পূর্ববর্তী পর্ব – ক্যান্সার : আমিই বা নই কেন?

ক্যান্সার নিয়ে লিখতে বসে কেন জানি বারবার নাসিরুদ্দিন হোজ্জার চাবি হারানোর গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে। হোজ্জা একবার তার বাড়ির চাবি হারিয়ে ফেললেন। রাতের বেলা আলোকিত ল্যাম্প পোষ্টের চারদিকে হন্যে হয়ে তিনি চাবিটা খুঁজছিলেন। বাড়ির পাশ দিয়ে এক লোক যাচ্ছিলেন। হোজ্জাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি খুঁজছেন ? হোজ্জা বললেন, ‘চাবি’। ভদ্রলোকও হোজ্জাকে সাহায্য করার জন্য তার সাথে মিলে ল্যাম্পপোস্টের চারিদিকে মাটিতে চাবি খুঁজতে লাগলেন। অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টার পরেও চাবিটা না পেয়ে ভদ্রলোক হোজ্জাকে জিজ্ঞেসা করলেন, ‘ভাই চাবিটা কি ঠিক এখানেই হারিয়েছিল?’ উত্তরে হোজ্জা বললেন, ‘নাহ, চাবি তো হারিয়েছে বাগানে’! সেই ব্যক্তি তখন অবাক হয়ে জানতে চাইলেন তাহলে হোজ্জা বাগান থেকে এত দূরে এসে ল্যাম্পপোস্টের নীচে এসে চাবিটা খুঁজছেন কেন? উত্তরে হোজ্জা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আরে গাধা নাকি! দেখছেন না, বাগানটা কীরকম ঘুটঘুটে অন্ধকার, সেখানে খুঁজে লাভ কি? যেখানে আলো আছে, সেখানেই তো খুঁজব’।

অনেকটা এরকমই ছিল ক্যান্সারের গবেষণার অবস্থা বিংশ শতাব্দীর বেশীর ভাগ সময়টা ধরেই। ক্যান্সার একটি বংশগতিয় রোগ, কিন্তু বলতে গেলে সত্তর দশকের আগ পর্যন্ত ক্যান্সারের গবেষণাগুলো জেনেটিক্সের আলো থেকে বহুদূরে অবস্থান করছিল। তবে সেটাকে বড্ড বেশী দোষের চোখে দেখাও বোধ হয় ঠিক হবে না। ঘোড়ার আগে তো আর গাড়ি জোতা সম্ভব নয়। জেনেটিক্সের ঘোড়ার নাগাল পাওয়ার কাহিনি কিন্তু খুব বেশী দিনের নয়। জেনেটিক্সের ভিত্তি স্থাপনকারী বিভিন্ন মৌলিক আবিষ্কারগুলো যে কত সাম্প্রতিক তা দেখলেও অবাক হতে হয়। এই তো সেদিনের কথা, ১৮৩৮ সালে প্রথমবারের মত আমরা জানতে পারি যে সব জীব ‘কোষ’ দিয়ে তৈরি, এর আগে আমরা জানতামই না যে আমাদের দেহ কোষ বলে এক মৌলিক বিল্ডিং ব্লক দিয়ে তৈরি। ১৮৬০ সালে মেন্ডেল জিন আবিষ্কার করলেও ১৯০৫ সাল পর্যন্ত আমরা গবেষণাটি সম্পর্কে জানতেই পারিনি। ১৮৭৯ সালে ফ্লেমিং প্রথম ক্রোমোজোমের নামকরণ করেন। ১৯১৫ সালে মরগ্যান আরেক ধাপ এগিয়ে বলেন যে মেন্ডেলের জিনগুলো আসলে ক্রোমোজোমের মাধ্যমে বাহিত হয় আর কোষ বিভাজনের সময় এই ক্রোমোজোমগুলোর ভিতর দিয়েই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জিনের সঞ্চালন ঘটে। সেই কোষ তত্ত্ব থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে ক্রিক এবং ওয়াটসনের ডিএনএর গঠন আবিষ্কার বা মনোডের জিনের মধ্যে আরএনএ কপি চিহ্নিত করা পর্যন্ত কোষের ভিতরের আভ্যন্তরীণ কাঠামো এবং কাজকর্ম সম্পর্কে কিছু কথা জানতে পারলেও ক্যান্সার কোষের গঠন সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান কিন্তু শূন্যের কোঠায়ই ছিল বলা যায়।

