শকুর পেয়াদা এখন ট্রাক চালায়। শকুরকে জীবনে জীবিকার জন্যে অনেক কিছুই করতে হয়েছে। সে প্রথম রোজকেরে হয় মা-র গলার রুপার হারটা বিক্রি করে। মা-র যে ভুলো মন- সবাই ধরে নিয়েছিল হারটা মিয়া বাড়ির পুকুরের পেটেই গেছে। কিছুদিন পরেই শকুরের ছোট চাচা বিয়ে করে ঘরে বউ আনলো। বউ তো নয় যেন জল টলটলে পুকুর, দেখলেই লাফ দিতে ইচ্ছে করে। শকুরের উঠতি বয়স- সবে সেয়ানা হতে শুরু করেছে। বিয়ের দিন সাতেক যেতে না যেতেই এক অমাবস্যার অন্ধকারে বৌয়ের গলাই হাত মারলো শকুর। অন্ধকারে হাতটা গিয়ে কোথায় পড়লো কে জানে – বৌয়ের সেকি চিৎকার, শকুরের পিলে চমকানোর জোগাড়! পিছন থেকে চাচা এসে দিলো কষে এক ঘা। তারপর বেদম চড় থাপ্পড়। ছিঃ! তুই শেষ পর্যন্ত আপন চাচীকে…! তোকে যেন এই গাঁয়ের ত্রিসীমানায় আর না দেখি! শকুর সেদিন বলতে পারেনি, শরীর না তার নজর পড়েছিল চাচীর গলার চকচকে হারটির দিকে। ওই রাতেই গাঁ ছেড়েছে শকুর। চোর বললে না হয় একটা কথা ছিল, যে অপবাদ জুটেছে তাতে চাচা না বললেও শকুর এ গাঁয়ে আর থাকতো না।

কুষ্টিয়া শহরে এসে শকুর একটা গাড়ির গ্যারাজে কাজ জুটিয়ে নিলো। কয়দিন পর গ্যারাজ থেকে উঠে পড়লো গাড়িতে – কিছুদিন হেলপার-গিরি করলো। একদিন গাড়ির সুপারভাইজারের পকেট থেকে কিছু টাকা হাতিয়ে নেমে পড়লো আরিচার ঘাটে, তারপর আর এদিকটাই ফেরেনি। সে মাছ ব্যবসা থেকে শুরু করে, কাঁচামালের ব্যবসা, নাইট-ডিউটি, রিকশা চালানো – কী না করলো!

