গল্পের ভিতরে গল্প (উৎসর্গ, রাজেশ তালুকদার, একজন সুন্দর মনের ভাল মানুষকে)

আকাশ মালিক

ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে সর্বোচ্চ মার্ক পেয়ে ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকারিণী জিনাতারা বেগম বাৎসরিক পরীক্ষার পর অষ্টম শ্রেণীতে ঢোকার দিন অপূর্ব এক পোশাক পরিধান করে স্কুলে আসলো। ছাত্র-ছাত্রীরা কেউ আড়চোখে তাকালো, কেউ মুখ বন্ধ করে হাসলো। জিনাতারা এমনিতেই ফর্সা রঙ্গের, তার উপর চোখে আধুনিক ফ্রেইমের চশমা। এবার গোলাকার মুখমন্ডল আবৃত হয়েছে গোলাপী কালারের সিল্কী কাপড়ের হিজাব দিয়ে। গলা থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত নাইট গাউনের মতো হালকা বেগুনী রঙের বিলেতি পিচ্ছিল কাপড়ের তৈরী গায়ের বসন। চৈতালি সমীরণ দুষ্টুমী করে, ধানক্ষেতের কচি পাতার দোলা জাগায় তার পিঠের উপর। সে মৃদু বাতাসের ঢেউ টের পায় তার নিতম্বে। জিনাতারার ভাল লাগে। আইডিয়াটা করেছিলেন তার দাদা কাজী আলমদর আলী সাহেব, যে দিন তাকে অত্র স্কুলের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান বানানো হয়। বিগত দশ বছর যাবত এই স্কুলে কোন জাতীয় দিবস উদযাপন হয়না, ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২৬শে মার্চ এবং ১৬ ডিসেম্বর স্কুল বন্ধ থাকে। স্কুলটির নাম শ্রী ভারত চন্দ্র দ্বি-পাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয়। লক্ষীপুর গ্রামের এই স্কুলটি এক কালে প্রচুর সুনাম অর্জন করেছিল। দূরের গ্রামের মানুষেরা এই গ্রামকে গুণীদের গাঁও বলে ডাকতো।

বাৎসরিক পরীক্ষার পর আজ স্কুলের প্রথম দিন। ছাত্র-ছাত্রীরা সকল আসেনি, দু-একজন শিক্ষকও অনুপস্থিত। এ দিকে পরীক্ষা হলকে পুনরায় ক্লাসে বিভক্ত করা হয়নি, বেঞ্চ টেবিল জায়গামত আসেনি, সুতরাং প্রধান শিক্ষক ঘোষণা দিলেন, ক্লাশের দরকার নেই, পরীক্ষা হল যেভাবে আছে সে ভাবেই থাক। সেখানে মিটিংয়ের আয়োজন করা হলো। সহকারী শিক্ষকগণ প্রধান স্যারের নির্দেশানুযায়ী একে একে তাদের বক্তৃতায় ব্যাখ্যা করলেন- ‘বিদ্যা অমূল্য ধন’, ‘শিক্ষাই জাতীর মেরুদন্ড’, ‘পরিশ্রম উন্নতির সোপান’ ইত্যাদি। প্রধান শিক্ষক তার মিটিং সমাপণী ভাষণের পূর্বে জিনাতারাকে শিক্ষকদের পাশে এসে দাঁড়াতে আদেশ দিলেন। তিনি জিনাতারার মাথায় হাত রেখে ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্য করে বললেন-‘এর নাম কী জানো’? এক সাথে কয়েকজন উচ্চস্বরে উত্তর দিলো ‘জ্বীন্নাঁতাঁরা’। স্যার বললেন- ‘হ্যাঁ, জিনাতারা। রেজিষ্টারিতে তার নাম জিনাতারা থাকবে, কিন্তু আজ থেকে আমি তার নাম দিলাম ‘মুক্তিকন্যা’ এটা হবে তার ডাকনাম’। স্যার আবার প্রশ্ন করলেন-‘মুক্তিকন্যা’ কেন নাম দিলাম তোমরা কি কেউ ধরতে পেরেছো? কেউ উত্তর দেয়না। সকলকে নিশ্চুপ দেখে, তিন বছর যাবত ক্লাস সিক্সে পড়ে থাকা আবুল পরম দায়ীত্বটা নিল। গ্রীবা উঁচু করে একহাত উপরে তুলে বললো- আমি ধরতে পেরেছি স্যার। স্যার বললেন- কী বুঝেছো, বলো দেখি তার নাম কেন দিলাম ‘মুক্তিকন্যা’? আবুল উত্তর দিলো- ‘ওর বাপ মনে হয় মুক্তিযোদ্ধা’। হলের ভিতর হাসির মাতম শুরু হয়ে গেল। শিক্ষকরা মুখ বন্ধই করতে পারছেন না। ছাত্র-ছাত্রীরা বোকা বনে গেল, বিষয়টা কী? তারা কোন সমাধান বের করতে না পেরে আবুলকে দোষারুপ আর মৃদু-মন্দ গালাগালি করে চুপ হয়ে গেল।

