আবুল কাশেম

নানা কারণে এই ধারাবাহিক রচনাটি কিছুদিনের জন্য স্থগিত ছিল। বাকী অংশ এখন নিয়মিত প্রকাশের আশা রাখছি।

[রচনাটি এম, এ, খানের ইংরেজি বই থেকে অনুবাদিত “জিহাদঃ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও ক্রীতদাসত্বের উত্তরাধিকার” গ্রন্থের ‘ইসলামি ক্রীতদাসত্ব’ অধ্যায়ের অংশ এবং লেখক ও ব-দ্বীপ প্রকাশনের অনুমতিক্রমে প্রকাশিত হলো।]

ইসলামি ক্রীতদাসত্ব, খণ্ড ১০

লেখক: এম, এ, খান

সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্তি: সামরিক বাহিনী ছিল আরেকটা প্রধান প্রকল্প যাতে ক্রীতদাসদেরকে বড় সংখ্যায় নিযুক্ত করা হতো। উত্তর আফ্রিকায় মুসা ৩০,০০০ ক্রীতদাসকে তার সেনাবাহিনীতে যুক্ত করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে সুলতান মৌলে ইসমাইল ২৫০,০০০ ক্রীতদাসে গড়া একটি শক্তিশালী কৃষ্ণাঙ্গ-বাহিনী রাখতেন। মরক্কো, মিশর ও পারস্যে সে আমলে ৫০,০০০ থেকে ২৫০,০০০ ক্রীতদাস দ্বারা গঠিত মুসলিম সেনাবাহিনী স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপলের পতন ঘটানো সে ভয়ঙ্কর জ্যানিসারি বাহিনী নীরেট ক্রীতদাসদের দ্বারাই গঠিত ছিল। দিল্লির প্রথম দাস সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবেক ছিলেন সুলতান মোহাম্মদ গোরীর ক্রীতদাস। ১২৯০ সাল পর্যন্ত দিল্লির সব সুলতানই ছিলেন ক্রীতদাস। তাদের সেনাবাহিনীও প্রধানত বহির্দেশ থেকে আনা ক্রীতদাস দ্বারা গঠিত ছিল।

অনেক মুসলিম ও অমুসলিম ইতিহাসবিদ ও লেখক মুসলিম শাসক-কর্তৃক সেনাবাহিনীতে ক্রীতদাসদেরকে নিয়োগকরণের এ নীতিকে এক মহৎ কাজ ও ক্রীতদাস মুক্তকরণ প্রক্রিয়া বলে গর্ব করেন। তাদের যুক্তি হলো: এরূপ মহৎ কাজ ক্রীতদাসদেরকেও সামরিক বাহিনীর উচ্চপদে পৌঁছানোর সুযোগ দেয়, এমনকি তারা শাসকও হয়ে যেতো। এটা সত্য যে, অনেক ক্রীতদাসই সেনাবাহিনীতে উচ্চপদে আসীন হয়েছে; কেউ কেউ চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শাসক-পদেও অধিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এসব দৃষ্টান্ত মুসলিম শাসকদের বদান্যতার ফল ছিল না, বরঞ্চ সেটা ছিল নিজ স্বার্থে তাদের একটা প্রয়োজন বা বাধ্যকতা: যেমন বিজয় অব্যাহত রাখতে, রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটাতে ও পরাজিতদের কাছ থেকে আরো বেশি লুণ্ঠিত মালামাল, ক্রীতদাস ও রাজস্ব সংগ্রহের খাতিরে। এটা কাজ করতো তাদের বর্বরতা, নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা এবং বিধর্মীদেরকে হত্যা ও ক্রীতদাসকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার হাতিয়ার হিসেবে। প্রত্যেকটি ক্রীতদাসের ক্ষমতার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিতকরণ চরম নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা ও হাজার হাজার, লাখ লাখ নিরীহ মানুষের জীবন ধ্বংসের পথ তৈরি করেছে। প্রত্যেক ক্রীতদাস, যারা সাধারণ এক সৈনিক বা যোদ্ধা হয়েছে, তারা কয়েকজন থেকে বহু নিষ্পাপ জীবন ধ্বংস করেছে।

