ইংরেজী weather শব্দটার সাথে আমাদের খুব করে পরিচয় থাকলেও অনেকটা একই উচ্চারণের wether এর সাথে তেমনটা নেই। থাকার কথাও নয়। তার উপর সেটার অর্থ যদি হয় একটি খাসি করা মেষ বা ভেড়া (A castrated ram), তাহলেতো কথাই নেই। তাছাড়া, চরানোর ব্যাপার না আসলে মেষ ব্যাপারটা আমাদের দেশে খুব একটা ব্যবহারও করতে হয় না। বাংলায় বাবারা অকর্মণ্য ছেলেকে মেষ চরানোর পরামর্শ দিয়ে মনের ক্ষোভ মেটান। আর মেষ না বলে যদি ভেড়া বলা হয়, তাহলে সেটার ব্যবহারও সদ্য বিবাহিত কাউকে বিয়ের পর ভেড়া হয়ে গেছে বলে উত্তক্ত করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
তবে, সকল অপমান মুখ বুজে সহ্য করে চলতে থাকা ভেড়া সমাজেও একজন অত্যন্ত সন্মানিত ভেড়া আছেন। এই নেতৃস্থানীয় ভেড়াটির (wether) গলায় ক্ষেত্রবিশেষে একটি ঘণ্টা (bell) ঝুলিয়ে দেয়ার কারণে, ইংরেজীতে এর নাম হয়ে যায় bellwether। বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধা বিশেষ কাজ হিসেবে বিবেচিত হলেও, এই ভেড়াদের গলায় ঘণ্টা বাঁধা কাজের মধ্যেই ধরা হবে না। বুদ্ধি বিবেচনা এবং দুটি চোখ থাকা সত্ত্বেও, নেতৃত্বের প্রতি অগাধ বিশ্বাসী এই নিরীহ প্রাণীগুলো, পথ চলার সময় কেন যে সে-সবের বিন্দুমাত্র ব্যবহারও না করে তাদের নেতা bellwether কে অনুসরণ করে সামনে এগিয়ে চলে, সেটা গবেষণার বিষয়ই বটে। তবে, কারণ সে যাই হোক না কেন, তাদের এই ভক্তিমূলক অনুসরণ প্রক্রিয়াটাকে সহজতর করাই bellwether এর গলায় ঘণ্টার ঝুলানোর মূল কারণ। গলায় ঝুলতে থাকা ঘণ্টার ধ্বণি শুনেই, দলনেতাকে অনুসরণ করে এগিয়ে চলে সমস্ত ভেড়ার পাল। তাছাড়া, সমস্ত পাল নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে যিনি থাকেন, সেই নিয়ন্ত্রণকর্তারও বুঝতে সুবিধে হয় ভেড়ার পালটি সে-মুহূর্তে ঠিক কোথায় বা কোনদিকে আছে।
আমেরিকায় ওহাইও-কে বলা হয়ে থাকে bellwether স্টেইট। এটি একই সঙ্গে swing (দুলন্ত/ঝুলে থাকা) স্টেইটও। শব্দ দু’টি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। swing শব্দটি ওহাইওর নির্বাচন পূর্ববর্তী আর bellwether শব্দটি নির্বাচন পরবর্তী অবস্থার জন্য দেয়া নাম। এই স্টেইটটিতে কোন দল থেকে প্রার্থী জয়ী হবে সেটা নির্বাচনের আগে ধারণা করতে পারা অত্যন্ত কঠিন বিধায় অর্থাৎ প্রার্থীদের ভাগ্য দোদুল্যমান থাকার কারণে এটি swing স্টেইট। অন্যদিকে, নির্বাচনের ফলাফলের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ওহাইও থেকে যে দল নির্বাচিত হয়, সেই দলই সাধারণত জাতীয় নির্বাচনেও জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে থাকে। অতএব, রূপকার্থে ওহাইওর দেখানো পথে অন্যরা হেঁটে যায় বিধায় এটি bellwether স্টেইটও।
- ছবিঃ আমেরিকার মানচিত্রে ওহাইও (লাল অংশটুকু) সৌজন্যেঃ উইকিপিডিয়া
