লিখেছেন: শেখ বাতেন

অনেক দিন আগে বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, সভ্য সমাজ থেকে গণিকাবৃত্তি দূর করতে হলে ভদ্রঘরের মেয়েদের কিছুটা গণিকার দায়িত্ব নিতে হবে। মানুষের বহুগামী স্বভাব ও নারী-পুরুষ সম্পর্কের বিদ্যমান অধঃপতনের মধ্যে কিছুটা সংস্কার আনার উদ্দেশ্যে হয়তো তিনি সেটা বলেছিলেন। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। সম্প্রতি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা-এর রিপোর্ট বলছে, গণিকারা আর আগের মতো নিষিদ্ধ লালবাতি এলাকায় সীমাবব্ধ নেই, আধুনিক শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এরা মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা নারী যারা অন্তরালে থেকে যৌনকর্মীর চাহিদা পূরণ করছে। পুঁজির বিশ্বায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত আবহমান গণিকায়নের এরা আধুনিক রূপ। এদের সম্পর্কে অনেক রকমের আলোচনা হতে পারে, হয়ে থাকে। তবে আমরা এদেরকে এখানে দুর্নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত করে আলোকপাত করবো।
দুর্নীতির সবচে সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা হলো ‘এবিউজ অব পাবলিক পাওয়ার ফর প্রাইভেট গেইন’। অর্থাৎ ব্যক্তিগত

প্রাপ্তির জন্যে রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক ক্ষমতার অপব্যবহার। এই প্রাপ্তিটা কী? এটা হতে পারে টাকা, চাকরি দেয়া, বিদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থা করা, এবং হতে পারে ফুর্তির জন্যে অভিজাত যৌনকর্মীর যোগান দেয়া। অনেক আগে স্টানলি কোচানেক ঢাকায় ঘুষ-দুর্নীতির আইটেম হিসাবে এই বনেদি যৌনকর্মীদের সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন এভাবে—

Pay off benefit includes money, job, luxury girls, building supplies, overseas travels, payment of foreign tution bills, overseas hotels, restaurent bills, and personal liabilities.. Some top busunessmen, noted one study, also maintained rest houses and high class exclusive hostesses to entertain important foreign guests and big bosses.

গুনার মিরডাল, স্টানলি কোচানেক, কামাল সিদ্দীকিসহ অনেকেই বাংলাদেশে দুর্নীতির আলোচনায় অভিজাত পতিতার উল্লেখ করেছেন। এদের সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার অসুবিধা আছে। এরা নিজের সম্পর্কে বলে না, লিখে না, সাক্ষাৎকার দিতে চায় না। উঁচুতলার মানুষের উপভোগের সঙ্গে জড়িত বলে গবেষণার আওতায় আনা সহজ হয় না। এদের কোনো সুনির্দিষ্ট নাম নেই। লাক্সারি গার্ল, হটসেট, কমফোর্ট ওমান, সোসাইটি গার্ল—এমন অনেক নাম। মূলত এরা হোয়াইট কালার প্রস্টিটিউট। যে কোনো অফিসে, হোটেলের লবিতে, গেস্টহাউজে এরা মানিয়ে যায়, কারো ফ্ল্যাটে এসেও হাজির হতে পারে, অথবা নির্দিষ্ট সময়ে কোনো নির্দিষ্ট বাসায়। কোচানেক ঢাকায় এদের উল্লেখ করেছিলেন, বিশ বছর আগে। কিন্তু গত বিশ বছরের বিশ্বায়নে মুক্ত বাণিজ্যের বদৌলতে সারা দুনিয়ায় দুর্নীতি, দারিদ্রায়ন ও নারীর পণ্যায়ন ঘটেছে দ্রুত গতিতে। তার ঢেউ, অন্যান্য রাজধানী শহরের মতো, ঢাকায় এসে আঘাত করেছে ।

