লিখেছেনঃ কালযাত্রী

গত পর্বে (১) জিন্নাহ ও তাঁর সৃষ্ট পাকিস্তানের ভিত্তিতে ইসলামের কথিত ভূমিকা, (২) পাকি-জামাতি ফ্যাক্টর ও (৩) পাকিস্তানে ইসলামীকরণে কার কি ভূমিকা ছিল (ও শুধু সেনাবাহিনীরাই জড়িত এই মিথ খন্ডন) নিয়ে আলোচনা করেছিলাম।

এই পর্বে (৪) বাংলাদেশের ইসলামীকরণে মুজিব, মোশতাক সরকার (ক্ষণস্থায়ী কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ), জেনারেল জিয়া ও এরশাদের ভূমিকা ও (৫) খালেদা জিয়া ও হাসিনা আমলে ইসলামীকরণ ও তাদের জামাত নীতি নিয়ে আলোচনা করব।

এই ব্লগের শিরোনাম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল গত পর্বে। নামকরন হয়ত যথার্থ হয় নি। শিরোনাম চয়ন করা কঠিন কাজ। একটি শিরোনামে সব বক্তব্য ধারণ করা সহজ নয়। যাহোক বিষয়বস্তুর দিকেই নজর দিলে ভাল হয়। ইসলামীকরণ শব্দটা একটা ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর দ্বারা সবসময় যে কোন বিশেষ কার্য বা ক্রিয়া বোঝান হয়েছে তা নয়। ইসলামের ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক মতাদর্শ, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি তাদের অবস্থান, জামাতের ব্যাপারে তাদের অবস্থান ইত্যাদি এই আলোচনার অন্তর্ভুক্ত, যা তাদের বিভিন্ন উক্তি আর কর্মকান্ডের দ্বারা প্রতিফলিত। মোট কথা ইসলাম কিভাবে সব দল ও নেতাদের হাবভাব, কথাবার্তা ও কর্মে প্রতিফলিত হয়েছে সেটা নিয়েই এই আলোচনা, বিশেষ করে এই পর্বে। এবার ৪-৫ নিয়ে আলোচনা শুরু করি। এটা অনেকটা সময়-রেখা(Timeline) ফর্ম্যাটে আলোচিত হবে।

৪। বাংলাদেশের ইসলামীকরণে মুজিব, মোশতাক সরকার (ক্ষণস্থায়ী কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ), জেনারাল জিয়া ও এরশাদের ভূমিকাঃ

১। মুজিব আমলঃ (Riaz –> God Willing: The Politics of Islamism in Bangladesh – Ali Riaz)

প্রচলিত বিজ্ঞতায় বলা হয় মুজিব তথা মুজিবের আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক বা আদর্শের ধ্বজাধারী ছিলেন, ও ধর্মনিরপেক্ষ এক বাংলাদেশ সৃষ্টি তাঁর স্বপ্ন ছিল। কিন্তু মুজিব বৃটিশ আমলে ও পাকিস্তান আমলে এমন কিছু বলেননি বা করেননি যারা দ্বারা তাঁকে ধর্মনিরপক্ষতার ধ্বজাধারী বলা যায়। বাংলাদেশ সৃষ্টির আগে আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো বা মুজিবের ভাষণে ধর্মনিরপেক্ষতার উল্লেখ কোথাও ছিল না। মুজিব বা আওয়ামী লীগের এজেন্ডা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসন, অর্থনৈতিক শোষণের অবসান। মুজিবের মানসে ধর্মনিরপেক্ষতার কোন ছাপ দেখা যায় নি। তিনি ইসলামী মূল্যবোধে খুবই স্বচ্ছন্দ ছিলেন। তাঁর ভাষণে তিনি বলতেন, আমি মুসলমান, এক আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করিনা, জেলে যাবার ভয় আমার নেই। বস্তুত পক্ষে ইসলামকে মুজিব বা আওয়ামী লীগই স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করতে পারতেন রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে সুযোগ হলে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পাকিস্তান সরকার আগেই Preemptively ইসলামকে ব্যবহার করে ফেলেছে পাকিস্তানকে অখন্ড রাখার এক হাতিয়ার হিসেবে। পাকিস্তানকে ভাঙ্গা ইসলামের শত্রুর(ভারত) কাজ বলে পাকিস্তান সরকার আগেই একটা বুলি বাজারে ছেড়ে দিয়েছিল। তাই মুজিব ইসলামকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের মূল্যবান সুযোগটা পেলেন না। কারণ পাকিস্তান সরকার সুকৌশলে মুজিবের রাজনৈতিক আন্দোলনকে ভারতের (অর্থাৎ হিন্দুদের) ইসলাম বিরোধী এক ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করেছিল। হাইপোথেটিক্যালি এমন যদি হত যে পাকিস্তানের সাথে ভারতের সুসম্পর্ক ছিল, আর ধর্মনিরপেক্ষতা পাকিস্তানের একটা মূল আদর্শ ছিল(জিন্নাহর আদর্শের সঙ্গে যা সঙ্গতিপূর্ণ), কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তান শোষিত হয়েছিল ঠিকই , তাহলে মুজিব সোৎসাহে ইসলামী কার্ড খেলতেন নিঃসন্দেহে। তখন তাঁর আন্দোলন হত শোষণ আর পাকিস্তানের অনৈস্লামিক আদর্শের বিরুদ্ধে। হয়ত তখন সাহায্যের জন্য সৌদী আরবই এগিয়ে আসত, জামাতও সমর্থন দিত। কিন্তু ইতিহাস সেটা নয়। কাল্পনিক চিত্রটা দিলাম বোঝাবার সুবিধার জন্য যে ধর্মনিরপেক্ষতা মুজিব বা আওয়ামী লীগের নাড়ির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোন ধারণা ছিলনা কখনো।

ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার প্রবর্তক ছিল তদানীন্তন বামপন্থী ছাত্র নেতারা। গণ আন্দোলনে মুজিব জনগণকে চালিত করছিলেন আর মুজিব অনেকখানি চালিত বা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিলেন শক্তিশালী ছাত্র নেতাদের দ্বারা, যাদের অধিকাংশই বাম চিন্তা ধারায় সিক্ত ছিল। তখন বাম চিন্তা ধারা একটা “Cool” ব্যাপার ছিল । ১৯৬৯ থেকে স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বে ও আন্দোলনে ছাত্র নেতাদের প্রভাবই সর্বাধিক ছিল। মুজিব পাকিস্তান থেকে ফেরার আগে সব কিছুর রূপরেখা মোটামুটি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল, ধর্মনিরপেক্ষতা যার মধ্য ছিল। বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার অন্তর্ভুক্তীকরণের জন্য মুজিবকে কৃতিত্ব দেয়া হলেও আসলে এই সংবিধান ড: কামাল হোসেন ও কিছু বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় রচিত। মুজিবের সুপারিশে ধর্মনিরপেক্ষতার অন্তর্ভুক্তীকরণ করা হয় নি। বলা যায় তিনি এটার বিরোধীতা করেন নি। যদিও এর ভিত্তি ছিল বামপন্থী ছাত্র সমাজের ১৯৬৯ এর ১১ দফা ভিত্তিক আন্দোলন, কিন্তু ১১ দফায় ও ধর্মনিরপেক্ষতার উল্লেখ ছিল না, জাতীয়করণের ও অর্থনৈতিক সাম্যের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল । পরিহাসের বিষয় যে ধর্মনিরপেক্ষ নতুন সংবিধান পাস করার পর সংসদে এক “মুনাজাতের” (ইসলামী প্রার্থণা) আয়োজন করা হয় মুজিবের নেতৃত্বে, ৪ঠা নভেম্বর ১৯৭২ এ।
(Riaz, p-33)