১৯৫০ সালের প্রথম দিকেও পোলিও বা গুটি বসন্ত রোগের মতই ক্যান্সার হওয়ার পিছনেও ভাইরাসই দায়ী বলে মনে করা হত। ১৯১০ সালে পেটন রুস নামক একজন সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ (ভিরুলজিস্ট) মুরগিতে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী রুস সারকোমা ভাইরাস আবিষ্কার করেন আর তারপর থেকেই শুরু হয় ল্যাম্প পোষ্টের আলোর নীচে ক্যান্সারের চাবি খোঁজার দীর্ঘ অথচ ভুল প্রক্রিয়া। তিনটি প্রধান ক্যাম্পে ভাগ হয়ে যায় ক্যান্সারের গবেষণা। এদের মধ্যে রুসের এই দলই সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন যারা ক্যান্সারের একমাত্র কারণ হিসেবে ভাইরাসকে দায়ী করতেন। ওদিকে ছিলেন এপিডেমিওলজিস্টরা যারা দাবী করতেন যে আমাদের চারপাশের নানা ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যগুলোই ক্যান্সারের মূল কারণ। আর এদের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে ছিলেন থিওডর বোভারির দল যারা সেই ১৯১৪ সাল থেকেই খুব বেশী কোন তথ্য প্রমাণ ছাড়াই মিনমিন করে বলার চেষ্টা করে আসছিলেন যে আমাদের কোষের ভিতরের জিনগুলোর মধ্যেই আসলে লুকিয়ে আছে ক্যান্সারের মূল কারণ। কিন্তু যথেষ্ট তথ্য প্রমাণের অভাবে বোভারির দল তেমন কোন পাত্তাও পাচ্ছিলেননা এই লড়াইয়ে। অর্ধ দশকেরও বেশী সময় ধরে এই টানাপড়েনের মধ্যে দিয়েই চলতে থাকে ক্যান্সারের গবেষণা। মুরগীতে এক ধরণের ক্যান্সারের জন্য দায়ী রুস ভাইরাস বা মানুষে সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের জন্য দায়ী এইচপিভি ভাইরাসের মত দুই একটা দুর্লভ ভাইরাসের দেখা মিললেও ক্যান্সার যে মূলত একটি সংক্রামক ব্যাধি নয় তা আমরা বুঝতে শুরু করেছি খুব সাম্প্রতিক সময়ে। ক্যান্সারের গবেষণা যতদিন ভাইরাসের আলোর নীচে সীমাবদ্ধ থেকেছে ততদিন পর্যন্ত আমরা ল্যাম্প পোষ্ট ছেড়ে আর বেশিদূর এগুতে পারিনি।

ক্যান্সার গবেষণার ইতিহাস নিয়ে তো অনেক কথা হল, এবার তাহলে আসুন ক্যান্সারের ‘বিজ্ঞান’ একটু নিয়ে কথা বলা যাক। একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের আলোয় দেখা যাক ক্যান্সার আসলেই কি, সে কীভাবে কাজ করে, কীভাবে ছড়ায় আর কেনইবা আমরা এখনো এর ভয়াবহতার সামনে এতটাই অসহায়। গত তিন দশকে প্রথমবারের মত আমরা কোষের বিভাজন এবং পুনর্জননের ইতিবৃত্ত বুঝতে শুরু করেছি। হ্যা শুধু ক্যান্সার কোষই নয়, সুস্থ কোষের পুনর্জননের ব্যাপারগুলোও আমরা এতদিন খুব ভালো করে বুঝতাম না। ক্যান্সারের বিভীষিকা এবং রহস্যময়তা বুঝতে হলে আমাদের বিবর্তন এবং কোষ চক্রের (সেল সাইকেল) মূল কিন্তু সূক্ষ্ম কিছু ব্যাপার বুঝতে হবে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি যে আমরা খুব ইদানিং কালে কোষচক্রের খুঁটিনাটি বুঝতে শুরু করেছি, গত তিন দশকের গবেষণাগুলো ধীরে ধীরে আমাদের সামনে স্বাভাবিক কোষচক্র এবং সেই সাথে ক্যান্সারের কোষ চক্রের ধাঁধাগুলো উন্মোচন করতে শুরু করেছে।

