লিখেছেন: হরিপূর্ণ ত্রিপুরা

আমি একমেবাদ্বিতীয়ম, সর্বশক্তিমান, সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ, সকল সৃষ্টি, পুষ্টি ও বিনাশের মূল । একক অবিভাজ্য হয়েও আমি বহুরূপি, নিরাকার হয়েও সাকার , অসীম হয়েও সসীম , স্বর্গের অধিপতি হয়েও জলে- স্থলে – অন্তরীক্ষে সবখানেই বিরাজমান । সকল মানুষ, জীব ও জড়বস্তুতে বিরাজিত বলে প্রাচীন আর্য ঋষিরা আমাকে বলতেন “ ব্রক্ষ” । চন্দ্র-সূর্য-দ্যাবা-পৃথিবী- নিমেষ-মুর্হুত-আহোরাত্র সবকিছুরই নিয়ন্তা আমি । পৃথিবীর মানুষ আমাকে যে রূপে কল্পনা করেছে , ব্যাকুল হয়ে র্প্রাথনা জানিয়েছে আমি সেভাবেই ধরা দিয়েছি বা বাধ্য হয়েছি । কারণ বিপরীতভাবে আমিও শরণাগত ভক্তের অনুগত সেবক মাত্র । ভক্তি ও ভালবাসার কাছে আমিও স্নেহকাঙ্গাল মানব শিশুর মতো অসহায় ও বন্দী । আর এখানেই আমার সীমাবদ্ধতা বা শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত ।
…………………………………………………………………….

বিদ্রোহের বা সমস্যার শুরু সেসময় থেকে, যখন আমার প্রিয় পুত্রকে যুবরাজ হিসেবে ঘোষণা করি । দেবদূত প্রধান লূসিফর এ ঘোষণাকে কায়মনোবাক্যে মেনে নিতে পারেনি। যদিও সে ছিল আমার সবচেয়ে অনুগত ও পদাধিকার বলে স্বর্গে আমার পরেই তার স্থান । তার চেহারা ছিল শান্ত প্রকৃতির ও লোভনীয় অভিব্যত্তিত্বে ভরা । তার ললাট ছিল উচুঁ এবং প্রশস্ত, একজন ক্ষমতাশালী ; বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক । গঠন নিখুঁত ও সমুন্নত । শরীর থেকে বিশেষ এক জ্যোতি বিকরিত হয়ে তার চর্তুপাশ আলোকিত করতো এবং অন্যান্য দেবদূত অপেক্ষা অধিক সৌন্দর্যময় করে তুলতো । দেবদূতগণের সৃষ্টির পূর্বে সে ছিল আমার সাথে এক এবং দেবসেনাদের মধ্যে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বে সে ছিল সবার শীর্ষে। তাই সে যীশুকে “ঈশ্বরের পুত্র ” এবং “আমার সমকক্ষ আরাধনা পাওয়ার অধিকার প্রাপ্ত এবং যীশুর বাণীও ঐশী আজ্ঞাবহ হবে ” -ঘোষণাকে একজন সাধারণ মানুষের মতো খ্রীষ্টের বিষয়ে পরশ্রীকাতর ও ঈর্ষান্বিত হয়ে প্রকাশ্যে তার বিরদ্ধাচারণ করল । সে সংগোপনে তার অনুগত সকল দেবদূতদের মন্ত্রণা সভায় এই বলে অভিযোগ করল যে আমি তাকে তুচ্ছ করেছি এবং যীশুকে প্রাধান্য দিয়েছি । সে আরও বলল – “দেবদূতগণের এতদিনের মনোরম স্বাধীনতার দিন শেষ ! তারা আজ থেকে “ ওড়ে এসে জুড়ে বসা ” একজন শাসনকর্তার প্রতি অবমাননাকর কৃতদাস সুলভ সমাদর প্রদর্শন করতে হবে ।” শান্তিপ্রিয় বিশ্বস্ত এবং অনুগত দূতগণ এই শক্তিশালী বিদ্রোহী সেনাপতিকে আমার সাথে পূর্ণমিলন করিয়ে দেবার প্রাণান্ত চেষ্টা করলেন। কিন্তু না ! লূসিফর কোনমতে টলেনা । পক্ষপাতমূলক এই ঘোষণার সে এসপার-ওসপার করেই ছাড়বে – “যারা ক্রীতদাস হতে অভিলাষী তারা ঈশ্বরের দিকে যাক , এবং যারা আত্মমর্যাদা সম্পন্ন , স্বাধীন ও মুক্ত জীবনের স্বপ্ন লালনকারী তারা আমার দিকে ভীড়ুক ।” নিশ্চিত পরাজয় জেনেও সর্বশক্তিমানের বিরূদ্ধে সে অন্যায় ব্যবস্থার প্রতিবাদ করবেই । সত্যিকারের বীরেরা বুঝি এমনই হয় !

