A lesser man would have seized the excuse of a mortal illness to duck responsibility and take it easy: ক্রিষ্টোফার হিচেন্সকে নিয়ে রিচার্ড ডকিন্সের স্মরণীয় উক্তি।

ধর্মের প্রতি তার বিতৃষ্ণা, মুলতঃ এই শব্দটার সাথে যে ধারনাটা জড়িত সেই অর্থেই, লুক্রেশিয়াস এর যেমন ছিল ঠিক সেধরনের। তিনি একে শুধুমাত্র মানসিক বিভ্রান্তির ফলে সৃষ্ট হওয়া কোন অনুভুতি মনে করতেনা, বরং বিষয়টিকে মহান নৈতিকতা বিরুদ্ধে একটি অপশক্তি হিসাবেও দেখতেন। প্রথমত: , কাল্পনিক শ্রেষ্ঠত্বের কাহিনী রচনা করে একটি ভিত্তি তৈরী করে এবং–ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাস স্থাপনা, ভক্তিমুলক অনুভুতি এবং উৎসবের অতি আতিশায্য, মানব জাতির কল্যাণের সাথে সম্পর্কহীনতা –এই সবকিছুকে সত্যিকারের কোন গুনাবলীর বদলে বিকল্প হিসাবে মেনে নেবার জন্য বাধ্য করে এর অনুসারীদের: কিন্তু সর্বোপরি ধর্ম, নৈতিকতার মানদন্ডকে কাঠামোগত সংস্কার করার মাধ্যমে, এটিকে কোন একটি মহান সত্ত্বার ইচ্ছার অধীনে কাজ করার প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসে, যে সত্ত্বাকে নিয়ে প্রশংসা এবং গুনগানের সত্যি কোন ঘাটতি রাখা হয়নি, কিন্তু সংযমী আত্মনিয়ন্ত্রিত সত্যের আলোকে এসব কিছু তাকে প্রতীয়মান করে তোলে উল্লেখযোগ্যভাবে ঘৃন্য একটা সত্ত্বা হিসাবে। জন স্টুয়ার্ট মিল (John Stuart Mill on his father, in the Autobiography )

কি ভয়াবহ অশুভ কাজ করার জন্য মানুষ প্ররোচিত হয় ধর্ম দ্বারা– লুক্রেশিয়াস (Lucretius, De Rerum Natura)

(ভুমিকা: ক্রিষ্টোফার হিচেন্স এর সাথে আমার প্রথম পরিচয় রিচার্ড ডকিন্স এর কোন একটি লেখার মাধ্যমে। হিচেন্স সম্বন্ধে সবারই কোন না কোন ধরনের মতামত হয়ত আছে, তবে দুরারোগ্য ক্যান্সারটি ছাড়া তার যোগ্য কোন প্রতিপক্ষই ছিল না। নির্লিপ্তভাবে তিনি কিছু দিন আগে বলেছিলেন, আমাকে একটু আগেই পার্টি থেকে চলে যেতে হচ্ছে। ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে তিনি সমৃদ্ধ করে গেছেন আমাদের চিন্তার জগত,পৃথিবীর প্রতিষ্ঠিত সব তথাকথিত সত্যকে নির্মোহ ‍আর চুলচেরা বিশ্লেষনের সাহসী ঐতিহ্যটাকে ধারন করে। অনাগত ভবিষ্যত চিরকৃতজ্ঞ থাকবে এই অসাধারন মানুষটির কাছে। ২০০৭ সালে মে মাসে হিচেন্স তার God Is Not Great: How Religion Poisons Everything প্রকাশ করেন। নীচের লেখাটি সেই বইটির দ্বিতীয় অধ্যায় Religion Kills এর আমার একটি অনুবাদ প্রচেষ্টা ‍মাত্র। লেখাটি উৎসর্গ করছি মুক্তমনার বুদ্ধিদীপ্ত সবাইকে, যাদের অনেকেরই ধর্মবিশ্বাসের অসারতা বুঝতে কখনো হিচেন্স পড়তে হয়নি অথচ ভবিষ্যতে পথে হিচেন্সের আলোকবর্তিকা এখন তাদের হাতেই। কাজী মাহবুব হাসান)

:line:

কল্পনা করুন, আপনি এমন কোন একটা কিছু করতে পারেন, যা আমি করতে অক্ষম। অন্যভাবে যদি বলি, কল্পনা করুন, আপনি একজন অসীম দয়াময়, সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তাকে অনুভব করতে পারেন, যিনি আপনাকে সৃষ্টি করার জন্য পুর্ব পরিকল্পনা করেছেন, তারপর আপনাকে সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী তৈরীও করেছেন এবং আপনাকে এমন একটি পৃথিবীতে জীবন ধারন করার সুযোগ করে দিয়েছেন, যা শুধু আপনার জন্যই তিনি তৈরী করেছিলেন এবং এখনও আপনার ভালো মন্দ, সবকিছু তিনি দেখা শোনা করছেন, এমনকি আপনি যখন ঘুমিয়ে থাকেন তখনও । আরো খানিকটা কল্পনা করুন, ভালোবেসে তিনি যে নিয়মকানুন এবং আদেশ বা নিষেধ সমুহ মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন, আপনি যদি তা মেনে চলেন, তাহলে অনন্তকালের জন্য প্রচন্ড সুখ আর শান্তিময় বিশ্রাম এর পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হবার সব যোগ্যতা আপনি অর্জন করবেন। আমি বলছি না, এই বিশ্বাসের জন্য আমি আপনাকে ঈর্ষা করছি (কারন আমার কাছে মনে হয়, এটা একটা ভয়াবহ ধরনের কল্যাণকামী এবং অপরিবর্তনযোগ্য কোন একনায়কতন্ত্রের জন্য কামনা করা); কিন্তু আমার একটা আন্তরিক প্রশ্ন আছে আপনার কাছে। কেন এই ধরনের বিশ্বাস, যারা বিশ্বাসী তাদেরকে সুখী করতে ব্যর্থ হচ্ছে? তাদের কাছে নিশ্চয়ই মনে হয়েছে যে, এক অপুর্ব বিস্ময়কর গোপন সত্য তারা জানতে পেরেছেন, জীবনের সবচেয়ে প্রতিকুলতম মুহুর্তেও যার উপর তারা আস্থা রাখতে পারেন।

আপাতদৃষ্টিতে উপরে উপরে কখনো মনে হতে পারে এটাই হয়তো আসল পরিস্থিতি। আমি সাদা এবং কালো, দুই ধরনের সমাজেই তাদের ইভানজেলিষ্টদের সার্ভিসগুলোতে গিয়েছি। যেখানে পুরো ঘটনাই মহাপাপ থেকে রক্ষা পাবার, ঈশ্বরের ভালোবাসা এবং এরকম আরো অনেক কিছু পাওয়ার তীব্র আনন্দর সুদীর্ঘ একটা আত্মচিৎকার মাত্র। ধর্মের এ ধরনের নানা মাত্রার বহু আচার অনুষ্ঠান এবং সবগুলোই প্রায় প্যাগানদের মত, ঠিক এমনভাবে পরিকল্পিত, যা সামাজিক উৎসব পালনের আমেজ তৈরী করে; আর ঠিক সেকারনেই আমি অনুষ্ঠানগুলো নিয়ে সন্দেহ পোষন করি। অবশ্য এছাড়াও আরো সংযত, ভদ্র আর পরিশীলিত মুহুর্তও আছে। আমি নিজে যখন গ্রীক অর্থোডক্স চার্চের সদস্য ছিলাম, আমি অনুভব করতে পারতাম- যদিও কোনদিন বিশ্বাস করতে পারিনি- আনন্দপুর্ন শব্দগুলো যা ইস্টারের দিন সকালবেলা বিশ্বাসীরা নিজেদের মধ্যে বিনিময় করতো: ‘Christos anesti!’ ( খৃষ্ট পুনরোজ্জীবিত হয়েছেন) , ‘Alethos anesti!’ ( সত্যি তিনি পুনরোজ্জীবিত হয়েছেন!); একসময় আমি গ্রীক অর্থোডক্স চার্চের সদস্য ছিলাম, আমি বলা উচিৎ, তার একটা কারন আছে, যা হয়তো আমার মত অনেকের ক্ষেত্রে, ধর্মের প্রতি তাদের বাহ্যিক আনুগত্য দাবী করার বিষয়টিকেও ব্যাখ্যা করে। অর্থোডক্স চার্চে যোগ যেমন আমি যোগ দিয়েছিলাম আর গ্রীক শ্বশুর শ্বাশুড়ীকে সন্তুষ্ট করার জন্য। যে বিশেষ দিনে এবং যে আর্চবিশপ, গ্রীক অর্থোডক্স কমিউনিয়নে আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহন করার অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছিলেন,সেই একই দিনে তিনি আমার বিয়েটাও পরিচালনা করেন, এভাবে তিনি একটার বদলে, দুটো অনুষ্ঠানের পারিশ্রমিক পকেটেস্থ করেছিলেন। পরে এই লোকই তার সহধর্মাবলম্বী সার্বিয়ার গনহত্যাকারী অর্থোডক্স সার্ব রাদোভান কারাদজিচ এবং রাতকো ম্লাদিচ, সারা বসনিয়া জুড়ে যারা অসংখ্য গণকবর পুর্ন করেছিল নিরীহ নারী পুরুষ আর শিশুর লাশ দিয়ে, তাদের একজন খুবই উৎসাহী সমর্থক এবং তাদের উদ্দেশ্যর পক্ষে অর্থসংগ্রহকারীর ভুমিকাও পালন করেছিলেন। এর পরের বার অবশ্য আমি যখন বিয়ে করি, সেটি পড়িয়েছিলেন সংস্কারপন্থী, আইনস্টাইন এবং শেক্সপিয়ার ঘেষা একজন ই্হুদী র‌্যাবাই, বিয়ের আনুষ্ঠিকতা পরিচালনাকারী এই ব্যক্তির সাথে আমার সামান্য খানিকটা মিল ছিল। কিন্তু এমন কি তারও অজানা ছিল না যে, তার সারাজীবনের সমকামীতা, তার ধর্মের প্রতিষ্ঠাতাদের কাছে নীতিগতভাবে খুবই গুরুতর অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত এবং যা পাথর ছুড়ে হত্যা করার মত শাস্তিযোগ্য। আর আমি যে অ্যাঙ্গলিকান চার্চে মুলতঃ ব্যাপটাইজড হয়েছি তা আজ হয়তো নীরিহ ভেড়ার মত মনে হতে পারে, কিন্তু তা এমন এক চার্চের উত্তরসুরী, যা সবসময়ই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে এবং বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের সাথে যার ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, এবং যার ঐতিহাসিক দ্বায়িত্ব ছিল ধর্মযুদ্ধ বা ক্রসেড পরিচালনা করা, ক্যাথলিক, ইহুদী এবং অন্যান্য ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্বিচারে নীপিড়ন করা এবং বিজ্ঞান ও যুক্তির সাথে সার্বক্ষনিক যুদ্ধ করা।

সময় এবং কাল ভেদে হয়ত এর তীব্রতা পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু কোন দ্বিধা ছাড়াই এই সত্যভাষন করা যেতে পারে যে, ধর্ম কখনোই, এবং পরিশেষে, তার নিজের বিস্ময়কর দা্বী এবং তথাকথিত সর্ব্বোচ্চ নৈতিক অবস্থানের পক্ষে ঐশ্বরিক সুনিশ্চয়তা নিয়েও সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। অবিশ্বাসীদের, ধর্মীয় ভিন্নমতাবলম্বী বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের জীবনে নাক গলানোর জন্য ধর্ম, অবশ্যই সবসময় তার প্রচেষ্টা অব্যহত রাখবে। এরা যতই অন্য জীবনের অনন্ত সুখের কথা ফলাও করে প্রচার করুক না কেন, তারা এই জীবনেই সকল ক্ষমতার অধিকারী হতে চায়। এটাই শুধুমাত্র এর থেকে আশা করা যেতে পারে, কারন, সর্বোপরি এটা সম্পুর্ন মানব সৃষ্ট। এবং ধর্মর নিজেরই তার নিজস্ব নানা প্রচারণার উপরে কোন ভরসা রাখতে পারে না, এমন কি নানা বিশ্বাসের শান্তিপুর্ন সহাবস্থানের বিষয়টিতেও পারে না সম্মতি দিতে ।