ক্যান্সার আমাদের বিবর্তনীয় পথেরই সাথী, একদিক থেকে চিন্তা করলে একে বহুকোষী জীবের বিবর্তন এবং অভিযোজনের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া বললেও ভুল হবে না। প্রায় সত্তর কোটি বছর আগে বিবর্তনের ধারায় বহুকোষী প্রাণীদের উন্মেষ ঘটে। এককোষী প্রাণীদের কোষ বিভাজনের পদ্ধতিটা বেশ সরল, পার্শ্ববর্তী পরিবেশে পুষ্টির লভ্যতাই অনেকাংশে তাদের বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটাকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু বহুকোষী প্রাণীতে, বোধগম্য কারণেই, এই কোষ বিভাজনের প্রক্রিয়াটা অনেক বেশী সূক্ষ্ম এবং জটিল। এখানে শুধু কোষ বিভাজন হলেই হচ্ছে না, তাদের স্পেশালাইজড বা সুনির্দিষ্ট কলা এবং অঙ্গগুলোর সঠিকভাবে পরিবর্ধন এবং বিন্যস্ত করার ব্যাপারটাও চলে আসছে। এজন্য কোষ বিভাজনের প্রক্রিয়ার সাথে সাথে সেটাকে সঠিক জায়গায় এবং সময়ে থামিয়ে দিতে পারা, ত্রুটিপূর্ণ ডিএনএর মেরামত ও নবায়ন করা এবং সঠিক কারণে কোষের মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য বেশ জটিল কিছু ব্যবস্থারও বিবর্তন ঘটতে হয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজনকে ঠেকানোর জন্য কোষ চক্রের ভিতরে এবং বাইরে যেন লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা রাগী সব দারোয়ান নিয়োগ করা হয়েছে। কোষচক্রের অভ্যন্তরে কড়া নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির আওতায় থেকে নির্দিষ্ট স্তরে একদল প্রোটিনের মধ্যে যে মিথষ্ক্রিয়া চলে সেগুলোই আমাদের কোষবিভাজনের সঠিকতা নিয়ন্ত্রণ করে। আর এই জটিল প্রক্রিয়াটার ভিতরে মিউটেশনের ফলে যখন এই সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণগুলো একের পর এক খসে পড়ে তখনই শুরু হয় কোষের দরজায় ক্যান্সারের আনাগোনা। তখন কোষ চক্রের এই প্রোটিনগুলো সঠিকভাবে আর বিভাজনের প্রক্রিয়াটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা, ক্যান্সারের কোষগুলো বাঁধাহীনভাবে শুধু বাড়তেই থাকে। তবে ক্যান্সারকে ঠিক এর উল্টোভাবেও কিন্তু দেখা যেতে পারে। ক্যান্সার হয় তখনই যখন কোন কোষ বিশুদ্ধ এক কোষ বিভাজনের প্রক্রিয়া তৈরি করে ফেলতে সক্ষম হয়, যেখানে কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, কোষচক্রের চোখ রাঙানী নেই, আছে শুধু বিভাজনের রামরাজত্ব। এভাবে কোন নিয়ন্ত্রণ ছাড়া বিভাজিত হতে থাকলে অকল্পনীয় এক গতিতে কোষের সংখ্যা বেড়ে টিউমার তৈরি হয়ে যেতে পারে। একতি কোষে দিনে যদি একবার কোষ বিভাজন ঘটে তবে ১০ দিনে তা বেড়ে এক হাজার কোষে, ২০ দিনে এক মিলিয়ন কোষে পরিণত হতে পারে, আর পৃথিবীর চেয়ে বহুগুন বড় কোন একটা প্রাণীতে পরিণত হতে বা তত বর একটা টিউমার তৈরি করতে তার কিন্তু একবছরেরও অনেক কম সময় লাগবে। সে কারণেই যে কোন বহুকোষী প্রাণীর ক্ষেত্রে কোষের বৃদ্ধি এবং নবায়নটা যতখানি প্রয়োজনীয় কোষচক্রকে সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় নিয়ন্ত্রণ করতে পারাটাও ততখানি অপরিহার্য। আর এজন্যই সব ইউক্যারিওটিক কোষেই এত শক্তভাবে নিয়ন্ত্রি্ত এক জটিল কোষচক্রের বিবর্তন ঘটেছে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে ক্যান্সার কেন হয় তা বুঝতে হলে কোষচক্রের কিছু মৌলিক ব্যাপার না বুঝলেই নয়। চলুন সোজা বাংলায় এবং খুব সংক্ষেপে স্বাভাবিক এবং ক্যান্সা্রে আক্রান্ত কোষচক্রের জটিল কাজকর্মগুলোর একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করা যাক।

স্তন্যপায়ী প্রাণীদের কোষ বিভাজনের উদাহরণটিই দেখা যাক। প্রত্যেকটি কোষচক্রে মূলত দুটি প্রধাণ ঘটনা ঘটে, প্রথমে ডিএনএর সিন্থেসিস বা ক্রোমোজোমের বিভাজন (S স্তর) এবং তারপর ঘটে নিউক্লিয়ার বিভাজন বা মাইটোসিস (M স্তর)। ভ্রূণের প্রাথমিক অবস্থায় অকল্পনীয় গতিতে এই কোষ বিভাজন ঘটতে থাকে। তখন কোষচক্র এই দুটি প্রধাণ স্তরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। S স্তরে CDK২ (সাইক্লিং ডিপেন্ডেন্ট কিনেস ) প্রোটিনের নির্দেশে ডিএনএর বিভাজন ঘটে আর তার পরপরই CDK১ এর নির্দেশে মাইটোসিস ঘটে যায়। কিন্তু পরবর্তী ধাপে যখন জটিলতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে তখন কোষগুলোর মধ্যে অত্যন্ত কঠোর এক ‘আমলাতান্ত্রিক’ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তৈরি হয়। এই S এবং M স্তরের মাঝখানে দুটো গ্যাপ স্তরের অবির্ভাব ঘটে, যাদেরকে গ্যাপ১ (G1) এবং গ্যাপ২ (G2) নামে অভিহিত করা হয়। G1 স্তর দেখা দেয় নিউক্লিয়ার বিভাজন এবং পরবর্তী ডিএনএ সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার সূচনার মাঝখানে। এই পর্যায়ে কোষচক্রে নিয়োজিত প্রোটিন এবং অন্যান্য উপাদানগুলোর ক্রিয়াকর্ম নির্ভর করে কোষের আভ্যন্তরীণ এবং বাইরের বিভিন্ন সঙ্কেতের উপর। বৃদ্ধি, টিকে থাকা, মৃত্যু, বিপাকক্রিয়া, ডিএনএর ক্ষয়ক্ষতি, আভ্যন্তরীণ রাসায়নিক চাপ বা পীড়ন, কোষের চারদিকের পরিবেশ ইত্যাদির মত বিভিন্ন ধরণের ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক সংকেতগুলোর উপর নির্ভর করে কোষটি বিভাজন বা নবায়নের দিকে এগিয়ে যাবে নাকি আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হবে। আমাদের দেহে ত্বক বা ক্ষুদ্রান্তের মত কিছু অঙ্গ বাদ দিলে বেশীর ভাগ পরিণত অঙ্গেই কিন্তু আর সেভাবে কোষ বিভাজন ঘটেনা। তখন এই কোষগুলো G1 স্তরের ভিতরেই এক নিষ্ক্রিয় অবস্থায় (G0 স্তর) বিরাজ করতে থাকে।


ছবি-১: সরল এবং জটিল কোষচক্র। (১)

