একটি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে আমার জন্ম। শৈশব থেকেই নানাবিধ ধর্মীয় , সামাজিক ও পারিবারিক অত্যন্ত কঠোর কিছু নিয়ম-কানুন ও আচার-আচরণের মধ্যে আমাকে দিনাতিপাত করতে হয়েছে। তারমধ্যে ধর্মীয় রীতিনীতিগুলোই ছিল কঠোরতম। আমার বাবা-মা ধর্মপ্রাণ মুসলিম। বাবা নিয়মিত এবাদত করতেন না। কিন্তু ধর্মীয় আইন-কানুন আমার উপর কঠিনভাবে প্রয়োগ করতেন। মা অতিরিক্ত ধর্মপ্রাণ। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সাথে আরো কয়েক ওয়াক্ত যোগ করে পড়েন। রোজা ৩০টার সাথে আরো বেশ কয়েকটা যোগ করেন। নিয়মিত কোরান তেলাওয়াত ত আছেই। ওঁরা দুজনই খুব কড়াকড়িভাবে ধর্মীয় নিয়মনিষ্ঠ হলেও বিদ্যাশিক্ষার বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। চাইতেন আমারা ভাই-বোনেরা যাতে অনেক অনেক পড়াশোনা শিখি। ছোটবেলা থেকেই আমার উপর কিছু আইন পাশ করানো হয়েছিল। যেমন; ১। উচ্চৈঃস্বরে হাসা বা কথা বলা যাবেনা। ২। খেলাধুলা করা যাবেনা ৩। বিপরীত লিঙ্গের কারো দিকে তাকানো যাবেনা ও তাদের সাথে কথা বলা যাবেনা। ৪। এবাদত বন্দেগী করত হবে নিয়মিত ৫। ভূপৃষ্ঠের দিকে তাকিয়ে পথ চলতে হবে। ৬। ভুলেও মনে কখনো প্রেম ভালবাসা উঁকিঝুঁকি মারতে পারবেনা। ইত্যাদি। কারণ এসব ইসলাম বিরোধী নিষিদ্ধ পাপকর্ম এবং বিশেষ করে মেয়েদের ওগুলো করতে নেই। আমার স্বভাব-চরিত্র ও জীবনযাত্রা ধর্মীয় বিবেচনায় নিষ্কলুষ রাখতে আমার বাবা-মা সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। আমাকে কীকরে সম্পূর্ণরূপে ইসলামজীবী করে তোলা যায় সেজন্য নানারূপ উপায় ও পদ্ধতি উদ্ভাবনে চিন্তিত থাকতেন। যেমন আমি স্কুল থেকে ফিরে এলে জিজ্ঞেস করা হত, ভূপৃষ্ঠ ব্যতীত অন্য কোন দিকে তাকিয়েছিস, কোন ছেলের সাথে কথা বলেছিস, কোন ছেলে তোর দিকে তাকিয়েছে? মাঝে মাঝে আমার পড়ার টেবিল ও বইখাতার উপর তল্লাসির চিরুনি অভিযান চালানো হত। দৈবাৎ যদি কোন কিশোরের লেখা পত্র টত্র পাওয়া যায়! অবশ্য একাজে ওঁরা সর্বদা নিরাশ হতেননা কালে ভাদ্রে যে কোন ছেলের লেখা পত্র পাওয়া যেতনা তা কিন্তু নয়। তারপর শুরু হত ভর্ৎসনা, বেধড়ক মারধোরের কথা ত বলাই বাহুল্য।

আমি স্বাভাবিকভাবেই জন্মসূত্রে মুসলিম ছিলাম। মানে বাবা-মা কর্তৃক মগজধোলাইকৃত ও বাধ্যতামূলক মুসলিম। মা দিবানিশি এবাদত নিয়েই থাকতেন। যখন-তখন প্রাসঙ্গিক ও অপ্রাসঙ্গিকভাবে ধর্মীয় ঔচিত্য-অনৌচিত্যের কথা বলতেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এরকম নূরানি বেষ্টনীর ভেতরে থেকেও আমার মনের গহীনে ইসলামী নূর তেমন একটা প্রবেশ করতে পারেনি। বিশ্বাসী ত ছিলাম কিন্তু ধর্ম-কর্ম মোটেই করতে চাইতাম না। মা আমায় আরবী পড়তে বলতেন। আর আমি ছিপারা সামনে নিয়ে হাউ মাউ কাউ করে কাঁদতে থাকতাম। কাজেই নিয়মিতভাবেই আমার উপর হালকা, মাঝারি ও তীব্র বেগে উত্তম-মধ্যম চলতে থাকত এবং বিভিন্ন ইহলৌকিক ও পারলৌকিক ভর্ৎসনা বর্ষণও চলত। যেমন; মরলে কোথায় যাবি, অনন্ত অনলে কীকরে জ্বলবি, যে পরকালে নিশ্চিত দোজখে যাবে ইহকালের তার কী মূল্য, নিজে দোজখে যাবি আমাদেরও পাঠাবি নাকি প্রভৃতি। আমি শেষরাতে অতি আরামের ঘুম হারাম করে কখনো নামাজ পড়তে শয্যাত্যাগ করতাম না। তাই ধর্মীয় উপদ্রবের মধ্য দিয়েই দিনের শুরু হত। একইভাবে দিনের শেষ হত। কারণ আমি এশার নামাজও পড়তাম না। আমি শুয়ে শুয়ে দোজখের ভয়াবহ ছবি কল্পনা করে কাঁদতাম তবুও নামাজ পড়তাম না।