সর্বশক্তিমান হিসেবে স্বর্গের সার্বিক মঙ্গলের জন্য আমি তৎক্ষণাত লূসিফরকে স্বর্গ হতে বিতাড়িত করতে পারতাম। কিন্তু আমি লূসিফরকে সমান সুযোগ দিলাম আমার পুত্র ও বিশ্বস্ত দেবগণের সাথে মোকাবিলায় তাদের শক্তি ও ক্ষমতা প্রদর্শনের ও পরিমাপ করবার । স্বর্গের সেকি ভয়ংকর দুর্দিন! অশ্বের চীৎকার, যুদ্ধাহত সৈনিকদের আর্তনাদ, অস্ত্রের ঝণঝণানি- যুদ্ধের ইত্যাকার ভয়াবহতায় স্বর্গ যেন কাঁপছিল থরথর। শান্তি ও পবিত্রতা বলে কিছুই থাকল না । মূর্খ শয়তানের দল! -ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে কিভাবে বুঝবে আমার লীলাখেলা । কেন, কখন, কাকে আমি অধিকতর প্রীত বর্ষণ করি , কেন কাকে আমি পরিত্রাতার মর্যাদায় আসীন করি – তার উত্তর কেউ কি জানে ? জানতে চাওয়া ও আমার প্রতি শয়তান সুলভ সংশয় প্রদর্শন, স্পর্ধা ও পাপ । আমি চাই নি:সংশয় ও নি:শর্ত আনুগত্য ।

স্বর্গে যে বিদ্রোহ, যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সেখানে শয়তান এবং তার দলবল লজ্জাজনক পরাজয়ের সম্মুখীন হয় আমার প্রিয় পুত্রের বাহিনীর কাছে । স্রষ্টার প্রতি অকৃতজ্ঞতা , বিদ্রোহের পরিণাম , এবং স্বর্গের শান্তি ও পবিত্রতা কলুষিত করার দায়ে তাদের সকলের দেবত্ব রদ করা হয় । শাস্তিস্বরূপ সকলকে পাতালের ভয়ংকর কারাকক্ষে হাড়কাপাঁনো শীত, ক্ষুধা, ও তৃষ্ণায় কাতর অন্ধকার পরিবেশে নিক্ষেপ করা হয় অনন্ত কালের জন্য ।

অস্বীকার করার উপায় নেই, সেদিনই জানালা দিয়ে প্রবেশ্য সূর্যালোকের মতো শয়তানের প্রভাবে উকিঁ দিয়েছিল অপূর্ণতার আকাঙ্খা। ফলশ্রতিতে মানুষ সৃষ্টি করলাম আমি, তাদের আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতা পরীক্ষার জন্য । প্রকৃতির রাজ্যে তাদেরকে তৈরী করলাম -“ আশরাফুল মখলুকাত” হিসেবে । শারীরিক গঠনে , প্রাকৃতিক পরিবেশে অভিযোজনে এবং প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণে মানুষ তাই তর্কাতীতভাবে অন্যান্য প্রাণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ । তাদের মগজে ঘিলুর পরিমাণও একটু বেশি করে দিয়েছিলাম, যাতে তারা বিশ্বের তাবৎ ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সকল সৃষ্টির সুসজ্জিত ও শৃংখলিত অপরূপ রূপ উপলদ্ধি করে আমার অস্তিত্ব ও সৃষ্টির উদেশ্যকে অনুধাবন করতে পারে এবং ভালমন্দ, ন্যায়-অন্যায় , পাপ-পূণ্য সবকিছুরই বিচার বিবেচনা করার ক্ষমতা লাভ করতে পারে । ভাল ও পূণ্য কাজের জন্য তাদেরকে দেখালাম স্বর্গের সীমাহীন ঐশ্বর্য ও আনন্দের লোভ আর পাপ ও মন্দ কাজের জন্য নরকের ভয়ংকর ও বিভৎসময় শাস্তির ভয় ।