নীচের উদ্ধৃত তথ্যসমূহ সবই প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে সঙ্গতিহীনঃ

– মুজিব বাংলাদেশকে ইসলামী দেশের সংস্থা OIC এর সদস্য করিয়ে ১৯৭৪ এ লাহোরে OIC এর সম্মেলনে যোগ দেন (এর পূর্বশর্ত হিসাবে পাকিস্তানের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য তিনি ভুট্টোকে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানান লাল গালিচা অভ্যর্থনা দিয়ে ও পাকিস্তানী যুদ্ধ্বাপরাধীদের ক্ষমা করে পাকিস্তানে প্রত্যাবাসিত করেন)। উল্লেখ্য যে OICর এই সম্মেলনে ইসলাম প্রচারে জন্য একটা বিশেষ তহবিল গঠন করা হয়।

এখানে উল্লেখ্য যে মুজিব ইসরাইলের স্বীকৃতিকে (১৯৭২ এর ফেব্রুয়ারী,বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানকারী দেশ সমুহের প্রথম চারটির একটি) প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, অথচ স্বাধীনতার বিপক্ষের পাকিস্তান ও সউদী আরবের স্বীকৃতির জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন, শুধু OIC এর সদস্য হবার জন্য, কারণ বাংলাদেশকে একটা বৃহৎ মুসলীম দেশ হিসেবে প্রজেক্ট করার বাসনা তাঁর মনে ছিল (J.N. Dixit এর লেখায় এটা প্রতীয়মান)। ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায় বিশ্বাসী হলে তো এরকম হবার কথা নয়, ইস্রাইলের স্বীকৃতি ও সাহায্য গ্রহণ করাই সঙ্গত হত। স্বীকৃতি গ্রহোন করেও প্যালেস্টাইনের পক্ষে অবস্থান নেয়া যেত, যদি প্যালেস্টাইনের কারণেই এটা হত। কিন্তু কারণ ছিল ইসলামী ভাবধারা। আরও উল্লেখ্য যে বাংলাদেশের পাসপোর্টে ইসরাইলে ভ্রমণই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় (যা এখনও বলবৎ আছে, পৃথিবীর আর কোন দেশ যা করেনা, এমনকি এখন কোন মুসলীম দেশও না )

– লাহোরে OIC এর সম্মেলনের দুমাস পরে জেদ্দাহতে ইসলামী দেশ সমূহের পররাষ্ট্র মন্ত্রী দের সম্মেলনে বাংলাদেশের নেতৃত্বে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা হয় (Riaz-33)

ডঃ সালাহউদ্দিন আহমেদের পণ্ডিত্যপূর্ণ বই “Bangladesh: Past and Present” এর ৩১২ পৃঃ থেকে কিছু উদ্ধৃতিঃ

“It is said Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman encouraged the creeds of secularism in the newly created state of Bangladesh and as such he was not an upholder of Islamic values in the polity of Bangladesh. In truth he encouraged the application of Islamic values not only in private life but also in public life.”

[এটা বলা হয় যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নাকি নবগঠিত বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে উৎসাহ দিয়েছিলেন এবং তাই তিনি ইসলামী মূল্যবোধের ধ্বজাধারী ছিলেন না। কিন্তু সত্য হল তিনি শুধু ব্যক্তি জীবনেই নয়, গণজীবনেও ইসলামী আদর্শের বাস্তবায়নে উৎসাহ দিয়েছিলেন]

পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়েত্তশাসনের আন্দোলনের সময়ে আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে ধর্মনিরপেক্ষতার কোন উল্লেখ ছিল না। ম্যানিফেস্টোতে বলে হয়েছিলঃ “আওয়ামী লীগ এই প্রতিশ্রুতি দেয় যে সংবিধানে একটা সুস্পষ্ট গ্যারান্টি দেয়া হবে যে এমন কোন আইন পাশ করা যাবে না যা কোরাণ বা সুন্নাহর পরিপন্থী।”

১৯৭০ নির্বাচনের প্রাক্কালেও মুজিব ইসলামী বিধানসমূহকে সমুন্নত রাখার পবিত্র আশ্বাস দেন এবং বলেন যে “আমরা কোরাণ ও সুন্নাহর পরিপন্থী কোন আইন প্রণয়ন না করার সাংবিধানিক নীতিতে অঙ্গীকারবদ্ধ”

ভারতীয় কূটনীতিক J.N. Dixit বলেছিলেন “মুজিব রাজনীতিতে রাষ্ট্র ও ধর্মের সম্পূর্ণ পৃথকীকরণএ বিশ্বাস করতেন না”

সাংবাদিক বসন্ত চ্যাটার্জীর সাথে এক সাক্ষাৎকারে মওলানা ভাষাণী বলেছিলেন যে “মুজিব আওয়ামী মুসলীম লীগ থেকে মুসলীম শব্দটি বাদ দিতেই প্রস্তুত ছিলেন না”

পৃঃ-৩১৭:
“ইসলামী শিক্ষা প্রসারের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ১৯৭১ এর ২৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৯৭৩ এ ৭২ লাখে উন্নীত করা হয়”

“মুজিব ইসলামী ব্যাঙ্কিং প্রবর্তনের জন্য ১৯৭৫ সালে ইসলামী ব্যাঙ্কিং উন্নয়ন অধ্যাদেশ জারী করেন”

প্রখ্যাত সাংবাদিক সালীম সামাদ তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছেনঃ
(দ্রঃ http://mukto-mona.net/Articles/saleem/secular_to_islamic.htm )

১। মুজিব নিষিদ্ধ ইসলামিক একাডেমীকে পুনরুজ্জীবিত করে মার্চ ১৯৭৫ এ ইসলামী ফাউন্ডেশনে উন্নীত করেন ও বেশি করে ইসলামী সমাবেশে উপস্থিত হতে শুরু করেন । তিনি মদ বিক্রয় ও মদ্যপান নিষিদ্ধে ঘোষণা করেন। ঘোড় দৌড় নিষিদ্ধ করেন (জুয়া নিষিদ্ধ)।

