[স্বীকারোক্তি: চার্বাক নিয়ে কিছু লেখা আর একটা সাগর মন্থন করা মনে হয় একই কথা। এই সাগর হলো প্রাচীন ভারতীয় দর্শন। তা কেবল সাগরই নয়, মহাসাগরই বলা যায়। অতএব প্রথমেই এটা বলে রাখা সঙ্গত হবে যে, চার্বাক নিয়ে লেখার মুরোদ বা দুঃসাহস অর্বাচীন আমার নেই। বরং অত্যন্ত কৌতুহলি পাঠক হিসেবে চার্বাককে জানার এক অসফল চেষ্টা হিসেবে অনুসন্ধান চালানোর যে জটিল পথে পা বাড়িয়েছি, তারই চিহ্নরেখা এই সিরিজের উপাত্ত। ফলে এক কদম এগিয়েই ভেতর থেকে উত্থাপিত প্রশ্নের ধাক্কায় আরেক কদম এগিয়ে যাবার অবাধ্য মোহকে অস্বীকার করতে পারি নি বলেই সসঙ্কোচে আরেক পা বাড়িয়ে দেয়া। গুটি গুটি পায়ে এভাবে কয়েক পা এগিয়েছি বটে, কিন্তু এ দূরপনেয় দীর্ঘ পথের শেষ কোথায় এটা যেমন জানা নেই, তেমনি আদৌ কোনো সঠিক পথে এগুচ্ছি কিনা তাও নিশ্চিত নই। তাই এ অনিশ্চিত অভিযানের নাম দিয়েছি ‘চার্বাকের খোঁজে...’। শেষপর্যন্ত খোঁজ পাই আর না-পাই, নির্বুদ্ধিকভাবে হলেও অন্ততঃ খোঁজার চেষ্টা তো করেছি, এটাই সান্ত্বনা ! হা হা হা !
এই বেআক্কেলে অভিযানে যে পথ পেরিয়ে যাবো, সে পথে আবারো যে ফিরে ফিরে আসতে হবে প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সংযোজনে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু মূল পাণ্ডুলিপিতে এই সংযোজনগুলো যথারীতি সন্নিবিষ্ট হতে থাকলেও ব্লগ-পোস্টে তা পুনঃসম্পাদন করা যদিওবা সম্ভব হবে না, তবে তা পরবর্তীকালে প্রকাশিতব্য সম্ভাব্য গ্রন্থকে হয়তো পুষ্ট করবে। অবশ্য আদৌ তা হবে কিনা তাও জানি না।

পরিশেষে যা না-বললে সত্যের অপলাপ হবে, তা হলো, এটাকে কোনক্রমেই মৌলিক কাজ ভাবার কারণ নেই। কেননা এই অভিযান আসলে তো এক দীর্ঘ পুস্তক-ভ্রমণই। এর সমস্ত তথ্য-উপাত্তই অকৃপণভাবে ধার করা হয়েছে বিভিন্ন গ্রন্থ থেকেই। তাছাড়া এ বিষয়ে আমি এমন নতুন কিছু তো রচনা করছি না, কেবল তথ্য জড়ো করা ছাড়া ! যার উৎস হলো এখানে এই ক্রমান্বয়াধীন গ্রন্থসূচি। ] তাই আশা করছি আমার এই নির্বুদ্ধিতাকে বুদ্ধিমান পাঠক নিজ গুণেই মার্জনা করবেন। ]
……………………………………..

১.০ : ভূমিকা

ভারতীয় দর্শন বলতে আমরা এমন এক আধ্যাত্মিক দর্শনের জগতকে বুঝে থাকি যেখানে প্রায় সবগুলো দর্শনই বিপুলভাবে আধ্যাত্মবাদে পরিপূর্ণ। এই সর্বগ্রাসী আধাত্মবাদের বিপরীতে কেবল একটি মাত্র দর্শন যে তার বস্তুতান্ত্রিক জড়বাদী ধারায় একক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূত্র ধরে সেই প্রাচীনকাল থেকেই নিজের অবস্থানটিকে শক্ত করে ধরে রেখেছে তা হলো চার্বাক দর্শন (carvaka philosophy) ।
.
শুধু তাই নয়, ভারতীয় আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির প্লাবনে ভেজা মাটিতে পাশাপাশি দাঁড়ানো এই মতবাদের বহমান অক্ষুণ্নতা স্বমহিমায় এতোটাই উজ্জ্বল যে, ভারতীয় দার্শনিকরা তাঁদের নিজ নিজ মতবাদকে সাজাতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই এই প্রতিপক্ষের কাছ থেকে সম্ভাব্য আপত্তি অনুমান করে আগেভাগেই যুক্তি তর্কের সাহায্যে সেই আপত্তি খণ্ডনের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। দু’পক্ষের দ্বন্দ্বময় যুক্তি আর পাল্টা যুক্তির যুযুধান স্রোতের বিপুল আয়োজনে ভারতীয় দর্শনের জগতটা তড়তড় করে এক সমৃদ্ধ অবস্থানে এগিয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে চার্বাক পক্ষের নিজেদের অবস্থানের জায়গাটা ঢাকা পড়ে গেছে এক রহস্যজনক অন্ধকারে। চার্বাকদের নিজস্ব রচনা সম্ভারগুলো দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিলুপ্ত এখন। তা কি যথোচিত সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে, না কি ক্ষমতাসীন প্রতিপক্ষের দুরভিসন্ধিমূলক অভিপ্রায়ে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে আমাদের জানার উপায় নেই। তবে বস্তুতই এ মতবাদ যে শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াবার যোগ্যতা রাখে তা অপরপক্ষের সমরায়োজনের প্রস্তুতি থেকেই আমাদেরকে অনুমান করতে হয়। এই বিরুদ্ধপক্ষ কর্তৃক চার্বাক মতবাদকে ঠেকানো ও খণ্ডনের বিচিত্র প্রয়াস হিসেবে সেই দ্বন্দ্বপ্রসূত বিরোধী রচনাগুলোই চার্বাক মতবাদ জানার ক্ষেত্রে আমাদের জন্য মহামূল্যবান উৎস হয়ে আছে আজো।
.
বিরুদ্ধপক্ষের নিজেদের অনুকুল দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে উপস্থাপিত দর্শন-তত্ত্ব ও সাহিত্যে প্রতিপক্ষের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি ও মূলানুগ মতবাদ জানার প্রচেষ্টা কতোটা সন্দেহমুক্ত ও নির্ভরযোগ্য হবে তার আশঙ্কা প্রশ্নাতীত নয় যদিও, কিন্তু চার্বাকদের নিজস্ব সৃষ্টিসম্ভারের একান্তই অনুপস্থিতিতে এ ছাড়া আমাদের উপায়ও নেই। তাঁদের দর্শনসম্বন্ধীয় ধারণার জন্য অন্যের রচনার উপর এই নির্ভরতার কারণেই হয়তো চার্বাক মতের সুপ্রাচীন শক্তিটা অবিকৃতভাবে আমাদের দৃষ্টিগ্রাহ্য হবে না কখনোই। তবে যুক্তিশীল কল্পনা অবারিত করলে তা অনুমান করা মোটেও দুঃসাধ্য হবে না বলে বিশ্বাস। এই অনুমান যথাযথ করার নিমিত্তে ভারতীয় দর্শনের প্রাথমিক পরিচিতি ও কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য জেনে রাখা আবশ্যক।

(চলবে…)

[*] [পরের পর্ব: ভারতীয় দর্শন-সূত্র]