(মুক্তমনার ‘বিশ্বাস ও বিজ্ঞান’ সংকলনের পাঠ-প্রতিক্রিয়া)

বিশ্বাস ও বিজ্ঞান
সম্পাদক মন্ডলীঃ
ড. অভিজিৎ রায়, শহিদুল ইসলাম, ফরিদ আহমেদ
সভাপতিঃ অজয় রায়
প্রকাশকঃ মুক্তমনা ও শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের উদ্যোগে – চারদিক, ৩৮/৪ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০।
প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি ২০১২
প্রচ্ছদঃ বিপ্লব মন্ডল
পৃষ্ঠাঃ ৫২৩
মূল্যঃ ৫২০ টাকা
ISBN 984 802 077 2

ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে বিজ্ঞানের নৈতিক সুসম্পর্ক নেই – থাকার কথাও নয়। উপাসনা ধর্মের পুরোটাই বিশ্বাস নির্ভর – যার অধিকাংশই আসে জন্মগত উত্তরাধিকারসূত্রে। মননে বৈজ্ঞানিক যুক্তিবোধ প্রাধান্য পেলে ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল অনেকটাই আল্‌গা হয়ে যায় বটে – কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই কিছুটা ভগ্নাংশ রয়ে যায় মনের আনাচে কানাচে। এর কারণ হলো বৈজ্ঞানিক যুক্তিবোধ ধারণ করার জন্য যতটুকু নির্মোহ এবং যুক্তিনিষ্ঠ হওয়ার শক্তি দরকার – ততটা মানসিক শক্তি সবার থাকে না। এই প্রয়োজনীয় মানসিক শক্তি অর্জনের একটি প্রধান উপায় হলো – বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের চর্চা, মুক্তমনা হবার মানসিক সংগ্রাম। এ সংগ্রাম শুরু করাটা কঠিন, চালিয়ে যাওয়া কঠিনতর। এর জন্য দরকার হয় মানসিক শক্তির নিয়মিত জোগান। মাসখানেক ধরে পড়ার পর যে “বিশ্বাস ও বিজ্ঞান” নামক বইটি সম্পর্কে আজ লিখতে বসেছি তাকে মুক্তবুদ্ধির চর্চায় একটা উল্লেখযোগ্য শক্তির জোগানদার বলা চলে।

প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে গত এক দশকে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে মুক্তমনা আজ স্বমহিমায় উজ্জ্বল। বাংলা ভাষায় বৈজ্ঞানিক মননের চর্চা ও প্রসারে মুক্তমনা-গোষ্ঠী এখন খুবই পরিচিত একটা নাম। বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মূল যে শক্তি – যুক্তিনিষ্ঠতা – তার উৎকর্ষ সাধনে মুক্তমনা নিরলস কাজ করে যাচ্ছে অন্তর্জালে তো বটেই – ত্রিমাত্রিক ভৌত জগতেও। তারই ধারাবাহিকতায় মুক্তমনার পাতায় প্রকাশিত প্রবন্ধগুলোর কিছু কিছু সংকলন আকারে প্রকাশিত হচ্ছে। প্রথম সংকলন “স্বতন্ত্র ভাবনা” ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। দ্বিতীয় সংকলন “বিশ্বাস ও বিজ্ঞান” প্রকাশিত হয়েছে এবারের বইমেলায়।

দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্যে সমৃদ্ধ পাঁচ শতাধিক পৃষ্ঠার বই “বিশ্বাস ও বিজ্ঞান” এর পাঁচটি অধ্যায়ে সন্নিবেশিত সাঁয়ত্রিশটি প্রবন্ধের প্রত্যেকটিই স্বতন্ত্র আবার একই সাথে বইয়ের মূল-আবহের সাথে সংযুক্ত। প্রবন্ধ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সম্পাদকমন্ডলী যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন তা প্রবন্ধগুলোর সন্নিবেশন আর বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় সার্থকভাবে প্রতিফলিত। “বিশ্বাস ও বিজ্ঞান”-এ পাঁচটি অধ্যায়ে যে পাঁচটি প্রাথমিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে সেগুলো যথাক্রমেঃ

(১) বিশ্বসৃষ্টির আদি কারণ কী?
(২) সর্বজ্ঞ-সর্বশক্তিমান সত্তার সন্ধান কি পাওয়া গেছে?
(৩) বিজ্ঞান ও বিশ্বাসের সহাবস্থান কি সম্ভব?
(৪) বিজ্ঞান ও অপবিজ্ঞানের সীমারেখা কোথায়?
(৫) নৈতিকতা ও মূল্যবোধ কি ধর্ম থেকে উদ্ভূত?