সম্প্রতি কোলকাতার কাজল ভট্টাচার্য ভারতের ও দক্ষিণ এশিয়ার শহরগুলিতে অভিজাত পণ্য নারীদের ক্রমবর্ধমান কর্মতৎপরতা নিয়ে যে আলোচনা করেছেন তাতে যথেষ্ট সমাজতাত্ত্বিক উপাদান রয়েছে। গোড়া থেকে টানতে গেলে বলতে হয়, মোগল আমলে রাজা-বাদশারা হেরেম ও পতিতার মধ্যখানে বনেদী ঘরের একশ্রেণীর নারীর যৌনতা ভোগ করতেন। অনুচর পাঠিয়ে তাদের ডেকে আনা হতো গান শুনতে, নাচ দেখতে, কিংবা খুনসুটি করতে। কিন্তু প্রায় সর্বক্ষেত্রেই সম্পর্ক গড়াত দেহসম্ভোগে। বনিকতন্ত্রের আগমনে হেরেমের বাণিজ্যিকীকরণ হয়। টেলিফোন আবিষ্কারের পর আর লোক পাঠিয়ে ডেকে আনার দরকার হয় না। ফোনকল করেই এদের যোগাযোগ পাওয়া যায়। সেই থেকে এরা কলগার্ল। তবে মধ্যস্ততা করার জন্যে দালাল দরকার হতো। প্রযুক্তির বিকাশে এখন সে ঝামেলাও নেই। বর্তমানে নানান এসকোর্ট সার্ভিস দালালের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজন হচ্ছে না। যোগাযোগ হচ্ছে সরাসরি।

বাংলাদেশেও এদের অনেকের শেকড় ভদ্র ঘরে, সাধারণত নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর হয়ে থাকে। মধ্যস্তরের শিক্ষিতা, পোশাকে ও চলনে রুচির পরিচয় থাকে। বিনোদন-সংস্কৃতি, মডেলিং, সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার সঙ্গে এরা সম্পর্কিত থাকতে পারে এবং সেখানকার স্বতঃস্ফূর্ত গতিবিধির সুযোগটা গ্রহণ করে। সেখানে পেশাগত নিয়মে এদের নীতিচরিত্র ভাঙার প্রাথমিক কাজটি সম্পন্ন হয়। জানা যায়, রাতারাতি ও সহজ পথে আয়ের জন্যে, গ্লামারের জগতে ঠাই পাবার জন্যে প্রতিমাসে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রাঙ্গণ থেকে প্রায় শ’দুয়েক নারী রাজধানীতে আসে বিনোদনের পেশায় প্রতিষ্ঠা পাবার জন্যে। প্রায় সমসংক্যক ব্যর্থ হয়। এরা সব খুইয়ে আবার প্রায়শ শেকড়ে আর ফিরে যেহে পারে না। শহরে টিকে থাকে অন্যভাবে।

এরা খণ্ডকালীন। পরিচয় দেবার মতো প্রায়শ এদের অন্য পেশাগত পরিচয় থাকে। যা দিয়ে এরা যৌন বেসাতি আড়াল করে। এরা গৃহবধূ, স্বামী পরিত্যাক্ত, এমনকি হতে পারে কারো একনিষ্ঠ প্রেমিকা। কিন্তু যুগের কনজিউমারইজমে প্রলুব্ধ পোশাক, প্রসাধনসামগ্রী, লেখাপড়ার খরচ, বাসাভাড়ার জন্যে বাড়তি আয় হিসাবে এরা দেহ ও সৌন্দর্যকে অর্থের সঙ্গে বিনিময় করে। এদের কিছু বিশ্বস্ত বন্ধু থাকে যারা তাদের ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। বন্ধুর বন্ধু, তারও বন্ধু এভাবেও সম্পর্ক তৈরিতে সাহায্য করে। এ বন্ধুত্বের আড়ালে মূলত লেনদেনের সম্পর্ক থাকে। আজকাল অল্পবয়সী বাংলাদেশী মেয়েরা এতে জড়িত হয়ে পড়েছে। অনেকের পরিবার সেটা জানে, বা আন্দাজ করতে পারে, তাদের কিছু করার থাকে না, আবার ক্ষেত্র বিশেষে সহাযোগিতাও করে।

