ছোট বেলায় মাঝে মাঝে দেখতাম আমার কিছু কাজিন, কাকা ও পাড়া-প্রতিবেশী এয়ার-গান কাঁধে নিয়ে শিকারি বেশে চোখেমুখে যথাসম্ভব বীরের মত অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে শিকারে বের হত। এবং দিনান্তে কয়েকটা গুলিবিদ্ধ, আহত ও নিহত কাক হাতে নিয়ে দোলাতে দোলাতে বিশ্বজয়ের গৌরবের মত সম গৌরবান্বিত হাসি হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরত। আশেপাশের বাড়ি বাড়ি ঘুরে সবাইকে তাদের স্বহস্তে গুলি ক’রে মারা কাকগুলো দেখিয়ে অনাবিল তৃপ্তি , আনন্দ ও বীরত্ব অনুভব করত। কোন এঙ্গেল থেকে বোকা কাককে তীক্ষ্ণবুদ্ধি খাটিয়ে গুলি করেছে, কীভাবে পায়ের আঙুল চুপিসারে টিপে টিপে নিঃশব্দে এক’পা আধ’পা ক’রে এগিয়ে গেছে গুলি ছোঁড়ার যথোপযুক্ত দূরত্বে আর বেকুব কাকটি বুঝতেই পারেনি! এক গুলিতেই কুপোকাত করল কাক ব্যাটাকে , এ-কি সোজা বুদ্ধির খেলা! কীভাবে গর্ধব কাকটির গোবরভর্তি মস্তিষ্কে বা হৃৎপিণ্ডে বা পাখায় তাক ক’রে নিশানা ছোঁড়া হয়েছিল, নির্ভুল নিশানায় কাকটি বিদ্ধ হয়ে অতি কর্কশ-কণ্ঠে অহেতুক বিশ্রীভাবে চিৎকার করতে করতে ইহলোক ত্যাগ করেছে সেসব বীরত্বপূর্ণ কাক-মারা ইতিহাস বর্ণনায় নিজেরাই কয়েকদিন বেশ মুখরিত থাকত।

দর্শক-শ্রোতাগণও বীর কাক-শিকারিদের বীরত্বের কাহিনী নিজকানে শুনে এবং তাজা রক্তমাখা কালো কুৎসিত মরা কাকগুলোর মৃতদেহ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ ক’রে বারে বারে অভিভূত হত। আরে বাহ এরা তো প্রকৃত বীর! এ তো হাতে নাতে চাক্ষুষ প্রমাণ! তারা শিকারিদের উদ্দেশ্যে কিছু প্রশংসাবাক্য এবং আশীর্বাদবাক্যও উচ্চারণ করত। যেমন; ছেলের নিশানা কী দারুণ! এই ছেলে তো যেনতেন ছেলে নয়, একদিন অনেক বড় হবে। ইত্যাদি। কাক শিকার ও মরা কাক দেখে আমিও যে উল্লসিত হতাম না , তা কিন্তু নয়! ছোট ছিলাম বুদ্ধি-বিবেচনা তো ছিলনা। এখন মনে পড়লে মনে হয় কত নিষ্ঠুরই না ছিল সে উৎসব! ঠিক যেন ক্ষুদ্র জলাশয়ে ঢিল ছুঁড়ে ব্যাঙাচি হত্যা করার মত।
কারো উল্লাস, আর কারো জীবননাশ!

