স্বর্গ। ঘন পল্লবিত, পুষ্পশোভিত আর কলকাকলিত উদ্যান। পাশেই কুল কুল করে বয়ে চলেছে স্ফটিকের ন্যয় স্বচ্ছ নহর। নহরটির এক সাজানো-গোছানো পাড়ে চিন্তিত মুখে বসে আছে সদ্য স্বর্গত এক পুণ্যাত্মা। পুণ্যাত্মার মন খারাপ। দুদিন হল সে স্বর্গে এসেছে, কিন্তু কিছুতেই একটা হিসাব মেলাতে পারছে না। ঈশ্বর-নির্দেশিকায় বলা হয়েছিল, ঈশ্বর ন্যয়বিচারক। তাছাড়া বার্তানির্দেশকও এই ধারনাই প্রচার করেছিলেন যে, মানব জাতি তার কৃতকর্ম অনুযায়ী ফল ভোগ করবে। প্রতিটি চুল পরিমাণ কাজেরও হিসাব রাখা হচ্ছে। কিন্তু স্বর্গে এসে পুণ্যাত্মা দেখতে পাচ্ছে, কার্য অনুসারে ফল পাচ্ছে না এখানকার বাসিন্দারা। সম বন্টন সর্বত্র!

বিষয়টি সে নিশ্চিত হয় স্বর্গারোহরনের ঘন্টাখানেকের মধ্যেই। তাও নিজ দেশের এক অতি পরিচিতজনকে দেখে। প্রায় এক কুড়ি হুর বগলদাবা করে ঐ ব্যক্তি চিত্ত সুখে মৌ মৌ করে বেড়াচ্ছিল স্বর্গোকুঞ্জে। জিজ্ঞেস করতেই লোকটি উদ্ভাসিত মুখে জানাল, স্বর্গের রক্ষীরা নাকি আদেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাজির করে যত খুশ, তত হুর। হুরদের নরম বাহু-ডোরে আবদ্ধ হয়ে লোকটি হেলে-দুলে এগিয়ে যাচ্ছিল একটি ঢেউ খেলানো দুগ্ধ নহরের দিকে। দৃশ্যটা দেখে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিল পুণ্যাত্মার! ব্যাপারটি তার কাছে ঘোরতর অবিচার মনে হল। কেন, লোকটি কি দুনিয়ায় তিন-তিনজন বিবি নিয়ে সুখের সংসার পাতেনি? তাছাড়া কিই বা এমন করেছে সে বিধাতার খেদমতে? হ্যাঁ, নিয়মমাফিক উপাসনা করেছে বটে। তবে এছাড়া আর বলার মত কি করেছে সে? অথচ পুণ্যাত্মা তার জীবন-যৌবন সব কিছু কি বিলিয়ে দেয়নি মহাপ্রভুর ডাকে? কতই বা বয়স হয়েছিল তার? ২৫ বছর বড়জোড়! বিয়ে থা করে, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-উপাসনা-উদরপনা নিয়ে ভালমতই তো জীবনটা কাটাতে করতে পারত সে! কিন্তু বিধাতার অমোঘ আহবানে পুণ্যাত্মা পৃথিবীর মায়া ভুলতে দেরি করেনি, হাতে তুলে নিয়েছে মারণাস্ত্র, হয়েছে আত্মঘাতী। আর আজ কিনা পৃথিবীর রূপ রসে আমৃত্যু মত্ত থাকা একটি লোক তার সমান সুবিধা ভোগ করবে স্বর্গে? এও কি মেনে নেয়া সম্ভব? এই কি ঈশ্বরের ন্যায়বিচার? নাহ, বিষয়টি নিয়ে ঈশ্বরের সাথে কথা বলতেই হবে!

