প্রিয়,ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
-ইরতিশাদ আহমদ

“ইয়োর অনার, আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলা আমার কথাগুলোকে একটা শ্রেণির প্রতিনিধির আরেকটা শ্রেণির প্রতিনিধিকে বলা কথা হিসেবে ধরে নিতে পারেন”।
-শিকাগো এইট-এর অন্যতম, মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত অগাস্ট স্পিজ, বিচারের সময় আদালতে।

শ্রমিকের রক্তে ভেজা মে দিবস আজ। আঠারোশো ছিয়াশি সালে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের ‘হে মার্কেটে’ আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপরে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় অগুনতি শ্রমিককে। দিনে আটঘণ্টার বেশি কাজ নয়, এই দাবী আদায়ের জন্য ছিল তাঁদের আন্দোলন।

এর আগে এমন কি, দিনে ষোলঘন্টা, সপ্তাহের সাতদিনই কাজ করেছে তাঁরা। দূর্বিষহ জীবনে বলি দিয়েছে সুখের আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু না, এমন জীবন তো মেনে নেয়া যায় না। মেনে নেয় নি তারা। ধীরে ধীরে হয়েছে সঙ্গবদ্ধ। সংগঠিত হয়েছে ইউনিয়নে।

আঠারোশো চুরাশির অক্টোবরে ‘ফেডারেশন অফ অর্গানাইজড ট্রেডস এ্যান্ড লেবর ইউনিয়নস অফ দ্য ইউনাইটেড স্টেটস এ্যান্ড কানাডা’ ঘোষণা দেয়, “…আঠারোশো ছিয়াশির মে মাসের এক তারিখ থেকে আইনসম্মত শ্রমদিন (লিগ্যাল ডে’স লেবর) আট ঘন্টা নির্ধারিত হলো, এবং আমরা শ্রমিক সংগঠনগুলোকে এই মর্মে সুপারিশ করছি যে, তারা যেন প্রস্তাবিত সময়ের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করে”।

আঠারোশো ছিয়াশির মে’র পয়লা তারিখে শ্রমিকেরা আট ঘণ্টা শ্রমদিবসের দাবীতে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট ডাকে। সারা দেশে সাড়ে তিনলাখেরও বেশি শ্রমিক এই ধর্মঘটে অংশ নেয়। মিছিলে যোগ দেয় হাজার হাজার শ্রমিক। চলমান ধর্মঘটের তৃতীয়দিনে আমেরিকার শ্রমিক আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি শিকাগোর হে’ মার্কেটে নিরস্ত্র শ্রমিকদের ওপরে গুলি চালায় পুলিশ। মারা যায় ছয়জন, আহত হয় অগুণতি। সরকার আর পুলিশের বর্বরতার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে মানুষ। পরের দিন প্রতিবাদসভা আর বিক্ষোভের আয়োজন করা হয় দেশব্যাপী।

চৌঠা মে, হে’মার্কেট স্কোয়ারে জমায়েত হয় কয়েক হাজার শ্রমিক জনতা, পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। সেদিনের বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় শেষ বক্তাটি যখন তাঁর কথা প্রায় শেষ করে এনেছেন, মাত্র শ’দুয়েক নিবেদিতপ্রাণ শ্রমিকশ্রোতা তখনো উপস্থিত। এমন সময় একশত আশি জনের এক সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী তাদের কাছে মার্চ করে এগিয়ে আসে এবং তক্ষুনি সরে যেতে নির্দেশ দেয়। এমন সময় হঠাৎ পুলিশ বাহিনীর মাঝখানে একটা বোমা বিস্ফোরিত হয়, মারা যায় সাতজন। কার ষড়যন্ত্র ছিল এটি আজো আবিষ্কৃত হয় নি। বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ না করে, খ্যাপা জানোয়ারের মতো, পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায় নিরস্ত্র শ্রমিকদের লক্ষ্য করে। পুলিশের গুলিতে কতজন শ্রমিক মারা গিয়েছিলেন সেদিন, আর কতজন যে আহত হয়েছিলেন আজো কেউ জানে না।