২। পরের দিকে মুজিব তাঁর ভাষণে ও জনসমাবেশে বেশি করে ইসলামের উল্লেখ করা শুরু করলেন। তাঁর কথায় ইসলামী প্রকাশভঙ্গী যেমন, আল্লাহ, ইনশাল্লাহ, বিসমিল্লাহ, তওবা আর ইমাম ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এক পর্যায়ে তিনি তাঁর বিদায়ী সম্ভাষণ জয় বাংলার পরিবর্তে “খোদা হাফেজ” ব্যবহার করা শুরু করেন।

– ২০০২ সালের ২৪শে ডিসেম্বরে ঢাকার “The Independent” পত্রিকায় শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে লেখা হয় হাসিনা বলেন যে “বঙ্গবন্ধু সীরাত মিশন প্রতিষ্ঠা করেন, মাদ্রাসা বোর্ড স্থাপন করেন, টঙ্গীতে তবলীগ জামাতের জন্য জমি বরাদ্দ করেন, কাকরাইল মসজিদ ও তার সংলগ্ন জমি তবলীগ জামাতের কাছে হস্তান্তর করেন আর বায়তুল মোকাররম মসজিদের জন্য তিন একর জমি নিবন্ধন করে দেন।
(দ্রঃ http://dir.groups.yahoo.com/group/MuktoChinta/message/4437 )

বস্তুত পাকিস্তানের মুসলীম লীগের সাথে আওয়ামী লীগের মূল পার্থক্য একটাই, সেটা হলে আওয়ামী লীগের প্রাইওরিটি ছিল বাঙলাদেশের শ্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতা(পরে) আর মুসলীম লীগের প্রায়োরিটি ছিল পাকিস্তানের অখন্ডতা। ইসলামী নীতির ব্যাপারে আওয়ামী লীগ আর মুসলীম লীগের মধ্যে খুব পার্থক্য ছিল না।

২। মোশ্তাক আমলঃ (আগস্ট’৭৫ – নভেম্বর’৭৫)

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী মোশ্তাক ছিলেন ইসলামপন্থী। ব্যক্তিগত জীবনে আর সবার মত তিনি মূল ধারার মুসলমান ছিলেন ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে মোশ্তাক বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করতে অস্বীকৃত জানান। যদিও প্রথমে মেজর ডালিম রেডিওতে বাংলাদেশকে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা দেয়। ধারণা করা হয় মুসলীম দেশের বিশেষ করে সৌদী আরবের স্বীকৃতি লাভের জন্য তা করা হয়েছিল (শেখ মুজিব সৌদী স্বীকৃতির জন্য চেষ্টা করে সফল হননি)। তাৎক্ষণিক ফলও হয়েছিল। সৌদী স্বীকৃতি এসেছিল। কিন্তু পরে মোশ্তাক বাংলাদেশ যেমন ছিল তেমনই থাকবে বলে ঘোষণা দেন, এতে সৌদীরা বিব্রত হয়েছিল। (দ্রঃ Bangladesh: Legacy of Blood – Mascarenhas, p-81). মোশ্তাক ছিলেন মার্কিনঘেষা ও ভারতবিমুখ। কিন্তু তাই বলে ধর্মনিরপেক্ষতা বিরোধী বলা যায় না। হলে তখনই ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা দিতে পারতেন, পরিবেশ সেটা করার অনুকুলেই ছিল, বিশেষ করে ডালিমই যখন সেঈ কাজটা করে দিয়েছিল। যে তিন মাস মোশ্তাক ক্ষমতায় ছিলেন অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারেই ব্যস্ত ছিলেন, ইসলামীকরণের কোন পদক্ষেপই নেন নি। অনেকে ডালিম-মোশ্তাক সরকারকে পাকিস্তান-জামাত পন্থী বলে চিত্রিত করেন। পাকিস্তান তখন পিপিপির ভুটো শাসিত (ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রমনা, জামাত বিরোধী)। মোশ্তাক ইসলাম বা পাকিস্তান পন্থী হলে দীর্ঘ দিন ধরে মুজিবের সাথে জেল খেটে বাংলাদেশের দাবী আদায়ে নিজেকে নিয়োজিত করতেন না। যেটা বলা সঠিক হবে তিনি মার্কিনঘেষা, ভারতবিমুখ ও পরে মুজিব বিরোধী (বাংলাদেশ উত্তর সময়ে, মুজিবের ভারত-সোভিয়েট মুখী নীতির জন্য, যদিও মুজিবের ভারত-সোভিয়েট মুখী হওয়াটাও পরিস্থিতির চাপে ছিল, মুজিব এতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন না ) ছিলেন। আর তা ছাড়া মুজিব পাকিস্তানকে যতটা ছাড় দিয়েছিলেন (যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে তাদেরকে পাকিস্তানে প্রত্যাবাসিত করে, লাল গালিচা দিয়ে ভুটোকে ঢাকায় অভ্যর্থনা দিয়ে, পাকিস্তানের স্বীকৃত গ্রহণ করে লাহোরে ইসলামী সম্মেলনে যোগ দিয়ে), খুব সম্ভবত এর চেয়ে বেশি আর কোন ছাড় দেয়নি মোশ্তাক সরকার (বা পরবর্তী কোন সরকার) পাকিস্তানকে।

৩। জেনারেল জিয়ার আমলঃ

জেনারেল জিয়ার ব্যাপারে প্রচলিত ধারণা হল তিনি বাংলাদেশে ইসলামায়নের সূচণা করেন, তিনি ইসলামপন্থী ইত্যাদি। উল্লেখযোগ্য যে জিয়া আইয়ুব আমলে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন, যার আমলে সেনাবাহিনীর ধর্মনিরপেক্ষ চেহারা ছিল(প্রথম পর্বে আলোচিত)। জিয়া ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশকে ইসলামী দেশ ঘোষণা করলেন না, যদিও অনেকে তাই ঘটবে বলে মনে করেছিল। তাঁর সহযোগী বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল তাওয়াব ( http://en.wikipedia.org/wiki/Muhammad_Ghulam_Tawab ) বাংলাদেশকে ইসলামী দেশ বলে ঘোষণা দেয়ার জন্যে জিয়াকে চাপ দিতে থাকেন (লিবীয় সাহায্যের আশায়)। কিন্তু জিয়া এই চাপে নত হলেন না। তাওয়াবের সাথে লিবিয়ার শক্তিশালী যোগাযোগ ছিল। এপ্রিল ১৯৭৬ এ তাওয়াব ও তার কিছু সমর্থক শেখ মুজিব হত্যার সাথে জড়িত চার হত্যাকারী অফিসারদের প্রবাস থেকে ফিরিয়ে এনে জিয়াকে অপসারণ করার জন্য এক অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র করে। ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে ইসলামী দেশ বলে ঘোষণা করা। কিন্তু জিয়া সেই অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ করে দেন আর তাওয়াব ও ষড়যন্ত্রকারীদের অপসারণ করেন।
(দ্রঃ http://www.country-data.com/cgi-bin/query/r-1218.html )
এবং Riaz-35)