পুণ্যাত্মা কষ্টে-সৃষ্টে ঈশ্বরের সাথে দেখা করার অনুমতি লাভ করে। দুরুদুরু বুকে শুধোয় ঈশ্বরকে, – “আমার একটি প্রশ্ন ছিল, মহা প্রভু!”
ঈশ্বর স্পষ্টতই বিরক্ত পুণ্যাত্মার উপর, -“দেখ বাছা, তুমি কি প্রশ্ন করবে তা আমার অজানা নেই। আমি খুব রুষ্ট হয়েছি তোমার আচরণে। স্বর্গে এসেছো তুমি দুদিন হল। আমার দেয়া উপহারসমূহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চতুর্দিকে। উজাড় করে দেয়া আছে আমার দয়ার ভাণ্ডার। অথচ সেদিকে তোমার খেয়াল নেই। তুমি বসে আছ আমার সিদ্ধান্তের সঠিকতা নিরূপণে। তোমার এহেন আচরণে আমি কিন্তু যারপরনাই হতাশ!”
পুণ্যাত্মা যথেষ্টই ভড়কে যায়; তবু সাহস সঞ্চয় করে বলে,-“মার্জনা করবেন, প্রভু! আপনার সিদ্ধান্তের উপর আমার অবিচল আস্থা ছিল এবং থাকবে। তবে বার্তানির্দেশক বলেছিলেন, আপনি সূক্ষ্ম হিসাবরক্ষক! তাই বলছিলাম কি, আমরা যারা আপনার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করিনি, তারা কি পার্থিব সুখ ভোগকারী অন্য স্বর্গবাসীদের সমান সুবিধাপ্রাপ্ত হব, নাকি কিঞ্চিত বেশী বরাদ্দ থাকবে আমাদের জন্য? তবে সবকিছুই কিন্তু মহাপ্রভুর ইচ্ছা! আপনি যা জানেন, আমরা তা জানি না। আপনি যা বোঝেন, আমরা তা বুঝি না। আমরা আপনার অধম-অজ্ঞান বান্দা মাত্র!”
মহাপ্রভু এবার মহা-ক্ষিপ্ত হলেন,-“তুমি তো মানুষ সুবিধার নও দেখছি! রক্ষীগণ তাহলে ঠিকই বলেছিল! মানুষকে কখনোই পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না! তোমাকে স্বর্গে উঠিয়েও দেখি সন্তুষ্ট করা যাচ্ছে না! কি সব আজে-বাজে প্রশ্ন করছ! আচ্ছা বলি, স্বর্গে বসে তোমার এত হিসাব কষার দরকারটা কি? দুনিয়ায় তো অনেক কস্ট করেছ আমার হুকুম তামিল করতে গিয়ে। এখন খানিক শান্তি কর না, বাপু। যাও না, খাও, দাও, আর ফুর্তি করো গিয়ে।”
পুণ্যাত্মা আবারও বেয়াড়া প্রশ্ন করে বসে,-“শুধু খেয়ে-দেয়ে আর ফুর্তি করেই স্বর্গের লাইফটা পার করে দেব, প্রভু? খানা-পিনা-ফুর্তি তো আম্রিকাতেও পাওয়া যায়, তাইলে আমি স্বর্গের জন্য আত্মাহুতি দিলাম কেন, প্রভু? আম্রিকার জন্য দিলেই তো পারতাম!”

প্রভু রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন,-“তুমি তো দেখছি মহামূর্খ? আম্রিকা কয়দিনের? আর স্বর্গ কয়দিনের? মাথাটা একটু খেলানোর চেষ্টা করো এখন থেকে, বুঝলে?”
পুণ্যাত্মা আপোষের সুরে বলে,-“ঠিক আছে, বুঝলাম প্রভু! স্বর্গের জীবন অনন্তকালের আর আম্রিকার জীবন ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু অনন্তকাল এই হুরদের সংগে কিভাবে কাটাব, সেই ভাবনাতেই তো পেরেশান হয়ে যাচ্ছি, প্রভু! আমার তো এক মেয়েমানুষে কয়দিন পরই অরুচি ধরে যায়!”
প্রভু ধৈর্য ধরে রাখেন,-“কেউ বলছে তোমারে, এক মেয়েমানুষ নিয়েই কাটায় দিতে হবে? তুমি প্রয়োজন-মাফিক বদলায় নিতে পারবা, যত খুশ, তত হুর!”
“কিন্তু প্রভু, অন্যের ছোঁয়া জিনিসে আমার আবার এলার্জি আছে”–পুণ্যাত্মার মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে।
“আসলে সমস্যা হয়েছে কি জানো, তুমি স্বর্গের বাসিন্দা, কিন্তু তোমার আত্মা নরকীদের মত। তোমার স্রস্টা তোমার জন্য নিত্যনতুন হুর পয়দা করার ক্ষমতা রাখে কিনা, কও?”- হতাশ কণ্ঠে বলেন প্রভু।

