ডিজিটাল সংসার
গল্পের এক রাজা রাজ্য শাসনের ফাঁকে একটা মাছ ধরে এনে রাণীকে বলেছে ভাজা করে রাখতে। রাজ সভা থেকে এসে খাবে। গল্পের রাজা মাছ ধরে আর গল্পের রাণী রাঁধে। একটাই মাছ। গল্পের রাজা শুধু নিজের বোঝই বুঝে। একটা মাছ ধরে শুধু নিজেই খায়। খাবারের এ চর্চা অবশ্য আমাদের গ্রামীণ সমাজে এখনও প্রচলিত। রাণী অনেক যত্ন করে মাছটি ভেজে রেখেছে আর কোন এক ফাঁকে বিড়াল এসে তা খেয়ে ফেলেছে। রাণী তো মহা বিপদে। রাজা খেতে এসে মাছ ভাজা আনা পেলে রাণীকে মারধর করবে।গল্পের রাজা আবার যে কোন অজুহাত পেলেই রাণীকে মারধর করে। কারণ রাণী হলেও নারীইতো। আর রাজার পুরুষ না হলে সাজে! রাণী জটপট বুদ্ধি বাতলে একটা ব্যাঙ ধরে তা ভেজে রেখে দিয়েছে।
অন্যান্য স্বামীর মতই রাজার বুদ্ধির বহর সম্পর্কে রাণীর ধারণা টনটনে। পুরুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য রাজা হলেও বদলায় না। রাজ্য চালালেও মাছ আর ব্যাঙ ভাজার স্বাদ পার্থক্য করার মত জিহ্বার সংবেদনশীলতা নেই।
শিশু রাজকন্যা সবই দেখেছে।
রাজা রাজ দরবার থেকে আসার সাথে সাথে রাজকন্যা ছড়া কাটছে —–
বললে মায় মার খায়
আর না বললে বাবায় ব্যাঙ ভাজা খায়।
রাজা রাণীকে জিজ্ঞেস করছে, রাজকন্যা কি বলছে?
রাণীর উত্তর, পাড়ায় খেলতে গিয়ে কি শিখে এসেছে, তা ই বলছে। আপনার এদিকে মন দিয়ে কাজ নেই।
গল্পের রাজকন্যা পাড়ায় গিয়ে জনশিশুদের সাথী খেলে যা বাস্তবে দেখি না।
যাহোক, পরে রাজা ব্যাঙ ভাজা খেয়েছিল কি না অর্থাৎ গল্পের পরিণতি কি হয়েছিল তা আর মনে নেই। আদৌ গল্পটির কোন পরিণতি ছিল কি না তা ও জানা নেই। গল্পটি , বিশেষ করে ছড়াটি শুনানো হতো শাখের করাতের মত কোন অবস্থানকে বুঝাতে।
রাজার মেয়ের সেই গল্পের মতই নারীদের অবস্থা ও অবস্থান। শাখের করাত। আসতে যেতে দুদিকেই কাটে।
আজও রাজা ও রাণীর সংসারের মত অবস্থা ঘরে ঘরে।প্রতি ঘরে। এরমধ্যে অনেকে ঘর ভাঙ্গেন সইতে না পেরে। অনেকে সয়ে থাকেন।অনেকে সয়ও না। ঘরও ভাঙ্গে না। আজকের অনেক রাণীরা ভালভাবেই জানে স্বামীর মেজাজকে কীভাবে ঠান্ডা রাখতে হয়। ছোটবেলায় বুড়োদের দেখত দাঁতের জন্য শক্ত মুড়ি খেতে না পেরে ছাতু করে খেতেন। তেমনি স্বামীকেও নিজের উপযোগী ছাতু করে নিতে হয়। কাজেই নিজের চাপার জোর দিয়ে, যুক্তির ভারি হামানদিস্তা দিয়ে স্বামীর চিন্তা ও ব্যবহারকে অনেকেই ছাতু করে নেয়। স্বামীকে চাপে রাখে।
অনেকেই ঘর বদলাতে চায় না। আমার এক বন্ধু রীতা দাশ রায় বলে, ঘর বদলিয়ে কি হবে? স্বামীর পুরুষ চরিত্রটি তো আর বদলাবে না। বিছানা, খাট, মশারিই শুধু বদলাবে। কাজেই ঘর বদলিয়ে ছেলেমেয়েকে কষ্ট দেয়া ছাড়া আর কিছুই পাব না।
অনেক ঘরে রাণীরা মারধরের শিকার। অনেক ঘরে রাজাদের ব্যাঙ ভাজি খাওয়ায়। আবার খাওয়াতেও হয় না। এখন একটা মাছ বিড়ালে খেয়ে ফেললে ফ্রিজে মাছ থাকে। রাজা টেরও পায়না।
তবে ঝগড়ার অনেকে ক্ষেত্র এখন বন্ধ করা গেছে।
আগে আমার মাকে প্রায়শঃই খাওয়ার পর পর একটা ছড়া কাটতে শুনতাম,
খাইলাম টাইলাম
থাল ধুইব কে?
