দিনক্ষণ নিয়ে এর আগে কথা হয়েছে অনেকবার। কিন্তু, প্রতিবারই সবার আশার মুখে ছাই দিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছিলো সেই মহালগ্ন। আজই, কাকতালীয়ভাবে নিশ্চয় নয়, ঠিক পাঁচ বছর আগের বিখ্যাত-কুখ্যাত-স্বনামধন্য তারিখ ওয়ান-ইলেভেনেই, গ্রেফতার করা হলো জামাতের প্রাক্তন আমির, মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর সুচিহ্নিত দালাল, তথা মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশ্য বিরোধিতাকারী গোলাম আজমকে। একজন মাত্র মানুষের কারাভ্যন্তরে প্রেরণের পেছনের কাহিনি যে দীর্ঘ অনেক বত্সরের অনেকের মেদ-মেধা, এমনকি প্রাণেরও বিনিময়ে অর্জিত, এই মহাসত্য যেন আজকের দিনে আমরা ভুলে না যাই। লক্ষ প্রাণের অতুলনীয় আত্মত্যাগের বিচারের ধারা মাঝপথেই গেছে থেমে অনেক কষ্ট অনেক বেদনা অনেক হতাশা জাগিয়ে। আমরা যেন নীরবে দৃঢচিত্তে প্রাণপণ করে আজ সেই রক্তাক্ত গণহত্যার সহযোগীদের এবং অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি বাংলার সেরা সন্তানদের খুনে-রাঙানো হাতের অধিকারীদের বিচারের দাবিতে একচিত্ত একমন্ত্র একপ্রাণ হই।

কে ভেবেছিলো এই নরঘাতকদের শেষপর্যন্ত সত্যিই পোরা যাবে কারাগারে, সত্যিই তাদের বিচারের জন্যে তৈরি করা যাবে বিশেষ আদালত, শীর্ষস্থানীয় শিরোমণিদের সাথে সাথে তাদের অযুতনিযুত সমর্থকদের মুখ চুন করে তাদের বিরুদ্ধে শুরু করা সম্ভব হবে বিচারিক প্রক্রিয়া? অভিনন্দন এবং শ্রদ্ধা জানাতে চাই সেই মহান সৈনিকদের যাঁরা প্রথম থেকেই সোচ্চার ছিলেন এই অমানবিক অপরাধীদের অসীম হিংস্র অপরাধের বিরুদ্ধে, যাঁরা তাদের বিচারের দাবি তুলেছেন বারবার শত বাধা এমনকি মৃত্যুর হুমকি বা শারীরিক আক্রমণের বাধা ঠেলে, এবং অন্যদেরও বিশ্বাস করিয়েছেন যে সম্ভব, এই হিমালয়ের চূড়া-ছোঁয়া সম্ভব। সম্মাননা প্রাপ্য তাঁদেরও, যাঁরা অন্তর্জালে নিজের মতো করে প্রাণ খুলে বাংলা লেখার প্রথম সুযোগে বিষাক্ত সাম্প্রদায়িকতা এবং জামাতশিবিরের নোংরা রাজনীতি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যময় ইতিহাসবিকৃতির প্রতিবাদ করেছেন দালিলিক ও বিস্তৃত তথ্যপ্রমাণযুক্তিসহযোগে। আজ বাংলাভাষার বৃহত্তম মিলনমেলায় বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী প্রচারণা অন্তত কাগজেকলমে নিষিদ্ধ। বাংলায় সেরা লেখালেখি যেসব ক্ষেত্রে হয়, সেখানে এই স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের প্রবেশ আইনতই নিষিদ্ধ, এমনকি ফেসবুকের মতো উন্মুক্ত ক্ষেত্রেও বিষাক্ত সাপের মতো এই পিচ্ছিল, ধর্মমুখোশধারী, ঠান্ডা মাথার খুনিদের প্রচারণা এমনি অনেক সৈনিকের শক্ত ধাক্কায় ধূলিসাৎ হয়ে পড়েছে। সবার হৃদয়ে একাত্তরের এই চেতনা থাকুক অমলিন এই নৃশংস খুনিদের রায় কার্যকর অবধি এবং তারও পরে অনন্তকাল ধরে।

আজ সকাল থেকে গ্রেপ্তারের কিছু সচিত্র বিবরণ পড়া যাক।

কারাগারের ছায়া?

