ভূমিকা
মানব মস্তিষ্ক এবং এর বিবর্তন নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কিছু লিখব ঠিক করেছি। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই লেখা। এটা সিরিজের প্রথম পর্ব বলা যেতে পারে। কিন্তু ব্লগ জগতে একটা কথা প্রচলিত আছে – কয়েক পর্বে সিরিজ লেখার চিন্তা করলে সেই সিরিজের নাকি অকালমৃত্যু ঘটে। তাই সেই ভয়ে এটাকে ‘প্রথম পর্ব’ কিংবা লেখার পরে ‘চলবে’ জাতীয় কথাগুলো বলা থেকে বিরত থাকলাম। কিন্তু ভবিষ্যতে এ নিয়ে লেখার হাল্কা হলেও এক ধরণের পরিকল্পনা থাকায় কিছু অংশ সবিস্তারে লিখতে পারিনি। সেজন্য কিছু কিছু অংশ ছন্নছাড়া মনে হলেও হতে পারে। সেরকম কিছু মনে হলে অগ্রিম ক্ষমা চাইছি। সবিস্তারে না লেখার কথা বলছি বটে কিন্তু লেখাটা শেষ করে এর দিকে তাকিয়ে নিজেরই ভয় লাগছে। লেখাটা রীতিমত হাতী সাইজে রূপ নিয়েছে দেখছি। এ ধরণের হাতী সাইজের লেখা আমার নিজেরই পড়া হয়ে উঠে না। পাঠকদের ক্ষেত্রেও সে সম্ভাবনাটুকু থেকে যাচ্ছে। তারপরেও লেখাটাকে আরো ছোট ভাগে ভাগ না করে পুরোটুকু একসাথেই দিলাম।

:line:

মানব মস্তিষ্কের আনইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন

 

মানব মস্তিষ্ক নিয়ে আমার কৌতূহল আসলে বহুদিনের। শুধু কৌতূহল বললে ভুল হবে, মস্তিষ্ককে ঘিরে আমার ছোটবেলা থেকেই ছিলো এক বিনম্র এক রহস্যময় অনুভূতি। তাই ২০০২ সালে আমার পিএচডি কাজের সময় যখন আমার সুযোগ আসলো মানব মস্তিষ্কের মডেলিং নিয়ে কাজ করার, সে সুযোগ আমি সাথে সাথে লুফে নিয়েছিলাম। একে তো এ ছিলো আমার জন্য এক দারুণ সুযোগ, তার উপর মানুষের জটিলতম অঙ্গ – মস্তিষ্কের মডেলিং নিয়ে কাজ। অভিভূত হবার মতোই ব্যাপার। কিন্তু অভিভূত হবার পাশাপাশি আমার মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল ভয়ের এক শীতল শিহরণও। ভয় পাওয়ার তো কথাই। শুধু আমি কেন, মানব মস্তিষ্কের গঠন, রকম সকম, আকৃতি, প্রকৃতি, জটিলতায় বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত হাবুডুবু খান। মস্তিষ্ককে হর-হামেশাই তুলনা করা হয় সুপার কম্পিউটারের সাথে, বলা হয় সেটা পৃথিবীর ‘শ্রেষ্ঠ সুপার কম্পিউটারেরও বাপ’, কেউ বা বলেন ‘শ্রেষ্ঠতম বায়োলজিক্যাল প্রত্যঙ্গ’, কেউ বা তুলনা করেন মহাবিশ্বের জটিলতার সাথে, যার রহস্যভেদ কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।

শুধু তাই নয়। মানব মস্তিষ্ককে এ পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ দেখে স্রষ্টার ‘পারফেক্ট ডিজাইন’ হিসেবে। শুধু ধার্মিকেরা নন, যারা নিয়মানুগ বিজ্ঞানের চর্চা করেন, যারা বিজ্ঞানের সাথে ধর্মকে খুব একটা মেশাতে পছন্দ করেননা, তারাও মানব মস্তিষ্কের কাছে গিয়ে যেন খেই হারিয়ে ফেলেন, হয়ে যান হতবিহবল। সবার কাছেই মানব মস্তিষ্ক নান্দনিক, জটিল এবং সর্বোপরি নিখুঁত। এর মধ্যে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই। কিন্তু তাইকি হবার কথা? আমরা জানি বিবর্তনের ফলে উদ্ভূত জীবদেহ কিংবা তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সচরাচর নিখুঁত হয় না। বিবর্তন কিভাবে কাজ করে সেটা জানা থাকলে এর কারণ বোঝাটা কিন্তু কঠিন নয়। প্রাকৃতিক নির্বাচন যেহেতু কেবল বিদ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলোর উপর ভিত্তি করে দীর্ঘ সময় ধরে পরিবর্তিত এবং পরিবর্ধিত হয়, তাই যুক্তি সঙ্গত কারণেই জীবদেহে অনেক ত্রুটিপূর্ণ বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়। আমাদের সবার চোখেই একটি জায়গা আছে যাকে আমরা অন্ধবিন্দু বা ‘ ব্লাইণ্ড স্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করি। আমাদের প্রত্যেকের চোখেই এক মিলিমিটারের মত জায়গা জুড়ে এই অন্ধবিন্দুটি রয়েছে, আমরা আপাতভাবে বুঝতে না পারলেও ওই স্পটটিতে আসলে আমাদের দৃষ্টি সাদা হয়ে যায়। এছাড়া আছে পুরুষের স্তনবৃন্তের মতো বিলুপ্তপ্রায় নিষ্ক্রিয় অঙ্গ। এগুলো দেহের তেমন কোন কাজে লাগে না। মহিলাদের জননতন্ত্র প্রাকৃতিক-ভাবে এমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে যে অনেকসময়ই নিষিক্ত স্পার্ম ইউটেরাসের বদলে অবাঞ্ছিতভাবে ফ্যালোপিয়ান টিউব, সার্ভিক্স বা ওভারিতে গর্ভসঞ্চার ঘটায়। এ ব্যাপারটিকে বলে ‘একটোপিক প্রেগন্যান্সি’। ওভারী এবং ফ্যালোপিয়ান টিউবের মধ্যে অতিরিক্ত একটি গহ্বর থাকার ফলে এই ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ডিস্ট্রফিন জিন আছে যেগুলো শুধু অপ্রয়োজনীয়ই নয়, সময় সময় মানবদেহে ক্ষতিকর মিউটেশন ঘটায়। আমাদের দেহে ত্রিশ বছর গড়াতে না গড়াতেই হাড়ের ক্ষয় শুরু হয়ে যায়, যার ফলে হাড়ের ভঙ্গুরতা বৃদ্ধি পায়, একটা সময় অস্টিওপরোসিসের মত রোগের উদ্ভব হয়। বিবর্তনীয় পথে উদ্ভূত জীবদের ‘ডিজাইন’ নিখুঁত নয় বলেই এই সমস্যাগুলো তৈরি হয়।

গতবছর একটা বই লিখেছিলাম ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ নামে। বইটার এক অধ্যায়ে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বাকযন্ত্রের স্নায়ুকে (recurrent Laryngeal nerve) উদাহরণ হিসেবে হাজির করা হয়েছিলো। মজার ব্যাপার হল, এই স্নায়ুটি সরাসরি মস্তিষ্ক থেকে বাকযন্ত্রে যাওয়ার সোজা এক ফুট রাস্তা সে গ্রহণ করেনি। মস্তিষ্ক থেকে বের হয়ে এটি প্রথমে চলে যায় বুক পর্যন্ত। সেখানে হৃদপিণ্ডের বাম অলিন্দের প্রধান ধমনী এবং ধমনী থেকে বের হওয়া লিগামেন্টকে পেঁচিয়ে আবার অনাবশ্যক-ভাবে উপরে উঠতে থাকে। উপরে উঠে তারপর সে যাত্রাপথে ফেলে আসা বাকযন্ত্রের (larynx) সাথে যোগ দেয়। হাত মাথার পেছন দিয়ে ঘুরিয়ে ভাত খাওয়ার ব্যাপারের মতো এই যাত্রাপথে স্নায়ুটি এক ফুটের জায়গায় তিন-ফুটের চেয়েও বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে। জিরাফের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার আমরা দেখতে পাই। সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরো ভয়ঙ্কর। মস্তিষ্ক থেকে বের হয়ে সে লম্বা গলা পেরিয়ে বুকের মধ্যে ঘোরাঘুরি শেষে আবার লম্বা গলা পেরিয়ে উপরে উঠে বাকযন্ত্রে সংযুক্ত হয়। একজন ভাল ডিজাইনার সরাসরি সংযুক্ত করে দিলে যে দূরত্ব তাকে অতিক্রম করতে হতো,তার থেকে প্রায় পনের ফুট বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে হয় উদ্দেশ্যহীন, লক্ষ্যহীন এবং অন্ধ প্রাকৃতিক নির্বাচনের কেরমতি মেনে নিয়ে। আরো একটা বিষয় বোঝা গেছে এই উদাহরণ থেকে। আমরা যে একসময় মৎস-জাতীয় পূর্বপুরুষ থেকে ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ে স্তন্যপায়ী জীবে পরিণত হয়েছি, এর একটি উল্লেখযোগ্য সাক্ষ্য কিন্তু এটি। এ নিয়ে অধ্যাপক জেরি কোয়েন তার ‘Why Evolution is True’ গ্রন্থে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। রিচার্ড ডকিন্সের Greatest Show on Earth বইটিতেও এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা আছে। এর বাইরে অধ্যাপক নীল সুবিনের লেখা ‘Your Inner Fish’ বইটিতেও প্রাসঙ্গিক বহু তথ্য পাওয়া যাবে।

চিত্র – বাকযন্ত্রের স্নায়ুর ‘ডিজাইন’ সাক্ষ্য দেয় যে আমরা মৎস-জাতীয় পূর্বপুরুষ থেকে ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ে স্তন্যপায়ী জীবে পরিণত হয়েছি।

