শকুনি আমলে সর্বক্ষেত্রেই
বৈষম্য ছিল আকাশ-পাতাল।
আমাদের উপরে পদে পদে চলছিল নিষ্পেষণ, নিপীড়ন।
তারপর শকুনিরা দিল
আমাদের হৃৎপিণ্ড ধ’রে টান।

ওরা আমাদের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল,
কেড়ে নিতে চেয়েছিল আমাদের বর্ণমালা।
এই ভাষা তো শুধু
আমাদের মুখের বুলি নয়!
এই ভাষা আমাদের হৃদয়
হতে নিঃসৃত হয়।

এই ভাষা কেবল মোদের
ভাব প্রকাশের মাধ্যম নহে।
এই ভাষা মোদের জীবনের কথা কহে।
এই ভাষা মোদের হৃৎপিণ্ডে সুরক্ষিত
মোদের ধমনীতে প্রবাহিত।

বাংলার পাখি গান গায় বাংলায়,
বাংলার নদী কথা কয় বাংলায়,
বাংলার বৃষ্টি কাঁদে বাংলায়,
বাংলার বাউল গায় বাংলায়,
বাংলার মাঠে ফসল হাসে বাংলায়,
ফুল হাসে বাংলায়,
বাংলার আকাশে চাঁদ হাসে বাংলায়,
বাংলার মা—শিশুকে ঘুম পাড়ায়
ঘুম পাড়ানি গান গেয়ে; বাংলায়।

নির্দয় পাষাণীরা আমাদের ফুল-পাখি-নদী
সকলের ভাষা কেড়ে নিয়ে
আমাদেরকে বাকরুদ্ধ ক’রে মারতে চেয়েছিল।
আমাদের বর্ণমালা কেড়ে নিয়ে
আমাদেরকে ওদের বর্ণমালায় শিক্ষা দিতে চেয়েছিল।

নিশ্চিহ্ন ক’রে দিতে চেয়েছিল
বিন্দু বিন্দু ক’রে গ’ড়ে তোলা
আমাদের হাজার বছরের
অমূল্য সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সিন্ধু।
ওরা চেয়েছিল আমরা নির্বাক, মূক হয়ে
বলতে না পারার হৃদয় গুমরানো
অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছটফট ক’রে মরি।

বাংলার তরুণেরা মেনে নেয়নি
এই বর্বরোচিত অন্যায়।
মাতৃভাষা রক্ষার জন্য হাজারো তরুণের
তাজারক্ত এক নিমেষে টগবগিয়ে উঠেছিল।
বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল ছাত্রছাত্রীরা।
তারা মৃত্যু উপেক্ষা ক’রে
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ হতে
নেমে এসেছিল রাজপথে।

তাদের জোরালো কণ্ঠে প্রকম্পিত
হয়েছিল বাংলার জল-স্থল।
তারা বজ্রকন্ঠে আকাশ কাঁপিয়ে
স্লোগান দিয়েছিল,”রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।“
এজন্যে পিশাচীরা গুলি চালিয়েছিল
তাদের উপর এলোপাথাড়ি।
বাংলার সন্তানের রক্তে
পিচ্ছিল হয়েছিল বাংলার রাজপথ।
বাংলামায়ের দেহের উপরে
প’ড়ে ছিল তারই সন্তানের লাশের স্তূপ।
আমরা রক্তের মূল্যে, প্রাণের মূল্যে
পেয়েছিলাম মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার।

পৃথিবীর আর কোনো ভাষার উপরে
শকুনি হামলা হয়েছিল কি?
এই পৃথিবীতে ভাষার জন্যে
প্রাণ দিয়েছে আর কোন জাতি?
শকুনের কবল থেকে মাতৃভাষাকে
ছিনিয়ে এনেছে আর কোন জাতি?

আমরাই সেই গর্বিত জাতি,
মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে
প্রাণ তুচ্ছ করেছিল যে জাতি।
আমরাই নিজভাষার তরে, নিজভূমে
হারায়েছি আপনার ভাই, আপনার জ্ঞাতি।

এই বর্ণমালা আমাদের রক্তে মোড়ানো,
এর প্রতিটি অক্ষর আমাদের রক্তে লেখা।
আমাদের প্রাণের মূল্য এই ভাষা;
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, আমাদের প্রাণের ভাষা।