G1 স্তরে সবগুলো পরীক্ষা পাশ করলে তবেই S স্তরে ঢোকার প্রশ্ন আসে আর না করলে কোষ চক্রে তখনকার মত বিরতি ঘোষণা করা হয়। আরেক গ্যাপ স্তর G2 দেখা দেয় S স্তর বা ডিএনএ সংশ্লেষণের পরপর। এখানে ডিএনএ বিভাজনের সম্ভাব্য ত্রুটি খতিয়ে দেখা হয়, মাইটোসিসের মাধ্যমের চূড়ান্ত কোষ বিভাজনের জন্য সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা তার পরীক্ষা চলে। বিভাজনে ত্রুটি বা ডিএনএর ক্ষয় জাতীয় ব্যাপারগুলো কোষের অখণ্ডতা বা শুদ্ধতা রক্ষায় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। আর এই হুমকিগুলোকে সামাল দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে কোষের ভিতরের প্রোটিনের পাহারাদার বাহিনী। এই উল্টোপাল্টা ক্ষয়ক্ষতিগুলো মেরামত না হওয়া পর্যন্ত ওরা লাঠি হাতে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, কোষ চক্রকে G1 বা G2 স্তর থেকে বেরিয়ে বিভাজনের পথে এগিয়ে যেতে বাঁধা দেয়। যদি পরিস্থিতি একেবারেই মেরামতের অযোগ্য হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তাদেরকে এপপ্টেসিসের মাধ্যমে মৃত্যুর দিকে পরিচালিত হতে বাধ্য করে। আর এই জটিল প্রক্রিয়াটাতে যখন নির্দিষ্ট স্থানে এবং অনুক্রমে মিউটেশন ঘটে তখনই শুরু হয় ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা (১)।

এ তো গেল স্বাভাবিক কোষচক্র এবার আসি ক্যান্সারের কোষ চক্রে। কোষচক্র কোষবৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে আর কোন কোষ ক্যান্সারাক্রান্ত হয় যখন কোষচক্রের কঠিন নিয়মকানুনগুলো আর অটুট থাকে না। ক্যান্সারের প্রসংগ আসলেই আমরা বেশীরভাগ সময়েই একইসাথে অনকোজিনের কথাও শুনে থাকি। কিন্তু এই অনকোজিনগুলো আসলে কি? তারা কীভাবে কাজ করে? এই অনকোজিনগুলো আর কিছু নয়, তারা কোষবৃদ্ধির কাজে নিয়োজিত প্রোটো-অনকোজিনগুলোর মিউট্যান্ট বা পরিবর্তিত রূপ। সাধারণ অবস্থায় প্রোটো-অনকোজিনেরা কোষ বিভাজনের প্রক্রিয়াকে উদ্দীপিত করে, তারা কোষের বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য দায়ী প্রোটিনগুলোকে কোড করে। এই জিনগুলোতে মিউটেশন ঘটলে অনেক সময় তারা সদা-সক্রিয় হয়ে অনকোজিনে (অনকোজিন কথাটাও এসেছে সেই গ্রীক শব্দ onkos থেকে যার অর্থ টিউমার বা mass) বা ক্যান্সারের জিনে পরিণত হয়। তখন তারা কোষচক্রের কোন চোখ রাঙ্গানী তোয়াক্কা না করে যখন বা যেখানে বৃদ্ধি পাওয়ার করার কথা নয় সেখানেও মনের সুখে কোষ বিভাজনের প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে তোলার চেষ্টা করে (নীচের ছবিতে দেখুন)। শুধু তাইই নয় কখনও কখনো এই অনকোজিনগুলো কোষকে অবধারিত মৃত্যুর (এপপ্টেসিস) হাত থেকেও বাঁচিয়ে দিতে পারে। অনেকেই ক্যান্সার কোষগুলোর এই যথেচ্ছ বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে দ্রুত গতিতে ছুটতে থাকা গাড়ির সাথে তুলনা করেন। ধরুন, আপনি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন কোথাও। আপনার পা গাড়ির এক্সেলারেটার বা গ্যাস প্যাডেলটি চেপে ধরে আছে। গতি কমানোর জন্য পা’টা উঠাতেই বুঝতে পারলেন যে এক্সেলারেটরটি আটকে গেছে, উপরে য়ার উঠে আসছে না। এই অবস্থায় আপনি পা তুলে নিলেও গাড়ির গতি কিন্তু আর কমবে না, গাড়িটি দ্রুতগতিতে ছুটে চলতেই থাকবে। চলন্ত গাড়িতে অকস্মাৎ গ্যাস প্যাডেল আটকে যাওয়ার মতই অনকোজিনগুলোও কোষচক্রকে চালিয়ে নিইয়ে যেতে সচেষ্ট হয়। তারা এমন সব প্রোটিন কোড করতে শুরু করে যারা কোষচক্রকে সদা উদ্দীপিত করে রাখে, সাধারণ নিয়মানুযায়ী G স্তরগুলোতে এসে কোষের বিভাজন আর থেমে থাকে না। কোষগুলো যেন নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলতে থাকা বিভাজনের অবিরাম-চক্রে নিজেদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে।