বলা-বাহুল্য, বাকযন্ত্রের স্নায়ুর এই আবর্তিত পথ শুধু মাত্র খুব বাজে ডিজাইনই নয় এটি ক্ষেত্র বিশেষে ভয়ংকরও। স্নায়ুটির এই অতিরিক্ত দৈর্ঘ্যের কারণে এর আঘাত পাবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। কেউ আপনাকে বুকে আঘাত করলে আমাদের গলার স্বর বন্ধ হয়ে আসে সেজন্যই। বুকে ছুরিকাহত হলে কথাবলার ক্ষমতা নষ্টের পাশাপাশি খাবার হজম করার ক্ষমতাও ধ্বংস হয়ে যায়। বুঝা যায় কোনো বুদ্ধিদীপ্ত মহাপরিকল্পক এই স্নায়ুটির ডিজাইন করেননি, এই অতিরিক্ত ভ্রমণ এবং ‘ব্যাড ডিজাইন’ সংক্রান্ত জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে বিবর্তনের কারণেই।

দেহের নানা জায়গায় ত্রুটি বিচ্যুতির নানা কারণ এবং ব্যাখ্যা আমাদের জানা থাকলেও অবধারিত ভাবে মস্তিষ্কের কাছে এসে আমরা থেমে যেতাম। যেন মনে করতাম মস্তিষ্ক ব্যাপারটা বিবর্তনের পথ ধরে যেন উদ্ভূত হয়নি, এক অশরীরী সত্ত্বার নিপুণ হাতে তৈরি বলেই এটি এত উন্নত, নিপুণ, নিপাট, নিখুঁত সুন্দর। এর ডিজাইনে কোন ফাঁক নেই, নেই কোন অপূর্ণতা। কিন্তু সত্যই কি তাই? আজকের এই প্রবন্ধে আমরা বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মস্তিষ্ককে বিশ্লেষণ করে দেখব এই দাবীর পক্ষে সত্যতা কতটুকু।

আগেই বলেছিলাম মস্তিষ্ক নিয়ে আমার ছিলো অদম্য কৌতূহল।  সেই কৌতুহলের খেসারত হিসেবে আমার গবেষণার জন্য প্রায় তেতাল্লিশটি কাঠামো (প্রত্যঙ্গ) সনাক্ত করে মডেলিং করতে হয়েছিলো। সেগুলোর ছিল বিদঘুটে সমস্ত নাম – কর্টেক্স, কর্পাস ক্যালোসাম, ফরনিক্স, হিপোক্যাম্পাস, থ্যালমাস, হাইপোথ্যালামাস, ইনসুলা, গাইরাস, কডেট নিউক্লিয়াস, পুটামেন, থ্যালামাস, সাবস্ট্যানশিয়া নাইয়াগ্রা, ভেন্ট্রিকুলাস, ব্রেইনস্টেম ইত্যাদি। আমার আগের দু একটি লেখায় আমার মডেলিং এর কিছু ছবি দিয়েছিলাম। এখানেও দেয়া যাক –

চিত্র- মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ সনাক্ত করে ত্রি-মাত্রিক মডেলিং; বিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের চিন্তাভাবনা, কর্মমান্ড, চাল চলন এবং প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা অনেকাংশেই মস্তিষ্কের এই সমস্ত প্রত্যঙ্গগুলোর সঠিক কর্মকাণ্ডের এবং তাদের সমন্বয়ের উপর নির্ভরশীল।

মানব মস্তিষ্ককে মডেলিং করা হয় কিভাবে? একেক জন একেকভাবে করেন। একজন মেডিক্যালের ছাত্র হয়তো মডেলিং করতে চাইবেন ব্রেন-অ্যানাটমিকে সামনে রেখে। একজন নিউরোসার্জনের কাছে হয়তো প্রাধান্য পাবে মস্তিষ্কের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের কাজের মডেল। একজন আণবিক জীববিজ্ঞানী হয়তো আণবিক স্কেলে ব্যাপারটার সুরাহা করতে চাইবেন। আবার এক মনোবিজ্ঞানী হয়তো দেখতে চাইবেন সার্বিকভাবে মস্তিষ্কের আচরণ। আমি আমার বুয়েটের ছাত্রজীবনে আর তারপরের চাকুরী জীবনে ছিলাম মূলতঃ মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার। তাই পিএইচডিতে বায়োইঞ্জিনিয়ারিং এ গবেষণা করতে গিয়ে ব্রেনের মডেলিং করলেও আমার সে মডেলিং ছিলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যন্ত্রকৌশলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ধার করা। ফাইনাইট এলিমেন্ট মডেলিং করে স্ট্রেস স্ট্রেইন এনালাইসিস ইত্যাদি। মস্তিষ্কের টিস্যুকে হাইপারভিস্কোইলাস্টিক পদার্থ হিসেবে নিয়ে অরৈখিক জালিকা (non-linear mesh) তৈরি করে মডেলিং করেছিলাম। আর প্রোগ্রাম করে একটা ডিসপ্লে ইঞ্জিন বানিয়েছিলাম যেটাতে সিমুলেশনগুলো দেখা যায়।

যাকগে, মস্তিষ্কের মডেলিং নিয়ে এত প্যাঁচালে কাজ নাই। এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্যও মডেলিং বোঝা নয়, বরং সার্বিকভাবে মস্তিষ্ককে বোঝার প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নেই বরং। তবে যেটা বলার জন্য এই আয়োজন সেটা বলে ফেলি। মস্তিষ্ক নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অদ্ভুত একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিলাম সে সময়। ব্যাপারটা হল – আমি অবাক হয়ে দেখলাম যে, মস্তিষ্ককে সাধারণভাবে যতটা নিখুঁত এবং চৌকস ভাবা হয় আসলে তা মোটেই নয়। বাকযন্ত্রের স্নায়ুর মতই কিছু প্রত্যঙ্গ মস্তিষ্কেও আছে যাদের কাজ করতে হলে অনেক অনেক ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে করতে হয়। কিছু কিছু জায়গায় তার ‘ডিজাইন’ হাস্যকর রকমের দুর্বল এবং খেলো। এর টিস্যু দুর্বল, নিউরনের গঠন আর কর্মক্ষমতা দুর্বল, এক্সনগুলো এতোটাই খারাপ পরিবাহী যে মাঝে মধ্যেই তথ্য চুইয়ে বাইরে হারিয়ে যায়, একটা সাধারণ কম্পিউটারের প্রসেসিং এর সাথে তুলনা করলে ব্রেনের প্রসেসিং দক্ষতা আসলে চোখে পড়ার মতোই অদক্ষ। এমনকি স্মৃতিসংরক্ষণেও নানা ঝামেলা হয় বলেই দীর্ঘদিন অতিক্রান্ত হলে প্রায়শই স্মৃতি আমাদের সাথে প্রতারণা করতে শুরু করে। আর সামান্য কিছু কাজ করতে গেলেই তার দরকার হয় বিশাল এক ‘নেটওয়ার্কিং’-এর। তার উপর আমাদের মস্তিষ্ক যেন শক্তিখেকো এক দানব – দেহের সিংহভাগ শক্তিই আসলে খরচ হয় আমাদের এই মস্তিষ্ককে সচল রাখতে।

এ ব্যাপারগুলো আমার চোখে পড়েছিলো অনেক আগেই। কিন্তু এ নিয়ে তখন খুব একটা উচ্চবাচ্য করার সাহস বা সুযোগ কোনটাই পাইনি। আর তা ছাড়া বড় বড় ঝানু-মাথা বিশেষজ্ঞরা যেভাবে ‘সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমির মত’ মস্তিষ্কের স্তব করায় ব্যস্ত ছিলেন, আর মানব মস্তিষ্ককে একেবারে পূজার বেদীতে তুলে যেভাবে ফুল-বেলপাতা সহযোগে অর্ঘ্য পরিবেশন করে যাচ্ছিলেন, আমি ভেবে নিয়েছিলাম হয়তো আমারই নিশ্চয় কোথাও না কোথাও ভুল হচ্ছে। এর মধ্যে কেটে গেল বেশ কিছু বছর। এর মাঝে চাকুরী জীবনে ভিন্ন ধরণের কাজে জড়িয়ে পড়লেও আমার পূর্বতন একাডেমিক কাজের যোগসূত্রের কারণেই হোক, কিংবা বিবর্তন নিয়ে মুক্তমনায় সাম্প্রতিক লেখালিখির কারণেই হোক মানব মস্তিষ্ক ব্যাপারটা সবসময়ই রয়ে গিয়েছিলো আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে। সেজন্যই এ সংক্রান্ত খোঁজখবর আর কিছুটা পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া। আর তা করতে গিয়েই দেখলাম – আমার সে সময়কার ধারণায় ভুল কিছু ছিলো না। হ্যাঁ, মানব মস্তিষ্ক যে অভিনব বা নিখুঁত কোন জিনিস নয়, বরং বহু জায়গায় রয়ে গেছে বেশ ভ্রান্ত ডিজাইনের আলামত – তা মানব মস্তিষ্ক নিয়ে বড় বড় বিজ্ঞানীদের অতি সাম্প্রতিক কিছু কাজ থেকে আবারো খুব ভালমতো বুঝতে পারলাম। এর মধ্যে কিছু ভাল বইও লেখা হয়েছে সেইসব ধারণাগুলোকে সন্নিবদ্ধ করে। এর মধ্যে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড লিণ্ডেনের লেখা ‘অ্যাক্সিডেন্টাল মাইণ্ড’ (The Accidental Mind: How Brain Evolution Has Given Us Love, Memory, Dreams, and God) এবং নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্যারি মার্কসের লেখা ‘ক্লুজ’ (Kluge: The Haphazard Evolution of the Human Mind) বইদুটো খুবই উল্লেখযোগ্য। তবে সেখানে যাবার আগে আমাদের মস্তিষ্ক নিয়ে সামান্য কিছু ব্যাপার জেনে নেয়া প্রয়োজন।