৬,০০০ আরব যোদ্ধা নিয়ে দেবাল অধিকারের পর (৭১২) মোহাম্মদ বিন কাসিম তার বাহিনী সম্প্রসারিত না করে সামনে এগুতে পারেনি। সুতরাং এক-একটা নগরী দখলের পর তার সেনাবাহিনী সংহত ও সম্প্রসারণের জন্য তাকে সময় নিতে হয়েছে। সম্ভবত ক্রীতদাসদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক লোককে শর্তহীনভাবে সামরিক বাহিনীতে নিযুক্ত করতে হয়েছিল তাকে (অন্ততঃ উত্তর আফ্রিকায় সেনাধ্যক্ষ মুসা সে প্রক্রিয়ায় তার সেনাবাহিনী সম্প্রসারিত করেছিলেন)।[১৪২] সামরিক শক্তি সম্প্রসারণের পর সে ইতিমধ্যে বিজিত ভূখণ্ডগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সামনে এগিয়ে গিয়েছে নতুন বিজয় অভিযানে। সিন্ধুতে আসার পর কাসিম প্রায় অর্ধ-ডজন বড় ধরনের অভিযান চালায়। তার বাহিনী উত্তরোত্তর বেড়ে দাঁড়ায় ৫০,০০০ সৈনিকে। নতুন সংযোজিত যোদ্ধাদের বিশেষ একটা অংশ সম্ভবত এসেছিল বন্দিকৃত ভারতীয় ক্রীতদাসদের মধ্য থেকে। বারানী লিখিত ‘রাজাই সেনাবাহিনী, সেনাবাহিনীই রাজা’ উক্তিটি লুণ্ঠনকারী মুসলিম শাসন ও বিজয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় গুরুত্বের কথা প্রতীয়মান করে। সুতরাং সেনাবাহিনীতে ক্রীতদাসদেরকে নিয়োগকরণ প্রক্রিয়া তাদের প্রতি মুসলিম শাসকদের আনুকূল্য প্রদর্শন ছিল না, বরং তা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। মুসলিম শাসকদের জন্য সেটা ক্রীতদাসদেরকে মুক্ত কিংবা উন্নীতকরণের লক্ষ্যে কোনো মহানুভবতা দেখানোর কাজ ছিল না; বরং সেটা ছিল নিজেদেরই (শাসকদেরই) ভাগ্য গড়ার বা বর্ধিতকরণের জন্য বাধ্যবাধকতা। সর্বোপরি সামরিক বাহিনীতে ক্রীতদাসদের অন্তর্ভুক্তি তাদের নিজস্ব ইচ্ছার ফসল ছিল না, বরং ছিল বাধ্যকতা। আর সেনাবাহিনীতে নিয়োগকৃত প্রত্যেক ক্রীতদাস বহু নিরীহ অমুসলিমের জীবন ধ্বংস ও তাদেরকে নিষ্ঠুরতার শিকারে পরিণত করার পথ খুলে দিয়েছিল, যারা নিকট অতীতে ছিল তাদেরই স্বধর্মী।