আমার পরিচিতদের মধ্যে কেউ কাকের মাংস খায়না। তবে কেন ওরা কাকগুলোকে শুধু শুধু খেলাচ্ছলে মেরে ফেলে দিত! কারণ হচ্ছে কাক মেরে মেরে ওরা ওদের হাত ও নিশানা পাকা করত। শিকারে আত্মবিশ্বাস এবং সাহস বাড়াত। এভাবে কাক মারতে মারতে পোক্ত শিকারি হয়ে ওরা ক্রমে ক্রমে শিকার করতে শুরু করত বক, ময়না, টিয়া, বুলবুলি প্রভৃতি। একেকদিন একেকটা নতুন নতুন ধরনের পাখি মেরে ওরা রাজ্যজয়ের উল্লাসে আত্মহারা হত। সবার বাহবা পেয়ে আরো বেশি বেশি উৎসাহী হয়ে উঠত আরো আরো শিকারে। বিপুল পরিমাণে বাহবা, আত্মবিশ্বাস ও সাহস সঞ্চয় ক’রে ওরা একদিন সমুদ্র-উপকূলে চ’লে যেত ঝাঁকে ঝাঁকে শীতের অতিথি পাখি শিকার করার জন্যে। সৌভাগ্যের জোরে দুই একজনের ভাগ্যে এয়ার-গানের স্থলাভিষিক্ত করেছিল সত্যিকারের বন্দুক । অবশ্য বন্দুকগুলো লাইসেন্স করান ছিল।

শিকারের নেশা ওদেরকে পেয়ে বসত। শীতের মৌসুমে এটাকে মৌলিক চাহিদার মত মনে হত ওদের। একদিক থেকে বিবেচনা করলে অবশ্য মৌলিক চাহিদাই বটে! খাদ্যের যোগাড়! প্রাকৃতিক ইকো-সিস্টেমের আওতাভুক্ত সবার তো খাদ্য-খাদক সম্পর্ক! কেউ খাদ্য, কেউ বা খাদক। কনকনে শীতের চিনচিনে কুয়াশাভরা রাতে সারা রাত চলত আড্ডা, জল্পনা-কল্পনা, পরিকল্পনা। সাথে চলত শীতের মজাদার পিঠে-পায়েস, গরুর দুধের চা, খেজুরের গুড়ের মোয়া, আরো কত কি! পরিকল্পনা হত কাল কোন জায়গায় শিকারে যাবে, ক’জন যাবে, কে সামনে থাকবে, কে পেছনে থাকবে ইত্যাদি। নিদ্রিত, নিস্তব্ধ নিশি-ভোরে কয়েকটা মোটরবাইকে একযোগে মারাত্মক আওয়াজ তুলে ওরা ছুটত শিকারের উদ্দেশ্যে। একেকটা বাইকে কমপক্ষে তিনজন বসত। অভিযাত্রীদের মধ্যে মাত্র ক’জন ছিল শিকারি। বাকিরা কেউ দর্শক, কেউ সহায়ক, কেউ উৎসাহদাতা। কেউ বা শিকারকরা পাখিগুলো বাইকের পেছনে ব’সে দু’হাতে ধরে দেশবাসীদেরকে নেড়েচেড়ে দেখাতে দেখাতে বাড়িতে বহন করে আনার দায়িত্ব পালন করতে যেত। সকাল ৯-১০টার মধ্যে ভোম ভোম শব্দে মোটর-বহর এসে হাজির হত বাড়িতে। উঠোনে পড়ত বিভিন্ন প্রজাতির, বিভিন্ন আকারের, বিভিন্ন বর্ণের আহত-নিহত পাখির স্তূপ। চারদিক থেকে সে দৃশ্য দেখতে হাজির হত অনেক দর্শনার্থী। সৌভাগ্যবানদের ভাগে দু’একটা মরা পাখি প’ড়েও যেত। এই রকম দৃশ্যের অবতারণা অনেক বাড়িতেই হত। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলেও হয়। কোনো কোনো অঞ্চলে পশুও শিকার করা হয়। যেমন; হরিণ, ভালুক ইত্যাদি। পক্ষীমাংস-ভোজ উৎসব চলত কয়েকদিন ব্যাপী, খুব ধুমধাম ক’রে। বিশেষ বিশেষ আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িও পাঠান হত আস্ত পাখি বা রান্না করা পক্ষীমাংস।