আমি লক্ষ্য করলাম – পৃথিবীর প্রথম দিককার স্থুলবুদ্ধি ও অনুভূতির মানুষেরা আমাকে কল্পনা করল বহুত্ব রূপে, পৃথিবীর রূপ -রস -গন্ধ ও স্পর্শের ভিত্তিতে। আকাশের বিশালতায়, পাহাড়ের অটল গার্ম্ভীয ও দৃঢ়তায় , মেঘে মেঘে বিদ্যুতের ঝিলিক দৃশ্যে ,আদি অরণ্যের বৃক্ষের ডালে ডালে ঘর্ষণের ফলে সৃষ্ট দাবানল ইত্যাকার প্রাকৃতিক ঘটনায় আদিম মানুষেরা যুগপৎ বিস্মিত ও ভীত হতো । আগুনের, পানির, বায়ুর, পাহাড়ের কতোরকম দেবদেবী রূপে তারা আমাকে পূজা করল । কিন্তু সময়ের চাকা যতই এগোল তাদের বুদ্ধি ও অনুভূতি সুসূক্ষ্ম হতে সূক্ষ্মতর হতে লাগল । তখন তারা আমাকে কল্পনা করল একক , অবিভাজ্য, ও নিরাকার রূপে । তখন আমি হলাম – অনাদি, অনন্ত , অরূপ , অস্পর্শ , অনাস্বাদীয়, নিত্য ও অগন্ধ । তবে আমাকে যেরূপে কল্পনা করুক না কেন , অন্তরের পবিত্রতা , ব্যাকুল প্রার্থনা , নি:শর্ত আনুগত্য ও নি:সংশয় বিশ্বাসই আমার সন্তুষ্টি বিধানের একমাত্র উপায় । বাইবেলে বর্ণিত -সরল মেষপালকের নিজস্ব বিধানে ঈশ্বর আরাধনার কাহিনী কে না জানে ?

কিন্তু মনুষ্যকুল বড় অদ্ভুত প্রকৃতির। জীব জগতের মধ্যে অদ্ভুততম। প্রথম থেকে ওদের চিন্তায় ও কার্যকলাপে আমি বিস্মিত। তাদের অনেকের অভিমত – সবকিছুই পূর্ব নির্ধারিত, অনাগতে যা ঘটবে তার বিধিবিধান একচুলও এদিক সেদিক হবার নয় । শুধু পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে ঝাঁকে ঝাঁকে মানব সন্তান এসে ঐশ্বরিক বিধিবিধান অনুসারে অভিনয় করে যায়। বিরুদ্ধবাদীদের যুক্তি- আহা মূর্খের দল ! জগতে তাহলে পাপ-পূণ্য, ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের মূল্য কি? পাপ, অন্যায় ও মন্দ কাজের জন্য কেন মানুষ দায়ী হবে, মানুষতো একটা দম দেওয়া পুতুল মাত্র । ” আবার কারো কারোর অভিমত – “মাতৃগর্ভ থেকেই মানুষের বন্দীত্বের শুরু , পৃথিবী একটা দাসত্বের কারাগার । মুক্তি, সাম্য, স্বাধীনতা সবিই মেকি, প্রতারণা মাত্র । মানুষের পক্ষে যা সম্ভবপর তা হচ্ছে – আপোষহীন, নির্ভীক শয়তানের মতো সকল অজ্ঞতা, অন্ধকার, শৃংখলতা ও দাসত্বের বিরুদ্ধে দাউ দাউ বিদ্রোহের শিখা আমৃত্যু প্রজ্জ্বলিত রাখা । ”

