কমিউনিটি কলেজে আমার ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন ডেভিড ওয়ালেস। বয়স তার পঞ্চাশের কোঠায়। উচ্চতা যেমন বিশ্রী রকমের বেশী তেমনি বিশ্রীভাবে ঝুলে থাকে তার বিদঘুটে লম্বা সরু গোপ থুতনির ঠিক কাছাকাছি। ইংরেজি সাহিত্যে ডক্টরেট, তারপরেও কলেজে এসে মাস্টারী করছেন। আগবাড়িয়ে কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করে বসলো- ডেভিড, সাহিত্যে তোমার এত বড় একটা ডিগ্রী, কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াও না? এই ধরনের সওয়াল ডেভিডের ভালো লাগার কথা নয়। সামান্য বিরক্তিতে কপাল যায় কুঁচকে। উত্তর করে- কেন তাতে তোমার কোন অসুবিধে আছে? উত্তর করে ভাবে সে, জবাবটা বোধ হয় একটু কড়া হয়ে গেল। প্রশ্নকর্তাকে একটু বুঝিয়ে বলা দরকার। তাই আগের কথাগুলো আর একটু মেরামতে মন দেয় ডেভিড- শোন, কলেজইতো শেখানোর জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয়েতো ভাল ভাল শিক্ষকে ভরা, এখানে কেউ আসতে চায় না- আমি না হয় এলাম। কথা আর কোন পক্ষই বাড়াতে পারে না এ বিষয়ে- প্রসঙ্গ যায় পালটে। যাই হোক, আমাদের ক্লাশটা ছিল লেখালাখির- সৃজনশীল লেখা বা ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ের। একদিন একটা ক্লাশে এসে ডেভিড সবাইকে একটা লেখার এসাইনমেন্ট দিল- ক্লাশে লিখে ক্লাশে জমা দিতে হবে, মার্ক আছে। একটা বিমূর্ত বিষয়- ‘বন্ধুত্ব’এর উপর লিখতে হবে সবাইকে। ক্লাশের সময় অর্ধেক পেরতে না পেরতে ফটাফট খাতা জমা হতে লাগলো শিক্ষকের টেবিলে। ডেভিড ভীষNণ করিতকর্মা শিক্ষক। সব খাতা শ্রেণীকক্ষেই দেখা সারা তার, মার্কিংও শেষ। ছাত্ররা ইচ্ছা করলে একে অপরের গ্রেডিং জানাজানি করতে পারে, কিন্ত শিক্ষকের এসব করতে মানা। তাই যার যার খাতা তার তার হাতে ধরিয়ে দিল ডেভিড। দুর্ভাগ্যের প্যাঁচখানা লাগলো আমার বেলায়। সবার পরে আমার খাতাখানা জমা পড়লো শিক্ষকের টেবিলে। টেবিলের খুব কাছের বেঞ্চিটাতে বসে বসে ভাবছি আমি- এত সময় ধরে কি দেখছে ডভিড? সবাই চলে গেছে, সময় যেন আর শেষ হয় না। ওদিকে সুযোগ বুঝে ক্ষুধাও বেয়াড়া হয়ে উঠছে। কি আর করা, অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করার নেই এই মুহুর্তে। এক সময় ডভিডের খাতা দেখা শেষ হলো। মুখে তার একটা সন্তুষ্টির হাসি। বেশী সময় নেই হাতে। ব্যাস্ত হাতে নিজের কাগজ-পত্র সব গুছিয়ে নিল সে।
-গল্পটাকি তোমার নিজের তৈরী?- সাদা ঝুলন্ত গোঁপের তলা থেকে প্রশ্নটা করে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হাসলো ডেভিড।
-হ্যা, আমারই।
-রচনার ভিতরে গল্প আর শেষে ধ্রুপদী কবিতার কোট- অন্য রকম হয়েছে, ব্যতিক্রমী। ভাল লেগেছে, এটুকুই বলবো।
-ধন্যবাদ, ডেভ।
-তোমাকে আমার এক শিক্ষকের ইমেল এড্রেস দিচ্ছি, যোগাযোগ করবে তার সাথে আমার রেফারেন্সে। উনি আমার খুবই প্রিয় শিক্ষক। লেখালেখির উপরে- বিশেষ করে গল্প লেখার উপর উনি মাঝে মাঝে কর্মশালা করেন অটোয়া, মন্ট্রিয়েল এইসব শহরে। যদি কখনো টরোন্টতে হয়, খবরদার মিস করো না। আমার বিশ্বাস লেখার শিল্প-কলাটা তুমি ধরতে পারবে, ভাল করতে পারবে লেখায়।