যুদ্ধাপরাধের ঘটনায় জামিন আবেদন খারিজ করে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর গোলাম আযমকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

বুধবার সকালে শুনানির পর নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এই আদেশ দেয়। সাবেক এই জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরুর জন্য ১৫ ফেব্রুয়ারি দিন রেখেছে আদালত।

আদেশের পর দুপুর ১২টার দিকে একটি প্রিজন ভ্যানে করে গোলাম আযমকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।

এর আগে বুধবার সকাল ১০টার পর কয়েকজন আইনজীবীকে সঙ্গে নিয়ে আদালতে হাজির হন গোলাম আযম। তাকে ভেতরে নেওয়া হয় হুইল চেয়ারে বসিয়ে।

সাড়ে ১০টায় ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরুর পরপরই তার জামিন আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হয়। বার্ধক্য ও স্বাস্থ্যগত জটিলতার কথা উল্লেখ করে মঙ্গলবার এই আবেদন জমা দেন গোলাম আযম।

তার আইনজীবী আব্দুর রাজ্জাক শুনানির শুরুতেই বলেন, অধ্যাপক গোলাম আযমের বয়স প্রায় ৯০। তার স্বাস্থ্যের অবস্থাও বিশেষ ভালো নয়। এর আগে একই অভিযোগের মামলায় ট্রাইব্যুনাল বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলীমকেও জামিন দিয়েছে। সুতরাং গোলাম আযমও তা পেতে পারেন।

শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল আবেদন খারিজ করে গোলাম আযমকে কারাগারে পাঠাতে বলেন। আব্দুর রাজ্জাক কারাগারে তার মক্কেলের জন্য ডিভিশন চাইলে তাও খারিজ হয়ে যায়। এ ব্যাপারে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন করার পরামর্শ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

ট্রাইব্যুনালের আদেশে বলা হয়, ১৫ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য প্রসিকিউশনকে বৃহস্পতিবারের মধ্যে সব নথিপত্র ও সাক্ষীদের নামের তালিকা জমা দিতে হবে। আর আসামিপক্ষ আগামী রোববারের মধ্যে এসব নথি সংগ্রহ করবে।

এদিকে গোলাম আযমের বিচারের দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন সকাল থেকেই প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন নিয়ে সমবেত হয় ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণের বাইরে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি হাইকোর্টের সামনে থেকে ট্রাইব্যুনালের ফটক পর্যন্ত রাস্তায় সকাল ১০টা থেকে মানববন্ধন করে।

এছাড়া সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদও আলাদাভাবে মানববন্ধন করে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি জানায়। গোলাম আজমকে গ্রেপ্তারের দাবিতে খণ্ড খণ্ড মিছিল চলতে থাকে ট্রাইব্যুনালের বাইরে। ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সকালেই অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। হাইকোর্টের ১ নম্বর ফটক ও মাজার গেটে দিয়ে বন্ধ রাখা হয় সাধারণের চলাচল।

আদালতের আদেশের প্রতিক্রিয়ায় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, “তার জামিন না মঞ্জুর হওয়ায় আমরা সন্তুষ্ট। তবে গ্রেপ্তারই যথেষ্ট নয়। বিচার যতো দ্রুত সম্ভব শেষ করতে হবে।”

গত ১২ ডিসেম্বর প্রথম দফায় ৫২ দফা অভিযোগ উত্থাপন করে গোলাম আযমকে গ্রেপ্তারের আবেদন জানায় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে তা পুনর্বিন্যস্ত করে ৫ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়।

বারে বারে ঘুঘু তুমি

মনে পড়ে বিষ্ণু দে-র কবিতা: “আনন্দ আজ আনন্দ অসীম/নীল আকাশের নিচে, মিলেছে আজ হিন্দু মুসলমান…”

অভিযোগের কিছু বিবরণ:

গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গত ১২ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে ট্রাইব্যুনালের কাছে তাকে গ্রেপ্তারের আবেদন করা হয়। ২৬ ডিসেম্বর অভিযোগ অবিন্যস্ত এবং শ্রেণীবদ্ধ নয় বলে রাষ্ট্রপক্ষের কৌশুলীদের কাছে সেটি ফিরিয়ে দিয়ে গত ৫ জানুয়ারি পুনরায় অভিযোগ দাখিলের দিন ধার্য্য করে দেন ট্রাইব্যুনাল। ৫ জানুয়ারিতে দেয়া অভিযোগপত্রে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী ৬২টি অভিযোগ আনা হয়। ৬২টি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে হানাদার বাহিনীকে সহায়তা ও তাদের সঙ্গে চক্রান্ত করার জন্য ছয়টি, তাদের সঙ্গে পরিকল্পনার তিনটি, উস্কানি দেওয়ার ২৮টি, তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ২৪টি এবং ব্যক্তিগতভাবে হত্যা ও নির্যাতনের একটি অভিযোগ।

রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি রানা দাশগুপ্ত বাংলানিউজকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগ থেকেই পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সঙ্গে গোলাম আযমের যোগাযোগ ছিলো। আর ওই অবস্থায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয়। অপারেশন সার্চলাইটের তিন দিন পরই খাজা খয়েরউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে ১৪০ সদস্যের শান্তি কমিটি গঠন করা হয়।

তিনি আরও জানান, তাদের দৈনন্দিন কাজ তদারকি করতে ৬ সদস্যের একটি কমিটিও করা হয়। আর ওই কমিটির দুই নম্বরে ছিলো গোলাম আযমের নাম।

রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘জামায়াতের এই সাবেক নেতার নেতৃত্বেই দেশের বিভিন্ন স্থানে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর, আল শামস ও মুজাহিদ বাহিনী গঠন করা হয়।’

এসব সংগঠনকে অস্ত্র সরবরাহ করা এবং এ বিষয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে সুপারিশ করার দায়িত্ব গোলাম আযমই পালন করতেন বলেও জানান তিনি।

রানা দাশগুপ্ত আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় এক ঈদের দিন গভীর রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেল থেকে ৩৮ জনকে এনে কৈরতলা এলাকায় হত্যা করা হয়। গোলাম আযম এ ঘটনায় সম্পৃক্ত ছিলেন।’

মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থা গত ৩১ অক্টোবর গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ৩৬০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন এবং আনুষঙ্গিক নথিপত্র রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলিদের কাছে জমা দেন।

১ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা গোলাম আযমের বিরুদ্ধে প্রসিকিউটরের কাছে এ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।

৩৬০ পৃষ্ঠার এ তদন্ত প্রতিবেদনে মোট ৪০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিবেদনটির সঙ্গে ১০ হাজার পৃষ্ঠার নথিপত্র উপস্থাপন করা হয়েছে।

কিন্তু, আসলে কী অপরাধ গোলাম আযম নামের এই ‘অধ্যাপক’ পদবিধারী ‘ভাষাসৈনিক’ শ্মশ্রূমণ্ডিত নুরানি চেহারার ইসলামের পথের অশীতিপর সৈনিকের?

প্রথমত, দেখা যাক একাত্তরে তাঁর অপরাধের কিছু বিবরণ।

২৫ শে মার্চ রাতে সংঘটিত অপারেশন সার্চলাইট এর ছয় দিন পর গোলাম আযম ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে একটি ভাষণ দেন। এ ভাষণে তিনি ভারতের কড়া সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, “ভারত সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী প্রেরণ করে কার্যত পূর্ব পাকিস্তানীদের দেশপ্রেমকে চ্যালেঞ্জ করেছে।…আমি বিশ্বাস করি যে, এই অনুপ্রবেশকারীরা পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমানদের নিকট হেত কোন প্রকার সাহায্য পাবে না। সূত্র: দৈনিক সংগ্রাম, ৭ এপ্রিল ১৯৭১।

৮ই এপ্রিলি গোলাম আযম জামাতের গণসংযোগ সম্পাদক মৌলানা নুরুজ্জামান এবং অন্য এক জামাত নেতা গোলাম সারওয়ারের সাথে এক যৌথ বিবৃতিতে জানান:

পূর্ব পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারত হস্তক্ষেপ করছে। দেশপ্রেমিক পাকিস্তানিরা যেখানেই ভারতীয় চর বা পাকিস্তানবিরোধী কিছু বা কোন অনুপ্রবেশকারী পাবে, সেখানেই তাদের ধ্বংস করা হবে।

গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধের শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিরোধিতাই করেননি বরং তিনি এবং তাঁর দল জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ প্রভৃতি বাহিনী গড়ে তোলেন। এরা পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে কাজ করে।

দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় ১১ এপ্রিল, ১৯৭১ (২৮ চৈত্র, ১৩৭৭ বাংলা সন) তারিখে প্রকাশিত “ঢাকায় নাগরিক শান্তি কমিটি গঠিত” শিরোনামের খবরে বলা হয়,

“গত ৯ই এপ্রিল ঢাকায় প্রতিনিধিত্বশীল নাগরিকদের এক সভায় এক শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি খাজা খয়েরউদ্দিনকে আহ্বায়ক মনোনীত করেছে। কমিটিতে মোট ১৪০ জন সদস্য রয়েছেন। এই কমিটির বৃহত্তর ঢাকার ইউনিয়ন ও মহল্লা পর্যায়ে অনুরূপ কমিটি গঠনের ক্ষমতা রয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটির পরিচালনায় এগুলো কাজ করবে। নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কমিটি সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কমিটির অন্যান্য বিশিষ্ট সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন এ. কিউ. এম. শফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক গোলাম আজম, মওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ মাসুম, আবদুল জব্বার খদ্দর, মাহমুদ আলী, এম. এ. কে. রফিকুল হোসেন, ইউসুফ আলী চৌধুরী, আবুল কাসেম, এম. ফরিদ আহমদ, অধ্যাপক গোলাম সারওয়ার, সৈয়দ আজিজুল হক, এ. এস. এম. সোলায়মান, পীর মোহসেনউদ্দীন, এডভোকেট শফিকুর রহমান, মেজর (অবঃ) আফসার উদ্দিন, সৈয়দ মোহসিন আলী, এডভোকেট ফজলুল হক চৌধুরী, আলহাজ্ব সিরাজউদ্দিন, এডভোকেট এ. টি. সাদী, এডভোকেট আতাউল হক খান, মকবুলুর রহমান, আলহাজ্ব মোহাম্মদ আকিল, অধ্যক্ষ রুহুল কুদ্দুস, ইয়ং পাকিস্তান সম্পাদক নুরুজ্জামান, মওলানা মিয়া মফিজুল হক, এডভোকেট আবু সালেক, এডভোকেট আবদুল নায়েম ও অন্যান্য। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হিন্দুস্তানের ঘৃণ্য ক্রিয়াকলাপের নিন্দা করে নিম্নলিখিত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। এই সভা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হিন্দুস্তানের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের তীব্র নিন্দা করছে। এই বিপজ্জনক খেলায়—যা মহাযুদ্ধের পথে এগুতে পারে—লিপ্ত না হওয়ার জন্য এই সভা ভারতীয় নেতাদের দ্ব্যর্থহীন ভাষায় হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে। এই সভা মনে করে যে, পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে হিন্দুস্তান বস্তুতঃপক্ষে পূর্ব পাকিস্তানীদের দেশপ্রেমে চ্যালেঞ্জ করছে। এই সভা আমাদের প্রিয় দেশের সংহতি ও মর্যাদা রক্ষার উদ্দেশ্যে এই চ্যালেঞ্জ সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলার জন্য দেশপ্রেমিক জনগণের প্রতি আকুল আহ্বান জানাচ্ছে।”

দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় ১৩ এপ্রিল, ১৯৭১ তারিখে প্রকাশিতখবরে বলা হয় ১২ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে পরিচালিত শান্তি কমিটির মিছিল শেষে গোলাম আযমের নেতৃত্বে পরিচালিত মোনাজাত সম্পর্কে বলা হয়,

“পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে সত্যিকারের মুসলিম সৈনিক হিসেবে দেশরক্ষার যোগ্যতা অর্জনের জন্য আল্লাহর দরগাহে দোয়া করেন। সত্যিকারের মুসলমান ও পাকিস্তানী হিসেবে বেঁচে থাকার ও পাকিস্তানে চিরদিন ইসলামের আবাসভূমি হিসেবে টিকিয়ে রাখার জন্য সর্বশক্তিমানের নিকট দোয়া করেন।”