যদিও স্রস্টার তৈরি স্বর্গীয় হুর পার্থিব হুরদের মত বেহুশ করতে পারে না পুণ্যাত্মাকে, তবে তা নিয়ে আর ঘাটাতে মন চাইলো না মহান প্রভুকে। বরং বলল,-“মার্জনা করবেন, প্রভু! আপনার ক্ষমতা জানি বলেই তো জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে মৃত্যুর কোলে সপে দিয়েছি নিজেকে। তবে একটা বিষয় এখনো মাথায় ঢুকছে না আমার! স্বর্গের অফুরান-অনিঃশেষ ফলভোগের সময় কোন সংযম অবলম্বন করতে হবে কি? মানে, কোন নিয়ম-কানুন মানা লাগবে কিনা?”
প্রভুর ধৈর্যবাধ ভেঙ্গে যাচ্ছিল! কাহাতক সহ্য হয় একটা আম-আদমির বেহুদা আর অসংলগ্ন কথাবার্তা! নেহায়েত আত্মঘাতি বোমাবাজ ছিল, নইলে কখন যে ঘাড় ধরে….। যাহোক, অনেক কস্টে নিজেকে সামলে বলেন,-“আরে বেকুব, নিয়ম-কানুন-সংযম তো পৃথিবীর জন্য। স্বর্গে তোমার কোন সংযম করা লাগবে না, যত খুশি বেহিসাবি জীবন যাপন কর তুমি, আমি কোন বাধা দেব না। এখন ভাগো এখান থেকে, স্বর্গ ভোগে নেমে পড়, যাও! দেরি করো না।”

পুণ্যাত্মা বলে উঠল,-“সত্যি বলছেন, প্রভু? স্বর্গে কোন নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করা লাগবে না? আহা, পৃথিবীতে কতই না মন চাইত হাই স্পিডে বাইক চালাব! কিন্তু প্রতি পদে পদে বাধা আর বাধা। আর এখানে আমি চাইলেই হাই স্পিডে বাইক চালাতে পারব? রাস্তার সব্বাইকে টপকে যেতে পারব?”
প্রভু উৎসাহভরা কন্ঠে বলেন,-“’আলবত পারবা। স্বর্গ তো পয়দাই করছি তোমাদের মন মাফিক মর্জি পূরণের জন্য। তবে তোমার মাথা কিছুটা আউলা আছে! নইলে, তুমি প্রভুর কথার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ করতা না। ”
পুণ্যাত্মা এরপরও সন্দিগ্ধ স্বরে বলে,-“কিন্তু রাস্তার অন্য সবাইও যদি আমার মত হাই স্পিডে চলতে চায়, তা হলে কি হবে প্রভু? সবাই যদি সবাইকে টেক্কা দিতে চায়, বেহিসাব-বেনিয়মের মহা-সর্গ পেয়ে? কোন মহা-সংঘর্ষ বাধবে না তো আবার, প্রভু? মানে, টেক্কায় টেক্কায় টক্কর আরকি?”

প্রভুর গলা খানিক চড়ে যায় এবার,-“সে চিন্তা তোমার নয়, বৎস! তুমি তোমার ইচ্ছামত বে-নিয়ম করে যাবে, ব্যাস। তবে তুমি এত কিছু থাকতে বাইক নিয়ে মাতলে কেন বুঝতে পারছি না! ওই যে সুন্দর সুন্দর নহর দেখতে পাচ্ছ, ওগুলি কি তোমাকে টানে না? মন চায় না অপরূপা হুর নিয়া সেখানে সাতার কাটতে?”’
পুণ্যাত্মা বেরসিকের মত বলে বসে,-“আমি পানির দেশের মানুষ, প্রভু! খাল-বিল কম দেখি নাই। তাই নহর বুঝি আমাকে অত টানে না। বরং, এইখানে স্বর্গে আপনি আমাকে একটা আম্রিকা বানায় দেন, তাতেই আমি খুশী থাকব।”

প্রভু ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন,-“’আম্রিকার মত একটা শয়তানাস্থান তোমাকে এতটা আকৃষ্ট করল কি করে, বুঝতে পারছি না! আমার স্বর্গত বান্দারা আম্রিকারে ভালবাসতে পারে, এটা কখনোই ভাবি নাই!”
পুণ্যাত্মা বলল,-“’আম্রিকা আকৃষ্ট করবে না তো, আফ্রিকা করবে নাকি, প্রভু? আম্রিকার মানুষের কত আনন্দ! ক্যাসিনো, ডিসকো, বার, জুয়া, লিভিং টুগেদার…তাছাড়া আপনিই তো বলেছেন, স্বর্গে অন্তত বেহিসাবি জীবন যাপনে কোন বাধা নাই।”’
প্রভু হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বলেন,-“ঠিক আছে, তুমি আম্রিকার লাইফ, বেহিসেবি জীবন- সব পাবা এইখানে। এবার সন্তুষ্ট? দয়া করে, এখন ক্ষান্ত দাও। তোমার হিসাব-নিকাশ বন্ধ কর।”

