আশারদ রাজনীতি বোঝে না, কিন্তু রাজনীতি তারে জড়ায়ে আছে অথবা সে রাজনীতি জাপটে ধরে আছে- এ দুটোই তার বেলায় সত্য। লোকে তারে ভয় করে। সামনা সামানি দেখা হলে কষ্ট করে ডান হাতটারে কপালের কাছে নিয়ে এসে সালাম দেবার চেষ্টা করে। আবার আড়ালে আবডালে মনের ক্ষেদ মেটায়- সুখ করে করে খিস্তি খেউড় ঝাড়ে, বলে আশা ডাকাত একটা বেজন্মা। এই কথাটার সাথে আশারদ একমত না। কারণ তার একটা নীতি আছে। দক্ষিণ বাংলার এই জেলায় এমন একটা লোক নেই যে বলতে পারে, আশারদ তার স্বধর্মী কাউরে গর্তে ফেলেছে- হেনস্থা করেছে। অবশ্য তার লিডারের ইশারায় দুয়েকটা অমন কাজ তাকে করতে হয়েছে অতীতে। নেতা চাইলে সেসব যে এখনও তাকে করতে হবে তাও সে জানে। তবুও তার একটা নীতি আছে। সে হচ্ছে তার নেতার হুকুম বর্দার- ধর্মের পাহারাদার। তার নেতা খান সাহেবদেরও খান- খান আব্দুল মহান খান। আশারদ বেঁচে থাকতে লিডারের কোন চাওয়া-পাওয়া অপূর্ণ থেকে যাবে- এমনটা হবার নয়। অনেক বুদ্ধি রাখে আশারদ তার মাথায়। অবশ্য তার অনেক কিছুই লিডারের কাছে থেকে থেকে শেখা। এই যেমন এই আল্লার দেশের দুশমন কারা, এই পবিত্র দেশের থেকে কারা সহায় সম্পদ সীমান্তের ওপারে পাচার করে- সব তার মাথায় কিলবিল করে চ্যালা সাপের মত। ওরা খোদারও দুশমন। ঐসব মালায়ুনদের গর্তে ফেলতে তার হাত কাঁপে না কোন সময়, কাপে না ধর্ম রক্ষা করার সেসব পূণ্য অর্জনে। এসব কাজে লিডারের ইশারা আছে- আছে চাওয়া পাওয়াও। মুখে না বললেও নেতার মৌন সম্মতি আছে এসবে। কে না জানে মহান মানুষদের চুপ করে থাকাও মস্তবড় নসিহত হয়ে যেতে পারে। সেই সব নসিহত অনুযায়ী কাজ করতে হয় আশারদকে। এসব কাজে অনেক সময় পুরস্কার মেলে উপরওলাদের তরফ থেকে। তবে আমজনতা তারে ভয় করে- এটা মন্দ লাগে না। আশা ডাকাত নামের ক্ষতিটা পুশিয়ে যায় তখন।
কথায় বলে দিন আর রাত পিঠা পিঠি চলে। পুরস্কারের পিছে পিছে তিরস্কারও চলে আসে। এমনি এক তিরস্কার হঠাৎ করে আজ ধাওয়া করেছে আশারদকে। কি এমন করেছে সে? মাত্র কয়েক বান্ডিল টাকাই তো? আর তো কিছু না! মনে হচ্ছে পুরো যক্ষের ধন লুট করে নিয়ে এসেছে আশারদ। এর জন্যে এত কলবর? এর জন্যে এত পুলিশ, দারোগা, কোতোয়ালদের দৌড়াদৌড়ি! আগেতো কখনও এমন হয়নি? দৌড়াতে দৌড়াতে আরও একবার স্মরণ করে আশারদ রাজনীতির কথা। রাজনীতি মনে হয় মৌসুমী হাওয়ার মত ঘন ঘন ভোল পাল্টায়। সেসব বোঝার চেষ্টা করে সে, কিন্তু বুদ্ধিতে কুলায় না। সবকিছু কেমন ঘোলাটে লাগে। কোন দুঃখে যে সে আজকে মালদার মালায়নটার সিন্ধুক ভেঙ্গে ছিল? ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ। পুলিশের তাড়া খেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ভাবে একবার আশা ডাকাত- লিডার ইচ্ছা করলে কিছু একটা করতে পারে তার জন্যে, হয়তো করবেও। বুঝতে পারে আশারদ- উপ রের মারফতী লেভেলে দেনা-পাওনা নিয়ে কিছু একটা গড়বড় হয়েছে। তারই ঠ্যলা এই পুলিশের গোল্লাছুট। দুদিন পরে সব ঠিক। শুধু নিজের পেট পালার জন্যতো সে এসব করছে না, ধর্মেওর একটা ব্যাপার আছে এখানে, আছে রাজনীতিরও একটা ফয়সালা। এসব কোন ব্যাপারই না তার জন্যে।
পুলিশ হচ্ছে খ্যাপা কুত্তার মত। পাগলা কুকুরের হাত থেকে জানটারে আগে বাঁচাতে হবে। দৌড়ে দৌড়ে জান শেষ। বাড়ীতে এসে উঠে আশারদ। এটা তার বাড়ী। অনেকখানি নিরাপদ জায়গা তার জন্য। আটচালা কাচাপাকা ঘরের মূল দরজাটা আলো করে বসে আছে আশারদের বুড়ী মা। বয়স সত্তরের কোঠায়। ফুরফুরা সাদা বুড়ী। পান চিবোয় আর কথা বলে।
-বাজান, আইসলে নাকি? অত হাপাচ্ছ কেন বাপধন?
মায়ের কথার জবাব দেবার সময় নেই আশারদের। আপাতত তাকে ঘরের ভেতরে ঢাবার মাঁচার উপরে আত্তগোপনে যেতে হবে- পালাতে হবে। পিড়ি পেতে বসে থাকা বৃদ্ধা মায়ের কোলের ভেতরে টাকার বান্ডিল গুলো রেখে আশারদ অদৃশ্য হয়ে যায় টোঙ্গের আড়ালে।
টাকার বান্ডিল নাড়াচাড়া করার অভ্যাস আছে বুড়ীর। তার ছেলে ‘কামাই সুদ’- রোজগারী। তাকে তাই এসব করতে হয়। বুড়ীর অমন সোনার টুকরো ছেলের কদর এই দেশের মানুষ বুঝলো না- পুলিশও না। মা-গত প্রাণ তার ছেলের। এই গ্রামের গরীব দুঃখীদের জন্যেও তার হাত খোলা। কে না উপকার পেয়েছে তার পূত্রের কাছ থেকে। বড় বেশি রাগ হয়, অভিমান হয় এই দেশের পুলিশের উপরে, তার ছেলেটারে আবার ধাওয়া করেছে। কি এমন করেছে সে?
পুলিশের কথা চিন্তা করতে না করতে দারোগা পুলিশ হাজির হয়ে যায় সাদা বুড়ীর সামনে। ঘরে ঢোকার দরজাটা আগলে বসে আছে বৃদ্ধা।
-এই বুড়ী, তোমার ছাওয়াল কই?