একটি সাধারন উদহারনই দেখা যাক, যার রুপকার আধুনিক ধর্মের সবচেয়ে সম্মানিত চরিত্রটি; ১৯৯৬ সালে আইরিশ প্রজাতন্ত্র একটি বিশেষ প্রশ্নের উপর গনভোট এর আয়োজন করেছিল, তাদের সংবিধান কি এখনও বিবাহ বিচ্ছেদের উপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রাখবে? ক্রমশ ধর্ম নিরেপক্ষতাবাদের দিকে অগ্রসর হওয়া দেশটির বেশীর ভাগ রাজনৈতিক দল, জনগনকে অনুরোধ করলেন এই আইনটি সংস্কার করার জন্য হ্যা ভোট দিতে। দুটো গুরুত্বপুর্ন কারনে আইরিশ নেতৃবৃন্দ এটি করতে চেয়েছিলেন: তারা বুঝতে পেরেছিলেন, প্রজাতন্ত্রের সব নাগরিকদের নৈতিকতাকে আইনী রুপ দেবার ক্ষেত্রে ক্যাথলিক চার্চের কোন ভুমিকা থাকার ব্যপারটা আসলে সঠিক না এবং বিষয়টি অবশ্যই বিচ্ছিন্ন উত্তর আয়ারল্যান্ডের সাথে ভবিষ্যতে কোন দিন একীভুত হবার আশা করাটাও একেবারে অসম্ভব করে ফেলবে, যদি এর উত্তরের প্রোটেষ্ট্যান্ট সংখ্যালঘুরা সারাক্ষনই ক্যাথলিক যাজকদের দ্বারা শাসিত হবার সম্ভাবনার কথা ভেবে সারাক্ষনই শঙ্কিত থাকে। ক্যাথলিকদের পক্ষে এই আইন পরিবর্তনের বিপক্ষে প্রচারনা করতে বা জনগনকে ’না’ ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করতে চার্চ এবং ধর্মীয় কট্টরপন্হীদের সহায়তা করতে কলকাতা থেকে উড়ে আসেন মাদার তেরেসা। অন্যভাবে বিষয়টি যদি বলি, একজন আইরিশ মহিলা, যার একজন মাতাল, বউ পেটানো, ইনসেস্ট্যুয়াস বা অগম্যগামী কোন পুরুষের সাথে বিয়ে হলে, তার আর এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করার কোন অধিকার নেই এবং ক্যাথলিক মতে তার আত্মাকে বিপথগামী এবং বিপদগ্রস্থ হবে যদি সেই মহিলা নতুন করে জীবন শুরু করার জন্য প্রার্থনা করে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন জানান। আর যদি কেউ প্রোটেষ্ট্যান্ট হয়, তবে তারা হয় রোমের ‍আশীর্বাদ নিতে পারে অথবা এ বিষয়ে তাদের পুরোপুরি চুপ থাকাটাই কাম্য। এমনকি না ভোটের জন্য প্রচারণাকারী ক্যাথলিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন কোন প্রস্তাবও ছিল না যে, তাদের বিশ্বাস বাকীদের উপর না চাপিয়ে ক্যাথলিকরা চাইলে তাদের চার্চের অনুগামী হতে পারে। এবং এটা হয়েছে আমাদের বৃটিশ দীপপুন্জ্ঞেই, বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে। যাই হোক, গনভোটে সংবিধানের এই ধারাটি পরিবর্তিত হয়েছিল, যদিও খুবই সামান্যতম ভোটের ব্যবধানে।( এবং মাদার তেরেসা সে বছরই একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি আশা করছেন তার বন্ধু্ রাজকুমারী ডায়ানা এবার সুখী হবেন, কারন তার স্পষ্টত দুর্ভাগ্যজনক বৈবাহিক সম্পর্ক অবশেষে থেকে মুক্তি লাভ করে। কিন্তু না, খু্ব একটা অবাক হবার কোন কারন নেই চার্চ এর দ্বি -মুখিতার স্বরুপ দেখে-সেটা মাদার তেরেসাই হোক না কেন-যা গরীবদের জন্য কঠোর আইন করে আর অন্যদিকে বোধগম্য কারনেই ধনীদের দেয় পশ্রয়।)

সেপ্টেম্বর ১১,২০০১ এর এক সপ্তাহ আগে, আমি যুক্তরাষ্ট্রের একজন সুপরিচিত রেডিও ধর্মীয় সম্প্রচারক ডেনিস প্রেগার সাথে একটি প্যানেলে ছিলাম। তিনি আমাকে চ্যালেন্জ্ঞ করেছিলেন শ্রোতাদের সামনে, তার ভাষায় ‘সরাসরি হ্যা বা না’ উত্তর দিতে হবে এমন একটি প্রশ্নের জবাব দেবার জন্য এবং আমি আনন্দের সাথে রাজী হয়েছিলাম। তিনি যেটা বলেছিলেন, সম্পুর্ন অপরিচিত একটি শহরে আমার নিজেকে কল্পনা করতে হবে, যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আমাকে আরো কল্পনা করতে হবে আমার দিকে এগিয়ে আসছে একদল মানুষ। এখন – আমি কি, আমাকে বেশী, নাকি কম নিরাপদ ভাববো, যদি আমি জানতে পারি যে তারা এই মাত্র একটি ধর্মীয় প্রার্থনা সভা থেকে ফিরছে? পাঠকরা হয়তো বুঝতে পারবেন, এটা সে ধরনের কোন প্রশ্ন না যার কেবল হ্যা বা না উত্তর দেয়া যেতে পারে। কিন্তু আমি এর উত্তর দিতে সক্ষম হয়েছিলাম, যেন আমার জন্য এটি কোন কাল্পনিক পরিস্থিতি নয়: ”যদি শুধু ইংরেজী ’“বি’ অক্ষরেই সীমাবদ্ধ থাকি, আমি আসলে এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে, বেলফাষ্ট, বৈরুত, বোম্বে, বেলগ্রেড, বেথলেহেম এবং বাগদাদে। প্রতিটা ক্ষেত্রেই আমি দ্বীধাহীনভাবে বলতে পারি এবং কারনও ব্যাখ্যা করতে পারি, কেন এরকম একটা পরিস্থিতিতে আমার তাৎক্ষনিকভোবে শঙ্কিত বোধ করা উচিৎ, যদি আমি মনে করি, সন্ধ্যা বেলায় আমার দিকে এগিয়ে আসা এই অচেনা মানুষের দলটি ফিরছে কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান শেষ করে।”

এই ছয়টি জায়গায় আমার স্বচক্ষে দেখা ধর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত নিষ্ঠুরতার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিচ্ছি। বেলফাস্টে, আমি দেখেছি সমস্ত রাস্তা জুড়ে ঘরবাড়ি আগুনে পুড়ে ধ্বংশস্তুপ হয়ে আছে, খৃষ্টধর্মের বিভিন্ন সেক্ট বা সম্প্রদায়গুলোর পারস্পরিক সাম্প্রদায়িক যুদ্ধের ফলে এবং আমি সাক্ষাৎকার নিয়েছি সেই সব মানুষেদের যাদের স্বজনদের অপহরন করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে বা নির্মম অত্যাচার করেছে প্রতিদ্বন্দী ধর্মীয় গ্রুপের ডেথ স্কোয়াডদের সদস্যরা, শুধু মাত্র অন্য ধর্ম বিশ্বাসে বিশ্বাসী হওয়া ছাড়া প্রায়ই আর কোন অপরাধই ছিল না তাদের।একটা পুরোনো বেলফাস্টের কৌতুক আছে, একবার এক ব্যক্তিকে বেলফাস্টের কোন একটা রোড ব্লকের চেক পোষ্টে আটকানো হলে, তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় তার ধর্ম কি? যখন সে উত্তর দেয়, সে আসলে নাস্তিক, তখন তাকে আবার জিজ্ঞাসা করা হয়, ’প্রোটেষ্ট্যান্ট নাকি ক্যাথলিক নাস্তিক?’ আমার মনে হয় এই কৌতুকটা দিয়ে বোঝা সম্ভব, কিভাবে ধর্ম নিয়ে অন্ধ মোহগ্রস্থতা স্থানীয়দের কিংবদন্তীতুল্য রসবোধেও পচন ধরেছে। যাই হোক, আমার এক বন্ধুর সাথে এই ঘটনেই ঘটেছিল, এবং অবশ্যই অভিজ্ঞতাটা সুখের ছিল না। আপাতদৃষ্টিতে এই ধ্বংশযজ্ঞের অজুহাত হলে প্রতিদ্বন্দী জাতীয়তাবাদ, কিন্তু দ্বন্দরত প্রতিপক্ষ দলগুলোর রাস্তায় যে শব্দ বা ভাষা ব্যবহার করে, সেগুলো প্রতিপক্ষ ধর্মবিশ্বাসের প্রতি অপমানজনক ( যেমন, Prods এবং Teagues)। অনেক বছর ধরে দেশটির প্রোটেষ্ট্যান্ট প্রতিষ্ঠানগুলো চেয়েছে ক্যাথলিকদের আলাদা এবং দমন করে রাখতে। আসলেই যখন এখানে আলস্টার (Ulster) রাষ্ট্র গঠন করা হয়েছিল, তাদের শ্লোগান ছিল, ‘একটি প্রোটেষ্ট্যান্ট সংসদ প্রোটেস্ট্যান্ট জনগনের জন্য’; ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার একটি প্রকৃতি হলো এটি খুব সুবিধাজনক ভাবে স্বউৎপাদনশীল এবং নিশ্চিৎ ভরসা রাখা যায় এর ‍উপর যে, এটি পাল্টা পরস্পরমুখী সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দেবেই। মুল ব্যাপারটায় ক্যাথলিক নেতৃত্বেরও মৌন সম্মতি আছে, যারা যাজক প্রধান স্কুল এবং পৃথকীকৃত প্রোটেষ্টান্টদের থেকে বিচ্ছিন্ন বসবাস করার এলাকাই কামনা করে; কারণ সেক্ষেত্রে তাদের পক্ষে সবকিছুকে নিয়ন্ত্রন করাটা সহজ হবে। সুতরাং ঈশ্বরের নামে প্রাচীন পুর্বপুরুষের ঘৃণাগুলো নতুন প্রজন্মের স্কুলের শিশুদের মাথায় জোর করে, বলা যায় ড্রিল করে ঢোকানো হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে ( এমনকি ড্রিল শব্দটা আমাকে অসুস্থ করে ফেলে: কারন এ ধরনের পাওয়ার টুল বা যন্ত্র প্রায়শই ব্যবহার করা হয়ে থাকে ধর্মীয় দলগুলো বিরাগভাজন হওয়া মানুষগুলোর হাটুর মালাকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেবার জন্য)।

১৯৭৫ সালের গ্রীষ্মে আমি যখন প্রথমবারের মত বৈরুতে আসি, তখনও শহরটাকে ’প্রাচ্যের প্যারিস’ বলে চিহ্নিত করা অসম্ভব ছিল না। তারপরও আপাতদৃষ্টিতে এই স্বর্গ বা ইডেনে নানা ধরনের সরীসৃপেরও কোন কমতি ছিল না। প্রধান যে অসুখটায় এটি আক্রান্ত ছিল তা হলো ধর্মের আধিক্যতা, বিরাজমান সবগুলো ধর্মই দেশটির গোত্রভিত্তিক সাম্প্রদায়িক সংবিধানে ’কোন না কোন ভাবে জায়গা’ করে নিয়ে নিয়েছিল। আইনগতভাবে দেশটির রাষ্ট্রপতিকে হতে হবে একজন খৃষ্টধর্মীকে, সাধানত: কোন একজন ম্যারোনাইট ক্যাথলিক, সংসদের স্পীকার হবেন একজন মসুলমান এবং এভাবে আরো অনেক র্ধ্ম ভিত্তিক পদ। স্পষ্টতই এই পদ্ধতিটি কখনোই সুষ্ঠভাবে কাজ করেনি। কারন বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাস, এমনকি বর্ণ ও জাতিগত পরিচয়ের বিভেদগুলোকে এটি সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিয়েছিল ( যেমন, মসুলমানদের গোত্র শিয়ারা ছিল সামাজিক শ্রেনীবিন্যাসের সবচেয়ে নীচের স্তরে এবং এছাড়া কুর্দদের ছিল না কোন ধরনের রাজনৈতিক এবং সামাজিক অধিকার)।

প্রধান যে খৃষ্টীয় দলটি ছিল, তারা আসলে ছিল একটি ক্যাথলিক মিলিশিয়ার দল, ফ্যালান্জ বা ফ্যালাঙ্কস (Phalange বা Phalanx); দলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পিয়ের জেমাইয়েল বলে একজন ম্যারোনাইট লেবাননীয় ক্যাথলিক ব্যক্তি, যিনি ১৯৩৬ সালে হিটলারের আয়োজিত বার্লিন অলিম্পিক দেখে ভীষন মুগ্ধ হয়েছিলেন। তার এই ধর্ম ভিত্তিক দলটি আন্তর্জাতিক কুখ্যাতি পায় ১৯৮২ সালে, লেবাননে শাতিলা সাবরায় প্যালেষ্টাইনীয়দের শরনার্থী শিবিরে, ইসরায়েলী জেনারেল শ্যারন এর সরাসরি নির্দেশে ব্যপক গনহত্যা পরিচালনায প্রধান ভুমিকা রাখার মাধ্যমে। একজন ইহুদী জেনারেল যে একটি খৃ্ষ্টীয় ফ্যাসিবাদী দলের সাথে আঁতাত করবে এটাই যথেষ্ট পরিমানে ভয়াবহ কুৎসিত একটি ঘটনা, কিন্তু তারা একজোট হয়েছিল কারন তাদের শক্র ছিল একই: মসুলমানরা। লেবাননের রাজনীতিতে ইসরায়েলের হঠাৎ প্রবেশটাই ইন্ধন যুগিয়েছিল হিজবুল্লাহর সৃষ্টিতে, যদিও বেশ নম্রভাবে নামকৃত ‘আল্লাহর দল’, এটি মুলত: লেবাননের অবহেলিত শিয়াদের সংগঠিত করে ধীরে ধীরে নিয়ে আসে ইরানের ধর্মতন্ত্রের শীর্ষ নেতৃত্বর অধীনে, যারা এর তিন বছর আগে তেহরানে ক্ষমতায় আসীন হয়েছিল। এই সুন্দর লেবাননেই সংগঠিত বা অর্গানাইজড ক্রাইম দলে সদস্যদের থেকে অপহরনের বানিজ্য দীক্ষা শেষে, ঈশ্বর বিশ্বাসীরা অবশেষে ’আত্মঘাতী বোমা’ হামলার সৌন্দর্যের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। এখনও আমি মনে করতে পারি, বোমা হামলায় প্রায় সম্পুর্ন ধ্বংসপ্রাপ্ত ফরাসী দুতাবাসের সামনে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মাথা পড়ে আছে রাস্তায়। মোট কথা হলো, যখনই প্রার্থনা সভা শেষ হয়, আমি রাস্তার অন্যপাশে যাওয়ার চেষ্টাই করি।

