:: পর্ব ১ :: পর্ব ২ :: পর্ব ৩ :: পর্ব ৪ ::

সামনের সবার অর্ডার দেয়া শেষে ফাস্ট ফুড্‌ দোকানের কাউন্টারের গিয়ে দাঁড়ালাম। লিস্ট দেখে অর্ডার দেয়া শেষ হয়ে গেলে মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো, ডুউয়ান্না হ্যাফসাম ফ্র্যাঁ ফ্রাঁআআসসস্‌?’ ইয়েস, প্লিজ বলে ক্রেডিট কার্ড এগিয়ে দিলাম। বলেই ভাবলাম, মনে হচ্ছে একটু আধটু অ্যামেরিকান হয়ে যাচ্ছি। কারণ, কিছুদিন আগেও এই মেয়েটার মত করে কথা বললে, আমি তার এক বিন্দুও বুঝতে পারতাম না। অ্যামেরিকান হবার মধ্যে আনন্দের কিছু নেই। তবে, অ্যামেরিকানদের কথা বুঝার মধ্যে নিশ্চয়ই আনন্দের কিছু আছে। আমেরিকান নয়, যে কোনো মানুষের কথা বুঝতে পারার মধ্যে আনন্দের ব্যাপার আছে।

ইউএসএ আসার আগে কখনোই বুঝতে পারি নি, অন্য ভাষা বুঝতে না পারার কষ্টটা কি। এখানে সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ স্প্যানিশ। ল্যাটিনোরা বাসের মধ্যে বসে শত শত শব্দের যে স্প্যানিশ ভাষাটা বলে যায়, সেখান থেকে শুধুমাত্র দুইটা শব্দ আমি বুঝতে পারি। একটা হলো এল, আরেকটা হলো লা। স্প্যানিশ যে কোনো কিছুর নাম বলার আগে এল বা লা দুটোর একটা বলতেই হবে। এল বলতে হয় পুরুষ হলে আর লা বলতে হয় স্ত্রী হলে। যেমন, যদি বলতে বলা হয়, ‘চেয়ার’। সেটা বলার আগে ‘চেয়ার’কে পুরুষ বা নারী বানিয়ে নিতে হবে। নতুন করে আসলে বানাতে হবে না, ওরা বানিয়ে রেখেছে। চেয়ার হচ্ছে নারী, আর চেয়ারের স্প্যানিশ হচ্ছে সিলা (silla), অতএব, স্প্যানিশ ভাষায় চেয়ার মানে, লা সিলা। প্রতিটা বাক্যেই যেহেতু কোনো না কোনো কিছুর নাম অর্থাৎ বিশেষ্য (noun) থাকে, তাই স্প্যানিশ ভাষায় কেউ কথা বললে তাকে প্রায় সময় লা বা এল বলতে হবে। অতএব, শত শত শব্দের মাঝে আমার কানে শুধু বাজতে থাকে লা আর এল। অন্য আর কিছু খুব বেশি একটা বুঝার উপায় নেই।

কিন্তু, ফাস্ট ফুডের দোকানে যে মেয়েটি আমাকে বললো, ডুউয়ান্না হ্যাফসাম ফ্র্যাঁ ফ্রাঁআআসসস্?’ সে স্প্যানিশ নয়, অ্যামেরিকান, আফ্রিকান অ্যামেরিকান। ব্ল্যাক বা কালো বললে না-কি রেসিস্ট হয়ে যায়, এজন্য সবাই আফ্রিকান অ্যামেরিকান বলে। শিকাগো শহরে আমি যখন ছিনতাইকারীর হাতে পড়ি, তখন একজন কালো পুলিশ অফিসার এসে আমাকে সব জিজ্ঞেস করছে, তারপর বলছে, সে কেমন, দেখতে কেমন।’ এটা সেটা অনেক কিছু বলার পর সে বুঝতে পারছে আমি বলতে পারছিনা। কারণ, আমার কাছে সবচেয়ে ভালো উত্তর হচ্ছে, সে দেখতে তোমার মত। কিন্তু, সেটাতো আর বলা যাচ্ছে না। আমি শুধু ভাবছিলাম কি করে ভদ্র ভাষায় উত্তরটা দেয়া যেতে পারে। ব্ল্যাক কোনো ভদ্রোচিত শব্দ নয়। তারপর সেই আমাকে বললো, আফ্রিকান অ্যামেরিকান? আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচলাম। এখানকার হোয়াইটদের ইংলিশ মোটামুটি পরিষ্কারভাবেই বুঝতে পারা যায়; কিন্তু, কিছু অ্যাফ্রিকান অ্যামেরিকানের কথা বুঝতে পারার চেষ্টা করার চেয়ে চট্রগ্রাম বন্দরে গিয়ে আদার ব্যাপারী হওয়াও অনেক ভালো। অন্তত জাহাজের খবর রাখা যাবে। কাউন্টারের মেয়েটি তার নিজস্ব ইংরেজী ভাষায় আমাকে যা বলেছে, তার সত্যিকারের ইংরেজী অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, অর্থাৎ ডুউয়ান্না হ্যাফসাম ফ্র্যাঁ ফ্রাঁআআসসস্‌?’ এর সত্যিকারের ইংরেজীটা হচ্ছে, ডু ইউ ওয়ান্না হ্যাভ্‌ সাম ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ্?

