(নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যানের জীবনকাহিনি)

[আপন আলোয় ফাইনম্যান ১ম পর্ব]

০২
রিচার্ড ফাইনম্যানের শৈশব কেটেছে হাসিখুশি আনন্দে আর অবাধ স্বাধীনতায়। বাবা মেলভিল যতটুকু সময় পান জ্ঞান বিজ্ঞান ও দর্শন নিয়ে কথা বলেন পরিবারের সবার সাথে। জীবনে কোন কাজই ছোট নয় আর যে কোন কাজ করার সময় গভীর অনুসন্ধিৎসা ও শৃঙ্খলার সাথে করা উচিত – এ শিক্ষা রিচার্ড শৈশবেই পেয়েছেন তাঁর বাবার কাছ থেকে। খাবার টেবিলে বসে সবাই মিলে নিয়মিত বই পড়তেন। মেলভিন শব্দ করে পড়তেন যেন সবাই শুনতে পায় – তারপর সবার সাথে আলোচনা করতেন যা পড়লেন তা নিয়ে। এভাবে সব বিষয়েই ছোট-বড় সবার নিজস্ব মতামত তৈরিতে উৎসাহ দিতেন। রিচার্ডের মা লুসিলের ছিল স্বতস্ফূর্ত মজা করার অদ্ভুত ক্ষমতা। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ মজার মজার কথায় প্রাণখোলা হাসিতে ফেটে পড়তেন মেলভিল। লুসিল এত হাসিখুশি – অথচ জীবনে তিনি কষ্ট পেয়েছেন অনেক বেশি। তাঁর বাবার মা-বাবা মানবেতর জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন পোলান্ডে ইহুদিদের ঘেটোতে। তাঁর মা কষ্ট পেয়েছেন নানা রকম অসুখে। তাঁর সবচেয়ে বড় বোন ভুগেছেন স্কিৎজোফ্রেনিয়ায়। একমাত্র জীবিত বড়বোন পার্ল ছাড়া তাঁর আর সবভাইবোনেরই অকাল-মৃত্যু ঘটেছে। তাই মনে হয় যেন হাস্য-কৌতুকেই উড়িয়ে দিতে চান তাঁর সব দুঃখ। রিচার্ড তাঁর মায়ের কাছ থেকে পেয়েছেন মজা করার প্রাণবন্ত স্বভাব আর বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন প্রাণখুলে উচ্চস্বরে হাসার ক্ষমতা। অবাধ স্বাধীনতার মাঝেই একটা সুশৃঙ্খল জীবন-পদ্ধতি গড়ে উঠেছে রিচার্ড ফাইনম্যানের।

রিচার্ডদের বাড়িটা ছিল তাঁর মায়ের বাবার। সেখানে রিচার্ডের মাসি পার্লও থাকতেন তাঁর স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে। রিচার্ডের মাসতুতো ভাই রবার্ট ছিলো তার চেয়ে তিন বছরের বড় আর মাসতুতো বোন ফ্রান্সিস ছিল তিন বছরের ছোট। রিচার্ডের বয়স যখন চার বছর তখন তার ছোটভাই হেনরি’র জন্ম হয়। কিন্তু জন্মের পরপরই অসুস্থ হয়ে যায় হেনরি। সারাক্ষণ কাঁদতে থাকে আর হাতের নখ দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। এক মাসের মধ্যেই মারা যায় হেনরি। রিচার্ডের মা-বাবার মানসিক কষ্ট বেড়েই চলে। কিন্তু তারপরও সত্যকে সহজ ভাবে নেবার ক্ষমতা তাঁদের অসীম। রিচার্ডের বয়স যখন নয় বছর – তখন তার ছোটবোন জোয়ানের জন্ম হয়।

ছোট্ট রিচার্ডের কৌতূহলের কোন সীমা ছিল না। তার ছোটবোন জোয়ানের জন্মের পর হাসপাতালে একজন নার্স যখন রিচার্ডকে বললো যে তার বোন হয়েছে – তখন রিচার্ডের প্রথম প্রশ্ন ছিলঃ “আপনি কীভাবে জানলেন যে বাচ্চাটি ছেলে না মেয়ে?” হতভম্ব নার্স ইতস্তত করে উত্তর দিয়েছিলঃ “বাচ্চার কানের গঠন দেখে বোঝা যায় বাচ্চা ছেলে না মেয়ে”। রিচার্ড অবাক হয়েছিল ঠিকই – কিন্তু বুঝতে পেরেছিল যে উত্তরটি সঠিক নয়। কারণ তার এবং তার বোনের কানের গঠনে তেমন কোন পার্থক্য নেই। রিচার্ড তার ছোটবোন জোয়ানকে পেয়ে খুব খুশি। যদিও তাদের বাবা বলেছিলেন – ছেলে হলে সে বিজ্ঞানী হবে – জোয়ান মেয়ে হয়েও বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকেছেন দাদা রিচার্ডের অনুপ্রেরণায়। পরে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করেছেন জোয়ান।

রিচার্ডকে তাঁর বাবা-মা কখনো রিচার্ড বলে ডাকতেন না। রিচার্ডের ডাকনাম ছিল রিটি। যদিও আমেরিকান কায়দায় সব রিচার্ডের ডাকনাম হয় ডিক। রিচার্ড ফাইনম্যানও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ডিক ফাইনম্যান নামেই পরিচিত ছিলেন। মেলভিল সময় পেলেই রিটিকে নিয়ে যেতেন ম্যানহাটানের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে। রিটির খুব ভালো লাগতো এই জাদুঘরে গিয়ে। ডায়নোসরের কংকাল দেখিয়ে মেলভিল ব্যাখ্যা করতেন ডায়নোসরের ইতিহাস। কীভাবে বিবর্তনের ফলে কোন কোন প্রজাতি প্রকৃতিতে টিকতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। বরফ যুগের পাথর দেখিয়ে ব্যাখ্যা করতেন যে একসময় পুরো পৃথিবী বরফাচ্ছন্ন ছিল। ব্যাখ্যা করার পর রিটিকে প্রশ্ন করতেন যে মানুষ কীভাবে জানলো যে একসময় পুরো পৃথিবী বরফাচ্ছন্ন ছিল? এ প্রশ্নের উত্তর স্বাভাবিক ভাবেই রিচার্ডের পক্ষে ওই বয়সে জানা সম্ভব নয়। মেলভিল সাহায্য করতেন – “এ পাথরের টুকরো নিউইয়র্ক থেকেই পাওয়া গেছে। তার মানে কোন এক সময় এই জায়গাটাও বরফাচ্ছাদিত ছিল”। বড় হয়ে রিচার্ড ফাইনম্যান তাঁর বাবার এরকম শিক্ষাপদ্ধতির প্রশংসা করে বলেছেন – “তিনি কোন বিষয় যখন ব্যাখ্যা করতেন পুরো ব্যাপারটাই জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠতো। বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলো হয়তো একটু এদিক ওদিক হতো – অর্থাৎ তিনি যদি বলেন যে বিশাল বিশাল বরফখন্ডগুলো বছরে এক ইঞ্চি করে সরে গিয়েছিল- সেখানে এক ইঞ্চির জায়গায় হয়তো বছরে দশ ফুট হতে পারে, কিন্তু ভৌগোলিক বিবর্তনের ব্যাপারটা সত্যি। আমার বাবা নিজে যেটুকু জানতেন বেশ ভালোভাবেই আমাকে তা শিখিয়েছেন”।