বোম্বে, এর সাগরের তীর ঘেষে চলা রাজপথে গলার হারের মত করে সাজানো আলোকসজ্জা, বিট্রিশ রাজের স্থাপত্য, সব মিলিয়ে একেও বলা হতো ’প্রাচ্যের মুক্তা’। এটি ভারতের সবচেয়ে বৈচিত্রময় বহুজাতিক শহরের একটি এবং এবং নানা স্তরের বৈচিত্রময়তাকে বুদ্ধিমত্তার সাথে খুজেছিলেন লেখক সালমান রুশদী, বিশেষ করে তার The Moor’s last Sigh উপন্যাসটিতে এবং মিরা নায়ার, তার চলচ্চিত্রে। এটা সত্যি যে সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে এর আগেও, যখন ১৯৪৭-৪৮ সালে ভারতের স্বশাসনের স্বপক্ষে সুবিশাল ঐতিহাসিক আন্দোলন যখন বিপদগ্রস্থ করেছিল মসুলমানদের একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবি এবং একজন অতি ধার্মিক হিন্দুর কংগ্রেস দলের মুল নেতৃত্ব দেবার বিষয়টি। যত পরিমান মানুষ এ্ই শহর পরিত্যাগ করেছিল বা বের করে দেয়া হয়েছিল সে সময়ের ধর্মীয় রক্তপিপাসু দাঙ্গায়, প্রায় সমপরিমান মানুষই আবার আশ্রয় পেয়েছিল এই শহরে। একধরনের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সহাবস্থান কিন্তু গড়ে উঠেছিল সেখানে পরবর্তীতে, সাধারনত: সমুদ্র তীরবর্তী শহরগুলোতে যেমন ঘটে থাকে এবং শহরটির উপর নানাধরনের বহিসংস্কৃতির প্রভাবের ফলে। পার্সীরা – প্রাক্তন জোরোয়াস্ট্রিয়ানরা, যাদের পার্সিয়া বা ইরানে নীপিড়ন থেকে বাচতে এখানে বসতি গড়েছিল-তারা ছিল এখানে সুপরিচিত সংখ্যালঘু, এছাড়া এই শহরে বাস করে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপুর্ন ইহুদী সম্প্রদায়ের একটি গ্রুপ। কিন্তু বিষয়টি বাল থ্যাকারে এবং তার উগ্র হিন্ুরে জাতীয়তাবাদী শিব সেনাদের সন্তুষ্ট করেনি, ১৯৯০ এর দশকে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, বোম্বে শহর তার অনুসারীরাই শুধুমাত্র তার অনুসারীদের জন্য শাসন করবে। তিনি তার পোষা এবং ধর্মীয় জোশে উদ্বুদ্ধ গুন্ডা পান্ডাদের রাস্তায় লেলিয়ে দেন নানা অপকর্ম ঘটাতে এবং যে তার সেই শক্তি আছে, সেটা সবাইকে দেখাতে, তিনি নির্দেশ দেন এই শহরের নাম বদলিয়ে রাখতে, মুম্বাই; কিছুটা সেকারনেই আমি এই নামটি উল্লেখ করলাম শহরটির ঐতিহ্যবাহী নামের নীচে।

১৯৮০র দশক পর্যন্ত্ বেলগ্রেড ছিল প্রাক্তন ইয়োগোস্লাভিয়া ( বা দক্ষিনের স্লাভদের দেশ) র রাজধানী। যে নামের অর্থ ইঙ্গিত করেছে, এটি বহু্জাতিক এবং বহুবিশ্বাসে বিশ্বাসীদের একটি দেশের রাজধানী। আমাকে অবশ্য একজন ধর্মনিরপেক্ষমনা ক্রোয়াট বুদ্ধিজীবি একবার হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন, যে বেলফাস্টের মতই, যা একটা অস্বস্তিকর কৌতুকের আকার নিয়েছিল; যদি ’আমি বলি যে আমি একজন নীরিশ্বরবাদী এবং একজন ক্রোয়াট, তখন মানুষ আমাকে জিজ্ঞাসা করে, আমি কিভাবে প্রমান করবো আমি যে সার্ব না’; এর অন্য অর্থ হচ্ছে আপনি যদি ক্রোয়াট হন তাহলে আপনাকে হতে হবে রোমান ক্যাথলিক। সার্ব হতে হলে আপনাকে হতে হবে অর্থোডক্স খৃষ্টান। ১৯৪০ এর শুরুতে, এর অর্থ হচ্ছে, একটি নাৎসী জার্মান নিয়ন্ত্রিত একটি পুতুল সরকার ক্ষমতা নেয় ক্রোয়েশিয়ায়, এবং যা বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে রোমান ক্যাথলিকদের কেন্দ্র ভ্যাটিক্যানের । এই ফ্যাসিবাদী ক্রোয়াট সরকার, স্বভাবতই এই এলাকা থেকে স্থানীয় ইহুদীদের বিতাড়িত ও হত্যার মাধ্যমে নির্মুল করার পাশাপাশি, অন্য খৃষ্ট ধর্ম মতাবলম্বীদেরও জোর করে ক্যাথলিক মতাবলম্বীতে রুপান্তরিত করার একটি জঘন্য ক্যামপেইনও পরিচালনা করে। এর ফলাফলে লক্ষ লক্ষ সার্ব অর্থডক্স খৃষ্টানকে হত্যা করা হয় ( যাকে ভ্যাটিক্যান হলোকষ্ট বলা হয়ে থাকে কোন কোন ক্ষেত্রে) অথবা সমুলে উৎখাত করা হয় তাদের বাসভুমি থেকে এবং এই লক্ষ্যে এই ফ্যাসিবাদী সরকারটি ইয়াসেনোভাকস (Jasenovacs) শহরে কাছে সুবিশাল কনসেনট্রেশন ক্যাম্প গঠন করা হয়েছিল। জেনারেল আন্তে পাভেলিচ ও তার উসতাশে (Ustashe) পার্টির ফ্যাসিবাদী উগ্র স্বৈরশাসন এতই ভয়াবহ রকম জঘন্য প্রকৃতির ছিল যে, এমনকি বেশ কিছু জার্মান নাৎসী অফিসার এরকম একটি সরকারে সাথে জড়িত থাকতে ইচ্ছুক না বলে প্রতিবাদও করেছিল।

যখন ১৯৯২ সালে আমি ইয়াসেনোভাকস ক্যাম্প দেখতে আসি তখন নিপীড়নের জ্যাকবুটটি অন্য পায়ে। স্লোবোদান মিলোসেভিচ এর নেতৃত্বে সার্বিয়ার সামরিক বাহিনী তখন দুইটি ক্রোয়েশিয়ান শহর ভুকোভার ও দুব্রোভনিকিএ নিষ্ঠুরভাবে বোমা মেরে ধ্বংশস্তুপে পরিনত করেছে। মুসলিম প্রধান শহর সারায়েভো তখন ঘিরে রেখেছে সার্ব বাহিনী, ২৪ ঘন্টা ধরে সেখানে বোমা হামলা চলছে। বসনিয়া হারজেগোভনিয়ায় অন্য জায়গায়, বিশেষ করে দৃনা নদীর তীর ঘেষে গনহত্যা, ধর্ষন আর লুটতরাজ চালায় সার্বরা, যে অপারেশনের নাম তারা নিজেরাই দিয়েছিল, ’জাতিগত বিশোধন’; যা আসলে, ’ধর্মীয় বিশোধন’ বললেই সঠিক হতো বেশী। মিলোসেভিচ লোকটি ছিল প্রাক্তন কমিউনিষ্ট সরকারের একজন আমলা, যে পরবর্তীকে রুপান্তরিত হয় ভিন্ন জাতি বিদ্বেষী একজন উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং তার মসুলমান বিরোধী ক্রসেড মুলত ছিল অর্থোডক্স খৃষ্টান সার্বদের জন্য বৃহত্তর সার্বিয়া সৃষ্টির লক্ষ্যে বসনিয়াকে দখল করার একটি কৌশল মাত্র। এই ক্রসেডটি পরিচালিত হয় মুলত বেসরকারী মিলিশিয়া বাহিনীর মাধ্যমে, যার নিয়ন্ত্রন ছিল তার হাতেই ( যা অবশ্যই প্রথাগতভাবে অস্বীকার করা হয়েছে); এই মিলিশিয়ার দল তৈরী হয়েছিল ধর্মোউন্মাদ উগ্র মানসিকতার মৌলবাদীদের নিয়ে, যাদের নিয়মিত আশীর্বাদ দিয়েছে অর্থডক্স খৃষ্টীয় যাজক এবং বিশপরা; এবং এদের দলগুলোকে সংখ্যায় ভারী করেছে গ্রীস ও রাশিয়া থেকে আসা, তাদের মত অর্থডক্স মতাবলম্বী সেচ্ছাসবকরা। এই খৃষ্টীয় অর্থোডক্সদের মিলিশিয়া বাহিনীর নানাবিধ কুকর্মের সাথে আরো একটি অন্যতম প্রধান কাজ ছিল, অটোমান শাসনের ( মুসলিম শাসন বিধায়) স্মারক সকল ঐতিহাসিক চিহ্নকে ধ্বংশ করা, এর একটি উল্লেখযোগ্য উদহারন হচ্ছে বানিয়া লুকায় বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক মিনারকে ডায়নামাইট দিয়ে ধ্বংশ করা। এই কাজটি তারা করেছিল পরিকল্পনা মোতাবেক যুদ্ধবিরতির সময়, কোন যুদ্ধের অংশ হিসাবে না।

অন্যদিকে আবার একই ঘটনা ঘটিয়েছিল তাদের ক্যাথলিক প্রতিপক্ষও, যদিও প্রায়ই যেটা ভুলে যাওয়া হয়। কমিউনিষ্ট শাসনামলের অবসান ঘটলে, ক্রোয়েশিয়ায় উসতাশে আন্দোলনের পুনরুত্থান ঘটে, এবং ক্রোয়েশিয়াও জোর করে হারজেগোভনিয়া ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যা তাদের দখলে (নাৎসী সমর্থিত ক্রোয়েশিয়া) ছিল। এই বলকান যুদ্ধের সময় অন্য সীমান্ত দিয়ে বসনিয়া হারজেগোভনিয়ার আরেকটি অপুর্ব সুন্দর শহর মোস্তারকে বোমা মেরে ধ্বংশ করে ক্রোয়েশিয়ার সামরিক বাহিনী। মোস্তারের কেন্দ্রে স্টারি মোস্ত বা পুরোনো ব্রীজ, যা ছিল একটি সুপরিচিত ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট এবং তুরস্কের শাসনামলের একটি নিদর্শন; ক্রোয়েশীয় মিলিশিয়ারা এটাকে বোমা মেরেছিল যতক্ষন না পর্যন্ত এটি নীচের নদীতে সম্পুর্ন ভেঙ্গে পড়ে। আসলে উগ্রপন্হী ক্রোয়াট এবং সার্ব বাহিনী পরস্পরের সাথে এক অশুভ আঁতাত করেছিল বসনিয়া-হারজেগভনিয়াকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ভাগ এবং ধর্মীয় বিশোধন (মসুলমান নিধন) করার প্রক্রিয়ায়। তারা সেই সময়ে এবং এখনও বিশ্ব ব্যাপী এই অপকর্মের লজ্জা এড়াতে পারছে, কারন খবর প্রকাশের গণমাধ্যমগুলো শব্দগুলোর অতিসরলীকরণ পছন্দ করে, যেমন ক্রোয়াট, সার্ব এবং শুধুমাত্র তারা যখন মুসলিমদের নিয়ে আলোচনা করে, তখনই কেবল ধর্ম বিষয়টি উল্লেখিত হয়। কিন্তু এই তিনটি শব্দ ক্রোয়াট, সার্বে এবং মুসলিম সমতুল্য না এবং বিভ্রান্ত সৃষ্টিকারী, কারন এখানে শব্দগুলো দুটি জাতীয়তা এবং একটি ধর্মকে নির্দেশ করছে (এই একই ভুল অন্যরকম ভাবে ইরাকের খবর পরিবেশনের সময়ও করা হয়েছে: শিয়া, ‍সুন্নী এবং কুর্দ এই ত্রিপাক্ষিক সংঘর্ষকে ব্যাখ্যা করতে); বসনিয়ার সারায়েভোকে যখন অবরোধ করে রাখা হয়েছিল, তখন সেখানে ছিল প্রায় ১০,০০০ সার্ব, সারায়েভো রক্ষা করার জন্য নিয়োজিত বাহিনীর নের্তৃত্ব স্থানীয় একজন কম্যান্ডার ছিলেন জেনারেল ইয়োভান দিভইয়াক, যুদ্ধের সময় যে ভদ্রলোকটির সাথে হাত মেলানোর সুযোগ পেয়েছিলাম বলে আমি গর্ব করতে পারি, তিনি নিজেও একজন সার্ব। শহরের ইহুদী জনসংখ্যা, যারা সেই ১৪৯২ সাল থেকে বসতি গড়েছে এখানে, তারাও বসনিয়া সরকারের সাথেই ছিল সবসময়। বিবরণগুলো অনেক বেশী সঠিক হতো যদি যদি টেলিভিশন এবং পত্রপত্রিকা খবরটাকে এভাবে পরিবেশন করতেন: আজ অর্থডক্স খৃষ্টান বাহিনী সারায়েভোর উপর তাদের বোমা বর্ষন অব্যাহত রেখেছে বা গতকাল ক্যাথলিক মিলিশিয়ারা মোস্তারে স্টারি মোস্ট সেতুটিকে ধ্বংশ করতে সফল হয়েছে। কিন্তু এই ধর্মীয় পরিচয় সংরক্ষিত রাখা হয়েছে শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্য যখন তাদের খুনী ধর্ষনকারীরা, তাদের নিজেদের ধর্মবিশ্বাসকে চিহ্নিত করার চেষ্টার কোন ক্রটি করেনি: যেমন মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্যদের ব্যান্ডোলিয়ের ( গুলি রাখার বেল্ট) এ বড় অর্থডক্স ক্রস লাগানো থাকতো কিংবা কুমারী মাতা মেরীর ছবি সাটা থাকতো তাদের রাইফেল বাটে । এভাবেই ধর্ম সবকিছুকে বিষাক্ত করে তোলে, এমনকি আমাদের নিজেদের প্রকৃত ঘটনার পার্থক্য বোঝার ক্ষমতাটাকে।