নামাজ একেবারেই যে পড়তাম না তা কিন্তু নয়। মাঝে মাঝে পড়তাম। কখনো দোযখের ভয়ে, কখনো মারের চোটে বাধ্য হয়ে পড়তাম। কখনো পড়ার ভান করতাম। তবে বেশির ভাগ সময়ই পড়তাম না। আমার আস্তিক-জীবনে আমি কোনদিন ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়িনি। বড়জোড় ২-৩ ওয়াক্ত। রোজা রাখতাম কয়েকটা। আমি বেনামাজি হলেও আল্লার কাছে মনে মনে সারাদিন প্রার্থনা করতাম। আল্লা এটা দাও, ওটা দিওনা। এটা কর, ওটা করোনা। এটা যেন হয়, ওটা যেন না হয় ইত্যাদি। আমার কাছে ১০-২০ টাকা যা-ই থাকত তার সিংহভাগই সওয়াব বা কোন কাজ হাসিলের উদ্দেশ্যে মসজিদ বা মাদ্রাসায় দিয়ে দিতাম। এবং আল্লাকে প্রলোভন দেখাতাম যে,”আল্লাহ যদি অমুক কাজটা করে দাও তাহলে কষ্ট করে জোগাড় করে আরো ১০ টাকা দেব। কাজ হলে মনে করতাম ঘুষের সুফল। আর না হলে মনে করতাম, এত কম টাকায় কীকরে হবে। স্কুলজীবনে আমার গণিতাতঙ্ক ছিল। অংক বই দেখামাত্র ভয়ে শিউড়ে উঠতাম। বাসায় কখনো অংক করতাম না। সযতনে বইটি লুকিয়ে রাখতাম যাতে ওটা দেখে ভয় পেতে না হয়। অংক পরীক্ষার আগে আল্লার দরবারে খাস দিলে প্রার্থনা করতাম যাতে অকস্মাৎ ঝড় তুফান এসে সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়, যাতে অংক পরীক্ষা বাতিল হয়ে যায়। প্রার্থনা কখনো কবুল হয়নি। কারণ আমার অংক পরীক্ষা কখনো বাতিল হয়নি। অনন্যোপায় হয়ে দুরুদুরু বক্ষে, কম্পিত হস্তে পরীক্ষা দিতে যেতাম। যতটুকু পারতাম ভয়ের চোটে তাও ভুল করে দিয় আসতাম। অন্যান্য বিষয়ে মোটামুটি ভাল নম্বর পেতাম। অংকে পেতাম ৩৫-৪০। আমার স্যাররা বলতেন, অংকে লেটারমার্ক। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক লুৎফর কবীর স্যার তাঁর একনিষ্ঠ পরিশ্রমে গণিতশাস্রকে আমার কাছে কিছুটা সহজবোধ্য ক’রে তুলেছিলেন। আমার গণিতভীতি কিঞ্চিত কমিয়ে দিয়েছিলেন। অংক করতে বসে বিদঘুটে বিদঘুটে প্রশ্ন করে সর্বদা স্যারকে অস্থির করে তুলতাম। তিনি কখনো বিরক্তি প্রকাশ করতেন না। আমার সব অর্থহীন বিরক্তিকর প্রশ্নের জবাব দিতেন চরম ধর্য্যের সাথে। আজ আমার এই সামান্য লেখার মাধ্যমে স্যারকে আন্তরিক শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। জানিনা এই লেখা কভু উনার দৃষ্টি গোচর হবে কিনা।

