উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুরের মাও-সংসাং পাহাড় থেকে যে নদীর ধারা নেমে এসেছে তাই শ্রীহট্ট জেলার মাঝখান দিয়ে বয়ে বয়ে একসময় মেঘনা নাম ধারণ করেছে | সেই মেঘনা-পাড়ের ছোট্ট একটি গ্রাম – নাম তার সুবর্ণগ্রাম | গ্রামটির একপাশে নদী আর তিনদিকে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ | শীতে শ্যামল আর বসন্তে- গ্রীষ্মে সোনালী ধানের ক্ষেত | তাই থেকে বুঝি গ্রামটির নাম হয়েছে সুবর্ণগ্রাম | মেঘনার একেবারে কূল ঘেঁষে যে পাড়াটি – তার নাম দয়মন্তীপাড়া – এই নামটি কোথা থেকে এসেছে এই কালের কেহই তা জানে না এবং এই নিয়ে কেউ মাথাও ঘামায় না | এই পাড়ার একেবারে নদীপাড়ের প্রথম বাড়িটিই আমাদের | আমি এই বাড়ির আমার বাবা-মা অংশুমান আর অণিমা রায়চৌধুরীর একমাত্র সন্তান – অরিন্দম রায় চৌধুরী | আমাদের বাড়ি থেকে তিন বাড়ি – দয়াল মিস্ত্রী, হারাধন পন্ডিত আর চিত্রকুট রায়ের বাড়ির পরই অসংখ্য আম, কাঁঠাল ও সুপারি গাছে ঘেরা একটি বিশাল মনোরম বাড়ি – সবাই বলে ঠাকুর বাড়ি | এই বাড়ির মালিক নবনীত আর শর্মিতা গুহঠাকুরতা | তাঁদের একমাত্র কন্যা নন্দিনী গুহঠাকুরতা | যদিও কোনদিন জানার চেষ্টা করিনি তবে বোধ করি বয়সে নন্দিনী আমার প্রায় সমবয়সী তবে ঠাহর করতে কষ্ট হয় না যে বুদ্ধিতে সে আমার চেয়ে অনেক বেশী অগ্রগামিনী |

আমাদের এই ছোট্ট পাড়ায় আমার সমবয়সী আর কোন ছেলে ছিলনা আর ছিলনা নন্দিনীর সমবয়সী কোন মেয়ে | তাই নন্দিনী আর আমিই হলাম একে অপরের খেলার সাথী | সময় পেলেই কারণে-অকারণে এক দৌঁড়ে তিন বাড়ি পার হয়ে চলে যেতাম নন্দিনীদের বাড়িতে | তাদের বাড়ির বড় উঠানে দুইজনে মিলে খেলতাম গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা ও ভোঁ-দৌড় এবং মাঝে মাঝে বাড়ির পিছনের আমবাগানে লুকোচুরি আর কালে-ভদ্রে তাদের বাড়ীর ছাদে বসে ষোলোগুটি | এমনি করে করে নন্দিনী হয়ে দাঁড়ালো আমার একমাত্র বাল্য সখা | নন্দিনীর সাথে খেলায় এতটাই মগ্ন হয়ে থাকতাম যে তাকে কোনদিন ভালোকরে দেখার সুযোগ হত না | মনে পড়ে সেই দিনের কথা যেদিন নন্দিনীকে প্রথম ভালোকরে দেখলাম | আমার বয়স তখন কেবল ছয় পার হয়েছে | মা-বাবা আমাকে স্কুলে ভর্তি করাবেন | মাঘের শুক্লপঞ্চমী – আমাদের বাড়িতে সেদিন সকালে সরস্বতী পূজা – আমাদের পারিবারিক পুরোহিত পন্ডিত সর্বেশ্বর চক্রবর্তী মহাশয় এসেছেন – পূজার আয়োজন চলছে | পূজা-শেষে হবে আমার হাতে-খড়ি | নন্দিনী এসেছে তার মায়ের সাথে – গায়ে তার টুকটুকে লাল একটা ফ্রক, পায়ে লাল মোজা, ছোট্ট সুন্দর কচি দুই হাতে সোনার চিকন দুইখানা বালা , চুলে ক্লিপ দিয়ে আটকানো ঝুমকা লতা আর হাতের মুষ্ঠে ধরা একখানা বেলি ফুলের মালা | এসেই আমার কিছু বোঝার আগেই আমার মা-বাবা আর পন্ডিতমশায়ের সামনেই টুপ করে আমার গলায় পরিয়ে দিল সেই মালা | আমি লজ্জা পেলাম এবং এক অজানা বিস্ময়ে হতবাক আর আনন্দে আত্মহারা হয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ নন্দিনীর দিকে তাকিয়েছিলাম – মনে হলো সেদিনই বুঝি আমি তাকে প্রথম দেখলাম !

এর কিছুদিন পরই নন্দিনীও একই স্কুলে ভর্তি হলো | আমরা দুটিতে একসাথে স্কুলে যাই, একত্রে এক বেঞ্চে ক্লাসে বসি, এবং স্কুল ছুটির পর একসাথে বাড়ি ফিরি | প্রায় প্রতিসন্ধ্যায় কখনো নন্দিনীদের বাড়িতে তার বাবার কাছে বা আমাদের বাড়িতে আমার মা’র কাছে আমরা একত্রে পড়তে বসতাম | আমাদের বাড়ি থেকে অনতিদূরে ছোট্ট একটা পুকুর – কিংবদন্তী আছে বহুকাল পূর্বে কে একজন মাছ ধরতে গিয়ে জালের মধ্যে একসাথে দুটো সোনার মোহর পেয়েছিল – এর থেকে এর নাম হয়েছে সোনাপুকুর | সেই পুকুরে নন্দিনীর বাবা নন্দিনীকে আর আমাকে নিয়ে যেতেন সাঁতার শিখানোর জন্যে – আমরা মাস দুয়েকের মধ্যেই সাঁতার শিখে ফেলি | তারপর থেকে নন্দিনী আর আমি প্রায়ই সেই পুকুরে যেতাম স্নান করতে | গ্রামের আরো অনেক ছেলে-মেয়েদের সাথে মিলে সেই পুকুরে একত্রে অনেকক্ষণ ধরে সাঁতার কাটতাম | মনে পড়ে আষাঢ় মাসে যখন মুষলধারে বৃষ্টি নামত নন্দিনী আর আমি বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কদমফুল দিয়ে খেলতাম, আর বৈশাখ মাসে রাতে যখন কালবৈশাখী-ঝড় হত পরদিন ভোরে আমরা দুজনে মনের আনন্দে তাদের আর আমাদের বাড়ির আমবাগানের নীচে বিছিয়ে পড়ে থাকা অসংখ্য কাঁচা-পাকা আম কুড়াতাম | | এমনি ভাবে অনাবিল আনন্দের মাঝে নন্দিনী আর আমি বেড়ে উঠতে থাকি আর একধাপ একধাপ করে স্কুলের সিঁড়ি পার হয়ে কখন যেন আমরা পঞ্চম শেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছি – মনে হলো আমরা দুজনেই যেন কেমন একটু বড় হয়ে গেছি !