৩০শে জুন লাহোরে সাংবাদিকদের কাছে গোলাম আযম বলেন,

“তাঁর দল পূর্ব পাকিস্তানে দুস্কৃতকারীদের(মুক্তিযোদ্ধা) তৎপরতা দমন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে এবং এ কারণেই দুস্কৃতকারীদের হাতে বহু জামায়াত কর্মী নিহত হয়েছে। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার উদ্দেশ্য ঢাকায় শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এর সদস্য ছিলেন পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বরা। গোলাম আযম ও এই কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৫ ও ৬ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংগ্রাম এ গোলাম আযমের পশ্চিম পাকিস্তান সফরকালের একটি সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বিবরণ দুই কিস্তিতে ছাপা হয়। এই সাক্ষাৎকারে তিনি মুক্তিবাহিনীর সাথে তার দলের সদস্যদের সংঘর্ষের বিভিন্ন বিবরণ ও পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থতির ওপর মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা জামায়াতকে মনে করতো পহেলা নম্বরের দুশমন। তারা তালিকা তৈরি করেছে এবং জামায়াতের লোকদের বেছে বেছে হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর লুট করছে জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। এতদসত্বেও জামায়াত কর্মীরা রাজাকারে ভর্তি হয়ে দেশের প্রতিরক্ষায় বাধ্য। কেননা তারা জানে ‘বাংলা দেশে’ ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য কোন স্থান হতে পারে না। জামায়াত কর্মীরা শহীদ হতে পারে কিন্তু পরিবর্তিত হতে পারে না। (দৈনিক সংগ্রাম, ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)

এ-ব্যক্তির একাত্তরের অপরাধের এমনি আরো বিস্তৃত বিবরণ পেতে পড়তে পারেন এই পিডিএফ ফাইলটি। এছাড়া, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে দেশি দালালেরা যা বলেছে বা করেছে, তার বিস্তৃত সংগ্রহ পাবেন এখানে।

এছাড়া, গোলাম আযম তাঁর তিন খণ্ডের আত্মজীবনী ‘জীবনে যা দেখেছি’-তে যা বলেছেন, তাও প্রণিধানযোগ্য এবং তাঁর বিরুদ্ধে অনায়াসেই সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এই বইয়ের তৃতীয় খণ্ডের কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো:

মুক্তিযুদ্ধ তাঁর কাছে,

“পাকিস্তান বিভক্তি ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিষাদময় কাহিনী।” (পৃ. ২১১)

রাজাকারদের পক্ষে তাঁর ওকালতি:

“যে রেযাকাররা (রাজাকার) দেশকে নাশকতামূলক তত্পরতা থেকে রক্ষার জন্য জীবন দিচ্ছে তারা কি দেশকে ভালবাসে না? তারা কি জন্মভূমির দুশমন হতে পারে?” (পৃ. ১৫০)

পাকিস্তানি সেনাবাহিনির পক্ষে এবং শান্তিবাহিনী গঠনের স্বপক্ষে নির্লজ্জ দালালি:

“সামরিক বাহিনীর অভিযানের ফলে জনগণ যে অসহায় অবস্থায় পড়ে আমাদের কাছে আসছে আমাদেরকে যথাসাধ্য তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। এ পরিস্থিতিতে জনগণের সামান্য খিদমত করতে হলে সামরিক সরকারের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমেই তা সম্ভব।” (পৃ. ১৪৩)

শান্তিবাহিনী নিয়ে তাঁর আক্ষেপ:

“‘মুক্তিযোদ্ধারা শান্তি কমিটির সঙ্গে শত্রুতা না করলে জনগণের পর্যায়ে শান্তি কমিটি ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হতো না।” (পৃ.-১৫৮)

আরো কিছু বিস্তৃত বিবরণ আছে এখানে।

বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নক্সায় ব্যস্ত গোলাম আজম, রাও ফরমান ও মালেক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ডঃ আনিসুজ্জামানের নিজের মুখের কিছু কথা শোনা যাক।