– এই হচ্ছে আমার সৃষ্ট মনুষ্যকুল ! – জীবন জগত সর্ম্পকে তাদের অভিমত গল্পের অন্ধজনদের হস্তী দর্শনের সামিল। কোনো বিষয়ে তাদের বক্তব্য মিথ্যা নয় আবার পুরোপুরি সত্যও নয়। কেননা তাদের সীমায়িত চক্ষু ও মনের গতি জগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে অক্ষম। তাই সামগ্রিক সত্যের কাছাকাছি তাদের পক্ষে কোনদিনই পৌঁছানো সম্ভব নয়। এটাই ওদের সীমাবদ্ধতা, বুদ্ধিমান জীব হিসেবে ট্র্যাজেডি এবং এখানেই তাদের সাথে আমার ভেদরেখা। এজন্য তাদের অনেকের শয়তান সুলভ বিরোধিতা প্রদর্শন। অজ্ঞতার বিশাল মহাসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি সীমার ওপার সর্ম্পকে ওরা কল্পনা করতে পছন্দ করে। অবশ্য সত্যানুসন্ধিৎসু কেউ কেউ দুর্বার সাহসে পাল তোলে বেরিয়ে পড়ে আজানার পথে, প্রকৃত সত্যের রহস্য উম্মোচনের আকাঙ্ক্ষাকে বুকে লালন করে কিন্তু মহাসাগরের অসীমে হারিয়ে যাওয়া ছাড়া তখন তাদের আর কোনো গত্যন্তর থাকেনা। কেউ কেউ ফিরে আসে হতাশা ও অনুশোচনায় দগ্ধ হৃদয় নিয়ে -“হায় হায় ! ঈশ্বরের সাথে অকৃতজ্ঞতার পরিণাম কি যে হবে ”- এই ভয়ংকর উৎকন্ঠাকে নিয়ে পূর্বতন বিশ্বাসের বেলাভূমিতে এসে তারা কেঁদেকুটে বুক ভাসায় । মানুষের জন্য জগত হচ্ছে হাজারো সব প্রতিবন্ধকতাময় , কুহেলিকায় পূর্ণ । মহাত্মা শংকর তাই জগতকে বলেছেন -“মায়া।” বিভ্রান্তির ছোবলে ছোবলে মানুষকে জর্জরিত ও উন্মাদ করে দেওয়ার জন্য এখানে আছে সব আয়োজন । আমার পরীক্ষার ক্ষেত্র এমনই সুকঠিন ও নির্মম ।

কিন্তু মানুষের হতাশার বুঝি কিছুই নেই । কি আর্শ্চয! সীমায়িত বুদ্ধি ও ক্ষমতার অধিকারী হয়েও ওরা স্বপ্ন ও কল্পনায় আমাকেও হার মানায় । সম্ভাবনা নামক আশাকে লালন করে তারা কি দু:সাহসে ছুটে চলে অনিশ্চয়তা পূর্ণ ভবিষ্যতের পানে। জীবন তাদের কাছে নিরন্তর গতির ও সৃজনশীলতার। আমার পক্ষেও তাদের সর্ম্পকে ভবিষ্যৎ বাণী করা দুষ্কর । কারণ স্বাধীন ইচ্ছা নামক জৈবনিক প্রবৃত্তির বলে ওরা নিজেদেরকে চালনা করতে সক্ষম । তাই পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে আমি একদিকে একক ও নিস্ক্রিয় দর্শক মাত্র ।