খুব সাধারণ ভাবে শুরু করি। হিউম্যান ব্রেন বা মানব মস্তিষ্ক আসলে কি? মানব মস্তিষ্ক হচ্ছে তিন পাউন্ডের ঘন টিস্যুর দলা। কিন্তু টিস্যুর দলা বললেও এমন নয় যে টিস্যুর সব জায়গা একই রকমের। কোন জায়গা ঘন, কোন জায়গা পাতলা, কোন জায়গায় জালির মত খাঁজ, কোন জায়গা হয়ত খাঁজ-বিহীন সরল, সোজাসাপ্টা। কিন্তু বুঝব কি করে মস্তিষ্কের টিস্যুর কোথায় কি আছে? আসলে মস্তিষ্কের কোন স্তরে কি আছে, সেটা জানতে হলে মস্তিষ্ককে পলাশী বাজারের মুশফিক কসাইয়ের মতো ব্যবচ্ছেদ করতে হবে।

মস্তিষ্ককে কিভাবে ব্যবচ্ছেদ করা যায়? সোজা কথায় আপনাকে ব্রেন নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে হবে। তবে যেনতেন ভাবে কাটাকাটি করলে হবে না, কাটার নিয়ম আছে কিছু। আপনার কাছে আসলে তিনটে পথ খোলা। আপনি মস্তিষ্ককে কাটতে পারেন আড়াআড়ি, যেটাকে বলে করোনাল সেকশন, কিংবা কাটা যায় উপর থেকে নীচ বরাবর – যেটাকে বলে এক্সিয়াল সেকশন, কিংবা কাটা যায় পাশ বরাবর। মস্তিষ্ককে এই তিন দিক থেকে কাটলে এর ক্রস-সেকশন তিন রকমের দেখাবে। আমার কথা শুনে ভজকট লেগে যাবার আগেই আমি পাঠকদের জন্য একটা ছবি দিচ্ছি যাতে ব্যাপারটা পরিষ্কার থাকে-

আমি এর মধ্যে পাশ বরাবর কাটা ‘স্যাজিটাল ক্রস-সেকশন’টাই বেছে নিচ্ছি, সুবিধার জন্য। এভাবে মাঝ বরাবর পাশ থেকে কেটে ফেললে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের হদিস পাব আমরা । তবে সবগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাম ঠিকুজি আমাদের এই মুহূর্তে জানার দরকার নাই, যেগুলো এই প্রবন্ধে উঠে আসবে, তার কয়েকটি এখানে দেয়া গেল-

চিত্র – মস্তিষ্কের স্যাজিটাল ব্যবচ্ছেদে পাওয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গ।

এর মধ্যে আবার কর্টেক্স, কর্পাস কলোসাম, থ্যালামাস, সেরেবেলাম, ব্রেন স্টেম, হাইপোথ্যালামাস আর সেরেব্রাম নামের অংশগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বিদঘুটে নামগুলো না হয় জানা গেল, কিন্তু এগুলো ঠিক কি কাজ করে সেটা বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। আর তা ছাড়া আমার লেখার যে হাত, তাতে সেটা হয়ে উঠবে শুকনো পাউরুটির মতোই ম্যাড়মেড়ে নিরস। কর্টেক্স কি করে, ব্রেনস্টেম কি করে, সেরেবেলামেরই বা কী কাজ, এগুলো ফেনিয়ে ফেনিয়ে বলার ইচ্ছেও আমার নেই, সাধ্যও সীমিত। কেউ বিভিন্ন অঙ্গের কাজ জানতে চাইলে বাজারে ব্রেনের অ্যানাটমি নিয়ে সহজ ভাষায় বহু বই আছে, সেগুলো দেখতে অনুরোধ করব। এর মধ্যে এই মুহূর্তে আমার হাতের সামনে আছে অধ্যাপক আম্মার আল চালাবি, মার্টিন আর.টার্নার এবং শেন ডেলামন্ট-এর লেখা ‘The Brain’ বইটি। এর বাইরে রিটা কার্টার, সুসান এল্ড্রিজ, মার্টিন পেজ, স্টিভ পার্কার প্রমুখের লেখা ‘The Human Brain Book’ বইটিও চমৎকার। এ ছাড়া মুক্তমনা ব্লগেও এ নিয়ে ভাল কিছু লেখা আছে, যেমন মস্তিষ্কে, অনুরণন সংগোপনে – নিউরোএনাটমি লেখাটির কথা বলা যায়। পাঠকদের সরাসরি সেই লেখাটিতে চলে যেতে পরামর্শ দিচ্ছি, মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের কাজ কারবার নিয়ে বিস্তারিতভাবে জানবার থাকলে।

আমি এ প্রবন্ধের জন্য যা করব তা হল, মস্তিষ্ককে বড় সড় তিনটি ভাগে ভাগ করে ফেলা – ক) উপরিভাগ বা ফোরব্রেন, খ) মধ্যভাগ বা মিড ব্রেন আর গ) নিম্নভাগ বা হিন্ড ব্রেন। মাথার একদম উপরের দিকে যে প্রত্যঙ্গগুলো যেমন কর্টেক্স, সেরেব্রাম (ছবি দেখুন) প্রভৃতি – সেগুলো মস্তিষ্কের মানবীয় অনুভূতির সর্বোচ্চ স্তর ধারণ করে বলা যায়। এই যে সচেতনতা, আবেগ অনুভূতি, পরিবার পরিজনদের প্রতি দায়িত্ববোধ, সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা সহ মানবীয় কাজগুলোর কথা আমরা জানি, সেগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয় কিন্তু এই স্তরেই। কোন কারণে মস্তিষ্কের এই অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে মানুষের ব্যক্তিত্বের বড় সড় পরিবর্তন ঘটে। যেমনি ঘটেছিলো এক হতভাগ্য রেলকর্মী ফিনিয়াস গেজ এর ক্ষেত্রে। ১৮৪৮ সালের দিকে ভার্মন্টের রেলপথ বানানোর কাজে তিনি নিয়োজিত ছিলেন। এই কর্মী বিরাট মোটা সোটা লোহার একটি দণ্ড হাতে নিয়ে, যেটাকে বলে টেম্পিং রড, ঝুঁকে পড়ে বিস্ফোরকে আগুন দিচ্ছিলেন। রেলরোড বানানোর সময় জমি সমান করার জন্য এই কাজটির দায়িত্ব কোন না কোন শ্রমিককে নিতেই হত। ফিনিয়াস গেজ এ ব্যাপারে দক্ষ একজন শ্রমিক, বহুবার তিনি এ কাজ করেছেন। সেদিনও তিনি কিন্তু ফিনিয়াস গেজের ক্ষেত্রে সেদিন যা হয়েছিলো তা হলিউডের ভৌতিক ছবিকেও যেন হার মানায়। কোন এক কারণে বিস্ফোরণে একটু উনিশ বিশ হয়ে যাওয়ায় গেজের হাতে ধরা টেম্পিং রড সোজা তার বাম চোয়াল আর চোখ ভেদ করে মাথার উপরের খুলির কিছু অংশ উপরে নিয়ে চলে যায়।

চিত্র – টেম্পিং রড যেভাবে ফিনিয়াস গেজের চোয়াল, চোখ আর মগজের কিয়দংশ ভেদ করে চলে গিয়েছিলো।

সবাই ভেবে নিয়েছিলো মারাই গেছেন গেজ। কিন্তু হাসপাতালে নেবার পর খুব অদ্ভুতভাবেই গেজ জ্ঞান ফিরে পান, এবং দীর্ঘদিনের চিকিৎসায় ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেন । হাসপাতালের পুরো সময়টা গেজের পরিবার পরিজন সহকর্মীরা ধরে নিয়েছিলেন যে কোন দিনই গেজ মারা যেতে পারেন, এবং তার জন্য কফিনেরও ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছিলো। তাদের অবশ্য দোষ দিয়ে লাভ নেই। এরকম খুলি চৌচির হওয়া, চোখ চোয়াল হারানো মগজ ভেদ করা রোগী বাঁচে নাকি?

কিন্তু গেজ মরলেন না। বাঁচলেন। কিভাবে বেঁচে গেলেন তা বলা মুশকিল। আসলে বিস্ফোরণাহত গেজের চেহারা সুরত দেখে ভয়ঙ্কর মনে হলেও খুব ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যাবে – টেম্পিং রড চোখ আর চোয়াল বিধ্বস্ত করার সময় কেবল মগজের উপরিভাগ – অর্থাৎ ফ্রন্টাল কর্টেক্সের কিছু অংশ উপরে নেয়া ছাড়া মগজের খুব বেশি ক্ষতি করতে পারেনি। খুব অবিশ্বাস্য ভাবে ঢাউস আকারের লৌহদণ্ডটি খুলি আর মগজের ফাঁক ফোকর খুঁজে বের হয়ে গিয়েছিলো। ফলে প্রচণ্ড আঘাত পেলেও মৃত্যুকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন গেজ।

পেজ অবশেষে কাজে ফিরলেন। কিন্তু ফিরলে কি হবে তার সহকর্মীরা লক্ষ্য করলেন ফিনিয়াস গেজ আর সেই আগের গেজ নেই। দুর্ঘটনার আগে গেজ ছিলেন হাসিখুশি, উদার, সহকর্মীদের প্রতি সংবেদনশীল এবং কাজকর্মের দায়িত্ববান একজন ব্যক্তি। কিন্তু দুর্ঘটনা সামলিয়ে কাজে ফেরার পর দেখা গেল তিনি হয়ে উঠেছেন খিটমিটে, ঝগড়ুটে, একদর্শী এবং স্বার্থপর। যে দায়িত্ব-সচেতনতা আর সহকর্মীদের সাথে ভাল ব্যবহারের কারণে সকলের পছন্দের মানুষ ছিলেন ফিনিয়াস গেজ, সেই গেজকেই তারা এড়িয়ে চলতে শুরু করলেন সবার সাথে তার গায়ে পড়ে ঝগড়া করার বাতিক আর দায়িত্ব-হীনতার কারণে। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা মনে করেন দুর্ঘটনায় গেজের ফ্রন্টাল কর্টেক্স পরিবর্তিত হবার কারণেই গেজের ব্যক্তিত্বের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। সবার পছন্দের মানুষটি হয়ে উঠেছেন সবার চক্ষুশূল। ফ্রন্টাল কর্টেক্স – যা মানবীয় আবেগ অনুভূতি আর ব্যক্তিত্বের অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে সেটা ক্ষতিগ্রন্থ হওয়াতেই এমন অবস্থা হয়েছিলো বলে মনে করা হয়। কিন্তু মস্তিষ্কের বাকি অংশগুলো – যেমন মিডব্রেন এবং হিন্ডব্রেনের কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গে কোন আঘাত না লাগায় তার মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকায় কিংবা শরীরবৃত্তীয় কাজ পরিচালনায় কোন সমস্যা হয়নি।