রিচার্ডের বয়স যখন দশ বছর তখন মেলভিল তাঁর পরিবার নিয়ে ফার রকওয়ে থেকে কাছাকাছি আরেকটা শহরতলী চেডারহার্স্টে চলে যান। চেডারহার্স্ট ইলেমেন্টারি স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হলো রিচার্ডকে। স্থানীয় ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল রিচার্ডের। তারাও তাকে রিটি বলেই ডাকতে শুরু করলো। রিটি দেখলো তার সমবয়সী ছেলেরা কাপড় শুকানোর দড়িতে আগুন জ্বালিয়ে সিগারেটের মত টানে। রিটি দেখলো এই আগুন না নেভালে নিজে নিজে নিভে যায় না। তার মাথায় একটা আইডিয়া এলো। ঘড়ি ধরে হিসেব করে দেখলো কত সময়ে দড়ির কতটুকু দৈর্ঘ্য পুড়ে। দড়ি পুড়ে যাওয়ার হারকে সময়ের সাথে তুলনা করে সে বুঝতে পারতো কখন বাড়ি ফেরার সময় হবে ইত্যাদি। কিন্তু সে দেখলো দড়িতে আগুন লাগিয়ে দড়িটা সাইকেলের সাথে বেঁধে সাইকেল চালালে দড়ি দ্রুত পুড়ে যায়। তার মানে তার দড়িপোড়া ঘড়ির ডিজাইনটা খুব কার্যকরী না। রিচার্ড সেই বয়সেই শিখে গিয়েছিল যে বৈজ্ঞানিক ডিজাইনে গন্ডগোল থাকলে যত প্রিয়ই হোক তা বাতিল করতে হয়।

বাড়ির বেসমেন্টে রিটি একটা ল্যাবোরেটরি গড়ে তুললো। অনেক ছোটবেলায় তার বাবা তাকে একটা কেমস্ট্রি সেট কিনে দিয়েছিলেন। রিটি তখন খুবই ছোট। নিজে কিছু করার আগেই পাড়ার বড় ছেলেরা এসে তার কেমিস্ট্রি সেট থেকে সব কেমিক্যাল বের করে একসাথে করে তাতে আগুন জ্বালিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে চেয়েছিল। বিস্ফোরণ যদিও ঘটেনি পুরো কেমিস্ট্রি সেটটার দফা রফা হয়ে গিয়েছিল। রিটি খুব বিরক্ত হয়েছিল বড়দের এরকম আচরণে। বাবার কাছে সে শিখেছে যে বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপের একটা নিয়ম আছে। ওটা ধাপে ধাপে পর্যবেক্ষণ করতে করতে সম্পন্ন করতে হয়। সবকিছু একসাথে মিশিয়ে দিলে হঠাৎ কিছু একটা হয়ে যাবে এরকম ধারণা চরম অবৈজ্ঞানিক।

বেসমেন্টের ল্যাবরেটরিতে বসে অনেক রাসায়নিক পরীক্ষা করতো বালক রিটি। তোয়ালেতে ফেরোসায়ানাইড ঢেলে রাখতো। তারপর হাত ধোয়ার সাবানে আয়রণ সল্ট মিশিয়ে বেসিনের কাছে রেখে দিত। তার মা যখন সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে তোয়ালেতে হাত মুছতেন – হাত টকটকে নীল হয়ে যেতো। মা চিৎকার করে উঠতেন “আমার লিনেন টাওয়েল”!!! ছেলের সব ধরণের বৈজ্ঞানিক উৎপাত হাসিমুখেই সহ্য করতেন মা। ছেলের এরকম কোন কাজে কোনদিন বাধা দেননি তিনি। দুপুরের খাবারের পর বান্ধবীদের সাথে বসে ব্রিজ খেলার সময় যখন রিটি বেসমেন্টের ল্যাবে বসে তার গবেষণা চালাতো তখন মায়ের বান্ধবীরা বলতেন “এতটুকু একটা বাচ্চাকে তুমি বেসমেন্টে বসে এসব করতে দাও কীভাবে? সে তো ঘরে আগুন লাগিয়ে দেবে যে কোন সময়”। মা হাসিমুখে বলতেন – “বিজ্ঞানের জন্য এতটুকু ঝুঁকি তো নিতেই হবে”।