কইত্তে আইছে থাল ধুওনি নুরা হাত লইয়া
তাগরে ফালাইলাম
ধাক্কা ধুক্কা দিয়া
আমরাই থাল ধুইলাম যেমুন তেমুন কইরা
মায়ের এ ছড়াটিকে এখন বিশ্লেষণ করলে শুনতে পাই এক ক্লান্তি জাগানিয়া বয়ান। সারাদিন কাজ করে খাওয়ার পর থালা বাটি ধুইতে ইচ্ছে করত না। কাউকে দিয়ে ধুয়াতেও পছন্দ ছিল না। এ অপছন্দটি দাসত্বের শৃংখলকে জিইয়ে রাখতে সহায়তা করে। এখন যেমন অনেকেই বলে, আমার সাহেব বুয়ার রান্না মুখেই নিতে পারে না। আমার ছেলেমেয়েরা আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারে না। নিজেকে সংসারে অবিসম্ভাবী করে রাখার প্রচেষ্টা। তারা নিজেই সব করতে ভালবাসে। এ ভালবাসা শৃঙ্খলিত জীবনের নেশা।
এখন রাণীরা , বিশেষ করে শহুরে, শিক্ষিত রাণীদের ডিজিটাল সংসারে শারীরিক পরিশ্রম অনেক কমেছে। টিপ দিলেই জল। চাবি ঘুরালেই আগুন। আগুন জ্বালাতে ধুঁয়ায় চোখ লাল করে মাথা ধরাতে হয় না। তবে চাকরিজীবী নারীকে সাধারণত দ্বৈত ভূমিকা পালন করতে হয় বলে শারীরিক পরিশ্রম ঘুব একটা কমেনি। তবে মানসিক শ্রম বেড়েছে শতগুণ। আগে মাথাই ছিল না। মাথা ব্যথাও ছিল না। ছিল না মগজ নামক বুদ্ধির কোন ভাণ্ডার।
এখন বহু রাণীকে রাজার মেয়ের মত শাঁখের করাতের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয়। যেমনঃ অফিসে কেন এত দেরী?
এ প্রশ্নটি সাধারণভাবে স্ত্রীরা স্বামীদের করেন বলে বিদিত। স্বামীরা অজুহাত হোক আর সত্যিকারই হোক কাজের বোঝার কথাই বলে থাকে। যারা অজুহাত দেয় তাদের নিয়ে বহু গল্প,চলচ্চিত্র, নাটক আছে। কাহিনীর ধারাবাহিকতায় স্ত্রী অনেক পরে স্বামীর পরকীয়ার বিষয়টি জানে এবং অসহায় স্ত্রীর তেমন কিছুই করার থাকে না, তবে স্বামীটি শেষ পর্যন্ত তথাকথিত সতী সাধ্বী স্ত্রীর কাছেই ফিরে আসে। এ হল গতানুগতিক কাহিনী।
আজকাল চাকরিজীবী স্রীর সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে নারীদের জীবনের জটিলতা।
এক পেশাজীবী নারীর প্রায়ই অফিসে দেরি হয়। স্বামীটিও প্রায়শঃই কী কাজ করেছে তা জানতে চায়। স্ত্রী তার অফিসের নৈতিক বাধ্যবাধকতা (moral obligation) লংঘন করে দেরিতে অফিসে যে প্রতিবেদন করে মেইল করে এর বিসিসি দেয় স্বামীকে। স্বামীটি ই মেইল পাঠানোর সময় দেখে স্ত্রীর ব্যস্ততার সত্যতার প্রমাণ পেয়ে আশ্বস্ত হয়।এখানে নারীটির কি করা উচিত। প্রাত্যহিক ঝগড়াকে এড়াতে, সংসার টিকিয়ে রাখতে নারীটি চাকরি ক্ষেত্রে যা করল তা কি চাকরির শর্ত সত্য ভঙ্গ হল না? এমনি করেই নারীর যাপিত জীবন প্রবাহ বহমান।