“বিজ্ঞান ও বিশ্বাস”-এর আলোকে প্রসঙ্গগুলোর একটু ভেতরে ঢুকে দেখা যাক। প্রথম অধ্যায়ে সাতটি প্রবন্ধের সমন্বয়ে আলোচনা করা হয়েছে “বিশ্বসৃষ্টির আদি কারণ”। সাতটি প্রবন্ধের দুটো – “ঈশ্বর কি সৃষ্টির আদি কারণ?” এবং “ মহাবিশ্ব এবং ঈশ্বর – একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা” লিখেছেন ডক্টর অভিজিৎ রায়। ‘বিজ্ঞানের ধর্ম ও ঈশ্বর প্রসঙ্গ” আলোচনা করেছেন প্রফেসর অজয় রায়, স্বাধীন ইচ্ছা ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে লিখেছেন অপার্থিব জামান, সংশয়ীদের ঈশ্বর প্রসঙ্গে লিখেছেন আহমাদ মোস্তফা কামাল। এ অধ্যায়ের দুটো বড় পাওনা আইনস্টাইনের “বিজ্ঞান ও ধর্ম” এবং রিচার্ড ডকিন্সের “আইনস্টাইনের মহাজাগতিক ধর্ম ও অন্যান্য প্রসঙ্গ” এর অনুবাদ।

বিশ্বব্রহ্মান্ডকে কি কেউ সৃষ্টি করেছিলেন কোন এক সময় – নাকি এটা নিজে নিজেই উদ্ভূত হয়েছে এ প্রশ্ন খুবই মৌলিক। বিশ্বাস ও বিজ্ঞানের মূল সংঘর্ষ শুরু হতে পারে এই পয়েন্ট থেকেই। যদি কেউ বিশ্বব্রহ্মান্ডকে সৃষ্টি করেছেন বলে বিশ্বাস করেন – শুধুমাত্র তখনই আসে সৃষ্টিকর্তার প্রশ্ন। আর যদি বিশ্বকে সৃষ্টি করার দরকার না হয়ে থাকে – মহাবিশ্ব যদি স্বয়ম্ভু হয় – তাহলে ঈশ্বরের অস্তিত্ত্ব নিয়ে তর্ক করতে হয় না। কিন্তু সমস্যাটা হলো খুব সহজে এ তর্কের মীমাংসা করা সম্ভব নয়। তাই আমাদের দরকার হয় যৌক্তিক ভিত্তি। বিশ্বাস ও বিজ্ঞানের প্রথম অধ্যায়ের প্রবন্ধগুলো আমাদের যুক্তির ভিতকে শক্ত করতে সাহায্য করে। কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশানের মধ্য দিয়ে যে মহাবিশ্ব নিজে নিজেই উদ্ভূত হতে পারে তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ও প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা আছে ডক্টর অভিজিৎ রায়ের প্রবন্ধে। বিশ্ব থেকে যেখানে ‘ফ্রি লাঞ্চ’ উধাও হয়ে যাচ্ছে – সেখানে দেখা যাচ্ছে এই মহাবিশ্ব নিজেই একটা ‘আলটিমেট ফ্রি লাঞ্চ’ (পৃঃ ২৩)। মহাবিশ্বের সাথে ঈশ্বরকে জড়িয়ে যে সমস্ত ছদ্মবৈজ্ঞানিক যুক্তি দেখিয়ে থাকেন অনেক “বিশ্বাসী-বিজ্ঞানী!” সেই বহু-ব্যবহৃত ‘প্যালের ঘড়ি’ ‘সাঁইবাবার ম্যাজিক’ ‘নৌকার কারিগর’ জাতীয় যুক্তিগুলোকে ফালি ফালি করে কেটে ডক্টর অভিজিৎ রায় দেখিয়েছেন যে সেগুলোতে একটুও সারবস্তু নেই। তাঁর “মহাবিশ্ব এবং ঈশ্বর – একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা” প্রবন্ধটি সে অর্থে হয়ে ওঠে একটা অর্থপূর্ণ আনন্দদায়ক আলোচনাও। তবে ৬৯ পৃষ্ঠায় পাঠকদের সপ্তম অধ্যায়ের “আত্মা বলে সত্যিই কি কিছু আছে?” দেখতে বলা হয়েছে। অথচ বইটিতে সপ্তম অধ্যায় নেই, এবং উল্লেখিত শিরোনামের কোন প্রবন্ধও নেই। ৮৪ পৃষ্ঠায় একই ভাবে ‘আমেরিকায় ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের নামে কী হচ্ছে?” প্রবন্ধ দেখতে বলা হয়েছে- অথচ এই শিরোনামে কোন প্রবন্ধ নেই এ গ্রন্থে।

ইংরেজি শব্দের যেরকম সুবিধে আছে – যেমন creation ও evolution বলতে আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন দুটো প্রক্রিয়া বুঝি – বাংলায় অনেক সময় আমরা উভয় অর্থেই ‘সৃষ্টি’ শব্দটি ব্যবহার করে ফেলি। যেমন “কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশানের মধ্য দিয়ে এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হতে পারে যা পরবর্তীতে সৃষ্ট মহাবিশ্বকে স্ফীতির দিকে ঠেলে দিয়েছে” (পৃঃ ২১)। এখানে এই দুটো ‘সৃষ্টি’ই কিন্তু evolve অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। আমার মনে হয় বাংলাতেও শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরো সতর্ক হবার সময় এসে গেছে।