পঞ্চম শ্রেণীতে উঠে ক্লাসে নন্দিনী তার মেয়ে সহপাঠীদের সাথে আলাদা বেঞ্চে বসত, তবে লক্ষ করতাম মাঝে মাঝেই সকলের অলক্ষে সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাত | এটা বলাই বাহুল্য নন্দিনীর দিকে তাকানোর জন্য আমারও মন সারাক্ষণ কেমন যেন আনচান করত | আমি নানাছলে নন্দিনীর কাছে যেতাম | বন্ধুরা টিপ্পনি কাটত, আমি গ্রাহ্য করতাম না | অপেক্ষা করতাম কতক্ষণে স্কুল ছুটি হবে আর নন্দিনীর সাথে ঘোষাল পাড়ার পাশ দিয়ে, জমিদার বাড়ীর আম বাগানের মাঝখান দিয়ে আর পদ্ম পুকুরটার পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মজার মজার গল্প করতে করতে আনন্দে বাড়ি ফিরব | আরো একটু বড় হতেই কেমন করে জানি আমাদের দুই বাড়ীর অভিভাবকরা মিলেই সিদ্ধান্ত নিল নন্দিনী আর আমি একই প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়তে যাব | মনে পড়ে সপ্তাহে তিন দিন আমাদের স্কুলেরই প্রিয় শিক্ষক গুরুদয়াল পন্ডিতজীর কাছে যেতাম সনাতন ধর্মের পাঠ নেওয়ার জন্যে | পন্ডিত মশাই একদিন আমাদেরকে “মহাভারত”-এর কচ-দেবযানীর “বিদায় অভিশাপ ” গল্পখানি বললেন – কেমন করে স্বর্গের দেবতাদের পুরোহিত বৃহস্পতির পুত্র কচ মর্ত্যের অসুরদের গুরু দেবযানীর পিতা শুক্রাচার্যের কাছ থেকে সঞ্জীবনী বিদ্যা শিক্ষা লাভ করে দেবযানীর হাজার বছরের গভীর প্রেমকে উপেক্ষা করে তার হৃদয় ভঙ্গ করে আবার স্বর্গে ফিরে গেল | সেই গল্প শুনে নন্দিনী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছিল আর আমার প্রাণে নন্দিনীর জন্যে কেমন জানি এক অদ্ভুত মায়া জন্মেছিল | নন্দিনীর এমন দয়ার্দ্র হৃদয়ের পরিচয় পেয়ে পন্ডিত মশাই এর পর থেকে আমাদেরকে আর কোন দিন বিরহের গল্প বলতেন না | মনে পড়ে সেদিনই প্রথম পন্ডিতমশায়ের কাছে পড়া শেষ করে নন্দিনী সারা রাস্তা আমার হাত ধরে বাড়ী ফিরেছিল | সেদিন রাতে আমি ঘুমাতে পারি নি, সারারাত কেমন জানি নন্দিনীর জন্যে আমার অবুঝ কিশোর-মন ছটপট করেছিল !

আমাদের বাড়ীতে লাল ইট দিয়ে বাঁধানো তুলসীবেদীর গোড়াতেই ছিল একটি শেফালীফুলের গাছ | রাতে ঝরে পড়ত সেই ফুল | শরতের আর হেমন্তের সকালে তুলসীবেদীকে ঘিরে মাটিতে বিছিয়ে পড়ে থাকত অসংখ্য শেফালীফুল | প্রায় সকালেই নন্দিনী আসতো ফুল তুলতে – তাদের গৃহ দেবতার পূজার জন্যে | কিছু ফুল সে নিত আর কিছু দিয়ে যেত আমার মাকে আমাদের গৃহ-লক্ষীর পূজার জন্যে | আমি প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমাদের ঘর থেকে উঠানে যাওয়ার লাল পাকা সিঁড়িটায় বসে থাকতাম কখন নন্দিনী আসবে সেই প্রতীক্ষায় | নন্দিনীকে দেখে খুশি হতাম | ঠাকুরের পূজার ফুল নিতে আসত বলে সে স্নান করে আসত | সকালে সদ্য স্নান করে আসা সেই মনোরমা বালিকার এই ঊষাকালে আগমন আমার মনে রং লাগিয়ে যেত | বাম হাতে ফুলের সাজি ধরে কুসুম পেলব ডানহাতের কচি কচি আঙ্গুলে নন্দিনী যখন শিউলি ফুল কুড়াত আমি মুগ্ধ নয়নে নন্দিনীকে দেখতাম আর ভাবতাম নন্দিনী যদি একদিন আমার আরো আপন হত! মনে পড়ে একদিনের কথা | আমি অনেকক্ষণ সকালে সিঁড়িতে বসে আছি, নন্দিনী আসছেনা | অপেক্ষার যেন শেষ নেই | ভাবছি হয়ত আর আসবে না | এর মধ্যে হঠাৎ করেই তার আগমন | সেই ফুট ফুটে সুন্দর কিশোরী মেয়েটি আজই প্রথম এসেছে শাড়ি পরে | একখানা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, পায়ের গোড়ালি থেকে বেশ একটু উপরে পরা, আলতা পরা খালি পায়ে ঘুঙ্গুর, হাতে সবুজে-লালে মেশানো কাঁচের চুড়ি|এলোকেশী সদ্য-স্নাত নন্দিনীর স্নিগ্ধ-শুচিশুভ্র-কান্তি আমাকে সেদিন মুগ্ধ করলো – আমি পলকহীন দৃষ্টিতে নন্দিনীর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম | তারপর এক দৌঁড়ে গেলাম নন্দিনীকে ছুঁতে, নন্দিনী আমাকে ছুঁতে দিলনা আমি স্নান করিনি বলে কারণ সে ফুল নিচ্ছে ঠাকুর-দেবতার পূজার নিমিত্তে | স্নান না করে ছুঁলে পাপ হবে যে ! আমার মন খারাপ হয়েছিল | নন্দিনী বুঝতে পারল | লক্ষ করলাম নন্দিনী সেদিন অনেকক্ষণ ধরে অন্য দিনের থেকে আরো অনেক বেশি করে ফুল কুড়াল | আমাকে অবাক করে দিয়ে সেদিন বিকালে নন্দিনী আমার জন্যে গেঁথে নিয়ে এলো একখানা শিউলি ফুলের মালা | আমার একটা ছোট্ট কাঠের বাক্স ছিল, নন্দিনীর দেওয়া সেই মালাখানি আমি সেই বাক্সে তুলে রেখেছিলাম | আমি মাঝে মাঝেই গোপনে সেই বাক্স খুলতাম, সেই মালাখানি স্পর্শ করতাম আর তার মধ্যে নন্দিনীর হাতের স্পর্শ অনুভব করতাম | আজ এতদিন পরেও শুকিয়ে যাওয়া সেই মালাখানি সেই বাক্সে সযত্নে রক্ষিত আছে |

