একবিংশ শতকের বিজ্ঞানের জগতে আগেকার যে কোন সময়ের চেয়ে জীববিজ্ঞানকে অনেক অনেক বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়। রোগে শোকে মানুষ মরেছে মানব ইতিহাসের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই। তখনো গুরুত্ব ছিল জীববিজ্ঞানের সন্দেহাতীত ভাবেই। কিন্তু একবিংশ শতকে এসে মানুষগুলো কেমন যেন সবকিছুতে জীববিজ্ঞান জুড়ে দিয়ে বসে আছে। ইঞ্জিনিয়ারিং মত কাঠখোট্টা বিষয়ও ঢুকে পড়েছে জীব্বিজ্ঞানের আঙ্গিনায়। মানবদেহের সবকিছু যেন এরা গাণিতিক সমীকরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করে ফেলবে। মানবদেহের সব সমস্যাও যেন মানুষ সমাধান করে ফেলবে গাণিতিক সমীকরণ দিয়েই। চিন্তাভাবনা গুলো কেমন বিস্ময়কর মনে হচ্ছে না?

উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নামে একটা বিভাগ রাখা হয়। বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডঃ সিদ্দীকি-ই রাব্বানী স্যারের পরিচালনায় বায়োমেডিকেল ফিজিক্স এন্ড টেকনোলজী নামে একটি স্নাতোকত্তর বিভাগ আছে, যেখানে চলছে মানবদেহ সংক্রান্ত নানা ইঞ্জিনিয়ারিং গবেষণা, অচিরেই হয়ত আরো আরো বিশ্ববিদ্যালয়েও দেখা যাবে এমন বিভাগ। বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এরই একটি উপভাগ হল নিউরাল ইঞ্জিনিয়ারিং, যেখানে নিউরোসায়েন্স, বায়োইলেক্ট্রিসিটি এবং ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর সমন্বয়ে কাজ করা হয়। বর্তমান সময় অব্দি মানুষের নিউরোসায়েন্স সম্পর্কে অর্জিত জ্ঞান যথেষ্ট পরিমাণ কম।আমরা এখনও জানিনা, মানুষের মস্তিষ্কে আসলে কি হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে। অথচ এই জ্ঞানের উপরেই ভিত্তি করে নিউরাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ জাহির করতে হবে ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা। স্বাভাবিক ভাবেই বোঝা যায়, মানুষের ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা অনেকদূর এগুলেও নিউরোসায়েন্সের রহস্য সম্পর্কে প্রায় অজানার পর্যায়ে থাকার কারণে, খুব বেশীদূর এগোয়নি নিউরাল ইঞ্জিনিয়ারিং নামের এই উপশাখাটি। এই শাখাটির জন্মের গল্প শুনব আজ।