আইনস্টাইনকে ঈশ্বর-বিশ্বাসী প্রমাণ করার জন্য মুখিয়ে থাকেন এক শ্রেণির মানুষ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একজন গণিতের শিক্ষক পেয়েছিলাম যিনি প্রায় প্রতিটি ক্লাসেই বলতেন সেই অতি পরিচিত কথা “ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান অন্ধ”। তাঁর বক্তব্য ছিল পরিষ্কার – নামাজ-কালাম না পড়ে শুধু বিজ্ঞান পড়লে কোন কাজ হবে না – তুমি অন্ধই থাকবে। (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর পরের বছরগুলোতে যে দ্রুত অন্ধকারের দিকে ছুটে গেছে তার কারণ আর যাই হোক – বিজ্ঞানচর্চা নিশ্চয় নয়।) সে যাই হোক – আইনস্টাইনকে ধর্ম-বিশ্বাসী বানাতে পারলেই যেন বিশ্ব-জয় করে ফেলা যায়। কিন্তু তাঁরা তলিয়ে দেখার চেষ্টাও করেন না আইনস্টাইন আসলে কোন্‌ ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। বিজ্ঞান ও ধর্ম সংক্রান্ত আইনস্টাইনের মনোভাব সম্পর্কে আলোচনা উঠে এসেছে এ অধ্যায়ের দুটো প্রবন্ধে। একটা আইনস্টাইনের নিজের – যা “বিজ্ঞান ও ধর্ম” নামে অনুবাদ করেছেন দিগন্ত সরকার। অন্য প্রবন্ধটি রিচার্ড ডকিন্সের – যেটি অনুবাদ করেছেন প্রফেসর অজয় রায়। দুটো অনুবাদই সুখপাঠ্য। আইনস্টাইনের লেখার স্টাইল সরল। তিনি সহজ কথা অনেক সহজ ভাবে বলতেন। কিন্তু রিচার্ড ডকিন্সের মূল লেখা যাঁরা পড়েন তাঁরা জানেন ডকিন্সের স্টাইল। শব্দ নিয়ে খেলতে পছন্দ করেন তিনি। তাই তাঁর লেখার আক্ষরিক অনুবাদ করতে গেলে কী পরিমাণ কষ্ট যে করতে হয় তা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন। এই জটিল কষ্টকর দরকারি কাজটি করেছেন অধ্যাপক অজয় রায়। ডকিন্স তাঁর প্রবন্ধে যে বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন তা হলো বিজ্ঞানীরা রূপকার্থে বা কোন কোন সময় বিদ্রুপার্থেও যদি “ঈশ্বর” বা এরকম শব্দ ব্যবহার করেন তাকে বিশ্বাসীদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন বিশ্বাসীরা। রূপকার্থে ব্যবহৃত পদার্থবিদ্‌দের ‘ঈশ্বর’ বাইবেলের, পুরোহিত-পাদ্রি-মোল্লা-রাবাইদের ব্যবহৃত ঈশ্বর থেকে ‘আলোক-বর্ষ’ দূরে। তাই ডকিন্স পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে সরাসরি অনুরোধ করেছেন তাঁরা যেন প্রতীক অর্থেও ঈশ্বর শব্দটি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকেন (পৃঃ৪২)। হিগ্‌স বোসনকে যে ‘গড পার্টিক্যাল’ বলা হচ্ছে তারও কত রকমের অপব্যাখ্যা যে শুরু হয়ে গেছে!

“ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান, সর্বকরুণাময়ই হন তাহলে মন্দ বিকল্পগুলি অপসারণ করে শুধু ভালগুলো রাখতে পারতেন না কি?” (পৃঃ ৪৬)। প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রশ্নে আস্তিকেরা যুক্তি দেন “এটার দ্বারা ঈশ্বর মানুষকে পরীক্ষা করেন”। সার্বিক যুক্তিতে প্রশ্ন আসেই- দুর্যোগে যারা মারা গেল তারা তো পরীক্ষার কোন সুফল পেলো না (পৃঃ৪৭) – এসব প্রশ্ন ও যুক্তিতে অপার্থিব জামানের নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ ‘স্বাধীন ইচ্ছা ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব’ সাদাসিধে কথায় ঈশ্বরের অনস্তিত্বকেই প্রমাণ করে।