বাংলাদেশের প্রগতিশীল নারীরা যখন বৃত্তভাঙ্গার জন্যে সংগ্রাম করছে, গ্রামের বস্ত্রবালিকারা যখন শহরে জীবিকার জন্যে কঠোর পরিশ্রম করছে, তখন এই শহরভিত্তিক নেটবালা-ফোনবালারা এক বা একাধিক ফোন নিয়ে সেজেগুজে ভিন্নতর উদ্দেশ্যে শহরে ঘুরপাক খাচ্ছে। অধঃপতিত দেশে তাড়াতাড়ি ওপরে ওঠার জন্যে তরুণেরা বিক্রি করছে পেশীশক্তি, তাদের নারী কাউন্টারপার্টরা বিক্রি করছে তরল প্রেম। এতে সহায়তা করছে আন্তর্জাতিক মানের প্রযুক্তি। এরা আজকাল ওয়েবসাইট, ইন্টারনেট, সার্বক্ষণিক মোবাইল ব্যবহার করছে যা অভূতপূর্ব সুযোগ দিয়েছে। এতে লম্পট পুরুষ ও নষ্ট নারীর যোগাযোগ দ্রুত ও নিরাপদ হয়েছে। যার ফলে আইন ও ইজ্জত বাঁচিয়ে বেইজ্জতি কাজের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের কোনো সামাজিক কর্তৃপক্ষেরই বাধা হতে পারছে না, এখন পর্যন্ত। কিছু কিছু বাংলাদেশ পর্ণ সাইট, এডাল্ট এন্টারটেনমেন্ট, এসকর্ট সার্ভিস বাঙালি নারীকে দ্রুত পণ্যায়িক করছে পুঁজির খোলা বাজারে। আপত্তিকর ভাসায় ঢাকার মহিলা হোস্টেল, শিলাঙনের মডেল এমনকি স্কুলগার্লও পাওয়া যায় বলে বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে। ফেসবুকে ‘ঢাকা কলগার্ল অ্যান্ড বয়েজ’ নামে পণ্যনারীরা যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করছে— নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, আশা বিশ্ববিদ্যালয়, ড্যাফোডিল, ইডেন, ঢাবি ইত্যাদি—যা দুর্ভাগ্যজনক। এই যৌন পরিষেবা চালিয়ে যাবার জন্যে কতক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতার হাত রয়েছে। যেমন যৌন সেবামানের নির্ভরযোগ্যতার প্রমাণ করতে বাংলাদেশে এসকর্ট সার্ভিসের এক নারীদেহ ক্রেতার সনদ তাদের ওয়েবসাইটে উপস্থাপন করেছে এভাবে—আমি সেক্সিএসকটার্ডস-এর সাথে যোগাযোগ করলাম। এরা আমাকে একটা ফোন নম্বর দিল। কিছু আকর্ষণীয় মেয়ের ছবি পাঠাল। আমি রেডিসন হোটেলে উঠে ওই নাম্বারে কল করলাম। ….আফ্রিন জানালো, সে মডেলিং করে। চমৎকার দেহ… (সম্ভোগের বর্ণনা)। শুধু এইসব মেয়েদেরকে বলতে যেনো তাদের ফোনটা বন্ধ রাখে। কারণ সেটা অনবরত রাজতে থাকে। এ ছাড়া অভিজ্ঞতা চমৎকার।

এসবকে এক সময় বানানো গল্প বলে মনে করা সম্ভব হতো। কিন্তু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এই রিপোর্ট দিয়েছে যে—বাংলাদেশে লালবাতিকেন্দ্রিক নিষিদ্ধ এলাকায় দেহব্যবসা দ্রুত শেষ হয়ে এসেছে। তার স্থান নিয়েছে নতুন এলাকা। এর মধ্যে রয়েছে ছাত্রীনিবাস। বাংলাদেশে আড়ালে থেকে দেহব্যবসায়ী নারীর সংখ্যা দশ হাজার।

কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লা কবিতায় এরকম আছে—বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে কিন্তু ভদ্র ঘরের প্রেমিকাকে আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না—ইত্যাদি। বাংলাদেশী পুরুষের নারী-দৃষ্টিভঙ্গি কোন পর্যায়ের সম্মানবোধ প্রতিফলিত করে? গত কয়েক বছরে শ’খানেক বাংলাদেশী কবির নারী উপলব্ধির প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেছি। তাদের মধ্যে এমন খুব কমই আছেন যারা প্রিয় নারীর জন্যে জমিন ও আসমানের মাঝখানের সবচেয়ে চমৎকার স্থানটি বরাদ্দ করতে কার্পণ্য করেছেন—উপমায়, কবিতায়। পরক্ষণে, তাদের মধ্যে এমন খুব কমই পাওয়া যাবে যারা সেই একই নারীকে অতঃপর পতিতার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেননি। একি শুধুই কবির অসুস্থ খেয়াল, ভারসাম্যহীনতা। এর কি সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি আছে? আমরা জানি, অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের গদ্যে আরো সরাসরি বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে। যখন তিনি বলেন, শহরের সবচে রূপসী মেয়েটি হয়ে ওঠেছে রক্ষিতা। পতিতারাই প্রসিদ্ধ এখন। এখানে যুবক ভোগে যৌনক্ষুধায়, বাতিল বুড়োরা করে উপভোগ। মডেল ও বিনোদনকর্মীদের উৎস ও সম্পর্ক নিয়ে তার তির্যক পর্যবেক্ষণ রয়েছে, যা নিয়ে আপত্তি করা হয়। তবে পাশের দেশের গবেষকের পর্যবেক্ষণে এই অধঃপতনের প্রতিফলন রয়েছে : মডেলরা কিসের জন্যে কোন পণ্যের শুটিং অনেক সময় জানতে পারে না। জানতে চায়ও না। কারণ লাইনে অনেক প্রতিযোগী। সুতরাং প্রোগ্রাম পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তবে কর্তৃপক্ষ প্রায়শ ঠকায় না। ‘প্রোগ্রামের’ পর একটা খাম ধরিয়ে দেয়। পরে সেটাই হয়ে যায় আসল কাজ।