দিনে দিনে শ্রী ভারত চন্দ্র দ্বি-পাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের গা থেকে লাল-সবুজের ইউনিফর্ম উধাও হতে থাকলো। মায়ের হাতের নিপুণ কারিগরির নিদর্শন কালো চুলের বেণীগুলো হিজাবের শক্ত বন্ধনে অবরোদ্ধ হলো। ক্রমে ক্রমে হিজাবের সংখ্যা বাড়তে থাকলো আর এর সাথে পাল্লা দিয়ে এক নতুন উপদ্রব জন্ম নিলো। ইভ-টিজিং। নবম-দশম শ্রেণীর ছাত্রীদের যারা পেটিকোট বা ছায়ার মতো লম্বা স্কার্ট পরে আসতো, তারা একটু বেশী অসুবিধেয় পড়লো। ছেলেরা হিজাবপরা মেয়েদের সামনের দিকে তাকায়না, পেছনের দিকেই তাদের ইন্টারেষ্ট বেশী। স্কুলে আসার পথে ভোরের সূর্যকীরণ যখন মেয়েদের সিল্কী কাপড়ে লুটিয়ে পড়ে, অকারণে বায়ূ যখন জল-তরঙ্গের ঢেউ তুলে তাদের পশ্চাদবস্ত্রে, দূর থেকে মনে হয় যেন জলপ্রপাতের পাদদেশে রূপালী ইলিশের নৃত্য। ছেলেরা তখন গেয়ে উঠে- ‘দোল-দোল দুলনী’ কিংবা ‘দুই পাহাড়ের মাঝে মৌলায় মসজিদ বানাইছে’। মেয়েরা বুঝে, টের পায় এর নাম ইভ টিজিং। মুক্তিকন্যা যখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী তখন একপর্যায়ে অবস্থা সহ্যের বাইরে চলে যায়। সর্বপ্রথম ক্লাশ টেনের কয়েকজন ছাত্রী প্রতিবাদী হয়ে উঠলো। এ ভাবে আর চলতে দেয়া যায়না, এর একটা বিহীত হওয়া চাই। তারা গোপনে দু একটা মিটিং করলো, কিন্তু কোন মিটিংয়েই মুক্তিকন্যা উপস্থিত হলোনা। ২৪শে মার্চ ক্লাস শেষে এক সপ্তাহের জন্য স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। মুক্তিকন্যার বিশ্বস্ত বান্ধবী রোখসানা উরফে রুখু তার ঘরে এসে জিজ্ঞেস করলো-
– কী রে, দুই দুইবার দাওয়াত দিলাম তুই মিটিংয়ে আসলিনা কেন?
– সমস্যাটা কী?
– মা’নে? ছেলেগুলো দিন দিন বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে, পথে ঘাটে ছাত্রীদের টিজিং করে তুই দেখছিস না?
– আমাকে তো কেউ করছেনা।
– বলিস কী? কিছুদিন পূর্বে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে আমাদেরকে দেখে আমার সামনেই মুকুল গান করলো- ‘রাধা কিউ গোরী ময় কিউ কালা’। সে তো তোকেই বলছিলো।
– জানি।
– জানিস? জিনাত তোর কি মাথা ঠিক আছে? তোর কী হয়েছে রে, আমাকে খুলে বল তো দেখি।
– তুই আমাকে বিশ্বাস করিস?
– নিশ্চয়ই।
– আমি তার প্রেমে পড়ে গেছি।
– কার? কৃষ্ণকালো মুকুলের? সে’ই তো তোকে বেশী টিজিং করে।
– তাই তো। আমি জানিনা কখন কী ভাবে এই কালো ছেলেটার চোখে চোখ পড়েছিল। তার মাথার চুল, হাতের মাসল, দুটো চোখ, তার ঠোঁট- –
– ব্যস, ব্যস ব্যস আর বলতে হবেনা। আমি তো ভাবছিলাম সেদিন ঠাস করে একটা থাপ্পড় দিয়ে আসি তার মুখে।
– তারপরও সে স্কুলে যেতে পারবে।
– অর্থাৎ?
– অর্থাৎ, তোর গালে দাগ পড়লে কয়েকদিন স্কুলে যেতে পারবিনা। বাস্তবকে অস্বীকার করে, অবজ্ঞা করে সমস্যার সমাধান হয়না।
– তো এখন কী করা?
– বিশ্বাস কর রুখু, তাকে এক মিনিটের জন্যেও চোখ থেকে সরাতে পারিনা। তুই আমাকে একটু সাহায্য করবি?
– বল্।
– এক সপ্তাহের জন্য স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। তুই মুকুলকে শুধু বলবি আমি তাকে ভালবাসি। জীবনে যদি কাউকে বিয়ে করি তাহলে তাকেই করবো। আর বলবি, ২৬ তারিখ আমার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান সে উপস্থাপনা করবে।
– বাহ বাহ বাহ। একটা কথা বলি জিনাত মাইন্ড করিস না। ইভ-টিজিং সমস্যার সমাধান করার জন্যে, তুই কি মনে করিস আমরা সবাই একে একে এক একটা ছেলের প্রেমে পড়ে যাই?
– আমাকে ভুল বুঝলি রুখু। এর সাথে ইভ-টিজিং সমাধানের কোন সম্পর্ক নেই। মুকুল যে কেমন বেপরোয়া ধরনের ছেলে, সকলে তাকে সমীহ করে চলে, তা তো দেখেছিস। ছুটির পর স্কুল যখন খুলবে, মুকুলকে তোদের মিটিংয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করবি, আমিও যাবো। মুকুল যদি কোন ছেলেকে বলে, মেয়েদের দিকে তাকালে চোখ খুলে ফেলবো তাহলে সেই ছেলে বিশ্বাস করবে সত্যিই ঘটনা খারাপ।
– এটা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা হলো, নাকি পুরুষের কাছে নারীর নতজানু—
– দেখ রুখু, এতোসব ক্যাচাল প্যাচাল বুঝিনারে বোন, সমাধানটাই তো সকলের কাম্য, এখানে জয়-পরাজয়ের কী আছে?
– -আচ্ছা মুকুল যদি তোর প্রস্তাব রিজেক্ট করে?
– তুই এখন যা তো, আমার মাথা ব্যাথা করছে, আমি একটু ঘুমাবো।