বিশিষ্ট লেখক আহমাদ মোস্তফা কামালের “সংশয়ীদের ঈশ্বর” খুবই সুলিখিত একটি প্রবন্ধ তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রবন্ধে পরিবেশিত কিছু কিছু যুক্তি পূর্ববর্তী প্রবন্ধগুলোতে প্রতিষ্ঠিত যুক্তির পরিপন্থি। সংশয়ীদের দার্শনিক অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে – নাস্তিকতা ও আস্তিকতা শব্দ দুটো নাকি দুটো বিশ্বাসের প্রতিনিধিত্ব করে (পৃঃ ৪৯)। ঈশ্বরে অবিশ্বাস আর ঈশ্বরের অনস্তিত্বে বিশ্বাস কি একই কথা? এ নিয়ে অনেক আলোচনা মুক্তমনায় হয়েছে তার উল্লেখ অবশ্য এ প্রবন্ধে নেই। আইনস্টাইনের ধর্ম সম্পর্কে আইনস্টাইন ও ডকিন্সের লেখা দুটো পড়ার পর যখন এ প্রবন্ধে বলা হয় আইনস্টাইন ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিলেন – ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে ইহুদি ছিলেন (পৃঃ ৫১, ৫৬) একটু ধন্ধ লাগে। “অন্য সব দর্শন যেখানে হেরে যায়, থেমে যায় সংশয়ীরা তখনও থাকেন চলমান। এই একটি জায়গায় সংশয়ীরা অন্য সবার থেকে শ্রেষ্ঠ” (পৃঃ৬১)। এই শেষ বাক্যদ্বয়ের মূল বক্তব্য যে ঠিক কী তা আমি বুঝতে পারিনি। কারণ সংশয় বা সন্দেহ বা দ্বিধা থেকে মুক্তির জন্যই তো বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান – তাই না? সেক্ষেত্রে অনন্তকাল সিদ্ধান্তহীন হয়ে ঝুলন্ত বা ‘চলমান’ থাকলেই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জিত হয়ে যাবে?

অজয় রায়ের দীর্ঘ প্রবন্ধ “বিজ্ঞানের ধর্ম ও ঈশ্বর প্রসঙ্গ” বেশ গুরুভার। বিজ্ঞান তথা পদার্থবিজ্ঞানের আলোকে ঈশ্বর প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়ে ম্যাক্স প্ল্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গি, হাইজেনবার্গের অসম্ভাব্যতার নীতি, অসঙ্গ ও নাগার্জুনের ভাববাদী দর্শন, রবীন্দ্রনাথের মানুষের ধর্ম প্রভৃতি বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। প্রবন্ধটি পড়তে গেলে একটু পর পর থামতে হয়। কারণ এর ধার এবং ভার দুটোই জটিল।

‘সর্বজ্ঞ-সর্বশক্তিমান সত্তার সন্ধানে’ “বিশ্বাস ও বিজ্ঞান”-এর দ্বিতীয় অধ্যায়ে সংকলিত হয়েছে সাতটি প্রবন্ধ। ভিক্টর স্ট্রেঙ্গারের ‘বিজ্ঞান কি ঈশ্বরকে খুঁজে পেয়েছে’ এবং স্টিভেন ওয়েইনবার্গের ‘পরিকল্পিত মহাবিশ্ব’ ছাড়াও অপার্থিব জামানের ‘ঈশ্বরের অস্তিত্ব-সৃষ্টির যুক্তির খন্ডন’, সৈকত চৌধুরীর ‘স্রষ্টা ও ধর্ম-অসঙ্গতির প্রসঙ্গ’ অভিজিৎ রায়ের ‘অপরিপক্ক নকশা’, বন্যা আহমেদ ও অভিজিৎ রায়ের ‘বুদ্ধিমত্ত নকশা ও বিজ্ঞান’, এবং মেজবাহ উদ্দিন জওহেরের ‘আস্তিকতা বনাম নাস্তিকতা’। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে তথাকথিত সর্ব-শক্তিমানের সন্ধান যে পাওয়া যায়নি, মানুষ যে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে সর্বজ্ঞ-সর্বশক্তিমান কল্পনা করে নেয় তা প্রবন্ধগুলোতে স্পষ্ট প্রমাণিত। ধর্মকে যাঁরা নৈতিকতার গোঁড়ায় বসিয়ে রাখতে চান তাঁদের জন্য ওয়েইনবার্গের ম্যাসেজঃ “ধর্ম থাকুক বা না থাকুক – সব সময়ই ভাল লোকে ভাল কাজ করবে আর খারাপ লোকে খারাপ কাজ করবে। কিন্তু ভাল লোককে দিয়ে খারাপ কাজ করানোতে ধর্মের জুড়ি নেই”। দিগন্ত সরকারের অনুবাদ ঝরঝরে চমৎকার। অপার্থিব জামান ও সৈকত চৌধুরীর প্রবন্ধে ধারালো যুক্তির ছাপ স্পষ্ট। ডক্টর অভিজিৎ রায়ের লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তিনি সাধারণ আটপৌরে গল্প দিয়ে শুরু করে পাঠককে টেনে নিয়ে যান বিজ্ঞান ও দর্শনের গভীরতায়। জটিল বিষয়গুলো কত সহজেই ঢুকিয়ে দেন পাঠকের মগজে। ‘অপরিপক্ক নকশা’তেও সিঙ্গাপুরের সেরাঙ্গুনের বাঙালি হোটেলের রুইমাছের ঝোল আর আলুভর্তার গল্প বলতে বলতে পাঠকের ক্ষুধা উস্‌কে দিয়ে দেলোয়ার হোসেন সাইদীর ওয়াজের ক্যাসেট সামান্য একটু শুনিয়ে পাঠককে নিয়ে ঠিকই উঠে পড়েন মানব শরীরের কলকব্জার লাইনে। দেখিয়ে দেন আমাদের চোখ, মেরুদন্ড, গর্ভাশয় সহ আরো অনেক অঙ্গের দুর্বল কাঠামোর নিদর্শন। পাঠক বুঝতে পারেন এ যে লক্ষ বছরের বিবর্তনের ফল- কোন বুদ্ধিমতী ঈশ্বরের সৃষ্টি নয়। তবে শেষ পৃষ্ঠায় লেখার মাঝখান থেকে কয়েকটি লাইন বাদ পড়ে গেছে সম্পাদনার ভুলে (পৃঃ ১৭২)।

ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের কূটকচালের বিরুদ্ধে জোরালো প্রবন্ধ বন্যা আহমেদ ও অভিজিৎ রায়ের ‘বুদ্ধিমত্ত নকশা ও বিজ্ঞান’। বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে ছদ্মবৈজ্ঞানিক ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন বা বুদ্ধিদীপ্ত নকশার দুর্বলতাগুলো পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে এ প্রবন্ধে। তবে প্রবন্ধটির শিরোনামে যে ‘বুদ্ধিমত্ত’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা মনে হয় ভুল প্রয়োগ। প্রবন্ধের আরেক জায়গায় ‘বুদ্ধিজীবী নকশা’ (পৃঃ ১৮৮) বলা হয়েছে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনকে। ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটাও মনে হয় ভুল প্রয়োগ।

মেজবাহ উদ্দিন জওহেরের ‘আস্তিকতা বনাম নাস্তিকতা’ প্রবন্ধটি সংকলনের মূল থিমের সাথে খাপ খায়না। এখানে যেসব দার্শনিক প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে – সেগুলো শৈল্পিক ঠিকই কিন্তু আধ্যাত্মিকও বটে। এখানে বলা হচ্ছে ঈশ্বর যে নেই তা প্রমাণের দায়িত্ব নাস্তিকদের একার (পৃঃ ২১৪)। এখানে আত্মাকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে (আত্মা মানুষের দেহ-বহির্ভূত কোন বিষয় নয়। দেহের সাথে আত্মা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত (পৃঃ২১৮))। এখানে শূন্য মানে শূন্য নয়। এখানে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিদ্যমান। (তিনি স্থান কালের অতীত অর্থাৎ অংকশাস্ত্রের জিরো ও ইনফিনিটি সংখ্যাদ্বয়ের বাইরে। সুতরাং কোন বিজ্ঞানের থিওরী দিয়ে তাকে মাপতে যাওয়া বাতুলতা (পৃঃ ২২১))। পুরো প্রবন্ধটি আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। বইটার শেষ পর্যন্ত পড়ার আগপর্যন্ত কোন কারণ আমি খুঁজে পাইনি এ প্রবন্ধকে সংকলনে স্থান দেয়ার উদ্দেশ্য। কিন্তু একেবারে পরিশিষ্ট-১ এ গিয়ে ডক্টর অভিজিৎ রায় ‘আস্তিকতা বনাম নাস্তিকতার প্রত্যুত্তরে’ একটা প্রবন্ধ লিখেছেন। এটা বইতে ‘আস্তিকতা বনাম নাস্তিকতা’ প্রবন্ধের ঠিক পরেই রাখা হলে পাঠকের মানসিক ভার কিছুটা লাঘব হতো। ডক্টর রায় তাঁর ক্ষুরধার যুক্তিতে ‘আস্তিকতা বনাম নাস্তিকতা’র বিচ্যুতিগুলো খন্ডন করেছেন। তারপরেও আমার মনে হয়েছে এখানে অক্কামের ক্ষুর চালানোর দরকার ছিল শুরুতেই- তাতে ‘বিশ্বাস ও বিজ্ঞান’এর অঙ্গহানি ঘটতো না।