মস্তিষ্কের উপরিভাগ বা ফোরব্রেনের কথা কিছুটা জানলাম। এবারে অন্য দুভাগ কি করে সেগুলোতে না হয় একটু যাওয়া যাক। মস্তিষ্কের মধ্যভাগ (মধ্যমস্তিষ্ক) বা মিডব্রেনের জায়গাগুলো বিবর্তনীয় যাত্রাপথের আরেকটু আদিম অঙ্গ। আর হিন্ডব্রেন একেবারে আদিমতম অঙ্গের সমাহার বলা যায়, প্রায় অর্ধ-বিলিয়ন বছর আগের প্রত্যঙ্গ এগুলো। মিডব্রেন বা মধ্যমস্তিষ্ক আমাদের ঠিকমত দেখা আর শোনার কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। আর হিন্ড ব্রেনের অঙ্গগুলো নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের চলাচল, ভারসাম্য, শ্বাসপ্রশ্বাস, সতর্কতা ইত্যাদি। বোঝাই যাচ্ছে এ অঙ্গগুলো কর্টেক্সের তুলনায় প্রাচীন, প্রায় সব প্রাণীর মধ্যেই এগুলো বিদ্যমান। সবাইকেই তো বেঁচে থাকার চলাচল করতে হয়, দেখে শুনে চলতে হয়, শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে হয়। তাই এ সব অঙ্গে বড় সড় আঘাত পেলে বেঁচে থাকা সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। বেঁচে গেলেও হয়তো মানুষটি থাকবে পক্ষাঘাত-গ্রন্থ হয়ে, অন্যের সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে।

চিত্র – সেফালাইজেশন প্রক্রিয়ায় প্রাচীন অঙ্গের উপর মানব মস্তিষ্কের নবীনতম অঙ্গগুলো স্তূপীকৃত হয়েছে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে মানব মস্তিষ্ক একদম শূন্য থেকে হুট করে তৈরি হয়নি। এর মধ্যে রয়ে গেছে বিবর্তনের দীর্ঘ পথ-পরিক্রমার কালিক ছাপ। প্রাচীন এবং প্রিমিটিভ কাজ করার জন্য যে অঙ্গগুলো অত্যাবশ্যক, সেগুলো তৈরি হয়েছিলো একদম প্রথমে, এর উপরে স্তূপীকৃত হয়ে বসেছে অপেক্ষাকৃত নবীনতর অঙ্গগুলো। আর সবচেয়ে উপরে মানে সবচেয়ে পরে স্তূপীকৃত হয়েছে ফ্রন্টাল কর্টেক্সের মতো নবীনতম অংশগুলো, যেগুলো মানবীয় অনুভূতি আর ব্যক্তিত্ব নিয়ন্ত্রণ করে। কাজেই একজন জীববিজ্ঞানী কিংবা বিবর্তন জানা স্নায়ুবিজ্ঞানী যখন ইঁদুরের মস্তিষ্ক দেখেন তখন তিনি জানেন যে, ওটা সরীসৃপের মস্তিষ্ক এবং সেই সাথে কিছু বাড়তি অংশের সমাবেশ। ঠিক একইভাবে তারা যখন আবার মানব মস্তিষ্কের দিকে তাকান, তখন তারা দেখেই বোঝেন যে এটা ইঁদুরের মস্তিষ্ক এবং সেই সাথে পরবর্তীতে যোগ হওয়া নতুন বাড়তি কিছু অংশের সমাহার। সেজন্যই অধ্যাপক লিন্ডেন তার বইয়ে বলেছেন –

When we compare human brain to that of other vertebrates it becomes clear that that the human brain has mostly developed through agglomeration. The difference between the lizard brain and the mouse brain does not involve a whole scale redesign. Rather, the mouse brain is basically the lizard brain with some extra stuff thrown on top. Likewise, the humans brain is basically the mouse brain with still more stuff piled on top. That’s how we wind up with two visual systems and two auditory systems ( one ancient and one modern) jammed into our heads. The brain is built like an icecream cone with new scoops piled on at each stage of our lineage.

লিন্ডেন যথার্থই বলেছেন। আমাদের মস্তিষ্ককে আমার পূর্বসূরিদের রেখে যাওয়া উপাদানের উপর ভর করে গড়ে উঠতে হয়েছে বলেই তাদের সেই সীমাবদ্ধতাকে সাথে নিয়েই তার বেড়ে উঠতে হয়েছে। আমাদের ব্রেন কোন নিখুঁত ডিজাইনে তৈরি হয়নি। আপনি আইসক্রিমের দোকানে গিয়ে কখনো কোন্‌-আইসক্রিম চেখে দেখেছেন? দেখেছেন তো নিশ্চয়। এক স্কুপ ভ্যানিলা নেবার পর হঠাৎ আপনার মনে হল আরেক স্কুপ স্ট্রবেরি আইসক্রিম নিলে কেমন হয়? এক স্কুপের উপরে যোগ হল আরেক স্কুপ। পয়সা দেয়ার সময় ভাবলেন, ওটার উপরে চকলেটের আরেকটা স্কুপ চাপিয়ে দেই। তিন-স্কুপ কোন আইসক্রিম হাতে নিয়ে মজাসে চাখতে চাখতে বাড়ি ফিরলেন। কিন্তু তা না হয় হল। কিন্তু এই আইসক্রিম কোনের সাথে মানুষের মস্তিষ্কের সম্পর্ক কি? সম্পর্ক আছে। অধ্যাপক লিন্ডেনের মতে, মস্তিষ্কের বিকাশ আর বিবর্ধন হয়েছে অনেকটা আইসক্রিম কোনের মতো করে, প্রতিবারই নতুন নতুন স্কুপ যোগ হয়েছে বিবর্তনীয় ধারার যাত্রাপথে। জীববিজ্ঞানে এর একটা গালভরা নাম আছে সেফালাইজেশন

চিত্র – বিজ্ঞানীরা বলেন আমাদের ব্রেইন গড়ে উঠেছে অনেকটা আইসক্রিম কোনের মতো করে প্রাচীন অঙ্গের উপর নবীনতর অঙ্গগুলো ক্রমশ: স্তূপীকৃত হয়ে।

লিন্ডেন তার বইয়ে এই আইস্ক্রিমকোনের স্কুপের উপমা ব্যবহার করেছেন অসংখ্যবার, তার চোখে ব্রেন সেজন্যই হয়ে উঠেছে নিখুঁত নয় বরং ‘তালগোল পাকানো এক জোড়াতালির ব্যবস্থা’ (cobbled together mess)। তবে এটাও তিনি পরিষ্কার করেছেন যে, মানব-মস্তিষ্কের সীমাবদ্ধতাগুলোকে বিবর্তনের দৃষ্টি থেকেই অনুধাবন করা যায় ভালভাবে, কোন নিখুঁত স্রষ্টার ম্যাজিক দিয়ে নয়। অধ্যাপক লিন্ডেন যে ব্যাপারটিকে ‘জোড়াতালি’ বলেছেন গ্যারি মার্কস তার বইয়ে এ ব্যাপারটিকে অভিহিত করেছেন ক্লুজ হিসেবে। যারা প্রকৌশলবিদ্যার সাথে জড়িত, বিশেষত – পুরকৌশল কিংবা যন্ত্রকৌশল – তাদের অনেকেই হয়তো ‘ক্লুজ’ শব্দটির সাথে পরিচিত। তারপরেও আমার ধারণা অধিকাংশ পাঠকদের কাছেই হয়তো শব্দটি অজানা। তাই এ নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের অবকাশ আছে।

ক্লুজ মানে হচ্ছে কোন একটা বড় সমস্যার খুব জোড়াতালি দেওয়া কদাকার (clumsy) সমাধান, কিন্তু কাজ কর্ম চালাতে সমস্যা হয় না। ইংরেজি অভিধানে ক্লুজ শব্দটির সংজ্ঞায়ন এরকমের –

kluge (klooj) n. Slang
A clumsy or inelegant solution to a problem.

ব্যাপারটা বোঝার জন্য ১৯৭০ সালের অ্যাপোলো ১৩ র সেই বিখ্যাত ঘটনার কথা স্মরণ করা যাক। অ্যাপোলো ১৩ চাঁদে যাওয়ার জন্য মহাকাশ যাত্রা শুরু করেছিলো সে বছর। এটি ছিলো আমেরিকার সপ্তম যাত্রা। কিন্তু চাঁদে যেতে গিয়ে মাঝপথে মহা বিপাকে পড়লেন এর মহাকাশযাত্রীরা। যাত্রার দু দিনের মধ্যে রকেটের অক্সিজেন ট্যাঙ্ক বিস্ফোরণে নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে যা হল তা রীতিমত ভয়ানক। মহাকাশযানের মধ্যে কার্বনডাইঅক্সাইডের মাত্রা বিপজ্জনকভাবে বেড়ে চলছিলো। ক্রুরা বুঝলেন, এই কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা খুব তাড়াতাড়ি নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে অচিরেই ভবলীলা সাঙ্গ হবার সম্ভাবনা। তারা হাতের সামনে যা পেলেন – মোজা, কার্ডবোর্ডের বাক্স, প্লাস্টিক ব্যাগ আর ডাক্টটেপ – সব জড় করে তা দিয়েই কিম্ভুতকিমাকার সব ফিলটার বানিয়ে ফেললেন। এই কদাকার ফিল্টারগুলোই তাদের প্রাণ বাঁচিয়ে দিলো, তারা নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। মাটিতে নেমে অ্যাপোলো মহাকাশযাত্রার অধিনায়ক জিম লোভেল মন্তব্য করেছিলেন –‘ হ্যাঁ আমাদের এই ফিল্টার সমাধান দেখতে কোন আকর্ষণীয় কিছু ছিলো না, কিন্তু বিপদের সময় ভালই কাজে দিয়েছিলো’। অ্যাপোলো ক্রুদের এই সমাধান আসলে ক্লুজের একটি ভাল উদাহরণ। হাতের সামনেই যা পাওয়া যায় তা দিয়ে কাজ চালানোর মতো সমাধান পেয়ে বিপদ উত্তরণের চেষ্টা।