বেশ কয়েক ধরণের মিউটেশনের ফলে প্রোটো-অনকোজিনগুলো অনকোজিনে পরিণত হতে পারে। যেমন ধরুন, রাস(Ras) প্রোটিনগুলো সাধারণ অবস্থায় এক ধরণের আণবিক সুইচ হিসেবে কাজ করে। ‘অন’ অবস্থায় তারা কোষ বিভাজনের সঙ্কেত প্রদান করে, ‘অফ’ অবস্থায় নিষ্ক্রিয় থাকে। কখনও কখনো মিউটেশনের ফলে এরা সদা ‘অন’ বা সক্রিয় হয়ে পড়ে। কোষের বাইরের বা ভিতরের সঙ্কেতগুলো কোষ বিভাজনের বিপক্ষে রায় দিলেও তারা কিন্তু সক্রিয় অবস্থাতেই বিরাজ করতে থাকে। ক্রোমোজোমের ট্রান্সলোকেশন ঘটেও আবার আরেক ধরণের মিউটেশন ঘটতে পারে। এর ফলে দুটি ভাঙ্গা ক্রোমোজোম একে অপরের সাথে উল্টাপাল্টা ভাবে জোড়া লেগে যায়। একধরণের লিউকেমিয়া বা ব্লাড ক্যান্সারে BCR/ABL ক্রোমোজোম ট্রান্সলোকেশন দেখা যায় যেখানে Bcr আর Abl এর দুই প্রান্ত জোড়া লেগে একীভূত হয়ে যায়। এর ফলে যে একীভূত বা ফিউশন প্রোটিনটি তৈরি হয় তা সদা-সক্রিয় হয়ে ওঠে। অনেক সময় আবার বিদ্যমান প্রোটো-অনকোজিনগুলোতে কোন রকমের পরিবর্তন না করেও অনকোজিন তৈরি হয়ে যেতে পারে। এরকম পরিস্থিতিতে নিজেদের অনেকগুলো কপি তৈরির মাধ্যমে জিনের এক্সপ্রেশন এমপ্লিফাইড হয়ে যেতে পারে (২)।

৭০ এর দশকে এসে কয়েকটি অনকোজিনের ক্লোনিং এর মাধ্যমে শুরু হয় প্রথম ক্যান্সারের বুহ্যভেদ করার প্রক্রিয়া। প্রথমবারের মত আধুনিক আণবিক যুগের সূচনা ঘটে ক্যান্সারের গবেষণায়। ল্যাম্পপোস্টের চারদিকের ক্ষুদ্র এলাকা ছাড়িয়ে আলো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে দূর থেকে দূরান্তরে, সঠিক জায়গাগুলোতে। তারপর ৮০র দশকে আমরা বেশ কয়েকটি টিউমার সাপ্রেসর বা টিউমার দমনকারী (নীচের ছবিতে দেখুন) জিনের ক্লোনিং করতে সক্ষম হই। উপরে কোষচক্র নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে পাহারাদারি ব্যবস্থার কথা শুনেছিলাম সেই কাজেই নিয়োজিত থাকে এই টিউমার দমনকারী জিনগুলো। সীমান্তের প্রহরীর মত কোষচক্রের বিভিন্ন চেকপয়েন্টগুলোতে পাহারা দেয় তারা। তাদের ক্ষমতা অসীম, বিভাজনের প্রক্রিয়ায় ভুল ত্রুটি দেখলে বিভিন্ন চেকপয়েন্টের ডাকে সাড়া দিয়ে তারা কোষ চক্রকে থামিয়ে দিতে পারে। বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় কোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি ঠেকাতে, অর্থাৎ আমাদের দেহে ক্যান্সার বা টিউমার ঠেকাতে, যে পদ্ধতিগুলোর বিবর্তন ঘটেছে তাদের মধ্যে এই টিউমার দমনকারী জিনগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ জিনগুলোর আবিষ্কার ক্যান্সারের গবেষণার মাইলফলক হিসেবে কাজ করেছে, এ থেকেই আমরা ক্যান্সারের জিনগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে শুরু করেছি। অনকোজিনগুলোর সক্রিয় হয়ে উঠতে বা কোষের বিভাজনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ধনাত্মক নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে এই জিনগুলোর একটি আ্যলেলে মিউটেশনই যথেষ্ট। কিন্তু অন্যদিকে কোষবৃদ্ধিতে বাঁধাপ্রদানকারী টিউমার দমনকারী জিনগুলোর কাজকে ঋণাত্মক নিয়ন্ত্রণপদ্ধতি হিসেবে গণ্য করা হয়। এদের অ্যালেলেগুলো সাধারণত রিসেসিভ হয়, তাই এদের ক্যান্সারাক্রান্ত জিনে পরিণত হতে দুটো অ্যালেলেই মিউটেশন ঘটা অপরিহার্য (এর কিছু ব্যতিক্রম আছে, যেমন TP53 নামক টিউমার সাপ্রেসর জিনে, কোন কোন ক্ষেত্রে, একটা অ্যালেলে মিউটেশন ঘটলে তারা আরেকটি অ্যালেলকেও নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে) (৩)।


ছবি-২: এখানে কোষচক্রের বিভিন্ন স্তরে পাহারার বিভিন্ন চেকপয়েন্টগুলো দেখানো হয়েছে লাল মোটা দাড়ি দিয়ে। অনকোজিনগুলো (কালো রেখা দিয়ে দেখানো হয়েছে) চেকপয়েন্টগুলো উপেক্ষা করে কোষ চক্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে আর ওদিকে টিউমার সাপ্রেসর জিনগুলো (তীর চিহ্ন দিয়ে দেখানো হয়েছে) সীমান্তের প্রহরীর মত চেকপয়েন্টগুলো আগলে রাখে যাতে করে সঠিক সময় না আসা পর্যন্ত কোষের বিভাজন ঘটতে না পারে (২)।