বেথলেহেমের ক্ষেত্রে, আমার মনে হয় আমি জনাব ডেনিস প্রেগারকে কোন ভালো দিনে শুধুমাত্র ছাড় দিতে পারি। সম্ভবত আমি যথেষ্ট নিরাপদ বোধ করবো কোন সন্ধ্যাবেলায় চার্চ অব ন্যাটিভিটির সামনে দাড়িয়ে থাকতে। এই বেথলেহেমেই, জেরুজালেম থেকে বেশী দুরে নয়, অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, একজন অস্পৃশ্য কুমারীর সহায়তায় ঈশ্বর তার পুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন।

”এভাবেই যীশু খৃষ্টের জন্ম হলো। তার মা মেরীর বিয়ে ঠিক ছিল জোসেফের সাথে, কিন্তু তারা একসাথে হবার আগে, মেরী পবিত্র আত্মার মাধ্যমে অন্তসত্ত্বা হলেন”; হ্যা, এভাবেই গ্রীক অর্ধদেবতা পার্সিউসেরও জন্ম হয়েছিল, যখন দেবতা জুপিটার কুমারী ডানাই র কাছে আসেন স্বর্ণর বৃষ্টি ধারা হিসাবে এবং তার গর্ভে জন্ম দেন একটি পুত্র সন্তানের । বুদ্ধেরও জন্ম হয়েছিল তার মায়ের শরীরের পাশের একটি খোলা জায়গা দিয়ে। জোড়াসাপে ঘেরা ক্যাটলিকাস, পালকের একটা বল, আকাশ থেকে নিয়ে নিজের বুকে লুকিয়ে রেখেছিল এবং অ্যাজটেক দেবতা হুইটজিলোপোচ্টলীর এভাবে জন্ম হয়েছিল তার গর্ভে। নিহত আজদেশট্রিশ এর রক্তে প্রতিপালিতেএকটি ডালিম গাছ খেকে কুমারী নানা একটা ডালিম পাড়েন এবং তার বুকের উপর এটি রাখেন এবং দেবতা অ্যাটিসের জন্ম হয় সেখানে। এক মঙ্গোল রাজার কুমারী কন্যা একদিন রাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখেন তিনি স্বর্গীয় আলোয় অবগাহন করছেন, যা তাকে গর্ভবতী করে ফেলে এবং গেন্জিস খানের জন্ম দেন। কুমারী দেবকার গর্ভে জন্ম নেন কৃষ্ণ। হোরাস এর জন্ম হয়েছিল কুমারী আইসিসের গর্ভে, মার্কারীকে জন্ম দিয়েছিলেন কুমারী মায়া। কুমারী রিয়া সিলভিয়া জন্ম দিয়েছিল রোমুলাসের। কোন বিশেষ কারনে বহু ধর্মীয় শক্তিই মনে করে যে নারীর সন্তার প্রসবের পথ একমুখী চলাচলের বা ওয়ান ওয়ে রাস্তার মত; এবং এমনকি কোরানও কুমারী মেরীকে দেখেছে বিশেষ সন্মানের সাথে। কিন্তু যাই হোক বিষয়টা পরবর্তীতে ধর্মযুদ্ধগুলোর উপর কোন প্রভাবই ফেলতে পারেনি, পোপের সেনাবাহিনী যখন বেথলেহেম এবং জেরুজালেম মুসলিমদের থেকে দখল করার যাত্রা শুরু করে, সারা পথে তারা বহু ইহুদী বসতিও ধ্বংশ করেছে, ভিন্নমতাবলম্বী খৃষ্টীয় বাইজানটিয়ামে লুট তরাজ করেছে এবং জেরুজালেমের সরু রাস্তায় তারা এমনই গনহত্যা চালিয়েছিল যে, উন্মত্ত, বিকৃত আনন্দে বিভোর এসব ঘটনার লিপিবদ্ধকারীদের বিবরন অনুযায়ী,সেখানে গনহত্যায় নিহত মানুষের রক্ত নাকি ধর্মযোদ্ধাদের ঘোড়ার লাগাম অবধি উঠেছিল।

এরকম কিছু ধর্মীয় ঘৃনা, জাতিগত বিদ্বেষ, গোড়ামী আর রক্তপিপাসার ঝড় হয়ত এখন অতিক্রান্ত হয়েছে, তারপরও এই এলাকায় এররকম আরো নতুন ঝড় সবসময়ই প্রত্যাসন্ন কিন্তু সে অবধি যে কেউই এই ’ম্যান্জার স্কোয়ার’ এ আপাতত নিজেকে আপেক্ষিকভাবে তেমন নিগৃহীত নাও ভাবতে পারেন। এই ম্যান্জার স্কোয়ারটি হচ্ছে শহরটির কেন্দ্র, এর নাম যেমন ইঙ্গিত করছে, একটি টুরিষ্ট ধরার এমন একটা চুড়ান্তভাবে রুচিহীন ফাদ, যে ল্যুর্ডকেও ( ফরাসী একটি গ্রাম, যেখানে কুমারী মার অশরীরি আবির্ভাব দেখেছেন বলে স্থানীয়রা দাবী করেছিলেন) লজ্জায় ফেলে দেবে। আমি প্রথম যখন এই করুণ শহরটি এসেছিলাম, এটা নামে মাত্র মুলত খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী প্যালেস্টাইনদের নিয়ন্ত্রিত একটি পৌরসভার অধীনে ছিল, যা মুলত সম্পর্কযুক্ত ছিল একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিবারের সাথে যারা পরিচিত ছিল ফ্রেইজ পরিবার নামে। এর পরে শহরটিকে আবার যখন দেখি, তার আগ পর্যন্ত এটি ছিল মুলত ইসরায়েলী সামরিক কর্তৃপক্ষের নিষ্ঠুর কারফিউর অধীনে-যে কর্তৃপক্ষের নিজেদের এই ওয়েষ্ট ব্যাঙ্কে উপস্থিতিটাই আবার কোন প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত ভবিষ্যতবানীর সাথে কিন্তু সম্পর্কহীন নয়। যদিও পরবর্তীতে এই সময় তাদের উপস্থিতি অন্য একটি ধর্মীয় গ্রুপের মানুষের কাছে অন্য আরেক ঈশ্বরের করা প্রতিজ্ঞার সাথে সম্পর্কিত ছিল। হামাসের শক্তিশালী নেতৃত্ব, যারা দাবী করে পুরো প্যালেষ্টাইনটা একটি ইসলামী ওয়াকফ সম্পত্তি বা ইসলামের জন্য করা পবিত্র কোন দান, ধীরে ধীরে বেথলেহেমে এর খৃষ্ঠান প্যালেস্টাইনীদের ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে দেয়। তাদের নেতা মাহমুদ আল জহর, ঘোষনা দেন যে ইসলামিক স্টেট অব প্যালেস্টাইন এর সকল অধিবাসীরা মুসলিম আইন মেনে চলবে, তেমনটাই আশা করা হচ্ছে। বেথলেহেমে, এখন প্রস্তাব করা হয়েছে অমুসলিমদের উপর আল-জেজিয়া কর আরোপ করা হবে. সেই ঐতিহাসিক কর যা পুরোনো অটোমান সাম্রাজ্য ধিম্মি বা অবিশ্বাসী ( শরীয়া আইন অনুযায়ী, ইহুদী, খৃষ্ঠান ইত্যাদি, ট্যাক্সের বিনিময়ে ইসলামী রাষ্ট্র যাদের নাগরিক অধিকার ও সুরক্ষা প্রদান করার ‍দাবী করে); এই পৌরসভার মহিলা কর্মচারীদের নিষিদ্ধ করা হয় পুরুষ দর্শনার্থীদের সাথে করমর্দন করে শুভেচ্ছা জানানোর প্রথা পরিত্যাগ করতে। গাজা শহরে ইউসরা আল আজামী নামের এক তরুনীকে গুলি করে হত্যা করা হয়, একটা গাড়ীতে তার হবু স্বামীর সাথে বসে থাকার কারনে। তার তরুন বর অবশ্য জানে বেচে যায় ভয়ঙ্কর নির্যাতন সহ্য করার পর। হামাসের নেতারা তাদের তথাকথিত ‘ভাইস এবং ভার্চু‘ স্কোয়াডের এই অহেতুক হত্যা আর নির্যাতনের স্বপক্ষে সাফাই গেয়েছে এই বলে যে তারা ‘সন্দেহজনক অনৈতিক ব্যবহার‘ এ জড়িত ছিল। একদা ধর্মনিরেপক্ষ প্যালেস্টাইনে, ভয়াবহভাবে যৌন অবদমিত তরুনদের দলকে এখন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে পার্ক করা গাড়ীর মধ্যে উকি মেরে দেখতে এবং তাদের অনুমতি দেয়া হয়েছে, যা ইচ্ছা তাই করবার জন্য।

আমি একবার ইসরায়েলের পরিশীলিত এবং চিন্তাশীল কুটনীতিক এবং রাষ্ট্রপরিচালনায় প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম একজন আব্বা এবান এর নিউ ইয়র্কে প্রদত্ত একটি বক্তৃতা শুনেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ইসরায়েল এবং প্যালেস্টাইনের সংঘর্ষর প্রথমেই যে বিষয়টা চোখে পড়ে, তা হলো এই সমস্যার খুবই সহজ সমাধানযোগ্যতা। এই মনোযোগ কাড়া ভুমিকার পর, প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধিত্ব করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কর্তৃত্ব নিয়ে তিনি আরো যোগ করেছিলেন যে, মুল বিষয়টা খুবই সাধারন, প্রায় মোটামুটি একই সমপরিমান দুটি জনগোষ্ঠী, একই ভুমির উপর তাদের দাবী জানাচ্ছে। অবশ্যই সেক্ষেত্রে সহজ সমাধানটা হচ্ছে পাশাপাশি দুটি রাষ্ট্র তৈরী করা। নিশ্চয়ই এতো স্বচ্ছ ব্যপারটা মানুষের বোঝার ক্ষমতার বাইরে নিশ্চয়ই নয়? এবং বিষয়টা আসলে সেরকমই হয়ত ছিল, বহু দশক আগে, যদি এ বিষয়টা থেকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে দাবী করা মেসিয়ানিক রাবাইদের এবং মোল্লা বা পাদ্রীদের দুরে রাখা যেত। কিন্তু উভয়পক্ষের ধর্মীয় পুরোহিতদের ঈশ্বর প্রদত্ত অধিকারের উপর উন্মত্ত একচেটিয়া দাবীগুলো এবং এর সাথে ইন্ধন যোগানো আর্মাগেডন-মনোভাবাপন্ন খৃষ্টানরা যারা অ্যাপোক্যালিপস কে আরো কাছে এগিয়ে নিয়ে আসার আশা করছে (তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, যার আগে সব ইহুদীর মৃত্যু অথবা ধর্মান্তর ঘটবে), এই পুরো ব্যাপারটাকে নিয়ে গেছে অসহনীয় একটা পর্যায়ে। পুরো মানবতা এখন জিম্মি হয়ে আছে এই ঝগড়া ফ্যাসাদের কাছে, যার সাথে এখন যোগ হয়েছে আসন্ন পারমানবিক যুদ্ধের শঙ্কা। ধর্ম সবকিছুকেই বিষাক্ত করে ফেলে। সভ্যতার জন্য ভয়ানক অভিশাপ ছাড়াও এ্টা এখন মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য পরিনত হয়েছে ভয়ঙ্কর হুমকিতে ।

সবশেষে বাগদাদ পরিস্থিতিতে আসি। এটি জ্ঞানার্জন আর সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ইতিহাসের অন্যতম সর্বশ্রেষ্ট কেন্দ্র ছিল একসময়। এখানেই একসময় খুজে পাওয়া গেছে অ্যারিস্টোটল সহ অন্য অনেক গ্রীকদের হারিয়ে যাওয়া কাজগুলো (হারিয়ে যাবার কারন অবশ্য, যার কিছু খৃষ্টান কর্তৃপক্ষ কিছু পুড়িয়েছিল, কিছু প্রকাশ বা ব্যবহার করতে নিষিদ্ধ করেছিল, দর্শনের স্কুলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল চিরতরে যাতে যীশুর শিক্ষার সমান্তরালে এবং মুখোমুখি নৈতিকতা নিয়ে যেন কোন ধরনেরই কার্যকরী আলোচনা না হতে পারে সেই লক্ষ্যে) সুরক্ষিত এবং পুনরায় অনুদিত হয়েছিল, এবং আন্দালুসিয়া দিয়ে সেগুলো সেগুলো আবার অজ্ঞ অন্ধকারে থাকা পশ্চিমা খৃষ্টানদের মধ্যে প্রচারিত হয়েছিল। বাগদাদের গ্রন্থাগার, এর কবিরা এবং স্থপতিরা অত্যন্ত সুপরিচিত ছিলেন। এই সব অনেক অর্জনই সম্ভব হয়েছিল মসুলমান খলিফাদের অধীনে, যারা মাঝে মাঝে এর জন্য সম্মতি যেমন দিয়েছেন, তেমনি কখনও কখনও নিয়ন্ত্রনও করেছেন তাদের প্রকাশকে তাদের খেয়াল খুশী মতন। এছাড়া বাগদাদ কিন্তু সুপ্রাচীন কালদিয়ীয় (Chaldean) এবং নেস্টোরিয়ীয় (Nestorian) খৃষ্টধর্মীয় ঐতিহ্যের চিহ্নও বহন করে এবং তাছাড়া ইহুদী ডায়াস্পোরার (প্রাচীন জুডেয়া এবং পরে প্রতিশ্রুত এরেৎজ ইসরায়েল থেকে নির্বাসিত ইহুদীরা) অন্যতম একটি কেন্দ্রও এটি। ১৯৪০ এর দশকের শেষ পর্যন্ত বর্তমানে জেরুজালেমে যত পরিমান ইহুদী বাস করে সমপরিমান ইহুদীদের বসবাস ছিল এই শহরে।