বিজ্ঞানের সাথে ধর্মীয় বিশ্বাসের যে বিরোধ তার স্বরূপ বিশ্লেষণ করা হয়েছে তৃতীয় অধ্যায়ের এগারোটি প্রবন্ধে। বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করার পরও অনেকেই সত্যিকারের বিজ্ঞানমনস্কতা অর্জন করতে পারেন না। ‘বিজ্ঞানমনস্কতা ও ধর্মবোধ’ প্রবন্ধে ইরতিশাদ আহমদ বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞানমনস্কতা যে সবসময় সমার্থক হয়না অথচ হওয়া উচিত তা ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, ধর্মের প্রভাব ও অপ্রয়োজনীয়তার কথা বর্ণনা করেছেন বৈজ্ঞানিক দক্ষতায়। ধর্মাচ্ছন্নতাকে ছাপিয়ে বিজ্ঞানমনস্ক ধারা প্রবল থেকে প্রবলতর হতে হতে একদিন মূলধারায় পরিণত হবে সে ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠতে সাহায্য করে এই প্রবন্ধ। ওয়াহিদ রেজার “ঈশ্বর-বিশ্বাস ও ধর্ম চেতনা” কিছুটা ইতিহাস-আশ্রয়ী। দিগন্ত সরকারের “বিবর্তনের দৃষ্টিতে সৃষ্টিতত্ত্ব” বিবর্তন ও সৃষ্টিতত্ত্বের বিরোধের উৎসগুলো বিশ্লেষণের পাশাপাশি সত্যের সন্ধানে বিজ্ঞানের কাজও দেখিয়ে দেয়। মোঃ জানে আলমের “ধর্ম ও বিজ্ঞানের সহাবস্থান” কিছুটা রক্ষণাত্মক। “ধর্মের বিরুদ্ধে সরাসরি কোন মন্তব্য করার প্রয়োজন নেই। তা আপনি-আচরি শুকিয়ে যাবে (পৃঃ৩৩০)” জাতীয় পদক্ষেপের প্রস্তাব কিছুটা দুর্বলতার স্বাক্ষর বলেই মনে হয়। আবুল হোসেন খোকন তাঁর “ধর্মের স্বরূপ ও বিজ্ঞান” প্রবন্ধে ইসলাম ধর্ম সৃষ্টির আগের এবং পরের যুদ্ধবিগ্রহের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনা করে দেখিয়েছেন যে ধর্মের নামে বা ধর্মকে আশ্রয় করে যে যুদ্ধ ও হত্যাযজ্ঞ চলে আসছিল ইসলামের অনেক আগে থেকেই – ইসলাম আসার পরও সেরকম যুদ্ধ বন্ধ হওয়া তো দূরের কথা ইসলাম নিজেই কারণ হয়েছে আরো অসংখ্য যুদ্ধের। আকাশ মালিকের “ধর্ম না কি বিজ্ঞান” প্রবন্ধে ইসলাম ধর্মের অবৈজ্ঞানিক হাঁসজারুর কিছু নমুনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে সাবলীল দক্ষতায়। ধর্মকে বিজ্ঞানের কাতারে বসিয়ে দেয়ার যে অপচেষ্টা ধর্মবাদীরা করে যাচ্ছেন, বিভিন্ন ভাবে বলার চেষ্টা করছেন যে বিজ্ঞানের যা কিছু আবিষ্কার সবই “ব্যাদে আছে” বা কোরান-গীতা-বাইবেলে আছে – তার সুন্দর সহজ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় অভিজিৎ রায়ের “ধর্ম গ্রন্থাদিতে বিজ্ঞানের আভাস” প্রবন্ধে।

তৃতীয় অধ্যায়ের একটু ব্যতিক্রমী প্রবন্ধ খান মুহাম্মদের অনুবাদে স্টিফেন গুল্ডের “স্বতন্ত্র বলয়”। এ প্রবন্ধ পড়ে আসলেই কোন সিদ্ধান্তে আসা যায় না স্টিফেন গুল্ডের বলয় কোন্‌ কোন্‌ ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র। লেখাটিতে বিবর্তন ও বাইবেলের মধ্যে বিরোধকে খুব নমনীয়ভাবে দেখা হচ্ছে। বলা হচ্ছে ক্যাথলিক চার্চ বিজ্ঞানকে ধর্মের জন্য হুমকি মনে করে না (পৃঃ ৩০২) এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার মূল্যায়ন করে। লেখাটিকে মাঝে মাঝে ফরমায়েশি লেখা বলে মনে হয়। লেখাটি কার্ল সাগানকে – অর্থাৎ তাঁর আত্মাকে উৎসর্গ করা হয়েছে। আত্মার অনস্তিত্বে সন্দিহান বিজ্ঞানীর লেখা কতটুকু বৈজ্ঞানিক আমি জানি না। অবশ্য গুল্ডের লেখার সমালোচনা পাওয়া যায় রিচার্ড ডকিন্সের “বিজ্ঞানের অঙ্গনে যখন ধর্মের প্রবেশ” প্রবন্ধে। তানবীরা তালুকদার সুন্দর অনুবাদ করেছেন।

চতুর্থ অধ্যায়ে বিজ্ঞান ও অপবিজ্ঞান সংক্রান্ত আলোচনা স্থান পেয়েছে তিনটি প্রবন্ধে। জাহেদ আহমেদ “বিজ্ঞান-অপবিজ্ঞান, কোথায় সীমারেখা” প্রবন্ধে উদাহরণ সহ আলোচনা করেছেন বিজ্ঞান ও অপবিজ্ঞানের রূপরেখা। ছক টেনে দেখিয়েছেন বিজ্ঞান, অপবিজ্ঞান ও ধর্মের পার্থক্য। ধর্ম ও বিজ্ঞানের একই-পাত্রে অবস্থান যে সম্ভব নয় তা প্রতিষ্ঠিত। তবে “একজন বিজ্ঞানীর ধার্মিক পরিচয় থাকতেই পারে, তাতে দোষের কিছু নেই (পৃঃ ৩৭৯)” লেখকের উদারতার পরিচায়ক, কিন্তু এরকম স্বীকৃতি বিজ্ঞানের জন্য বিপজ্জনক। ৩৭৬ পৃষ্ঠায় প্রাকৃতিক নির্বাচনের পরিবর্তনের ধাপ দেখানোর জন্য যে ছকটি দেয়া হয়েছে তা পুরোপুরি ভুল। একই ছক ৩৬৭ পৃষ্ঠাতেও দেয়া হয়েছে। অপার্থিব জামানের “বিজ্ঞান, ধর্ম ও বিশ্বাস” প্রবন্ধটি তৃতীয় অধ্যায়ে স্থান পেতে পারতো। নাস্তিকের ধর্মকথার “নিম গাছে আমের সন্ধান” মূলত কোরান ও আরো কিছু ধর্মগ্রন্থে বিজ্ঞানের সন্ধান পাওয়ার ধর্মবাদী দাবির অসারতার আরো কিছু প্রমাণ।