আমার অনেক নারী সহকর্মীকে দেখি অফিসে এসে বাসায় ডালে লবণ দেয়। মানে সংসারের যাবতীয় খবরাখবর নেয়। নিতে হয়। পুরুষ সহকর্মীদের ফোন করতে দেখি, তবে কোন মাছের সাথে কি সবজি দেয়া হবে তা নিয়ে মাথা ঘামায় না । বরং শেয়ার বাজার গরম করে । বিভিন্ন এলাকায় জমির দামের খবরাখবর নেয়।পুরুষরা অফিস সময়ে ওয়াস রুমে গিয়ে কথা বলে কি না আমার জানার সুযোগ নেই। তবে নারীদের মাঝে মাঝে ওয়াস রুমে গিয়ে কথা বলা দেখি । শুনিও। তা ও সংসারের সব প্যাঁচাল। মোবাইলকে সংসারের রিমোট কন্ট্রোল হিসেবে ব্যবহার করে। বাচ্চা স্কুল করে সুস্থভাবে যথাসময়ে বাসায় পৌঁছল কি না তা জেনেও স্বস্তি নেই। আমি দেখি ও শুনি। বললে আমার নারীদের পেশাদারিত্বে আঘাত করা হয়। আর না বললে সত্যের অপলাপ।
ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠি নির্বিশেষে আমাদের একটাই পরিচয় আমরা মানুষ। এরই মাঝে ধনী-গরীব,রাজা-ফকির, ইতর- ভদ্র কত না রকমফের। এগুলোতো সবই অর্জন। ঈশ্বরের হাত কতটুকু? বা ঈশ্বরের কোন হাত আছে কি?
আমার মতে আমাদের তথা বিশ্বের নারীদের এখনো অর্জন করার আছে অনেক কিছু। অর্জন নিজেদেরই করতে হয়। অনুকূল পরিবেশ, যথাসময়ে যথাযথ সহিযোগিতা অর্জনকে বেগবান করবে নিশ্চয়ই। এখনে অধিকার আদায় এবং অধিকার প্রতিষ্ঠা দুটোই প্রয়োজন।
একজন উচ্চশিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত পুরুষকে খুব সহজেই স্বল্পশিক্ষিত মহিলাকে বিয়ে করে নিজের মত করে গড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে দেখা যায়। আমাদের সমাজে এমন কোন উচ্চশিক্ষিত বিত্তবান মহিলা আছেন কি যিনি একজন দরিদ্র স্বল্পশিক্ষিত পুরুষকে বিয়ে করে তার দায়িত্ব কাঁধে নেবেন?
দায়িত্ব নিচ্ছি না বলে ডোমিনেট করতে পারছি না, এমনটি কি ভাবা যায়?
বরং কার বরের ডিগ্রী কত বড়, টাকা পয়সা কত বেশী আছে, সমাজের কত লোক তাকে আদাব সালাম দেয় ইত্যাদিকে নিজের যোগ্যতার চেয়ে বেশী প্রাধান্য দেন অনেক মহিলা। আমাদের এ বৃত্ত থেকে বেড়িয়ে আসা উচিত নয় কি?
প্রবন্ধটি খুবই বাস্তবধর্মী এবং পরিশীলিত। আমার খুব ভালো লেগেছে। অনেক অনেক শুভেচ্ছা দিদির জন্য।
@জালাল উদ্দিন মুহম্মদ,
উচিত। একশতবার উচিত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীসহ সবাইকে ভাবতে শিখিয়েছে যে স্বামী হবে স্ত্রীর চেয়ে বয়সে, জ্ঞানে,ধনে, শিক্ষায় —- সব কিছুতে উঁচু,বড়। তা হতেই হবে। এ প্রথা ভাঙার মত অনেক নারীই এখন এগিয়ে আসছে।
ধন্যবাদ পড়া, মন্তব্য করা এবং তা ফোন করে জানানোর জন্য।
পণ্যের বাজারে টিকে থাকতে হলে, পণ্য হয়ে ওঠা দরকার। বাজার থাকবে পণ্য থাকবে না, তা কি হয়?