১৯৯২ সালে তিনি গোলাম আযমের মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী তথা ১৯৭২ সাল এবং এর পরে গোলাম আযমের বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা তুলে ধরেন। তাঁর ভাষায়: “যেহেতু ১৯৭১ সালে আমি দেশ ছেড়ে গিয়েছিলাম, সুতরাং গোলাম আযমের তখনকার কার্যকলাপ সম্পর্কে আমার অভিযোগ হবে শোনা কথার সামিল। আমি বরঞ্চ ১৯৭২ সাল থেকে গোলাম আযম বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যা যা করেছেন, সে-সম্পর্কে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে অভিযোগ আনবো। আর কেউ ১৯৭১ সালে তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে অভিযোগ করুক। আলোচনার পরে স্থির হলো, গণ-আদালতে অভিযোগকারী হবো আমরা তিনজনঃ বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গোলাম আযমের ভূমিকা সম্পর্কে অভিযোগ উত্থাপন করবেন সৈয়দ শামসুল হক; মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে অভিযোগ উত্থাপন করবে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর; আর বাংলাদেশ-প্রতিষ্ঠার পর পৃথিবীর নানাদেশে তাঁর বাংলাদেশবিরোধী ভূমিকা সম্পর্কে অভিযোগ উত্থাপন করবো আমি”। এবার আমরা দেখে নেই তাঁর সেই ঐতিহাসিক অভিযোগপত্রটি

মাননীয় আদালত, আমি, মরহুম ডাঃ এ টি এম মোয়াজ্জমের পুত্র এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অভিযোগ উত্থাপন করছি। আমি অভিযোগ করছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের পক্ষে; আমি অভিযোগ করছি পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে লাঞ্ছিত মায়েদের পক্ষে; আমি অভিযোগ করছি হানাদার বাহিনী দ্বারা ধর্ষিত বোনদের পক্ষে; আমি অভিযোগ করছি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর আল বদর কর্তৃক নিহত বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে; আমি অভিযোগ করছি শত্রুর হাতে প্রাণদানকারী পিতামাতার অসহায় এতিম সন্তানদের পক্ষে; আমি অভিযোগ করছি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিকদের পক্ষে। আমি অভিযোগ আনছি মরহুম মওলানা গোলাম কবিরের পুত্র গোলাম আযমের বিরুদ্ধে-ইনি একজন পাকিস্তানি নাগরিক, তবে বহুদিন ধরে বেআইনিভাবে বসবাস করে আসছেন ঢাকার রমনা থানার মগবাজার এলাকার ১১৯ নম্বর কাজী অফিস লেনে।

ইনি সেই গোলাম আযম-যিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রতিটি অন্যায়, বেআইনি, অমানবিক ও নিষ্ঠুর কাজ প্রকাশ্যে সমর্থন করেছিলেন; যিনি মুক্তিযোদ্ধাদের দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দিয়ে তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করার আহ্বান জানিয়েছিলেন; যিনি আল বদর বাহিনী গড়ে তুলে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করার প্ররোচনা দিয়েছিলেন। গোলাম আযমের প্ররোচনায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আছেন আমার শিক্ষক মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সন্তোষকুমার ভট্টাচার্য ও সিরাজুদ্দীন হোসেন, আমার অগ্রজপ্রতিম শহীদুল্লা কায়সার, আমার বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আহমদ, আমার সহকর্মী আবুল খায়ের, আনোয়ার পাশা, রাশীদুল হাসান ও মোহাম্মদ মোর্তজা, আমার ছাত্র আ ন ম গোলাম মোস্তফা ও সৈয়দ নজমুল হক-যাঁদের মৃত্যুতে আমি ক্ষতিগ্রস্ত, শোকাহত ও ব্যথাতুর। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আমার বিশেষ অভিযোগঃ তিনি সর্বদা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছেন এবং এখনো করছেন; বিশেষ করে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৮ সালের ১০ জুলাই পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সশরীরে উপস্থিত থেকে, বক্তৃতা ও আলোচনার মাধ্যমে, স্মারকলিপি ও বিবৃতির দ্বারা, মুদ্রিত ও প্রকাশিত প্রচারপত্র ও প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে এবং সাংগঠনিক উদ্যোগ গ্রহণ করে নিজে এবং অপরের দ্বারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে দুর্বল ও সহায়হীন, বিচ্ছিন্ন ও বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র করেছেন। বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে এতে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আমার অভিযোগের সমর্থনে গোলাম আযমের কিছু কার্যকলাপের পরিচয় এখানে তুলে ধরছি।

[১] ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হলে গোলাম আযম পাকিস্তানে বসে মাহমুদ আলী ও খাজা খয়েরউদ্দীনের মতো দেশদ্রোহীর সঙ্গে মিলিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি নামে একটি সংগঠনের সূচনা করেন এবং বিভিন্ন দেশে পূর্ব পাকিস্তান পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তোলার আয়োজন করেন। তিনি এই উদ্দেশ্যে দীর্ঘকাল পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির বলে নিজের পরিচয় দিতেন।