এই টিউমার দমনকারী জিনগুলো সঠিক সঙ্কেত না পাওয়া পর্যন্ত কোষ চক্রকে S স্তরে আটকে রাখে। শুধু তাই নয় এরা আবার কখনও কখনো দরকার পড়লে এপপ্টসিসের (বহুকোষী প্রাণীতে কোষের প্রোগ্রাম করা মৃত্যু এপপ্টসিস বলে) মাধ্যমে কোষকে আত্মহত্যা করতেও বাধ্য করে। আমরা যদি আবার সেই গাড়ির তুলনায় ফেরত যাই তাহলে দেখবো যে এরা আসলে গাড়ির ব্রেক হিসেবে কাজ করে। উপরের উদাহরণ অনুযায়ী গাড়ি চালাতে চালাতে আপনি যদি দেখেন যে এক্সেলারেটরটা আটকে গেছে তখন আপনি কি করবেন? প্রথমেই নিশ্চয় মনের অজান্তেই আপনার পা চলে যাবে ব্রেকের উপর। কিন্তু তখন দুঃস্বপ্ন সত্যি হওয়ার মত যদি দেখেন যে ব্রেকটাও কাজ করছে না? যত জোরেই চাপ দিন না কেন গাড়ি তো থামছেই না, গতিও কমছে না কিছুতেই। এ যেন ঢাকা-আরিচা সড়কে ব্রেক ফেল করে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা সেই গাড়িটি! আর ঠিক একই অবস্থা ঘটে ক্যান্সার কোষগুলোতেও। শুধু প্রোটো-অনকোজিনগুলোতে মিউটেশন ঘটলে কোষের ব্রেক বা টিউমার দমনকারী জিনগুলো শেষ রক্ষা করতে এগিয়ে আসতে পারে। কিন্তু তাদের মধ্যেও যদি মিউটেশন ঘটে যায় তাহলে তো আর কোন কথা বাকি থাকেনা। তখন আমাদের দেহে কোষের জন্ম এবং মৃত্যুর মধ্যে সামঞ্জস্য ধরে রাখা সম্ভব হয় না, শুরু হয় নিয়ন্ত্রণহীনভাবে কোষ বিভাজনের খেলা যেখান থেকে ক্যান্সারের উৎপত্তি ঘটতে পারে। উপরের ছবিতে যে pRb প্রোটিনটি (রেটিনোব্লাস্টোমা প্রোটিন) দেখানো হয়েছে সেটির কোডের জন্য দায়ী এক ধরণের টিউমার দমনকারী জিন RB1। এই pRb প্রোটিনটি কোষের S স্তরে ঢোকার জন্য যে জিনগুলো দরকার তাদের এক্সপ্রেশন বন্ধ করে দিয়ে কোষচক্রকে G1 স্তরে আটকে রাখে। কিন্তু এই ধরণের জিনগুলোতে মিউটেশন ঘটলে কোষের এই ঋণাত্মক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিটি ভেঙ্গে পড়ে।

ছবিতে যে TP53 জিনটি দেখানো হয়েছে সেটিও আরেক ধরণের টিউমার দমনকারী জিন, আমাদের ক্যান্সার কোষে প্রায়শই এদের মধ্যে মিউটেশন ঘটতে দেখা যায়। কোষ বিভাজনের সময় ডিএনএ তে কোন খুঁত বা ক্ষয়ক্ষতি দেখলে তারা হয় কোষ চক্র বন্ধ করে দেয় অথবা কোষটিকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। এই জিনে মিউটেশন হলে বা অন্য কোন জিনে মিউটেশনের ফলে এই জিনটির কাজ বাধাপ্রাপ্ত হলে সুস্থ কোষ চক্রের নিয়ম ভঙ্গ করে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া ডিএনএসহই কোষগুলো বৃদ্ধি পেতে থাকে। ক্যান্সারের গবেষকেরা প্রথমে শুধু অনকোজিন এবং কোষচক্রকে আটকানোর কাজে টিউমার দমনকারী জিনগুলো নিয়ে কাজ করলেও আশির দশকের শেষের দিকে এসে তারা বুঝতে শুরু করেন যে বহু ক্যান্সারের জিন ডিএনএর মেরামত এবং ক্রোমোজোমের সুস্থিতি রক্ষায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। এই জিনগুলোতে মিউটেশন হলে পয়েন্ট মিউটেশনের হার বেড়ে যায়, কোষে ক্রোমোজোম হারিয়ে যায় বা তাদের বহু প্রতিলিপি তৈরির হার বেড়ে যেতে শুরু করে বা ক্রোমোজোম স্থিতিশীলতা (হোমিওস্ট্যাসিস) বিঘ্নিত হয় (৩)। আধুনিক গবেষণা থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে উঠতে শুরু করেছে যে বেশীরভাগ ক্যান্সারেই ডিএনএর মেরামত এবং ক্রোমোজোমের স্থিতাবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। ডঃ বার্ট ভোগেলস্টাইন ক্যান্সারের জিনোম গবেষণার রাজ্যে এক অতি পরিচিত নাম। তিনিই প্রথম আশির দশকের শেষে, ক্যান্সার কোষে TP53 এর সঠিক ভূমিকা ব্যাখ্যা করেন। এর পরের পর্বে এই অতি গুরুত্বপূর্ণ TP53 জিনটির বিবর্তন, মিউটেশন এবং ক্যান্সার রোধে এর ভূমিকা নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করার ইচ্ছে রইলো ।