আশির দশকের শেষভাগে বিটিভিতে ম্যাকগাইভার নামে একটা সিরিজ শুরু হয়েছিল অনেকেরই মনে আছে। বাংলাদেশে সেই সময়টাতে যারা ছিলেন তারা জানেন আজকের জামানার মতো হাজারটা হিন্দি চ্যানেল ছিলো না। এরশাদের জামানায় সাহেব-বিবি-গোলামের বাক্স বিটিভিই ছিলো সবে ধন নীলমণি। সামরিক জান্তার নিয়ন্ত্রণাধীন বিটিভির গৎ বাঁধা তোষামোদি নানা অনুষ্ঠান আর অপ-অনুষ্ঠানের ভিড়েও এই একটি সিরিয়ালের জন্য বিটিভির কাছে চিরকৃতজ্ঞ ছিলাম সে সময়। আমেরিকান এই সিরিয়ালটা নিয়ে এসে দেশে দেখানোর ব্যবস্থা করা। বলা বাহুল্য, আমাদের মত কিশোরদের জন্য খুব প্রিয় একটা সিরিজ ছিলো সেটা। আমেরিকার এই সিক্রেট এজেন্ট বিভিন্ন মিশনে গিয়ে নানা রকম ভয়ঙ্কর বিপদ আপদের মধ্যে পড়ে যেত, আর উপস্থিত বুদ্ধির জোরে হাতের সামনে যা উপকরণ খোলা ছিলো তা দিয়েই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা করতো। ম্যাকগাইভারের সমাধানগুলো ছিল অনেকটাই ক্লুজ!

বিবর্তনের কাজও অনেকটা সেরকমই, সেজন্য বিবর্তনের ফলে তৈরি হয় নানা ধরণের ক্লুজ জাতীয় দ্রব্য। বারে বারেই আমরা বলেছি যে, বিবর্তনকে যেহেতু পূর্বসূরিদের রেখে যাওয়া বিদ্যমান উপকরণ নিয়ে কাজ করতে হয় এর মধ্যে নানা ধরণের ডিজাইনগত ত্রুটি দেখা যেতে পারে। আমাদের মেরুদণ্ডের কথাই ধরুন। আমাদের এতবড় মাথা আর দেহের ওজনকে ধরে রাখার জন্য এক কলামের এই মেরুদণ্ড খুবই অনাকর্ষনীয় সমাধান। সেজন্যই দেখা যায় আমাদের দেহের ওজনকে বহন করতে গিয়ে প্রায়ই আমাদের পিঠব্যাথা বা ব্যাক পেইন হয়। যারা কম্পিউটারের সামনে বেশি ঝুঁকে কাজ করেন, কিংবা যারা ভারী বোঝা বয়ে নেওয়ার কাজ করেন, তারা অনেকেই এটা হাড়ে হাড়ে বোঝেন। কিন্তু এক কলামের জায়গায় তিন-কলাম বিশিষ্ট মেরুদণ্ড আমাদের থাকলে কিন্তু আমরা সহজেই এই অযাচিত পিঠ ব্যথা এড়াতে পারতাম। সত্যি বলতে কি কোন ইঞ্জিনিয়ারকে এ ধরণের যন্ত্র ডিজাইন করার দায়িত্ব দেয়া হলে তিনি কখনই মাথা আর দেহের এত ভারী ওজন এক কলামের উপর চাপিয়ে দিতেন না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিবর্তন তা করতে পারেনি, তাকে নির্ভর করতে হয়েছে আমাদের মৎস-জাতীয় পূর্বসূরিদের রেখে যাওয়া একটিমাত্র মেরুদণ্ডের কাঠামোর ওপর। তাকে যতদূর পারে বদলে টদলে মানুষের উপযোগী করে বানাতে হয়েছে। তাই মাছেদের জন্য সেটা পিঠব্যাথার কোন কারণ না হলেও মানুষের জন্য হয়। এটা প্রাকৃতিক ক্লুজ ছাড়া আর কিছু নয়। আর ক্লুজ জাতীয় সমাধান কখনোই নিখুঁত ডিজাইনের গ্যারান্টি দেয় না।

আসলে কোন কিছু নিখুঁত কিংবা ‘এলিগেন্ট’ করে বানানোর মিশন নিয়ে বিবর্তন মাঠে নামেনি, যদি জোড়াতালির ফলে সেটা টিকে থাকে বা সমস্যা না করে, তাইলে সেই বৈশিষ্ট্য সে ধারণ করে আর ছড়িয়ে পড়ে। আর যদি জোড়াতালিতে সমস্যা হয়, তাহলে সেটা প্রাকৃতিক নির্বাচনের করাতে কাটা পড়ে যায়। জিন মিউটেশন, ক্রোমোজম মিউটেশন; জেনেটিক রিকম্বিনেশন, জেনেটিক ড্রিফট সহ জিন নিয়ে প্রকৃতির নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় থেকে যদি সফল ফলাফল বেরিয়ে আসে তবে সেটা বৈশিষ্ট্য হিসেবে জনপুঞ্জে বাহিত হতে পারে, আর পরীক্ষার ফলাফলে গড়বড় হলে তা জনপুঞ্জ থেকে হারিয়ে যাবে। বিবর্তনের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মাঝে সাঝে নান্দনিক কোন কিছু যে বেরিয়ে আসে না তা নয়, কিন্তু মনে রাখতে হবে নান্দনিক কোন কিছু বানানোর তরিকা নিয়ে মাঠে নামেনি, বরং বিবর্তনের সমাধানগুলো বহুক্ষেত্রেই ত্রুটির উর্ধ্বে নয়, বরং নানাভাবেই সীমাবদ্ধ। আমাদের মস্তিষ্কও এর ব্যতিক্রম নয়।

মস্তিষ্কের সীমাবদ্ধতার কথা বলতে গেলে নিউরনের কথাই আসবে সবার আগে। ৬০ কোটি বছর আগে Cnidaria নামের একধরণের জেলিফিশের মধ্যে প্রথম নিউরনের অস্তিত্ব দেখা গিয়েছিলো বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে মিলিয়ন বছর পরের মানব প্রজাতি এসেও কিন্তু নিউরনের গঠনগত কোন পরিবর্তন হয়নি। এমন নয় যে, জেলিফিশের নিউরনগুলো মানব প্রজাতিতে এসে কোন ‘সুপার নিউরন’ টাইপের কিছু হয়ে উঠেছিল। বরং, সত্যি কথা বলতে কি – জেলিফিশের একেবারে আদিম নিউরনগুলোকেই অপরিবর্তনীয়ভাবে ব্যবহার করতে হচ্ছে মানব মস্তিষ্ক চালাতেও। আদিম জিনিসপত্র ব্যবহার করে আধুনিক যন্ত্র বানাতে গেলে যা হয় আর কি – ক্রমশ জবড়জং সিস্টেম তৈরি হয়ে যায়। দৈনন্দিন জীবন থেকে একটা উদাহরণ দেই। যারা অনেক পুরনো বাসায় – মানে অন্তত: বিশ পচিশ বছর আগে তৈরি কোন বাসায় থাকেন তারা একটি অসুবিধাতে প্রায়ই ভোগেন। কোন কিছু মেরামত করতে গিয়ে দেখেন পুরনো পার্টস আর পাওয়া যায় না, কারণ এ কয় বছরে প্রযুক্তিই গেছে বদলে। বিদ্যুতের লাইন টানার পদ্ধতি, প্লাগ, সকেট, বাথরুমের শাওয়ারের ডিজাইন থেকে শুরু করে অনেক কিছুই আর পুরনো পদ্ধতি দিয়ে হয় না। ছোট জিনিসের ক্ষেত্রে যেমন পুরনো ক্যাসেট প্লেয়ার ফেলে দিয়ে আপনি আইফোন বা আইপড কিনে নিতে পারেন, কিন্তু পুরো বাড়ি তো আর সেভাবে ফেলে দেয়া যায় না। ফলে যেটা আমাদের মেনে নিতে হয় – তা হল জোড়াতালি। এই জোড়াতালি দিতে গিয়ে যেটা সবচেয়ে ভালভাবে কাজ চলবে বলে মনে করি – সেই সমাধানই আমরা গ্রহণ করি। মস্তিষ্কের ক্ষেত্রেও হয়েছে ঠিক তাই। আদিম রদ্দিকালের জেলিফিশের নিউরন ব্যবহার করতে হয়েছে তাকে। লিন্ডেনের ভাষায় নিউরনগুলো খুবই অদক্ষ – ‘slow, leaky and unreliable’। নিউরনগুলো সংযুক্ত থাকে এক্সন (Axon) নামে জৈবপরিবাহী দিয়ে। আমাদের বাসা বাড়িতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিতে তামার তারগুলো যেভাবে বৈদ্যুতিক সংকেত বয়ে নিয়ে যায়, মানব মস্তিষ্কের এক্সনগুলো ঠিক সেই কাজগুলোই করে। কিন্তু করে অনেক ধীর গতিতে, অদক্ষভাবে। একটা তামার তারের মধ্য দিয়ে বৈদ্যুতিক সংকেত প্রায় আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে প্রবাহিত হতে পারে, খুব নিখুঁতভাবে বললে – ঘণ্টায় প্রায় ৬৬৯ মিলিয়ন মাইল বেগে। সে-তুলনায় এক্সনের মধ্য দিয়ে সংকেত যায় অনেকটাই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, বড়োজোর আড়াইশো মাইল বেগে। তার মানে সিগনালের সংকেত পরিবাহিতার ক্ষেত্রে এক্সনগুলো তামার পরিবাহীর তুলনায় প্রায় ২.৫ মিলিয়ন গুণ ধীর। তার উপর মরার উপর খাড়ার ঘার মতো সিগন্যালগুলো পরিবাহী চুইয়ে বাইরে চলে যায় মাঝে সাঝেই। এর অবশ্য কারণ আছে। আমাদের মস্তিষ্ক ভেসে থাকে সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড নামের এক ধরণের লবণাক্ত তরলের মধ্যে। লবণাক্ত তরলের মধ্য দিয়ে কোন পরিবাহীর মধ্য দিয়ে তথ্য পরিবাহিত হয়, তখন তথ্যের অপচয় হয়। সেই লর্ড কেলভিনের সময় (১৮২৪ -১৯০৭) থেকেই বিজ্ঞানীদের তা জানা। কেলভিন সাহেব আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্য দিয়ে টেলিগ্রাফিক তথ্য আদান প্রদানের একটা হিসেব করতে গিয়ে দেখেছিলেন যে, স্রেফ তার টেনে আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্য দিয়ে কয়েক হাজার মাইল দূরের জায়গায় তথ্য স্থানান্তর সম্ভব নয়। লবণাক্ত জলে তথ্য চুইয়ে বাইরে চলে যাবে (সেজন্যই সাবমেরিন-কেবলগুলোতে কিছুদূর পর পর এক ধরণের বুস্টার এমপ্লিফায়ার ব্যবহার করা হয়, সিগনালকে জোরদার করার জন্য)। একই ধরণের ঘটনা ঘটে মস্তিষ্কের ক্ষেত্রেও। এক্সন দিয়ে তথ্য যেতে গিয়ে অনেক সময়ই তথ্য চুইয়ে সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইডের লবণাক্ত তরলে তথ্য হারিয়ে যায়, সিগন্যাল হয়ে যায় দুর্বল। এই দুর্বলতাকে সামাল দিতে গিয়ে মস্তিষ্ককেও এমপ্লিফায়ারের মতো কিছু একটা কোন একভাবে তৈরি করতে হয়েছে। পরের কোন পর্বে এ নিয়ে লেখার ইচ্ছে আছে। আপাতত: এ পর্বে আরো কিছু সীমাবদ্ধতার দিকে তাকাই।