সময় গড়িয়ে চলে – আর নন্দিনীর সাথে আমার ঘনিষ্টতাও বেড়ে চলে | আমরা এখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে | দুজনেই এখন কখনো তাদের আবার কখনো আমাদের বাড়িতে সন্ধ্যায় মাঝে মাঝে একত্রে মাস্টারের দেওয়া পাঠানুশীলন সম্পন্ন করি | আমি আর নন্দিনী দুজনেই ক্লাসে ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের দলে | ইতিমধ্যে আমাদের স্কুলে সিলেটের ধরমণ্ডল থেকে একজন নতুন শিক্ষক এসেছেন – সিরাজুল আলম স্যার | তিনি খুব ভাল ছবি আঁকতেন এবং ছোট ছোট ছবি এঁকে তাঁর প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের উপহার দিতেন | একদিন তিনি লালফ্রক পরা একটা ছোট্ট মেয়ে নাচছে এমন একটা ছবি এঁকে নন্দিনীকে উপহার দিলেন | নন্দিনী খুব খুশি হল – আর আমার মনে কি যেন এক ভাবের উদয় হল | মন বলল আমিও যদি এমন সুন্দর ছবি এঁকে নন্দিনীকে উপহার দিতে পারতাম তবে নন্দিনী না জানি আরো কত খুশি হত | এর পর থেকে আমি সময় পেলেই আমাদের ঘরে টাঙানো ক্যালেন্ডারের বিভিন্ন ছবি দেখে দেখে আঁকার চেষ্টা করতাম | অনেক দিন চেষ্টা করতে করতে আবিষ্কার করলাম আমিও এখন ভালো ছবি আঁকতে পারি | মনে পড়ে তখনও পর্যন্ত আমার কোন রঙের পেন্সিল ছিল না | কয়েকদিন পরই নন্দিনীদের বাড়িতে তার জন্মদিন উপলক্ষে পূজা হবে | আমি মনে মনে চিন্তা করতে থাকলাম নন্দিনীকে তার জন্মদিনে কি উপহার দিব ? শেষে ঠিক করলাম তার জন্যে একটা সুন্দর ছবি আঁকব | মনে পড়ে তারপর থেকে সকাল সন্ধ্যায় বসে বসে খেলা আর খাওয়া উপেক্ষা করে অনেক সময় ধরে একটা সাদা কাগজে শুধু পেন্সিল দিয়ে নন্দিনীর জন্মদিন উপলক্ষে একটা গোলাকৃতির আল্পনা আঁকলাম আর আল্পনার ঠিক মাঝখানটায় লিখলাম “নন্দিনীর খুশির জন্মদিনে আমার আনন্দ-উপহার” | এই ছবিখানা পেয়ে নন্দিনী খুব খুশি হলো | এর পর থেকে আমি সময় পেলেই ছবি আঁকতাম – ছবি এঁকে আমি খুশি হতাম কিন্তু মন বলত আমি নন্দিনীর জন্যেই শুধু ছবি আঁকি – কারণে- অকারণে আমি তাকে ছবি উপহার দিতাম |

বলাই বাহুল্য স্কুলে গিয়ে আমার বেশ কয়েকজন ছেলে বন্ধু হলো | তাদের সাথে আমি মাঝে মাঝে ফুটবল খেলতে যেতাম | কিন্তু আমি সময় পেলেই নন্দিনীর কাছে ছুটে আসতাম | নন্দিনীর মাকে আমি মাসিমা ডাকতাম | মাসিমাও আমাকে পছন্দ করতেন | তাদের বাড়ির উঠানে পা দিলেই মাসিমা প্রথম দেখতে পেলে আমাকে আদর করে ঘরে নিয়ে যেতেন | নন্দিনীকে আশেপাশে কোথাও না দেখা গেলে “এই নন্দ কোথায় গেলে অরিন্দম এসেছে ” ডাকতে ডাকতে সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াতেন | মাঝে মাঝে তার মায়ের সেই ডাক শুনে নন্দিনী কোথায় থেকে পাগলের মত ছুটে আসত | মনে পড়ে নন্দিনীর মা’র সামনে আর আমাদের বাড়িতে আমার মায়ের সামনে কতদিন আমরা দুটিতে মিলে একসাথে এক থালায় ভাত খেয়েছি | নন্দিনীকে নিয়ে কতদিন তাদের বাড়ি থেকে অনতিদূরে শাল আর তমালগাছে ঘেরা বড় পদ্মপকুরের দিকটায় বেড়াতে গিয়েছি, বিকালে মাঝে মাঝে পুকরের শানবাঁধানো ঘাটে গিয়ে বসতাম – দুটিতে মিলে কত অজানা রাজ্যের অদ্ভুত সব গল্প করতাম | আমাদের গ্রামে প্রতি বছর চক বাজারের পাশটায় খুব বড় অশ্বত্থ গাছটার নীচে পৌষের মেলা বসত | আমি একবার সারা বছরের একটু একটু করে জমানো টাকা দিয়ে নন্দিনীর জন্যে সেই মেলা থেকে তিব্বত স্নো, পাউডার, একটা ছোট্ট সেন্ট, এক শিশি আলতা আর অনেকগুলো কাঁচেরচুড়ি কিনে দিয়েছিলাম | এই কান্ড দেখে নন্দিনীর মা আমাকে “বোকা ছেলে” বলে অম্ল-মধুর ভর্ৎসনা করলেন, আমার মা মুচকি হাসলেন আর নন্দিনী খুশীতে সবগুলি চুড়ি পরে আমার সাথে দুষ্টামি শুরু করলো | মনে পড়ে প্রতি বছর লক্ষ্মী-পূজার রাতে নন্দিনীর সাথে সারারাত জেগে থাকতাম | একবছরের কথা বিশেষ মনে পড়ে | মেঘ-বিহীন আকাশে পূর্নিমার পূর্ণ চাঁদ – ফুটফুটে জ্যোৎস্নারাত – সে বছর নন্দিনীরা খুব বড় করে লক্ষ্মী পূজা করলো | সারা গ্রামের অনেক মানুষ এলো | আমি আর নন্দিনী মিলে সবার মধ্যে প্রসাদ বিতরণ করলাম | শেষে মধ্য রাতের পরে নন্দিনীর বাবা-মা আর দিদিমার সাথে তাদের বড় উঠানটায় একটা পাটি বিছিয়ে নন্দিনী আর আমি বসলাম | নন্দিনীর দিদিমা সারারাত ধরে “বেহুলা-লখিন্দর ও চাঁদ-সওদাগরের” গল্প বললেন | নন্দিনী আর আমি মুগ্ধ হয়ে সেই গল্প শুনলাম | মনে হলো আমার চিত্তে নন্দিনীর জন্যে আরো খানিকটা মমতা এসে বাসা বাঁধলো |