এরপর সৌদী আরব থেকেও চাপ আসতে থাকে ইসলামী দেশ বলে ঘোষণা দেয়ার।
(দ্রঃ Muslim Women of Power: Gender, Politics and Culture in Islam – Clinton Bennett বইএর
পৃঃ ৯৬)

তেল সংকট ও অর্থনৈতিক সাহায্যের প্রয়োজনের বাস্তবতার কাছে নত হয়েই হয়ত জিয়া একটা আপোষ রফা (সৌদীদের “বুঝ দেয়া”) করে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি অপসারণ করেন ও সংবিধানের উপরে বিসমিল্লাহ জুড়ে দেন (সংবিধানের মূল অংশে নয়)। সংবিধানের এই ধর্মনিরপেক্ষতার অনুচ্ছেদের কারণে সৌদী আরব দীর্ঘদিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি মুজিবের আমলে, যদিও মুজিব সবরকম চেষ্টাই করেছিলেন স্বীকৃতির জন্য, বাংলাদেশকে ইসলামী দেশ হিসেব ঘোষনা করা ছাড়া। ১৯৭৯ এ জিয়ার দল নির্বাচিত হবার পর ২৯শে অক্টোবর, ১৯৭৯ এ প্রধান মন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান বলেন যে বাংলাদেশকে ইসলামী দেশ হিসেবে ঘোষণা দেয়ার কোন পরিকল্পনা নেই।
(দ্রঃ Bangladesh: Past and Present – পৃঃ ৩১৪)

সংবিধানের এই পরিবর্তনকে ইসলামীকরণ বলা যায় এক অর্থে। তবে “ধর্মনিরপেক্ষতা” শব্দটা সংবিধানে না থাকলেই কোন দেশ ধর্মনিরপেক্ষ থাকতে পারে না তা নয়। মার্কিন সংবিধানে “ধর্মনিরপেক্ষতা” শব্দ নেই, ভারতের সংবিধানেও “ধর্মনিরপেক্ষতা” শব্দটা ছিল না ১৯৭৬ পর্যন্ত। তার মানে এই নয় যে ভারত ১৯৭৬ এর আগে ধর্মনিরপেক্ষ ছিল না, বা ১৯৭৬ এর পর ভারত আরো ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে গেল। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা উল্লেখ করেও ইসলামীকরণ করা যায়, যেমন মুজিব করেছিলেন। সংবিধানের মূল অংশের উপরে বিসমিল্লাহ জূড়ে দেয়া বা “আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাস” উল্লেখ করা ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার বিরোধী অবশ্যই, এবং ধর্মনিরপেক্ষতা কামীদের জন্য তা আপত্তিকর বটেই। তবে জনজীবনে ইসলামায়নের কোন কার্যকরী প্রভাব এর দ্বারা পড়েনি। সরকারী পর্যায়ে যে কোন অনুঠানের সূচণায় বিসমিল্লাহ বলার রেওয়াজ অবশ্য শুরু হয় এতে, যার প্রতিবাদ কেউ করেনি। শেখ হাসিনাও বিসমিল্লাহ সংযোজনের কোন বিরোধিতা করেন নি। (দ্রঃ God Willing: The Politics of Islamism in Bangladesh – Ali Riaz, p-39, “Sheikh Hasina said that she had no quarrel with Bismillah”)

জিয়া ক্ষমতায় এসে ধর্মীয় দলের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেন, ও জামাত নেতা গোলাম আজমকে দেশে ফিরতে অনুমতি দেন, দৃশ্যত সৌদী চাপে, তিন মাসের ভিসায় তাঁর অসুস্থ মাকে দেখতে। অবশ্য জিয়া গোলাম আজমকে বাংলদেশের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেননি তাঁর শাসনামলে বা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে অনুমতিও দেননি। অনেকে এটাকে ইসলামায়ন বা জামাতীকরণ বলেন। কিন্তু সঠিক অর্থে তা নয়, কারণ গণতন্ত্রের তাত্বিক কাঠামোতে সব দলেরই রাজনীতি করাটা স্বাভাবিক। তিনি নিজে জামাত করেননি বা জামাতের সঙ্গে মোর্চা করেননি। আর গোলাম আজমকে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেয়াটা তুলনা করা যায় মওদুদীর পাকিস্তান ও জিন্নাহর বিরোধীতা সত্বেও মওদুদীর পাকিস্তানে অভিবাসনে জিন্নাহর অনুমতি প্রদান। কিন্তু জিন্নাহ জামাতী বা ইসলামায়ক হয়ে যাননি তাতে। জিয়ার গঠিত বিএনপিতে জাতীয় গণতান্ত্রিক দল (জাগদল), ভাষাণীর ন্যাপ, ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (UPP), ও মুসলীম লীগের এক অংশ যোগ দেয়। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে যোগ না দিলেও কিছু আওয়ামী সদস্যও বিএনপিতে যোগ দিয়েছিল। এটা একটা জগা খিচুড়ি পার্টি ছিল, ডান আর বামের সংমিশ্রণে, যাতে কোন বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতিফলন না ঘটে। জিয়া একজন প্র্যাগম্যাটিস্ট ছিলেন। কিন্তু কোন ধর্মীয় দল সামগ্রিকভাবে এতে যোগ দেয়নি বা বিশেষ কোন ধর্মীয় বা রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতিফলন ছিলনা এই মন্ত্রীত্বে । মুসলীম লীগ অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষে ছিল বলে মুসলীম লীগের সদস্যদের বিএনপিতে নেয়াকে অনেক ইসলামী পদক্ষেপ বলেন কিন্তু পাকিস্তান মানেই ইসলামীকরণ বা জামাতীকরণ সেটা যে ভুল সেটা আগেই আলোচনা করেছিলাম। (শাহ আজিজুর রহমানের বাংলাদেশকে ইসলামী দেশ ঘোষণা না করার কথা উল্লেখ্য এই প্রসঙ্গে)। আমাদের আলোচনার ফোকাস ইসলামীকরণ এবং কে কতটা জামাত তোষণের নীতি অবলম্বন করেছিল সেটা নিয়ে ।

তাঁর মন্ত্রীত্বে একজন ধর্মবাদী লোক ছিলেন মওলানা মান্নান, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করার অভিযোগ ছিল মান্নানের বিরুদ্ধে। এটা এক আপত্তিকর এবং অবাঞ্ছিত পদক্ষেপ ছিল। কিন্তু এটাকেও ধর্মনিরপক্ষতা বিরুদ্ধ কোন পদক্ষেপ বলা যায় না, কারণ কারো ব্যক্তিগত আদর্শ রাষ্ট্র পরিচালনায় অবান্তর, যতক্ষন না সেই ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত মতাদর্শ রাষ্ট্রের উপর না চাপায় । জিয়ার বিএনপিতে অনেক বামপন্থী ও প্রাক্তন আওয়ামী লীগার ও ছিল। শেখ হাসিনার প্রথম আমলেও কিছু প্রাক্তন জামাত সদস্য আওয়ামী লীগে যোগদান করেছিল। কাজেই জিয়া নিজে কোন ইসলামী পদক্ষেপ না নিলে একজন ইসলামিস্টকে সরকারে অন্তর্ভুক্ত করলেই সেটা ইসলামায়ন হবে না। কারণ কিছু বামপন্থীও ছিল তাঁর সরকারে। কিন্তু সেটাকে বামামীকরণ বলা যায়না।