আমেরিকায় আমার প্রথম দিনগুলোতে, সাধারণত নতুন কোনো খাবারের দোকানে গেলে, ওর্ডার দেয়ার সময় তারা যাই বলুক না কেন আমার কানে বাজতে থাকতো, হি জি জি জি, বি জি জি জি। আমি বলতাম, ইয়েস! ইয়েস বললে, তারা আবার বলতো, কি জি জি জি, টি জি জি জি। আমি বলতাম, নো। তারপর অপেক্ষার পালা। কি অর্ডার দিয়েছি সেটাতো নিজেই জানি না, খাবার দেখলে বুঝবো। ভাগ্য ভালো থাকলে সঠিক খাবার আসে। আর ভাগ্য খারাপ হলে দুপুরে লাঞ্চ অর্ডার দিয়ে হয়তো দেখতাম, সিঙ্গারা সাইজের কোনো খাবার চলে এসছে। দোকানের মেয়েটি আকর্ণবিস্তৃত হাসি হেসে এগিয়ে দিচ্ছে আমার দিকে। আর আমার চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে লাঞ্চ এর পরিমাণ দেখে। অন্যদিকে, বিকালের স্ন্যাকস্‌ অর্ডার দিয়ে দেখতাম বিশাল সাইজের প্লেট ভর্তি খাবার। আমেরিকায় বিখ্যাত ফাস্ট ফুড চেইন শপ ‘সাবওয়ে’। বাংলাদেশে থাকাকালীন হলিউডের সিনেমাগুলোতে দেখতাম নায়ক রাস্তার পাশে নেমে সাবওয়ে থেকে খাবার কিনে খাচ্ছে। প্রথম যেদিন এ দোকানে গেলাম, সে এক কেলেঙ্কারী অবস্থা। আইটেমগুলোর নাম হচ্ছে অরিগানো, হানি ওট, হ্যালাপিনোস, পেপার জ্যাক, হানি মাস্টার্ড, র‍্যাঞ্চ। আমাকে যদি এই নামগুলো বলে জিজ্ঞেস করে কি খাবো, আমি কিই-বা বলতে পারি। এর থেকে রিমান্ডে নেওয়াওতো ভালো। আর, খাবারের নাম হবে কাচ্চি বিরিয়ানী নয়তো খাসির রেজালা; বড়জোর হতে পারে ‘খাসির মাথা মুগডাল’! এর মধ্যে হানি ওট, অরিগানো হচ্ছে ব্রেড। আরে বাবা, ব্রেড কে ব্রেড বলো, অন্য নামে ডাকার কি দরকার! ওদিকে, ব্রেড এর সাইজ কে সোজা করে বলো ‘১২ ইঞ্চি। না, তারা সেটা করবে না, তারা সাইজের নাম দেবে ফুট লং। ভাবখানা হচ্ছে, ‘এক পা লম্বা ব্রেড খাবেন, না এক হাত লম্বা ব্রেড খাবেন?’