এভাবে কেটে গেল অনেক বছর। আমার মেট্রিক পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এল। আমার এখনো ছিপারা শেষ হলনা। পরীক্ষার আগে পাঠ্য বইয়ের চেয়ে বেশি দোয়াদরুদ পড়েছিলাম। যাতে সুস্থ শরীরে সহিসালামতে পরীক্ষা দিতে পাড়ি। আমার একটা অসুখ ছিল। আল্লার দরবারে বেশি করে প্রার্থনা করেছিলাম যাতে পরীক্ষার সময় আমি সুস্থ থাকি। আমার মাও রাতের ঘুম বিসর্জন দিয়ে বিভিন্ন রকমের এবাদত করতে লাগলেন। মসজিদে দোয়া ও মিলাদ পড়ালেন, আল্লার ঘরে কিছু টাকা দিয়ে আল্লাকে ঘুষ দিলেন। আমাদের সমবেত তোষামোদ ও ঘুষ তিনি গ্রহণ করলেন ঠিকই (কারণ সেগুলো আজ পর্যন্ত ফেরত আসেনি) তবে বিনিময়ে কাজের কাজ কিছুই হলনা। আমি প্রচণ্ডভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমি পরীক্ষার চিন্তায় ছটফট করতে করতে আরো বেশি অসুস্থ হলাম। কোন পড়াশোনা করতে পারলাম না। কোন রিভিশন করতে পারলাম না। তবুও বিসমিল্লাহ বলে কোন রকমে পরীক্ষা দিয়ে দিলাম। আমার পরীক্ষা শেষ হল। কিন্তু হায় তখনো আমার ছিপারা খতম হলনা!

এবার বাবা-মা আমায় নিয়ে কোমর বেঁধে লাগলেন নূরানি শিক্ষা দিতে। প্রতিদিনই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে লাগল। ছিপারা পড়তে বসে মুখ গোমরা করে চুপ করে থাকা, কান্নাকাটি করা, তারপরে চুলটানা-কানটানা-গালটানা-কাঠির বাড়ি খাওয়া; আরো চড়া গলায় কান্না। এভাবে কয়েক ঘণ্টা। আমাদের বাড়িতে কেউ বেড়াতে আসলে মাকে জিজ্ঞেস করত,’ঝুমু কোরান খতম কয়বার করেছে?’ মা ইতস্তত করে আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে, দাঁত কড়মড় করে বলতেন,’ করেছে ত কয়েকবার।‘ আমি সাময়িকভাবে খুব লজ্জা পেতাম। নিজের উপর ধিক্কার জন্মাত। মনে মনে পণ করতাম,” যেকোন ভাবেই কোরান খতম করবই করবই।“ কিছুক্ষণ পরেই লজ্জা ও পণ উবে যেত। বাবা-মা আদা-জল খেয়ে লেগে রইলেন। অবিরত বলে যাচ্ছেন, “নামাজ পড় কোরান পড়। নাহলে সমাজে মুখ দেখানো যাবেনা। তোমার বিয়ে শাদী হবেনা। আর বলাই বাহুল্য যে নরকেও জায়গা হবেনা।“ আমি শুধু বলতাম, কালকে থেকে শুরু করব ইনশাল্লাহ। এদিকে লুকিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের উপন্যাস পড়তাম। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক ভয়-ভীতি প্রদর্শনে তেমন কার্যকরী ফল দেখা যাচ্ছিলোনা দেখে বাবা খুবই মর্মাহত হয়ে ঘোষণা দিলেন, “ তোমাকে নিয়ে আর পারছিনা। তোমাকে দ্বীনী শিক্ষা প্রদানের নিমিত্তে মৌলবি নিযুক্ত করা হয়েছে।“ আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। পরদিন বিকেলে দেখলাম চিবুকে স্বল্পসংখ্যক দাড়িযুক্ত, গোল পাঞ্জাবী পরিহিত এক মৌলবি সত্যিই আমাকে পড়াতে হাজির। আমি ওজু করে নাক পর্যন্ত ঘোমটা টেনে তার সামনে ছিপারা নিয়ে হাজির হলাম। অজানা কারণে অবিলম্বে উচ্চৈঃস্বরে কান্না জুড়ে দিলাম। মৌলবি কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও দিশেহারা। বাবা-মা লজ্জিত ও দিশেহারা। আমার কান্না শুনে আমাদের প্রতিবেশীরা চারদিক হতে একে অপরকে ডেকে জনস্রোতের মত ছুটে এসে জানালায় উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল এবং এক অভূতপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করতে লাগল। ওরা কানাকানি করতে লাগল, ছি ঝুমু এখনো কোরান খতম করেনি! তাদের দেখে আমার কান্নার স্বর সপ্তম ছেড়ে নবম দশমে পৌঁছে গেল। বয়েসে আমার চেয়ে অনেক ছোট যারা তারাও কোনার খতম