এখন তার বয়স ৬০ ছুঁইছুঁই। তবে বলে নেয়া ভালো- বর্তমান গল্পটি শকুরকে নিয়ে নয়। যারা ইতোমধ্যে শকুরকে নিয়ে খুব আগ্রহী হয়ে উঠেছেন, তাদেরকে বলছি, আরো বেশি হতাশ হওয়ার আগেই যেন তারা ফেলে রাখা কাজে ফিরে যায়।
আমার এই গল্পের প্রধান চরিত্র কল্পনা। কেউ বলে কল্পনা রায়, কেউ বলে কল্পনা খাতুন। আসল নামটা কি যেন ছিল, কল্পনা ঠিক মনে করতে পারে না কিংবা মনে করতে চায় না। কল্পনা থাকে যশোরের পতিতা পল্লীতে। সেই আট বছর বয়স থেকে এখানে আছে। এই পল্লীতে যারা আসে তাদের সবার একটা করে গল্প থাকে। কারও কারও গল্প খুব বেদনাদায়ক, শুনলেই শরীরের সবগুলো পশম দাঁড়িয়ে স্যালুট করে। কল্পনার গল্পটি তেমন নয়। খুব সাধারণ একটা গল্প। কল্পনার মা ঢাকায় একটি গার্মেন্টস-এ কাজ করতো। গাঁয়ের বাড়িতে ছিল একপাল মানুষ। বাবা অক্ষম, কাজ করতে পারত না, তার এই অক্ষমতা সে খানিকটা পুষিয়ে নিয়েছিল মধ্যরাতে মা-র জমিনে ঘন ঘন বীজ বপন করে। ফলে পরিবারের জনসংখ্যা বেড়েছে দিনে দিনে, বেড়েছে খাবারের চাহিদা। এই চাহিদার সিংহভাগ কল্পনার মাকেই মেটাতে হতো। কাজ করে যা জুটতো তা থেকে খেয়ে কর্মে এক পয়সাও বাঁচতো না। কাজেই মাঝে মধ্যে তাকে ঢাকার সস্তা হোটেলগুলোতে নাইট-ডিউটি করতে যেতে হতো। একবার এক নাইট-ডিউটি চলা কালে তার সাথে সাক্ষাৎ ঘটে মোটা তাজা একটি লোকের। লোকটি কল্পনার মা-র প্রেমে পড়ে যায় তখনই। তারা বিয়ে করে সংসার পাতে বস্তির ছোট্ট একটি খুপরিতে। বছর পার হতে না হতেই জন্ম হলো কল্পনার। বেশ সুখের সংসার ছিল তাদের। কল্পনার বাবার বদ অভ্যাস বলতে- মাঝে মধ্যে নেশাটা একটু বেশি ধরলে কল্পনার মাকে হালকা মারধর করতো। নেশা ছাড়া সে আর পাঁচটা মানুষের মতোই খুব সাধারণ মানুষ। কল্পনার বয়স তখন পাঁচ কি ছয়, বস্তিতে ওরা যে ঘরে থাকে তার পাশের ঘরটিতে অল্প বয়সী একটা মেয়ে আসলো। কল্পনার মা-র মতোই গাঁ থেকে এসেছে। এক মাসের মাথায় মেয়েটি উধাও, সাথে কল্পনার বাবাও। কল্পনার মা-র গার্মেন্টস-এর কাজটা তখনো ছিল। বাবা হারানোর বছর পুজতে না পুজতে মাও গেল। একদিন সন্ধ্যায় ঘরের মালিক নজু চাচা তার লাল মরচে পড়া দাঁত বের করে বলল- তুই কাল থেকি আমার সাথে থাকবি। আমি নয়া ভাড়াটি তুলবু। তোর মা আর আসবি না। হেই আজ সকালে গার্মেন্টস-এ আগুন লেগি পুড়ি মরিচে। প্রথম থেকেই নজু চাচার সাথে কল্পনার খুব ভাব ছিল। তাই সে কল্পনাকে ফেলতে পারেনি। নজু চাচা খুব আদর করতো কল্পনাকে। প্রায়ই কল্পনাকে বুকের উপর তুলে কচি উরুতে হাত বুলাতে বুলাতে ঘুম পাড়াতো তাকে। একদিন নজু চাচা বললো- চল, তোরে আমি আমার বুনের কাছে র্যাবইখা আসি। দেখবি, মেলা মজা ল্যাগবি। প্রথম দিকে কল্পনা ভেবেছিল এটা এতিম খানা। তবে তার বয়সী হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া আর সবাই ধামরা, সব মেয়ে মানুষ। তাই এতিম খানা না হলেও এটা যে আশ্রম জাতিয় কিছু একটা সে ব্যাপারে সে নিশ্চিৎ ছিল। এখানে এসে তার খারাপ লাগতো না মোটেও। পেট পুরে খেতে পেত, স্নো পাউডার মাখতো। বিন্দু খালা ওকে জোর করে খাওয়াত। কল্পনাও বিন্দু খালা বলতে পাগল। শিশুরা পশুর মতো, ভালোবাসা আর মন্দবাসা ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না।

কল্পনার সেই সব দিনগুলোর কথা আবছা আবছা মনে আছে। সে পিছন ফিরে তাকালে দেখতে পায়- ভীষণ কুয়াশা, কিছুই ঠাওর করা যায় না। একভাবে তাকিয়ে থাকলে একসময় কুয়াশা কিঞ্চিৎ হটিয়ে একটা চাটায়ের ঘর দেখা যায়, কারা যেন ফিসফাস করে ভেতরে। থেকে থেকে একটা ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না শোনা যায়। খানিকটা এগিয়ে গেলে ঘরের ভেতরকার মানুষগুলোকে আবছা আবছা দেখা যায়। এটুকু অবলম্বন করেই কল্পনা বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকতে তার এখনো ভালো লাগে।
সময়ের সাথে সাথে বিন্দু খালার যত্ন-আত্মির মাত্রাও বেড়ে যায়। না খাওয়া শরীর একটু আদর যত্ম পেয়ে যেন বর্ষার নদীর মতো ফুলে ফেঁপে ওঠে। একদিন পূর্ণিমার রাতে, কল্পনার বয়স তখন বার কি তের হবে- কল্পনা সেদিন সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়েছিল – স্বপ্ন দেখলো – ভয়ঙ্কর একটি স্বপ্ন। একটা মানুষ কিংবা জন্তু একটি ধারালো তপ্ত চাকু দিয়ে কল্পনার শরীরের কোথায় কোথায় যেন ছেদ করে দিতে চাইছে! কল্পনা ভীষণ চিৎকার করছে কিন্তু কেউ কিছুতেই শুনছে না, স্বপ্ন তো ! সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখলো তার পা’জামা রক্তে ভিজে জবুথবু অবস্থা। কি সর্বনেশে স্বপ্ন রে বাবা! কল্পনা দিন পনের বিছানায় পড়ে থাকলো। বিছানায় শুয়ে আবার দেখলো সেই স্বপ্নটি। তারপর থেকে মাঝে মধ্যে দেখতো, আর রক্তে ভিজে যেত না কল্পনার পা’জামা। স্বপ্নে সব সয়ে গিয়েছিল বোধহয়। এখন প্রতি রাতে জেগে বসে স্বপ্নটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে কল্পনা।