“বিশ্বাস ও বিজ্ঞান”র পঞ্চম অধ্যায় “নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বনাম নাস্তিকতা”। এ অধ্যায়ে সাতটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। নৈতিকতা যে ধর্মের একচেটিয়া সম্পত্তি নয় – বা নৈতিকতার সাথে ধর্মের সম্পর্ক যে মূলত কাকতালীয় তা বোঝা যায় প্রবন্ধগুলো পড়লে। অভিজিৎ রায়ের প্রবন্ধ “নৈতিকতা- বেহেস্তে যাওয়ার ছাড়পত্র?” ধর্ম ও নৈতিকতার খিচুড়ি থেকে মূল উপাদানগুলো কিছুটা হলেও আলাদা করে দেখাতে সক্ষম যে ধর্মগ্রন্থগুলো মানবিক নৈতিকতা ধারণ করার একমাত্র আধার নয়, মানবিক মূল্যবোধ ধর্মগ্রন্থ থেকে উৎসারিত নয়। মীজান রহমান তাঁর “হতবুদ্ধি, হতবাক!” প্রবন্ধে ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ছোট ছোট প্রশ্নের মাধ্যমে প্রমাণ করে দেন ধর্মগ্রন্থের অন্তসারশূন্যতা। যেমন – ধর্মগ্রন্থ কেন মাতৃভাষায় পড়া যাবে না? ‘তোমার ধর্ম তোমার আর আমার ধর্ম আমার’ যদি ধর্মের বাণীই হয় – তবে কেন তোমার ধর্ম আমার না হলে তোমাকে খুন করা আমার জন্য ‘ফরজ’ বলা হয় কোন কোন সময়? ভিক্টর স্ট্রেঙ্গারের “আমাদের মূল্যবোধ কি ঈশ্বরের দান” অনুবাদ করেছেন মুন্সী কেফাযেতুল্লাহ। ভাল বলেই কি কোন কাজ করার জন্য আদেশ দেয়া হয়, নাকি কাজটা করার জন্য আদেশ দেয়া হয় বলেই কাজটা ভাল? বাইবেলের অহিংসার অবতার যীশুখ্রিস্টের হিংস্র রূপ আমরা দেখতে পাই- “আমি পৃথিবীতে শান্তি প্রেরণ করতে আসিনি, বরং তরবারী প্রেরণ করতে এসেছি (পৃঃ ৪৪১)”। অপার্থিব জামান “বিবর্তনের দৃষ্টিতে নৈতিকতার উদ্ভব” আলোচনা করেছেন তাঁর প্রবন্ধে। দিগন্ত সরকার “স্বার্থপর জিনের আলোকে সহযোগিতা এবং আত্মত্যাগ” ব্যাখ্যা করেছেন। পুরুজিত সাহার “প্রসঙ্গ নৈতিকতা” প্রবন্ধও আমাদের বুঝতে সহায়তা করে যে নৈতিকতা ধর্ম থেকে উদ্ভূত নয়। পৃথিবীর কোন দেশেরই মানবাধিকার কমিশন ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি হয়নি।

স্টিফেন হকিং ও লিওনার্দ ম্লোদিনোর সাম্প্রতিক বই “গ্রান্ড ডিজাইন” এর আলোচনা পাঠকের উপরিপাওনা। পরিশিষ্ট-২ এ স্থান পেয়েছে অভিজিৎ রায় ও অজয় রায়ের এই মূল্যবান আলোচনাটি। যদিও তাঁদের “অনুবাদক” বলা হয়েছে এখানে – তাঁরা অনুবাদ করেন নি – আলোচনা করেছেন বইটি সম্পর্কে। হকিং ও ম্লোদিনো এই বইতে ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তাকে শূন্যের কোঠায় ঠেলে দিয়েছেন বলে বইটি প্রকাশের সাথে সাথেই ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় উঠেছে। হকিং-এর ক্ষেত্রে অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। কারণ আর যাই হোক এখন বিজ্ঞানের জগতে “ঈশ্বর” একটি চমৎকার পণ্য।