[২] ১৯৭২ সালে গোলাম আযম লন্ডনে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি’ গঠন করেন এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র উচ্ছেদ করে আবার এই ভূখণ্ডকে পাকিস্তানের অংশে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করেন। ১৯৭৩-এ ম্যানচেস্টারে অনুষ্ঠিত ফেডারেশন অফ স্টুডেন্‌টস ইসলামিক সোসাইটিজের বার্ষিক সম্মেলনে এবং লেসটারে অনুষ্ঠিত ইউ কে ইসলামিক কমিশনের বার্ষিক সভায় তিনি বাংলাদেশবিরোধী বক্তৃতা দেন। ১৯৭৪-এ মাহমুদ আলীসহ কয়েকজন পাকিস্তানিকে নিয়ে তিনি পূর্ব লন্ডনে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটির এক বৈঠক করেন। বাংলাদেশকে পাকিস্তানে পরিণত করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে দেখে এই সভায় স্থির হয় যে, তাঁরা এখন থেকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নিয়ে একটি কনফেডারেশন গঠনের আন্দোলন করবেন। এই সভায় গোলাম আযম ঝুঁকি নিয়ে হলেও বাংলাদেশে ফিরে অভ্যন্তর থেকে ‘কাজ চালানোর’ প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করেন। ১৯৭৭-এ লন্ডনের হোলি ট্রিনিটি চার্চ কলেজে অনুষ্ঠিত একটি সভায় তিনি এ কথারই পুনরাবৃত্তি করেন এবং সেই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য পাকিস্তানি পাসপোর্ট ও বাংলাদেশি ভিসা নিয়ে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে আগমন করেন।

[৩] ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে গোলাম আযম রিয়াদে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামি যুব সম্মেলনে যোগদান করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সকল মুসলিম রাষ্ট্রের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত তিনি সাতবার সউদি বাদশাহ্‌র সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার আহ্বান জানান এবং কখনো তিনি বাদশাহ্‌কে বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করতে ও কখনো বাংলাদেশকে আর্থিক বা বৈষয়িক সাহায্য না দিতে অনুরোধ করেন। ১৯৭৪ সালে রাবেতায়ে আলমে ইসলামির উদ্যোগে মক্কায় অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এবং ১৯৭৭ সালে কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত একটি সভায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করেন।

[৪] অনুরূপভাবে গোলাম আযম ১৯৭৩ সালে বেনগাজিতে অনুষ্ঠিত ইসলামি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য লবিং করেন। একই বছরে ত্রিপলিতে অনুষ্ঠিত ইসলামি যুব সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে হানিকর বক্তব্য উপস্থাপন করেন।

[৫] ১৯৭৩ সালে গোলাম আযম মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম স্টুডেনটস অ্যাসোসিয়েশন অফ আমেরিকা অ্যান্ড কানাডার বার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানভুক্ত করার জন্য সবাইকে কাজ করতে আহ্বান জানান।

[৬] ১৯৭৭ সালে গোলাম আযম ইসতামবুলে অনুষ্ঠিত ইসলামিক ফেডারেশন অফ স্টুডেনটস অরগানাইজেশনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশবিরোধী বক্তৃতা করেন।

মাননীয় আদালত, আমি গোলাম আযমের বিরুদ্ধে বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ উত্থাপন করছি। ইনি সেই গোলাম আযম-যাঁকে ফেরার ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নিজ এলাকার মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হতে নির্দেশ দেন; ১৯৭৩ সালের ১৮ই এপ্রিল এক প্রজ্ঞাপনবলে বাংলাদেশ সরকার যাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করে দেন; যিনি পাকিস্তানি পাসপোর্ট ও তিন মাসের ভিসা নিয়ে ১৯৭৮ সালের ১১ই জুলাই বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর যিনি বেআইনিভাবে এ দেশে রয়ে যান; ১৯৭৬, ১৯৭৭, ১৯৭৮, ১৯৭৯ ও ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন করেও যিনি নাগরিকত্ব ফেরত পাননি; বাংলাদেশ সরকার যাঁকে ১৯৮৮ সালের ২০শে এপ্রিলের মধ্যে দেশত্যাগের নির্দেশ দিলেও যিনি বাংলাদেশে থেকে যান; যাঁর নাগরিকত্ব ফেরত দেওয়ার ইচ্ছা বাংলাদেশ সরকারের নেই বলে ১৯৮৮ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিকবার জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছেন; সেই গোলাম আযমের উপযুক্ত শাস্তি বিধানের জন্য এই গণ-আদালতের কাছে আমি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করলাম।