আপন সৃষ্ট মানুষের মহিমায় বিমুগ্ধ ঈশ্বর স্বর্গের অর্পূব মনোরম ইডেন নামক বাগানে একাকী সহাস্য বদনে ওপরের কথাগুলো ভেবে তারিফ করছিলেন মনুষ্য প্রজাতির । এমন সময় দুজন দায়িত্বশীল দেবদূতের আগমন । তাদের আগমনের হেতু -পৃথিবী থেকে পারলৈাকিক বিচার ময়দানে দেবদূতেরা নিয়ে এসেছে অনেক মানুষের আত্মা কিন্তু বেঁধেছে এক মহাফ্যাঁসাদ । প্রথাগত ধার্মিক ও পাপিষ্ঠদের পরেও কিছু লোক আছে যাদেরকে কোন শ্রেণীতে ফেলা যায় না । তারা পৃথিবীতে প্রচলিত কোন ধর্মীয় বাণীকে ঐশী বলে মানতে পারেনি । পবিত্র ধর্মগ্রন্থ গুলোতে ওরা স্বর্গ, লিঙ্গ, বর্ণ, জাতি ইত্যাদি বর্ণনায় ওরা এমন সব অন্যায় , অসংগতি , বৈষম্য, অযুক্তি ও অসত্য খোঁজে বের করল , যা ঈশ্বরের অস্তিত্বকেও সংশয়ের মুখে ঠেলে দেয় । কিন্তু দেবদূতদের রের্কড বইয়ে দেখা যাচ্ছে – ধর্মগ্রন্থের ঈশ্বরকে আনুগত্য দেখানো ছাড়া ওরা এমন কোন পাপ করেনি যার জন্য নরকেও পাঠানো যায় । উপরন্তু ওরা পৃথিবীর সকল জীব ও জড় সত্ত্বাকে ভালবেসেছিল, তাদের যথাযোগ্য মর্যাদার জন্য করেছিল আজীবন সংগ্রাম। প্রেম, সততা, সত্যবাদিতা, বুদ্ধিমত্তা , জ্ঞানে ও ন্যায়পরায়ণতায় ওরা ছিল প্রথাগত ধার্মিকদের থেকে অনেক উপরে । পরম বিচারক ঈশ্বর বাধ্য হয়ে তাদের জন্য তৈরী করলেন -মর্ত্য। যা পৃথিবীর নামেই এবং পৃথিবীর আদলেই গড়া । তারপর ঈশ্বর ধার্মিকদেরকে স্বর্গে ও পাপিষ্ঠদেরকে নরকে পাঠালেন আপন আপন কর্মফল ভোগ করার জন্য ।

স্বর্গে প্রথম দিনেই উল্লাসিত ধর্মাত্মাদের তরফ থেকে এলো নানান রকমের দাবি -দাওয়া, চাওয়া । অসুন্দররা চাইলো সৌর্ন্দয, বেটেরা লম্বা, বেমানান লম্বারা মানানসয়তা, বোবারা স্বর, কানারা চক্ষু, কালারা শ্রবণেন্দ্রিয় , অতীত যৌবন স্মৃতিতে কাতর বৃদ্ধরা প্রতিশ্র্র্র্রুত অনন্ত যৌবন, অর্থাৎ র্পাথিব সব অপ্রাপ্তি ও আকাঙ্ক্ষা পূরণের আর্জি ধর্মাত্মারা ঈশ্বর সমীপে পেশ করলো। দাবিগুলো যৌক্তিক এবং আবশ্যক পূরণীয় হওয়াতে ঈশ্বর সবাইকে তৎক্ষণাৎ রূপে গুণে সমান করে দিলেন। তাছাড়া পুরুষদের আরো দেওয়া হলো প্রতিশ্রুত একাধিক সুন্দরী শ্রেষ্ঠা নারী, সুখাদ্য-পানীয়সহ অনন্ত জীবন উপভোগের জন্য সকল উপকরণ ।

প্রথম কয়েকদিন মহাত্মাদেরদের শৃংগারের উ: আ: শীৎকার সুমধুর সঙ্গীতের মতো ধ্বণিত হতে থাকল স্বর্গের প্রতিটি কোণে কোণে। অসংখ্য স্বর্গীয় সুন্দরীদের নিয়ে কামসুরায় মত্ত ধার্মিকগণ সারাক্ষণ কামক্রীড়ায় রত, স্বর্গ উদ্যানের বৃক্ষের ডালে, কার্পেটের মতো বিছানো নরম ঘাসে, শূন্যে বিভিন্ন ভঙ্গিতে কামের কতো বিচিত্র ও বৈচিত্র্যময় দৃশ্য । স্বর্গ যেন যৌনতার এক অবাধ লীলাক্ষেত্র । রসিক ও খেয়ালী ঈশ্বর মুচকি হেসে ভাবলেন – “এবার সব ঠিক হতে বাধ্য।”
কিন্তু না , অভিযোগ ও দাবি দাওয়ার বহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগল । সদাপ্রভুর নিজর্নতার শান্তি প্রায় নষ্ট হওয়ার উপক্রম । দায়িত্বশীল দেবদূতদের মাধ্যমে আসা অভিযোগ নামায় চোখ বুলিয়ে ঈশ্বর খানিকক্ষণ কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে রইলেন । একবুক দীর্ঘশ্বাস টেনে বললেন – “হায়রে মানুষ ! শয়তান ও পারেনি এমন সমাধানহীন গোলকধাঁধায় ফেলতে ।