সামগ্রিকভাবে বিশাল বইটার সম্পাদনার কাজ ব্যাপক এবং জটিল। একাধিক সম্পাদক থাকার কারণে কাজের সমন্বয় করাও বেশ জটিল। তাই বইটার কিছু দুর্বলতা রয়েই গেছে। ছবিগুলোর পরিস্ফূটন মোটেও মানসম্মত হয়নি। বিপ্লব মন্ডলের প্রচ্ছদ দৃষ্টিনন্দন কিন্তু দুর্বোধ্য। লেখক ও অনুবাদকের পরিচিতি দেয়া হয়েছে – কিন্তু সম্পাদকমন্ডলীর পরিচিতি দেয়া হয়নি (শহিদুল ইসলামের পরিচয় আমি জানি না)। বানানের ব্যাপারে কিছু কথা না বললেই নয়। বানানবিভ্রাট বইয়ের প্রাণহানি ঘটায় না সত্যি কিন্তু অঙ্গহানি ঘটায়। “বিশ্বাস ও বিজ্ঞান”-এ বেশ কিছু বানান ভুল রয়ে গেছে। টাইপ-সেটিং এর যুগে ছাপাখানার ভূত তাড়াবার জন্য প্রুফ-রিডিংয়ের ব্যবস্থা ছিল। বর্তমানে প্রুফ-রিডারের পদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে কিনা জানি না। তবে প্রযুক্তির এত উন্নতি ঘটার পরেও যদি বানান-বিভ্রাট তাড়ানো না যায় – তার দায় দায়িত্ব বর্তায় সম্পাদক মন্ডলীর ওপর। অন্যতম সম্পাদক ফরিদ আহমেদের নামের বানানই ভুলে ‘ফরিদ আহমদ’ হয়ে গেছে গ্রন্থের প্রথম পৃষ্ঠাতেই। ৩৩ পৃষ্ঠায় লেখকের নাম রিচার্ড ডকিন্স হয়ে গেছেন রিচার্ড ‘ডিকন্স’।আরো যেসব বানান-বিভ্রাট চোখে পড়েছে তার তালিকা এখানে উল্লেখ করলাম না। কারণ আমার বিশ্বাস ভুলগুলো সম্পাদক মন্ডলীরও চোখে পড়েছে।

দুটো প্রাসঙ্গিক বিষয় উল্লেখ করে এ আলোচনা শেষ করবো।
ভূমিকায় বলা হয়েছেঃ “প্রবন্ধে প্রকাশিত মতসমূহ অবশ্যই লেখকদের নিজস্ব। এর দায়ভাগ প্রকাশক বা সম্পাদকমন্ডলীর উপর বর্তাবে না”। একটু মিশ্র-প্রতিক্রিয়া হলো এটুকু পড়ে। যদি কোন লেখা নিয়ে লেখক সমস্যায় পড়েন বা লেখা নিষিদ্ধ হয় – সে কারণেই কি এরকম সাবধানতা? লেখাগুলোতো সম্পাদকমন্ডলীই নির্বাচন করেছেন, প্রকাশকতো বইয়ের বিষয়বস্তু জেনেই তা প্রকাশ করেছেন। সুতরাং সম্পাদক বা প্রকাশক কোন দায়ভাগই নেবেন না তা কী করে হয়? মুক্তমনার সাহসী মনোভাব ক্ষুন্ন হয় এখানে।

দ্বিতীয় প্রসঙ্গঃ ‘বিশ্বাস ও বিজ্ঞান’ গ্রন্থে প্রকাশিত ডক্টর অভিজিৎ রায়ের কয়েকটি প্রবন্ধ ঈষৎ পরিবর্তিত আকারে ভিন্ন শিরোনামে “অবিশ্বাসের দর্শন” গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। সৈকত চৌধুরীর প্রবন্ধও একই ভাবে ‘পার্থিব’ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। কোন একটি রচনা প্রয়োজনে একাধিক গ্রন্থে স্থান পেতে পারে। কিন্তু কোন লেখা যখন কোন বইতে স্থান পায় – তখন সেই লেখাটি অন্য বইতে সংকলিত হবার সময় শিরোনাম বদলে দেয়া কতটুকু যুক্তিসংগত? রিচার্ড ডকিন্সের একই রচনার কি ভিন্ন ভিন্ন শিরোনাম থাকে?

“বিশ্বাস ও বিজ্ঞান” গ্রন্থের পেছনের মলাটে এবং ভূমিকায় পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে বইটির উদ্দেশ্য- একাডেমিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তিবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যকার সম্পর্ক খোঁজা, জানা এবং বোঝার চেষ্টা। বইটির পাঠক মাত্রেই একমত হবেন যে উদ্দেশ্য ও প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। মুক্তমনার এরকম প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক।

(“বিশ্বাস ও বিজ্ঞান” বইতে আমার নিজের একটা অনুবাদ এবং একটা লেখা স্থান পেয়েছে। ঘটনাক্রমে আমার লেখাটির শিরোনামও “বিশ্বাস ও বিজ্ঞান”। লেখাটি ইচ্ছাকৃতভাবে এ আলোচনার বাইরে রেখেছি।)