এসব আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগের কথা। ডেভিডের কথা মতো সব ঠিক ঠিক করেছিলাম, কিন্তু শিল্প বা কলা কোনটাই ধরতে পারিনি। সব কিছুই কলা দেখিয়ে চলে গেছে সামনে দিয়ে। ডেভিড আমাকে যার ঠিকানা দিয়েছিল তার নাম- জোসি লিন্দ্রো উরবিনাJos, উত্তর আমেরিকার একজন নামকরা ছোটগল্পকার। চিলির মানুষ তিনি, জন্মেছিলেন ১৯৪৯সালে। সে দেশের গৃহযুদ্ধের সময়ে আত্মরক্ষার তাগিদে কানাডায় চলে আসেন ১৯৭৭ সালে এবং অটোয়ার কার্লটন ইউনিভার্সিটিতে সাহিত্যের উপর তার লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯৮৭ সালে তার ছোটগল্পের সংগ্রহ ‘লস্ট কজেস’এর প্রথম অনুবাদ প্রকাশিত হয় ইংরাজিতে। এই দক্ষ গল্পকারের দুটো কর্মশালায় অংশ নেয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল, সেই নব্বই-এর দশকে। তার গল্পের দুটো বৈশিষ্ট আমাকে খুব টানে- এক, তিনি খুব অল্প পরিসরে লিখতে সমর্থ, দুই- গল্পে তার সৃষ্ট টার্নিং পয়েন্ট বা বাঁকগুলো ভীষন ধারালো, অনেকটা ‘ও হেনরি’র মতো। আজ আর নিজের গল্প নয়, জোসি উর্বিনার খুবই খর্বাকার একটা গল্পের ছায়া অবলম্বনে একেবারে খোল-নলচে পালটে বাংলা আবহ ও পারিপার্শ্বিকতায় কিছু একটা লেখার চেষ্টা করবো।

একজন নারীর প্রতিকৃতি

পাখীর বাসার মত ছোট সারি সারি ঘর। বাম সারি ডান সারি দুই পাশে অগুনিত ঘর, কংক্রিটের নরক। সারিগুলোর মাঝখান দিয়ে সরু করিডোর। ঘরগুলোয় কোন জানালা নেই, তবে করিডোরের এক্কেবারে শেষ মাথায় একটা ছোট্ট জানালা। সেখান দিয়ে সূর্য্য আসে না, আসে তার ছায়া আলো আধারী মিশিয়ে। এই ব্যবস্থা কয়েদিদের জন্য- যেন তারা সূর্য্য ছুয়ে ফেলতে না পারে, না পারে জ্বলে উঠতে- তারই জন্যে এই কৌশল।

অস্থায়ী জেলখানা এটা। জেলখানার ছোট্ট একটা কবরে তেইশ নম্বর কয়েদী মিস জাহানারা বসে আছে সজাগ। তার হাত-পা-চোখ-মুখ সব সজাগ- সজাগ তার পঞ্চ ইন্দ্রীয়। তার কানে একটা আওয়াজ এলো এইমাত্র- একটানা আওয়াজ- ভারী বুটের মচমচ খটখট শব্দ, যেমন আসে প্রতিদিন ভোরে ঠিক এই সময়ে। সূর্য্যের হালকা ছায়ার ভেতর দিয়ে ভারী জীবন্ত কোন প্রাণী এগিয়ে আসছে তেইশ নম্বর রুমের দিকে। সেই একই শব্দ, সেই একই গন্ধ, সেই একই ছায়া- মিস জাহানারা আরও সজাগ হয়। চকিতে তার আঙ্গুল হয়ে যায় চিরুনীর দাত- তা দিয়ে চুল গুলো আচড়ে ফেলে সে। হাতের আঙ্গুলের ডগায় থুথু লাগিয়ে ভ্রুজোড়া পরিপাটি করে, মলিন নখগুলোও মেজে নেয় মিস জাহানারা। এক সময় তেইশ নম্বর ঘরের সামনে এসে সব আওয়াজ থেমে যায়। ঘরে ঢোকে বালুচ ক্যপ্টেন। স্বীকারোক্তি তার চাইই। সেই একই মুখ, একই গলার আওয়াজ, সেই একই বাঁকা প্রশ্ন। পুরু পাথরের গোপ, আর পাথরের মুখের ভেতর থেকে তার বেরিয়ে আসে শব্দ বাক্য আর পরিত্যাক্ত বাগধারা।
-তারপর, মিস জাহানারা, সেদিন তাহলে আমাদের কোথায় পাওয়া গিয়েছিল?
-আমাদের বুঝা উচিত, আমরা একজন নারীর সাথে কথা বলছি।
কয়েদীর কথার ব্যকরন পরিস্কার, তবে তার চোখের দৃষ্টিতে কি যেন এক অচেনা আলোর আসা যাওয়া।
খুব ভারী একটা ঘুষি এসে পড়ে কয়েদির মুখের উপরে চকিতে। চোয়ালের হাড় ভেঙ্গে কয়েকটা টুকরো হয়। সেগুলোর শব্দ আর ব্যথা টের পায় মিস জাহানারা।
-সেদিন তাহলে আমদের কোথায় পাওয়া গিয়েছিল, মিস জাহানারা?
-আমাদের বোঝা উচিত, আমরা একজন নারীর সাথে কথা বলছি।
চোয়াল ভাঙ্গা কয়েদীর আবারও নির্ভয় উত্তর। চোখে তার তখনও অচেনা স্বপ্ন, তবে সেটার কোথাও ভাঙ্গা নেই- একেবারেই নিরবিচ্ছিন্ন সেটা। মুক্তির স্বপ্ন সেটা। ভুলে একবার তাকায় কয়েদী করিডোরের শেষ প্রান্তের জানালাটার দিকে, যেখান দিয়ে প্রতিদিন এসে ঢুকতো সূর্য্যের ছায়া। অবাক হয়ে দেখলো কয়েদী, আজ সেখানে ঢুকে পড়েছে আস্ত সূর্য্যটা নুহুর প্লাবনে প্লাবনে।