এটা না-হয় ওহাইওর রাজনৈতিক পরিচয়। এবার আসা যাক অন্য পরিচয়ে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে, এই জায়গাটিতে থেকে এমন কিছু মানুষ জন্ম নিয়েছে, সভ্যতার ইতিহাস যেমন করেই লেখা হোক না কেন, যেভাবেই লেখা হোক না কেন, তাদের অবস্থানের বিন্দুমাত্র বিচ্যুতিও ঘটবে না। ওহাইওতেই জন্মগ্রহণ করেছেন চাঁদের বুকে সর্বপ্রথম বিচরণকারী মানব নীল আরমস্ট্রং। শুধু তাই নয়, যে দুই ভাইয়ের কল্যাণে সর্বপ্রথম আকাশে পাড়ি জমায় মানুষের স্বপ্নের আকাশযান, সেই উলবার রাইট আর অরভিল রাইটেরও জন্মস্থান এই ওহাইও। অতীত ইতিহাস বাদ দিয়ে যদি রত্নগর্ভা এই স্টেইটের বর্তমানের বিখ্যাত মানুষদের তালিকা করতে বলা হয়, তাহলেও সে তালিকা খুব একটা ছোট হবে না। আর সেই তালিকায় থাকা প্রথম দিকের একজন ব্যক্তি হবেন স্টিভেন স্পিলবার্গ- এমন এক চলচ্চিত্র পরিচালক, বর্তমানের প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত যিনি বিচরণ করে বেড়ান ভবিষ্যতের বিস্ময় ভুবনে।
আমার আবাসস্থল শিকাগো থেকে ওহাইও বেশ কয়েক ঘণ্টার ড্রাইভ। ছয় ঘন্টার কিছুটা বেশি সময় লাগে। যাওয়ার পথে থেমে থেমে স্টারবাকস্ এর কফি আর বিস্বাদ খাবার খেতে খেতে যখন বিদ্রোহী হয়ে উঠার উপক্রম, ঠিক তখনি রাস্তায় পড়লো ওয়েফল হাউজ। কম দামে ভালো খাবারের দোকান। এমনও হতে পারে আমেরিকায় আসার পর প্রথবারের মত ওয়েফল হাউজে খাবার কারণে ভালো লাগলো। শিকাগোতে ওয়েফল হাউজ নেই। আমেরিকার সব খাবারের দোকান সব স্টেইটে থাকে না। কিছু কিছু শুধু পুর্ব দিকের স্টেইটগুলোতে (ইস্ট কোস্ট) থাকে, কিছু আবার থাকে পশ্চিমে (ওয়েস্ট কোস্ট)। মাঝখানের স্টেইটগুলোরও (মিডওয়েস্ট) কিছু স্বকীয় বৈশিষ্টের খাবারের দোকান আছে। বলে রাখা ভাল যে, আমেরিকানদের দিনের এক-পঞ্চমাংশ সময়ই যায় কোথায় খাবে সেটার পরিকল্পনা করে, আরো এক-পঞ্চমাংশ সময় যায় কোথায় খেলো সেটার ধারা বর্ণনা করে। এ-এক বেজায় খাদ্যকেন্দ্রিক জাতি।
আমেরিকার অন্যসব স্টেইটের সাথে ওহাইওর একটা বিশেষ পার্থক্য আছে। বেশিরভাগ স্টেইটে নামী-দামী শহর একটাই থাকে। খুব কম স্টেইটেই দুইটা নামকরা শহর। আর তিন শহরের স্টেইট খুঁজে পেতেতো রীতিমত কম্বিং অপারেশান চালাতে হবে। কিন্তু, আমেরিকার বিশ্বখ্যাত সব শহরগুলোর মত ততটা নামকরা না হলেও, এই ওহাইওতে প্রায় সমান রকমের নামকরা চার-চারটি শহর আছে- ডেইটন, সিনসিনাটি, ক্লিভল্যান্ড এবং কলাম্বাস। এদেশে শহরবাসীরা তাদের শহরের ইতিহাস আর ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করে থাকে। আমেরিকা এত বড় দেশ হবার কারণে, দেশপ্রেমের সাথে সাথে মানুষের মাঝে শহরপ্রেমও দেখা যায়। এর মধ্যে ১৮৬৫ সালে সর্বপ্রথম অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালু করার কৃতিত্ব সিনসিনাটি শহরের। অন্যদিকে, আমেরিকায় সর্বপ্রথম ট্রাফিক লাইট স্থাপন নিয়ে গর্ব করে থাকে ক্লিভল্যান্ডবাসী। আর, ডেটন-নিবাসীরাতো অহঙ্কারে মাটিতে পা’ই রাখেন না। রাখবেই বা কেন, যে অরবিল আর উইলভার রাইট ভ্রাতৃদ্বয় আকাশে উড়ে উড়ে স্বপ্ন দেখার আকাস-কুসুম চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলো, সেই দুই ভাইতো ডেটনেরই দুই সন্তান।