এবার আমাদের আলোচনার অন্যতম ফোকাস ইসলামীকরণের দিকে নজর দেই। ইসলামায়নের একটা পদক্ষেপ ছিল প্রথম থেকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষা (শুধু ইসলাম নয়, সব ধর্মই, যার যে ধর্ম সেটা অনুযায়ী) চালু করা। মুজিব আমলে পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল (পাকিস্তান আমলের মত)। অবশ্য যেহেতু সব ধর্মের শিক্ষাকেই বাধ্যতামূলক করা হয়েছিলে তাই এটাকে অনেকে ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী বলেনা, বাংলাদেশী ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা অনুযায়ী (=সব ধর্মের সমান প্রতিফলন)। এটা পাকিস্তান আমলেও করা হয়েছিল। এছাড়া আর কোন উল্লেখযোগ্য ইসলামীকরণ আমার জানা মতে নেই। বাংলাদেশে ওয়াহাবী প্রভাবের সূচনা তখনো হয় নি।

ইসলামের দৃষ্টিতে গ্রহণীয় নয় এমন একটা উদ্যোগও নেন তিনি। উপরে উল্লেক্ষিত Clinton Bennett এর বইএর ৯৭ পৃষ্ঠা থেকেঃ
“He setup the Ministry of Women’s Affairs and increased the number of reserved seats to 30. He appointed women police,who wore “shirts and trousers” like their male colleagues. When the Saudis objected that women should not be visible in public, he reassigned them “duty inside checkpoints and traffic booths”
(খালেদা জিয়া ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ করেন দ্বিতীয় মেয়াদে)

সৌদীদের চাপ ও নাক গলানোর মাত্রা উপরের উদ্ধৃতি থেকেই অনুমেয়।

– মুজিব কর্তৃক নিষিদ্ধ মদ, জুয়া ও হাউজির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন।

৪। এরশাদ আমলঃ

এরশাদের আগমন হয় বিচারপতি সাত্তারের বিএনপি সরকারকে সরিয়ে। অতীতে পাকিস্তান বা বাংলাদেশে আর কোন সামরিক অভ্যুত্থানে এরকম সঙ্গত কারণ ছাড়া বেসামরিক সরকারকে সরানোর নজীর নেই। সাত্তার ভালই চালাচ্ছিলেন সিভিল গভার্নেন্সের পথে। সাত্তার এমন কোন কাজই করেন নি যার জন্য সেনাবাহিনীর কোন হস্তক্ষেপের প্রয়োজন ছিল। এরশাদের নিজের ক্ষমতার লোভই এর কারণ। যাই হোক এবার এরশাদের ইসলামীকরণের কথায় আসি। এরশাদের আমলেই বাংলাদেশে ওয়াহাবী প্রভাবের সূচণা হয়।

ক্ষমতায় এসেই ১৯৮২ র শেষের দিকে এক ইসলামী জনসভায় যে উনি ঘোষণা দিলেন যে ইসলামী আইনই হবে নতুন সামাজিক ব্যবস্থার ভিত্তি (১৯৯৬ তে জাতীয় পার্টির ম্যানিফেস্টোতে শরীয় আইন চালু করার কথা বলা হয়েছিল) আর সংবিধানে ইসলামের যথোপযুক্ত স্থান দেয়া হবে। এরকম স্পষ্ট ইসলামী কথা বাংলাদেশে এর আগে কোন সামরিক বা বেসামরিক দেশপ্রধান বলেননি। ১৯৮৩ র ১৫ই জানুয়ারী তিনি ঘোষণা দিলেন বাংলাদেশকে ইসলামী দেশে পরিণত করাই তাঁর সংগ্রামের লক্ষ্য।
(God Willing – Riaz, p-37)

১। পূর্বে প্রতিশ্রুত ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম ঘোষণা জুন ১৯৮৮ তে। উল্লেখ্য যে এরশাদের এই ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার বিরোধিতা করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ও বামপন্থী দল সবাই এর প্রতিবাদে ১২ই জুন ১৯৮৮ তে সাধারণ ধর্মঘট ডাকে। (God Willing – Riaz, p-39)

২। একুশে ফেব্রুয়ারীতে আলপনা আঁকা নিষিদ্ধ করা ও পরিবর্তে কোরান পাঠ প্রবর্তন করা। এরশাদ বললেন এখন থেকে ২১ শে ফেব্রুয়ারী ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার দিবস হবে। এবং আরও ঘোষণা দিলন “ইসলামের আদর্শ ও নীতি জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সকল স্তরে প্রতিফলিত হবে”। জিয়ার বিপরীতে তিনি ইসলামী আইডেন্টিটিকে বাঙ্গালী আইডেন্টিটির সঙ্গে সাঙ্ঘর্ষিক বলে মনে করতেন এবং ইসলামকে বাংগালীর উপরে স্থান দিতে চেয়েছিলেন।
( http://www.time.com/time/magazine/article/0,9171,955132,00.htm? )

৩। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলীম দেশ থেকে প্রচুর টাকা এনে ইসলামী শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা করলেন। ১৯৮৬ সালে প্রথমবারের মত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হল বিপুল পেট্রডলার সাহায্যে। সৌদী আরব থেকে কোটি কোটি ডলার সাহায্য নিয়ে মাদ্রাসা, মসজিদ স্থাপন শুরু হল। যার পরিণতিতে ওয়াহাবী ইসলামের আবির্ভাব ঘটে বাংলাদেশে। সৌদী অর্থায়নে ৪৬৯ টি উপজিলায় ইসলামী মিশন স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। বাংলাদেশের ওয়াহাবীকরণের সূচনা এখান থেকেই শুরু হয়।

৪। মসজিদ সংস্কৃতির প্রচলন। এরশাদ প্রত্যেক শুক্রবার বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে খুৎবা দিতে শুরু করলেন। আত্রশির পীর হলেন। অন্যকেও উদবুদ্ধ করলেন। টিভি তে এগুলি প্রচারো করা হত। ইমাম ট্রেইনিং ইন্সটিটিউট স্থাপন।

৫। শুক্রবার সরকারী ছুটি ঘোষণা। পাকিস্তানেও তা করা হয়নি। এর জন্য ব্যবসার বিরাট ক্ষতির কথা নাই বা বললাম। ছুটি থাকাতে জুম্মার নামাজের খুৎবার সময় বেড়ে গেল আর মাইকে কান ফাটান খুৎবা শুনতে বাধ্য হল সব মানুষ, ইচ্ছা বা অনিচ্ছা সত্বেও। আর ইসলামী জেহাদী আর কট্টর বাণী প্রচারেও সুবিধা হল ছুটি থাকায় ।