চেডারহার্স্ট ইলেমেন্টারি স্কুলে বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন মেজর কনোলি। মোটা ভারী কর্কশ কন্ঠের কনোলি ছিলেন ছাত্রছাত্রীদের আতংক। ক্লাসের সবাইকে তিনি বাধ্য করতেন তাঁকে ‘মেজর’ বলে ডাকতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি নাকি মেজর ছিলেন। নামের সাথে ‘মেজর’ না থাকলে তাঁর ভাল লাগতো না। একদিন মেজর ক্লাসে পড়াচ্ছেন আলোর প্রজেক্টর সিস্টেম কীভাবে কাজ করে। বোঝানোর জন্য ব্ল্যাকবোর্ডে তিনি বাল্ব লেন্স ইত্যাদি আনুষঙ্গিক বিষয় আঁকার পর বাল্ব থেকে সমান্তরাল রেখা এঁকে বললেন যে আলো সমান্তরাল ভাবেই বের হয়ে লেন্সে পড়ে। রিচার্ড ও তার এক বন্ধু সাথে সাথেই বলে উঠলো -“এটা তো হতে পারে না। বাল্বের ফিলামেন্ট থেকে আলো তো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে সমান্তরাল ভাবে বের হবে কীভাবে?” মেজর ঘাড় ফিরিয়ে চোখ লাল করে গর্জন করে উঠলেন – “আমি বলছি সমান্তরাল ভাবে বেরোবে, তাই আলো সমান্তরাল ভাবে বের হবে”। সারা ক্লাস ভয়ে চুপ। রিচার্ড ঐ বিজ্ঞানের ক্লাস থেকে একটা মাত্র জিনিস ছাড়া আর কিছুই শিখতে পারেনি। আর ঐ একমাত্র জিনিসটি হলো একটা তথ্যঃ ১ মিটার সমান 39.37 ইঞ্চি। মেজর কনোলি মুখস্ত করানোর ব্যাপারে দক্ষ ছিলেন। ১ মিটার সমান কত ইঞ্চি শেখানোর জন্য তিনি বলতেন – এই স্কুলের নম্বর হলো 39 আর সেখান থেকে দুই বিয়োগ করলে 37, তাই এক মিটার সমান 39.37 ইঞ্চি!! কী কারণে দুই বিয়োগ করতে হবে – বা যে সমস্ত স্কুলের নম্বর 39 নয় তাদের ক্ষেত্রে কী হবে তা নিয়ে মেজর কনোলির কোন মাথাব্যথা নেই।

ফাইনম্যানের মতে “মেজর কনোলি ছিলেন মস্তবড় মিথ্যেবাদী। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর বীরত্বের কাহিনি বর্ণনা করতেন বানিয়ে বানিয়ে। তিনি নাকি প্লেনে বসে আরেকটা প্লেনের প্রপেলারের ব্লেডের মধ্যে গুলি ছোড়ার মেশিনগান আবিষ্কার করেছিলেন। প্লেনে বসেই নাকি তিনি এসব পরীক্ষা করেছিলেন। এরকম আরো কত কত গল্প যেগুলোর একটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। শুনতে হয়তো মজা লাগতো – কিন্তু যতই শুনতাম লোকটাকে ততই মিথ্যেবাদী মনে হতো”।

চেডারহার্স্টে থাকতে সায়েন্স ফিকশান পড়তো রিচার্ড। বিজ্ঞানের প্রতি ভালবাসার কারণে সায়েন্স ফিকশান ভালোই লাগতো তখন। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান যতই বাড়তে লাগলো সায়েন্স ফিকশানের প্রতি ভালবাসা হারিয়ে গেল। কারণ সায়েন্স ফিকশানে অসম্ভাব্য সব কিছু খুব সহজেই জোড়াতালি দিয়ে সম্ভব হয়ে যাচ্ছে দেখলে তার মেজাজ খারাপ হয়ে যেতো। ফলে হাইস্কুলে ওঠার পর আর সায়েন্স ফিকশান পড়া হয়নি রিচার্ডের।

ক্লাসের সবচেয়ে ভাল ছাত্র রিচার্ডকে যে সহপাঠীরা সবাই খুব ভালবাসতো তা নয়। সব ক্লাসেই কিছু গুন্ডা-পান্ডা থাকে। তাদের ক্লাসেও ছিল। প্রায়ই তারা তাদের চেয়ে নিরীহদের মারধর করতো। রিচার্ড একেবারে নিরীহ না হলেও মারপিট করতে ভালো লাগে না তার। তাই গুন্ডা ছেলেদের এড়িয়ে চলতো সে। কিন্তু তারা তাকে ছাড়তো না, ক্লাসের বাইরে সুযোগ পেলেই ল্যাং মেরে ফেলে দিতো রিচার্ডকে। রিচার্ড কী করবে বুঝতে পারছিল না। মার খেয়ে চুপচাপ গাছের নিচে বসে ভাবতো সে। একদিন এভাবে বসে থাকতে গিয়ে শুনতে পেলো উঁচু ক্লাসের ছেলেরা বিজ্ঞান বিষয়ক কথাবার্তা বলছে। মুহূর্তেই কান খাড়া হয়ে গেল তার। বড় ছেলেদের একজন বলছেঃ “মরিচা হলো আয়রন ক্লোরাইড”। রিচার্ড আর চুপ করে থাকতে পারলো না। বললোঃ “এক্সকিউজ মি। মরিচা আয়রন ক্লোরাইড নয়, আয়রন অক্সাইড। বাতাসের অক্সিজেন আয়রনের সাথে মিশে আয়রন অক্সাইড বা মরিচা তৈরি করে”। উঁচু ক্লাসের ছেলেরা সব অবাক হয়ে গেল। তারা ঘিরে ধরলো রিচার্ডকে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যেতে লাগলো বিজ্ঞান সম্পর্কে। দেখলো রিচার্ড সব জানে এবং বেশ ভালো ভাবেই জানে। অন্তত মেজর কনোলির চেয়ে অনেক ভাল। এরপর ক্লাসের বাইরে গুন্ডা-ছেলেরা রিচার্ডের ধারে কাছে আসলেই বড় বড় ছেলেরা এসে রিচার্ডের পক্ষে দাঁড়ায়। তারপর থেকে রিচার্ডকে আর কেউ ঘাঁটাতে সাহস করেনি।

বছরখানেক পরে চেডারহার্স্ট থেকে আবার ফার রকওয়েতে ফিরে এলো ফাইনম্যান পরিবার। তাদের আগের বাড়িতেই। সেখানে এসেও ল্যাবোরেটরি বানিয়ে নিল রিচার্ড। এবার শুরু হলো পদার্থবিজ্ঞানের পরীক্ষানিরীক্ষা। রেডিওর কলকব্জা নিয়ে কাজ। রিচার্ড ফাইনম্যানের জবানীতেই শোনা যাক সেসব কথা।