এপ্রিল ২০০৩ এ বলপুর্বক সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করা বিষয়ক কোন ব্যাপারে, আমার অবস্থান সম্বন্ধে বিস্তারিত কিছু এখানে বর্ণনা করবো না। শুধু বলবো তার শাসনামলকে যারা ধর্মনিরেপেক্ষ বলে মনে করেন, তারা নিজেদেরকে এখনো বিভ্রান্তিতে রেখেছেন। এটা সত্য যে সাদ্দাম এর নেতৃত্ব দেয়া বাথ পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মিশেল আফলাক নামের একজন অলক্ষুনে খৃষ্টান ব্যক্তি, যার ফ্যাসিজমের প্রতি আকর্ষন ছিল লক্ষ্য করার মত। এবং এটাও সত্যি যে এই পার্টির সদস্যপদ সব ধর্মাবলম্বীদের জন্য উন্মুক্ত ছিল (যদিও অবশ্য মনে করার যথেষ্ট সঙ্গত কারন আছে যে দলটিতে ইহুদীদের সদস্যপদ ছিল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ); তবে, অন্তত ১৯৭৯ সালে তার সর্বনাশ ডেকে আনা বিপর্যস্থ ইরান আগ্রাসন আগ পর্যন্ত, যখন ইরাধী ধর্মতন্ত্রের মোল্লাদের ক্ষুদ্ধ অভিযোগ তাকে চিহ্নিত করেছিল ‘অবিশ্বাসী‘ হিসাবে; সাদ্দাম হোসেন কিন্তু তার সমস্ত শাসনামল-যা স্পষ্টতই সংখ্যালঘু সুন্নী গোত্রের উপজাতীয় সংখ্যালঘুতার উপরে নির্ভরশীল –পরিচালিত করেছিল ধর্ম এবং জিহাদের লেবাসে। ( সিরিয়ার বাথ পার্টি, যা আলাওয়াইট সংখ্যালঘুদের বিশ্বাসী সদস্যদের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে তারাও ইরানী মোল্লাদের সাথে দীর্ঘ ভন্ডামীপুর্ণ একটি সম্পর্ক বজায় রেখেছে); সাদ্দাম ইরাকী পতাকায়- আল্লাহু আকবার – আল্লাহ সর্বশক্তিমান- কথাটা যোগ করেছিল। এছাড়া সাদ্দাম পৃষ্ঠপোষকতা করেছে অগনিত আন্তর্জাতিক জিহাদী, মোল্লাদের এবং ঐ অঞ্চলে একই কাজে অন্যান্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকের সাথে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন, বিশেষ করে সুদানের গনহত্যাকারী সরকারের সাথে। এছাড়া এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মসজিদটিই তার বানোনো, যার নাম দেয়া হয়েছে ‘সকল যুদ্ধের জননী‘ মসজিদ; যা পুর্ন করেছে একটা সম্পুর্ন রক্তে লেখা কোরান, সাদ্দাম যেটা দাবী করতো, তার নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে লেখা হয়েছে বলে। কুর্দিস্থানের (যারা প্রধানত সু্ন্নী) মানুষের উপর যখন তার নিজের গনহত্যা কার্যক্রম শুরু করেছিল -যার অংশ হিসাবে যে সময় যথেচ্ছভাবে ভয়াবহ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল, এছাড়া হত্যা এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে জোরপুরবক দেশান্তরী করার ঘটনা তো ছিলই- সাদ্দাম হোসেন সেই ক্যাম্পেইনের নাম দিয়েছিল, ’অপারেশন আনফাল’, কোরান থেকে এই শব্দটি ধার করা হয়েছিল-সুরা নং ৮ এর যুদ্ধ শেষে পাওয়া বিজিতদের জানমাল বা সম্পত্তি বা গনিমতে মাল-তথাকথিক অবিশ্বাসীদের সম্পত্তি এবং জান লুন্ঠন এবং ধ্বংস করার প্রক্রিয়াকে জায়েজ করার জন্য। যখন যৌথ বাহিনী ইরাকী সীমানা অতিক্রম করে ২০০৩ সালে, তারা সাদ্দামের সেনাবাহিনীকে চায়ের কাপে চিনির গলে হয়ে যাবার মতই উবে যেতে দেখেছিল। কিন্তু মোটামুটি কিছু দৃঢ় প্রতিরোধ তারা পেয়েছিল আধাসামরিক যোদ্ধাদের গ্রুপ থেকে, যারা খানিকটা শক্ত সমর্থ হয়েছিল ভীনদেশী জিহাদীদের যোগদানের মাধ্যমে, যাদের বলা হতো ফেদাঈন সাদ্দাম। এই গ্রুপটির অন্যতম প্রধান একটি কাজ ছিল স্থানীয় যারা পশ্চিমা বাহিনীর এই হস্তক্ষেপকে সমর্থন করেছিল তাদেরকে জনসমক্ষে হত্যা করা। এবং বেশ কিছু ঘৃন্য অপকর্ম যেমন জনসমক্ষে ফাসী বা ভয়াবহ রকম বিকলাঙ্গতার মাধ্যমে হত্যা করা দৃশ্য ভিডিওতে তারা ধারন করেছিল সবাইকে দেখানোর মাধ্যমে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে।

নিদেনপক্ষে সবাই স্বীকার করে নেবে, গত ৩৫ বছরের যুদ্ধ আর স্বৈরশাসনে নির্যাতন ইরাকী জনগন অনেক সহ্য করেছে, এবং আর্ন্তজাতিক আইনে অবৈধ হয়ে সাদ্দামের এই শাসনও এভাবে চিরকাল হয়ত চলতেও পারত না- সুতরাং সত্যিকারের শাসনামল বা রেজিম পরিবর্তনের পদ্ধতি সম্বন্ধে যত আপত্তি বা বিতর্কই থাকুক না কেন- অন্তত সমস্ত ইরাকী সমাজ শান্তিতে স্বাধীনতার ‍সাথে নিঃশ্বাস নেবার একটা সুযোগ পাওয়ার যোগ্যতা অবশ্যই রাখে, যে সময়টাতে তারা তাদের দেশ পুনর্নিমান এবং বহু বিরোধ মীমাংসার কথা বিবেচনা করতে পারতো । কিন্তু তাদের মুক্তভাবে শ্বাস নেবার জন্য এক মিনিটও সময় দেয়া হয়নি।

সবারই এর পরবর্তী ঘটনাক্রম জানা আছে। আল-কায়েদার সমর্থকরা,জর্ডানের এক প্রাক্তন কয়েদী আবু মুসাব আল জারকাওয়ী নেতৃত্বে হত্যা আর চোরাগুপ্তা হামলার উন্মত্ত ক্যামপেইন এর সুচনা করেছিল। তারা শুধুমাত্র বোরকা না পরা মহিলাদের বা ধর্মনিরেপক্ষ সাংবাদিক কিংবা শিক্ষকদের উপরই হিংস্রভাবে চড়াও হয়নি বা শুধুমাত্র খৃষ্টানদের (ইরাকের জনসংখ্যার ২ শতাংশ খৃষ্টান)চার্চে বোমা মেরেই ধ্বংশ করেনি কিংবা অ্যালকোহল নির্মাতা ও বিক্রেতা খৃষ্টানদের গুলি বা নির্যাতন করেই পঙ্গু করে দেয়নি, তারা তাদের এই গুলি করে গনহত্যা এবং একদল নেপালী শ্রমিকদের, যাদের তারা ধরেই নিয়েছে হিন্দু, সুতরাং বিবেচনার কোন প্রশ্নই আসেনা-গলাকাটার বীভৎস দৃশ্যই শুধু ভিডিও তে ধারন করেছে সবাই দেখানোর জন্য। এবং তাদের এইসব হত্যা অত্যাচার নীপিড়ন ছিল মোটামুটি নিত্য নৈমিত্তিক একটা ব্যপার । কিন্তু তারা তাদের সবচেয়ে বিষাক্ত সন্ত্রাসের ক্যামপেইনটি পরিচালনা করেছে তাদেরই মুসলিম ভাইবোনদের উপর। বহুদিন ধরে নীপিড়িত সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়াদের অনেক মসজিদ এবং অন্তেষ্টিক্রিয়ার সময় গণজমায়েতে এরা বোমা মেরে শিয়া মতাবলম্বীদের হত্যা করেছে নির্বিচারে। সাদ্দাম পতনের পর কারবালা আর নাজাফের দরগাহগুলো নতুন করে মুক্ত হবার শিয়া শরনার্থীরা নিজেদের জীবন ঝুকি নিয়ে বহুদুর পথ পাড়ি দিয়েছে তাদের জন্য এই পবিত্র তীর্থ স্থানগুলো দর্শন করেতে। তাদের নেতা ওসামা বিন লাদেন কে লেখা একটা চিঠিতে জারকাওয়ী তার এই ভয়াবহ রকম অশুভ সন্ত্রাসী নীতির দুটি প্রধান কারন উল্লেখ করেছিলো: সে লিখেছিল, প্রথমতঃ শিয়ারা হচ্ছে হেরেটিক (ধর্মীয় ভিন্নমতাবলম্বী), যারা সালাফীবাদীদের বিশুদ্ধ এবং সঠিক পথটা বেছে নেয়নি, সুতরাং সত্যিকারে পবিত্র জিহাদীদের (যেমন ‍তারা) জন্য শিয়ারা সঠিক হত্যার শিকার হবার জন্য যোগ্য। দ্বিতীয় কারনটা হলো, ইরাকী সমাজে যদি সত্যি একটি ধর্মযুদ্ধর সুচনা করা যায় তাহলে পশ্চিমা ক্রসেডারদের পরিকল্পনাটা বানচাল করা যেতে পারে। এই আল-কায়েদা সন্ত্রাসীদের সবচেয়ে স্পষ্টতম আশা ছিল শিয়াদের কাছে এই হামলাগুলোর দ্রুত প্রত্যুত্তরের, যা সুন্নী আরবদের তাদের বিন লাদেন পন্হী ’রক্ষাকারীদের’ সাথে এক শিবিরে নিয়ে আসবে। শিয়াদের সবচেয়ে বড় ইমাম আয়াতোল্লাহ সিসতানীর বেশ কয়েকবার সংযম প্রদর্শন করা মহতী আবেদন সত্ত্বেও, তাদের এধরনের পাল্টা উত্তর দেবার জন্য শিয়াদের উদ্বুদ্ধ করতে খুব বেশী একটা কষ্ট করতে হয়নি জারকাওয়ী বাহিনীর। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শিয়া ডেথ স্কোয়াডরা প্রায়শই পুলিশের ইউনিফর্মে সুসজ্জিত হয়ে সুন্নীদের উপর চড়াও হয়ে নির্বিচারে হত্যা এবং নির্যাতন করা শুরু করলো। এই ঘটনায় পার্শ্ববর্তী দেশ ইরানী ইসলামী প্রজাতন্ত্রের গোপন প্রভাব শনাক্ত করা খুব একটা কঠিন হলো না কারো পক্ষে এবং বেশ কিছু শিয়া এলাকায়, বোরকা ছাড়া নারী এবং ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষদের জন্য বাস করা বিপদজ্জনক হয়ে উঠলো। আন্ত: গোত্র বিবাহ এবং আন্তসাম্প্রদায়িক সহযোগিতার বেশ দীর্ঘ ইতিহাস নিয়ে ইরাক একসময় গর্ব করতো। কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে এই হিংস্র দ্বান্দিকতা খুবই দ্রুত সফল হলো ভয়াবহ দুর্দশা,পারস্পরিক অবিশ্বাস আর শত্রুতা এবং সম্প্রদায় ভিত্তিক রাজনীতির বৈরী পরিবেশ তৈরী করতে। আবারো, ধর্ম সব কিছুকে বিষাক্ত করে তোলে।

আমার উল্লেখ করা এই সব উদহারনে, সেই সব মানুষও কিন্তু ছিলেন, যারা ধর্মের নামে এই হানাহানির প্রতিবাদ করেছেন, যারা উগ্রবাদিতার আগ্রাসন আর হত্যাকারীদের কাল্টদের ক্রমশঃ বর্ধমান জোয়ারের মুখে দাড়িয়ে চেষ্টা করেছেন এর গতিরোধ করতে। আমি হাতে গোনা কিছু যাজক এবং বিশপ এবং রাবাই এবং ইমামদের কথা মনে করতে পারি যারা তাদের নিজেদের সম্প্রদায় কিংবা বিশ্বাসের উপর স্থান দিয়েছিল মানবতাকে। ইতিহাস অবশ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় এরকম আরো অন্য উদহারনেরও, আমি যা পরে আলোচনা করবো। কিন্তু সেটা মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, ধর্মের প্রতি না। এরকমই যে কোন পরিস্থিতি মুখে, এধরনের মানবতার সমস্যাগুলো আমাকে এবং আরো অনেক নীরিশ্বরবাদীদের উদ্বুদ্ধ করেছে, আয়ারল্যান্ডে ক্যাথলিকদের প্রতি বৈষম্যমুলক আচরনের প্রতিবাদ করতে,বা বসনিয়ার মসুলমানদের পক্ষে খৃষ্টান বলকানদের শোধনবাদী নীতির প্রতি প্রতিবাদ করতে,কিংবা আফগানী ও ইরাকী শিয়াদের পক্ষে কথা বলতে, যারা সুন্নী জিহাদীদের তলোয়ারের মুখে স্বশস্ত্র হয়েছে নিজেদের রক্ষা করতে এবং এর বীপরিতটাও, এবং এছাড়া আরো অগনিত এধরনের পরিস্থিতিতে আক্রান্ত মানবতার পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে অনেক নীরিশ্ববাদী ; এধরনের কোন অবস্থান বেছে নেয়াটাই যে কোন আত্মমর্যাদাশীল মানুষেরই কর্তব্য। কিন্তু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর এ সমস্ত ঘটনাগুলোয় সুস্পষ্ট নিন্দাবাদ জানানোর ক্ষেত্রে দৃশ্যমান সাধারন অনিচ্ছা, তা সেটা ক্রোয়েশিয়ার ক্ষেত্রে ভ্যাটিকান হোক, বা সৌদি বা ইরানী নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব ধর্মবিশ্বাসের গ্রুপের ক্ষেত্রেই হোক না কেন, সার্বিকভাবে ব্যপারটা অতিশয় বিরক্তিকর। এবং সামান্যতম কোন উস্কানীতে প্রতিটা ধর্ম বিশ্বাসী দলের, তাদের পুর্বপুরুষদের আচরনের পুনরাবৃত্তি করার অতি ইচ্ছাটাও কিন্তু কম জঘন্য নয়।