ব্যক্তি মানুষ তো বাজারের বাইরে নন। তাই টিকে থাকার প্রতিযোগিতায়, নানান কৌশল। যে ব্যবস্থার অধীনে মানুষের বাস, তাকে অপরিবর্তিত রেখে, উপদেশ দান করে আর কি হবে, হয়তো রাতে ভাল ঘমু হবে।
টিকে থাকার বাজারটাকে একটুখানি মেলে ধরার জন্য ধন্যবাদ।
@স্বপন মাঝি,
ধন্যবাদ নতুন দৃঢটিভঙ্গি নিয়ে কলামটি পড়ার জন্য।
ভালো লাগল ডিজিটাল সংসার
@আফরোজা আলম,
আপনাদের ভাল লাগাই লেখাটি চালিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা যোগাবে।
:guru:
@প্রতিফলন,
পুরুষ সহকর্মীরাও শেয়ার বাজার নিয়ে মাথা গরম করেন।
মনযোগ দিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
@গীতা দাস,
এখানে নারী-পুরুষ বৈষম্য নয়, “ডালে লবণ দেয়া“-র মতো phrase ব্যবহার করাটা আমার বিশেষ দৃষ্টি কেড়েছে।
@প্রতিফলন,
:lotpot:
গীতা দাস,
আপনার পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ এবং ভাষাশৈলী হৃদয়গ্রাহী। ভাল লাগছে ‘কালের অনুধ্যান’।
@ইরতিশাদ,
আপনারা সঙ্গে থাকলে লেখাটি চলবে ইরতিশাদ ভাই।
আমার মতে নারীটির উচিৎ স্বামীকে ‘স্বামী’ পদ থেকে পদচ্যুত করা কারণ সে তার স্ত্রী কে অকারন (লেখা দেখে কারণ নেই বলেই মনে হল) সন্দেহ করে। এবং, স্ত্রীর অফিসের বসের উচিৎ এই মহিলার বিরুদ্ধে অফিসের নিয়ম ভাঙার কারণে শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা গ্রহন করা।
নতুন নতুন বিষয় নিয়ে লিখে খুব ভালো কাজ করছেন। এসব নিয়ে বেশী করে ভাবা দরকার।
@কাজী রহমান,
হে হে বিষয়টাকে এত সোজা মনে করেছেন জনাব! আমাদের দেশে স্বামীদের স্ত্রীকে পদ চুত্য করে সহজেই একাধিক স্ত্রীকে সে পদে বসাতে পারে। কিন্তু স্ত্রীদের কি সুযোগ আছে?
ভুলে গেলে চলবে না ছেলেরা বিয়ে করে আর মেয়েদের এখনো বিয়ে হয় আমাদের সমাজে।
সামাজিক বিশ্লেষণ নিয়ে লেখার জন্য লেখককে ধন্যবাদ।
@রাজেশ তালুকদার,
সোজা বললাম কখন?
ভুলেও যাইনি।
আমি যা বলেছি তা আমার মতে; কি করা উচিৎ ত’ই বলেছি।
গীতাদি আজকের জীবন কে তুলে এনেছেন, আজকের কথা বলেছেন যা আজকেই আলাপ হওয়া দরকার। ভালো কাজ হয়েছে এখানে।
@রাজেশ তালুকদার,
নেই। সেজন্যে নারীকে এ সব ক্ষেত্রে শতবার ভাবতে হয়।
@কাজী রহমান,
তার মানে নারীকে আপনি স্বামী সংসার এবং চাকরিচ্যুত দুটোই করতে চান????????
@গীতা দাস,
অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। প্রতিবাদের মূল্য যেমন দিতে হবে পুরস্কার ছিনিয়ে নেবার জন্য।
অকারণ সন্দেহ করে যে স্বামী, স্ত্রীত্ব টিকিয়ে রাখতে যে স্বামীকে দেখাতে হয় স্ত্রীর অফিসের কাজের নমুনা, তথ্য প্রযুক্তির এই যুগেও প্রমান করতে হয় স্বামীটির প্রতি নতজানু অনুগত্য সেই পুরুষ স্বামীকে স্বামীপদ থেকে বিদায় করে দেওয়াই ভালো।
স্বামীর এই চরিত্র বদলাতে চাপ সৃষ্টি করতে হবে, বাধ্য করতে হবে, ব্যাক্তি পর্যায় থেকে সামাজিক পর্যায়ে। ত না হলে মেয়েরা পড়ে পড়ে মার খেতেই থাকবে, কাজের কাজ তবে কবে হবে?
এইটা বরং বদ স্বামীদের টাইট দেবার জন্য কিছু একটা করা।
বেতন দেয় চাকুরী যিনি দেন, আর বেতন নেন যিনি চাকরী করেন। ডালে নূন দেওয়ার জন্য কি বেতন দেওয়া হয়। ওটা অফিসের কাজের বাইরে করলে অসুবিধা নাই, অফিসের কাজের সময়ে থেকে করলে তা সময় চুরি বলে। কেউ চুরি করলে তার শাস্তি হোক তা কি চাইতে পারি না?
বললে মায় মার খায়
আর না বললে বাবায় ব্যাঙ ভাজা খায়। :-Y
@সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড,
বাবার ব্যাঙ ভাজির চেয়ে মায়ের মার খাওয়াই ঘটে সাধারণত। শুধু মাথা ঠুকে এ থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় নেই।