১৭৭১ সালে, চিকিৎসক এবং পদার্থবিদ লুইগি গ্যালভানি একদিন কিছু পরীক্ষার জন্য ব্যাঙের ব্যবচ্ছেদ করছিলেন, যেখানে ব্রাস দন্ডে ঝোলানো ব্যাঙটিকে যখনি চিমটা দিয়ে স্পর্শ করছিলেন, তখনই মৃত ব্যাঙের মাংসপেশীর সংকোচন পর্যবেক্ষণ করেন, যেন ব্যাঙটি মৃত নয়, জীবিত। আরেকটি অনুরূপ গল্প শোনা যায়, তিনি ব্যাঙটিকে টেবিলের উপরে রেখে আস্তে আস্তে তার চামড়া ছড়াচ্ছিলেন, যে টেবিলে তিনি ব্যাঙের চামড়া ঘষে স্থির বিদ্যুৎ পর্যবেক্ষন করবেন। তো ঐ চামড়া ছড়ানোর সময়েই দুটি ভিন্ন ধাতু দিয়ে ব্যাঙটিকে স্পর্শ করেন, আর তখনই মৃত ব্যাঙটির পা জীবিত ব্যাঙের মত নড়ে ওঠে। এই ঘটনায় তিনি ধারণা করেছিলেন, তিনি এক বিশেষ ধরণের বিদ্যুত আবিষ্কার করেছেন, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন, “অ্যানিমেল ইলেক্ট্রিসিটি”, যা মৃত ব্যাঙের নড়ে ওঠার কারণ। কিন্তু তার এই ধারণার স্পষ্ট বিরোধিতা করতেন তারই সহযোগী ভোল্টা, যার ধারণা ছিল, দুটি ভিন্ন ধাতু পরষ্পরকে স্পর্শ করার কারণে কিছু বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়েছে, যা ব্যাঙের শরীর দিয়ে প্রবাহিত হবার ফলে ব্যাঙটি নড়ে উঠেছিল। এই প্রাকৃতিক ঘটনার নাম তিনি গ্যালভানির নাম অনুসারে দেন গ্যালভানিজম। ভোল্টার মতে, প্রবাহিত বিদ্যুতের উৎস ব্যাঙের শরীর ছিল না, ছিল ধাতু দুটির যোজনীর ভিন্নতা, যা গ্যালভানির অ্যানিম্যাল ইলেট্রিসিটির ধারণার উলটো ছিল। পরবর্তীকালে ভোল্টা তার ধারণা প্রমান করেন দুটি ভিন্ন ধাতু দ্বারা নির্মিত ভোল্টেয়িক সেল সৃষ্টি করে। এই ঘটনার ফলাফল হিসেবে, ব্যাটারী, ভোল্টেয়িক সেল ইত্যাদির জন্মের সাথে সাথে বায়োইলেক্ট্রিসিটি নামের শাখাটিরও জন্ম হয়, যার আলোচ্য বিষয় গ্যালভানিজম, জীবদেহের বিদ্যুৎ পরিবহনযোগ্যতা। জীবদেহে বিদ্যুৎ পরিবাহিত হয়, তা আমরা সবাই জানি, কিন্তু কিভাবে পরিবাহিত হয়?

জীবদেহের গাঠনিক উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হল পানি, আর তাতে ভেসে বেড়ায় অসংখ্য আয়ন। জীবদেহের কোষের ভিতরে এবং বাইরে যে আয়নপূর্ণ তরল আছে, সেটাই বিদ্যুৎ পরিবাহক জন্য কাজ করে। তবে প্রাণীদেহের নিউরণগুলো বিদ্যুত পরিবহনে বিশেষভাবে পারদর্শী। নিউরণের মধ্য দিয়ে যত তথ্য প্রবাহিত হয় তার সবটাই আসলে বৈদ্যুতিক সিগন্যাল রূপে প্রবাহিত হয়। মানুষ বা প্রাণীর চারপাশের পরিবেশের সমস্তরকম তথ্য বৈদ্যুতিক সিগন্যাল রূপে পৌছে যায় মস্তিষ্কে, আর মস্তিষ্ক এইসব বৈদ্যুতিক সিগন্যাল থেকেই পরিবেশের সমস্ত তথ্যের পাঠোদ্ধার করে। এইসব বৈদ্যুতিক সিগন্যালের নাম দেয়া হয়েছে অ্যাকশন পটেনশিয়াল, অনেকগুলো অ্যাকশন পটেনসিয়াল যখন পেরিফেরাল নার্ভ বা দেহের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা নার্ভ, যেমন ধরুন, আঙ্গুলের ডগা, পায়ের পাতা বা চোখের নার্ভ, এইরকম বিভিন্ন জায়গা থেকে একটার পিছনে আরেকটা দলবেধে মস্তিষ্কে প্রবেশ করে, বা মস্তিষ্ক থেকে এমন বিভিন্ন জায়গার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়, তখন অ্যাকশন পটেনশিয়ালের সিরিজকে বলে পালস ট্রেইন।

নিউরাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর কাজ হল, এইসব পালস ট্রেইন থেকে কিভাবে মস্তিষ্ক পাঠোদ্ধার করে তা বোঝার জন্য বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা নিরিক্ষা করা, পরীক্ষা নিরিক্ষার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে মানব দেহের নার্ভ সংক্রান্ত সকল রকম সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। সমস্যা হল, কিভাবে মানব দেহে একটি অ্যাকশন পটেনশিয়াল সৃষ্টি হচ্ছে তা যদি না জানা যায়, তাহলে সমস্যাগুলোও কোন জায়গায় কোন রকমের ত্রুটির জন্য হচ্ছে, তা বোঝা যাবে না। তাই সবার আগে বুঝতে হবে, কিভাবে মানব দেহে ইলেক্ট্রিক সিগন্যাল তৈরী হচ্ছে। এই অ্যাকশন পটেনশিয়াল সৃষ্টির প্রক্রিয়া এবং এর ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাখ্যা যাদের হাত ধরে জানা গেছে, তাদের কল্যাণেই এখন আমরা নার্ভের কর্মকান্ডগুলোকে গাণিতিক প্রক্রিয়ায় ব্যাখ্যা করার, সমস্যাগুলো ইঞ্জিনিয়ারিং প্রক্রিয়ায় সমাধান করতে চেষ্টা করতে পারছি। এইখানে বলে রাখি, ইঞ্জিনিয়ারিং যদি হয় লভ্যজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে প্রযুক্তি গড়ে তোলা, তাহলে নিউরাল ইঞ্জিনিয়ারিং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সন্দেহাতীত ভাবে আলাদা। কারণ এই ক্ষেত্রটাই আমরা এখনও জ্ঞান বিজ্ঞানের এতোখানি উৎকর্ষতায় পৌছায় নি, যে একদল বৈজ্ঞানিক গবেষণা করবে, আর ইঞ্জিনিয়ারেরা শুধু বসে বসে সেইসব জ্ঞান ব্যবহার করে প্রযুক্তি সৃষ্টিতে মন দেবে। বরং, কোন ইঞ্জিনিয়ারিং সমস্যার সমাধান করার লক্ষ্যে সেই গবেষক দলকেই বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান চালাতে হয় সাধারণত। তাদের প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য সমাধান তাদেরই বের করে নিতে হবে, এর পর ইঞ্জিনিয়ারিং সমাধানের দিকে এগুনো সম্ভব। এইপথে পথ নির্দেশক হিসেবে কাজ করেছেন যারা, আসুন এবার তাদের গল্প শুনি ছোট্ট করে।

১৯০২ সালে জুলিয়াস বার্নেস্টাইন প্রদান করেন “মেমব্রেন অনুকল্প”, যা বায়োইলেক্ট্রিসিটি এবং নিউরোবায়োলজির জগতে প্রথম পরিমাপযোগ্য অনুকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়। বার্নেস্টাইনের দেয়া মেমব্রেন অনুকল্পে ধারণা করা হয়েছিল, অ্যাকশন পটেনশিয়াল সৃষ্টি হয় পটাসিয়ামের কারণে। কিন্তু কিভাবে? জীবদেহে কোষের বহিস্থ তরল এবং কোষস্থ তরল একটি অর্ধভেদ্য কোষ পর্দা দ্বারা আলাদা করা থাকে। কোষপর্দার মধ্য দিয়ে কিছু কিছু পদার্থ বিশেষ পরিবহন প্রক্রিয়ায় এপাশ থেকে অপাশে যেতে পারে, অধিকাংশ পদার্থ এই কোষ পর্দা অতিক্রম করতে পারে না। বার্নেস্টাইনের মতে নিউরনের মধ্য দিয়ে তড়িৎ পরিবহনের সময় কোষ পর্দায় পটাসিয়াম আয়নের পরিবহনযোগ্যতা বেড়ে যায়, ফলে কোষের ভিতরে, বাহিরে পটাশিয়াম আয়নের ঘনত্বের ভিন্নতা কমতে থাকে আর তারই ফলশ্রুতিতে কোষস্থ তরলের বিভব ক্রমাগত শুন্যের কাছাকাছি পৌছে যায়। খুব সংক্ষেপে বললে অ্যাকশন পটেনসিয়াল হল, কোষপর্দার তড়িৎ পরিবহনের সময়ে মেমব্রেন পটেনশিয়ালের মানের তাৎক্ষণিক পরিবর্তন। একটি নিউরণ যখন অনুত্তেজিত অবস্থায় থাকে, তখন এর পটেনশিয়ালের (রেস্টিং পটেনসিয়াল) মান -৪০ মিলিভোল্টের এর কাছাকাছি বা এর নীচে থাকে, অর্থাৎ কোষের বাইরের তরলের চেয়ে কোষের ভিতরের তরলের বিভব ঋণাত্মক। অন্যভাবে বলা যায়, কোষের বহিঃস্থ ধনাত্মক আধানের পরিমাণ কোষস্থ তরলের চেয়ে বেশী। বার্নেস্টাইন তার মেমব্রেন অনুকল্পে বলেন, যখন অ্যাকশন পটেনশিয়াল সৃষ্টি হয় তখন, মেমব্রেন পটেনশিয়ালের মান ঋণাত্মক অঞ্চল থেকে ক্রমাগত শুন্যের কাছাকাছি চলে আসে। সেইসময়ের বিজ্ঞানীরা বার্নেস্টাইনের এই অনুকল্প মেনে নিয়েছিলেন, কারণ এই অনুকল্প ভুল প্রমাণ করার কোন উপায় বা ভিন্ন কোন অনুকল্পের চিন্তা তাদের মাথায় ছিল না।

