এক গাঁয়েতে ছিল একটি উচ্ছল মেয়ে।
সারা মুখে তার সদা হাসি
ফুলের মত থাকত ছেয়ে।
দিনমান বেড়াত সে হেসেখেলে।
ঘুঙুর পায়ে কাটত তার দিনগুলি নেচেগেয়ে।
গাঁয়ের সকলে ভালবেসে
ডাকত তারে ”দস্যিমেয়ে।”

সেই মেয়ে কাটত সাঁতার পদ্মপুকুরে।
সুতোবিহীন ঘুড়ির মতন
উড়ে যেত দিক-দিগন্তরে।
গাইত গান কোকিলের সুরে।

ঘনকালো কুন্তলরাশি তার
পিঠের পরে থাকত খোলা।
কখনো তার কুন্তলমেঘে
থাকত দীঘল বিনুনি,
কখনো বা বিশাল খোঁপা।
খোঁপায় সোভা পেত জুঁই-চামেলি-চাঁপা।
বাতাসের দোলায় দুলত তার কবরী,
মনের আনন্দে দুলত সেই মেয়ে সারাবেলা
দুদোল-দোলা।
জীবন ছিল তার মুক্তবিহঙ্গের মত
মুক্তমেঘের মত খোলা।

তার সাথে হলো একদিন
পুতুলবিয়ের ছল।
সেই হতে তার মুক্ত, চঞ্চল
হাতে পায়ে পড়ল যে শেকল।
তার জীবন হল অসাড়, বিকল।
সে ছিল এক কপট ফন্দি।
স্বাধীন পাখি চার দেয়ালে হল বন্দি।

যে মেয়ে উড়ত পাখা মেলে আকাশের নীলে,
সে বন্দি হল নিশ্ছিদ্র জেলে।
জেলখানার কর্তৃপক্ষগণ
তার ডানা দিলো ভেঙে।
চার দেয়ালের ভেতরেও
একটি বৃত্ত দিল এঁকে।
তার মুক্তমেঘের মত কুন্তলরাশি
ঘোমটায় দিল ঢেকে।
জীবনটা সেঁটে দিলো
তাদের আঁকা ছকে।

সেই সুতোবিহীন দুরন্ত, উড়ন্ত ঘুড়ি
হেঁসেলের আঁধার কোণে
পড়িল মুখ থুবড়ি।
তার অমলিন মুখের হাসি হায়!
উনুনের আগুনে পু’ড়ে হলো ছাই।
লেখাপড়া গেল চুলায়।
ধোঁয়ায় সাথে বাষ্পীভূত হয় চোখের জল।
সেই উচ্ছলতা উবে গেল সুদূর অজানায়।
প্রফুল্ল জীবন হলো জ্বালাময়।

ক্ষণে ক্ষণে কর্তৃপক্ষের নিত্য নতুন
তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, ফরমায়েশ আর হুকুম জারি।
উঠতে বসতে লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ঝাড়ি।
ওদের সারাদিনই খাই খাই,
এর এটা চাই, ওর ওটা চাই
তার সেটা চাই।
আরো কতজনের কতকিছু যে চাই!
কোনো হিসাব নাই, বিরাম নাই।
শুধু চাই চাই,
সবকিছু বন্দির কাছেই চাই।

ওর উদ্দেশ্যে এই কথাগুলোই সারাদিন বলা হয়;
“আজকাল কাপড়-চোপড় পরিষ্কার হয়না।
ঠিক মতন ধোয়না।
নবাবের মেয়ে তাইনা?
এসব এখানে চলবেনা।
এতক্ষণ কেন? কথা কানে যায়না?
রান্না এমন কেন? মুখেই দেয়া যায়না।“

এ ওটা খায়, ও সেটা খায়না।
সকলেরই আজব, আজগুবি বায়না।
সবার খাওয়ার পরে
তার তরে উচ্ছিষ্ট ছাড়া আর কিছুই রয়না।
অবশেষে শ্রান্তদেহে বিক্ষত মনে
চোখের জলে মেখে উচ্ছিষ্ট খেতে
তার আর রুচিতে সয়না।

তার উপর যতোই উৎপীড়ন হোক
সে কখনো ‘টুঁ’ শব্দটিও করেনা।
শুধু ভাবে হায়
“কী ছিল আমার অন্যায়
এ আমি এলাম কোথায়?”