-জানিনে বাবা। আশারদ সেই সকালে বেরোয় গেছে, এহনও তো ফেরেনি।
-এই বুড়ী, তুমি মিথ্যে কথা বলতাছো। সইরা বসো তুমি দরজা থেইকা। আমরা ঘর সার্চ করুম।
পুলিশ জাওয়ানদের মুখে খিস্তি ওড়ে। সেখানে নাছোড়বান্দা বুড়ীর জন্যে নরম কথা, ভক্তি-শ্রদ্ধায় মাখামাখী শব্দ উচ্চারিত হয় কচিৎ। এটা তাদের কাজের সময়। কাজের কথা এমনই হয়। সাদা বুড়ী সত্যিই নাছোড়বান্দা। দরজা থেকে তাকে একচুলও নাড়ানো যায় না। ধৈর্য্যচ্যুত দারোগা বুড়ীকে একনিমেষে ফুটবল বানিয়ে ফেলে। বড় এক লাথির আঘাতে বৃদ্ধা কাত হয়ে পড়ে যায় বারান্দার পাশে। বড় বড় টাকার অনেকগুলো বান্ডিল ফুরফুরা সাদা বুড়ীর কোলের ভেতর থেকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অবাক হয় সবাই, বিষ্ময়ে সবার চোখ হয় ছানাবড়া। শুধু টাকার বান্ডিল গুলো অবাক হয় না- ওরা দাত বের করে হাসতে থাকে, শুধুই হাসতে থাকে। সোনার টুকরো আশারদকেও পাওয়া যায়। সাদা বুড়ী এখনও নাছোড় বান্দা। এতকিছুর পরেও ভয়ঙ্কর ভাবে বিশ্বাসী। মুখে তার অনবরত বিশ্বাসের কথা-পূত্রের উপরে অগাধ বিশ্বাসের প্রলাপ।
-বিশ্বাস করেন, দারোগা সায়েব, আমার ছাওয়াল চোর-ডাকাত কিচ্ছু না। সে বড় চাকরী করে। তার মালিক এই দ্যাশের বড় একজন মানুষ। আফনারা তারে চেনেন। সে তারে অনেক বেতন দেয়। এই সব ট্যাহা তার রোজগারের। ওরে ছাইড়ে দেন, আফনেরা।
দারোগা সাহেবের পা জড়িয়ে ধরে বৃদ্ধার আর্তি ঝুঝি আর শেষ হয় না। ভুল বকা বুড়ীর দিকে কেউ তেমন নজর দেয় না। জওয়ানরা তাদের বাধাছাদায় ব্যস্ত। গ্রামবাসীরা বাড়ীটারে ঘিরে ভিড় করেছে। তারা চোখে বিস্ময় আর লুকোন ঘৃণা নিয়ে দেখছে আশা ডাকাতের পতন দশা। তারা বুড়ীর মত অত বেশি ঈমান রাখে না। তারা জানে আশা ডাকাতের বৃত্তান্ত। মনের ভেতরে সযত্নে তারা ঘৃণাগুলো লুকায়ে রাখে, বেরিয়ে আনতে পারে না, কারন তারা জানে খুব অল্প কিছু দিনের ভেতরে আশারদ তার সিংহাসনে এসে বসে পড়বে। আবার তাদের রাজা হবে। রাজা হতে গেলে বেশি বুদ্ধি লাগে না- আমজনতাকে একটু খানি ভয় পাইয়ে দিতে পারলেই হলো।
কোন কিছুতে দারোগার মন টলেনা। এক সময় দারোগার পা ছেড়ে বৃদ্ধা ছেলের গা ধরে- তার পয়ত্রিশ পেরোন মুখে চাপদাড়ী সোনার টুকরো ছেলে। ছেলের গা ধরে ধরে বুড়ী ধাক্কায় আর চিৎকারে পাড়া মাথায় তোলে- স্নোহান্ধ নির্বোধ বৃদ্ধা।
-বাজান, এগোরে তুমি কইয়ে দেও- এসব তুমার রোজগারের টাহা। কইয়ে দেও সবাই শুনুক। কও, বাজান কও।