৭৩২ সালে ফ্রান্সে টুরের যুদ্ধে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতিসহ মুসলিমরা পরাজিত হলে ইসলামি বিজয়ের জোয়ার কিছুটা অবদমিত হয়ে পড়ে। এ পর্যায়ে মুসলিম বাহিনীর জিহাদী জোশ সম্ভবত কমে যাচ্ছিল। বিশাল ভূখণ্ড বিজয় ও বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ আহরণের পর আরব ও পারস্য সেনারা সম্ভবত রক্ত-ঝরা যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার উৎসাহ-উদ্দীপনা, যা তাদের জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, কিছুটা হারিয়ে ফেলেছিল। এ সময় উত্তর আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ ও বার্বার ক্রীতদাসরা একটা বিশাল মুসলিম বাহিনী গঠন করে, যারা ইউরোপে জিহাদী অভিযান অব্যাহত রাখে। ইসলামি সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে মুসলিম শাসকরা পেয়ে যায় তুর্কি জনগোষ্ঠীকে, যাদের ছিল যুদ্ধ ও রক্তপাতে অশেষ উদ্দীপনা। আব্বসীয় খলিফারা, বিশেষত খলিফা আল-মুতাসিম (৮৩৩-৪২), বিপুল সংখ্যায় তুর্কীকে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা শুরু করেন, অবসাদগ্রস্ত আরব ও পারস্য সেনাদেরকে সরাতে। সেনাবাহিনীতে নিয়োগকৃত এসব তুর্কির অধিকাংশই ছিল ক্রীতদাস, যাদেরকে যুদ্ধের মাধ্যমে বন্দি করা হয়েছিল; সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত করতে তাদেরকে দিউশারমির মতো প্রক্রিয়ায় যোগাড় করেও প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। পরবর্তী খলিফারাও এ প্রবণতা অব্যাহত রাখেন; ফলে তুর্কিরা মুসলিম সেনাবাহিনীতে মূল শক্তি হয়ে উঠে এবং আরব ও পারস্যদের কর্তৃত্ব বিলুপ্ত হয়।

শক্তিধর তুর্কি সেনানায়কদের মধ্যে কেউ কেউ পরবর্তীকালে খলিফার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহ করে নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। প্রথম স্বাধীন তুর্কি রাজত্ব শুরু হয় ৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে মিশরে। ইসলামি সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে আল্পতাগীন নামে এক তুর্কি ক্রীতদাস শাসক, যিনি ছিলেন ট্রানসক্সিয়ানা, খোরাসান ও বোখারার পারস্য শাসক (সামানিদ বংশ) আহমদ বিন ইসমাইলের (মৃ. ৯০৭) ক্রয় করা ক্রীতদাস। সামরিক দক্ষতার কারণে সামানিদ গভর্ণর আব্দুল মালিক (৯৫৪-৬১) আল্পতাগীনকে ৫০০টি গ্রাম ও ২,০০০ ক্রীতদাস সেনার দায়িত্বে নিয়োগ করেন। আল্পতাগীন পরে গজনীতে এক স্বাধীন শাসকে পরিণত হন। তিনি সবুক্তাগীন নামে আরেক তুর্কি ক্রীতদাসকে ক্রয় করেছিলেন, যিনি আল্পতাগীনের মৃত্যুর পর ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সুযোগ গ্রহণ করেন। আল-উত্বি লিখেছেন: সবুক্তাগীন ধর্মযুদ্ধের নামে হিন্দুস্তানের অভ্যন্তরে বারবার হানা দেয়। যাহোক সবুক্তাগীনের পুত্র ছিলেন সুলতান মাহমুদ গজনী, যিনি ভারতের বিধর্মীদের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক ধর্মযুদ্ধ পরিচালনা করেন। এর প্রায় দেড় শতাব্দী পরে আরেক ক্রীতদাস সুলতান, সুলতান মোহাম্মদ গোরী ভারতীয় স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্বের উপর সর্বশেষ আঘাত হেনে দিল্লিতে মুসলিম সুলতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। গজনীতে অবস্থানকৃত সুলতান গোরীর মৃত্যুর পর সেনাপতি পদে উন্নীত তার তুর্কি ক্রীতদাস কুতুবুদ্দিন আইবেক নিজেকে দিল্লির প্রথম সুলতান ঘোষণা করেন। প্রথম দিকে দিল্লির সুলতানদের সেনাবাহিনী পরিচালনা প্রধানত বিদেশী বংশোদ্ভূত ক্রীতদাসদের দ্বারাই গঠিত ছিল। বিভিন্ন বিদেশী জাতীয়তার তুর্কি, পারস্য, সেল্জুক, ওঘুস (ইরাকে বসবাসকারী তুর্কি), আফগান ও খিলজি’দেরকে ব্যাপক সংখ্যায় ক্রয় করে গজনী ও গোরীয় বাহিনীতে নিয়োগ করা হতো। সুলতান ইলতুতমিসের কন্যা সুলতানা রাজিয়ার (শাসনকাল ১২৩৬-৪০) বাহিনীতে আবিসিনিয়া থেকে কিনে আনা কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসরা ছিল প্রধান শক্তি।