পুণ্যাত্মা বলে,-“শুধু আর একটা কথা ছিল, প্রভু! দুনিয়াতে আমি তেমন কিছু পাইনি! এখানে আমি সম্পদশালী হতে চাই।”
প্রভু রেগে বলেন,-“তো তোমাকে কেউ নিষেধ করেছে? তোমাকে তো ব্লাঙ্ক চেক দিয়ে রাখা আছে। তুমি শুধু আমার রক্ষীদের বল্বে, কি কি সম্পদ তোমার দরকার। দেখবে তৎক্ষনাৎ হাজির হয়ে যাবে তোমার খেদমতে।”
পুণ্যাত্মা বলে,- “’ইয়ে প্রভু, শুধু সম্পদশালী হয়ে আমার কাজ নেই। আমার চাওয়া অন্যদের থেকে বেশী সম্পদশালী হওয়া। বিশেষ করে, আমার দেশের সেইসব স্বর্গত মানুষ, যারা পৃথিবীতে আমার রিক্ত অবস্থা দেখে দয়া করেছে আমাকে, তাদের থেকে বেশী সম্পদশালী হতে পারলে পরম তৃপ্তি বোধ করব আমি।”

প্রভুর মনে হয় ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে, যেকোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটবে,-“’তুমি তো দেখছি বড্ড আজব লোক হে, সম্পদ চাইছ ভোগের জন্য না, লোক-দেখানোর জন্য। নাহ, তুমি আসলে স্বর্গের উপযুক্ত নও।”
পুণ্যাত্মা ভিতরে ভিতরে বেশ কুঁকড়ে যায়,-“ক্ষমা করুন প্রভু। ঠিক আছে, অন্যের চেয়ে বেশী সম্পদশালী করার দরকার নেই আমাকে। তবে আপনার বার্তাবাহক বলেছিলেন যে, কাউকে কাউকে স্বর্গে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হবে। যেমন, কেউ হবে সর্দার, কেউ হবে সর্দারনী। তাই জানতে চাচ্ছিলাম, স্বর্গের এই অঞ্চলটি যেখানে আমার বসবাস, সেখানে কি কোন সর্দার নিয়োগ করা হয়েছে? জানা থাকলে তার কথামত চলতে পারতাম। ভুল ত্রুটি হলে শুধরে নিতে পারতাম নিজেদের।”
প্রভুর কণ্ঠ্যে এবার সত্যি সত্যি বিস্ফোরণ,-“’খামোশ, তোমার সাহস তো কম নয়! আমার রাজ্যে থেকে তুমি সর্দারের কথামত চলবে? দুনিয়াতেও তোমরা বরাবর এক কাজ করেছো! আমি যাকে পাঠাতাম নসিহতে, তাকেই কিনা তোমরা স্রষ্টা বানিয়ে ফেলতে? তোমাকে স্বর্গ থেকে ছুড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছা করছে আমার!”’

ভয়ানক ভয় পেয়ে যায় পুণ্যাত্মা! জিভ কেটে বলে,-“মার্জনা করবেন, প্রভু! যাতে আপনাকে বিরক্ত করতে না হয়, সেজন্যই একজন সর্দারের কথা বলছিলাম! আমাকে ভুল বুঝবেন না, প্রভু!’’ এরপর পুণ্যাত্মা আর কথা না বাড়িয়ে লুটিয়ে পড়ে প্রভুর সামনে; ভক্তিরসের বানে পুণ্যাত্মার নিথর দেহ মৃতের মতই পড়ে থাকে প্রভুর প্রাসাদে!
ভোগের সামগ্রী নিয়েই যেখানে মেতে থাকে বেশিরভাগ স্বর্গত, সেখানে পুণ্যাত্মার এই সর্বাঙ্গ প্রণামে মুগ্ধ না হয়ে পারেন না প্রভু! তার রাগ কিছুটা দমে আসে। এক সময় বলেন,-“ঠিক আছে, উঠ, উঠে দাঁড়াও। যাও, তোমাকেই এই অঞ্চলের স্বর্গত বাসিন্দাদের সর্দার করে দেয়া হল। কি এবার খুশিতো? তোমার চাওয়া-পাওয়া পূর্ণ হয়েছে নিশ্চয়? আর কোন বাড়াবাড়ি করবে না, বুঝতে পেরেছো? যাও এখন, বেরিয়ে পড় স্বর্গের চিরহরিৎ প্রান্তরে। ভোগ কর যথেচ্ছা, যথাতথা!”