এতো গেল তিন শহরের কথা। বাকী থাকে ওহাইওর রাজধানী কলাম্বাস। আমেরিকায় পথ দেখানো প্রথম নাবিক ক্রিস্টোফার কলাম্বাসের নামেই নামকরণকৃত এই শহর। যে-শহরের নামের মাঝেই লুকিয়ে আছে এক-খণ্ড দুর্দান্ত ইতিহাস, বড়াই করার জন্য তার চেয়ে বেশি কি আর লাগে সে-শহরের! খুব শান্ত আর নিরিবিলি শহর কলাম্বাস, মনোরমই বলা চলে। অন্য বড় শহরগুলোর মত ততটা ব্যস্ত নয়। আমি যে বাসায় যাব সেটা একেবারে শহরের কেন্দ্রবিন্দু ডাউনটাউনেই। থাকার জন্য আগেই বলে রেখেছে আমার ছাত্রজীবনের এক বন্ধু, কলাম্বাস শহরে একটা কোম্পানীতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছে সে। তার নিজের বাসা নিউ ইয়র্ক শহরে। কিন্তু, ব্যস্ত নিউইয়র্ক শহরে থাকতে থাকতে বিরক্তি এসে গেছে বলে কিছুটা ধীরগতির শহর কলাম্বাসেই এখন থাকছে। শহরের মাঝখানে ‘হাই স্ট্রিট’ ধরে তার বাসায় যাওয়ার পথে দেখি গোটা স্ট্রিট এর উপর কিছু দূরে দূরে গেটের মত করে(আর্চ) সাজানো আছে। সেগুলোতে আবার নান রকমের আলোকসজ্জা। হাই স্ট্রিট হচ্ছে কলাম্বাসের বেইলি রোড অর্থ্যাৎ তারুণ্যের প্রাণ-প্রাচুর্যে সরগরম হয়ে থাকা সড়ক। প্রতিটা শহরে গিয়ে আমার প্রথম কাজ হচ্ছে বেইলী রোড খুঁজে বের করা। এই হাই স্ট্রিটটিকে কলাম্বাসের অন্যতম এক আকর্ষণ হিসেবেও ধরা হয়ে থাকে। অবাক ব্যাপার হচ্ছে অন্য আর সব শহরে ডাউনটাউনে বাসা ভাড়া সবচেয়ে বেশি হলেও, কলাম্বাস শহরে ডাউনটাউনের বাসা ভাড়া তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে কম।
- ছবিঃ ওহাইও’র বেইলি রোড হাই স্ট্রিট
এই শহরের বিশাল অংশ জুড়ে আছে ওহাইও স্টেইট ইউনিভার্সিটি। স্টুডেন্ট ভর্তির হিসেবে এটি আমেরিকার সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় ষাট হাজারের কাছাকাছি স্টুডেন্ট এখানে পড়ে। কিন্তু, বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত বড় ক্যাম্পাস হলেও পরিকল্পিত আর চমৎকার করে সাজানো । শহরের বাড়িগুলোতে পতাকা উড়ছে বাকায়েজ(Buckeyes) এর। বাকায়েজ ওহাইও স্টেইট ইউনিভার্সিটি স্পোর্টস্ টিম এর নাম। স্পোর্টস বলতে প্রধানত বেইজ বল, বাস্কেট বল আর আমেরিকান ফুটবল। স্পোর্টস এর জন্য বাকায়েজ’দের খ্যাতি গোটা আমেরিকাজুড়ে। এদের শিরোপার তালিকা ঈর্ষনীয়। শহরবাসীও তাই আগ্রহ করে বাড়ীর দরজায় বাকায়েজ এর পতাকা টানিয়ে রাখে। তাছাড়া, ওহাইওর মানুষজকেও বাকায়েজ বলা হয়ে থাকে। এখানকার বাকায়েজ নামক বৃক্ষের নাম থেকে এ-নামের আবির্ভাব ঘটে। ব্যাপারটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার এর কারণে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমকে যেমন টাইগার বলা হয়ে থাকে অথবা ক্যারিব নামক আদিবাসীদের নামে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের যেমনটা ক্যারিবিয়ান বলা হয়ে থাকে সে-রকম।
- ছবিঃ ওহাইও স্টেইট ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস
- ছবিঃ বাকায়েজ’দের স্বপ্নের স্টেডিয়াম
- ছবিঃ ক্যাম্পাসএর ভিতরকার সেতু
আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ফারমার্স মার্কেট থাকে। এটি বাংলাদেশী হাঁটের আমেরিকান সংস্করণ। মানুষজন এখানে নিজেদের ঘরে তৈরী করা বিভিন্ন খাবার কিংবা অন্যান্য সামগ্রী এনে দোকান নিয়ে বসে। আবার নিজেদের মাঠে উৎপন্ন হওয়া তাজা ফলফলাদি কিংবা শাক-সবজি নিয়েও উপস্থিত হয় ফারমার্স মার্কেটে। কলাম্বাসের ফারমার্স মার্কেটে গেলাম তৈমুরের সাথে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময়, কোনো এক বছর তৈমুরকে কেমেস্ট্রি পড়াতাম। ও তখন ঢাকায় ইংলিশ মিডিয়াম একটা স্কুলে পড়ে। আমার কাছে কেমিস্ট্রি পড়ার পর, খুব স্বাভাবিকভাবেই, সেটা নিয়ে আর বেশি দূর এগোনোর কথা চিন্তাও করতে পারেনি। এখন ওহাইও ওয়েজলিয়ান ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্স নিয়ে আন্ডারগ্র্যাড করছে। কলাম্বাসে এখন আন্টি-আঙ্কেল অর্থাৎ তৈমুরের বাবা-মাও অবস্থান করছেন। বাংলাদেশ থেকে ওকে দেখার জন্য এসেছেন। তৈমুরের মতে কলাম্বাসের ফারমার্স মার্কেটে পাওয়া তিরামিসু গোটা আমেরিকায় সেরা। ডিমের কুসুম, কফিতে রাখা হাল্কা ও মিষ্টি স্পঞ্জ কেক এবং চিজ্ দিয়ে বানানো হয়ে থাকে এটি। তিরামিসু ইতালিয়ান কেক। ছলনাময়ী এই কেক চোখের সামনে পড়লে না খেয়ে থাকাটা কষ্টকর, তার উপর ইতালিয়ান তিরামিসু নামের অর্থ আমায় তুলে নাও (পিক্ মি আপ্)।
- ছবিঃ ফারমার্স মার্কেট
- ছবিঃ পেঁচা বিল্ডিং, ওহাইও ওয়েজলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস
কলাম্বাসে বাংলাদেশীদেরর সংখ্যা খুব একটা কম নয়। কম নয় মানে হাজার হাজার বাংলাদেশি আছেন এখানে। মূলত, সবাই ডাবলিন নামক এলাকা অথবা সেটার কাছাকাছি কোথাও বসবাস করেন। এর মাঝে একদিন রাতে আবার সেখানকার এক বাসায় যাওয়ার জন্য দাওয়াত দেয়া হলো। খুব কম সময়ের জন্য কলাম্বাস এসেছি, অনেক না বলার পরও ব্যর্থ হয়ে, না গিয়ে উপায় থাকলো না। যথাসময়ে গিয়ে উপস্থিত হবার পর, যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে দাওয়াতপর্ব শুরু হলো। এ-ধরনের দাওয়াতে সকল বিতর্কের অবসান ঘটে রাজনীতিবিদদের দোষ দেওয়ার মধ্য দিয়ে। পলিটিশিয়ানরা দেশটার বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে সে-ব্যাপারে একমত হবার মধ্যে দিয়ে সাধারণত সবাই খাবার টেবিলের দিকে যাত্রা শুরু কর থাকে। এ-বাসায় গিয়ে দেখি আরো এক ডিগ্রি উপরে। বাংলাদেশী স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল চলছে। সেখানে চলমান টক-শো’তে আবার দুই রাজনীতিবিদ দেশপ্রেম নিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছেন। কিছুক্ষণ পর তারা মিষ্টতা বাদ দিয়ে এমন বাগ্বিতণ্ডা শুরু করলেন যে, আমাদের আর বিতর্ক করে একমত হতে হলো না যে, সকল দোষ রাজনীতিবিদদের। আমরা বিতর্ক না করে, টিভি চ্যানেলে তাদের কাণ্ড-কারখানা দেখেই, সরাসরি তাদের উপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে, খাবার টেবিলে চলে গেলাম। গৃহকর্তা সবাইকে নিশ্চিত করলেন হালাল দোকান থেকে কিনে আনা হালাল খাবার। তিনি যথার্থ ভদ্রলোক এবং তার স্ত্রীও খুবই আন্তরিক।