খিলজি শাসনের সময় (১২৯০-১৩২০) ভারতে প্রথম বারের মতো অক্রীতদাস বা মুক্ত ব্যক্তি শাসক পদে ক্ষমতাসীন হয়। এ সময় ক্রীতদাস করে জবরদস্তিমূলকভাবে ইসলামে ধর্মান্তরিত ভারতীয়রাও সামরিক বাহিনীতে আসা শুরু করে। এর ফলে গোঁড়া মুসলিমরা বিরক্ত হয়। তারা সেনাবাহিনীতে ম্লেচ্ছ বা হীন জাতীয় ভারতীয়দের অন্তর্ভুক্তিকে ঘৃণা করতো। কিন্তু এ সময় মোঙ্গলরা ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে আক্রমণ করে আসছিল। তাদেরকে প্রতিরোধ করতে সুলতানের শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন প্রয়োজন পড়ে। সুতরাং ভারতীয় মুসলিম ক্রীতদাসদেরকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য হয়ে উঠে। অধিকন্তু খিলজিরা ক্ষমতা দখল করেছিল তুর্কিদেরকে বিতাড়িত করে, যারা অবিরাম বিদ্রোহ করে আসছিল। অতএব আনুগত্যের বিষয়টি চিন্তা করেও খিলজিরা সেনাবাহিনীতে ব্যাপকভাবে তুর্কিদের নিয়োগ করতে পারতো না। পরে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক (শাসনকাল ১৩৫১-৮৮) ইসলামে ধর্মান্তরিত মোঙ্গলদের আক্রমণের গন্ধ পেলে (১৩৯৮ সালে সত্যি সত্যি তিমুরের বর্বর আক্রমণ ঘটে) তারও বিশাল বাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য হয়ে পড়ে। ফলে ভারতীয়রা সর্বপ্রথম মুসলিম সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অনুমতি পায়। বিধর্মী থেকে ধর্মান্তরিত মুসলিমদেরকে সেনাবাহিনীতে অক্তর্ভুক্তির ব্যাপারে একই প্রকারের বিরোধিতা ছিল অন্যান্য স্থানেও। মিশরে স্থানীয় কপ্টিক খ্রিষ্টান, যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল, তারা দীর্ঘদিন সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি।

ভারতীয় যোদ্ধাদের ভূমিকা: সেনাবাহিনীতে ভারতীয় যোদ্ধারা (অধিকাংশই ধর্মান্তরিত ক্রীতদাস) ‘পাইক’ নামে পরিচিত ছিল। সাধারণত অত্যন্ত নিম্নপদে তাদেরকে নিয়োগ করা হতো পদাতিক-সেনা হিসেবে। যুদ্ধে ধৃত ক্রীতদাস কিংবা আনুগত্য-উপঢৌকন হিসেবে প্রাপ্ত ক্রীতদাসদের মধ্য থেকে তাদেরকে বাছাই করা হতো। শেষ দিকে কিছু হিন্দুও জীবনধারণের তাগিদে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। পাইকরা সব ধরনের টুকিটাকি কাজে নিয়োজিত হতো, যেমন হাতি ও ঘোড়া দেখাশোনা করা। ঘোড়-সওয়ার বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত কাজেও তারা নিয়োজিত হতো। ভারতে মুসলিম সুলতান ও সম্রাটরা বিশাল সেনাবাহিনী রাখতেন। মোরল্যান্ড উল্লেখ করেছেন যে, আকবরের শাসনামলে ‘‘যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধকারী একজন মুঘল যোদ্ধার দুই থেকে তিনজন করে চাকর থাকতো।’’[১৪৩] স্বাভাবিকভাবেই, শেষের দিকে ভারতের মুসলিম সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন কাজে অসংখ্য ক্রীতদাস নিয়োগ করা হতো। সামরিক অভিযানকালে পাইকরা সেনাবাহিনীর অগ্রসর হওয়ার জন্য ঝোপ-জঙ্গল কেটে পথ তৈরি করতো। বিশ্রাম নিতে থামলে বা গন্তব্যে পৌঁছুলে পাইকরা শিবির স্থাপন করতো, তাঁবু খাটাতো। আমির খসরু লিখেছেন: কখনো কখনো সর্বোচ্চ ১২,৫৪৬ গজ পরিধি জুড়ে শিবির স্থাপন করা হতো।[১৪৪]

যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু-পক্ষের প্রাথমিক আক্রমণ সামাল দিতে পাইকদেরকে সম্মুখভাগে মোতায়েন করা হতো। আল্কালকাসিন্দি ‘সুভ-উল-আসা’ গ্রন্থে লিখেছেন: ‘সম্মুখভাগের প্রচণ্ড আক্রমণ থেকে তারা পালাতে পারতো না। কারণ তাদের ডানে-বাঁয়ে থাকতো ঘোড়া এবং পিছনে হাতি, যাতে কেউ দৌড়ে পালাতে না পারে।’ পর্তুগিজ রাজকর্মচারী ডুয়ার্ত বারবোসা (১৫১৮) তার প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণীতে লিখেছেন: ‘পাইকরা তলোয়ার, ছোরা ও তীর-ধনুক বহন করতো। তারা ছিল অত্যন্ত দক্ষ তীরন্দাজ এবং তাদের ধনুকগুলো ইংল্যান্ডের ধনুকের মতো বড় আকারের। তারা অধিকাংশই হিন্দু।’ তবে কিছু ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিন্দু ধর্মান্তরিত মুসলিম ক্রীতদাসও, যেমন মালিক কাফুর, মালিক নায়েক, সরঙ্গ খান, বাহাদুর নাহার, শাইখা খোখার ও মাল্লু খান প্রমুখ সেনারা অবশ্য ক্ষমতার উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন তাদের সামরিক শৌর্য ও সুলতানের প্রতি আনুগত্যের কৃতিত্বে।[১৪৫]

মোটকথা: সেনাবাহিনীতে ভারতীয় ক্রীতদাসরা যোদ্ধা বা সৈনিকদের চাকর-বাকর, আস্তাবলে ঘোড়া-হাতির তত্ত্বাবধায়ক, যুদ্ধের সম্মুখভাগে ছোরা-তলোয়ার ও তীর-ধনুক হাতে পদাতিকভাবে শত্রুর ভয়ঙ্কর প্রথম আক্রমণ প্রতিহত করাসহ সব রকমের টুকিটাকি কাজ করতো।

অন্যত্রও স্থানীয় সৈনিকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে অনুরূপ প্রবণতা ছিল। প্রাথমিক যুগে সেনাবাহিনীর বাইরে রাখার পর যখন ইসলামে ধর্মান্তরিত কপ্টিকদের নিয়োগ করা অনিবার্য হয়ে উঠে, ‘তখন তাদেরকে পদাতিক বাহিনীর দলে তালিকাভুক্ত করা হতো। সেনাবাহিনী বিজয় লাভ করলে তারা যুদ্ধের লুণ্ঠিত মালামালের হিস্যারূপে ঘোরসওয়ার যোদ্ধার অর্ধেক পেতো।’[১৪৬] মরক্কোতে ইসলামে ধর্মান্তরিত ইউরোপীয় বন্দিরা ছিল ক্রীতদাসদের মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণিত। ভয়ঙ্কর বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার জন্য তাদেরকে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হতো। শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণে তাদেরকে সম্মুখভাগে নেতৃত্ব দিতে হতো এবং শত্রুর আক্রমণ মোকাবেলা করা থেকে তাদের পালাবার কোনো পথ ছিল না। যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার চেষ্টা করলে বা পালানোর পথ খুঁজলে তাদেরকে কেটে টুকরা টুকরা করা হতো।[১৪৭]