তখন এগারো বারো বছর বয়স আমার। বাড়িতে একটা ল্যাবোরেটরি গড়ে তুললাম নিজের মত করে। ল্যাবে যে যন্ত্রপাতিগুলো আছে তা হলোঃ একটা পুরনো কাঠের প্যাকিং বাক্স যার মধ্যে কয়েকটা তাক লাগিয়ে ওটাকে যন্ত্রপাতি রাখার একটা তাকে পরিণত করলাম। তাকের ওপর একটা হিটার আছে যেটাতে আমি আলু সিদ্ধ করতাম। আর একটা স্টোরেজ ব্যাটারি এবং একসারি বৈদ্যুতিক আলো। সারিবদ্ধ বৈদ্যুতিক আলোটা আমার বানানো। পাঁচ সেন্টের দোকান থেকে কিছু সকেট কিনে এনেছিলাম। সকেটগুলো কাঠের উপর স্ক্রু দিয়ে এঁটে তার দিয়ে জোড়া লাগালাম। কোনটা সিরিজে, আর কোন কোনটা প্যারালালে। আমি জানি বৈদ্যুতিক রেজিস্ট্যান্সের সিরিজ ও প্যারালাল সংযোগের মাধ্যমে ভোল্টেজের তারতম্য ঘটানো যায়। স্কুলে এগুলো আমি পড়েছি। কিন্তু বইয়ের পড়ার সাথে মিলিয়ে এসব বানাতে গিয়ে আমার হিসেবে একটু গন্ডগোল হয়েছিল। যে বাল্বগুলো আমি জ্বালানোর চিন্তা করছি তাদের রেজিস্ট্যান্স আমি হিসেব করিনি। তাতে কিছু যায় আসে না। ভোল্টেজের সামান্য এদিক ওদিক নিয়ে আমি খুব মাথা ঘামাচ্ছি না। আমি মজা পাচ্ছি। যখন বাল্বগুলোকে সিরিজে লাগাচ্ছি – কী চমৎকার জ্বলছে। সবগুলো মৃদু মৃদু। নতুন কিছু না হলেও আমার ভীষণ ভালো লাগলো। প্রায়ই আমি বাল্বগুলো জ্বালাতাম।

সার্কিটে একটা ফিউজ লাগানো ছিলো। ফলে আমি কোন কিছু শর্ট-সার্কিট করে ফেললেই ফিউজটা জ্বলে যেতো। আমার কাজের জন্য আমি চাচ্ছিলাম এমন একটা ফিউজ যেটা ঘরের ফিউজের চেয়ে কম মাত্রার। নিজেই বানিয়ে নিলাম সেটা। একটা পুরনো জ্বলে যাওয়া ফিউজের চারপাশে একটা টিনের পাত পেঁচিয়ে সহজেই একটা ফিউজ বানিয়ে ফেললাম। ফিউজটার সমান্তরালে একটি পাঁচ ওয়াটের বাল্ব লাগিয়ে দিলাম। যখন ফিউজটা পুড়ে যায় তখন বাল্বটা জ্বলে ওঠে। কীভাবে? আমার স্টোরেজ ব্যাটারি চার্জ করে যে তারটি, সেই তারের মাধ্যমে ফিউজ-সংলগ্ন বাল্বটি জ্বলে। বাল্বটি আড়াল করে রেখেছি কিছু রঙিন কাগজ দিয়ে। কাগজগুলোও নিয়েছি পুরনো ফেলে দেয়া চকলেটের খোসা থেকে। ফিউজ পুড়ে গেলে বাল্বটা জ্বলে ওঠে রঙিন কাগজে একটা দাগ পড়ে যায়। তা দেখে সহজেই বুঝতে পারি কোথায় ফিউজ জ্বলে গেল। এতে নতুন কিছু সৃষ্টি হচ্ছে না, কিন্তু আমার ভীষণ ভালো লাগছে এ সমস্ত কাজ করতে। নিজেকে খুব বিজ্ঞানী বিজ্ঞানী লাগছে।

রেডিও শুনতে আমি খুব ভালবাসি। ছোট্ট একটা রেডিও ছিল আমার। রেডিওটা আমি কিনেছিলাম পুরনো দোকান থেকে। সারাক্ষণ শুনি, এমনকি ঘুমানোর সময়ও শুয়ে শুয়ে শুনি। একজোড়া ইয়ারফোন লাগিয়ে শুনি যেন কেউ টের না পায়। বাবা-মা যখন বাইরে যেতেন মাঝে মাঝে, গভীর রাতে ফিরে এসে দেখতেন আমি ঘুমাচ্ছি কিন্তু কানে তার লাগানো। তাঁরা খুব উদ্বিগ্ন হতেন। কী হচ্ছে আমার মাথায়? ঘুমানোর সময় যদি রেডিও চলতে থাকে সারাক্ষণ – তাও সরাসরি কানে ঢুকে যায় শব্দ।

ক’দিনের মধ্যে আমি একটা সতর্কঘন্টা বানালাম। নাম দিলাম চুরির ঘন্টা। খুবই সাধারণ একটা জিনিস। একটা বড় ব্যাটারি, আর একটা বড় ঘন্টা -তার দিয়ে লাগানো। এটা আমার ঘরের ভেতর দরজার সাথে এমন ভাবে লাগিয়ে রাখলাম যেন দরজা খুললেই তারটা ব্যাটারির সাথে সংযোগ পায়। ফলে ঘন্টাটা বাজতে থাকে। আর দরজা বন্ধ করলে সংযোগ কেটে যায় – ঘন্টা বাজা বন্ধ হয়ে যায়।

একদিন মা-বাবা ফিরেছেন গভীর রাতে। খুব সাবধানে আমার ঘরে ঢুকছেন আমার কান থেকে ইয়ারফোন খুলে নেয়ার জন্য। আমার যাতে ঘুম ভেঙে না যায় সেজন্য যথাসম্ভব আস্তে আস্তে দরজাটা ফাঁক করে যেই ঘরে ঢুকতে যাবেন প্রচন্ড শব্দে ঘন্টাটা বেজে উঠলো – বং বং বং বং বং। আমি লাফ দিয়ে বিছানায় বসে পড়লাম। চিৎকার করে উঠলাম – এটা বাজছে, এটা বাজছে। আমার আনন্দের কোন সীমা ছিলো না।

একটা ফোর্ড কয়েল জোগাড় হয়ে গেল – পুরনো গাড়ি থেকে ফেলে দেয়া স্পার্ক কয়েল। ওটা নিয়ে এসে ল্যাবে রাখলাম। আমার সুইচবোর্ডে একটা স্পার্ক টার্মিনাল বসালাম এবং টার্মিনালের প্যারালালে একটা ছোট্ট টিউব লাইট লাগিয়ে দিলাম। টিউব লাইটটি আর্গন গ্যাসের। যখন জ্বলতো নীলচে আলোয় ঘর ভরে যেতো।