এমতাবস্থায় সাবওয়ে কাউন্টারে মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, মে আই হেল্প ইউ স্যার। আমি এগিয়ে যেতেই জিজ্ঞেস করে কি খেতে চাই। আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বলি, তোমার যেটা পছন্দ সেটা দাও। সেতো চরম স্মার্ট হবার ভাব করে বললো, আরে বাবা! তুমি খাবা!! আমি করে বলবো!!! ভেবে দেখলাম, ঘটনা সত্য। মনে মনে বলি, বেটি, একবার যদি তোমাকে বেচারাম দেউরির নান্না মিয়ার দোকানে নিতে পারতাম অথবা চকবাজার নিয়ে দেখাতে পারতাম আইটেমের নাম হচ্ছে ‘বড় বাপের পোলা’, তখন দেখতাম কি অর্ডার দাও তুমি। উপায়ান্তর না দেখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে বললাম, এটা, ওটা, সেটা। ও মাঝে মাঝে বলে, আর ইউ শিওর।’ আমি বলি, হুম্‌! মনে মনে আরো বলি, ‘বাঙালি এক কথার মানুষ, বলসি তো বলসি’। এইতো গেলো শুধু সাবওয়ের কথা। সাধারণ একটা কফির দোকানেও একই ঝামেলা। এখানে দুগ্ধজাত সামগ্রীর মধ্যে তরল দুধ আছে অথবা বেশি ফ্যাটযুক্ত ক্রিম আছে। কফির সাথে খাওয়ার জন্য এরা তরল দুধ এবং ক্রিম এর মিশ্রণে হিজিবিজি কিছু একটা তৈরী করে। তৈরী করা নতুন জিনিসটার যে নাম দেওয়া হয়, সেটার মধ্যে দুধ কিংবা ক্রিমের নাম গন্ধও নেই। দুধ এবং ক্রিম দুইটা নামই বাতাসে মিলিয়ে গিয়ে সেটার নতুন নাম হয়ে গেলো হাফ এন্ড হাফ। কফি খেতে গিয়ে কি এত যন্ত্রণা সহ্য করা যায়! আমার দেশের শ্রীমঙ্গলেতো ‘এক গ্লাসে চার লেয়ার’-ওয়ালা চা পাওয়া যায়, তাই বলে আমরা কি সেটাকে অন্য নামে ডাকি, আমরা কি বলি এটার নাম কোয়ার্টার-কোয়ার্টার-কোয়ার্টার-কোয়ার্টার

কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই সমস্যাগুলো এখন আর তেমন হয় না, হলেও খুব কম। এখন যেটা হয়, সেটা সবারই কম বেশি হয়ে থাকে। অতএব, সময় আসলো, কতটুকু আমেরিকান হয়ে গেলাম সেটা পরীক্ষা করে দেখার। এই পরীক্ষা অত্যন্ত সহজ এবং সুলভ। জিআরই কিংবা টোফেল পরীক্ষার মত অযথা টাকা কামানোর ধান্ধা নেই এখানে। শিকাগো শহরের ভদ্রলোক বলে সুখ্যাত ‘সায়েজ’ ভাইয়ের কল্যাণে এই পদ্ধতি বাঙালি কমিউনিটিতে বেশ জনপ্রিয়তাও লাভ করে। আমেরিকায় একটা সফট্‌ ড্রিংক আছে, যেটা এখানে খুবই জনপ্রিয়। আমাদের দেশে যে রকম, ‘স্পাইট’ কিংবা ‘কোক’, সেরকম খানিকটা। এই বিখ্যাত ড্রিংক এর নাম ডক্টর পেপার। এটি আমেরিকায় সবচেয়ে পুরাতন সফট্‌ ড্রিংক, যেটি ১৯০৪ সালে সর্বপ্রথম বাজারজাতকরণ করা হয়। সায়েজ ভাইয়ের মতে, ‘যেদিন আপনার ‘ডক্টর পেপার’ খেতে ভালো লাগবে, সেদিন বুঝবেন আপনি পুরোপুরি আমেরিকান হয়ে গেছেন। যদি মোটামুটি ভালো লাগে, তাহলে বুঝবেন মোটামুটি আমেরিকান হয়েছেন।’ সায়েজ ভাইয়ের কথা অনুযায়ী বাংলাদেশে থেকেই কতটুকু আমেরিকান সেটা দেখার জন্যই প্রথম দিকে আমেরিকায় এসেই ‘ডক্টর পেপার’ এ চুমুক দিয়ে দেখি।