আটজনকে রায়ট বাধানোর এবং পুলিশ হত্যার অপরাধে গ্রেফতার করা হ্য়। পরবর্তী কয়কেদিন পুলিশ নযীরবিহীন নির্যাতন চালায় নির্দোষ শ্রমিকদের ওপর। অভিযুক্ত আটজনের মধ্যে মাত্র একজন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন, যিনি ছিলেন সেদিনের সমাবেশের শেষ বক্তা (স্যামুয়েল ফিল্ডেন)। তাঁর বক্তৃতার সময়েই বোমাটি বিস্ফোরিত হয়। কারো বিরুদ্ধেই বোমা নিক্ষেপের অভিযোগ প্রমাণিত হয় নি। কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই সাজানো প্রহসনমূলক বিচারে আটজনই দোষী সাব্যস্ত হন। চার জন – আলবার্ট পারসন্স, অগাস্ট স্পিজ, জর্জ এঙ্গেল আর এডলফ ফিশার-কে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় আঠারোশো সাতাশি সালে । লুইস লিন্গ কারাগারে আত্নহত্যা করেন। বাকী তিনজনকে (মাইকেল শোয়াব, স্যামুয়েল ফিল্ডেন, অস্কার নীবে) শ্রমিকদের তীব্র আন্দোলনের মুখে মুক্তি দেয়া হয়, আঠারোশো তিরানব্বই সালে।

হে মার্কেটের ঘটনাবলীর নায়করা পরবর্তীতে পরিচিতি পান ‘শিকাগো এইট’ নামে।

ঠিক কি কারণে মে’র পয়লা তারিখটাকে বেছে নেয় হয়েছিল দৈনিক আট ঘণ্টা শ্রমসময়ের দাবী কার্যকর করার জন্য তা জানা যায় না। তবে আঠারোশো ঊননব্বইয়ের চৌদ্দই জুলাই (বাস্তিল দিবসের শততম বার্ষিকীতে) কম্যুনিস্টদের সংগঠন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক (সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল) তাদের প্যারিসে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে প্রতিবছর মে’র প্রথম দিনটাকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস (ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কার্স ডে) হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ঘোষণায় বলা হয়,

“কংগ্রেসএকটা বিরাট আন্তর্জাতিক বিক্ষোভানুষ্ঠান সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যাতে বিশ্বের দেশে দেশে প্রতিটি শহরে একটি নির্দিষ্ট দিনে মেহনতি জনগণ সরকারী কর্তৃপক্ষের কাছে আইনসম্মত শ্রমদিবসকে আটঘন্টায় নামিয়ে আনার দাবী জানাবে, এবং একই সাথে প্যারিস কংগ্রেসে নেয়া ইন্টারন্যাশনালের অন্যান্য সিদ্ধান্তাবলীও কার্যকরী করবে। যেহেতু আঠারোশো নব্বইয়ের পয়লা মে আমেরিকান ফেডারেশন অফ লেবর তাদের ডিসেম্বর, আঠারোশো অষ্টাশিতে অনুষ্ঠিত সেইন্ট লুই কনভেনশনে এই ধরনের বিক্ষোভানুষ্ঠান সংগঠনের সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যেই নিয়ে ফেলেছে, আমরাও এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক বিক্ষোভানুষ্ঠানের জন্য যথাযোগ্য বলে গ্রহণ করেছি। বিশ্বের দেশে দেশে শ্রমিকরা নিজ নিজ দেশের বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে অবশ্যই এই ধরনের বিক্ষোভানুষ্ঠান সংগঠিত করবেন”।

সেই থেকে মে’র প্রথম দিন পালিত হয়ে আসছে বিশ্বের দেশে দেশে (যুক্তরাষ্ট্র আর কানাডা বাদে) আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে।

আজকের এই বিশেষ দিনে মুক্তমনার পাঠকদের উপহার দিতে চাই আমার অত্যন্ত প্রিয় একটা কবিতা, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘মে-দিনের কবিতা’ আর একটা গান, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘জন হেনরী’।

মে দিবস দীর্ঘজীবি হোক। সবাইকে মে দিবসের শুভেচ্ছা।

মে-দিনের কবিতা

সুভাষ মুখোপাধ্যায়

প্রিয়,ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য
কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।
চিমনির মুখে শোনো সাইরেন-শঙ্খ,
গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে,
তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য
জীবনকে চায় ভালবাসতে।
প্রণয়ের যৌতুক দাও প্রতিবন্ধে,
মারণের পণ নখদন্তে;
বন্ধন ঘুচে যাবে জাগবার ছন্দে,
উজ্জ্বল দিন দিক্‌-অন্তে।
শতাব্দীলাঞ্ছিত আর্তের কান্না
প্রতি নিঃশ্বাসে আনে লজ্জা;
মৃত্যুর ভয়ে ভীরু বসে থাকা, আর না –
পরো পরো যুদ্ধের সজ্জা।
প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা,
দুর্যোগে পথ হয় হোক দুর্বোধ্য
চিনে নেবে যৌবন-আত্মা।।