করেছে আমি করতে পারিনি। এই লজ্জা রাখি কোথায়? এই লজ্জাজনক গোপন ব্যাপারটি অনেকেই জানত না। আজকে সবাই জেনে গেল! জনসমাজে আমার এত অপমান! মনে মনে বলতে লাগলাম ধরণী দ্বিধা হও। মৌলবি আমাকে কয়েকটা সুরা জিজ্ঞেস করলেন। আমি দুই একটা পেরেছিলাম, বেশির ভাগই পারিনি। বাবামা লজ্জায় ভূমিসাৎ হলেন এবং বেদ্বীন কন্যার কারণে আখেরাতে অনন্ত দোজখবাস সম্বন্ধে সুনিশ্চিত হলেন। মা কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন,’ আলেমের ঘরে জালেম।‘ বাবা বললেন, ওকে কোন নেককার দ্বীনী ছেলের হাতে তুলে দিতে হবে। আমরা ত ব্যর্থ।‘ মৌলবি বাবা-মাকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন, আমাদের নবিজী ৪০ বছরে নবুয়ত পেয়েছেন। বৃদ্ধ বয়েসে ইসলাম গ্রহণ করেও অনেকে সুরা কেরাত শিখে আল্লার পথে চলছে। আল্লার রহমতের কোন শেষ নেই।“ আমাকে পড়াতে তিনি কয়েকদিন এসেছিলেন। আমার অনাগ্রহ ও কান্নাকাটি দেখে ব্যর্থমনোরথ হয়ে শেষ পর্যন্ত আশা বন্ধ করলেন। আমাকে প্রকাশ্যে ও আড়ালে অনেকেই টিটকারি করতে লাগল। মৌলবি বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে দ্বীনী বাবা-মায়ের বেদ্বীন কন্যার কুৎসা রটিয়ে সওয়াব হাসিল করতে লাগলেন। ক’টি মাস কাটল চরম দুর্বিসহ ধর্মীয় আজাবে। তারপরে আমার পরীক্ষার ফলাফল বের হল। আমি কলেজে ভর্তি হলাম ও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমার গ্লানিবোধের পরেও নিজের দ্বীনী অবস্থার উন্নতি সাধনের কোন চেষ্টাই করলাম না। ১৫-১৬ বছরের একটি মেয়ে ছিপারাও শেষ করেনি এটা ধার্মিকদের কাছে হাস্যকর ও লজ্জাজনক মনে হবে। আমারও তাই মনে হত। এখন মনে হয় না পড়ে ভাল করেছিলাম। শুধু শুধু দুর্বোধ্য কিছু বুলি আউড়ে সময় নষ্ট।

শৈশবে ইসলামী পরিমণ্ডলে আবদ্ধ ছিলাম। আস্তিক ছিলাম। আমার এক নাস্তিক ফুপাত ভাই বলত, “আল্লা মানুষকে বানায়নি। মানুষই আল্লাকে বানিয়েছে।“ আমি কানে আঙুল দিয়ে সেখান থেকে দৌড়ে পালাতাম।ধার্মিক মানুষদেরকে ফুলের মত পবিত্র মনে করতাম। যারা ধর্ম-কর্ম কম করে তাদের মন্দ মনে করতাম। তারপরেও ধর্ম পালনে আমার এত অনীহা ছিল কেন জানিনা। আরবী ভাষায় আজ পর্যন্ত আমার কোরান খতম হয়নি। বড় হয়ে নিজের ভাষায় যখন পড়লাম তখন আজন্মলালিত ধর্ম ছাড়তে বাধ্য হলাম। আমার ধর্ম ছেড়ে যুক্তিবাদী নাস্তিক হবার ব্যাপারে একমাত্র অবদান হচ্ছে নবি মুহাম্মদের। তার রচিত কোরান যদি এতটা জঘন্যতম ও বর্বরতম না হত তাহলে হয়ত আমার ধর্মবিশ্বাস এত তাড়াতাড়ি উবে যেতনা। ফরিদ দাদা যেমন বলেছেন, ধর্ম ছাড়তে উনাকে বিজ্ঞান, দর্শন পড়তে হয়নি। তেমনি আমাকেও পড়তে হয়নি বিজ্ঞান, দর্শন বা নাস্তিকতার জ্ঞানগর্ভ কোন বই বা আস্তিকতার অসাড়তা সম্পর্কে কোন কিছুই। কোরানের কয়েক পৃষ্ঠা পড়েই বুঝে গিয়েছিলাম এসব বানোয়াট। মুহাম্মদের প্রতি বেশিরভাগ নাস্তিকই ঘৃণা প্রদর্শন করে থাকেন। আমিও করি। কিন্তু আমার নাস্তিক হবার ব্যাপারে যেহেতু পুরো কৃতিত্বটাই তার সেহেতু একটা ধন্যবাদ অন্তত আমার কাছ থেকে তার প্রাপ্য আছে। কী বলেন পাঠক?