অস্বীকার করার উপায় নেই—নারীর যে-দেহসৌন্দর্য ও আকর্ষণী ক্ষমতা দেশপ্রেম, সমাজ পরিবর্তনের মহতী উদ্যোগ ও তারুণ্যের অনুপ্রেরণা হতে পারত তা-ই পণ্যমূলে ধারণ করতে চলে আসছে বাজারে। বেচাকেনা হচ্চে জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। যৌনতা তারুণ্যের অধিকার, অথচ আকর্ষণীয় যুবক প্রেমিক পুরুষের বদলে লক্ষণীয়ভাবে অগ্রাধিকার পাচ্ছে বয়স্ক লম্পট পুরুষ, উঁচু পদবির আমলা, বস, ডিরেক্টর, ডিজি, বিনোদন জগতের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের লম্পট ও হাইপ্রোফাইল রাজনীতির লোকেরা। বাংলাদেশের গ্রামীন সাংস্কৃতিক ঐহিত্য সংরক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক প্রতিষ্ঠানের আমলা তার এক ঘণ্টার কবিতা আবৃত্তির একটি ক্যাসেটে দশটি নারী-মডেল ব্যবহার করেছেন। সরকারি প্রকল্পে কিংবা সাংস্কৃতিক-সামাজিক অনুষ্ঠানে স্খলিত চরিত্রাদের অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। সাংস্কৃতিক কর্মী, মডেল, কবি ইত্যাদি পরিচয়ের সূত্রে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাহচর্যে কোনো অনুষ্ঠানে লক্ষনীয়ভাবে এমন কাউকে উপস্তাপন করাচ্ছেন যা অন্যান্যদের জন্যে বিব্রতকর। সর্বত্রই সংযোগ এমন প্রকাশ্যে হয় না বটে তবে সর্বক্ষেত্রেই এসবের একটা আর্থিক দিক রয়েছে। করাপশনের সংজ্ঞায় না ফেলে এর ব্যাখ্যাা হয় না। অর্থাৎ মিস ইউজ অব পাবলিক পাওয়ার ফর প্রাইভেট গেইন। বস্তুত লালসার সামগ্রী ক্রয় করার সামর্থ্য অর্জন করেছে একটি শ্রেণী যারা এখন যৌনপল্লীতে যেতে চায় না কিন্তু সম্ভোগের জন্যে চায় বৈচিত্র্যময় হোমলি পরিবেশ। এই বাস্তবতায় ঘরের বউ আর পেশাদার যৌনকর্মীর মাঝখানে সামাজিক চাহিদা তৈরি হয়েছে হাফ-গেরস্ত নগরনটির। যারা দুর্নীতি-সফল দুশ্চরিত্র বাঙালির ভোগের আইটেম হিসাবে দ্রুত বেহেস্তের সন্ধান পেতে নরকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। নষ্ট পুরুষের মতো এরাও গণিকার প্রাপ্তি ও সতীর সম্মান দুটিই রক্ষা করার চেষ্টা করে। এরা কখনোই স্বীকার করে না যে যৌনতাবিক্রি করছে, যা যৌন পেশার অন্যান্যদের থেকে এদের আলাদা করে। যে আব্র“র আড়ালই ব্যবহার করুক এরা গণিকা। কারণ, সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞায় এরা যৌনতাকে বিনিময় করছে অর্থের সঙ্গে বা এমন প্রাপ্তির সঙ্গে যার তাৎক্ষণিক অর্থমূল্য রয়েছে।