কল্পনার বয়স এখন ত্রিশ ছুঁলো বলে। বেশ্যা বাজারে কাঁচা শরীর বিকোয় বেশি। এ কয় বছরে- রাত নেই, দিন নেই- কত ধকল গেছে শরীরটার উপর দিয়ে! কল্পনার মাঝে মধ্যে মনে হয় বাংলাদেশের প্রায় সব পুরুষই তার দেহটা নগ্ন করে মগ্ন হয়ে দেখেছে, মাতাল হয়ে মাতলামি করেছে ভিতরে ও বাইরে। এখন তার বিশ্রাম বড়ো দরকার। কিন্তু বাদ সাধে শরীরটা। কল্পনার শরীরের গাঁথুনিটা বেশ মজবুত, সেগুন গাছের মতোন পিটানো। বেশ্যা পল্লীতে বরাবরই সবাই হিংসে করেছে তাকে। আর সববাইকে হিংসা করেছে কল্পনা- গতরটা এতো দেখনা না হলে এতো ধকল যে তাকে সইতে হতো না! কোনো কোনো দিন এমন গেছে- এক সাথে পাঁচজন খরিদ্দার এসেছে, পাঁচ জনেরই চায় কল্পনাকে। কল্পনা লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে একে একে সকলের আগুন নির্বাপণ করে। এখন আবার ভারত থেকে একটা বড়ি এসেছে- গরু মোটা তাজা করন বড়ি। বিন্দু খালা কল্পনাকে নিয়ম করে কয়েক ডোজ খাইয়েছে। এ বয়সে গা গতরে একটু মাংস লাগলে বিকোয় বেশি। কল্পনার বাজার দর আবারও চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। এই পল্লীতে যে একবার এসেছে অথচ কল্পনার নাম জেনে যায়নি এমনটি হয়নি। দেখে শুধু আফসোসই হয়েছে অনেকের, আগে থেকে বুকিং না দিলে যে কল্পনা কপালে জোটে না! তারপর আবার তিনটা দেহের দাম সে একাই হাকায়। এসব দামদর খালায় করে, কল্পনার আয়ের একটা বড় হিসে্স এমপি, মন্ত্রী পর্যন্ত চলে যায়।

এ সপ্তাহে কল্পনাকে বুকিং দিয়েছে শকুর পেয়াদা। শকুর পেয়াদা দিন পনের যশোরেই থাকবে। এখন ফুলের মৌসুম যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ট্রাকে করে ফুল পৌঁছে দেয় শকুর পেয়াদা। ফুল নিয়ে কারবার করতে তার বেজায় ভালো লাগে। ফুলের ঘ্রাণ শুকতে শুকতে সে নারী দেহের নেশাটা ঝালিয়ে নেই। আজ রাতে প্রথম গেল সে কল্পনার কাছে। কল্পনা তখন ড্রেসিং টেবিলে সাজগোজ করছিল। বিন্দু খালা শকুরকে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে বলে গেল- মেহমান বাইরির, খাতির যেনে কম না হয়! কল্পনা আয়নাতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো শকুর পেয়াদাকে। কল্পনা আর নড়েও না, চড়েও না। শকুর কণ্ঠস্বরটা একটু পিচ্ছিল করে বলল- কই, এদিকে একটু আয় দিকিনে। তোর নাকি একিনে হেবি ডিমান। শকুর উঠে গিয়ে কল্পনার কাধে হাত রাখলে কল্পনা এক ঝটকায় হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল- সাহেব, আজ আমার শরীলডা ভালা না। পায়ে পড়ি, আপ্নে অন্য কুতাও যান। ফুল আছে, মেলা সুন্দরী, বয়সেও কাঁচা, ওকে ডেকে দিই? শকুরের কেমন মায়া হয় কল্পনার ওপর। ঠিক আছে, আমি জোর করবু না। কাউকি ডাকতি হবি না। এদিকে একটু আয়, আমার পাশে বোস, তোর লগে একটু কথা কই। মেলা দিন কারু সাথে গল্প করিনি। শকুর অনেকটা জোর করে কল্পনাকে কাছে টেনে বসালো। কল্পনার বুকে হাত দেওয়া মাত্রই কল্পনা এক ঝটকায় রুম থেকে বের হয়ে যায়।