বিশাল ও ব্যাপক অভিযোগ নামার কিয়দংশ নিম্নরূপ :

স্বর্গে কোন প্রার্থনার প্রয়োজন নেই । তাই নেই প্রার্থনার পবিত্র স্থানও। এখানে সংযমের ও কোনো বালাই নেই । স্বর্গ ভূমিতে এসে হঠাৎ অকর্মণ্য হয়ে পড়া ধর্মাত্মারা সারাক্ষণ যৌন ক্রিয়া ও ভাল খাদ্যদ্রব্য ভক্ষণে ব্যস্ত থাকে । এতদিনকার পৃথিবীতে কৃত কঠোর সংযম ও সাধনার ফল অল্প সময়ে উসুল করার জন্য তারা উন্মত্ত, উন্মুখ ।

কোনো কোনো ধর্মাত্মার পৃথিবী থেকে নিয়ে আসা অদ্ভুত বাতিক – ভাল খাদ্য দ্রব্য ভক্ষণের পরে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেওয়া তাদের চিরকালীন অভ্যাস। অন্যথায় শান্তি ও স্বস্তি যেন সুদূর পরাহত । কিন্তু ধর্মাত্মাদের কে বোঝাবে স্বর্গ প্রকৃতি জগৎ নয় , তাই প্রাকৃতিক ব্যাপার বলেও স্বর্গে কিছুই নেই। খাবার পরে হুম করে এক ঢেকুঁঢ়ে সব শেষ ! আবার চাইলে বীরদর্পে অংশ নিতে পারে রসনার উৎসবে।
মানব জাতি সমতায় বিশ্বাসী নয় । একে অপরকে আক্রমণ, ল্যাঙ মেরে পেছনে ফেলার চেষ্টা ওদের মজ্জাগত স্বভাব । স্বর্গেও তার ব্যতিক্রম হলোনা । একজন আরেক জনের নারী নিয়ে কাড়াকাড়ি , ফল স্বরূপ মারামারি ,ঝগড়া বিবাদ -স্বর্গকে কলুষিত করে ফেললো। স্বর্গ যেন ফিরে গেল দেবদূত ও শয়তানদের যুদ্ধের সময়কালে। কিন্তু স্বীয় প্রতিশ্রূতিতে আবদ্ধ ঈশ্বর আজ চরম অসহায় ।

আমার দেব সেনাদের জন্য ঘটনাগুলো অরো ভয়ংকর ও অবমাননাকর । পৃথিবীতে অতি সংযমের সাথে আজীবন সাধনার ফলশ্রুতিতে ধর্মাত্মাদের এই স্বর্গ প্রাপ্তি । এতোদিনকার শৃঙ্খলিত সুপ্ত কামনা-বাসনা স্বর্গে এসে মুক্তির আনন্দে দিশেহারা, উন্মাদ। কারোর কারোর অদ্ভুত সাধ – বৈচিত্র্য পরখ করার । সুন্দরী শ্রেষ্ঠা স্বর্গীয় নারীরা আর তাদের আকর্ষণ করে না । তাই স্বর্গে কতর্ব্যরত সুন্দর দেবদূতদের উপর ওরা সদল বলে মাঝে মাঝে চড়াও হয় । হায়রে বৈচিত্র্য পিয়াসী কামুকের দল ! দেবদূতরা নারী পুরুষ কোনটাই নয়, ওরা নিচ্ছিদ্র একথা তাদের কে বোঝাবে ।