বেশীরভাগ ক্যান্সারেই ( লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়ার মত দুই একটি ক্যান্সার এর ব্যতিক্রম, যেখানে মাত্র ৫-১০ টি মিউটেশন দেখা যায়) শ’খানেকের বেশী মিউটেশন চোখে পড়ে। কোলন বা মলাশয় ক্যান্সার বা স্তন ক্যান্সারে গড়ে প্রায় ৫০-৮০টি মিউটেশন দেখা যায়, অগ্নাশয়ের ক্যান্সারে ৫০-৬০ টি, ব্রেন ক্যান্সারে (যা সাধারণত অনেক কম বয়সে ঘটতে দেখা যায়, আর তাতে করে এই কোষগুলোতে মিউটেশন ঘটার জন্য অনেক কম সময় পাওয়া যায়) ৪০-৫০ টি মিউটেশন ঘটতে দেখা যায় (৪)। ডঃ ভোগেলস্টাইন এই মিউটেশনগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করতে পছন্দ করেন। ক্যান্সার কোষের মধ্যে কিছু মিউটেশন সরাসরি ক্যান্সারের গঠনে কোন ভূমিকা বা সরাসরি কোন ভূমিকা পালন করেনা, এদেরকে তিনি প্যাসেঞ্জার মিউটেশন বলেন। আর অন্যদিকে যে মিউটেশনগুলো সরাসরি কোন কোষকে ক্যান্সারাক্রান্ত করে তুলতে ভূমিকা রাখে তাদের বলা হয় ড্রাইভার মিউটেশন। কোন ক্যান্সার কোষে বেশীরভাগ মিউটেশনই প্যান্সেঞ্জারের মত নিষ্ক্রিয় থাকে। আর ড্রাইভার মিউটেশনগুলো সক্রিয়ভাবে আক্রমণ করে আমাদের পূর্ব পরিচিত অনকোজিন বা টিউমার দমনকারী জিনগুলোকে। তবে এখানে আরেকটা ব্যাপার লক্ষণীয় যে প্রতিটি ক্যান্সার জিনোম অনন্য, যে কোন দুটি স্তন ক্যান্সার বা ফুসফুসের ক্যান্সারের জিনোমের মধ্যে পার্থক্য অকল্পনীয়-রকম বেশী । ক্যান্সার জিনোম সিকোয়েন্সিং শুরু করার পর গবেষকেরা অবাক হয়ে দেখতে পান যে, সুস্থ দুটি কোষের গঠনের মধ্যে প্রায় হুবহু মিল দেখা গেলেও দুটি ক্যান্সারাক্রান্ত কোষের মধ্যে অমিলের পরিমাণ চোখে পড়ার মতই। ডঃ ভোগেলস্টাইন ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, ক্যান্সার জিনোম সিকোয়েন্সিং আমাদের এত বছরের চিকিৎসার পর্যবেক্ষণকেই বৈধতা দিতে শুরু করেছে। প্রত্যেকটা রোগীর ক্যান্সারই আলাদা কারণ তাদের প্রত্যেকের ক্যান্সার জিনোম অনন্য (৪)।

আশা করি, এখন পাঠকেরা বুঝতে পারছেন কেন ক্যান্সারের ব্যাপারস্যাপারগুলো বুঝতে হলে কোষচক্র কীভাবে কাজ করে তা বোঝাটা একান্ত জরুরী হয়ে দাঁড়ায়। কোষচক্রের ভাষায় ব্যাখ্যা করতে না পারলে ক্যান্সার নিয়ে কোন গভীর জীববিজ্ঞানীয় আলোচনাই সম্ভব নয়। আর কোষচক্রের ভাষায় বলতে গেলে ক্যান্সারের সংজ্ঞাটাও কিন্তু বেশ সরল। সোমাটিক বা দেহকোষে মিউটেশনের ফলশ্রুতিতে কোষচক্রের নিয়ন্ত্রণকারী বিধিনিষেধগুলো যখন ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে তখনই ক্যান্সারের সম্ভাবনা দেখা দেয়। কোষের বিভাজন, বৃদ্ধি এবং মৃত্যু নিয়ন্ত্রণের জন্য যে বিশেষ পদ্ধতিগুলো বিবর্তিত হয়েছে তাতে কিছু নির্দিষ্ট মিউটেশন ঘটলে কোষগুলো যথেচ্ছা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। উপরের আলোচনায় দেখেছি যে, একটি মিউটেশনের মাধ্যমে অনকোজিন তৈরি হলেই কিন্তু কোন কোষ ক্যান্সারাক্রান্ত হয়ে পড়ে না, সেই সাথে টিউমার দমনকারী প্রক্রিয়া এবং ডিএনএ মেরামতের প্রক্রিয়াগুলোসহ কোষচক্রের একাধিক প্রক্রিয়াগুলোও ভেঙ্গে পড়তে হবে। অর্থাৎ কোন কোষের ক্যান্সারাক্রান্ত হতে হলে তাকে নির্দিষ্ট অনুক্রমে বেশ কিছু মিউটেশনের মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং সেটা ঘটার হার খুব কম বললেই চলে। আমরা এও দেখেছি যে একটি মাত্র মিউটেশন থেকে কখনওই ক্যান্সার হয় না, তা জার্মলাইন বা জনন কোষ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়াই হোক বা অন্যান্য দেহকোষ থেকে ঘটা স্বতঃস্ফূর্ত মিউটেশনই হোক। আর এখানেই সূচিত হয় অন্যান্য বংশগতিয় রোগের সাথে ক্যান্সারের পার্থক্যটা। মাস্কিউলার ডিস্ট্রফির মত বংশগতিয় অসুখ বংশ পরম্পরায় বাবা মার থেকে ছেলেমেয়েতে বাহিত হতে পারে, কিন্তু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। বাবা মা থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া মিউটেশনের ফলে পরবর্তীকালে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়লেও তা থেকে সরাসরি ক্যান্সার হয় না, তার উপর বহুদিন ধরে আরও বেশ কিছু সংখ্যক নির্দিষ্ট মিউটেশনের বোঝা চাপলে তবেই সেখান থেকে ক্যান্সারের সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। তাহলে প্রশ্ন করতে হয়, আমাদের চারদিকে এত (আগের পর্বে এই পরিসংখ্যানগুলো দিয়েছিলাম) মানুষের মধ্যে ক্যান্সার দেখা যায় কেন? এর কারণটাও বেশ সহজবোধ্য। আমাদের দেহে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কোষে যদি সাধারণ হারেও মিউটেশন ঘটতে থাকে তাহলে ৬০-৭০-৮০ বছরের জীবনে অন্ততপক্ষে একটি কোষের ক্যান্সারাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তেমন কম নয় বললেই কিন্তু চলে। আর এ কারণেই বয়স বাড়ার সাথে সাথে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়তে থাকে।