দাওয়াতের আসরে আশপাশের বাসা থেকে আসা কিছু অতিথিও আছেন। এ-সমস্ত আসরে আসল কথাটা বের হয় খাওয়ার পর। ধীরে সুস্থে এই-সেই কথাবার্তা বলার পর হঠাৎ করে একজন আমাকে বললেন, মুনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা। আমি হতভম্ব ভাব দেখিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি, কোথাকার কোন মুনার সাথে আমার সম্পর্ক থাকবে কেন, আর সাথেইতো আমার বউ বসে আছে। ভাব বুঝে তিনি বলেন, তার মানে মুনার সাথে আপনার কোনো পরিচয়ও নেই? আমি বলি, এ-নামে কাউকে আমি চিনিই না। মনে মনে বলি, কী আজব! দাওয়াত দিয়ে ডেকে এনে এগুলো কি কথা-বার্তা! আমাকে রিমান্ডে আনলো না-কি! বলার পর আবার মনে হলো, মুনা নামে আমি কমপক্ষে তিনজনকে চিনি। সাথে থাকা আরেকজন বললেন, আপনি মনে হয় বুঝতে পারছেন না। মুনা মানে মুসলিম উম্মাহ অব নর্থ আমেরিকা। সংক্ষিপ্ত আকারে সবাই বলেন মুনা (MUNA) । এ-পর্যায়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলব না অস্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবো সেটা বুঝতে না পারলেও, উনাদের আলোচনা কোন দিকে যাবে সেটা ঠিকই বুঝতে পারলাম। তাই দ্রুত প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে, দেশের উন্নতি কেন হচ্ছে না, সে অতিগুরুত্বপূর্ণ কারণ নির্ণয়ের ভার উনাদের হাতে সমর্পণ করে সে-দিনের মত বিদায় নিলাম।
- ছবিঃ রাতের কলাম্বাস শহর
- ছবিঃ বড় দিনের প্রস্তুতি
- ছবিঃ সুপ্রিম কোর্ট ভবন
- ছবিঃ শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর উপর ব্রিজ
- ছবিঃ নিঝুম রাতের শহর কলাম্বাস
পরবর্তী দিন আবার বিশেষ একটা দিন। ব্ল্যাক ফ্রাইডে। ব্ল্যাক ফ্রাইডে মানে কেনা-কাটা। একটা কিনলে একটা ফ্রি। আমেরিকানরা উৎসাহ নিয়ে এ-দিবস পালন করে। আর অন্য কিছু দেশ আমেরিকানরা কেন এ-দিবস পালন করে সেটা নিয়ে নিজেদের মাঝে ঝগড়া করে। ব্ল্যাক ফ্রাইডের দিনে সমস্ত কলাম্বাস শহর ঘুরে দেখা গেলো কোনো মানুষই নেই, জনশুন্য মরুভূমি। সাধারণত, প্রাকৃতিক দূর্্যোগের সম্ভাবনা থাকলে শহর খালি করে এ-অবস্থা করা হয়। কিন্তু সেরকম কোনো সতর্কতা বাণী শুনেছি বলেও মনে হলো না। শহরের মানুষ সব গেল কোথায়, সেই হিসেব মিলানোর চেষ্টা করতে করতে গিয়ে উপস্থিত হলাম শপিং মলে। শপিং মলে পা রাখার সাথে সাথেই সব হিসেব মিলে গেল। আসলে পা রাখার আগেই হিসেব মিলে গেল, কারণ অত সহজে সেখানে পা রাখা যাচ্ছিলো না। গোটা শহর চলে এসেছে শপিং-এ। কলাম্বাসের বিখ্যাত ইস্টন শপিং সেন্টারে আয়তন সবমিলিয়ে সতের লক্ষ বর্গফুট, প্রতিবছর সেখানে দুই কোটিরও বেশি মানুষ শপিং করতে আসে। প্রায় সবগুলো নামকরা ব্র্যান্ড এর উপস্থিতি আছে ইস্টন শপিং সেন্টারে।
- ছবিঃ কলাম্বাসের নগর ভবনের সামনের ভাস্কর্য
- ছবিঃ সবুজের মাঝে গড়ে তোলা শিল্প
এখানে বিভিন্ন দেশের নামে ছোট ছোট কিছু এলাকা আছে। শহরের মাঝেই বা পাশে অবস্থিত ইট-পাথরের সেই এলাকাগুলোকে ভিলেজ বলে ডাকা হয়। শহরের এক পাশে অবস্থিত জার্মান ভিলেজ। উনিশ শতকের শুরু থেকে মাঝামাঝি সময়ে বেশ কিছু সংখ্যক জার্মান নাগরিক এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। একদা এ-অঞ্চলে তাদের বিচরণের স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই জার্মান ভিলেজ। জার্মান ভিলেজ ছাড়াও আছে ভিক্টোরিয়ান ভিলেজ এবং ইতালিয়ান ভিলেজ। এ সবকিছুই শুধু মনে করিয়ে দেয়, নানান দেশ আর নানান জাতির আগমনে, বহু বর্ণের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে আজকের এই আমেরিকা।