ঈশ্বর নারীদের অভিযোগ নামায়ও চোখ বুলালেন । ছোট , সংক্ষিপ্ত । স্বর্গে থেকেও অনেকে স্বামী বিরহে কাতর । অনেকের স্বামী কর্মফলের জন্য নরকে শাস্তিপ্রাপ্ত , আবার অনেকের স্বামী স্বর্গ নারীতে আসক্ত – তাদের পানে তাকানোর ফুসরত নেই । অথচ পৃথিবীতে ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে তারা পুরুষদের চেয়ে কোন অংশে কম করেনি । সবচেয়ে বড় কথা মানব জাতির প্রবাহকে ধারাবাহিক রক্ষার মহান দায়িত্ব তারাই পালন করে এসেছে । কিন্তু স্বর্গে প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এই বৈষম্য ও অবহেলা তাদের পছন্দ হলোনা । অতি বিল্পবী কেউ কেউ পুরুষদের সমান সুযোগ সুবিধা চেয়ে বসল , পুরুষদের যথেচ্ছাচার ব্যভিচারের প্রতিবাদস্বরূপ কেউ কেউ স্বর্গের ঘোড়া , কুকুর , ইত্যাকার নিম্ন প্রাণীকে তাদের কামসঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করল এবং প্রবল প্রতাপশালী পুরুষদের বিপক্ষে এই রূপ অব্যর্থ অস্ত্র প্রয়োগ করে তাদেরকে চরম অপমানিত ও নাজেহাল করে ছাড়ল ।

এরপর ঈশ্বর নারী পুরুষ উভয়ের তরফ থেকে আসা অভিযোগ নামায় চোখ বুলালেন –- ভয়ংকর ও প্রতিকার বিহীন । পৃথিবীতে সব লোভনীয় হাতছানিকে তুচ্ছ করে, সকল প্রতিকুলতার সম্মুখে পাথরের মতো বুক পেতে দিয়ে ওরা ধর্ম পালন করেছে । পরমাত্মার সাথে মিলনের জন্য সর্বদা জ্বালিয়ে রেখেছে বিচ্ছেদের বিরহ যন্ত্রণা , হাহাকার , কান্না । ফলস্বরূপ এই স্বর্গপ্রাপ্তি । কিন্তু মানুষের অনন্ত আকাঙ্খা ও অতৃপ্তির কাছে স্বর্গও কিছুদিন পরে পানসে হয়ে গেল । ওরা এখন চরমপূর্ণতার অবসাদে বিপর্যস্ত , ক্লান্ত , স্থবিরতার ভাবে দিশেহারা , মুহ্যমান । স্বর্গের অপরির্বতনীয় চিরন্তন সৌন্দর্য , অপার প্রাচুর্যতা , সৃজনহীন বন্ধ্যাত্বতা – তাদের কাছে মনে হলো দু:সহ , কৃত্রিম ও প্রতারণাময় । প্রেম ভালোবাসা , স্নেহ-মমতা , পৃথিবীতে অনিশ্চয়তাময় অনাগতের প্রতিটি পদক্ষেপে অস্তিত্বের উত্তেজনা , শিশুর কান্না , প্রিয়ের কাপাঁ কাপাঁ কন্ঠে ভালবাসার অমিয়বাণী , প্রতিনিয়ত সংগ্রাম ও বিরামহীন গতি অর্থাৎ ক্ষণস্থায়ী সব র্পাথিব বৈশিষ্ট্যের জন্য স্বর্গের প্রতিটি কোণে জেগে উঠেছে দীর্ঘশ্বাস ও কান্নার রোল ।

অভিযোগগুলো পড়ে ঈশ্বর বিমর্ষ ও চিন্তিত মুখে নত রইলেন কিছুক্ষণ । মানুষের অন্তহীন অতৃপ্তি ও আকাঙ্খার কাছে সবকিছুর আবেদন ক্ষণস্থায়ী ও আপেক্ষিক । তাদের কাছে আজকে যা স্বপ্ন, মুক্তি, স্বাধীনতা ও কাঙ্খিত আগামী কালে তা যথাক্রমে দু:স্বপ্ন, শৃঙ্খলের দু:সহ কাটা ও প্রবঞ্চনাময় । তবুও ঈশ্বর মানব জাতিকে পারলেন না দোষারূপ করতে । কারণ এই অতৃপ্তি ও অপূর্ণতার আকাঙ্খাও তার থেকে উদ্ভুত। একদিন শয়তানের প্রভাবে সৃষ্ট অপূর্ণতার আকাঙ্খা থেকে তিনিইতো মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন। আর অন্তহীন সৃজনশীলতার মধ্যেইতো তার অস্তিত্বের মূর্ত প্রকাশ । স্বর্গের মৃতবৎ বন্ধ্যাত্বে ও গতিহীনতায় মানুষের উন্মত্ততা ও বিকৃতি ঈশ্বর বুঝতে পারলেন । কিন্তু তিনি আজ নিরূপায় । এরকম সমস্যা উদ্ভবের সম্ভাব্যতা ও সমাধান নিয়ে তো তিনি কখনো কল্পনা করেননি ।