৬। রেড ক্রসের নাম রেড ক্রিসেন্ট করা। প্রতীকি মনে হলেও এতে ইসলামী এনজিওর অনুপ্রবেশ সহজতর হল। এরশাদের সময়েই বিপুল সঙ্খ্যক ইসলামী দলের গঠন হয়।

৭। এরশাদ মাদ্রাসা শিক্ষা পুনরুজ্জীবিত করলেন ও সৌদী ও ইরানী অর্থায়নে দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন মাদ্রাসা স্থাপন শুরু করলেন ( http://muktadhara.net/page41.html )

দীর্ঘ প্রায় নয় ব্ছর ধরে ইসলামী নীতি অবলম্বনের অপরিহার্য পরিণতিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক মানসে ইসলামের এক অনপনীয় প্রভাব পড়েছিল, যার ফলে ১৯৯১ এর নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ ও এমনকি বামপন্থী দলরাও ইসলামী প্রতীক অবলম্বন করতে শুরু করে জনগণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে, বা এটা বোঝাতে যে তারা এরশাদ বিরোধী হলেও ইসলাম বিরোধী নয়।

৫। খালেদা জিয়া ও হাসিনা আমলে ইসলামীকরণ ও তাদের জামাত নীতিঃ

বিএনপি-জামাত বহুল প্রচলিত এক শব্দ। কথাটা প্রযোজ্য বিএনপির দ্বিতীয় মেয়াদ থেকে। এর আগের ১৯৯২-৯৬ এর বিএনপির বেলায় নয়। ২০০১ সালে বিএনপি জামাত সরকার গঠিত হবার পর এই প্রথ্ম জামাত সরকারে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সুযোগ পেল। এটা বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার উপর এক বিরাট আঘাত। এরশাদের পরে ইসলামী এনজিও, সউদী অর্থায়নে ইসলামী পদক্ষেপের অবারিত সুযোগ আবার খুলে গিয়েছিল এই সময়ে। আবার আওয়ামী লীগ(হাসিনা) যে সম্পূর্ণ জামাত বিরোধী এটাও ভুল ধারণা। ইতিহাস সরল রেখায় চলেনা এর পুনরুক্তি করতে হয়। বিএনপির ২০০১ সালের নির্বাচনে জামাতের সাথে আঁতাত প্রথমবারের মত খোলাখুলিভাবে জামাতকে বৈধকরণ করা হলেও এটা আকস্মিক বা অপ্রত্যাশিত কিছু নয়, এর আগে থেকেই জামাতকে বৈধকরণের দিকে আওয়ামী লীগও গিয়েছিল। দুই দলই জামাতকে কিং মেকার করতে চেয়েছিল। তবে জামাতকে কিং মেকার করার চেষ্টা (সফল হয় নি) অনেক আগেই আওয়ামী লীগ করেছিল। এটা কাকতালীয় কোন ব্যাপার নয় যে শেখ হাসিনা ১৯৯৬ (নির্বাচনের পূর্বে) সালে জামাতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার বিরুদ্ধে ছিলেন। যাহোক আরও এরকম কিছু তথ্যের উল্লেখ/উদ্ধৃত করা হবে নীচে।

এখন কিছু পর্যবেক্ষণ বর্তমান ও অতীত নিয়ে। (হান্নান –> বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস – ড: হান্নান)

– আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলেরই এক অংগ সংগঠন হল ওলামা লীগ । এটা ধর্মনিরপেক্ষার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

– ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বদরুল হায়দার চৌধুরী গোলাম আযমের সাথে বৈঠক করে বিতর্কিত হয়ে পড়েন (হান্নান-৫৩)

– ১৯৯১ এর সাধারণ নির্বাচনের পর, আমির হোসেন আমু আওয়ামী লীগের পক্ষ হয়ে জামাতের বর্তমান সচিব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মাধ্যমে জামাতের ১৮ জন এমপিএর সহায়তায় এক যুক্ত সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন । এর বিনিময়ে জামাতকে ২-৩ টা মন্ত্রীত্ব ও মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত কয়েকটা আসন ছেড়ে দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়। কিন্তু জামাত এইপ্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
(দ্রঃ http://groups.yahoo.com/group/alochona/message/21807
এবং http://bangladesh-web.com/view.php?hidDate=2006-02-01&hidType=OPT&hidRecord=0000000000000000087167 )

– গোলাম আযম তার জবানবন্দীতেও এই তথ্য প্রদান করেঃ
(দ্রঃ http://bdlawhouse.blogspot.com/2011/12/ict-charges-wont-prove-true-prof-ghulam.html
এবং http://www.thenewnationbd.com/newsdetails.aspx?newsid=25663 )

– ২৭ শে জুন ২০০৬ এ জামাতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামী সংসদের বাজেট অধিবেশনে বলেন যে ১৯৯১
সালে সাধারণ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠনে তাঁর দলের সাহায্য চেয়েছিলেন।
( http://www.highbeam.com/doc/1G1-147536925.html, লিঙ্ক এখন নেই)

– কোন দলই ১৯৯১ এ তাদের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টতে গোলাম আযমের বিচারের প্রতিশ্রুতি উল্লেখ করে নি। (হান্নান-৭৪)

– গোলাম আযম ইস্যুতে দীর্ঘদিন সংসদ বর্জনের পর ২৯শে জুন ১৯৯২ সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়। প্রচলিত আইন অনুযায়ী গোলাম আযমের বিচার হবে ও ২৪ জনের বিরুদ্ধে আনীত দেশদ্রোহী মামলা প্রত্যহার হবে বলে মধ্যরাতে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়। বিরোধী দলের সাথে এই চুক্তির প্রতিবাদে ১লা জুলাই ১৯৯২ জামাত সংসদ থেকে ওয়াকাউট করে। (হান্নান -৭৮)

“কিন্তু ১৯৯১ সালে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বিএনপি প্রথমে মহিলা আসনে নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় সরকার গঠনে এককভাবে সমর্থ ছিল না। এর জন্য অন্য যে কোন একটি দলের সমর্থন পাওয়া তার প্রয়োজন ছিল। আওয়ামী লীগ এই সমর্থনে এগিয়ে আসেনি, বরং বিএনপির সরকার গঠনের প্রয়োজনীয় যোগ্যতার প্রশ্ন তোলে। এই প্রেক্ষাপটে যেহেতু জাতীয় পার্টির সমর্থন পাওয়ার প্রশ্ন উঠেনা সেহেতু জামাতে ইসলামীর নিঃশর্ত সমর্থন বিএনপিকে জামাতে ইসলামীর দিকেই ঠেলে দেয়। জামাতে ইসলাম নিঃশর্ত সমর্থন বিএনপিকে দেয় নি, সংসদের দুটো মহিলা আসন জামাতকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে জামাতে ইসলামী অভিযোগ করেছে, সমর্থনের শর্ত হিসেবে গোলাম আযমের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও বিএনপি দিয়েছিল।” (হান্নান -৮১)