এদিকে ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী জন জ্যাক্যারি ইয়ং, বৃহদাকার স্কুইডের ব্যবচ্ছেদ/পরীক্ষণ চালান। সেখানে তিনি প্রায় এক মিলিমিটার ব্যাসের কিছু নালি দেখতে পান কিন্তু বিস্মিত হন এই নালি গুলো রক্ত পূর্ণ নয় দেখে! তারমানে এগুলো কিছুতেই রক্ত সংবহন নালি হতে পারে না। তিনি ধারণা করেন, এগুলো স্কুইডের নার্ভ হতে পারে। এরপর তিনি এইসব নালীতে ইলেক্ট্রোড প্রবেশ করিয়ে তড়িৎ প্রবাহিত করার ফলে স্কুইডের মাংসপেশীর সঞ্চালন পর্যবেক্ষণ করেন, যা নিশ্চিত করে, এই নালীগুলো আসলেই স্কুইডের বৃহদাকার নার্ভ। স্কুইডের এইরকম প্রসস্থ নার্ভ আবিষ্কারের পরেই কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়।

httpv://www.youtube.com/watch?v=omXS1bjYLMI

১৯৩৭-৩৮ সালে হডজকিনের আমেরিকায় পোষ্ট ডক্টরাল পরিদর্শনকালীন সময়ে, বিজ্ঞানী কোলের সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সময়ে তারা দুজনে, নিউরনের মেমব্রেন পটেনশিয়াল মাপতে প্রায় সক্ষম হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যা ছিল, নিউরণ এতো সূক্ষ্ম, যে এর ভিতরে ইলেক্ট্রোড প্রবেশ করিয়ে এর বিভব পরিমাপ করা সেই সময়ে প্রায় অসাধ্য ব্যাপার ছিল। তদুপরি, তারা তাদের পাওয়া ফলাফলের উপর নির্ভর করতে পারছিলেন না। তখন তারা প্রমাণ করেছিলেন, বার্নেস্টাইনের অনুকল্পে সত্যতা আছে কিছুটা, আসলেই, অ্যাকশন পটেনসিয়াল সৃষ্টিকালে, কোষপর্দায় পটাসিয়ামের প্রবেশযোগ্য বেড়ে যায়। কিন্তু তারা যা বুঝে উঠতে পারছিলেন না, তা হল, বার্নেস্টাইনের মতে, পটাশিয়ামের প্রবেশযোগ্যতা বাড়ার ফলে মেমব্রেন পটেনশিয়াল শুন্যের কাছাকাছি পৌছে যায়, কিন্তু হডজকিন-কোলের পরীক্ষার ফলাফল বলছে, অ্যাক্যাশন পটেনশিয়াল সৃষ্টির সময়কালে, মেমব্রেন পটেনশিয়াল শুন্যকে ছাড়িয়ে ধনাত্মক হয়ে যায়, অর্থাৎ কোষস্থ তরলে কোষের বহিস্থ তরলের চেয়ে ধনাত্মক আধানের পরিমান বেড়ে যায়। এই ঘটনার কোন ব্যাখ্যা বার্নেস্টাইনের অনুকল্প দিতে পারে না। এমনকি তারা বুঝতেও পারছিলেন না, কেন এমন ফলাফল আসছে। তারা চিন্তা করেন স্কুইডের কথা, স্কুইডের ১ মিলিমিটার ব্যাসের প্রসস্থ অ্যাক্সনে, ইলেক্ট্রোড প্রবেশ করানো সম্ভব এবং যথেষ্ট সূক্ষ্মতার সাথে মেমব্রেন পটেনসিয়াল নির্ণয় করা সম্ভব, কিন্তু তারা এখনও মেমব্রেন পটেনশিয়ালের ধনাত্মকতার কারণ নির্ণয় করতে পারেননি। কোল এবং হডজকিন উভয়েই পৃথক পৃথক আয়নের জন্য মেমব্রেনের বৈশিষ্ট্য পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।