- ছবিঃ জার্মান ভিলেজে বয়স্ক মানুষদের (সিনিয়র) পরিচালিত এবং তাদের নির্মিত সামগ্রীর দোকান থেকে তোলা
- ছবিঃ সিনিয়রদের আবিষ্কৃত টেকনিক
তবে, এ-শহরে অবস্থিত সবকিছুকে পেছনে ফেলে অনন্য হয়ে আছে অন্য আরেকটা জিনিস। এখানেই আছে একেবারে মূল জাহাজের মত করে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা ক্রিস্টোফার কলাম্বাসের জাহাজ স্যান্টা মারিয়ার রেপ্লিকা। অন্য আরো দু’টি জাহাজ সহকারে এই স্যান্টা মারিয়ায় রওয়ানা দিয়েই কলাম্বাস এসেছিলেন আমেরিকায়। স্যান্টা মারিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিট ধরে চিন্তা করেও হিসেবে মিলাতে পারিনি, কি পরিমাণ দুঃসাহস আর জেদ থাকলে সে-সময়কার সাধারণ এই জাহাজে চড়ে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে একদল নাবিক চলে আসতে পারে অজানা এক পৃথিবীতে। এতো আর এমন নয় যে, সামনের জন গলায় ঘণ্টা ঝুলিয়ে এগিয়ে গেল, আর তাকে দেখে দেখে পেছনের সবাইও এগিয়ে চলে গেলাম।
- ছবিঃ দিনের স্যান্টা মারিয়া
- ছবিঃ রাতের স্যান্টা মারিয়া
ভেড়াদের দিয়ে যেহেতু কাহিনীর শুরুটা করলাম, শেষটাও না হয় ভেড়াদের দিয়েই করা যাক। মেষ কিংবা ভেড়া কোনো নামেই না ডেকে এদেরকে অন্য আরেকটা বাংলা শব্দ গড্ডল বলেও ডাকা যায়। ভেড়ার সমার্থক wether এর আরেকটা অর্থ হলো গড্ডল, আর bellwether এর অর্থ গড্ডলিকা। কিন্তু, এ-যাত্রাও শেষ রক্ষা হয় না। বাড়ীর স্বঘোষিত গুরুজন কিংবা মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকের কাছে গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিওনা জাতীয় চোখ-রাঙ্গানি মিশ্রিত নীতিকথা শুনেননি এ-রকম মানুষ কমই আছে। অর্থাৎ তারা বুঝাতে চান, ভেড়ার পালের মত না-বুঝে সামনের জনকে অনুসরণ করেই শুধু পথ চলো না, নিজের বিবেক বুদ্ধি খরচ কর। যদিও ছোটবেলায় গড্ডলিকা শব্দের অর্থ কি সেটা জানতে চাওয়াতে আমার স্কুলশিক্ষক নিজের মত করে ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে রাগ করে বলেছিলেন, বোকা না-কি! শব্দ শুনেইতো অর্থ বুঝা যায়!! যে জিনিস গড় গড় করে বয়ে যায়, সে-জিনিসই গড্ডলিকা!!! অর্থাৎ গড় গড় করে বয়ে যাচ্ছে যে স্রোত, সে স্রোতের মধ্যে সাঁতার কাটতে যেও না।
মইনুল রাজু (ওয়েবসাইট)
ফেইসবুক পেইজ (ছড়া)
[email protected]
স্টেইটস্ অব আর্ট সিরিজের অন্যান্য পর্বগুলিঃ
:: নিউইয়র্ক (প্রথমার্ধ) :: নিউইয়র্ক (দ্বিতীয়ার্ধ) :: পোর্টল্যান্ড (ওরিগন) :: সিলিকন ভ্যালি (ক্যালিফোর্নিয়া) :: ওয়াশিংটন ডিসি :: ডেট্রয়েট (মিশিগান) :: রিচ্মন্ড (ভার্জিনিয়া) :: লস এঞ্জেলেস (ক্যালিফোর্নিয়া) ::
খুব ভাল লাগলো। ছবিগুলো চমৎকার। এই শহরটাতে ছিলাম পুরো দুটো বছর। আপনার লেখা পড়ে কিছুটা স্মৃতিতাড়িত হয়ে পড়েছি। ধন্যবাদ আপনাকে।
লেখককে অনেক ধন্যবাদ। লেখাটি পড়তে পড়তে কল্পনায় আমরিকা ঘুরে এলাম। (Y) (F)
@ভক্ত,
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন। 🙂
লোক প্রবাদ দিয়ে শুরু করে আমেরিকার সিটি ঘুরানো— রাজু ছাড়া আর কে পারে এমন মিশ্রণ ঘটাতে!