এর কয়েকমাস পরেই নন্দিনীদের বাড়িতে শিবরাত্রির উৎসব | রাতে মার সাথে গিয়েছি তাদের বাড়িতে | নন্দিনী তার মার সাথে শিবরাত্রির উপবাস করছে | পরনে তার হালকা নীল শাড়ি আর কপালে চন্দনের টিপ | মাসিমা আমাদের প্রসাদ দিলেন আর নন্দিনী এসে আমার কপালে দিয়ে গেল একটা চন্দনের ফোঁটা | নন্দিনীর দেয়া সেই চন্দনের টিপ মুছে যাবে এই চিন্তায় সেই রাতে সারারাত চিত হয়ে শুয়ে ঘুমালাম | মা অবাক হয়েছিলেন সকালে উঠেও আমার কপালে সেই চন্দনের ফোঁটা দেখতে পেয়ে | মনে পড়ে কপালের এই জায়গাটাতে অনেক দিন যেন নন্দিনীর হাতের ছোঁয়া লেগে ছিল |

এর কয়েকমাস পর , ১৯৪৭ সাল, আমরা তখন সপ্তমশ্রেণীতে, গ্রামের আর এক প্রান্তে হাইস্কুলে পড়ি, আমাদের পাড়া থেকে বেশ খানিকটা দূরের হাঁটাপথ, নন্দিনী বরাবরের মতই আমার স্কুল-সাথী | একটু বড় হয়েছি – পরিবার, পাড়া, আর গ্রাম-এর বাইরে দেশ আর বিদেশ সন্বন্ধেও একটু একটু বুঝতে শিখছি | সবার মধ্যে আলোচনা চলছে আমাদের দেশ থেকে ইংরেজরা চলে যাবে, এই দেশ পরাধীনতা থেকে মুক্তি পাবে যদিও তখনও পরাধীনতা থেকে মুক্তির অর্থ পরিষ্কার করে বুঝতাম না | দেখতে দেখতে আগষ্টের ১৪ তারিখ এলো | সবাই স্কুলে বলাবলি করলো আজ থেকে আমরা স্বাধীন – আমাদের দেশ এখন পূর্ব পাকিস্তান| আমাদের গ্রামে একটা ছোটখাটো আনন্দ মিছিলও হলো | কিন্তু একি ! আমাদের, নন্দিনীদের আর পাড়ার সকল বাড়িতে বিষাদের কালোছায়া | সবাই আলোচনা করছে আমাদের কি হবে ? আমরা কি এদেশে আর থাকতে পারব ? কয়েকমাস যেতে না যেতেই দেশ ছেড়ে অনেক পরিবার ভারতে যেতে শুরু করলো | আমার আর নন্দিনীর বাবা- মায়েরাও এই নিয়ে রাত-দিন আলাপ-আলোচনা করতেন| তাদের চোখে-মুখে উদ্বেগ আর আশঙ্কার কালো ছায়া | বলাই বাহুল্য তাদের সেই উদ্বেগ আর আশঙ্কার কালোছায়া এসে নন্দিনী আর আমাকেও আচ্ছন্ন করলো | মনে পড়ে আমি আর নন্দিনী একদিন তাদের বাড়ির ছাদে যাওয়ার সিঁড়িতে বসে অনেকক্ষণ ধরে আলাপ করছিলাম – কি হবে আমরা যদি এই বাড়ী, এই দেশ ছেড়ে চলে যাই | আমরা কোথায় যাব | নন্দিনীরা আর আমরা কি এক জায়গায় যাব ? এক জায়গায় না গেলে আমরা কি করব ! কেমন করে থাকব ! এসব বলতে বলতে আমরা দুজনেই সেদিন কান্নায় ভেঙ্গে-পড়েছিলাম| নন্দিনীর জন্যে আমার মনটা যেন সেদিন কেমন করে উঠেছিল !