বৃদ্ধার কথা প্রলাপ হয়ে বাতাসের সাথে মিশে যায়। তার সোনার ছেলের সেদিকে যেন কোন হুশ নেই। অবাক চোখে পলকহীন তাকিয়ে থাকে আশা ডাকাত বৃদ্ধা মায়ের চোখের দিকে, মুখের দিকে। একটা কোন শব্দ তার মুখ থেকে বের হয় না। একসময় কোমরের দড়িতে হ্যাচকা টান পড়ে। মায়ের চোখ থেকে চোখ নামিয়ে ফেলে আশারদ। একটা চোরা বিষকাটা যেন কোথা থেকে এসে তার কলিজায় বেঁধে। ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণায় কুকুড়ে যায় সে। বুঝতে পারে আশারদ এ কাঁটা বুড়ী নির্বোধ মায়ের সাথে প্রতারণার কাটা। এর খোঁচা সহজে আরোগ্য হবার নয়। বুঝতে পারলেও কিছু করার নেই আশা ডাকাতের। আশারদ সত্যিকারের পেশাদার- ভাবের জগতে বিচরন তার নয়। মুসা নবীর হাতে যাদু ছিল- সে যাদুতে লাঠি সাপ হয়ে যেত। তার আছে সমস্ত শরীরে যাদু। সে যাদুর মায়ায় কোমরের দড়ি ফুলের মালা হয়ে গলায় ঝুলবে তার। সেটা শুধু সময়ের ব্যপার মাত্র। তার চেয়ে সে যেমন আছে তেমন থাক। অন্ততঃ মায়ের কাছে সে যেমন আছে তেমন থাকুক- বড় কোন চাকুরে, ওথবা বড়-রোজগারী ছেলে হয়ে থাক। কারণ সে আশারদ- আশা ডাকাত। হাজার হলেও তার একটা নীতি আছে- ধর্ম আছে।
গল্পটা অনেক সুন্দর হয়েছে।শুধু ধর্মভিত্তিক রাজনিতীই নয় অন্যান্ন রাজনিতীও কিন্তু এজাতীয় সন্ত্রাসবাদকে প্রত্যক্ষ মদদ দেয়।গল্পে অন্ধ পুত্রস্নেহের ব্যাপারটা ভালো লেগেছে।সমাপ্তির অংশটুকু সবচাইতে ভালো লেগেছে। ধন্যবাদ………………… (F)
@ছন্নছাড়া,
ধন্যবাদ আপনাকে, গল্প পড়ার জন্য।
” হাজার হলেও তার একটা নীতি আছে- ধর্ম আছে।”
মানুষের নীতি কি মানুষের ধর্ম? না, মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য,আচার-আচরনই তার ধর্ম।
“মানব ধর্ম”কে বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে সুসমন্বয় করার জন্য যে কতগুলি নিয়মনীতি, বিধিবিধান প্রয়োজন পরে সেগুলিও ধর্ম। সুতারাং ধর্ম সাধানতঃদুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
ডঃ মোতাহের হোসেন চৌধুরীর মতে,”ধর্ম সাধারণ কালচার, কালচার শিক্ষিত লোকের ধর্ম।”
মানুষের ধর্ম অসংখ্য চিরপরিবর্তনশীল,এ স্বভাব-ধর্মকে বিশ্ব-প্রকৃতির সঙ্গে সুসমন্বয় সাধনের সর্বাঙ্গিন সুন্দর ব্যবস্থার লক্ষ্যে আমাদের কাজ করতে হবে।
আপানার গল্পটি আমাদের বাঙলাদেশের চির চেনা-জানা,সামাজিক-পরিবেশের বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠেছে, ধর্ম-মাতাল সমাজের আর্থ-সামাজিক,রাজনৈতিক ভিত্তিগুলি কুসংস্কার, অজ্ঞতা, অন্ধকারচ্ছন্ন ভয়াবহ।
দেশ রক্ষকের ভুমিকায় যারা আছেন তারাও এর অবসান চায়না,বরং এ ব্যপারে জনগণকে সহয়তা করছে। তারা চায় জনগণ যত বেশি অজ্ঞ, অসচেতন,ধর্মান্ধও কুসংস্কারে নিমজ্জিত থাকবে ততই তাদের জন্য মঙ্গল, কারন এগুলিকে পুঁজি করে আরও বেশীদিন ক্ষমার আসনে নিচিন্তে বসে থাকা যাবে। কিন্তু আমার ধারনা অচিরে এর অবসান ঘটবে…। মানুষের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে, অবচেতন মন-মস্তিস্কে,আসবে চেতনা, যে চেতনায় গড়ে উঠবে মুক্ত-স্বাধীন, স্বনির্ভর রূপসী সোনার বাংলাদেশ…।।
আপনার জন্য রইল আমার অনেক শুভ কামনা……
@শামিম মিঠু,
আপনার অনুভুতি, বিশ্লেষন এবং প্রকাশ সঠিক। ধন্যবাদ পড়ার জন্য।