পুণ্যাত্মাও বেজায় খুশি! পুলকিত চিত্তে ফিরে চলে প্রভুর প্রাসাদ থেকে, যাহোক, অনেক দরকষাকষি করে হলেও সর্দার পদটি বাগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে মহান প্রভুর কাছ থেকে। অন্য স্বর্গতদের তুলনায় তার শ্রেষ্ঠত্ব এবার নিশ্চিত হয়েছে। দুনিয়ার বলিদান সার্থক হয়েছে। কে বলে, আত্মঘাতিদের জায়গা নরকে? এত বড় পুরুস্কারপ্রাপ্তির পরও এ কথা তাকে বিশ্বাস করতে হবে?

কিন্তু পুণ্যাত্মার সুখানুভূতিতে ব্যাঘাত ঘটে হঠাৎ। একটি গোলমালের শব্দ; পেছন থেকে। ঈশ্বরের দরবার থেকেই ভেসে আসছে যেন! নিশ্চিত হওয়ার জন্য পুণ্যাত্মা পিছু ফিরে, গিয়ে যা দেখতে পায়, তার জন্য অবশ্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না সে। শত শত স্বর্গত, সব তারই এলাকার, ভিড় জমিয়েছে বিধাতার চারপাশে; উচ্চস্বরে কি যেন বলছে তারা!

স্তম্ভিত হয়ে যায় পুণ্যাত্মা! ভাল করে কান পাততেই শুনতে পায়, ওরা বলছে,- “না প্রভু, এ আমরা কিছুতেই মেনে নেব না। স্বর্গে এসেছি আমরা ভোগ করতে। কোন সর্দারের হুকুম তামিল করতে না। এখানে কোন সর্দার-মর্দার থাকতে পারে না। আমরা সবাই স্বাধীন। হ্যা, স্বাধীন। আর এমনই আশ্বাস দেয়া হয়েছিল আমাদের।”
প্রভুর মুখ নিঃসৃত ‘স্বর্গ থেকে উৎখাতের’ হুমকিতেও কোন কাজ হচ্ছে না! এক সময় প্রভু রক্ষীদের হুকুম দেন,-“উল্লুকগুলোকে ঘাড় ধরে নরকে ফেলে দিয়ে আয় তো!” এক সঙ্গে অনেক স্বর্গতের মিলিত প্রতিবাদধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। ওদের ভিতর থেকে একজন বলে উঠে,-“আপনি আমাদের নরকে নিতে পারেন না! কারণ নরকে যাওয়ার শর্ত হল, পৃথিবীতে আপনার হুকুম-আহকাম না মানা। কই, আমরা তো তা করিনি। আর এই জন্যই তো আমরা আজ স্বর্গে।”

প্রভুর আওয়াজ পাওয়া যায় এবার,-“ও আচ্ছা, আমার হুকুম তাহলে শুধু পৃথিবীর জন্যই? স্বর্গে তা মানার দরকার নেই, তাই না? যত সব আহাম্মকের দল!” আবার সমবেত কণ্ঠে রব উঠে। দলের আর এক স্বর্গত বলে উঠে,-“অবশ্যই আপনার হুকুম মানার দরকার নাই স্বর্গে। কারণ আপনিই তো বলছেন, স্বর্গে কোন নিয়ম নাই, কানুন নাই।”

প্রভুর বজ্র নিনাদ শুনতে পাওয়া যায় এবার,-“বটে, তাহলে তোমাদের পৃথিবীতেই পাঠিয়ে দেব ক্ষণ।” স্বর্গত দলটি থেকে একজনের তেজোদীপ্ত কন্ঠস্বর ভেসে আসে,-“দেন পাঠায়ইয়া পৃথিবীতে। কোন সমস্যা নাই। দাসত্ব করতে হইলে পৃথিবীতেই করমু। স্বর্গে ক্যান?”

অ্যাডাম-ইভের পর স্বর্গের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মত এই ঘটনা ঘটে। স্বর্গে মহা গোলযোগ বাধাতে, একটি বিশাল সংখ্যক মানুষকে পাঠিয়ে দেয়া হয় পৃথিবীতে। স্বর্গ কিছুতেই ধরে রাখতে পারছিল না ঐ মানুষগুলোকে। তাদের কাছে স্বর্গের হিসাব-নিকাশ যে বড্ড গোলমেলে ঠেকছিল!