[মন্তব্যঃ এই সন্ধিক্ষণে আওয়ামী লীগ যদি বিএনপিকে সরকার গঠনে সাহায্য দিতে এগিয়ে আসত তাহলে
জামাতকে কোনঠাসা করার এক সুবর্ণ সুযোগ হত]

– খালেদা জিয়া সাংবাদিকদের কাছে গোলাম আযমের বিচারের যৌক্তিকতা স্বীকার করেন, তবে বলেন যে প্রচলিত আদালতেই এই বিচার হতে পারে। (হান্নান-৮২)

– ২৩ শে মার্চ ১৯৯২ এ গোলাম আযমকে নোটিশ জারী করে কেন তিনি ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও বাংলাদেশ ত্যাগ করছেন না এবং সাংবিধানিক বিধি লঙ্ঘন করে জামাতে ইসলামীর আমীর হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না এই মর্মে কারণ দর্শাতে বলে। ২৪ শে মার্চ সরকারের নোটিশের জবাবে গোলাম আযম তাঁর বাংলাদেশি নাগরিকত্ব সম্পর্কে যে যুক্তি প্রদর্শন করেন, সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে এবং গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করে। (হান্নান-৮৩)

– ২রা এপ্রিল ঢাকা কুরিয়ারে প্রকাশিত রিপোর্টে বলে হয় যে ২২ শে মার্চ মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশের দূত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে গোলাম আযমকে গ্রেফতারের না করার আবেদন করেন । ঐ দূত এবং জামাত নেতারা সরকারকে গুরুতর পরিণতির জন্য হুঁশিয়ারও করে দেন।
( http://groups.google.com/group/soc.culture.bangladesh/browse_thread/thread/b5ac29eac5d4ac02# )

– ২৪শে জানুয়ারী, ১৯৯৩ পুলিশ মীরেরসরাই জামায়েতে ইসলামের অফিস ঘেরাও করে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করে এবং ১১ জনকে গ্রেফতার করে। (হান্নান-১২৭)

– ১৯৯৩ এর সেপ্টেম্বর বিএনপি তাদের মহাসম্মেলন আয়োজন করে যেখানে খালেদা জিয়া তাঁর ভাষণে দেশের বরেণ্য রাজনীতিকদের স্মরণ করার সময় শেখ মুজিবরের নামও উচ্চারণ করেন। এই সম্মেলনে সকল রাজনৈতিক দলকে দাওয়াত দেয়া হলেও গোলাম আযমের নামে দাওয়াত না দেয়ায় জামাত অতিথি হতে নিজেদের বিরত রাখে। (হান্নান-১৪৬)

– ২০শে সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ সংসদে জামাতে ইসলামী সরকারী দল ও বিরোধী দলের মিলিত আক্রমণের শিকার হয়। এই প্রথম বিএনপিও বিরোধী দলের সাথে জামায়েত বিরোধী ভূমিকা পালন করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্র শিবিরের হাতে ছাত্রদলের কর্মীদের হাতে মার খাওয়ার ঘটনা থেকে বিএনপির এই চেতনা জাগ্রত হয়। বিরোধী দলের নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ তাঁর পক্ষের সমাপণী বক্তব্যে বলেন এখানে আজ যে ঐক্য সুর ধ্বনিত হয়েছে এটা সত্যি আনন্দের। মতভিন্নতা সত্ত্বেও আজ আমরা প্রমাণ করেছি দলের চেয়ে দেশ বড়। (হান্নান-১৪৭)

– ২০শে জুন, ১৯৯৪ বাসদ (বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল) এর মোস্তফা ফারুক এক সভায় বলেন যে ফতোয়াবাজ ও স্বাধীনতা বিরোধী জামাত-শিবির চক্র নতুন চক্রান্তে মেতেছে। আর ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টি ও জামাতের সাথে ঐক্য করেছে। (হান্নান-২২০)

– ২৬শে এপ্রিল , ১৯৯৬ ঢাকার এক সমাবেশে জামাতে ইসলামের আমীর গোলাম আযম বলেন, বিএনপি সরকারের সময় সবচেয়ে বেশি ইসলাম বিরোধী কাজ হয়েছে, ইসলামের বিরুদ্ধে বই লেখা হয়েছে, সেই লেখকদের তারা হেফাজত করছে। তাদের এক মহিলা এমপি পারিবারিক আইন বদলানোর জন্য সংসদে বিল এনেছিল। (হান্নান-৪৭৪)

– ৩১শে মার্চ ১৯৯৬ তে ঢাকার এক সমাবেশে গোলাম আযম বলেন যে বিএনপি এক সন্ত্রাসী পার্টি (হান্নান-৪৬৯)

– ১৭ই মে ১৯৯৬ যশোরের এক জনসভায় গোলাম আযম খালেদাকে মুনাফিক বলে উল্লেখ করেন তাঁরই সহায়তায় সরকার গঠন করে তারপর তাঁকে জেলে পাঠানোর জন্য। (হান্নান-৪৮০)

– দেশের প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ঐতিহাসিকভাবে তাঁর দলের প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল, মৌলবাদী জামাতে ইসলামী, যারা ১৯৭১ স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, এবং একসময়ের একনায়ক এরশাদের জাতীয় পার্টির সাথে এক অদ্ভুত মোর্চা গঠন করেন। মোর্চার অভ্যুদয় প্রেসিডেন্ট আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে বাধ্য করে নভেম্বরের শেষে সংসদ ভেঙ্গে দিতে ও সত্ত্বর নির্বাচনের আয়োজন করতে, ১৯৯৬ এর ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি।
(দ্রঃ http://www.cpj.org/attacks95/attlist95.asia.html )

– আওয়ামী লীগ জামাত বৈঠক ১৯৯৬ তে। জাহানারা ইমামের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় হাসিনা বলেন রাজনৈতিক কারণে তিনি জামাতের সাথে সন্ধি করেছিলেন।
(দ্রঃ http://groups.google.com/group/soc.culture.bangladesh/browse_thread/thread/4d62cccb6b3482ae# )

– ১৯৯৬ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ্যতা না পাওয়ায় এরশাদের জাতীয় পার্টির সহায়য়তা নিয়ে সরকার গঠন করে। জামাত সেই ঐক্যজোটের সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল, আর তাদের সমর্থন উৎসাহের সাথে গ্রহন করা হয়েছিল।
[The Jatya party, which had enacted the bill making Islma the state religion, ad Awami League which had condemned the bill,saying that undermined the spirit of liberation struggle, formed a coalition which ruled the country for five years, between 1996 and 2001. The Jamaat extended its support to the coalition and was greeted with entusiasm]
(Riaz-42)

– ১৯৯৬ এর নির্বাচনের সময়ে শেখ হাসিনা জামাতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার বিরুদ্ধে ছিলেন (দ্রঃ প্রথম আলো, ১৯শে জানুয়ারী, ২০০৮, “যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ধর্মভিত্তিক রয়াজনীতি ও নির্বাচন”- বদিউল আলম মজুমদার)