সময় গড়িয়ে চলে – মনের ভিতরের সেই দেশ বিভাগের কালো ছায়াটা যেন থেকে থেকেই জেগে উঠে | এই আশঙ্কার মাঝে নন্দিনীর জন্যে কেন জানি আমার প্রাণে আরো বেশি মায়া লাগে | মনে হয় যেন নন্দিনী আমার সবটা অন্তর দখল করে নিল | সারাক্ষণ কেবল নন্দিনীর কথা মনে হত | মনে হত যেন এখন সারাক্ষনই কেবল নন্দিনীর কথা ভাবি | একা যখন হাঁটি – আকাশের দিকে তাকালে সেখানে মেঘের মধ্যে তার মুখ দেখি – বাতাসের শব্দে নন্দিনীর কথা শুনি | আমি যখন একা থাকতাম মনের তুলিতে মনের পটে নন্দিনীর ছবি আঁকতাম | এরপর থেকে কি জানি কি হলো – নন্দিনীর জন্যে মনে মনে ছন্দ গড়তাম – মনের পৃষ্ঠা থেকে ক্রমে খাতার পৃষ্ঠায় অদ্ভুত সব পংক্তিমালা লিখতে শুরু করলাম | বলাই বাহুল্য কবিতা সন্বন্ধে তখন আমার কোনই ধারণা নেই – তবু লিখতাম – সময় পেলেই লিখতাম – লিখে লিখে খাতার পাতা ভরাতাম | কাকতালীয় ভাবে আবিষ্কার করলাম নন্দিনীও কবিতা লিখতে শুরু করেছে | তারপর থেকে যেন শুরু হলো পাল্লা দিয়ে লেখা | একসময় মনে চেপে বসলো নন্দিনীকে নিয়ে একটা কবিতা লিখব | লিখি আর ছিঁড়ি – কিছুতেই নন্দিনীকে দেওয়ার মোটামুটি যোগ্যও একটা কবিতা হচ্ছে না | অবশেষে অনেক চেষ্টার পর তাকে নিয়ে দুটি কবিতা লিখলাম | সেই প্রথম নন্দিনীকে নিয়ে আমার কবিতা লিখা – আমার প্রথম দুটি কবিতা | আমার খাতার একটি পাতা ছিঁড়ে তার প্রথম পাতায় :

নন্দিনী, আমার নন্দিনী,
গ্রীষ্মের দুপুরে তুমি শীতল-জলের-স্রোতস্বিনী!
নন্দিনী, আমার নন্দিনী,
বর্ষার বৃষ্টিতে তুমি কদম্ব-কেয়া-কামিনী!
নন্দিনী, আমার নন্দিনী,
শরতের রাতে তুমি তারার মৃদু হাতছানি!
নন্দিনী, আমার নন্দিনী,
হেমন্তের প্রাতে তুমি মধুর-প্রভাত-রাগিণী!
নন্দিনী, আমার নন্দিনী,
শীতের সকালে তুমি সোনা রোদের ঝলখানি!
নন্দিনী, আমার নন্দিনী,
বসন্তের ত্রিসন্ধ্যায় তুমি রিনি-ঝিনি-কিঙ্কিণী!

কাগজের দ্বিতীয় পাতায় আরেকটি কবিতা:

ওগো নন্দিনী,
তুমি যে সেজেছ মোর রানী,
তোমারেই মনে মোর জানি |
তুমি শুভ্র-জ্যোতি-চাঁদের-কণা আমার নয়নমনি,
আমি তোমারেই সঁপিলাম-আমার প্রাণের প্রাণ খানি |
কবিতা-দুটো লিখে নন্দিনীকে দিয়েছি | পরদিন নন্দিনীর কাছ থেকে আমার জন্যে একটি ছোট্ট কবিতা:

দিবাবসানে যখন সন্ধ্যা এসে নামে,
আবার রাত্রি’বসানে যবে দিবাকর উঠে গগনে,
মনে মনে গাঁথি মালা কল্পনার সোনার ফুলবনে,
পরাব কবে তোমার গলে,
সেজে মনোরম বসনে আর মধুর মনে !

নন্দিনীর কবিতাটি ছোট্ট বটে, কিন্তু এর ব্যঞ্জনা আমার প্রাণ ছুঁয়ে গেল |

সময় বহে চলে নিরবধি | সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নন্দিনী আর আমি বেড়ে উঠছি নব নব ছন্দে | আমরা এখন অষ্টম শেণীতে | দুজনেই পড়ালেখায় যেমনি মনোযোগী তেমনি আরো নানা কাজে | আমি ছবি আঁকি, অনেক কবিতা লিখি আর সময়ে অসময়ে এই ভারতবর্ষের এক বিখ্যাত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কবিতার বই “গীতাঞ্জলি ” পড়ি | মাত্র কয়েকমাস আগেই বাবা বাড়ী আসার সময় এই বইখানা নিয়ে এসেছিলেন আর বলেছিলেন এই বইখানা লিখেই নাকি তিনি এই বিশ্বের সবচেয়ে বড় সম্মান “নোবেল পুরস্কার ” পেয়েছেন | এই কথা শোনার পর থেকে তাঁর আরো লেখা পড়ার জন্যে উৎসুক হয়ে উঠলাম | যখন পড়তে ভালো লাগত না বসে বসে ছবি আঁকতাম | বিচিত্র সব ছবি আঁকি সাদা কাগজে পেন্সিল দিয়ে | নন্দিনীও কবিতা লিখে – সুন্দর সুন্দর সব কবিতা – প্রকৃতি আর মানুষ নিয়ে | আমাকে পড়তে দেয় – আমি পড়ি আর ভাবি কি করে নন্দিনী এত সুন্দর কবিতা লিখে ! আমার গত বৎসর জন্মদিনে নন্দিনী আমার জন্যে অনেক বড় একটা কবিতা লিখেছিল – আমার পড়ার ঘরে আমার পড়ার টেবিলের উপরের দেয়ালে সেই কবিতাখানি এখনো টাঙানো আছে | কবিতা লিখার পাশাপাশি সে গানও শিখতে শুরু করলো আমাদের পাশের গ্রামের “ধীরেন উস্তাদজী” নামে খ্যাত এক গানের শিক্ষকের কাছে | সে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখে আর শিখে তার মা’র পছন্দের কিছু ভজন | ভারী সুকন্ঠী সে, যত সুন্দর মুখশ্রী ততই সুন্দর কন্ঠশ্রী, দুইয়ের এক অদ্ভুত সম্মিলন | মনে পড়ে একদিন বিকালে গিয়েছি তাদের বাড়ীতে – নন্দিনী তখন রেওয়াজ করছে | আমি কিছু বলার আগেই নন্দিনী বলল “আমি একটা নতুন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছি – আমি এখন তোমাকে সেটা গেয়ে শুনাব” | শর্মিতা মাসিও এসে একটা চেয়ারে বসলেন – নন্দিনী হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান ধরল আমার প্রথম শুনা একটা গান “আমার পরান যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাই গো” | সেদিন শরতের সায়াহ্নে কেরোসিন দীপ-শিখার মৃদু আলোকে নন্দিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে তার সুললিত কন্ঠে যখন সেই অমৃতময় গানখানি শুনছিলাম – আমার মনে কি জানি এক অজানা অনুভূতি এসে বাসা বেঁধেছিল – তখন আমার মন চলে গিয়েছিল অজানা এক দেশে – দূরে অনেক দূরে | নন্দিনীকে আমার মনে হয়েছিল অনেক কাছের আবার অনেক দূরের !