রাজকীয় কারখানায় নিয়োগ: ব্যাপকহারে ক্রীতদাস নিয়োগের আরেকটি ক্ষেত্র ছিল রাজকীয় কারখানা। গোটা সুলতানাত ও মুঘল শাসনামলে ভারতে রাজকীয় কারখানাসমূহে ক্রীতদাসদের নিয়োগ করা হতো। রাষ্ট্রীয় ব্যবহারের যাবতীয় জিনিসপত্র এসব কারখানায় তৈরি করা হতো: যেমন স্বর্ণ, রূপা ও তামার নানারকম অলঙ্কারাদি, অন্যান্য ধাতুর জিনিসপত্র; বস্ত্র, সুগন্ধি, বর্ম, অস্ত্রশস্ত্র, চামড়ার দ্রবাদি, কাপড়-চোপড়, ঘোড়ার ও উটের গদি এবং হাতির পিঠের চাদর ইত্যাদি।[১৪৮] এসব কারখানা চালানোর জন্য হাজার হাজার ক্রীতদাসকে কারিগর শিল্পী বানানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। উচ্চপদস্থ আমির বা খানরা এগুলোর পর্যবেক্ষণে থাকতো। এসব কারখানাগুলোতে কাজ করার জন্য সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ১২,০০০ ক্রীতদাস নিয়োগ করেছিলেন। সুলতান বা সম্রাট, তাদের সেনানায়ক, যোদ্ধা ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় উন্নত মানসম্পন্ন ও সুন্দর জিনিসপত্র তৈরি করতো তারা। এছাড়াও তারা যুদ্ধের জন্য অস্ত্রপাতি, বিদেশী রাজা বা প্রভুর জন্য প্রেরিতব্য উপহার-সামগ্রী অত্যন্ত যত্নের সাথে তৈরি করতো। কমোডর স্টুয়ার্ড ও তার সঙ্গীরা মরক্কোতে সুলতান মৌলে ইসমাইলের কারখানা পরিদর্শন করে দেখতে পান: ‘‘কারখানাগুলো কাজে ব্যস্ত বয়স্ক লোক ও বালকে ভরা। তারা তৈরি করছে ঘোড়ার গদি, বন্দুকের কুঁদা, তরবারির খাপ ও অন্যান্য বস্তু।’’[১৪৯]

[আগামী পর্বে আলোচিত হবেঃ ক্রীতদাসদের ভাগ্যঃ রাজপ্রাসাদ ও দরবারে নিয়োগ]

সূত্রঃ

142. Large numbers of volunteer Jihadists from the Islamic world, seeing new opportunities for engaging in holy war against the infidels, also poured into Sindh to join Qasim’s army.

143. Moreland, p. 88

144. Lal (1994), p. 89-93

145. Ibid

146. Tagher J (1998) Christians in Muslim Egypt: A Historical Study of the Relations between Copts and Muslims from 640 to 1922, trs. Makar RN, Oros Verlag, Altenberge, p. 18

147. Milton, p. 135-36

148. Lal (1994), p. 96-99

149. Milton, p. 186

————–
চলবে—

ইসলামে র্বরতা (দাসত্ব অধ্যায় ১) )

ইসলামে বর্বরতা দাসত্ব অধ্যায় ২)

ইসলামে র্বরতা (দাসত্ব অধ্যায় ৩)

ইসলামে র্বরতা (দাসত্ব অধ্যায় ৪)

ইসলামে র্বরতা (দাসত্ব অধ্যায় ৫)

ইসলামে র্বরতা (দাসত্ব অধ্যায় ৬)

ইসলামে র্বরতা (দাসত্ব অধ্যায় ৭)