http://youtu.be/02vku-6fZWQ
ভিডিওঃ ‘ডক্টর পেপার’ এর বিজ্ঞাপণ

‘ডক্টর পেপার’ এর স্বাদের কথা বলছি। তবে তার আগে, ‘ডক্টর পেপার’ এর এক সময়কার সিইও ক্লেমেন্টস সাহেবের কথার একটু পুনরাবৃত্তি করি। ক্লেমেন্ট সাহেব ‘ডক্টর পেপার’ এর স্বাদ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, আমি এরকমভাবে ডক্টর পেপার প্রস্তুত করে যাচ্ছি যে, আপনি কাউকে বলতে পারবেন না, এটার স্বাদ কেমন। কারণ, ডক্টর পেপার এর স্বাদ একদমই আলাদা। এটার স্বাদ আপেলের মত নয়, কমলার মতও নয়, স্ট্রবেরির মততো নয়ই। এটা বিয়ার নয়, কোলাও নয়। এটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এক অনন্য স্বাদের পাণীয়। ক্লেমেন্ট সাহেবের দূর্ভাগ্য যে তিনি বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেননি। তাহলে তিনি বুঝতে পারতেন, ডক্টর পেপার কোনো অনন্য স্বাদের ড্রিংক নয়। এটি নিশ্চিত করে বাংলাদেশের নাপা সিরাপের মধ্যে তেলাপোকা মারার বিষ মিশিয়ে দিলে যে স্বাদ হবে, সে একই স্বাদ। সায়েজ ভাইয়ের দেয়া পরীক্ষা অনুযায়ী আমি একশোতে দশ অর্জন করলাম। কারণ, নাপা সিরাপ খেতে অতটাতো আর খারাপ না। প্রায় আড়াই বছর পর যখন মনে হচ্ছে যে, এখন আফ্রিকান আমেরিকানদের কথাও ভালোই বুঝতে পারছি, তখন মনে হলো ‘ডক্টর পেপার’ টেস্টটা আরেকবার দিয়ে দেখা যাক। দেখি, এতদিন পরে কতটুকু আমেরিকান হলাম। যেই কথা সেই কাজ। খেলাম, আর চোখ বন্ধ করে ভাবলাম, কি করে আমি যেদিন প্রথম খেয়েছিলাম, সেদিন ‘ডক্টর পেপার’ এর জন্য একশোতে দশ বরাদ্দ করেছিলাম। বাংলাদেশের নাপা সিরাপতো এর তুলনায় অমৃত। বুঝতে পারলাম, আমেরিকান হওয়াতো দূরে থাক, আমি বরং বাংলাদেশি হবার যোগ্যতাইতো হারিয়ে ফেলছি। ‘ডক্টর পেপার’ টেস্টে ফেইল মেরে মনে মনে বলতে থাকলাম, সকল দেশের রাণী সে-যে আমার জন্মভূমি