আরেকটা শহর ঘুরলেই তো ১০টা হবে। এরপরই কি শেষ?
@গীতা দাস,
গীতা’দি আর বোলেন না! এই মরার দেশে এত এত সুন্দর সব জায়গা দশ পর্বেতো শেষ করা যাবেই না, বরং আরো দশটার মত পর্ব পেন্ডিং-ই হয়ে আছে। আর আমার নিজ শহর শিকাগো নিয়েইতো এখনো লিখিনি। 🙂
@মইনুল রাজু,
যাক, রাজু তার বলয় থেকে বেরিয়ে বেড়িয়ে নিচ্ছে সমগ্র আমেরিকা। আর আমরাও সাথে সাথে ঘুরছি। ঘোরাঘুরি অব্যাহত থাকুক।
[…] মূল লেখার লিংক ইংরেজী weather শব্দটার সাথে আমাদের খুব করে পরিচয় থাকলেও অনেকটা একই উচ্চারণের wether এর সাথে তেমনটা নেই। থাকার কথাও নয়। তার উপর সেটার অর্থ যদি হয় একটি খাসি করা মেষ বা ভেড়া (A castrated ram), তাহলেতো কথাই নেই। তাছাড়া, চরানোর ব্যাপার না আসলে মেষ ব্যাপারটা আমাদের দেশে খুব একটা ব্যবহারও করতে হয় না। বাংলায় বাবারা অকর্মণ্য ছেলেকে মেষ চরানোর পরামর্শ দিয়ে মনের ক্ষোভ মেটান। আর মেষ না বলে যদি ভেড়া বলা হয়, তাহলে সেটার ব্যবহারও সদ্য বিবাহিত কাউকে বিয়ের পর ভেড়া হয়ে গেছে বলে উত্তক্ত করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। […]
দারুণ ভ্রমণবৃত্তান্ত। (F)
@তামান্না ঝুমু,
ধন্যবাদ আপনাকে। 🙂
@মইনুল রাজু,
আপনার লেখার সাথে সাথে সারা আমেরিকা মনে হয় ঘুরে এলাম। লেখা গুলো আর ছবি এতো প্রাণবন্ত
কি আর বলি। এই রকম ভ্রমন কাহিনি পড়তে সব সময় ভালো লাগে। নিজে তো দেশের মাটিতে পড়ে আছি।
কদিনের জন্যে একটু আধটু বিদেশ গিয়েছিলাম তাও আবার আশে পাশে। নেপাল বা ভারত এইজাতীয়-
তবে সেই ভ্রমন ও ছিল দারূণ উপভোগ্য। এক সময় করে লিখব কিনা ভাবছি-
@আফরোজা আলম,
ভারতে গেলেও নেপালে আমার কখনোই যাওয়া হয়নি। আপনি ভারত নেপাল নিয়ে লিখে ফেলুন। আমাদের পড়বার সৌভাগ্য হোক। 🙂
মনে আছে, জর্জ বুশের ‘রিইলেকশানের’ সময় অধীর আগ্রহে সিএনএনের পর্দায় তাকিয়ে ছিলাম, অপেক্ষা ওহাইওর ফলাফলের! ওহাইও তখন থেকেই মনে দাগ কেটে আছে!