বিগত দুই দশকে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মিয়ানমার, রাশিয়া, ইউক্রেনসহ সর্বত্র এর বিশ্বঅর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অভিজাত পতিতারা বিকশিত হয়েছে ব্যাপক সংখ্যায়। এমনকি বিয়ের বিকল্প হিসেবে এদের উপযোগিতা, এদের খরচ যে কম পড়ে—ওয়েবসাইটে অংক করেও দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে। ইসলামি পাকিস্তানের মোল্লারা যৌনপল্লীকে আগুন ধরিয়ে উচ্ছেদ করেছে বটে অন্তরালবাসীনীর যৌনব্যবসা ব্যাপকতা বেড়েই চলছে শহরগুলিতে যা উচ্ছেদের ক্ষমতা তাদের নেই। ভারতে অন্তরালের যৌনব্যবসা ব্যাপক। তবে সেখানে এই নিয়ে গবেষণাও হয়। কথা হয়, পার্লামেন্টের আলোচনায়ও উঠে। আর বাংলাদেশে-এর ব্যাপকতা লক্ষণীয় কিন্তু গবেষণা-আলোচনা সীমিত। খুন-খারাবি বা অন্য ঘটনার খোঁচাখুঁচিতে মাঝে-মধ্যে পুলিশি তথ্য পত্রিকার মুখরোচক বয়ান হিসাবে বেরিয়ে আসে। তারপর দ্রুত আবার সুদৃঢ় পর্দার অন্তরালে। বড় রকমের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক গণআন্দেলন না হলে আগামী দশ বছরে এদেশে নারী-পুরুষের পণ্য সম্পর্ক আরো ভয়ংকর হয়ে ভেসে ওঠবে বলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়।

দুর্নীতির বিশ্লেষকরা বলেন, দুর্নীতির দুটো পক্ষ। এক পক্ষ সুবিধাভোগী, অন্য পক্ষ এর শিকার। তবে লক্ষণীয় ব্যপার হলো, সাধারণ পতিতারা তাদের দুর্ভোগের জন্যে কাউকে না কাউকে দায়ী করে কথা কয় বটে; কিন্তু এদের এলিট ভগ্নিরা তা করে না। তারা বন্ধু বা ক্লায়েন্টদের দ্বারা নির্যাতিত মনে করে না। বরং এদেরকে মনে করে বান্ধব, সহায়তাকারী ও পরিপূরক। দুই পক্ষই যদি জেতে তাহলে ঠকছেটা কে? এক কবির লেখায় এর জবাব দেয়া সুবিধাজনক হতে পারে, এভাবে—

ছেলেরা ভাবে প্রেমিক হয়ে/কি’ই না ঠকাচ্ছি মেয়েদের।/
সামান্য থ্রি পিছের দামে/শুষে নিচ্ছি ডালিম জলপাই/মোহনার রস।
মেয়েরা ভাবে বান্ধবী কিংবা/প্রেমিকার নিখুত অভিনয়ে/কিভাইে না শুষে নিচ্ছি/
মানিব্যাগ এবং শৌর্যের নির্যাস।/
ছেলে ভাবে, হারছে মেয়ে/ মেয়ে ভাবে, হারছে ছেলে/…
এভাবে ভাঙছে সব। এগুচ্ছে সবাই।
[জাহিদ কামাল/ মানুষ এক সীমাহীন সীমাবদ্ধ পাখী।]

এই ভাঙন কি অপরিহার্য বাঁচার লড়াই না খেলারামের খেলা? এ কি অর্থকষ্ট না জীবন ভোগের এক্সপেরিমেন্ট? এর উত্তর দীর্ঘ বিতর্ক উস্কে দিতে পারে, আমরা সেখানে প্রবেশ করতে চাই না। বরং এই ভুক্তভোগী নারীদের জীবন পর্যবেক্ষণ করে যে সত্য জেনারেলাইজ করা যায় তা হলো—দেহটাকে পণ্যের মতো ঝকঝক করে সাজিয়ে রাখা, অনরবত মিথ্যার আশ্রয়, পরিচয়ের লুকোচুরি, সামান্য ধূসর এলাকা ডিঙিয়ে পরিবার থেকে যৌনতার বাজারে, বাজার থেকে ঘরে এই আসা-যাওয়া—মুখে যাই বলুক, এদের ভেতরে কষ্ট, নিঃসঙ্গতা, অসঙ্গতি, ইন্সমনিয়া, ভারসাম্যহীনতা, সর্বোপরি অন্যের দ্বারা ব্যবহৃত হয়ে হয়ে নিজের জীবন সম্পর্কে নিজের ধারণা এমন তলানিতে গিয়ে পৌঁছায় যে, একটা সময় এদের প্রায় সবাই আবিষ্কার করে—এ জীবন তার নিজের নয়, অন্যের সামগ্রী।