আমেরিকায় প্রথম যেদিন আমার ইউনিভার্সিটিতে গেলাম, সেদিনকার ঘটনাটা আরেকবার স্মরণ করা যাক। ক্যাম্পাসের ঢুকে সামনে এগোতেই, চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে থাকা একজন অবশ্যই সুন্দরী তরুণী জিজ্ঞেস করলো, ডু ইউ ওয়ান্না হ্যাভ এ কিজ্‌? একি! কিজ্‌ টিজ্‌ এ-সব নিয়ে না হয় পরে চিন্তা করা যাবে, তাই বলে এখানে আসতে না আসতেই কিজ্‌ দিতে চায় কেন? মনে মনে ভাবি, আমেরিকাতো মনে হচ্ছে খুব একটা খারাপ জায়গা না। আবার চেয়ার টেবিল, খাতা-কলমও আছে। ‘কিজ্‌’ এর দোকান খুলে বসেছে না-কি! কি বলবো না বলবো ভেবে না পেয়ে বললাম, ইয়েস! সুন্দরী আস্তে করে এগিয়ে আসলো, মুখে হাসি, চোখে হাসি। কাছ এসে হাতে ধরিয়ে দিলো একটা কাগজ আর কলম। ক্যুইজ। সে আসলে জিজ্ঞেস করেছিলো, ডু ইউ ওয়ান্না হ্যাভ এ ক্যুইজ্‌। নিজের মনে নিজেই হাসতে থেকে ‘ক্যুইজ্‌’ দিয়ে সময় নষ্ট করলাম। পরবর্তীতে একসময় গেলাম আমার কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের অফিসে। এখানেও বসেন এক ভদ্রমহিলা। কথাবার্তা শেষে বলে উঠে, ডু ইউ ওয়ান্না হ্যাভ কিজ্‌? নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি কি কিজ্‌ বিশ্ববিদ্যালয়-এ ভর্তি হলাম না-কি! মনে মনে ভাবলাম নিশ্চয় ভুল শুনেছি। কিন্তু, সে আবারও বলে উঠে, ডু ইউ ওয়ান্না হ্যাভ কিজ্‌? সে শেষ করে উঠার আগেই আমি বলে উঠলাম , নো। সে অবাক হয়ে বলে, বাট, ইউ নিড্‌ কিজ্‌। বলে কি এসব! কোনো কথাও বলতে পারছি না। অনেক কষ্টে-সৃষ্টে বললাম, হোয়াই? সে বলে, ইউ হ্যাভ টু ওপেন ইওর রুম। হাঁফ ছেড়ে বেঁচে বুঝলাম সে আসলে জিজ্ঞেস করেছিলো, ডু ইউ ওয়ান্না হ্যাভ কিয়ীজ্‌? মানে আমি যে এখানে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করবো, আমাকে একটা রুমে বসে অফিস করতে হবে, সে অফিসের চাবি দিতে চায়।

সে অনেক দিন আগের কথা। সে-সব দিনতো এখনো ইতিহাস, হিস্‌ট্রি। তবে আসল হিস্‌ট্রি এর সাথে সাথে আমেরিকায় ক্রেডিট হিস্‌ট্রি নামক আরেকটা আজব হিস্‌ট্রিও আছে। বাংলায় বলা চলে ঋণাতিহাস। নগদ টাকায় জিনিস কিনলে এরা খুব নারাজ হয়, ক্রেডিট কার্ড দিয়ে ধার করে কিনলে মহা খুশি। হিস্‌ট্রি জিনিসটাই যেহেতু সময়ের সাথে সাথে তৈরি হয়, তাই অনেকদিন থাকার কারণে আমারও এই জিনিসটা তৈরী হয়েছে। যে-কোনো সুপার মার্কেটে গেলেই কাউন্টারে জিজ্ঞেস করবে, তাদের ক্রেডিট কার্ড নিতে রাজী আছি কি-না। নিলে দশ বা বিশ ডলারের ছাড় পাওয়া যাবে। আমি যদি অফারটা গ্রহণ করি, তাহলে কাউন্টারে যে আমাকে অফার করলো সেও কমিশন জাতীয় কিছু একটা পাবে।

কোনো এক তুষার পড়া সন্ধ্যায় কপালদোষে আমি গিয়ে উপস্থিত হলাম সে-রকম এক সুপার শপ-এ। কাউন্টারে মেয়েটি যথারীতি জিজ্ঞেস করলো, ওদের কার্ড নেব কি-না। আমিও কি মনে করে যেন হ্যাঁ বললাম। সে-তো মহা খুশি। তবে চাইলেই সাথে সাথে আমাকে কার্ড দেবে না, আমার ঋণাতিহাস ভালো হতে হবে। অর্থাৎ আমার যে ধার করে ঘি খাওয়ার অভ্যাস আছে সেটা প্রমাণ করতে হবে। আসলে ঋণাতিহাস চেক করার প্রকৃত উদ্দেশ্য অন্য। ওরা দেখে যে, আমি ঠিকমত ঋণ পরিশোধ করি কি-না। কেউ যদি ঋণ না নেয় তাহলে বুঝার কোনো উপায় নেই, সে ঠিক মত ঋণ পরিশোধ করে কি-না। তাই এরা জোর করে ঋণ দিয়ে দেয়, তারপর দেখে যে-ঋণ নিলো সে ঠিকঠাক পরিশোধ করি কি-না। এটা আমার নিজস্ব ব্যাখ্যা। তাদের মূল উদ্দেশ্য কি সেটা কখনো খুঁজে দেখিনি। অন্যকোনো, যৌক্তিক এবং অতি অবশ্যই পুঁজিবাদী একটা কারণ আছে।