আজ ২৬শে মার্চ। গ্রামের পাঠশালা, মক্তব-মাদ্রাসা, হাই স্কুল সব বন্ধ। আজকের দিনের আবহাওয়া কেমন হবে সেই ভাবনায় গতরাতে কাজী সাহেবের ভাল ঘুম হয়নি। মাথা ব্যাথা করার কথা ছিল কিন্তু করছেনা। এতো সুন্দর সকাল হবে ভাবতেই পারেন নি। উঠোনে নাতনী জিনাতারাকে দেখে গালভরা হাসি দিয়ে বললেন-
– কি দাদু, তোমার কি মাথায় ঠান্ডা লাগলো? গত রাতেও তোমার মাথাব্যাথা হয়েছিল। তুমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলে আমি তোমার মাথায় একটা ফু দিলাম।
– একসাথে পুরো দুটো প্যারাসিটেমল খেয়ে ঘুমিয়েছিলাম, আপনি কোন্ সময় ফু দিয়েছিলেন টের পাইনি।
– তোমার গলার স্বরে তো মনে হয় সর্দিও আছে। মাথা ভারী ভারী লাগছে?
– না, তেমন কিছু না, আমি ভালই আছি।
– দেখলে দাদু, গতরাতের রেডিও খবরে বলা হলো, ‘আগামীকাল দেশের উপর দিয়ে ক্ষণেক্ষণে হালকা ধমকাহাওয়া বইবে ও গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হবে’। দেখো আকাশে মেঘের কোন লক্ষণই নেই। Morning Shows the Day ঠিক না?
– আমাদের এখানে হচ্ছেনা, অন্য কোথাও হতে পারে। খবরে কিন্তু ‘বইবে’ ‘হইবে’ বলেনা, বলে ‘হতে পারে’ ‘সম্ভাবনা আছে’।