১৯৪২ সালে কোল এবং কার্টিজ অ্যাকশন পটেনশিয়ালের ঋণাত্মক থেকে ধনাত্মক হয়ে যাওয়ার প্রমাণ স্বরূপ একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, যেখানে দেখানো হয়, অ্যাকশন পটেনশিয়ালের সাধারণ ধনাত্মক মান ১১০ মিলিভোল্টের উপরে। তাদের এই পেপারটি বৈজ্ঞানিক মহলে ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হয়, অন্যান্যদের মতে, কোল-কার্টিজ তাদের পাওয়া অ্যাকশন পটেনশিয়ালের সর্বোচ্চ মানটিকে অ্যাকশন পটেনসিয়ালের সাধারণ মান হিসেবে অভিহিত করেছিলেন, যা ছিল আসলে অ্যাকশন পটেনশিয়াল হিসেবে অতিভাল একটি মান। এভাবে সর্বোত্তম ফলাফলটিকে অন্যান্যদের কাছে তুলে ধরার এই প্রবণতাকে বৈজ্ঞানিক মহল অনুৎসহিত করে এবং পেপারটিকে বিভ্রান্তিকর পেপার হিসেবে অভিহিত করেন। কিন্তু তাতে থেমে যায় নি কোল-কার্টিজের গবেষণা কার্যক্রম।

১৯৪৭ সালের দিকে জর্জ মারমন্ট এবং কোলের প্রচেষ্টায় উদ্ভাবিত হয় ভোল্টেজ ক্ল্যাম্প টেকনিক, যা মেমব্রেন পটেনশিয়ালকে পরিবর্তিত হবার বদলে, একটি নির্দিষ্ট পটেনশিয়ালে স্থির রাখে। ফলে আগে যেখানে ৫ মিলি সেকেন্ড সময়ের মধ্যে মেমব্রেন পটেনসিয়াল ঋণাতক থেকে ধনাত্মক হয়ে যাচ্ছিল, এখন সেখানে একটি নির্দিষ্ট পটেনশিয়ালে স্থির রেখে ঐ পটেনশিয়ালে মেমব্রেনের বৈশিষ্ট পরীক্ষা করা সম্ভব হয়ে ওঠে। এইপর্যন্ত কোলের অবদান আসলেই অনস্বীকার্য। অ্যাকশন পটেনশিয়ালকে অনুধাবন করার ক্ষেত্রে কার্যকরী পথের দুয়ার খুলে দেয় কোলের উদাভবিত এই প্রযুক্তি। ভোল্টেজ ক্ল্যাম্প পদ্ধতি ব্যবহার করে কোল যে সমস্ত ফলাফল পেয়েছিলেন, তা ব্যাখ্যা করতে তিনি পারেন নি। তিনি সেসব ফলাফল দেখান হডজকিন এবং হাক্সলিকে। ইতিমধ্যে হডজকিন এবং হাক্সলির মনে উদয় হয়েছে নতুন চিন্তা। বার্নেস্টাইনের অনুকল্প ভুল নয় তো? এটা কি হতে পারে, অ্যাকশন পটেনশিয়াল সৃষ্টির কারন সোডিয়াম আয়নের প্রতি কোষ পর্দার প্রবেশযোগ্যতা বৃদ্ধি, পটাশিয়ামের প্রতি নয়? তাদের এই চিন্তা থেকে কোলের পরীক্ষালব্ধ ফলাফল এবং প্রযুক্তির অধিকার পাবার আগেই তারা কোষপর্দার সোডিয়াম আয়নের প্রবেশযোগ্যতা নিয়ে করেছিলেন কিছু গণনা, পরিকল্পনা।

