রডহ্যাম দম্পতি এখন কঙ্গোতে। এসেছেন কন্যাকে দেখতে। নিজের কন্যা নয়- দত্তক সন্তান। তাতে কিছু যায় আসে না, কারণ স্নেহ মমতার কোন ঘাটতি নেই তাদের ভেতরে। পশ্চিমের ধনী চকচকা মানুষ তারা। একটা মেয়ে সন্তানকে দওক নেয়া, আর মাঝে মাঝে তাকে দেখতে আসা কোন ব্যাপারই না তাদের কাছে। জগতের অনেক বড় বড় দায়িত্ব কর্তব্যের ভার ভীষণ ব্যাস্ততায় তাদের উপর চেপে ছিল এতদিন। বছর দুই হলো তারা সে চাপ থেকে মুক্ত। অবসর নিয়েছেন মিষ্টার ও মিসেস রডহ্যাম। ব্যাস্ততা তারা অপছন্দ করতেন না। কাজ-সমাজ-বন্ধুবান্ধব-ব্যাস্ততা এগুলো সবই তারা উপভোগ করেছেন ধ্রুপদী জীবনের ছন্দে। সেখানে একটা ছোট্ট শিশুর জন্য পর্যাপ্ত জায়গা তারা করে উঠতে পারেননি এই এতটা দিনেও। তাই তারা নিঃসন্তান। উচ্ছল জীবনের ছন্দপতনের ভয় ভাবনায় তাদের সন্তানহীন জীবন কেটে গেছে আগোচরে। খন্ডিত দুএকটা টুকরো অবসর তারা কাটিয়েছেন পোষা প্রানীদের আদর যত্ন-সংরক্ষণে। এতটা বছর দুধের স্বাদ ঘোলে মিটলেও আজ অবসর জীবনে তা মিটছে না। সন্তান বাৎসল্যের একটা চাহিদা চারা থেকে মহীরূহে পরিণত হয়েছে অখন্ড অবসরের এই কটা দিনে। সেই ডাকেই সাড়া দিয়েছেন রডহ্যম দম্পতি। তাই এক সেবা সংস্থার সাহায্যে কালো আফ্রিকার কালো এক মেয়েকে দত্তক নিয়েছেন তারা। মাসে মাসে সামান্য কিছু আর্থিক সাহায্যে নিজের দেশে থেকেই বড় হচ্ছে তাদের মেয়ে শামা।

শামা এবার পাঁচ বছরে পড়েছে। এক বছর বয়সে নিজের বাবা-মাকে হারিয়েছে। তাদের কথা তার তেমন মনেও পড়েনা। ন্যানির কাছে শুনেছে তার জীবনের গল্প, এই সেবাসদনে আসার গল্প। তার কিছুটা সে বুঝেছে, কিছুটা বোঝেনি- বয়সের কারণে। মাত্র একবছর বয়স তার তখন। আরও দু-চারটা পরিবারের মত শিশু শামা আর তার বাবা-মা তাদের শহরতলীর আবাস ছেড়ে জানের ভয়ে আশ্রয় নিয়েছে নিভৃত পল্লীর এক স্বজনের পর্ন কুটীরে। যদি কোনভাবে দাঙ্গাটা এড়ানো যায়, পরে সুযোগ মত ধীরে-সুস্থ্যে নিজেদের ঘরে ফিরলে চলবে। দাঙ্গা শুরু হয়েছে বহু আগে। কত আগে তা তারা শুমার করতে পারে না- দুই তিন বা চার প্রজন্ম আগে হয়তো। রক্ত পিপাসা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। কালো নিধন করছে অন্য কালোকে। প্রতিবেশি যে মায়া ভরা মুখের দুষ্টু বালকটা অহর্নীশি নিঃসন্তান দুর-সম্পর্কের দাদীমার স্নেহ লুটতো সে আজ তার সেই দাদীমার রক্তেই হাত রাঙাচ্ছে। বন্ধু নিচ্ছে বন্ধুর প্রান- ভাই মারছে ভাইকে। ক্ষমতা মানুষগুলোকে পাগলা মহিষ থেকেও ক্ষিপ্ত করে ফেলেছে, তুলে নিয়েছে লাজ-লজ্জা নীতি।