সুতরাং না জনাব প্রেগার কোন ধর্মীয় সভা শেষ হবার পর নিরাপদ আশ্রয় খোজার সতর্ক হবার নিয়মটার ব্যতিক্রম আমি এখনও খুজে পাইনি। এটাতো, আমি আগেই বলেছি শুধু ’বি‘ অক্ষর।এই সব ঘটনায় যে কোন মানুষ, যারা মানুষের নিরাপত্তা অথবা মর্যাদা সম্বন্ধে চিন্তিত, তাদের এখন তীব্রভাবে আশা করতে হবে গনতান্ত্রিক বা প্রজাতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের একটি গন প্রাদুর্ভাবের।

ধর্মের বিষাক্ত প্রভাব কিভাবে কাজ করে যাচ্ছে সেটা দেখতে আমার এই সব ভীনদেশী শহরে যাওয়ার কোন প্রয়োজন ছিলনা। ১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১ সালের সেই গুরুত্বপুর্ন দিনটির বহু আগেই আমি অনুভব করতে পেরেছিলাম, ধর্ম সুশীল সমাজের উপর তার চ্যালেন্জ্ঞ পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার অশুভ প্রচেষ্ঠার পুনঃ সুচনা করতে যাচ্ছে। আমি যখন অপেশাদার এবং সখের বৈদেশিক সংবাদাতা হিসাবে কাজ না করি, আমি মোটামুটি শান্ত এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ একটা জীবন কাটাই: বই কিংবা প্রবন্ধ রচনা করে, আমার ছাত্রদের ইংরেজী সাহিত্যকে ভালোবাসার জন্য অনুপ্রানিত করে, সাহিত্য বিষয়ক পছন্দের নানা সন্মেলনে যোগ দিয়ে, প্রকাশনা বা অ্যাকাডেমিতে নানা বিষয়ে সাময়িক তর্ক বিতর্কে অংশ নিয়ে।কিন্তু এমনকি এধরনের সুরক্ষিত অস্তিত্বেও হানা দিয়েছিল ধর্মের অভাবনীয় আগ্রাসন এবং অপমান এবং চ্যালেন্জ্ঞ। ফেব্রুয়ারী ১৪, ১৯৮৪, বন্ধু সালমান রুশদী আক্রান্ত হলেন যুগপৎ মৃত্যুদন্ড এবং যাবজ্জীবন কারাদন্ডে,তার অপরাধ,একটি কাল্পনিক উপন্যাস লেখা। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে, একটি বিদেশী রাষ্ট্রের ধর্মতন্ত্রের প্রধান-ইরানের আয়াতোল্লাহ খোমেনী-তার নিজের নামে জনসমক্ষে অর্থ পুরষ্কার ঘোষনা এবং ফতোয়া জারি করে একজন ঔপন্যাসিকের মৃত্যুদন্ড ঘোষনা করে, যে কিনা অন্য একটি দেশের নাগরিক। যারা এই ঘুষের বিনিময়ে হত্যাকান্ডে পরিকল্পনা-যে তালিকায় ছিল ”দি স্যাটানিক ভার্সেস এর প্রকাশনার সাথে জড়িত সবাই”- উৎসাহিত করা হয়েছে, তাদেরকে শুধু অর্থই না বেহেশতের বিনামুল্যে টিকেট এর নিশ্চয়তাও প্রদান করা হয়েছিল। মুক্ত স্বাধীন মত প্রকাশের প্রতিটি মুল্যবোধের বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় কোন ধরনের অপমান কল্পনা করা অসম্ভব। আয়াতোল্লাহ নিজে তো পড়েনি, সম্ভবত পড়তেও পারে না কিন্তু যাই হোক সবাইকে এই উপন্যাসটি পড়তে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হলো। আয়াতোল্লাহ ব্রিটেন সহ সারা পৃথিবীর মুসলিমদের কুৎসিৎ বিক্ষোভ উস্কে দিতে সফল হয়েছিল, যেখানে বিক্ষাভরত জনগন, বই পোড়ালো এবং উচু গলায় চিৎকার করে বইটির লেখককে সেই আগুনে পোড়ানোর অদম্য বাসনাও ব্যক্ত করা হলো অকুন্ঠভাবে।

এই ঘটনা পর্বটি – খানিকটা ভীতিকর খানিকটা কদর্য-কিন্তু অবশ্যই এর উৎপত্তি বস্তু বা ’বাস্তব‘ পৃথিবীতে। আয়াতোল্লাহ যে লক্ষ হাজার তরুন ইরানী জীবনকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল সাদ্দাম হোসেন এর শুরু করা যুদ্ধকে প্রলম্বিত করার জন্য এবং এভাবেই সেই যুদ্ধকে চেয়েছিল তার নিজের প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মতত্ত্বর বিজয়ে রুপান্তরিত করতে; কিন্তু রুশদীর ঘটনার সেই সাম্প্রতিক সময়ে আয়াতোল্লাহ বাধ্য হয়েছিল যুদ্ধের বাস্তবতাটাকে বোঝার জন্য এবং তাকে রাজী হতে হয় জাতিসংঘর যুদ্ধ বিরতি চুক্তি মেনে নিতে, অবশ্য এর আগে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, বিষ খাবেন কিন্তু তবুও চুক্তিতে কিছুতেই সই করবেন না। সুতরাং সেই মুহুর্তে এই ইমামের আরো একটা ’ইস্যু‘র প্রয়োজন ছিল। সেটার সুযোগও আসলো, যখন দক্ষিন আফ্রিকার বর্নবাদী সরকারের নিয়ন্ত্রিত সংসদে বসে এমন একদল প্রতিক্রিয়াশীল মসুলমান সাংসদ ঘোষনা দেয় যে, যদি জনাব রুশদী তাদের দেশের একটি বইমেলায় অংশগ্রহন করার জন্য এ দেশে আসেন, তবে তাকে হত্যা করা হবে। এর মধ্যে পাকিস্থানের একটি ইসলামী মৌলবাদী দল তাদের বিক্ষোভে এ বিষয়ে রক্তপাতও ঘটিয়ে ফেলেছে। সবাইকে যে ছাড়িয়ে যেতে হবে, এটাই খোমেনীকে প্রমান করার দরকার ছিল।

ঘটনাচক্রে যা আসলেই ঘটেছিল তা হলো, বেশ কিছু বক্তব্য, যা ইসলামের নবী মোহাম্মদ বলেছিলেন বলে দাবী করা হয়, অথচ মুল মুসলিম শিক্ষার সাথে যাদের সামন্জষ্য খুজে বের করা ছিল বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল। কোরান এর বিশেষজ্ঞরা এই সমস্যাটিকে যে কোনভাবে সমাধান করার প্রচেষ্ঠায় প্রস্তাব করেছিলেন যে, এই সমস্ত ক্ষেত্রে, নবী দুর্ঘটনাবশত আল্লাহর বদলে খোদ শয়তানের কাছ থেকে সেই ঐশী আদেশগুলো পেয়েছিলেন। বিশেষজ্ঞদের এই বুদ্ধিমান কুটচালটি- যা হয়তো মধ্যযুগীয় সবচে বক্রতম কোন খৃষ্টান আত্মপক্ষসমর্থনকারীর কোন ধরনের মানহানির কারন হত না- তবে বিষয়টি একজন কল্পনাপ্রবন ঔপন্যাসিকের জন্য চমৎকার সুযোগ করে দিয়েছিল, পবিত্র বিধান এবং সাহিত্যর সম্পর্কটির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কটির অনুসন্ধান কল্পে। কিন্তু কল্পনাহীন আক্ষরিক অর্থে সীমাবদ্ধ মানসিকতা ব্যর্থ হয়ে‍ছিল সাহিত্যের আয়রনীর মানসিকতাটাকে বুঝতে এবং বিষয়টি অনুভুত হয়েছে, একটি অশনি সংকেত হিসাবে। উপরন্তু রুশদী নিজেও প্রতিপালিত হয়েছেন মসুলমান হিসাবে, কোরান সম্বন্ধে তারও কিছু লেখাপড়া জ্ঞান আছে, যার অর্থ হচ্ছে ইসলামের ভাষায় তিনি হলেন ইসলাম ধর্মত্যাগী (বা মুরতাদ; এবং ইসলামে ধর্মত্যাগকারীদের কোরানের আইন অনুযায়ী শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদন্ড); ধর্মত্যাগ করার কোন অধিকার কারো নেই এবং যারা এই চেষ্টা করবে তাদের জন্য সব ধর্মীয় রাষ্ট্র নির্দিষ্ট করেছে কঠোরতম শাস্তি।

আয়াতোল্লাহর আহবানে ইরানী দুতাবাসের সহায়তায় ধর্মীয় ডেথ স্কোয়াডের সদস্যরা রুশদীকে হত্যা করার জন্য বেশ কয়েকবার আন্তরিক প্রচেষ্টাও চালায়। রুশদীর উপন্যাসের ইতালীয় ও জাপানীয় অনুবাদক দুজন দুষ্কৃতিকারীদের প্রত্যক্ষ আক্রমনের স্বীকার হন। আপাতঃদৃষ্টিতে একটি ক্ষেত্রে এক অনুবাদক অত্যাচারিত হন শুধু তিনি রুশদীর অবস্থান কোথায় সেটা হয়তোবা জানতে পারেন, আক্রমনকারীদের এই উদ্ভট বিশ্বাসের কারনে। একজনকে এতো ভয়াবহ ভাবে প্রহার এবং ক্ষতবিক্ষত করা হয় ,যে আক্রমনকারীরা তাকে মৃত ভেবে ফেলে পালিয়ে যায়। তার নরওয়েজীয় প্রকাশককে পেছন থেকে হাই ভেলোসিটি রাইফেল দিয়ে গুলি করে এক আততায়ী; হত্যাকারী ব্যক্তি তাকে মৃত ভেবে বরফের মধ্যে ফেলে রেখে যায়, বিস্ময়করভাবে তিনি প্রানে বেচে যান। আপনারা যে কেউ হয়তো ভাবতে পারেন, নিঃসঙ্গ এবং শান্তিপ্রিয় একটি মানুষকে, যে ভাষার প্রতি নিবেদিত একটি জীবন বেছে নিয়েছে, তাকে হত্যা করার জন্য এধরনের নির্লজ্জ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা হয়তো সর্বজনীন নিন্দা কুডিয়েছিল। না, ঘটনা কিন্তু তা ঘটেনি। সতর্ক শব্দচয়নে প্রকাশিত বিবৃতিতে ভ্যাটিক্যান, ক্যান্টারবারী আর্চবিশপ এবং ইসরায়েলের সেফারডিক রাবাই, প্রত্যেকেই আয়াতোল্লাহর সমব্যথী হবার পথ বেছে নিলেন। নিউ ইয়র্কের কার্ডিনাল আর্চ বিশপ এবং অসংখ্য ছোটখাট ধর্মীয় নেতারাও একই কাজ করলেন, যদিও তারা কোন মতে কয়েকটা শব্দ ব্যবহার করার ব্যবস্থা করতে পারলেন, যেখানে সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয়ার জন্য নিন্দা জ্ঞাপন করা হলো, কিন্তু এরা প্রত্যেকেই দাবী করলেন, সালমান রুশদীর দি স্যাটানিক ভার্সেস এর প্রকাশনার মাধ্যমে যে প্রধান সমস্যটা তৈরী হয়েছে, সেটা ভাড়াটে খুনীদের হত্যাকান্ড না বরং ব্লাসফেমী বা ধর্মীয় অবমাননা করা ! বেশ কিছু সুপরিচিত জনব্যাক্তিত্ব, যারা ধর্মীয় কোন সংস্থার সদস্য নন, যেমন মার্ক্সবাদী লেখক জন বার্জার,কনজারভেটিভ পার্টির ইতিহাসবিদ হিউ ট্রেভর-রপার এবং অসংখ্য স্পাই থ্রিলারের বর্ষীয়ান লেখক জন লো কারে প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ বলেছিলেন রুশদী নিজেই তার সমস্যার কারন। এই পরিস্থিতি তিনি নিজেই নিজের উপর ডেকে এনেছেন একটি মহান একেশ্ববাদী ধর্মকে ’অবমাননা’ করে। আর ব্রিটিশ পুলিশ একজন ভারতে জন্মগ্রহনকারী প্রাক্তন মসুলমান নাগরিককে ঈশ্বরের নামে জীবননাশ করার একটা সম্মিলিত ক্যামপেইন থেকে যে রক্ষা করছে, এই ব্যপারটা এদের কাছে আদৌ অসাধারন বলে মনে হলো না।‍

আমার জীবন সাধারনত যে ধরনের সুরক্ষিত. সেখানে আমি, ১৯৯৩ সালের থ্যাক্স গিভিং উইক এন্ডে, প্রথমবারের মত এই প্রায় পরাবাস্তব পরিস্থিতির স্বাদ পেয়েছিলাম; যখন রুশদী প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সাথে একটি পুর্বনির্ধারিত সাক্ষাৎকারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আসেন এবং আমার বাসায় একটি বা দুইটি রাত কাটান। সুবিশাল এবং ভীতিকর নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা প্রয়োজনীয়তা ছিল এই বিষয়টিকে পরিকল্পনা মাফিক শেষ করতে। যখন তার এই সংক্ষিপ্ত সফর শেষ হয়, আমাকে স্টেট ডিপার্টমেন্টে যাবার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল, সেখানে একজন উর্ধতন কর্মকর্তা আমাকে অবহিত করেন,গোয়েন্দারা বিশ্বাসযোগ্যভাবে ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়েছেন, যে আমি এবং আমার পরিবারের উপর, রুশদীর সাথে সংশ্লিষ্টতার কারনে প্রতিশোধ নেবার চিন্তা ভাবনা করছে উগ্র ইসলামবাদীরা; সেকারনে আমাকে আমার ঠিকানা এবং ফোন নম্বর বদলে ফেলার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়; অবশ্য আমার মনে হলো কোন ধরনের পাল্টা আক্রমন ঠেকানোর জন্য এগুলো কার্য্যকরী কোন পদ্ধতি না। কিন্তু বিষয়টা আমাকে অবশ্যই মনে করিয়ে দিল, যা আমি আগেই জানতাম। আমার পক্ষে ‌ এই উগ্র বাদীদের বলা সম্ভব হল না, বেশ, আপনারা আপনার লুকিয়ে থাকা এক ইমামের শিয়া স্বপ্নর পেছনে দৌড়াতে থাকুন এবং আমাকে আমার থমাস পাইন আর জর্জ ওরওয়েল এর লেখা নিয়ে গবেষনা করতে দিন এবং আমাদের দুই পক্ষের জন্য এই পৃথিবী এখনও অনেক বড়। কিন্তু প্রকৃত বিশ্বাসীরা তো আর বিশ্রাম নিতে পারেন না যতক্ষন না অবধি সারা পৃথিবী তাদের মতের কাছে নতজানু হবে। ধার্মিকরা তো বলে, এটা কি সুস্পষ্ট না সবার কাছে যে, ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন এবং যারা এটা স্বীকার করতে অস্বীকার করে, তারা তাদের বেচে থাকার অধিকারকেও পরিত্যাগ করে?