১৯৪৯ সালে হডজকিন এবং তার সহযোগী হাক্সলি, কোল-মারমন্ট উদ্ভাবিত ভোল্টেজ ক্ল্যাম্প পদ্ধতি দিয়ে স্কুইডের বৃহদাকার অ্যাক্সনে পরীক্ষা চালান এবং বিভিন্ন নির্দিষ্ট বিভবে মেমব্রেনের বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করেন। তারাই প্রথম অ্যাকশন পটেনসিয়ালের কারণ হিসেবে সোডিয়ামকে সনাক্ত করেন। তাদের ভাষ্যমতে, অ্যাকশন পটেনশিয়াল ঘটার প্রধান কারণ সোডিয়াম আয়ন যার ইকুইলিব্রিয়াল পটেনশিয়াল বা নের্নস্ট পটেনশিয়াল প্রায় +৫০ মিলিভোল্টের কাছাকাছি, যা ব্যাখ্যা করে, অ্যাকশন পটেনশিয়াল সৃষ্টির সময় কোষ পর্দায় সোডিয়ামের প্রবেশযোগ্যতা অনেক বেড়ে যায়, পটাসিয়ামের চেয়ে বহুগুন, যার ফলশ্রুতিতে বহু আয়নের মাঝে মেমব্রেন পটেনশিয়াল বিশেষভাবে সোডিয়াম আয়নের ঘনত্বের ভিন্নতার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, এবং মেমব্রেন পটেনশিয়াল সোডিয়ামের ইকুইলিব্রিয়াম পটেনশিয়ালের দিকে যাত্রা করে। ১৯৫২ সালে, হডজকিন এবং হাক্সলি তাদের এই তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, ধারাবাহিকভাবে ৫টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, যার প্রথম চারটিতে তারা তাদের পরীক্ষালব্ধ ফলাফলগুলোর প্রতি আলোক পাত করেন এবং ৫ম গবেষণা পত্রে তারা তাদের সমস্ত ফলাফলকে একটির সাথে আরেকটি যুক্ত করে একটি পূর্ণাঙ্গ গাণিতিক মডেল আকারে প্রকাশ করেন যা অ্যাকশন পটেনশিয়ালের পুরো প্রক্রিয়াকে সাফল্যের সাথে ব্যাখ্যা করতে সম্ভবপর হয়। স্যার অ্যালান হডজকিন এবং স্যার অ্যান্ড্রু হাক্সলির ১৯৫২ সালের সেই গবেষণা পত্রটি এরপর ১৯৬৩ সালে যে কেবল নোবেল বিজয় করে নিয়েছে, শুধু তা নয়, বিজ্ঞানের জগতে নিউরনের কোষপর্দায় আয়ন চ্যানেল এর উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে, নিউরণের গানিতিক মডেল উপস্থাপনের মাধ্যমে কম্পিউটেশনাল নিউরসায়েন্সের গবেষণার সূচনা করেছে। তাদের কাজ এতটাই শক্তিশালী এবং নিখুত, যে তাদের আয়ন চ্যানেল তত্ত্ব এবং গাণিতিক সমীকরনগুলো পরবর্তীতে কোষপর্দার কার্যক্রম ব্যাখ্যায় স্ট্যান্ডার্ড হয়ে দাঁড়ায়। হডজকিন- হাক্সলির ১৯৫২ সালে প্রকাশিত গবেষণা পত্রের পর বিগত ৬০ বছর যাবত তাদের ব্যাখ্যাই এখন পর্যন্ত সঠিক হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে এবং বর্তমানকালে নিউরোসায়েন্স বা নিউরাল ইঞ্জিনিয়ারিং যে গবেষণার কথাই বলতে যাই না কেন, তার ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। তাদের ব্যাখা করা অ্যাকশন পটেনশিয়ালের গাণিতিক মডেলটিকেই নিউরাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রথম সফল সূচনা হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

—————————————————
তথ্যসূত্রঃ

১. Hodgkin and the action potential 1935-1952
২. voltage clamp by John W. Moore (2007), Scholarpedia, 2(9):3060.
৩. Hodgkin, A.L. & Huxley, A.F. A quantitative description of membrane current and its application to conduction and excitation in nerve. The Journal of Physiology 117, 500-544 (1952).
৪. উইকিপিডিয়া