ্বশুড়বাড়ি। আমাদের কিসের সেন্টিমেন্ট? শিমু মংলায় পড়বে, বাবু স্কুলে। আপনারা না চাইলেও এসব করা হবে। দোয়া করবেন।
– শহিদুল্লাহ।

চিঠির প্রতিটি লাইনে, বাক্যে পারিবারিক জীবন ও জগত নিয়ে রুদ্রের চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস-ভাবনার যথেষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। সে ভাবনা বিশ্লেষণের দায় পাঠকের হাতেই ছেড়ে দিলাম। আমাকে সব চেয়ে বেশী ভাবিয়ে তুলেছে রুদ্রকে লেখা তার স্ত্রী তাসলিমার চিঠিটি। ভালবাসা জিনিসটা কী? জৈবিক সম্পর্ক আমরা বুঝি, মনের সম্পর্কটা কী? বিচ্ছেদের যন্ত্রণা, বিরহের ব্যথা আমরা কতটুকু অনুধাবন করতে পারি? তাসলিমা আজও কেন অপর পারের রুদ্রের কণ্ঠ শুনতে পান? জগতটাকি আসলেই কোন ইন্দ্রজালিক মায়ার বাঁধনে বাঁধা? তাসলিমার চিঠি পড়া যাক-

প্রিয় রুদ্র,
প্রযত্নে, আকাশ
তুমি আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখতে বলেছিলে। তুমি কি এখন আকাশ জুড়ে থাকো? তুমি আকাশে উড়ে বেড়াও? তুলোর মতো, পাখির মতো? তুমি এই জগত্সংসার ছেড়ে আকাশে চলে গেছো। তুমি আসলে বেঁচেই গেছো রুদ্র। আচ্ছা, তোমার কি পাখি হয়ে উড়ে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে না? তোমার সেই ইন্দিরা রোডের বাড়িতে, আবার সেই নীলক্ষেত, শাহবাগ, পরীবাগ, লালবাগ চষে বেড়াতে? ইচ্ছে তোমার হয় না এ আমি বিশ্বাস করি না, ইচ্ছে ঠিকই হয়, পারো না। অথচ এক সময় যা ইচ্ছে হতো তোমার তাই করতে। ইচ্ছে যদি হতো সারারাত না ঘুমিয়ে গল্প করতে – করতে। ইচ্ছে যদি হতো সারাদিন পথে পথে হাটতে – হাটতে। কে তোমাকে বাধা দিতো? জীবন তোমার হাতের মুঠোয় ছিলো। এই জীবন নিয়ে যেমন ইচ্ছে খেলেছো। আমার ভেবে অবাক লাগে, জীবন এখন তোমার হাতের মুঠোয় নেই। ওরা তোমাকে ট্রাকে উঠিয়ে মিঠেখালি রেখে এলো, তুমি প্রতিবাদ করতে পারোনি।
আচ্ছা, তোমার লালবাগের সেই প্রেমিকাটির খবর কি, দীর্ঘ বছর প্রেম করেছিলে তোমার যে নেলী খালার সাথে? তার উদ্দেশ্যে তোমার দিস্তা দিস্তা প্রেমের কবিতা দেখে আমি কি ভীষণ কেঁদেছিলাম একদিন ! তুমি আর কারো সঙ্গে প্রেম করছো, এ আমার সইতো না। কি অবুঝ বালিকা ছিলাম ! তাই কি? যেন আমাকেই তোমার ভালোবাসতে হবে। যেন আমরা দু’জন জন্মেছি দু’জনের জন্য। যেদিন ট্রাকে করে তোমাকে নিয়ে গেলো বাড়ি থেকে, আমার খুব দম বন্ধ লাগছিলো। ঢাকা শহরটিকে এতো ফাঁকা আর কখনো লাগেনি। বুকের মধ্যে আমার এতো হাহাকারও আর কখনো জমেনি। আমি ঢাকা ছেড়ে সেদিন চলে গিয়েছিলাম ময়মনসিংহে। আমার ঘরে তোমার বাক্সভর্তি চিঠিগুলো হাতে নিয়ে জন্মের কান্না কেঁদেছিলাম। আমাদের বিচ্ছেদ ছিলো চার বছরের। এতো বছর পরও তুমি কী গভীর করে বুকের মধ্যে রয়ে গিয়েছিলে ! সেদিন আমি টের পেয়েছি।