কাজী সাহেব কথা না বাড়িয়ে পুকুরের পূর্ব পাড়ে এসে পশ্চিমমূখী হয়ে দাঁড়ালেন। বিশাল এই বাড়িটিতে ৩০ বছর আগে ৭টি পরিবার বাস করতো। তিনটি ঘাটে দল বেঁধে মেয়েরা স্নান করতো, দুই ভাগে ছেলেরা উঠোনে বল আর মেয়েরা গোল্লাছুট খেলতো। নারী পুরুষ, শিশু-কিশোর মিলিয়ে এক সময় বাড়িতে ৩৬জন মানুষ ছিল। অর্ধ ইঞ্চি জায়গার জন্যে সুনা মিয়া আর ধলা মিয়া দুই ভাই মারামারি করে হাসপাতাল গেলো। এখন এই ঘর, বাড়ি, বাড়ির গাছ-বিছালি, ফল-মুল কোনকিছুর মালিকানা দাবী করার মতো কেউ নেই। ইংল্যান্ড যারা গিয়েছিলেন তাদের চতুর্থ প্রজন্ম বাংলাদেশকেই ভুলে গেছে। যে দুই পরিবার ঢাকা ও সিলেটে স্থায়ী বসতি গড়েছেন, তারা ঈদে পর্বেও গ্রামে আসেন না। আজ বহু বছর যাবত কাজী আলমদর আলী ৬ কেদার জমি নিয়ে তৈরী এই বাড়ির অলিখিত একচ্ছত্র মালিক। এক সময় বাড়ির চতুর্পার্শ্বে নৌকা চলাচলের জন্যে খাল ছিল, বর্ষাকালে ছেলে-মেয়েরা সারিবদ্ধ হয়ে জাল দিয়ে বড়শী দিয়ে মাছ ধরতো, এখন সবটুকুই পাকা রাস্তা। পশ্চিমের বড় ঘরের সন্মুখ থেকে উঠোন হয়ে পুবের বাংলা ঘরের মধ্য দিয়ে পুকুরের দক্ষিণ পাড় বেয়ে গাঁয়ের মূল সড়ক পর্যন্ত পিচঢালা পথ।
আলমদর আলী সাহেব তার নাতনীকে কাছে ডেকে এনে বললেন-
– বুঝলি জিনাত, আজকের দিনটি এই গ্রামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে।
– দাদু, বইয়ের মোড়ক উম্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা ও আমার একটি ছড়া আবৃতি করার জন্যে আমার সহপাঠি এক বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করেছি, ঠিক আছে?
– অবশ্যই অবশ্যই। আচ্ছা দেখো, কেমন পরিষ্কার রাস্তা, কোথাও মরা একটি আমের পাতা অযতনে পড়ে রয়নি। মনুর মা সযতনে সব সরিয়ে রেখেছে।
– বাগানবাড়ির ফিনিশিং-টাচটা তো দেখেন নি দাদু। এক সপ্তাহ ধরে আব্বু, মনু, মনুর মা আর ঐ পেইন্টার মিলে বাড়িটাকে একদম, কী বলবো- –
– তাজমহল, স্বর্গোদ্যান?
– বেটা পেইন্টার একজন ভাল দক্ষ আর্টিষ্টও। উঠোনে যে প্যান্ডোল বাঁধা হয়েছে তার নীচে এক হাজার মানুষের বসার জায়গা হবে। ইশ্, আজ যদি ইংল্যান্ডের বড় চাচা, মেজো চাচা ভাই-বোনদের নিয়ে উপস্থিত থাকতেন, কতই না সুন্দর হতো। এই বাড়িতেই থাকার মানুষ নাই, বাগান বাড়ি খামোখাই বানিয়ে রেখেছেন দাদু। কি বড় বড় আম গাছ, কাঁঠাল গাছ, কলা বাগান, লিচু সব বাঁদুড় আর কাঠবিড়ালীর পেটে যায়।
– আজ যদি বাগান বাড়ি বিক্রীর নাম ধরি, দাম কতো টাকা হবে জানো? পাঁচ কোটি তো কোন কথাই নেই। তুমি রেডি হয়ে থেকো, আমরা ঠিক সোয়া দশটায় বাগান বাড়ি যাবো, কেমন?