আর্মস্ট্রং, রাইট ভাতৃদ্বয়, আর স্পিলবার্গ- তিনটে নামের সাথেই আকাশ-মহাকাশ কেমন মিশে আছে! আর ওহাইও- শব্দটির মাঝেও আছে ‘হাই’, সুতরাং, আকাশ-মহাকাশের অনেক উঁচুতে! মিলগুলো কেমন অদ্ভুত না, মইনুল ভাই!
লেখা তো আগের মতই হইছে, তথ্য আর বিনোদন- উভয়কে পাওয়া গেছে এ লেখাতেও!
@কাজি মামুন,
আসলেও অদ্ভুত মিল। ব্যাপারটা চমৎকার ধরেছেন। আমি খেয়ালই করিনি। :))
আমি নির্বাচন ওভাবে ফলো করতাম না। কারণ, আমেরিকার সিস্টেমটা বুঝতাম না। এবারেরটা পুরোপুরি ফলো করার ইচ্ছে আছে। দেখা যাক।
ভালো থাকবেন।:-)
@মইনুল রাজু,
ইংরেজদের খাওয়ার অবস্থা দেখেন নাই। খেতে বসলে আর উঠার নামই ধরেনা। বহু বছর আগে রেষ্টুরেন্টে কাজ করতাম। এমনও হয়েছে সন্ধ্যা সাতটায় ঢুকে রাত একটায় বেরিয়ে গেছে। স্বামী-স্ত্রী না কি বয় ফ্রেন্ড-গার্ল ফ্রেন্ড আল্লায়ই জানে, ঘন্টার পর ঘন্টা কী যে কানাকানি করে। বিরক্ত হয়ে আমি মনে মনে বলতাম- হায়রে কাষ্টমার, তোদের এতো কী যে আছে বলার ভেবে অবাক হই।
@আকাশ মালিক,
আর কেন জানি না এদের প্রতিবেলার খাবার পরিমাণ এত বেশি থাকে। আমার দুইবেলার খাবার এরা একবেলাতেই খায়। 🙂
আম্রিকায় পড়ালেখার চাপ কেমন ? কম হলে ওহাইও স্টেইট ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্য চেষ্টা করতাম | আপনার লেখা আমার সবসময়ই ভালো লাগে |
@অঙ্কন,
সিমেস্টার শুরু হলে পড়ালেখার একটূ চাপ থাকে। প্রতি সিমেস্টার চার বা সাড়ে চার মাসের মত। কিন্তু, পড়ালেখা খুব সিস্টেম্যাটিক। আপনার ভালো লাগবে। চেষ্টা করতে পারেন।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। 🙂
@অঙ্কন, ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সেমিস্টারের বদলে কোয়ার্টার সিস্টেম চালু আছে। অর্থাৎ তিন মাসে একটা কোয়ার্টার। সামার কোয়ার্টারে তেমন কোন কোর্স অফার করা হয়না। অন্যান্য কোয়ার্টার চলাকালীন পড়ালেখার চাপ অনেক।
ওহাইও কে ভেড়ার সাথে তুলনা করে খুব বড় একটা উপকার করলেন। মিডওয়েস্টের স্টেটগুলোর কথা মনে হলেই কেন এমন লাগে তা এদ্দিনে বুঝতারলাম, গড্ডলের গতিবিধির কথা মনে পড়ে যায় বলেই বোধ হয় 🙂 । কেমন যেন কোন ক্যারেক্টার ছাড়া একটু বোরিং স্টেট এগুলা…
@বন্যা আহমেদ,
বন্যা’দি, কি আর বলবো। বুঝলাম কোস্টাল এরিয়া সমুদ্রের নিকটবর্তী হওয়ায় সেখানে ব্যবসা বাণিজ্যও বেশি হওয়ায় সেগুলো কিছুটা বেশী আকর্ষনীয়। কিন্তু, তাই বলে গ্র্যআন্ড ক্যআনিয়ন কিংবা ইয়েলোস্টোনটাও কি মাঝের স্টেইটগুলোতে থাকতে পারতো না! একদমই নিরামিষ মিডওয়েস্টের স্টেইটগুলো। আমি সেখানকার একটা স্টেইটে তিনবার গিয়েও তিন লাইন লেখা লিখতে পারি নাই। আসলেও বোরিং। 🙂