আমরা হরহামেশাই খুব বড় গলায় কম্পিউটারের সাথে ব্রেনের তুলনা করি, অথচ একটা সাধারণ ডেস্কটপ কম্পিউটারের সেন্ট্রাল প্রোসেসিং ইউনিট প্রতি সেকেন্ডে ১০ বিলিয়ন অপারেশন সম্পন্ন করতে পারে। সেখানে একটা নিউরনের সংকেতের সীমা প্রতি সেকেন্ডে মাত্র ৪০০ স্পাইক থেকে ১২০০ স্পাইক। শুধু তাই নয়, মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারগুলো পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে দেখা গেছে এগুলো খুব অদক্ষ ‘প্রোবাবিলিস্টিক ডিভাইস’, তার লক্ষ্যের দিকে তাক করতে সমর্থ হয় মাত্র ৩০ ভাগ ক্ষেত্রে সফলভাবে। বাকি সময় সেগুলো যেন হারিয়েই যায় বিস্মৃতির অন্তরালে। এহেন অদক্ষতার নমুনা দেখে অধ্যাপক গ্যারি লিঞ্চ এবং রিচার্ড গ্র্যাঙ্গার তাদের ‘বিগ ব্রেন’ বইয়ে মজা করে বলেছেন – ‘ইন্টেলের কোন ডিজাইনার যদি এভাবে প্রসেসর চিপের ডিজাইন করতেন, তাহলে সাথে সাথে তাকে কোম্পানি থেকে ফায়ার করা হতো! ‘। সেজন্যই সার্বিকভাবে বলা যায় যে, বৈদ্যুতিক যন্ত্র হিসেবে মস্তিষ্ক খুব বেশি পদের কিছু নয়।

কিন্তু ‘পদের কিছু নয়’ বলে চলে গেলেই তো হবে না, আমাদের বলতে হবে এই অদক্ষ যন্ত্রটা এত চমৎকারভাবে কাজ করে কীভাবে? শুধু তো কাজ করছেই না রীতিমত ঘোল খাইয়ে ছাড়ছে আমাদের সবাইকে। নিশ্চয় এর পেছনে কোন ব্যাখ্যা আছে তাই না? আসলে নিউরনগুলো খুব অদক্ষ বলেই এরা কম সংখ্যায় থাকলে এদের থেকে কোন বড়-কিছু আমরা আশা করতে পারি না। কিন্তু মস্তিষ্ক সে সমস্যার সমাধান কর ফেলেছে একটু ঘুরপথে। নিজেদেরকে বিপুলভাবে সংখ্যায় বাড়িয়ে। সেই যে ছোটবেলায় যে আমাদের শেখানো হয়েছিলো মিলেমিশে কাজ করতে, সেটা আমরা না শিখলেও নিউরনেরা কিন্তু ঠিকই শিখে গেছে। সেই ‘দশে মিলি করি কাজ’ –এর মাধ্যমে অসম্ভবকেও সম্ভব করে তুলতে পারে এরা। হ্যাঁ, জেলিফিশের নিউরনের সাথে মানুষের নিউরনের গঠনগত পার্থক্য না থাকলেও সংখ্যাগত পার্থক্য অনেক। জেলিফিশে শ খানেকের বেশি নিউরন নেই, কেঁচোর মত একটু জটিল প্রাণীতে আছে মাত্র তিনশটির মতো নিউরন। আর মানুষের মাথায়? প্রায় একশ বিলিয়ন নিউরন। সেই একশ বিলিয়নের প্রতিটি নিউরনে আছে ৫০০০টির মতো জংশন, যেগুলোকে আমরা সিন্যাপ্সিস নামে অভিহিত করি। তাহলে একশ বিলিয়ন নিউরনে কয়টি সিন্যাপ্সিস জংশনের অন্তর্জাল তৈরি হবে? ১০০ বিলিয়নের সাথে ৫০০০ গুন করে যা পাই তা হল – ৫০০, ০০০, ০০০, ০০০, ০০০ বা পাঁচশ ট্রিলিয়ন । আপনি যদি প্রতি সেকেন্ডে একটি করে গোনা শুরু করেন, তাহলে সবগুলো গোনা শেষ করতে করতে আপনার দেড় কোটি বছর পার হয়ে যাবে।

বুঝতে পারছেন নিশ্চয় কি বিশাল যজ্ঞ তৈরি করতে হয়েছে মানব মস্তিষ্ককে ঠিক মত কাজ করাতে গিয়ে। গোটা দশেক, কিংবা হাজার খানেক নয়, একেবারে একশ বিলিয়ন নিউরন আর পাঁচশ ট্রিলিয়ন সিন্যাপ্সিসের পসরা সাজাতে হয়েছে অবস্থা সামলাতে গিয়ে। এর ফলে আমাদের মস্তিষ্ক হয়ে গেছে অনাবশ্যক রকমের বড়। মস্তিষ্ককে চালাতে শরীরের সবচেয়ে বেশি শক্তি ব্যয় হয়, দেহের শতকরা বিশভাগ শক্তিই চলে যায় আমাদের এই ‘কুমড়ো-পটাশ’ মোটা মাথাকে চালাতে গিয়ে । মস্তিষ্ক শুধু শক্তি-খেকোই নয়, পাশাপাশি আবার রীতিমত জিন-খেকোও বটে। আমাদের দেহের সবচেয়ে বেশি জিনের পরিস্ফুটন ঘটে এই মাথাতেই। আমাদের দেহে জিনের সংখ্যা তেইশ হাজারের মত, একটা বোধ বুদ্ধিহীন কেঁচোর চেয়ে খুব একটা বেশি নয়। কিন্তু পার্থক্য আছে জিনের পরিস্ফুটন বা এক্সপ্রেশনে। প্রায় সত্তুরভাগ জিনের পরিস্ফুটন ঘটে এই মাথাতেই, যা আবার প্রকারান্তরে নিয়ন্ত্রণ করে পাঁচশ ট্রিলিয়ন সার্কিটের অবিশ্বাস্য বড় এক নেটওয়ার্ক। অনেকটা মশা মারতে কামান দাগার মতোই ব্যাপার স্যাপার। এগুলো হয়তো কিছুই লাগতো না, যদি নিউরনগুলো এককভাবে এতোটা অদক্ষ না হতো।

বড় মাথার সমস্যা কেবল বড় নেটওয়ার্ক তৈরিতেই হয়নি, সেই সাথে শরীরবৃত্তীয় সমস্যাও তৈরি করেছে। বড়-মাথাওয়ালা সন্তান জন্মদানের জন্য সম্ভবত: মেয়েদের শরীর সেভাবে প্রস্তুত ছিলো না। মানব প্রজাতিতে একটা সময় অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে মস্তিষ্কের বিবর্তন আর বিবর্ধন ঘটেছিল, তার সাথে মেয়েদের শরীরে বিভিন্ন অঙ্গ – যেমন জরায়ু, যোনিপথ প্রভৃতি সেভাবে বিবর্ধিত হতে পারেনি। তাই ইতিহাসের পথপরিক্রমনায় বহু নারীকে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। আসলে সিজারিয়ান-অপারেশন সহ শল্যচিকিৎসার বিভিন্ন আধুনিক রক্ষাকবচগুলো আবিষ্কারের আগে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মায়েদের মৃত্যুহার ছিলো আশঙ্কাজনক-ভাবেই বেশি। জীবজগতের আর কোন প্রজাতির কোন সদস্যকে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যেতে হয়নি, হয় না। নিঃসন্দেহে এটা শরীরের বিরাট বড় একটি ‘ডিজাইন-গত ত্রুটি’। একজন নিখুঁত ডিজাইনার সবকিছু দেখে শুনে ডিজাইন এবং পরিকল্পনা করে বানাননি বলেই এগুলো নিখুঁতভাবে তৈরি হয়নি, এতে রয়ে গেছে ক্লুজ, তথা বিবর্তনগত জোড়াতালির নানা ছাপ।