অবশেষে আমার ধার করে ঘি খাওয়ার অভ্যাস প্রমাণ করার জন্য কাউন্টারের মেয়েটি সুপার শপ এর ‘প্রমাণকারী কর্তৃপক্ষ’-কে দিলো ফোন। কতক্ষণ ধরে আমার নাম-ধাম সব কিছু বলার পর, ওদিক দেখে বললো আমাকে ফোন দেয়ার জন্য। আমি ফোন ধরার পর, গুড মর্নিং-ইভিনিং সব শেষ করে প্রমাণকারী মহিলা অনুরোধ করলো, আমার ‘ফার্স্ট নেইম’ বলার জন্য। আমি বলি, বিএম। সে বলে, ডিএম। আমি বলি না, বিএম। সে বলে, ওহ! আই অ্যাম সরি, পিএম। আমি বলি, নোহ! আই অ্যাম সরি, ইটস্‌ বিএম। সে বলে, জি ফর গুড্‌। মানে এ পর্যায়ে সে ভাবছে, জিএম। অবস্থা বড়ই বেগতিক। বাংলাদেশে ট্রাফিক পুলিশরা ওয়াকি-টকিতে এভাবে কথা বলে। অথবা, বাস কাউন্টারের লোকজন এক কাউন্টার থেকে অন্য কাউন্টারে কথা বলার জন্য, বিশেষ করে কোন্‌ কোন্‌ সিট্‌ ফাঁকা আছে, সেটা জানানোর জন্য এভাবে কথা বলে। যেমন, ডি১-ডি২ সিট ফাঁকা হলে তারা বলে ডেলটা১-ডেলটা২ ফাঁকা। এ১-এ২ হলে বলে আলফা১-আলফা২।

কিন্তু ঋণাতিহাস উদ্ধার হওয়ার সম্ভাব্য সেই মুহূর্তে আমার মাথায় আসলো ‘বি’ দিয়ে তৈরী ‘বাট’ (but) এবং ‘এম’ দিয়ে তৈরী ‘মেডিসিন’ (medicine)। ওদিক থেকে মহিলা তাগাদা দিয়ে বলছে, মিস্টার হোয়াটেভার(!) এম? আমি বলি, ‘হুম্‌। সে বলে, ইউর ফার্স্ট নেইম। আমিও বললাম, বি ফর বাট্‌, এম ফর মেডিসিন, বিএম ফর বাট মেডিসিন। কিন্তু উচ্চারণের ধাক্কায় বাট হয়ে গেলো বাট্‌ (butt), বাট মেডিসিন হয়ে গেলো, ‘বাট্‌ মেডিসিন’ (butt medicine)। ওদিক থেকে হত-বিহবল কণ্ঠে মহিলা বলে, এক্সকিউজ মি। আবার আমার জাতীয়বাদী চেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো, বলসিতো বলসি, বাঙালি এক কথার মানুষ। জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুব্ধ হয়ে এবার গলার স্বর আরো খানিকটা উঁচুতে উঠিয়ে বললাম, বিএম ফর বাট্‌ মেডিসিন। জীবনের সেই ক্রান্তিলগ্নে দেখলাম, একদিকে কাউন্টারের মহিলা গভীর দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে, অন্যদিকে খানিকটা পাশে দাঁড়ানো আমার বউ অবাক হয়ে ভাবছে এ কাকে বিয়ে করলাম, ফোনের অপর প্রান্তে আরেকজন শুধু এক্সকিউজ মি, এক্সকিউজ মি করছে। আর আমি শুধু বলছি বাট্‌ মেডিসিন, বাট্‌ মেডিসিন। কয়েকদিন পর ক্রেডিট কার্ড দেয়া হবে কি-না সে ব্যাপারে বাসায় চিঠি আসলো, যার প্রথম লাইন-উই আর সরি টু ইনফর্ম ইউ দ্যাট……’

মইনুল রাজু (ওয়েবসাইট)
[email protected]