ঘটনাচক্রে শিয়াদের ’হত্যাকারীরা’ এই বিষয়টিকে আক্ষরিক অর্থে কয়েকবছর পর সারা বিশ্ববাসীর উপর জোরপুর্বক ঘটিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। আফগানিস্থানের তালিবান দুঃশাসন যে এত বেশী জঘন্য ছিল, যারা সংখ্যালঘু শিয়া হাজারা জনসংখ্যাকে হত্যা করছিল নির্বিচারে, যে ইরান নিজেই ১৯৯৯ সালে দেশটি আক্রমন করতে চেয়েছিল। তালিবানদের অন্য ধর্ম বিদ্বেষ এত তীব্র যে তারা বেশ সময় নিয়ে নানা প্রক্রিয়ায় বোমা মেরে ধ্বংশ করেছিল পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ট সাংস্কৃতিক নিদর্শন-বামিয়ানের জোড়া বুদ্ধমুর্তিগুলোকে, যারা তাদের অসাধারন সৌন্দর্যে আফিগানিস্থানের অতীতের গ্রীক এবং অন্যান্য বহু সংস্কৃতির মিশ্রনের প্রতীক ছিল। কিন্তু যেহেতু ‍ মুর্তি , এবং নিঃসন্দেহে প্রাক-ইসলামিক সভ্যতার, সে কারনেই বুদ্ধমুর্তিগুলো তালিবান এবং তাদের আল-কায়েদা অতিথিদের জন্য মুর্তমান ছিল সরাসরি অপমানের চিহ্ন হিসাবে। এবং বামিয়ানকে জোড়া বুদ্ধ মুর্তি বোমা মেরে অগনিত পাথরের টুকরো আর ধ্বংশস্তুপে রুপান্তর করাটা পুর্বাভাষ দিয়েছিল ২০০১ সালের শরতে ম্যানহাটনে আরো এক জোড়া বিল্ডিং ও সেই সাথে প্রায় তিন হাজার মানুষের পুড়ে ছাই হবার ঘটনাটির।

প্রত্যেকেরই হয়ত নিজস্ব ৯/১১ এর একটা কাহিনী আছে; আমি আমারটা বলা বাদ দিচ্ছি শুধুমাত্র একটা কথা ছাড়া, আমার অল্প পরিচিত একজন,যাকে বহনকারী প্লেনটি পেন্টাগনের দেয়ালে ধ্বংশ হয়েছিল,সে কোনমতে তার স্বামীকে ফোন করতে পেরেছিল, তার হত্যাকারীদের চেহারা ও তাদের কৌশলএর খানিকটা বিবরন দিয়ে (এটা যে কোন হাইজ্যাক না এবং সে যে মারা যাচ্ছে এটা তাদের কাছ থেকে জানার পর); ওয়াশিংটনে আমার বাসার ছাদ থেকে আমি নদীর ওপারে ধোয়ার কুন্ডলী উঠতে দেখেছিলাম এবং এর পর থেকেই যখনই আমি ক্যাপিটল বা হোয়াইট হাউজের সামনে দিয়ে গেছি,তখনই চিন্তা করেছি, কি ঘটতো, যদি না ভীষন সাহস এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে যাত্রীরা, চতুর্থ প্লেনটিকে এর নিশানা থেকে বিশ মিনিটের ওড়ার দুরত্বে পেনসিলভেনিয়ার মাঠে ক্র্যাশ করাতে ব্যর্থ হতেন।

বেশ, ডেনিস প্রেগার এর প্রতি বাড়তি উত্তর হিসাবে আমি এই লেখাটা লিখতে পারলাম, এখন আপনি আপনার উত্তর পেয়ে গেলেন। নিউইয়র্ক, পেনসিলভেনিয়া এবং ওয়াশিংটনের এই ১৯ জন আত্মঘাতী খুনী সেদিন ঐ প্লেনে সবচেয়ে আন্তরিক ধর্মবিশ্বাসী ছিল এ বিষযে কোন সন্দেহ নেই। হয়তো এখন আমরা খানিকটা কম শুনতে পারি ,যে কিভাবে ’ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ’ নৈতিক যোগ্যতা এবং সুবিধা ধারন করে, যা অন্যরা কেবল হিংসাই করতে পারে। এবং পরবর্তীতে ইসলামী বিশ্বে এই ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে সম্পাদিত মহান কর্মটিকে যে উৎসব এবং তীব্র আনন্দের প্রচারনার সাথে স্বাগতম জানানো হয়েছিল, সেখান থেকে আমাদের কি শিক্ষা নেবার দরকার ছিল? ৯/১১ এর সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রে জন অ্যাশক্রফট নামের একজন অ্যাটর্নী জেনারেল ছিলেন,যার মন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রে জিসাস বা যীশু ছাড়া আর কোন রাজা নেই (যে দাবী আসলে ঠিক দুটি শব্দ বেশী বড়);দেশটির একটি প্রেসিডেন্ট ছিল,যিনি দেশের গরীবদের দেখা শোনা করার দ্বায়িত্ব দিতে চান ’ধর্মীয়বিশ্বাসভিত্তিক’ প্রতিষ্ঠানগুলোকে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটা কি সেই বিশেষ মুহুর্ত ছিলনা, যখন যুক্তির আলো এবং একটি সমাজের সুরক্ষাকে – যে সমাজ রাষ্ট্র থেকে চার্চকে পৃথক করেছিল এবং স্বাধীন মতপ্রকাশ এবং মুক্ত জ্ঞান অন্বেষণের দিয়েছিল বিশেষ মর্যাদা -খানিকটা সুযোগ কি করে দেয়া যেত না।

হতাশা তখনও ছিল এবং আমার মতে এখনও অনেক প্রকট । ঘটনার কয়েকঘন্টার মধ্যেই রেভারেন্ডদ্বয় প্যাট রবার্টসন এবং জেরী ফালওয়েল ঘোষনা দিলেন, তাদের স্বদেশী মানবমানবীদের এই বলিদান হচ্ছে, ধর্ম নিরপেক্ষ এই সমাজ-যা সমকামীতা এবং গর্ভপাতকে পশ্রয় দিয়েছে –তার প্রতি ঈশ্বরের বিচার। ওয়াশিংটনে সৌন্দর্যময় ন্যাশনাল ক্যাথিড্রালে এই সন্ত্রাসের শিকারে নিহতদের জন্য আয়োজিত ভাবগম্ভীর স্মরণসভায়, বিলি গ্রাহামকে ভাষন দেবার অনুমতি দেয়া হয়েছিল, যে ব্যক্তিটির সুবিধাবাধীতা এবং ইহুদীবিদ্বেষী মনোভাবের রেকর্ড ছোটখাট একটা জাতীয় লজ্জার বিষয়। চার্চে এই লোকটি তার অসার সার্মনে তিনি দাবী করেন, মৃতরা এখন সবাই স্বর্গে এবং তারা পারলেও আর আমাদের মধ্যে ফিরবেনা। আমি এটাকে অসার বলছি কারন, সেই দিন আল কায়েদা যাদের হত্যা করেছিল তাদের মধ্যে বেশ বড় সংখ্যকই তথাকথিত পাপিষ্টরাও ছিলেন। এবং এটা চিন্তা করা কোনই কারন নেই যে বিলি গ্রাহাম তাদের আত্নার বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে জ্ঞাত আছেন, তাদের মৃত্যু পরবর্তী ইচ্ছার কথা জানাতো আরো দুরবর্তী ঘটনা। স্বর্গ সম্বন্ধে খুটিনাটি বিষয় জানার দাবীর মধ্যেও কিছু অশুভ অলক্ষুনে ব্যাপার আছে, বিশেষ করে যে ধরনের জ্ঞান, বিন লাদেন নিজে দাবী করে থাকে তার খুনীদের পক্ষে।

সবকিছুরই অবনতি ঘটতে থাকে তালিবানদের অপসারন থেকে সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করার মধ্যবর্তী সময়কালে। এখন উর্ধতন সামরিক অফিসার, জেনারেল উইলিয়াম বয়কিন ঘোষনা দেন, এর আগে সোমালিয়ার নাটকীয়তার মধ্যে কর্মরত থাকার সময় তিনি হলফ করে দাবী করতে পারেন তিনি একটি অতিপ্রাকৃত দৃশ্য বা ভিশন এর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তার দাবী ‍অনুযায়ী আপাতদৃষ্টিতে তিনি শয়তানের অবয়ব লক্ষ্য করেছেন মোগাদিসুর কিছু আকাশ থেকে তোলা আলোকচিত্রে, কিন্তু তা শুধুমাত্র জেনেরালের আত্মবিশ্বাসকে মজবুত করেছে, এই বিশ্বাসে যে তার ঈশ্বর তার এই প্রতিপক্ষ অশুভ অ্‌পদেবতা অপেক্ষা অনেক বেশী শক্তিশালী। কলোরাডোর ইউ এস এয়ারফোর্স একাডেমীতে দেখা গেল যে, ইহুদী এবং অ্যাগনস্টিক বা অজ্ঞেয়বাদী ক্যাডেটরা খুবই বাজে ভাবে নিগৃহীত এবং নিপীড়িত হচ্ছে একদল ’নতুন করে জন্ম নেয়া’ খৃষ্টান ক্যাডারদের হাতে, যাদের কোন শাস্তি হয়নি এবং যারা দাবী করেছিল, শুধুমাত্র জেসাসকে যারা তাদের ব্যাক্তিগত ত্রানকর্তা মনে করেন, তারাই শুধু এই বাহিনীতে কাজ করার যোগ্যতা রাখে। অ্যাকাডেমীর ডেপুটি কমান্ডার এ সংক্রান্ত বেশ কিছু ইমেইল প্রেরন করলেন, একটি জাতীয় প্রার্থনা ( খৃষ্টীয়) দিবস সৃষ্টির জন্য আবেদন জানিয়ে। মেলিন্দা মর্টন নামের একজন চ্যাপলেইন, যিনি এই বাহিনীর হঠাৎ উন্মত্ততা এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের উপর শক্তি প্রদর্শনের প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন তাকে দ্রুত বহুদুরে জাপানের একটি ঘাটিতে বদলী করে দেয়া হলো। অন্যদিকে ইতিমধ্যে নির্বোধ বহুসংস্কৃতিবাদ এই চলমান নাটকে তাদেরও অবদান রাখতে সফল হলো, তাদের নানা কর্মকান্ডের মধ্যে একটি ছিল, শস্তা এবং সৌদিদের গনহারে প্রকাশিত কোরানে সংস্করন আমেরিকার জেলখানাগুলোয় ব্যবহারের জন্য ব্যাপক হারে বিনামুল্যে বিতরনের ব্যবস্থা করা। এই ওয়াহাবী বিবরনের টেক্সটি আবার মুল সংস্করনের চেয়ে বাড়তি খানিকটা জোরালো সুপারিশ সম্বলিত ছিল, যেখানে উদাত্ত আহবান জানানো হয়েছে , খৃষ্টান, ইহুদী এবং ধর্ম নিরপেক্ষদের বিরুদ্ধে জিহাদী অবস্থান নেবার জন্য। এই সব কাহিনী পর্যবেক্ষন করা অনেকটা সাংস্কৃতিক আত্মহত্যা পর্যবেক্ষন করার মতই: আরো সঠিকভাবে বলতে হলে, একটি সহায়তাপ্রাপ্ত আত্মহনন, যেখানে বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসী,উভয়ই প্রস্তুত ছিল এতে সক্রিয় অংশ নেবার জন্য।