জন হেনরী
গান – হেমাঙ্গ বিশ্বাস

জন হেনরী, জন হেনরী-
নাম তার ছিল জন হেনরী
ছিল যেন জীবন্ত ইঞ্জিন
হাতুড়ির তালে তালে গান গেয়ে শিল্পী
খুশী মনে কাজ করে রাত-দিন
হো হো হো হো- খুশী মনে কাজ করে রাত-দিন।।

কালো পাথরে খোদাই জন হেনরী
কালো পাথরে খোদাই জন হেনরী
গ্রানাইট পেশী গড়া ঝলমল
হাতুড়ির ঘায়ে ঘায়ে পাথরে আগুন ধরে
হাতুড়ি চালানো তার সম্বল
হো হো হো হো – হাতুড়ি চালানো তার সম্বল।।

পশ্চিম ভার্জিনিয়ার রেলে সুরঙ্গে
পশ্চিম ভার্জিনিয়ার রেল সুরঙ্গে
পাথুরে পাহাড় কেটে কেটে
রেল লাইন পাতা হবে হেনরীর হাতুড়ির –
ঘায়ে ঘায়ে রাত যায় কেটে
হো হো হো হো – ঘায়ে ঘায়ে রাত যায় কেটে।।

জন হেনরীর চির প্রিয় সঙ্গিনী
নাম তার মেরি ম্যাক ডেলিন
সুরঙ্গের কাছে যেত কান পেতে শুনত
হেনরীর হাতুড়ির বিন
হো হো হো হো- হেনরীর হাতুড়ির বিন।।

সাদা সর্দার কাজ চায় আরো
সাদা সর্দার কাজ চায় আরো
স্টীম ড্রিল করে আমদানী
আশংকা হেনরীর মেশিনের কাছে বুঝি
পেশী নিবে পরাজয় মানি
হো হো হো হো- পেশী নিবে পরাজয় মানি।।

আমি মেশিনের হবো প্রতিদ্বন্দ্বী
আমি মেশিনের হবো প্রতিদ্বন্দ্বী
জন হেনরী বলে বুক ঠুকে
স্টীম ড্রিলের সাথে চলে হাতুড়ির পাল্লা
কে আর বলো তারে রোখে
হো হো হো হো- কে আর বলো তারে রোখে।।

সাদা সর্দার বলে হেসে হেসে
সাদা সর্দার বলে হেসে হেসে
কালো নিগারের দেখো দুঃসাহস
তোর যদি জয় হয়, হবে না সূর্যোদয়
দুনিয়াটা হবে তোর বশ
হো হো হো হো- দুনিয়াটা হবে তোর বশ।।

জন হেনরীর হাতুড়ির ঝলকে
জন হেনরীর হাতুড়ির ঝলকে
চমকায় বিজলীর গতি
মানুষের সৃষ্টি দুরন্ত স্টীম ড্রিল
মানুষের কাছে মানে নতি
হো হো হো হো- মানুষের কাছে মানে নতি।।

অগ্নিগিরি হলো রুদ্ধ
থেমে গেল হাতুড়ির শব্দ
হেনরীর জয়গান চারিদিকে উঠে জমে
হৃদপিন্ড তার স্তব্ধ
হায় হায় হায় হায়- হৃদপিন্ড তার স্তব্ধ।।

জন হেনরীর কচি ফুল মেয়েটি
জন হেনরীর কচি ফুল মেয়েটি
পাথরের বুকে যেন ঝরনা
মার কোল থেকে সে পথ চেয়ে আছে তার
বাবা তার আসবে না আর না
হায় হায় হায় হায়- বাবা তার আসবে না আর না।।

পাখির কাকলি ভরা ভোরে
পুবালী আকাশ যবে রঙ্গীন
পাখির কাকলি ভরা ভোরে
পুবালী আকাশ যবে রঙ্গীন
হেনরীর বীর গাঁথা বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে
সিটি দিয়ে চলে যায় ইঞ্জিন
হো হো হো হো – সিটি দিয়ে চলে যায় ইঞ্জিন।।

প্রতি মে দিবসের গানে গানে
নীল আকাশের তলে দূর
শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ
হেনরীর হাতুড়ির সুর
হো হো হো হো- হেনরীর হাতুড়ির সুর।।
জন হেনরী, জন হেনরী-
নাম তার ছিল জন হেনরী
ছিল যেন জীবন্ত ইঞ্জিন

হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানটি ডাউনলোড করতে চাইলে –

http://www.esnips.com/doc/d8ac916a-3bc6-44b4-a470-72bde8bf8246/john-henry

তথ্যসূত্রঃ

http://www.salon.com/2012/04/30/may_days_radical_history/singleton/
http://www.marxists.org/subject/mayday/articles/speeches.html
Weinberger, Jeff., May Day: “May we?” or Mayhem, One Struggle, V. 1, Ed. 1, 2012