একদিন ফোর্ড কয়েলটা নিয়ে খেলছি – মানে বৈদ্যুতিক স্পার্ক দিয়ে কাগজ ছিদ্র করছি। এসময় হঠাৎ কাগজে আগুন লেগে গেল। কাগজটি আমার হাতে ছিল। জ্বলতে জ্বলতে একদম আমার আঙুলের কাছে চলে এলে আমি ঘরের কোণে রাখা ময়লার টিনে ফেলে দিলাম। কিন্তু টিনের ভেতর ছিল কিছু পুরনো খবরের কাগজ এবং কিছু হাবিজাবি। আর যায় কোথায়। সবগুলো কাগজে আগুন লেগে গেল। ঘরের ভেতর বেশ বড় আগুনের শিখা উঠছে টিন থেকে। বসার ঘরে আমার মা তাঁর কিছু বান্ধবীর সাথে বসে ব্রিজ খেলছিলেন। যে কোন মুহূর্তে আমার ঘরের আগুনের আলো দেখে ফেলতে পারেন। আমি তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিলাম। আর একটা ম্যাগাজিন দিয়ে টিনের মুখ চেপে ধরলাম। আগুন নিভে গেল।

কিছুক্ষণ পরে ম্যাগাজিনটা সরাতেই পুরো ঘর ধোঁয়ায় ভর্তি হয়ে গেল। ময়লার টিনটি প্রচন্ড গরম- হাত দিয়ে ধরা যায় না। কী করি। একজোড়া প্লায়ার্স দিয়ে টিনটা ধরে জানালার কাছে নিয়ে গেলাম। যেন ধোঁয়া জানালা দিয়ে বাইরে চলে যায়। কিন্তু হলো উল্টোটা। বাইরে প্রচন্ড বাতাস। সেই বাতাসে টিনে আবার আগুন লেগে গেল। এবার ম্যাগাজিনটাও হাতের কাছে নেই যে চাপা দেবো। জ্বলন্ত টিনটি নিয়ে আবার ঘরের মাঝখানে চলে এলাম। ম্যাগাজিনটি চাপা দিয়ে আবার আগুনভর্তি টিন নিয়ে জানালার কাছে গেলাম। এবার সত্যি নিজের উপর বিরক্তি লাগছিল। জানালার পর্দায় যে কোন মুহূর্তে আগুন লেগে যেতে পারে। খুবই ভয়ানক অবস্থা। এবার কোন কিছু না ভেবে জানালা দিয়ে টিনটা উপোড় করে দিলাম। তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে পড়লাম। মাকে ডেকে বললাম – খেলতে যাচ্ছি।

ইলেকট্রিক মটর নিয়েও কিছু কাজ করেছিলাম সেসময়। একটা ছোট্ট এমপ্লিফায়ার বানিয়েছি সবে। ইচ্ছে আছে একটা ফটোসেল বানাবো। যেটা একটা বৈদ্যুতিক ঘন্টার কাজ করবে। ফটোসেলটার সামনে হাত নিয়ে গেলেই ঘন্টা বাজবে- এরকম একটা পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু আমার মা সারাক্ষণ “রিটি, বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরে আসো” “খেলতে যাও” ইত্যাদি বলতে থাকেন। কিন্তু আমি সারাক্ষণ ঘরে বসে এটা ওটা করতে পছন্দ করি। অন্তঃত আমার ল্যাবোরেটরিটা আমাকে টানে দিনরাত।

পুরনো জিনিসপত্রের দোকান থেকে আমি রেডিও কিনতাম। আমার টাকা পয়সা বেশি ছিল না যদিও – কিন্তু ভাঙা রেডিওগুলোর দামও তেমন কিছু ছিল না। আমি ভাঙা রেডিওগুলো যে কোনভাবে সংগ্রহ করে চেষ্টা করতাম মেরামত করতে। রেডিওগুলো খুব জটিলভাবে নষ্ট হতো না। কোনটার সামান্য তার ছিঁড়ে গেছে বা কোন স্ক্রু আলগা হয়ে গেছে এরকম। আমি হাতড়ে হাতড়ে এটা ওটা নেড়েচেড়ে মাঝে মাঝে দেখতাম রেডিও ঠিকই চলছে। এরকম একটা রেডিওতে এক রাতে আমি টেক্সাসের ওয়াকো স্টেশন থেকে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান শুনতে পেলাম। কী যে আনন্দ হচ্ছিলো তখন।

আমার মেরামত করা রেডিওতে স্ক্যানেকট্যাডির ডাব্লু -জি-এন স্টেশন থেকে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান শুনতে পারতাম আমার ল্যাবে বসেই। সেসময় আমাদের একটা খুব প্রিয় রেডিও-অনুষ্ঠান ছিল ‘ইনো ক্রাইম ক্লাব’। আমরা মানে আমার দুই মাসতুতো ভাই-বোন, আমার বোন আর প্রতিবেশী কিছু সমবয়সী ছেলে-মেয়ে। আমরা আমাদের নিচের তলার বসার ঘরে সবাই একসাথে বসে শুনতাম ‘ইনো ক্রাইম ক্লাব’। ওটা প্রচারিত হতো নিউইয়র্ক থেকে। এদিকে আমি আমার ল্যাবে বসে মেরামত করা রেডিওতে ডাব্লু-জি-এন’ স্টেশন থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে আবিষ্কার করলাম নিউইয়র্ক স্টেশন থেকে প্রচারের একঘন্টা আগে ‘ডাবলু-জি-এন’ প্রচার করে ‘ইনো ক্রাইম ক্লাব’। একই অনুষ্ঠান।

আমার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চেপে বসলো। আমি করলাম কী – এক ঘন্টা আগে ল্যাবে বসে ‘ইনো ক্রাইম ক্লাব’ একা একা শুনতাম। এক ঘন্টা পরে বসার ঘরে এসে অন্য সবার সাথে আবার শুনতে বসতাম। তারপর অনুষ্ঠান শুরু হবার আগে ভবিষ্যৎবাণী করতে শুরু করলাম – এরকম হবে ওরকম হবে ইত্যাদি। তাদের সাথে বাজিও ধরতে লাগলাম। স্বাভাবিকভাবেই তারা বাজিতে হারতে লাগলো। কিন্তু এরকম জেনেশুনে না-জানার ভান করতে গেলে যতটা রেখেঢেকে করা উচিত ছিল তা না করে আমি একটু বাড়াবাড়ি রকমের ভবিষ্যৎবাণী করে ফেলতে লাগলাম। যার ফলে তারা সবাই বুঝতে পারলো এখানে কোন চালাকী আছে। সবাই মিলে আমাকে ধরলো চেপে। আমি আর গোপন করতে পারলাম না। বলতে হলো ‘ডাব্লু-জি-এন’ এর কথা। এরপর থেকে কেউ আর একঘন্টা অপেক্ষা করে থাকতে পারে না। সবাই একঘন্টা আগে আমার ল্যাবে এসে ভাঙা রেডিওতে ‘ইনো ক্রাইম ক্লাব’ শুনতে শুরু করলো।