ছবি-৩: বিনাইন টিউমার এবং ম্যালিগিন্যান্ট টিউমার বা ক্যান্সার। সৌজন্যঃ ন্যাশনাল ক্যান্সার ইন্সটিটিউট (www.cancer.gov)

কিন্তু সব টিউমারই কি ক্যান্সার? নাহ, টিউমার মাত্রই যেমন ক্যান্সার নয় তেমনি টিউমারের সাইজ বড় হলেই তাকে ক্যান্সার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়না। পার্থক্যটা নির্ভর করে টিউমারের কোষগুলোর বিস্তৃতির ক্ষমতার উপর। যে টিউমারগুলো তাদের মূল বা প্রাথমিক অঙ্গের ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকে, সেখান থেকে শরীরের অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়তে পারে না তাদেরকে বলে বিনাইন টিউমার। আর ওদিকে টিউমারের যে কোষগুলো মেটাস্টেসিসের মাধ্যমে (আগের পর্বে এ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছিলাম) তাদের প্রাথমিক অঙ্গ থেকে লিম্ফ নোড বা রক্তনালীর মাধ্যমে অন্যান্য অঙ্গেও ছড়িয়ে পড়ে নতুন নতুন উপনিবেশ স্থাপন করতে সক্ষম তাদের বলে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার বা ক্যান্সার। কিন্তু এই বাঁধনহীনভাবে বেড়ে চলা কোষগুলো শুধু যে বেয়ারা প্রকৃতির তাইই নয় যথেষ্ট চতুরও বটে। বিন্ধ্যপর্বতের মত অবিরাম গতিতে বেড়ে চলার জন্য তাদের যে অক্সিজেন বা অতিরিক্ত পুষ্টির দরকার হবে তার যোগান দেওয়ার ব্যবস্থাও করে ফেলতে জানে তারা। একসময় আশেপাশের রক্তনালীগুলোকেও তারা চাকরীতে নিয়োজিত করে ফেলে এই কাজ করার জন্য। আর তারপরই শুরু হয় তাদের বাঁধনহীনভাবে বেড়ে চলার খেলা, তারা রক্তস্রোতকে কাবু করে শরীরের অন্যান্য কলা এবং অঙ্গকে আক্রমণ করতে শুরু করে। প্রতিটা অঙ্গের নতুন পরিবেশে নতুন করে গড়ে তোলে তাদের উপনিবেশ। আগের পর্বে উল্লেখ করেছিলাম যে, এভাবে মূল অঙ্গ থেকে ছড়িয়ে গিয়ে অন্যান্য কলা এবং অঙ্গে ছড়িয়ে পড়াকেই মেটাস্টেসিস বলে। ত্বকের ক্যান্সারের কোষগুলো যদি মেটাস্টিসাইজড হয়ে যকৃত বা মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ে তখন তাকে ত্বকের ক্যান্সার হিসেবেই অভিহিত করা হবে, যকৃত ক্যান্সার নয়। বিনাইন টিউমারগুলো সাধারণত ক্ষতিকর হয়না, আবার মূল অঙ্গের বাইরে ছড়িয়ে না পড়া পর্যন্ত ক্যান্সারের চিকিৎসা বেশ সহজ। কিন্তু মেটাস্টেসিস শুরু হলেই তা ক্রমশ: আমাদের বর্তমান চিকিৎসা ক্ষমতার আওতার বাইরে চলে যেতে শুরু করে।

পরবর্তী পর্বে কিমোথেরাপী, রেডিয়েশন এবং টার্গেটেড থেরাপী নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছে রইলো।

তথ্যসূত্রঃ
১) Massague, J. G1 Cell –Cylce control and Cancer. Nature 432. ( 2004) doi:10.1038/nature03094)
২) Chow, A. Y. (2010), Cell Cycle Control by Oncogenes and Tumor Suppressors: Driving the Transformation of Normal Cells into Cancerous Cells. Nature Education 3(9):7।
৩) Steven A. F (2012). Dynamics of Cancer, Inicidence, Inheritence and Evolution of Cancer. Prometheus books. 69-70.
4) Mukharjee, S (2010) The Emperor of All Melodies, A Biography of Cancer. Scribner. 450-453.