দুজনেই খুব ভালো রেজাল্ট করে সবে নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছি | এখন জানুয়ারী মাস | আর মাস দেড়েক পরেই নন্দিনীর পঞ্চদশতম জন্মদিন | মাসিমা বললেন এবার খুব জাঁকজমক করে নন্দিনীর জন্মদিন পালন করবেন – গ্রামের অনেক মানুষকে নিমন্ত্রণ করবেন | আমি মনে মনে ঠিক করলাম এবার নন্দিনীর জন্মদিনে তার একটা বড় করে ছবি এঁকে নন্দিনীকে উপহার দিয়ে অবাক করে দিব | যেমনি পরিকল্পনা তেমনি কাজ – দুই সপ্তাহ ধরে প্রায় প্রতিদিন স্কুলের পরে নন্দিনীকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যেতাম | একটা লাল শাড়ি পরে এলোচুলে নন্দিনী আমার ঠাকুরদাদার পিতার জমিদারীর হাতলওয়ালা সিংহাসনটায় বসত | আমি একবার নন্দিনীর দিকে আর একবার কাগজের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পেন্সিল দিয়ে নন্দিনীর একখানা স্কেচ করলাম | তারপর প্রায় এক মাস ধরে প্রায় নাওয়া -খাওয়া ভুলে গিয়ে একটু একটু করে বেশ বড় আকৃতির একটা শক্ত সাদা কাগজে অনেক চেষ্টা করে পেন্সিল দিয়ে আমার মনের সবটা রং মিশিয়ে নন্দিনীর একটা অপরূপ সুন্দর ছবি আঁকলাম | প্রতিদিন একটু একটু করে ছবিটা আঁকতাম আর আমি নিজেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকতম | এই ছবিটা দেখে দেখে আমার নিজেরই যেন আফসোস মিটত না – আর মনে মনে ভাবতাম কতক্ষণে নন্দিনীকে এই ছবিটা উপহার দিব | মনে পড়ে নন্দিনীর জন্মদিনের আগের দিন সন্ধ্যায় হঠাৎ কি মনে করে গোপনে মা’র রুপার সিঁদুরের কৌটা থেকে একটু সিঁদুর এনে এই সাদা-কালো পেন্সিলের ছবিটায় নন্দিনীর কপালে একটা লাল টিপ পরিয়ে দিলাম | মনে পড়ে তার জন্মদিনে আমার হাত থেকে তার এই ছবিখানা হাতে পেয়ে নন্দিনী আমাকে সবার সামনেই বুকে জড়িয়ে ধরেছিল | তবে মুহুর্তেই লজ্জায় আরক্তিম হয়ে নন্দিনী ছুটে পালালো ! সেদিন আমার দেওয়া সেই ছবিখানা পেয়ে নন্দিনী যে কি প্রচন্ড খুশি হয়েছিল আর নন্দিনীর সেই খুশির ধাক্কা আমার অন্তরে যে আনন্দের হিল্লোল তুলেছিল সেই কথা মনে করে আজও আমার মন শিহরিত হয় |

নন্দিনীর জন্মদিনের কয়েকদিন পরেই নন্দিনীর মা-বাবা আর আমার মা-বাবার সাথে একত্রে আমরা সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে গিয়েছিলাম | নন্দিনী আর আমি হাত ধরে ধরে প্রাণের অবারিত আনন্দে-উচ্ছাসে আর হাসিতে – খুশিতে একাকার হয়ে যখন সেই চূড়ায় উঠলাম আমরা দুজনেই চন্দ্রনাথকে প্রণাম করলাম | নন্দিনী সেই সাথে হুট করে আমাকেও প্রণাম করে বসল | আমি সেদিনই প্রথম আবেগে আপ্লুত হয়ে সেই দেবতার সামনে নন্দিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম !

তখন কেবল বসন্তের শুরু | শীতের শেষ রেশটুকু তখনও একটু একটু অনুভূত হচ্ছে – চারিদিকের সব সবুজ গাছপালা হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা আর আকাশে রৌদ্র-মেঘের খেলা | এর মধ্যে বসন্তের মৃদু-মন্দ মলয়-সমীরণ – রোদের-তাপ গায়ে লাগছে না | নন্দিনী-আমি উদ্ভান্তের মত চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখছি – এই দেখতে দেখতে কখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়েছে | নন্দিনী আজ পরেছে কুচ কুচে কালো রঙের সিল্কের শাড়ি – তার পাড় আর আঁচলে সোনালী রঙের নিঁখুত কাজ আর সারা জমিনে ছোট ছোট হালকা ভরাট সোনালী বৃত্ত | পায়ে পরেছে মল, দুই হাতে একটি করে চিকন সোনার চুড়ি আর তার সাথে অনেকগুলো কালো বেলোয়ারি কাঁচেরচুড়ি, গলায় কন্ঠহার, কানে কালো কুন্তল, নাকে সোনার নাকফুল, ঠোঁটে ঘন কালচে-লাল লিপস্টিক, চোখে কাজল আর কপালে দুই ভুরুর মাঝখানে একখানা ঘন কালো টিপ | ফাগুনের পড়ন্ত বিকালের অস্তাচলগামী রবির সোনাঝরা আলোর আভায় নন্দিনীকে মনে হলো স্বর্গের অপ্সরা | চন্দ্রনাথ-মন্দিরের ঠিক পাশটাতে নাম-না-জানা সেই বড় গাছটার নীচে বসে নন্দিনী দরাজ মিষ্টি গলায় অসীম মমতায় গেয়ে চলল একটি অসাধারণ রবীন্দ্রসঙ্গীত “আকাশ আমায় ভরলো আলোয়, আকাশ আমি ভরবো গানে |” নন্দিনীর কন্ঠে সেই প্রাণ-স্পর্শ-করা গান খানি শুনছি আর পলকহীন বিমুগ্ধ নয়নে একবার তাকাই দূর-দিগন্তে আর একবার নন্দিনীর দিকে | সেদিন কি জানি এক অজানা আনন্দানুভূতিতে আমার প্রাণ ছুঁয়ে গেল আর আমার মন যেন কোন দূরে হারিয়ে গেল ! আনমনা হয়ে বসে রইলাম | নন্দিনীর ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম | তখন বেলা প্রায় শেষ, সন্ধ্যা হয় হয় | এখনই ফিরতে হবে নীচে | যাওয়ার আগে দুজনে মিলে প্রার্থনা করলাম পাষান দেবতার কাছে:

“অরিন্দম-নন্দিনী নাম এক-সুত্রে গাঁথা,
থাকি যেন চিরকাল হয়ে চিরসখা |”

মাত্র মাস খানেক হলো চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে বেড়িয়ে এসেছি – সেই আনন্দ-স্মৃতি এখনো মনে লেগে আছে | দিনটি ছিল সোমবার, আর সব দিনের মতই সেদিনও যথারীতি সকাল হলো – আর সব সকালের মতই একটি সকাল | নন্দিনীর সাথে স্কুলে যাওয়ার জন্যে সকালে তাদের বাড়ি গেলাম | নন্দিনীর কোনো সাড়াশব্দ নেই | মাসিমা আমাকে ডেকে ঘরে নিয়ে গেলেন | নন্দিনী তখনো বিছানায় | আমি কাছে যেতেই বিছানায় উঠে বসলো | তার কান্না-কাতর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বিস্ময়াবিভূত| কারো মুখে কোনো কথা নেই | মাসিমা নীরবে এসে আমার কাছটিতে বসলেন – অত্যন্ত স্নেহশীল হয়ে মৃদুভাবে আমার পিঠে হাত রাখলেন | তখনো পর্যন্ত আমি কিছুই বুঝতে পারছি না | বেশ খানিকটা সময়ধরে নন্দিনীর মা দেশবিভাগের পরিনতি সম্বন্ধে একটা ব্যাখ্যা দিলেন – তারপর কোমল-দয়ার্দ্র কন্ঠে আমাকে বললেন আর দুই মাস পরে তারা এই দেশ ছেড়ে ভারতের মেঘালয়ে চলে যাবেন | মনে পড়ে এটা শুনার পর কয়েকমুহুর্তের জন্যে বোধহয় আমার চেতনা লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল – আমি চারিদিক অন্ধকার দেখলাম | আমি আস্তে করে আমার বইখাতাগুলো হাতে নিয়ে নন্দিনী আর তার মাকে কিছু না বলেই উঠে চলে গেলাম – তারপর বড় বড় পা পেলে উদভ্রান্তের মত স্কুলে গিয়ে হাজির হলাম | সেদিন প্রথম ক্লাসেই আমাদের ক্লাসে স্কুল-ইন্সপেক্টর এসেছিলেন | ইন্সপেক্টর ক্লাসে ঢুকতেই আমাদের ক্লাস শিক্ষক নাকি প্রচলিত রীতি অনুযায়ী সবাই কে ইশারা করেছিলেন উঠে দাঁড়িয়ে ইন্সপেক্টরকে সম্মান জানাতে | আমি তখন বোধহীন – কোথায় তাকিয়েছিলাম কিছুই জানি না – আমাদের শিক্ষকের কোনো ইঙ্গিত আমার মর্মে পৌঁছেনি | ইন্সপেক্টর চলে যাওয়ার পর আমার স্যার আমাকে কাছে নিয়ে সস্নেহে জিজ্ঞেস করলেন “তোর আজ কি হয়েছে ?” -আমি কোন উত্তর দিতে পারলাম না – আমার চোখ থেকে অঝরে জলের ধারা বইতে শুরু করলো | আমার প্রিয় অবিনাশ স্যার সেদিন কি বুঝেছিলেন জানি না – তিনি আমাকে বাড়ি চলে যেতে বললেন | আমি তখন নবম শেণীর ছাত্র -অনেক লজ্জাও পেলাম বটে | লজ্জায় আর “নন্দিনী চলে যাবে” এই দুঃখে আমি পাগল-প্রায় হয়ে বাড়ি চলে এলাম | সেইদিন মাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম | সেই রাতে আমি কিছুই খাইনি এবং পরদিন স্কুলেও যাইনি | মা আমাকে নিয়ে খুব চিন্তিত হলেন |

সময়ের চাকা দ্রুত বহে চলে – একদিন একদিন করে দিন ফুরিয়ে যায় – মনে হয় যদি কোনভাবে পারতাম এই সময়ের চাকাকে স্তব্ধ করে দিতে ! নন্দিনী আর আমি বসে থাকি – আর কেবল একজন আরেকজনের দিকে চেয়ে থাকি – মুখে কোন কথা সরে না | আমি নন্দিনীকে কিছু বলতে চাইলেই যেন কান্না এসে আমার কন্ঠ রোধ করে | আমি বুঝতে পারি নন্দিনীও যেন আমাকে কত কথা বলতে চায় – কিন্তু পারে না – তার কষ্ট আমাকে পীড়া দেয় | নন্দিনী আমাকে একদিন বলল তার মা যখন পূজা দেয় তখন তার মা তাকে ঠাকুর ঘরে নিয়ে যায় | তার মা তাকে বলে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতে তারা যেন নতুন দেশের নতুন জায়গায় মঙ্গলমতে পৌঁছতে পারে – আর নন্দিনী ঠাকুরকে প্রণাম করে মনে মনে বলে ঠাকুর যেন তার মা-বাবার মনটা ঘুরিয়ে দেয় – তাঁরা যেন এই দেশ ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করে | নন্দিনীর কথা শুনে আমিও আমার মা যখন সকাল-সন্ধ্যায় লক্ষীর পূজা করত আমিও প্রণাম করে নন্দিনীর মত ঠাকুরকে একই কথা বলতাম | বিছানায় শুয়ে শুয়ে কতদিন সীতাকুন্ডের পাহাড়ের চন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে মনে মনে প্রণাম করে বলেছি তিনি যেন দয়া করে নন্দিনীদের যাত্রা বাতিল করেন | কিন্তু হায় ! নন্দিনী আর আমার সব প্রার্থনাই নিষ্ফল প্রমানিত হলো | সত্যি সত্যিই একদিন বিষাদের কালো ছায়ায় মাখানো নন্দিনীদের চলে যাওয়ার সেই দিন এসে উপস্হিত হলো | সেই দিন ১৯ শে জুন, বৃহস্পতিবার, ১৯৪৯ খ্রীষ্টাব্দ:

ধরণী উঠিল জাগি রাত্রি অবসানে,
ব্যথিত সে বুঝি আজ এই বিদায়ক্ষণে |
ক্ষণে ক্ষণে আকাশেতে বিজলি হানে,
বায়ু বহে খরবেগে দিবাকর বিনে |
গৃহে তাদের অন্ধকার, তেমনি বাহিরে,
তবু তারা যাবে চলে কোন সুদূরে |

নন্দিনী এলো ক্রমে ঘরের বাহিরে,
তাকেও যে যেতে হবে সেই বহুদূরে |
চক্ষে তার বহে জলের ধারা, বক্ষে তার আর্তচিৎকার !
তবুও ভ্রুক্ষেপ না করে কেহ – মনে তার বিষম হাহাকার !
ব্যথিত ধরণী বুঝি চমকিল ক্ষণতরে
তবুও সময় নাহি একটু থামিবারে !
ছিল যে নন্দ’র নিত্য-সহচর, অস্তিমান ঘরে ও বাহিরে,
ক্ষণকাল পর হতে সে বিরাজিবে কেবলি অন্তরে |

নদীতে প্রবল ঢেউ – ভয়ার্ত আকাশ ,
তবু তারা গেল চলে – নিয়তি নিষ্টুর হেন
শক্তি কোথা ? তারে রুধিবারে|

অরিন্দম রহিল বসে – বসে ছিল যেথা,
মুখে নাই কোনো ভাষা কিছু বলিবার |
চক্ষে নাই কোনো জল – পাথর-প্রায় ,
কেমনে সে বহিবে বুঝি এই ব্যথা-ভার!

সময় তবুও থেমে থাকে না, সে বহে চলে তার আপন গতিতে, উদাসীন আর নির্লিপ্ত ভাবে | নন্দিনীরা চলে গেছে আজ আটদিন | বিকাল গড়িয়ে এখন প্রায় সন্ধ্যা | সারাদিনের বিরামহীন বৃষ্টির বুঝি একটু বিরতি হয়েছে | সারাদিন শুয়েই ছিলাম -একটু আগেই উঠে বসলাম | সাতদিন যাবৎ প্রায় কিছুই খাইনা এই সংবাদ পেয়ে বাবা উদ্বিগ্ন হয়ে তাঁর কর্মস্হল থেকে আজই সকালে বাড়ি এসেছেন | বাবাকে অনেকদিন পর কাছে পেয়ে আমি খুশি | সকাল থেকেই অনেকক্ষণ বাবা আমার কাছেই বসে ছিলেন | বিকালে আমার প্রিয় শিক্ষক প্রদ্যোত স্যার এসেছিলেন আমাকে সান্তনা দিতে | তিনি অনেক কিছু বলে গেলেন আর যাওয়ার সময় টেবিলে একটা কাগজ রেখে আদেশ দিয়ে গেলেন সেটি মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্যে | একটু আগে মা এসে আমার মাথায় অনেকক্ষণ হাত বুলিয়ে দিয়ে গেলেন | এখন তিনি গিয়াছেন ঘরে সন্ধ্যা-প্রদীপ আর তুলসী তলায় মঙ্গল-দীপ জ্বালাতে | টেবিলের উপর একটা ছোট্ট খাম | খুলে দেখি এক চিলতে চিঠি | পঞ্চদশী স্হিতধী নন্দিনী লিখে গেছে এক গভীর তত্ত্বকথা:

প্রাণের অরিন্দম,
সময় আজ আমাকে নিয়ে চলছে তোমার থেকে অনেক দূরে অজানা এক দেশে | আর এই সময়ই হয়তো বা আবার তোমার-আমার মিলন ঘটাবে ভবিষ্যতে কোনো একদিন | প্রার্থনা করি ততদিন ভালো থেকো আর আমাকে ভালোবেসো |
ইতি তোমার নন্দন |
৫ ই আষাঢ়, ১৩৫৬ বঙ্গাব্দ |

নন্দিনীর লেখা চিঠিখানা পড়া শেষ করে স্যারের দেওয়া কাগজখানা হাতে নিয়ে দেখি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একখানি কবিতা “যেতে নাহি দিব ” | আগে কখনো পড়িনি | গভীর আগ্রহ নিয়ে সেই কবিতাখানি পড়লাম | পড়ে ঠিক কি বুঝলাম বুঝতে পারিনি | তবে নন্দিনীর ছোট্ট চিঠিখানা আর এই কবিতাখানা পড়ে অনুভব করলাম আমার মনে কেমন জানি একটু স্বস্তি ফিরে এলো | মনে হলো আমার নন্দিনী হয়তবা আবার ফিরে আসবে আর সেই কবিতার কয়েকটা চরণ মনে বাব বার ধ্বনিত -প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো:

“যত বার পরাজয়
তত বার কহে,
‘আমি ভালোবাসি যারে
সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে |”

অরিন্দম রায়চৌধুরী
২৭ শে জুন, ১৯৪৯ খ্রীষ্টাব্দ
সুবর্ণগ্রাম, পূর্ব পাকিস্তান

পরিশিষ্ট: ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর আজ থেকে প্রায় ৬৩ বৎসর পূর্বে নন্দিনীদের পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে যেতে হয়েছিল | যেকোন কারণেই হোক অরিন্দমরা দেশ ছেড়ে গেল না বা যেতে সমর্থ হলো না – সেই পূর্ব পাকিস্তানের সুবর্ণগ্রামেই থেকে গেল | নন্দিনীরা চলে যাওয়ার পর অরিন্দম কেমন ছিল আর নন্দিনীরা স্বজন আর এই পরিচিত সমাজ ছেড়ে অজানা দেশ ভারতের মেঘালয়ের কোথায় গেল এবং সেখানে গিয়ে তাদের কি পরিনতি হয়েছিল সেই সন্বন্ধে এই লেখক কিছুই অবগত নয় | অরিন্দম-নন্দিনীর আবার কখনো দেখা হয়েছিল কিনা এটি জানারও এই লেখকের আর কোনোদিনই সুযোগ হলো না | তবে কৃত্রিম দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে অবিবেচক, অপরিণামদর্শী, আর অমানবিক-নিষ্ঠুর দেশ বিভাগ যে অরিন্দম-নন্দিনীর কাহিনীর মত এমন অসংখ্য বিরহ-বেদনার কাহিনীর জন্ম দিয়েছিল সে তো বলাই বাহুল্য ! – ইতি লেখক, ৫ ই ফেব্রুয়ারী, ২০১২ খ্রীষ্টাব্দ |