আমার বড়ো হাসি পায় দেখে, এখন তোমার শ’য়ে শ’য়ে বন্ধু বেরোচ্ছে। তারা তখন কোথায় ছিলো? যখন পয়সার অভাবে তুমি একটি সিঙ্গারা খেয়ে দুপুর কাটিয়েছো। আমি না হয় তোমার বন্ধু নই, তোমাকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম বলে। এই যে এখন তোমার নামে মেলা হয়, তোমার চেনা এক আমিই বোধ হয় অনুপস্থিত থাকি মেলায়। যারা এখন রুদ্র রুদ্র বলে মাতম করে বুঝিনা তারা তখন কোথায় ছিলো?
শেষদিকে তুমি শিমুল নামের এক মেয়েকে ভালোবাসতে। বিয়ের কথাও হচ্ছিলো। আমাকে শিমুলের সব গল্প একদিন করলে। শুনে … তুমি বোঝোনি আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। এই ভেবে যে, তুমি কি অনায়াসে প্রেম করছো ! তার গল্প শোনাচ্ছো ! ঠিক এইরকম অনুভব একসময় আমার জন্য ছিলো তোমার ! আজ আরেকজনের জন্য তোমার অস্থিরতা। নির্ঘুম রাত কাটাবার গল্প শুনে আমার কান্না পায় না বলো? তুমি শিমুলকে নিয়ে কি কি কবিতা লিখলে তা দিব্যি বলে গেলে ! আমাকে আবার জিজ্ঞেসও করলে, কেমন হয়েছে। আমি বললাম, খুব ভালো। শিমুল মেয়েটিকে আমি কোনোদিন দেখিনি, তুমি তাকে ভালোবাসো, যখন নিজেই বললে, তখন আমার কষ্টটাকে বুঝতে দেইনি। তোমাকে ছেড়ে চলে গেছি ঠিকই কিন্তু আর কাউকে ভালোবাসতে পারিনি। ভালোবাসা যে যাকে তাকে বিলোবার জিনিস নয়।
আকাশের সঙ্গে কতো কথা হয় রোজ ! কষ্টের কথা, সুখের কথা। একদিন আকাশভরা জোত্স্নায় গা ভেসে যাচ্ছিলো আমাদের। তুমি দু চারটি কষ্টের কথা বলে নিজের লেখা একটি গান শুনিয়েছিলে। “ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি দিও”। মংলায় বসে গানটি লিখেছিলে। মনে মনে তুমি কার চিঠি চেয়েছিলে? আমার? নেলী খালার? শিমুলের? অনেক দিন ইচ্ছে তোমাকে একটা চিঠি লিখি। একটা সময় ছিলো তোমাকে প্রতিদিন চিঠি লিখতাম। তুমিও লিখতে প্রতিদিন। সেবার আরমানিটোলার বাড়িতে বসে দিলে আকাশের ঠিকানা। তুমি পাবে তো এই চিঠি? জীবন এবং জগতের তৃষ্ণা তো মানুষের কখনো মেটে না, তবু মানুষ আর বাঁচে ক’দিন বলো? দিন তো ফুরোয়। আমার কি দিন ফুরোচ্ছে না? তুমি ভালো থেকো। আমি ভালো নেই।

ইতি,
সকাল
পুনশ্চঃ আমাকে সকাল বলে ডাকতে তুমি। কতোকাল ঐ ডাক শুনি না। তুমি কি আকাশ থেকে সকাল, আমার সকাল বলে মাঝে মধ্যে ডাকো? নাকি আমি ভুল শুনি?

চলুন, শারমিন মোস্তফার কণ্ঠে চিঠিটা শুনা যাক- তার আগে বিদ্রোহের কবি, ভালবাসার কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর প্রতি জ্ঞাপন করি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

httpv://www.youtube.com/watch?v=PebfRu7gzho