তবে বৃহৎ মস্তিষ্কের কিছু সুবিধা তো আছেই। মানুষের মস্তিষ্ক বড় আর এত ট্রিলিয়ন নিউরনের সমাহার বলেই এটি একসাথে সমান্তরাল পথে কাজ করে যেতে পারে। এটা নিঃসন্দেহে একটা বড়গুণ যা কম্পিউটার থেকে মানব মস্তিষ্ককে আলাদা করে দিয়েছে। আজকের দিনের যে কোন কম্পিউটারে থাকে একটিমাত্র ‘সেন্ট্রাল প্রোসেসিং ইউনিট’, যাকে আমরা বলি সিপিইউ, অন্যদিকে মস্তিষ্ক যেন অজস্র প্রসেসরের বিস্তীর্ণ সমাহার। সমান্তরালভাবে সবাই মিলে কাজ করে সে ছাড়িয়ে যেতে পারে আমাদের চিরচেনা কম্পিউটারের সকল সীমাবদ্ধতা। হ্যাঁ – বড় বড় যোগ, বিয়োগ, গুণ ভাগ করায় কিংবা একঘেয়ে ধরণের সিমুলেশন করে ফলাফল বের করে দেয়ার ক্ষেত্রে হয়তো আমাদের মস্তিষ্ক মেশিনের সাথে পাল্লা দিতে পারে না, কিন্তু আবেগ, অনুভূতি, চিন্তা, সৃজনশীলতা, সৃষ্টি নৈপুণ্যে সে সহজেই ছাড়িয়ে যেতে পারে যে কোন কম্পিউটারকে এক নিমেষেই। কম্পিউটার গণনায় যত দক্ষই হোক না কেন, চেহারা সনাক্তকরণ এবং ‘ভিজুয়াল রিকগনিশন’-এ মানব মস্তিষ্কের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। আমরা যখন মোনালিসার ছবির দিকে তাকাই, আমাদের মস্তিষ্ক-কোষগুলোতে শুরু হয়ে যায় একই সাথে অজস্র নিউরনের নিরন্তর উদ্দীপনা; নিমেষ-মধ্যে আমরা বুঝে ফেলি এটি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির সেই বিখ্যাত শিল্পকর্ম – রহস্যময়ী মোনালিসা। শুধু চেনা জানা চিত্রকর্ম নয়, পরিচিত-জনের চেহারা, গোলাপ ফুল, চেয়ার থেকে শুরু করে আমাদের পোষা কুকুরের সামান্য অংশ দৃষ্টিগোচর হলেই তাকে চিনে ফেলার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা আমাদের মস্তিষ্কের আছে, অথচ এগুলো করতে কম্পিউটারের সময় লাগে অনেক। আসলে কম্পিউটারের সাথে হরহামেশা তুলনা করা হলেও মস্তিষ্কের সাথে কম্পিউটারের কাজের পার্থক্য আছে। বড় একটা জায়গায় পার্থক্য হল – ‘শেখা বনাম প্রোগ্রামিং’ এর দ্বন্দ্ব। আমরা ছোটবেলা থেকে প্রতি মুহূর্তে শিখে শিখে বড় হই, অতীতের ভুল থেকে ভবিষ্যতের গন্তব্য নির্ধারণ করতে পারি খুব সফলভাবে। কম্পিউটার কিন্তু কিছু শেখে না। কম্পিউটার নির্ভর করে প্রোগ্রামিং এর উপর, অর্থাৎ এর ভিতর আগে থেকেই পুরে দেয়া তথ্যের উপর। তাই প্রতিবার কম্পিউটার অন করলে সেটা একইভাবে একই চেহারা নিয়ে আপনার কাছে হাজির হবে, মানব মস্তিষ্ক তা নয়।

সেজন্যই বলা যায় মানব মস্তিষ্ক কম্পিউটারের তুলনায় অনেক নমনীয় (flexible)। এই নমনীয়তা আমাদেরকে অনেক-বেশী সৃজনশীল করে গড়ে তুলেছে। তবে এজন্য এতো উল্লসিত হবার কিছু নেই; সেটা আবার আমাদের জন্য এক ধরণের শাঁখের করাত হিসেবেই হাজির হয়েছে যেন। নির্বোধ কম্পিউটারকে আমরা যত গালিই দেই না কেন, আমরা জানি কম্পিউটারের ‘মেমোরি’ নিখুঁত। আমাদের মস্তিষ্কের স্মৃতি সে তুলনায় ততটাই ভঙ্গুর। আমরা অনেকেই অফিস যাবার সময় গাড়ীর চাবি খুঁজে পাইনা, প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগ খুঁজে পাইনা, চশমাটাও হারিয়ে ফেলি প্রায়শই। কাজের সময় বন্ধুর ফোন নম্বর মনে করতে পারিনা, প্রিয়জনের জন্মদিন বেমালুম ভুলে বসে থাকি। আমি একবার আটলান্টা সাউথ টার্মিনালে গাড়ী পার্ক করে তিন দিনের জন্য কাজে চলে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে আর মনে করতে পারছিলাম না আমি কি গাড়ি সাউথ টার্মিনালে পার্ক করেছিলাম নাকি নর্থ টার্মিনালে। রীতিমত ঘন্টাখানেক সময় লেগেছিল গাড়ি খুঁজে পেতে। নিউজ উইকে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে মানুষেরা নাকি দিনে গড়পরতা প্রায় ৫৫ মিনিট সময় ব্যয় করে জানা জিনিস খুঁজে পেতে। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে শতকরা ৬ ভাগ ক্ষেত্রে স্কাইডাইভারেরা মৃত্যুবরণ করে প্যারাসুটের রিপকর্ড খুলতে ভুলে গিয়ে।

তার চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার হল – স্মৃতি আমাদের সাথে প্রতারণা করে। খুব স্পষ্ট ঘটনা – যেটা আমরা কখনোই ভুলে যাব না বলে মনে করি – সময়ের সাথে সাথে তার উপর জমতে থাকে যেন ধুলোর পুরু স্তর। বছর-খানেক পরে আমরা যখন ঘটনাটিকে মনে করতে চেষ্টা করি অনেক সময়ই তালগোল পাকিয়ে যায়, পুরো ঘটনা বিকৃত অবস্থায় আমাদের সামনে উঠে আসে। ঘটনার সূত্র যায় হারিয়ে পার্শ্বচরিত্রগুলো হয়তো বদলে যায়, ইত্যাদি। এলিজাবেথ লোফটাস (Elizabeth Loftus), ইরা হাইমেন (Ira Hyman), এল্‌ক গেরার্টস (Elke Geraerts) এর মত বিজ্ঞানীরা ‘ফলস মেমোরি’ (মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলে কনফাবুলেশন) নিয়ে তাদের নানা গবেষণায় দেখিয়েছেন কীভাবে মানুষ স্মৃতি প্রতারণা আর স্মৃতিবিভ্রমের শিকার হয়ে ভুল ঘটনাকেই সত্য বলে মনে করে অনেক সময়। এমনকি না ঘটা কোন ব্যাপারও আমরা অনেক সময় সত্য বলে মনে করি, নিজেদের ‘উদ্ভাবনী শক্তি’ আর ‘সৃজনশীলতার’ বলি হয়ে। সেজন্যই আমরা যখন স্মৃতি রোমন্থন করি সেগুলো কোন ধরণের ‘রিপ্লে’ বাটন চেপে রিপ্লে করা হয় না, করতে হয় এক ধরণের ‘রিকন্সট্রাকশন’ বা পুনর্গঠন। এই পুনর্গঠন করতে গিয়ে প্রায়শই স্মৃতি এলোমেলো হয়ে যায়। কম্পিউটারে কিন্তু তা হয় না। যখন কোন ডকুমেন্ট কম্পিউটারে সংগ্রহ করে রাখা হয়, আপনি কম্পিউটারের বোতাম টিপে সেটি খুললে প্রতিবারই সেই একই ডকুমেন্টই খুলবে, কোন ধরনের ভুলচুক হবে না, কিংবা করবে না আপনার সাথে কোন ধরণের প্রতারণা। প্রতিবার ‘রিপ্লে’তে একই ফল আপনি আশা করবেন, এবং সেই রিপ্লে হয় প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই নিখুঁত।

আরেকটা বড় সমস্যা হল, আমাদের মস্তিষ্ক যখন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে, তা প্রায়ই আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী জায়গাগুলোর সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মস্তিষ্কের যে সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সাহায্যে আমরা বাইরের জগত থেকে তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণ করি – যেমন – ঐক্ষিক কর্টেক্স, শ্রাবনিক কর্টেক্স, থ্যালামাস, অ্যামেগডালা – প্রভৃতি প্রত্যঙ্গগুলো – সেগুলো আবার মস্তিষ্কে ভয় ভীতি, রোমাঞ্চ, আবেগ অনুভূতি নিয়ন্ত্রণেরও বড় উৎস। একটা সময় মানুষ যখন বনে জঙ্গলে ছিলো তখন সাপ কিংবা এ ধরণের বিষধর জীব বা কীটপতঙ্গ দেখলে ভয় পেয়ে পালাতে কিংবা আত্মরক্ষায় সচেষ্ট হত। এই ভীতির চাহিদা তৈরি করতে অ্যামিগডালা, ভিজুয়াল কর্টেক্স সহ নানা জায়গা উদ্দীপ্ত হত। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন আধুনিক যুগে কম্পিউটারের প্রবন্ধ পড়ে কিংবা ভিডিও দেখে তথ্য সংগ্রহ করার সময়ও কিন্তু সেই আদিম অঙ্গের ভিন্ন ব্যবহারের উপর নির্ভরশীল থাকি। এর কিছুটা ভাল দিক আছে, আবার আছে কিছু মন্দ দিকও। চিন্তা করে দেখুন – আমরা চাবি কিংবা চশমা হারিয়ে ফেললেও, কিংবা বন্ধুর ফোন নম্বর, ঠিকানা কিংবা গতকাল কি দিয়ে প্রাতঃভোজন সেরেছি সেটা মনে করতে না পারলেও, আবেগময় ঘটনার সাথে সম্পর্কযুক্ত অনেককিছু খুব ভালভাবে মনে রাখতে পারি। আমার ঠাকুমা যেদিন মারা গেলেন সেদিনের প্রতিটি ঘটনা আমি এখনো মনে করতে পারি। আমি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনে করতে পারি আমার বাবার যেদিন বাইপাস অপারেশন হয়েছিলো, সেদিনকার প্রতিটি ঘটনাও। সকালে কি দিয়ে নাস্তা করেছিলাম থেকে শুরু করে, কিভাবে ট্যাক্সি করে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো থেকে শুরু করে, অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগে বাবা কী বলেছিলেন –সবকিছু। সে প্রায় আজ থেকে বিশ বছর আগেকার একটি দিন, কিন্তু সে দিনের কথা মনে করতে আমার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। এর কারণ আমার আবেগের সাথে এর একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। এ ব্যাপারটা শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে নয় অনেক বড় পরিসরেও প্রযোজ্য। আমি আমার আমেরিকান সহকর্মীদের সাথে কথা বলে দেখেছি – তাদের প্রায় প্রত্যেকেই ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখটিকে খুব ভালভাবে স্মরণে রেখেছেন। তারা সেই স্মরণীয় দিনটির কথা ছবির মতো মনে করতে পারেন, সে সময় তারা কোথায় ছিলেন, কিভাবে টুইনটাওয়ার ভেঙ্গে পড়ার খবর শুনেছিলেন , কিভাবে অফিসের সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজনদের সাথে এ নিয়ে কথা বলেছিলেন, নিজেদের এবং পরিবারের নিরাপত্তায় উৎকণ্ঠিত হয়েছিলেন – সে সবের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা তারা দিতে পারেন কেউ জিজ্ঞাসা করলেই। আমাদের স্মৃতিগুলো কম্পিউটারের মেমোরির মতো আবেগ-মুক্ত নয়, বরং আবেগের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত।