সেসময় আমরা বেশ বড় একটা বাড়িতে থাকতাম। বাড়িটা আমার ঠাকুরদা মানে আমার মায়ের বাবা রেখে গিয়েছিলেন তাঁর মেয়েদের জন্য। যদিও তেমন কোন টাকা-পয়সা তিনি রেখে যেতে পারেন নি- কাঠের তৈরি বাড়িটা অনেক বড়। বাড়িতে আমার বড় মাসিও থাকতেন তাঁর স্বামী ও ছেলে-মেয়েদের নিয়ে। আমি বাড়ির চারদিকে তার টেনে নিয়ে গিয়ে প্রত্যেকটা রুমে তারের সংগে প্লাগ আটকে দিলাম। দোতলায় আমার রেডিওর সাথে ওই তারের সংযোগ করে দিলাম। এখন উপরে-নিচে যখন যে ঘরেই আমি থাকি- ইয়ারফোন প্লাগে লাগিয়ে রেডিও শুনতে পারি। একটা লাউড-স্পিকারও জোগাড় করেছিলাম। তবে পুরোটা নয় – অর্ধেকটা – মানে শুধুমাত্র বেসটা ছিল – হর্নটা ছিল না।

একদিন ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে লাউডস্পিকারটার সাথে সংযোগ করে দেখলাম- কিছু একটা হচ্ছে। স্পিকারটার গায়ে আঁচড় কাটলাম- ইয়ারফোনে তা শোনা গেল। বুঝতে পারলাম স্পিকারটাকে মাইক্রোফোন হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। এমনকি আলাদা কোন ব্যাটারিরও দরকার হবে না। স্কুলে আমরা আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের কাজ সম্পর্কে পড়েছিলাম। আমি আমার ইয়ারফোন আর স্পিকারের সাহায্যে মাইক্রোফোনের ব্যবহার দেখালাম। ঠিকভাবে না জানলেও আমার ধারণা হয়েছিল আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলও এরকম কিছু করেছিলেন টেলিফোন আবিষ্কারের সময়। এখন দেখা গেলো আমার একটা মাইক্রোফোনও আছে। পুরনো এমপ্লিফায়ারের সাহায্যে আমি এখন রেডিওর মতো কথাবার্তা সম্প্রচার করতে পারি – উপরতলা থেকে নিচের তলায় – নিচের তলা থেকে উপরতলায়।

আমার ছোটবোন জোয়ানের বয়স তখন মাত্র তিন বছর। কিন্তু রেডিও শুনতে শুনতে সে ইতোমধ্যেই কিছু কিছু অনুষ্ঠানের ভক্ত হয়ে গেছে। ‘আংকেল ডন’ নামে একজনের একটা অনুষ্ঠান তার খুব প্রিয় ছিল। আংকেল ডন সেই অনুষ্ঠানে বাচ্চাদের জন্য মজার মজার গান গাইতেন। আবার বাচ্চাদের কারো জন্মদিনের জন্য পাঠানো কার্ডগুলোও পড়তেন – “মেরি আজ তার জন্মদিন পালন করছে ২৫নং ফ্ল্যাটবুশ এভিনিউতে ইত্যাদি ইত্যাদি। হ্যাপি বার্থ ডে মেরি – ইত্যাদি ইত্যাদি”। একদিন আমি আর আমার মাসতুতো বোন ফ্রান্সিস জোয়ানকে নিচের বসার ঘরে রেডিওর সামনে বসিয়ে দিয়ে বললাম, “জোয়ান, আজ এক্ষুণি খুব মজার একটা বিশেষ অনুষ্ঠান আছে। তোমার খুব ভাল লাগবে। এখানে বসে বসে অনুষ্ঠানটা শোন”। জোয়ান রেডিওর কাছে বসে রইলো। আমরা উপরে গিয়ে আমার মাইক্রোফোন থেকে রেডিও ব্রডকাস্টিং শুরু করলাম। ওটাই ছিল আমার প্রথম রেডিও প্রোগ্রাম!

“আংকেল ডন বলছি। তোমরা সবাই জানো নিউ ব্রডওয়েতে একটা চমৎকার ছোট্ট মিষ্টি মেয়ে থাকে যার নাম জোয়ান। তার জন্মদিন – না আজ নয় – তবে খুব শীঘ্র। এই তো সামনের ওই তারিখে। হ্যাপি বার্থডে জোয়ান, কিউট জোয়ান” ইত্যাদি বলে আমরা ছোট্ট একটা গান গাইলাম। গানের পর মুখে শব্দ করে মিউজিক বাজালাম “ডিডল লিট্‌ ডিট্‌, ডুডল ডুডল লুট ডুট, ডিডিল ডিডিল লিট্‌, ডুডুল লুট ডুট …” ইত্যাদি। অনেকক্ষণ ধরে অনুষ্ঠান প্রচার করে নিচে নামলাম।

জোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম, “কিরে, অনুষ্ঠানটা শুনেছিস? কেমন লাগলো?”
জোয়ান খুব গম্ভীরভাবে বললো “অনুষ্ঠানটা ভালো হয়েছে। তবে তোমরা মুখ দিয়ে মিউজিক বাজাতে গেলে কেন?”

একদিন বাসায় একটা টেলিফোন কল রিসিভ করলাম আমি। কেউ একজন জিজ্ঞেস করছেন “হ্যালো মিস্টার। আপনি কি রিচার্ড ফাইনম্যান?”
– “হ্যাঁ”
– “আমি একটা হোটেল থেকে বলছি। আমাদের একটা রেডিও আছে। কিন্তু সেটা বাজছে না। আমরা এটা ঠিক করাতে চাচ্ছি। আপনি কি এটা ঠিক করে দেবেন?”
– “কিন্তু আমি তো একটা বাচ্চা ছেলে। আমি তো জানি না কীভাবে”
– “হ্যাঁ, তাই নাকি? তবুও তুমি কি একবার এসে রেডিওটা দেখে যাবে?”