আজকাল টিভি দেখতে বসলে ছোট্ট বেলার এইসব স্মৃতিগুলো মনে প’ড়ে যায়। প্রায়শই টিভিতে খবরে দেখতে পাই যে পাখির মত ক’রে কিছু প্রাণীকে গুলি ক’রে মেরে ফেলা হচ্ছে; গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের গণতান্ত্রিক নির্দেশে। এই প্রাণীগুলো অবশ্য পাখাবিশিষ্ট নয়, হাত-পা বিশিষ্ট; দেখতে মানুষের মত। এদের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহও স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে দেখান হয়। এদের পাখির মত বা জীবাণুর মত মৃত্যুতে অনেক শান্তিপ্রিয় মানুষ বেশ শান্তি ও স্বস্তির নিঃশ্বাসও ফেলে থাকে। অনেকেই উল্লসিত হয়। এই মানুষগুলোর পাখি-মৃত্যুতে বিশ্বের দরবারে সব সময় একই সংবাদ পেশ করা হয়। যেমন;মরা অমুক বিরাট দাগী আসামী ছিল, সে খুনী-চোর-ডাকাতও ছিল। এলাকাবাসীরা তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল, পুলিশ অনেকদিন ধরে তার পিছু নিয়েও তার কোনো হদিস পাচ্ছিল না। পরিশেষে র্যা বের সাথে ভয়ানক ক্রসফায়ারিং হয়। প্রথমে সে গুলি ছোঁড়ে, শেষে প্রাণ বাঁচাতে র্যা বও পাল্টা গুলি ছোঁড়ে। দু’পক্ষের বন্দুকযুদ্ধ চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। এক পর্যায়ে র্যা বের নিষ্ঠা এবং আল্লা ও সরকারের রহমতে র্যা ব সক্ষম হয় দাগী আসামীর ইহলীলার অবসান ঘটিয়ে দিতে। মারহাবা র্যা ব, মারহাবা, বাহবা। মৃত দাগীটির মৃতদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে লুকান অবস্থায় পাওয়া যায় কাটা রাইফেল, তালি-দেয়া রাইফেল, পিস্তল, বন্দুক, এ কে ৪৭, আরো নাম না জানা অনেক অনেক মরণাস্ত্র। এবং সে অস্ত্রগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে বিশ্ববাসীকে প্রদর্শন করান হয়। এতসব তথ্য-উপাত্ত দেখে ঈমান আনতে অনেকেই বাধ্য হয় যে এ-তো আসলেই মহাসন্ত্রাসী ছিল! মানবজাতি ও মানবসভ্যতার তরে বিশাল হুমকি স্বরূপ ছিল। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে আসামীর সাথে এতগুলো অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত ক্রসফায়ারিঙে কোনো র্যা ব আহত বা নিহত হয়নি! র্যা বের উপরে আল্লার বিশেষ রহমত আছে , এ বিষয়ে ঈমান আনতেই হয় ।

কোনো মানুষ অপরাধী হলেই তাকে কীট-পতঙ্গের মত মেরে ফেলে দিতে হবে! তাহলে দেশে সরকার বা আইনের কী দরকার! আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার করতে যদি সরকার ব্যর্থ বা অক্ষম হয় সেটা কার অক্ষমতা বা ব্যর্থতা? “অপচয়কারী শয়তানের ভ্রাতা” তাই হয়ত এই স্বল্প খরচের আইন প্রবর্তন করা হয়েছে অনেক বিবেক-বুদ্ধি খরচ ক’রে। আসামীদের খাওয়ানো, পরানো , তাদেরকে প্রহরী দ্বারা পাহারা দেওয়ানো ইত্যাদি ইত্যাদি জিনিস অনেক খরচান্ত ব্যাপার। তাছাড়া জেল-হাজতে জায়গারও সংকুলান হচ্ছেনা। দেশেও জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটেছে। অল্প খরচে সব জটিল সমস্যার আশু সমাধান! এক গুলিতে অনেক সমাধান। একটা গুলি ছুঁড়লে একটা দাগী শেষ। মামলা খতম। এত কম খরচ ও কম ঝামেলায় এমন সুবিচারের সুব্যবস্থা পৃথিবীর আর কোন দেশে আছে? দেশের এতসব বড় বড় সমস্যার কথা ভেবেই মনে হচ্ছে এমন একটি মহান আইন চালু করা হয়েছে। এই মহান আইন যারা পরিকল্পনা করেছেন ও তা বাস্তবে প্রবর্তন করেছেন তাদের বুদ্ধিমত্তা প্রশংসার দাবীদার।