একদিন পর আবার আসে শকুর। কল্পনা গো ধরে আয়নার সামনে বসে থাকে। শকুরের বৌয়ের কথা মনে পড়ে যায়। একটু ফিরতে রাত হলেই মাগির সেকি দেমাগ! তারপর ছেলে ভুলানোর মতো করে এটাসেটা দেওয়ার কথা বলে মাগির দেমাগ ভাঙ্গাতে হবে। কল্পনা কি চায় তার কাছে? টাকা?
কাছে আয়। কিছু টাকা ধরে দিবুনি। আমার কে আছে খাবার! একুন থেকি তুই খাবি। পায়ের ওপর পা তুলি আরাম করি খাবি।
কেনে আপনার বউ ছেলেপুলে নেই?
ছেলো, সব ছেলো। একুন নেই। এক মাগির ঢেসাই পড়ি সব শেষ হয়ি গিছে।
তাইলে আবার মাগির কাছে আইছেন যে?
মাগি ছাড়া গতি আছে নাকি পুরুষ মান্ষের। মাগি না খ্যালি, দুনিয়ার এতো ধন-ট্যাকা খাবে কেডা? আর তুই মাগি হতি যাবি কেনে? তুই হচ্ছিস কি যে আমার তুলতুলে টিয়া পাখি। তোকে আমি টিয়ার সাঁঝ এনি দেবো একদিন।
শকুর ভোলানোর চেষ্টা করে, কিছুতেই কিছু হয় না। শকুরের কেন জানি ভালো লেগে গেছে মেয়েটিকে, জবর দস্তি করতে মন চাই না। আবার নিজের শরীরটাও বাগ মানতে চায় না যে ! শকুরের না হয় একটু বয়স হয়েছে- দেহের সেই শক্তিও গত হয়েছে, তাই বলে মন শুনবে কেন! শকুর আজকেও ভালো মানুষের মতো উঠে গেল। এইভাবে সে জীবনে কোনো মাগির ঘর থেকে উঠে আসেনি। আজ যাওয়ার সময় বিন্দু খালাকে বলে গেল বিষয়টি। কাল একটু আইসেন তো। আমি দেখছি মাগির কিসে এতো দেমাগ। দরজা বন্ধ করে চুলের মুঠি ধরে শায়েস্তা করবেন। বাগে না আসলিই তো খেলা জমে ভাল। বিন্দু খালা পান চিবতে চিবতে বলল কথাগুলো।

পরদিন মধ্য রাতে হাজির শকুর পেয়াদা। আজ শকুর মাল খেয়ে এসেছে। চোখের ভেতরটা পাকা তরমুজের মতো লাল টকটক করছে। শকুরকে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজার সিটকিনি তুলে দিল বিন্দু খালা। কল্পনা ছুটে গেল দরজার কাছে- ও খালা, তোর পায়ে পড়ি, দরজাটা খুলে দে। আমি হের সাথে শুতি পারবু না যে! ও খালা, আমার এতো বড়ো সর্বনাশ তুই করিসনে। আজ আর শকুর কোনো কথা বলে না। পেছন থেকে চুলের মুঠি চেপে ধরে। লুঙ্গির গিট্টু খুলেই লাফিয়ে পড়ে কল্পনার ওপর। কল্পনা কি যেন বলতে চায়, শকুর কল্পনার মুখ চেপে ধরে এক হাতে, অন্য হাতে কল্পনাকে নগ্ন করে তোলে। কল্পনার আর কিছুই বলার নেই। মৃতের মতো ভান করে দেহ এলিয়ে পড়ে থাকে কল্পনা, শকুর পেয়াদা উপরে ডাঙ্গায় তোলা টাকি মাছের মতোন ছটফট করে। জন্মের সুখ সে মিটিয়ে নেই কল্পনার দেহে।

কল্পনা বিড়বিড় করে বলে – বাপজান, সেই যে গেলি আমারে টিয়া পাখির সাঁঝ এনি দিবি বুলি! আর তো আইলি না?