প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য, প্রায়ই জামাত-এ-ইসলামী গোলাম আযমকে ‘অধ্যাপক’ এবং ‘ভাষা সৈনিক/ভাষা আন্দোলনকারী’ উল্লেখ করে। তাদের প্রথম দাবিটির সূত্র অনির্দেশ্য এবং গোলমেলে। দ্বিতীয় দাবি প্রসঙ্গে শওকত ওসমান অনবদ্য ভাষায় বলেছিলেন, “বেশ্যাও একদা সতী থাকে।”

উক্ত দাবিটির খণ্ডন দেখতে পাবেন এই লিংকগুলোয়:

প্রথম লিংক: গোলাম আজম ভাষা সৈনিক হিসাবে প্রচার – জামাতিদের ভন্ডামীর একটা নমুনা মাত্র। (ব্লগার এস্কিমো)

দ্বিতীয় লিংক: গো.আযমের ভাষাসৈনিক স্ট্যাটাস এবং উমরের কলাম ‘ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর ভেলকিবাজি’। (ব্লগার-নুরুজ্জামান মানিক)

দেখে নিতে পারেন এই ছবিটাও।

গোলাম আযমের ভাষা আন্দোলনের গোপন কাহিনি

এই জীবন্ত নরপিশাচটিকে দেশের নাগরিকত্ববঞ্চিত করা হয়, কিন্তু পরে আবারো তিনি বিচারের ফাঁক গলে ও নানাবিধ অদৃশ্য ভানুমতির খেলোয়াড়দের বদান্যতায় ফিরে পান নাগরিকত্ব। এই নাগরিকত্বের রায় দেওয়া বিচারক নিয়ে দেখুন আরেক ব্লগার ও সাংবাদিক শওকত হোসেন মাসুমের একটি লেখা।

এবার বলুন এই দেশবিরোধী কুলাঙ্গার গর্ভস্রাবের জন্যে এরকম শাস্তিও নিতান্ত কম হয়ে যায় কি না।

শুয়োরের শিরে শু-দান

এই মহাপাপী নরপশুটিকে আপনি আপনি সম্বোধন করে মুখ তেতো হয়ে গেছে। তাই, সুশীলতা ঝেড়ে এই মাদারচোদ পাকিস্তানিপয়দা জানোয়ারের বাচ্চার দিকে ঘৃণার তীব্রতম থুথু ছুঁড়তে চাই। বলতে চাই, এই খানকির বাচ্চাটাই এবং এর পেছনের অনেকেই এদেশের অজস্র হত্যা, ধর্ষণ, জঘন্যতম অপরাধের জন্যে দায়ী। সব মাদারচোদের বিচার চাই, সব বাঞ্চোতের বাচ্চার।

এই আনন্দের দিনে আমার কচকচানি ক’টা কথা বলেই শেষ করি।

এখনো শেষ নয় কাজ। এখনো হটা যাবে না রাজপথ বা অন্য কোন জায়গার অবস্থান থেকে। এখনই নয় আনন্দ উদযাপনের অন্তিম মুহূর্ত। এখনই নয় কোন প্রতিরক্ষায় বা আক্রমণে তিলমাত্র শিথিলতা। শেষ সেই দিনের জন্যে এখনো বসে থাকবো আমরা সবাই ঘাঁটি গেড়ে, যেদিন ওরা আসবে চুপিচুপি, যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ। যেদিন গর্ব করে বলতে পারবো, বাংলার মাটি আজ রাজাকার-আলবদর-দেশবিরোধী মুক্ত। যেদিন ফিরে আসবে আবার ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ, নিষিদ্ধ হবে সব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল, সংবিধান থেকে মুছে যাবে বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম নামের অশ্লীল শব্দটি থাকবে না সংবিধানে। সেদিন নীরবে আমি প্রচণ্ড কষ্টে আমার কান্না আর আবেগ রাখবো সংহত করে, বোঝাবো নিজেকেই, “কেউ যেন ভুল করে গেও নাকো মনভাঙ্গা গান…”