যে হোটেল থেকে ফোনটা এসেছিল ওটা চালাতেন আমার মাসি। আমি কিন্তু তখন তা জানতাম না। একটা স্ক্রু ড্রাইভার পকেটে করে সেখানে গেলাম আমি। আমার বয়স আর স্বাস্থ্য অনুযায়ী আমার পকেটের স্ক্রু ড্রাইভারটাকে ‘বিশাল’ সাইজের বলেই মনে হচ্ছিল তাদের। আমি রেডিওটার কাছে গেলাম। বিরাট রেডিও। ভাবছি কী করা যায়। আমি আদৌ তেমন কিছু জানি না কীভাবে কী করতে হয়। রেডিওটার পেছন দিকটা খুলে দেখলাম। হোটেলের একজন কর্মচারী আমাকে সাহায্য করলেন। ভেতরে তিনি দেখলেন নাকি আমি দেখলাম ঠিক মনে করতে পারছি না- তবে দেখলাম একটা স্ক্রু আলগা হয়ে আছে- যার জন্য ভল্যুমের নব ঘুরালেও ভেতরের শ্যাফ্‌টটা উঠছে না। ফলে রেডিওতে কোন শব্দ তৈরি হচ্ছে না। স্ক্রুটা টাইট করে দিতেই রেডিও সচল হয়ে গেল।

রেডিওর কারিগর হিসেবে আমার পসার বাড়তে লাগলো। ক’দিন পরেই আরেক জায়গা থেকে ডাক পেলাম। এই রেডিওটা মোটেও বাজে না। কোন ধরণের শব্দই হয় না। কিন্তু এটাও খুব সহজেই ঠিক করে ফেললাম। প্লাগে গন্ডগোল ছিল – তাই ব্যাটারি কানেকশান পাচ্ছিল না। রেডিওর গন্ডগোল যত গোলমেলে হতে লাগলো আমার কাজের হাত তত পরিষ্কার হতে শুরু করলো। আমি আস্তে আস্তে শিখতে লাগলাম রেডিওর কলকব্জা আর তাদের কাজের আইনকানুন সম্পর্কে।

কারেন্ট মাপার জন্য একটা মিলি-এমিটার কিনে নিলাম পুরনো জঞ্জালের দোকান থেকে। ওটাকে নিজেই ভোল্টমিটারে পরিবর্তন করে নিলাম। ভোল্টমিটারের স্কেলটাও বানিয়ে নিলাম নিজে – যদিও ঠিক সূক্ষ্মভাবে সঠিক স্কেলে হলো না তবুও মোটামুটি কাজ চলে। এখন এই যন্ত্রের সাহায্যে আমি বুঝতে পারি রেডিওর কানেকশান ঠিক আছে কিনা বা এ সংক্রান্ত কোন ত্রুটি আছে কিনা।

রেডিও সারাবার জন্য লোকে যে আমাকেই ডাকে তার একটা কারণ আছে। আমি যে খুব একটা ভাল কারিগর তা নই। কিন্তু তখন আমেরিকাতে মন্দা চলছে। মানুষের হাতে টাকা-পয়সা নেই বললেই চলে। বেশি টাকা দিয়ে পেশাদার কারিগরের হাতে রেডিও সারানোর সামর্থ্য নেই কারো। সেখানে আমি নামমাত্র পারিশ্রমিকে সব করে দিচ্ছি। ছাদে উঠে এন্টেনা ঠিক করে দিচ্ছি, বৈদ্যুতিক বাল্ব লাগিয়ে দিচ্ছি – এরকম আরো অনেক কাজ প্রায় বিনে পয়সায় করে দিচ্ছি। দিনের পর দিন জটিল জটিল সব কাজ হাতে আসছিলো আর আমি দ্রুত শিখছিলাম। একদিন একটা কাজ এলো – ডি-সি সেটকে এ-সি সেটে বদলে দিতে হবে। মোদ্দা কথা হলো ব্যাটারিতে চলে যে রেডিও তাকে ইলেকট্রিসিটিতে চালাতে হবে। আমি জানতাম না কাজটা কীভাবে করতে হয়। আমি পারিনি কাজটা করতে।

আরেকটা কাজ পেয়েছিলাম – কাজের মত কাজ। একজন প্রিন্টারের রেডিও সারিয়েছিলাম কিছুদিন আগে। । প্রিন্টারের এক বন্ধুর রেডিও নষ্ট হয়ে গেলে তিনি তাকে আমার কথা বললেন। একদিন তিনি আমাকে নিতে এলেন – তাঁর বাড়িতে গিয়ে রেডিও ঠিক করে দিয়ে আসতে হবে। লোকটা খুব গরীব। তাঁর গাড়িটাও ঝরঝরে। থাকেনও শহরের একেবারে প্রান্তে দরিদ্রপল্লীতে। গাড়িতে যেতে যেতে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “রেডিওর সমস্যাটা কী?”
– “যখনই রেডিও অন করি ছোট্ট কর্কশ একটা শব্দ হতে থাকে। একটু পরেই অবশ্য শব্দটা চলে যায়। কিন্তু শুরুর কর্কশ শব্দটা আমি সহ্য করতে পারছি না”।

মনে মনে বললাম – শখ কত! যার বেশি টাকাপয়সা নেই তার কর্কশ শব্দ সহ্য করতে হবেই বৈকি। যেতে যেতে লোকটা সারাক্ষণ বিরক্ত করেছেন আমাকে। যেমন – “রেডিও সম্পর্কে তুমি আসলেই কি কিছু জানো? কীভাবে জানবে? তুমি তো একটা বাচ্চা ছেলে”। সারাটা পথ এভাবে বকবক করেছেন লোকটা। আর আমি চুপ করে ভাবছিলাম – লোকটার সমস্যা কী? আর রেডিওর সমস্যাটাই বা কোথায়?

লোকটার বাড়ি পৌঁছেই আমি রেডিওর কাছে গেলাম। অন করার সাথে সাথেই – ওরে বাপ্‌রে। এটা ছোট্ট শব্দ?? ওয়াহ-বুয়াহ-উউউ-গোঁ-ওয়াহ– প্রচন্ড কর্কশ শব্দ। এই শব্দ সহ্য না হবারই কথা। অবশ্য একটু পরেই শব্দটা আর নেই- সব ঠিকমত চলছে। আমি ভাবতে লাগলাম – এরকম শব্দের উৎস কোথায়?