এটা এখানে এখনই উল্লেখ করা প্রয়োজন এই ধরনের কর্মকান্ড, যেমন অনৈতিক এবং অপেশাদারীত্বের পরিচয় বহন করে এবং অবশ্যই সুস্পষ্টভাবে সংবিধান বিরোধী, অ-যুক্তরাষ্ট্রীয়। জেমস ম্যাডিসন, সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর রচয়িতা, যা যে কোন ধর্মের প্রতিষ্ঠানকে শ্রদ্ধা প্রদর্শনকারী যে কোন আইন নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছিলেন, এছাড়া আর্টিকেল ৬ এর লেখকও ছিলেন তিনি, যা কোন অস্পষ্টতা ছাড়াই উল্লেখ করেছে, কোন অফিস বা পাবলিক ট্রাষ্ট এর কোন পদের জন্য কোন ধরনের ধর্মীয় পরীক্ষা কখনই আর প্রয়োজন হবেনা। তার পরবর্তী রচনা ডিটাচ মেমোরান্ডা ব্যপারটা স্পষ্ট করেছে, সরকারীভাবে কোন চ্যাপলেইনে নিয়োগ করা প্রথমত সংবিধান বিরোধী, সেটা সামরিক বাহিনী হোক কিংবা কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানই হোক না কেন। কংগ্রেসে চ্যাপলেইনশীপ পদ তৈরী করা সমঅধিকার আইনের এবং এছাড়াও সংবিধানের মুলনীতির সুস্পষ্টভাবে অবমাননা করার সমতুল্য। সামরিক বাহিনীতে যাজকের উপস্থিতি নিয়ে ম্যাডিসন লিখেছিলেন, এই ধরনের পদসৃষ্টি কারন লোভনীয়, উদ্দেশ্য হয়তোবা প্রশংসার, কিন্তু আপাতদৃষ্টি তা যতই ঠিক মনে হোক ‍না কেন, কোন ভ্রান্ত কোন নীতিকে বিশ্বাস করার চেয়ে, সত্যিকার ন্যায়নির্ভর নীতি মেনে চলার এবং এর পরিনতির উপর ভরসা রাখাটাই কি কম বিপদজ্জনক নয়? সারা পৃথিবীর সামরিক এবং নৌবাহিনীর দিকে তাকান, এবং বলুন তাদের ধর্মের যাজকদের নিয়োগ কি, দলবদ্ধ সবার আত্মিক স্বার্থরক্ষা বা কোন একজনের সাময়িক স্বার্থ রক্ষা করছে, কোনটা বেশী নজরে পড়ে? যদিও আজকাল আর কেউ ম্যাডিসনকে উদ্ধৃত করে, সম্ভাবনা থাকে সবাই তাকে হয় উন্মাদ নয়তো দেশদ্রোহী মনে করবে। কিন্তু তারপরও ‍তিনি এবং টমাস জেফারসন, ভার্জিনিয়া স্ট্যাট্যুট অন রেলিজিয়াস ফ্রিডম এর এই দুই লেখককে ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে যা হচ্ছিল তাই হয়তো এখনো হয়ে আসতো: যেমন, ইহুদীরা কোন কোন রাজ্যে কোন সরকারী প্রতিষ্ঠানে কোন পদে আসীন হতে পারতো না, কোথাও এই অবস্থা হতো ক্যাথলিকদের এবং মেরীল্যান্ডে যেমন এই নিষেধাজ্ঞা ছিল প্রোটেষ্টান্টদের উপর।মেরীল্যান্ডে হলি ট্রিনিটি সম্পর্কে কোন ধরনের অবমাননাকর কথা বললে শাস্তি ছিল প্রথমে নিপীড়ন, এরপরে শরীরে পুড়িয়ে চিহ্নিত করে দেয়া, এবং তৃতীয়বার একই অপরাধ করলে কোন যাজকের উপস্থিতি ছাড়া সরাসরি মৃত্যুদন্ড । জর্জিয়া হয়তো তাদের রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ধর্ম প্রোটেষ্টান্টিজমই অব্যাহত রাখত – লুথারের অনেক হাইব্রিড ধর্মের মধ্যে সেটা বলতে তারা যা বোঝায়।

ইরাকে স্বশস্ত্র হস্তক্ষেপ নিয়ে বিতর্ক যখন উত্তপ্ত হয়েছে, চার্চের পালপিট থেকে মুষলধারায় নির্বোধের মত এর পক্ষে বিপক্ষে মন্তব্য প্রবাহিত হয়েছে। বেশীর ভাগ চার্চই সাদ্দাম হোসেন এর অপসারন চায়নি। পোপও নিজেকে চুড়ান্ত নির্লজ্জে পরিনত করেছিলেন, একজন চিহ্নিত দাগী যুদ্ধাপরাধী তারেক আজিজকে -যে রাষ্ট্রীয়ভাবে শিশুহত্যার সাথে জড়িত ছিল-ভ্যাটিকানে তাকে ব্যাক্তিগত নিমন্ত্রন জানানোর মাধ্যমে; ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট পার্টির একজন উর্ধ্বতন ক্যাথলিক সদস্য আজিজ ভ্যাটিক্যানে শুধুমাত্র সাদর সম্ভাষনই পেলেন না (এধরনের বিশেষ কোন আতিথেয়তার অনুমোদন এটাই অবশ্য প্রথম না), তাকে এরপর আসসিজিতে নিয়ে যাওয়া হয়, সেইন্ট ফ্রান্সিস এর পবিত্র প্রার্থনা কক্ষে ব্যক্তিগত প্রার্থনার বিশেষ ব্যবস্থাও করা হয়। সেইন্ট ফ্রান্সিস আপাতদৃষ্টিতে পাখিদের সাথে কথা বলতে পারতেন বলে এমন ধারনা প্রচলিত আছে। তারেক আজিজ নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন, এসব খুবই বেশী সহজ হয়ে গেল। বিশ্বাসের অন্যপ্রান্তে, কিছু, যদিও সবাই না,যুক্তরাষ্ট্রের ইভানজেলিকাল চার্চ অত্যন্ত আনন্দের সাথে শোরগোল তুলেছে, এবার বোধহয় ঈশ্বরপুত্র যীশুর জন্য মুসলিমদের রাজ্য জয় করার একটা সুযোগ তৈরী হতে যাচ্ছে। ( আমি সবাই না বলে, কিছু বলেছি, কারন একটা মৌলাবাদী উগ্রপন্থী খৃষ্টান বিচ্ছিন্ন গ্রুপ ইরাক যুদ্ধে নিহত যুক্তরাষ্ট্রের সৈনিকদের অন্তেষ্টিক্রিয়ার সময় পিকেটিং করতে ব্যস্ত ছিল, তাদের দাবী এই সব মৃত্যু যুক্তরাষ্ট্রের সমকামীতার জন্য ঈশ্বরের অভিশাপ। শোকাহত স্বজনদের সামনে তাদের মানসিকতার রুচির পরিচয় বহনকারী তাদের একটি প্ল্যাকার্ড এ লেখা ছিল, ’ঈশ্বরকে ধন্যবাদ আইইডি (IED)’র জন্য, এই নির্বোধগুলোর কি জানা আছে, রাস্তার পাশে ফেলে রাখা এসব বোমা (বা IED: Improvised Explosive Device) যারা পেতেছে, তারা তাদের মতই উগ্র এবং সমপরিমান সমকামীবিদ্বেষী ফ্যাসীবাদী মসুলমানরা। এটা আমার কোন সমস্যা না প্রমান করা যে কোন ধর্মতত্ত্বটা এখানে সঠিক: আমি বরং বলবো দুটোরই ঠিক হবার সম্ভাবনা প্রায় সমপরিমান।) চার্লস স্ট্যানলী, আটলান্টার ফার্ষ্ট ব্যাপটিষ্ট চার্চ থেকে যার সম্প্রচারিত হওয়া সাপ্তাহিক সার্মন লক্ষ লক্ষ দর্শক দেখে থাকেন, এই যাজক বক্তৃতাসর্বস্ব যে কোন ইমামই হয়ত হতে পারতেন, বলেছিলেন, ’আমাদের যে কোন উপায়ে এই যুদ্ধের সহযোগিতা করা উচিৎ। ঈশ্বর এখন যুদ্ধ করছেন সেই সব মানুষের সাথে, যারা তার বিরোধিতা করেছে, তার এবং তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে’। তার সংস্থার ব্যাপ্টিষ্ট প্রেস নিউজ সার্ভিস একজন মিশনারীর লেখা প্রবন্ধ ছেপেছিল, বিশেষ উল্লাস প্রকাশ করা এই লেখাটি বোঝাতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ নীতি এবং এর সামরিক শক্তিমত্তা অবশেষে হয়ত আব্রাহাম, জ্যাকব, আইজাক এর দেশে গসপেলের বিস্তারে নতুন সুযোগ করে দিতে পারে। হার মানতে রাজী নন টিম লাহায়ে সিদ্ধান্ত নেন আরো বাড়াবাড়ি করার, ইনি বিশেষভাবে সুপরিচিত বানিজ্যসফল ‘লেফট বিহাইন্ড’ ’নামের শস্তা ধারাবাহিক উপন্যাসের যৌথ লেখক হিসাবে,সেখানে তিনি গড়পড়তা আমেরিকানদের প্রথমে রাপচারের (রাপচার হচ্ছে খৃষ্ট ধর্মর একটি বিশ্বাস, যে ভবিষ্যতে কোন দিনে যীশু খৃষ্ট মেঘের মধ্যে স্বর্গ থেকে নেমে আসবেন। এবং তিনি মৃত তার উপর বিশ্বাসী খৃষ্টানদের তিনি পুনরোজ্জীবিত করে, তাদের শরীরকে সৌন্দর্য মন্ডিত করে, মেঘের মধ্যে তার কাছে নিয়ে যাবেন স্বর্গে আহোরন করার জন্য) জন্য প্রস্তুত করেন এবং তারপর আর্মাগেডনের ( পৃথিবীর শেষ যুদ্ধ) জন্য। তার বক্তব্যে, ,ইরাক হচ্ছে বেশ কিছু পৃথিবী সমাপ্ত কারী ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু’; একজন বাইবেল উৎসাহী, প্রাচীন ব্যবিলনের দুরাগ্রহী রাজা নেবুশাদনেজ্জার এর সাথে সাদ্দাম হুসেইন এর তুলনা করেছেন, যে তুলনা স্বয়ং এই স্বৈরশাসকই সম্ভবত পছন্দ করতেন। বিশেষ করে সাদ্দামের প্রতিটি ইটে তার নামাঙ্কিত করে প্রাচীন ব্যাবিলনের দেয়াল পুননির্মানের প্রচেষ্টা সেই আভাসই দিচ্ছে। এভাবেই ধর্মী উগ্রতাবাদকে কিভাবে দমন এবং পরাজিত করা যায়, সেই বিষয়ে কোন ধরনের যৌক্তিক আলোচনার পরিবর্তে সেই ম্যানিয়াটার দুটি রুপই তাদের পারস্পরিক অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছে: জিহাদীদের আক্রমন পুনদৃশ্যমান করেছে ক্রসেডারদের রক্তরন্জ্ঞিত অপচ্ছায়া।

এই ক্ষেত্রে ধর্ম বর্ণবাদ থেকে অভিন্ন নয়। এর একটি রুপ অনুপ্রানিত করে এবং প্ররোচিত করে অন্য আরেকটি রুপ। ডেনিস প্রেগারের চেয়েও আরো খানিকটা কৌশলগত একটি প্রশ্ন আমাকে একবার করা হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল আমার ভিতর সু্প্ত থাকা সংস্কার বা প্রেজুডিস মাত্রা কতটুকু তার পরিমাপ করা।ধরা যাক একদিন গভীর রাতে,নিউ ইয়র্কের প্রায় খালি একটা সাবওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে আপনি দাড়িয়ে আছেন, হঠাৎ করে প্রায় এক ডজন কালো তরুন সেখানে উপস্থিত হলো। আপনি কি যেখানে দাড়িয়ে ছিলেন সেখানে থাকবেন নাকি, সবচে কাছের বের হবার পথের দিকে আগাবেন। আমি আবারো বলতে পেরেছিলাম, ঠিক সেই রকম একটি অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। মধ্যরাতের বেশ কিছু পর, একা একা আমি ট্রেইনের অপেক্ষা করছিলাম, হঠাৎ করে সেখানে আমার সঙ্গী হলো টানেল থেকে বেরিয়ে আসা মেরামতে জন্য কাজ করা একদল শ্রমিক তাদের কাজের গ্লোভ পরা হাত এবং নানা যন্ত্রপাতি নিয়ে। তাদের সবাই ছিল কালো। সাথেই সাথেই আমি নিজেকে নিরাপদ অনুভব করলাম এবং তাদের কাছাকাছি এগিয়ে গেলাম। আমার কোন ধারনাই ছিল না তাদের ধর্ম বিশ্বাস সম্বন্ধে। কিন্তু আমার বর্ননা করা প্রতিটি উদহারনে, ধর্ম ছিল গোত্রভিত্তিক সন্দেহ আর ঘৃণাকে বহুগুনে বাড়ানো জন্য দায়ী , যেখানে প্রতিটি গোত্র বা গ্রুপের সদস্যরা একে অপরের সম্বন্ধে কথা বলে ঠিক অন্ধ গোড়ামীর ভাষায়: খৃষ্ঠান আর ইহুদীরা নোংরা শুয়োরের মাংস খায় এবং বিষাক্ত মদ পান করে গোগ্রাসে। বৌদ্ধ আর মসুলমান শ্রীলংকাবাসীরা,২০০৪ সালের মদ নির্ভর খৃষ্ঠীয় ক্রিসমাস বা বড়দিনের উৎসব উদযাপনকে মনে করে এর কদিন পরে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সুনামীর কারন হিসাবে; ক্যাথলিকরা নোংরা, অনেকগুলো করে ছেলেমেয়ের জন্ম দেয়। মসুলমানরা খরগোশের মত বংশবৃদ্ধি করে, ভুল হাত দিয়ে শৌচকার্য্য সম্পন্ন করে। ইহুদীদের দাড়িতে উকুন আছে, তাদের পাসওভার মাতজোর (এক ধরনের রুটি) বাড়তি ফ্লেভার ও স্বাদ এর জন্য তারা খৃষ্টান শিশুদের রক্ত খুজে বেড়ায়। এবং এভাবে এই তালিকা চলতে থাকবে।


You have to choose your future regrets’-Christopher Hitchens