ঈশ্বর এবার মনস্থির করলেন দেবদূতবিহীন অবহেলিত মর্ত্যের অবস্থা কেমন ঘুরে দেখার জন্য । সরেজমিনে এসে ঈশ্বর তাজ্জ্বব বনে গেলেন, অস্ফুটে মুখ থেকে বেরোল আনন্দের ধ্বনি -“ওয়াহ! অদ্ভুত, কি আর্শ্চয ।” মর্ত্যে দেখলেন কোনো ঝগড়াবিবাদ-মারামারি নেই, সবার চাহিদাও খুবই সীমিত । কঠোর কোন নিয়মকানুন নেই, যার যার মতো সুন্দর এক শৃঙ্খলায় চলছে সহজ সরল এই ভদ্র মানুষগুলো । ঈশ্বরের আগমন বার্তা পেয়ে সবাই সারিবদ্ধভাবে জড়ো হলো, তাকিয়ে থাকল প্রেমপূর্ণ অপলক দৃষ্টিতে, পৃথিবীতে যেমনটি ওরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে উপভোগ করতো , প্রেমাস্পদকে ভালবাসতো । ধার্মিকদের মতো হুমড়ি খেয়ে চুমু খাওয়ার প্রতিদ্বন্ধিতায় নামেনি কেউ। ওদের ভালবাসা ও ভক্তি এমনই দৃঢ়, অটল, ও গভীর যে অতিশায়োতি ও কাউকে দেখানোর কোন প্রয়োজন পড়ে না। নিত্যনতুন সৃজনশীলতায় ওরা মর্ত্যে বানিয়েছে পৃথিবীর মতো ফসল ফলানোর উপযোগী মাটি , স্বর্গের মতো বন্ধ্যাত্ব ও মৃতবৎ দু:সহ স্থবিরতার চিহ্নমাত্র নেই । আর্শ্চয প্রতিভা ও প্রাজ্ঞতায় এখানকার জীবন সতত চঞ্চল ও গতিময় । এখানে শিশদের জন্ম হয় নরনারীর ভালবাসার গর্ভ থেকে , গুটি গুটি পায়ে ওরা ওঠোনে খেলে বেড়ায়, কল কল হাসিতে আলোকিত করে নিজেদের চারপাশ – যে দৃশ্যের সৌন্দর্য তুলনা বিশ্ব ব্রক্ষান্ডে কোথাও নেই । বৃদ্ধরাও ভয়হীন চিত্তে মেনে নেয় মৃত্যের নিয়তিকে । জন্ম-মৃত্যু-সৃষ্টি ও ধ্বংসের সৃজনশীল অন্তহীন খেলায় মত্ত পুরো জগতে এভাবে স্পন্দিত হচ্ছে প্রাণের মহিমা । ঈশ্বর অভিভূত হলেন , নিজেকে দেখতে পেলেন এখানকার সব মানুষ ও সৃষ্টির মধ্যে । সৃজনশীলতা ছাড়া তো স্রষ্টার কোন মহিমা কিংবা অস্তিত্ব নেই । স্বর্গের ধর্মাত্মাদের দ্বারা লুন্ঠিত শান্তি ও পবিত্রতাহীন পরিবেশে আর নয় । দক্ষিণহস্ত উত্তোলন পূর্বক এতদিনের প্রিয় দেবদূতদের ও প্রিয়তম স্বর্গকে ব্যথিত চিত্তে জানালেন – “ বিদায় ………………….. । ”