কোরানের কয়েক লাইন পড়েই আমার মনে সন্দেহ ও প্রশ্ন দানা বেঁধে উঠেছিল। কিন্তু এ নিয়ে কার সাথে কথা বলব, কাকে প্রশ্ন করব। যার সাথেই কথা বলতে চাই সে-ই আসতাগফেরুল্লাহ পড়তে শুরু করে, আর বলে, এসব বাজে কথা কোরানে নেই এগুলো তোমার বানানো কথা। মনে অশান্তি নিয়ে প্রশ্নের হিমালয় নিয়ে পড়া বন্ধ করে দিলাম। আবার কৌতূহলবশতঃ দুই এক লাইন পড়ি। প্রশ্নের হিমালয়ের উচ্চতা বাড়তে থাকে, অস্থিরতা আরো বেশি। আবার পড়া বন্ধ। এভাবে দীর্ঘ সাত বছর লেগে গিয়েছিল আমার কোরান শেষ করতে। তারপর ত পড়েছি অসংখ্যবার। এই মূল্যহীন, বর্বর বইটি পড়ে ও একে নিয়ে ভেবে ভেবে আমি যে সময় নষ্ট করেছি সে সময়ে অন্তত এক’শ ভাল বই পড়তে পারতাম। কোরান শেষ করে যখন আমি ক্ষোভ ও প্রশ্ন ভারাক্রান্ত তখন আমার ছোট ভাইয়ের কাছে সন্ধান পেলাম মুক্তমনার। দিনরাত নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে মুক্তমনা পড়তে লাগলাম। এর সাথে একাত্ন হয়ে গেলাম। এক সময় স্বপ্ন জাগল মনে, ইস আমিও যদি মুক্তমনায় লিখতে পারতাম! একদিন সে অসম্ভব স্বপ্ন পূরণ হল। এখন মুক্তমনা আমার আশ্রয়, আমার প্লাটফর্ম। এখানে আমি মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি, আলোচনা করতে পারি, প্রশ্ন করতে পারি, মনের ভার লাঘব করতে পারি। মুক্তমনা থেকে আমি পেয়েছি অনেক, শিখেছি অনেক। মুক্তমনা আমার নাস্তিকতাকে যুক্তিপূর্ণ করেছে, সমৃদ্ধ করেছে। তাই মুহাম্মদের সাথে সাথে মুক্তমনাকেও অজস্র ধন্যবাদ। ধন্যবাদ অভিদাকে এ রকম অসাধারণ একটি ক্ষেত্র তৈরির জন্যে।

কাটায়ে উঠেছি ধর্ম আফিম নেশা
ধ্বংস করেছি ধর্ম যাজকী পেশা
ভাঙ্গি মন্দির ভাঙ্গি মসজিদ
ভাঙ্গিয়া গীর্জা গাহি সংগীত। কাজী নজরুল ইসলাম

মানুষ সকল অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার ভেঙে বেরিয়ে আসুক আলোর পথে। সৎ, সুবিবেচক ও মুক্তমনের মানুষ গ’ড়ে উঠুক। মুক্তমনা প্রসারিত হোক নিখিলে। বেঁচে থাকুক অনন্তকাল, আমাদের পরে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মে; তারও পরে ,তারও পরে, তারও পরে—————