আমি পায়চারি করতে লাগলাম। মাথার ভেতর চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কী হতে পারে? একটা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। তখনো ট্রানজিস্টার রেডিও চালু হয়নি। সব রেডিওতেই টিউব ব্যবহৃত হতো। এই রেডিওর টিউবগুলো হয়তো উল্টোভাবে লাগানো হয়েছে। ফলে টিউবগুলো গরম হচ্ছে, এমপ্লিফায়ার গরম হচ্ছে ঠিকই – কিন্তু ফিডব্যাক পাচ্ছে না বা ভুলপথে ফিডব্যাক পাচ্ছে। কিংবা আর-এফ সেকশান বা রেডিও-ফ্রিকোয়েন্সি সেকশানে কিছু হয়েছে। যাই হোক হয়েছে শুরুর অংশে। কারণ একটু পরেই যখন সিগনাল-সাইকেল পূর্ণ হচ্ছে তখন সবকিছু ঠিকমত চলছে।

লোকটি দেখছেন আমাকে। প্রায় চোখ লাল করে বিরক্ত স্বরে বললেন – “কী করছো তুমি? এসেছ রেডিও ঠিক করতে। তা না করে তুমি শুধু সামনে পেছনে ঘুর ঘুর করছো?”
– “আমি ভাবছি” – বললাম তাঁকে।
মনে মনে বললাম, “ওকে – দেখাই যাক”। ভেতরের অংশ খুলে টিউবগুলোকে উল্টোভাবে লাগিয়ে অন করতেই – সব ঠিকঠাক। বিশ্রী কর্কশ শব্দটা আর নেই। চমৎকার ছাগলের মত চুপ করে আছে রেডিওটা। টিউব গরম হতে যেটুকু সময় নেয় সেটুকু সময় পরেই রেডিওটা চমৎকার বাজছে।

কোন মানুষ যখন শুরুতে তোমাকে খুব নিচু চোখে দেখে বা আন্ডারএস্টিমেট করে, কিন্তু পরে যখন দেখে তুমি চমৎকার কিছু একটা করেছো তখন সেই মানুষই তোমার ওপর একশ’ গুণ বেশি খুশি হয়, তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়। এই লোকটিও আমার ওপর প্রচন্ড খুশি হয়ে উঠলেন। এরপর থেকে কোথাও কোন রেডিও মেরামতির কাজ আসলেই আমার কথা বলেন লোকটা। আর সবার কাছেই বলে বেড়ান “সে শুধুমাত্র মাথা খাটিয়েই রেডিও ঠিক করে ফেলে”। বাচ্চা একটা ছেলে- পায়চারি করতে করতে ভাবলো কিছুক্ষণ – তারপর রেডির ডালাটা খুলে কিছু একটা করলো আর কর্কশ রেডিওটা চমৎকার ঠিক হয়ে গেলো। লোকটার কাছে এটা ছিল একটা প্রচন্ড বিস্ময়কর ব্যাপার।

সেসময় রেডিওর সার্কিটগুলো আসলেই খুব সহজ সরল ছিল। রেডিওর ঢাকনা খুললেই সব যন্ত্রপাতি পরিষ্কার চেনা যেতো। স্ক্রুগুলো খুলে যন্ত্রপাতি আলাদা করলেই রেজিস্টার, ক্যাপাসিটার হেনতেন সব দেখা যায়। সবগুলোর গায়েই লেখা আছে কোন্‌টা কী। ক্যাপাসিটারের মোম গলে গেলে বোঝা যায় যে ক্যাপাসিটার খুব গরম হয়ে গেছে অর্থাৎ ভেতরে পুড়ে গেছে। রেজিস্টারের জায়গায় কালো হয়ে যাওয়া মানেই হলো রেজিস্টারের দফারফা হয়ে গেছে। আর যদি রেজিস্টার দেখে কিছু বোঝা নাও যায় তাহলে ভোল্টমিটার দিয়ে টেস্ট করে দেখা যায় ঠিকমত ভোল্টেজ সাপ্লাই আছে কিনা। গ্রিড ভোল্টেজ সবসময় দেড় বা দুই ভোল্ট। আর প্লেট ভোল্টেজ একশ’ বা দু’শ ডি-সি। সুতরাং ভেতরের জিনিসপত্র দেখে বুঝে কোথায় কী ঠিকমত কাজ করছে না তা বের করে নিয়ে রেডিও মেরামত করা আমার জন্য কঠিন কাজ ছিল না।

মাঝে মাঝে আমার অনেক বেশি সময় লাগতো রেডিওর সমস্যা বের করতে। মনে আছে একদিন পুরো একটা বিকেল আমার গেলো শুধু একটা পোড়া রেজিস্টার খুঁজে বের করতে। রেজিস্টারটি যে পুড়ে গেছে তা এমনিতে দেখে বোঝার কোন উপায় ছিল না। রেডিওটা ছিল আমার মায়ের এক বান্ধবীর। তাই আমি খুব স্বাধীনভাবে কাজ করছিলাম। পিঠের ওপর চোখ রেখে কেউ বারবার প্রশ্ন করছিল না “এই কী করছো?”। বরং তার বদলে কিছুক্ষণ পর পর “এই রিটি- এক গ্লাস দুধ দিই তোমাকে। এই কেকটা খাও” ইত্যাদি বলে আপ্যায়ন করছে। শেষপর্যন্ত আমি রেডিওটা ঠিক করতে পেরেছিলাম। কারণ আমার এসমস্ত কাজে ধৈর্য অপরিসীম। কাজের এক পর্যায়ে আমি প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু যখন আমার মায়ের বান্ধবীটি বললেন, “রেখে দাও রিটি। অনেক বেশি ঝামেলার কাজ এটা। পারলে পরে করো”। জেদ চেপে গেলো আমার। কাজের কাছে হেরে যাবার বান্দা আমি নই। যত সময়ই লাগুক সমস্যার শেষ না দেখে আমি ছাড়তে পারি না। এটা অনেকটা পাজল সলভ করার মত। ধাঁধা বলো আর হায়ারোগ্লিফিক্‌স বলো বা কম্বিনেশান লক খোলা বলো সবই তো পাজল এক একটা। এসমস্ত কাজে আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে না সহজে।

ক্রমশঃ_______
[আপন আলোয় ফাইনম্যান ৩য় পর্ব]