– ১৯৯৬ নির্বাচনের প্রাক্কালে শেখ হাসিনা হিজাব পরা ও ঘন ঘন উমরাহ করা শুরু করেন, আওয়ামী লীগ তাদের ম্যানিফেস্টোতে আল্লাহু আকবর ও “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, নৌকার মালিক তুই আল্লাহ” শ্লোগান যোগ করে।

– মতিউর রহমান নিজামী চাপাই নবাবগঞ্জের এক জনসভায় অতীতে বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সাথে যোগসাজস করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থণা করেন। (হান্নান-৭৬৯, প্রথম আলো ১২ই ডিসেম্বর, ১৯৯৮)

– ২ রা মার্চ, ১৯৯৮ মসজিদ ভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম উদ্বোধন করতে গিয়ে হাসিনা বলেন তিনি ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ইসলামী ফাউন্ডেশনের নতুন ভবনের কাজ শুরু করেছেন। ৪২ টি জেলায় ফাউন্ডেশনের অফিস ভবন নির্মানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নির্ধারিত সময়ের ১১ মাস আগেই ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থায়ী হাজী ক্যম্পের কাজ সমাপ্ত করেছেন। (হান্নান-৬৯২)

– ২০০২ সালের নভেম্বরে মাদ্রাসা শিক্ষক কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির এক প্রতিনিধিদলের সাথে সুধা সদনে এক মিটিং এ হাসিনা তার আমলে আওয়ামী লীগ ইসলাম ও মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে কি কি করেছিল তার বয়ান দেন । মাদ্রাসা শিক্ষকেরা অভিযোগ করেন যে বর্তমান সরকার মাদ্রাসা স্থাপনে অনুমত দেয়া ও স্বীকৃত দেয়ায় বন্ধ করেছেন। (দ্রঃ ডেইলী স্টার নিউজ, ২০০২, ১৬ই নভেম্বর, dailystarnews.com/200211/16/n2111603.htm#BODY4 লিঙ্ক এখন আর নেই)

– ২০০২ সালের ২৪শে ডিসেম্বরে ঢাকার “The Independent” পত্রিকায় শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে লেখা হয় হাসিনা বলেন যে তাঁর সময়ে ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের জন্য কল্যান ট্রাস্ট গঠিত হয়। ১.৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে গাজীপুরে মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষন ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয়। তাঁর আমলে এমপিওভুক্ত মাদ্রাসার সংখ্যা বিএনপির আমলের ৫৯৭৭ থেকে বেড়ে ৭১৪৬ এ উন্নীত হয়।
(দ্রঃ http://dir.groups.yahoo.com/group/MuktoChinta/message/4437 )

– ২০০৬ সালের আগস্টে শরীক ইসলামী ঐক্যজোটের চাপে বিএনপি সরকার কওমী মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দেয়।

– ২০০৬ এর ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ কট্টরপন্থী ইসলামী দল খেলাফাত মজলিশের সাথে এক নির্বাচনী সমঝোতা চুক্তি সই করে।

উপসংহারঃ

আমার আলোচনা সম্পূর্ণ দাবী করার সুযোগ নেই। আর অনেক কিছু হয়ত যোগ করা যায় দুই দলেরই ইসলামীকরণের পক্ষে ও বিপক্ষে। যেটুকু উল্লেখ করেছি তাতে কয়েকটা পরিস্কার চিত্র বেরিয়ে আসে। এক হল পাকিস্তান বা বাংলাদেশে সৌদী হস্তক্ষেপ, অর্থায়ন ও অণুপ্রেরণায় বাংলাদেশের ইসলামায়ন। আরেকটা হল সব দলই স্বার্থ রক্ষায় ইসলামীকরণে (জামাত তোষণ এর অন্তর্ভুক্ত) হাত দিয়েছে। কেউ পুত পবিত্র নয় রাজনীতিতে। আর এটা এক ধাপে হয় নি। সব দলের সব ইসলামী পদক্ষেপই সামগ্রিক ধারাবাহিক ইসলামীকরণের একটা গ্রন্থি মাত্র। ইসলামীকরণের সূত্রপাত বাংলাদেশের জন্ম লগ্ন থেকেই। তবে এই প্রক্রিয়ায় এরশাদের অবদানই সর্বাধিক ক্ষতিকর, যার কুপ্রভাব একমুখী, অনপনেয়। ওয়াহাবীকরণে তিনিই পথিকৃৎ ছিলেন। ইসলামের ব্যবহারে প্রয়োজনে বিপরীত মেরুর দলগুলি এক শয্যায় শয়ন করেছে। আমরা আর অবাক হইনা যে কোন দলের সাথে যে কোন ইসলামী দলের আঁতাতে। আমরা অবাক হব যদি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কোনদিন আঁতাত করে ধর্মীয় দলগুলির বিরুদ্ধে। এরকম একটা চেতনা বা স্পিরিট এসেছিলে এক ঐতিহাসিক মূহূর্তে (উপরে ২০শে সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ এ সংসদে আব্দুস সামাদ আজাদের মন্তব্য উল্লেখ্য)। কিন্তু দুর্ভাগ্য পরমুহূর্তেই ঐ চেতনার মৃত্যু ঘটে। অথচ এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ চেতনা এখন বাংলাদেশের জন্য। বাংলাদেশের জনগন নতুন তৃতীয় কোন রাজনৈতিক শক্তি চায় না বলেই মনে হয়, তা নাহলে নোবেল বিজয়ী ইউনুসের মত গুনী ব্যক্তির রাজনীতি করার অভিপ্রায়কে কটাক্ষ করে নাকচ করে দিত না, যার জন্য ড: ইউনুসকে প্রমাদ গুনতে হল। আবার জামাতের মত মোল্লাদের পার্টিকেও চায় না(এখনও)। যদি জনগন একসময় বীতশ্রদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগ বিএনপি উভয়কে চরম ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে তাহলে তার একমাত্র পরিণতিতে এরশাদের জাতীয় পার্টিই তৃতীয় শক্তি হিসেবে উঠে আসবে(অবশ্য যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়)। আর এরশাদ বা তাঁর যোগ্য কোন উত্তরসূরীর দ্বারা এরশাদের প্রতিশ্রুত শারিয়া আইনের মুখ দেখবে জনগন। জামাতের দরকার হবে না। এরশাদের পার্টিই জামাতের কাজ করে দেবে। জামাতের সদস্যরা তখন জেপি তে যোগদান করবে গণহারে। এটা এড়াতে হলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একটা ন্যুনতম বোঝাপড়ায় আসা উচিত।

Chris Blackburn এর একটা উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করিঃ

(দ্রঃ http://www.secularvoiceofbangladesh.org/Jamaat%20i%20Islami%20%20A%20threat%20to%20Bangladesh%20by%20Chris%20Blackburn.htm )

“I hope that the two parties can unite in their condemnation and rejection of the Jamaat’s plans for Bangladesh. I have met several BNP leaders and I am amazed by how much they loathe the Jamaat and its policies. I just hope that the top leadership of the BNP will start to listen to the grassroots.”