প্রায় আশি বছর আগে কলকাতার অভিজাত পতিতার মানদা দেবীর ‘শিক্ষিত পতিতার আত্মচরিত’-এ উল্লেখ আছে—উকিল বুদ্ধি বিক্রি করে, পণ্ডিত বিদ্যা বিক্রি করে। এমনকি দীক্ষাগুরুও মন্ত্র বিক্রি করে। তবে রূপবতী কেন দেহ বিক্রি করবে না। তার একশো বছর আগে, মহামতি এঙ্গেলস-এর চেয়ে পবিত্র কিছু আমাদের শোনাতে পারেননি। কঠিন ভাষায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিনিও বলেছেন—কে মানছে মনোগেমি, কোথায় বিবাহের আদর্শ লঙ্ঘিত নয়; নীতিহীনতা, লাম্পট্য, প্রাপ্তির শর্তে দেহদান—এ যুগের ব্যতিক্রম নয়, বৈশিষ্ট্য। তবে তিনি আমাদের আশা দিতে চেয়েছেন, যদি বদলে দেয়া যায় বিদ্যমান বণিকতন্ত্র, উৎপাদন সম্পর্ক, তখনই শুধু ভালোবেসে পুরুষ হাত ধরতে পারবে কোনো এক প্রিয় নারীর। তখন নারী ও পুরুষের মধ্যিখানে আকর্ষণ ছাড়া অন্য উদ্দেশ্য থাকবে না।

কিন্তু তার আগে কী হবে? পুঁজিবাদের দীর্ঘ ইতিহাস বলে—নদীর নাব্যতা, বায়ুমণ্ডলের স্বচ্ছতা, প্রকৃতি-পরিবেশের নির্মল চরিত্র, নারীর নিভৃত প্রাঙ্গণ ক্রমেই দূষিত হচ্ছে পণ্য সম্পর্কের আওতায়। প্রযুক্তির কারণে গত বিশ বছরে তা দ্রুত সম্প্র্রসারিত হয়ে প্রায় বিনা বাধায় প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। পরিবেশ রক্ষার জন্যে না-হোক, সমাজ বিপ্লবের জন্যে না-হোক, শুধুমাত্র প্রিয় নারীর ভালোবাসার যথার্থ সম্পর্কের জন্যে হলেও বিদ্যমান লম্পট পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করা ঐতিহাসিক কর্তব্য হিসাবে জরুরি হয়ে আছে। অন্য কোনো মহান নৈতিক বাণী দিয়ে উপসংহার টানা হলে তা হবে অর্থহীন, মোনাফেকি।

তথ্যনির্দেশ
স্ট্যানলি কোচানেক, ১৯৯৩, প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট পলিটিক্স এন্ড বিজনেস ইন বাংলাদেশ, ইউপিএল, ঢাকা
কামাল সিদ্দীকি, ১৯৯০, দি সোসাল ফর্মেশন ইন ঢাকা সিটি, ইউপিএল, ঢাকা
কাজল ভট্টাচার্য, ২০১০, কলগার্লের দুনিয়া, গাঙচিল, কলকাতা
মানদা দেবী, ২০০৪, শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত, চিরায়ত প্রকাশন, কলকাতা
ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস, পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি
জাহিদ কামাল, ২০১১, মানুষ এক সীমাহীন সীমাবদ্ধ পাখী, মৃদুল প্রকাশন, ঢাকা
হুমায়ুন আজাদ, ২০০৯, মাতাল তরণী, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা
ফেসবুক, ২০১২, ঢাকা কলগার্ল এন্ড বয়েজ
সেক্সিএসকটার্ডস, এসকর্ট ইন ঢাকা, ক্লায়েন্টের অবস্থান ও মন্তব্য তারিখ: ০৩.০৭.২০০৮
[ http://www.sexyescortads.com/review/7011]
কলগার্ল ইন ঢাকা হোটেলস
[http://www.bengali-information.50webs.com/Bangladesh_Hotel/Call_Girl_In_Dhaka_Hotel.htm]

[লেখক : গবেষণা সহকারি, সমাজবিজ্জান, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্ক, বিংহামটন, নিউ ইয়র্ক]