 

চিত্র: তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহৃত ঐক্ষিক কর্টেক্স, শ্রাবনিক কর্টেক্স, থ্যালামাস, অ্যামেগডালা – প্রভৃতি প্রত্যঙ্গ – সেগুলো আবার ভয় ভীতি, রোমাঞ্চ, আবেগ অনুভূতি নিয়ন্ত্রণেরও বড় উৎস।

আর স্মৃতি আবেগাপ্লুত হবার কিছু তো সমস্যা আছেই। আবেগকে যুক্তির সাথে আলাদা করতে সমস্যা হয়। মানুষকে ‘সৃষ্টির সেরা জীব’, ‘বুদ্ধিমান প্রজাতি’ প্রভৃতি হিসেবে গন্য করা হলেও অধিকাংশ মানুষই ধর্ম, কুসংস্কার, মিথ্যা বিশ্বাস থেকে নিজের যুক্তিকে আলাদা করতে পারে না, বরং নানা ধরণের মিথ্যা বিশ্বাস, অপবিশ্বাস আর কাল্টের কাছে আত্মসমর্পণ করে। কেউ বা হয়ে উঠে মাদকাসক্ত। আমরা অনেক সময়ই আমাদের আবেগী মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণের বশ হয়ে থাকি বলেই এমনটি ঘটে। শুধু ধর্মে বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রেই যে এটি ঘটে তা নয়। ধার্মিক, অধার্মিক, নিধার্মিক, আধাধার্মিক, গোঁড়া, প্রগতিশীল সবার ক্ষেত্রেই এটি ঘটতে পারে। রাজনৈতিক ধ্যানধারণার ক্ষেত্রে সেটা আরো ভালভাবে বোঝা যায়। যিনি আওয়ামীলীগকে সমর্থন করেন, তাকে আওয়ামীলীগের হাজারটা দোষ দেখালেও বলবেন, আফটার অল বিএনপির চেয়ে ভাল। যিনি বিএনপির সমর্থন করেন, তিনি আবার বলবেন, দেশটাকে ভারতের লেজুড় হওয়া থেকে বাঁচাতে চাইলে বিএনপিই একমাত্র ভরসা। বিএনপি জামাত ওয়ালারা ‘নয়া-দিগন্ত’, ‘সংগ্রাম’ প্রভৃতি সংবাদপত্রের খবরকে প্রাধান্য দিলে আওয়ামিলীগপন্থিরা হয়তো চোখ বুজে প্রাধান্য দেয় জনকণ্ঠের মত পত্রিকাকে। আমেরিকায়ও দেখা যায় লিবারেলরা সিএনএন আর এনবিসি দেখলে রক্ষণশীলদের প্রিয় হচ্ছে ফক্স নিউজ চ্যানেল। যিনি সিগারেট খেতে পছন্দ করেন, তাকে সিগারেট পানের অপকারিতা সম্বন্ধে হাজার বার বলা হলেও তার মাথায় ঢুকবে না, বরং বলবেন ‘আরে একটা দুটো সিগারেট খেলে কিছু হয় না!’ যিনি জ্যোতিষ শাস্ত্রে বিশ্বাস করেন, তিনি কেবল সেই দিনের রাশিফলের সেই ঘটনাগুলোই মনে রাখবেন, যেগুলো তিনি মনে করেন ‘মিলে গেছে’, আর যেগুলো মেলেনি সেগুলো তৎক্ষণাৎ ভুলে যাবেন। গ্যারি মার্কস তার বইয়ে দেখিয়েছেন, আমাদের মস্তিষ্ক যেভাবে বিবর্তিত হয়েছে তাতে ‘কনফার্মেশন বায়াস’ বা স্বীকৃতিগত পক্ষপাতদুষ্টতা’র উপকরণগুলো ‘ক্লুজ’ হিসেবে রয়ে গেছে। সেজন্যই দেখা যায়, কেউ আমাদের কাউকে পছন্দের তালিকায় থাকলে সচরাচর তার দোষত্রুটি খুব বেশি দেখতে পাই না, খুব বেশি তার আদর্শের সমালোচনা করি না। হ্যা, স্বজনপ্রীতির মতো শোনাচ্ছে – মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ‘halo effect’, আবার উল্টোদিকে কেউ আমাদের অপছন্দনীয় হলে কিংবা কারো আদর্শ নিজ আদর্শের সাথে না মিললে তার চোদ্দগুষ্টি নাশ করে ফেলি। এটাকে বলে ‘pitchfork effect’। খুব বেশি দূরে যাবার দরকার নেই, আমাদের ব্লগগুলোর দিকে তাকালেই এ ধরণের বিভিন্ন ইফেক্টের সত্যতা খুঁজে পাবেন পাঠকেরা।

তাহলে এ প্রবন্ধের উপসংহার কি দাঁড়ালো? দাঁড়ালো যে, মানব শরীরের অন্যান্য অঙ্গের মতো মস্তিষ্কও বিবর্তনেরই উপজাত, তাই এর প্রত্যঙ্গগুলোও ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়, বরং এক ধরণের ক্লুজ। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন মানব মস্তিষ্ক পুরনো কাঠামো ভেঙ্গে রিডিজাইন করে তৈরি করা হয়নি বলেই প্রাচীন অঙ্গের উপর আধুনিক উপকরণ স্তূপীকৃত হয়ে বসেছে। সেজন্য আমাদের মস্তিষ্কে দু ধরণের ঐক্ষিক ব্যবস্থা দেখা যায় – একটি নতুন আরেকটি পুরাতন। আদিম জেলিফিশের নিউরন একইভাবে ব্যবহার করায় সেগুলো অদক্ষ, সেগুলোকে সঠিকভাবে কর্মক্ষম করে তুলার জন্য বিশাল আয়তনের নেটওয়ার্ক লাগে। এই বিশাল আয়তনের নেটওয়ার্ককে ধারণ করতে গিয়ে আমাদের মস্তিষ্ককে হতে হয়েছে আশাতীত বড়, সেটা আবার হয়েছে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মায়েদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ। আমাদের স্মৃতি নিখুঁত নয়, বহুলাংশেই ভঙ্গুর। স্মৃতি আমাদের প্রতারণা করে, আমরা মিথ্যা বিশ্বাসে আক্রান্ত হই, আক্রান্ত হই ‘কনফার্মেশন বায়াস’ দিয়ে কিংবা স্বজনপ্রীতি কিংবা ‘হ্যালো ইফেক্ট’ দিয়ে। আমরা শরীরের জন্য ক্ষতিকর জেনেও ধূমপান করি, কেউবা ড্রাগে আসক্ত হয়ে উঠি। এমনকি ড্রাগ ফাগ বাদ দিলেও, তেল চর্বি জাতীয় খাবারের প্রতি লালসাগ্রস্থ থাকি, সেগুলো দেহের জন্য খারাপ জেনেও। আমরা আমাদের জিনগত কোন উপকার না পেলেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিভির সামনে বসে থাকি, অর্থহীন কমেডি দেখি, কিংবা কেউ হয়ে উঠে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। ক্লুজ, ক্লুজ, ক্লুজ! মস্তিষ্ক নিখুঁত ডিজাইনে তৈরি নয় বরং বিবর্তনেরই লক্ষ্যহীন ‘ক্লুজিয়’ ফসল। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী François Jacob সেজন্যই বলেছেন –

দৃশ্যমান জীবজগত আসলে ঐতিহাসিক কাঠামো – আক্ষরিকভাবেই এরা সব ইতিহাসের সৃষ্টি। তারা প্রকৌশলগত কোন নিখুঁত সামগ্রী নয়, বরং একধরণের জোড়াতালি (patchwork), যা তৈরি হয়েছে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন অপদ্রব্যের সদ্ব্যবহারে।

পরের পর্বগুলোতে মস্তিষ্কের বিবর্তন নিয়ে বলার ইচ্ছে রইলো।

তথ্য সূত্র –
১) David J. Linden, The Accidental Mind: How Brain Evolution Has Given Us Love, Memory, Dreams, and God, Belknap Press, 2007
২) Gary Marcus, Kluge: The Haphazard Evolution of the Human Mind, Mariner Books;2009
৩) Gary Lynchand Richard Granger, Big Brain: The Origins and Future of Human Intelligence, Palgrave Macmillan, 2008
৪) Ammar al-Chalabi, Shane R. Delamont and Martin Turner , The Brain: A Beginner’s Guide, Oneworld; 2008
৫) Jerry A. Coyne, Why Evolution Is True, Penguin, Reprint edition, 2010
৬) Richard Dawkins, The Greatest Show on Earth: The Evidence for Evolution, Free Press, 2009
৭) Neil Shubin, Your Inner Fish: A Journey into the 3.5-Billion-Year History of the Human Body, Vintage, 2009