প্রতিদিনের মত সেদিনও জেগে গিয়েছিল ছোট্ট মেয়ে শামা ভোররাতে ক্ষিদের জ্বালায়। আঘাত হেনেছে মরন-দাঙ্গা নিভৃত পল্লীতে। রাতের সে দাঙ্গায় ঘুমন্ত বাবা মার মাথা থেকে দেহ আলাদা হয়ে পড়ে আছে, মায়ের বুকের উত্তাপে ঘুমিয়ে তা ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি শিশু। কারন সে দাঙ্গা বোঝে না, রাজনীতি বোঝেনা, সে বোঝে-ভোর রাতে তার মায়ের বুকের দুধ চাই। এক ফোটা দুধ নেই বুকে, যে তাপটুকু ছিল তাও কোথায় উড়ে গেছে। ভয়ে ক্রোধে, অনিশ্চয়তার ধাক্কায় শরীরের সবটুকু শক্তি এক করে কাঁদতে থাকে বিদ্রোহী শিশু। আর সেই কান্নার আওয়াজ সাহায্যকারীদের কানে গিয়ে পৌছায়। তারাই তাকে দিয়ে যায় এই সেবা সদনে। এটাই এখন তার মা-বাপ। এখানকার সবাই ভালো, ন্যানী ভালো। তার সেই পিতামাতা, যারা অনেক দূর থেকে তাকে টাকা পাঠায়- তারাও ভালো। শুধু ছবিতে সাদা রংএর বাবা মাকে দেখে শিশু শামার মন ভরেনা। তাই ছোট কাঁপা হাতে সে লিখেছে-‘বাবা, মা তোমাদের দেখতে আমার খুব মন চায়। তোমরা খুব ভালো। তোমরা এসো।’ ছোট্ট সে চিঠির সরলতা যাদু করেছিল রডহ্যাম দম্পতিকে। সে চিঠির ডাকে সাড়া না দিয়ে তাদের কোন উপায় ছিল না। তাইতো তারা এখন কঙ্গোর এই সেবা সদনে। একবার বৃদ্ধ মেয়েকে কোলে তুলে নেন, আরেকবার বৃদ্ধা বুকে ধরেন চেপে। চকোলেট, কেন্ডি, আর উপহারে ভরে যায় কৃষ্ণকলির হাত পকেট ঘর। স্নেহের সব উপাচারে ভরে যায় শিশু কন্যার সারা দেহ, সারা মন। ছোট মনে অত বেশী জায়গার সংকুলান হয় না, উপচে পড়ে স্নেহ।

পায়ে পায়ে বিদায়ের মুহুর্ত এসে হাজির হয় পিতা-মাতা, কন্যার সামনে। প্রস্থানের প্রস্তুতি নেয় তারা।
-তোমরা আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাও।
ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে উচ্চারণ করে কালো কন্যা। আবারও অনেক উপহার, কেন্ডিতে আর আদরে ভরে যায় ছোট্ট শামার শরীর। অবোধ এই শিশুকে কিছু একটা বুঝ তো দিতেই হবে।
-তোমার জন্য এরপরে আরও অনেক উপহার নিয়ে আসবো। আর আমরাও প্রায়ই আসবো।
বলতে বলতে বেশ কিছু দূর এগিয়ে যায় পিতা-মাতা। দত্তক মা পেছন ফিরে তাকায় একবার। সহসা মনেহয় তার, তাইতো নিয়ে গেলে সাথে করে কি এমন ক্ষতি! পয়সা দিলে একদিনে সব কাগজ-পত্র বানানো যায়। নিয়ে যেতে কোন বাধা নেই। পরক্ষণে প্রতিবেশী বন্ধুদের কথা ভাবে। ওরা কি ভাববে- এই তত্ত্বের উদয় হয় তার মনের ভেতরে। মিস্টার রডহ্যামের মনের ভেতরেও একটা শুকনো বাতাসের ঢেউ উঠে। একবার তিনি অনাগত সেই দৃশ্যের কথা কল্পনা করলেন- যখন চকচকে কালো এক শিশুর হাত ধরে তিনি রবিবারের প্রার্থনার জন্য গির্জায় ঢুকতে যাবেন তখন প্রতিবেশী মি. রবার্ট অথবা মি. জনসন হেসে বলবেন, তোমার মেয়ে বুঝি? তাদের সে অর্থপূর্ন হাসির ভাষা আর চোখের কুটিল শব্দ সম্ভার তাকে তখন মাটির ভেতর সেঁধিয়ে দেবে লজ্জায়, অপমানে। তার চেয়ে এই ভাল- মাঝে মাঝে এসে বুকে চেপে ধরলে বুকের পিপাসা মিটবে আবার মানুষের বাকা হাসিও দেখতে হবে না। একসঙ্গে তারা আরও একবার পেছন ফিরলো। আশ্চর্য হয়ে দেখলো- শামাকে ধরে রাখা ন্যানিটা সেই বাঁকা হাসি হাসছে- অপমানের হাসি। ভীষণ কষ্ট হলো মনে- অপমানও। অবোধ মেয়ে তখনও খুতখুত করে কাঁদছে। কি করতে পারে তারা আর। সবাই সবকিছু পারে না। হাত নেড়ে মেয়েকে বিদায় জানালো অতঃপর রডহ্যাম দম্পতি। ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগলো তারা। পায়ে পায়ে বাড়ি খেল তারা কয়েক বার। মনের ভেতরে বিরক্তি শব্দ করে উঠল- ধুত্তুরী বেয়াড়া পা। পাও কি বুঝে ফেললো তাদের মনের কথা!