কাজী সাহেব বাংলা ঘরে এসে পত্রিকার বিজ্ঞাপনটা আবার পড়লেন। দিনের সময় সূচী অনুযায়ী, সকাল সাড়ে দশটা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত জাকাত ও কাফফারার টাকা এবং শাড়ি বিতরণ। ১টা থেকে তিনটা পর্যন্ত জিনাতারার ছড়া বইয়ের মোড়ক উন্মোচন। সাড়ে তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত কাঙ্গালী-ভোজ। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে আটটা পর্যন্ত বিশেষ অতিথিদের সাথে নৈশভোজন। মনু এসে খবর দিল, বাগান বাড়িতে লোক এসে গেছে, অনেক মানুষকে গেইটের বাইরে লাইন ধরায়ে রাখা হয়েছে, আরো মানুষ আসছে। কাজী সাহেব বাংলা ঘরের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন। এখান থেকে বাগানবাড়ি দেখা যায়। কাজী সাহেবের বাড়ির সামনে পাকা সড়ক, তারপর ছোট্ট একটি মাঠ, মাঠের পূর্ব ধারে সুমতি নদী। তারপর অনাবাদি কিছু জায়গা, থোকা থোকা বেতের ঝোপ, এর পর বাগানবাড়ি, আর বাগানবাড়ির ঠিক দক্ষিণ পাশেই ভারত চন্দ্র হাই স্কুল। দূর দেখার চশমাটা চোখে লাগিয়ে কাজী সাহেব বাগানবাড়ির দিকে তাকালেন। দেখলেন, এ তো সেই একাত্তরের ছবি। মনে পড়ে এ ভাবেই সে দিন ঘটি-বাটি, গাট্টি-বোচকা করে, মানুষের বাচ্চা মুরগীর বাচ্চা এক খাঁচায় ভরে, কেউ মাথায় আর কেউ কাঁধে করে গ্রাম ছেড়ে ছুটে চলেছিল যে যেদিকে পারে। কাজী সাহেব মনে মনে ভাবেন, কিন্তু এ তো উলটো হচ্ছে, এ যেন দেশ ত্যাগীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। হায়রে দেশ তোর এই অবস্থা? পিঁপড়া যেমন মরা ফড়িংযের গন্ধ পেলে সারিসারি দল বেঁধে বের হয়ে আসে, মানুষও টাকার গন্ধ পেলে তেমনি কবর থেকে বের হয়ে আসে। বাংলাদেশের ১৪ কোটি মানুষ, সবাই কি এক দিনের জন্যে ফকির হয়ে গেল?

বাগানবাড়ি যাওয়ার পথে জিনাত বললো- ‘দাদু, আপনার বক্তৃতায় সিলেটি ভাষা আর সাধু-চলিত ভাষার খিচুড়ী চলবেনা। আর আলোচনা সভার সভাপতি দিয়েছি আপনাকে, প্রধান অতিথি সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, বিশেষ অতিথি কুমার পাড়া ইউনিয়নের নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করবে স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র মুকুল হোসেন’। বাগানবাড়ি এসে কাজী সাহেব লক্ষ্য করলেন, থানার টি এন ও সাহেব কথা মত সময়ের আগেই এক ডজন পুলিশ পাঠিয়ে দিয়েছেন। পুলিশের উপস্থিতে কোন প্রকারের হৈচৈ গন্ডগোল নেই। সু-সৃংখল সারিবদ্ধভাবে সবাই শুভক্ষণের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।

জাকাত- কাফফারার টাকা ও শাড়ি বিতরণ পর্ব শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশের চেহারায় বিষন্নতার ভাব দেখা দিল। কাঙ্গালেরা বৃষ্টি না হওয়ার জন্যে আকাশের দিকে হাত তুললো আর কৃষকেরা বৃষ্টি হওয়ার জন্যে দোয়া করলো। আকাশের বিধাতা মধ্যপন্থা অবলম্বন করলেন। বৃষ্টি হলো কিন্তু মাটি ভিজলোনা। দক্ষ ব্যবস্থাপকবৃন্দের ও প্রশাসনের সহযোগীতায় আশাতীত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে যথাসময়ে প্রথম দুই পর্ব শেষ হলো। আলোচনা সভায় স্কুলের দু একজন ছাত্র মুক্তিকন্যার ছড়া ও মেধার প্রশংসা করলো, তার সুন্দর উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করলো, বাকি প্রায় সকল বক্তাই তাদের বক্তৃতার মাধ্যমে, স্বাধীনতার এতো দিন পরে মানুষ কী পেলো, মুক্তিযুদ্ধের ফসল কার ঘরে উঠলো, আর বর্তমান ও অতীত সকল সরকারের ব্যর্থতার বিস্তারিত নমুনা উপস্থিত জনতার সামনে তুলে ধরলেন। আবহাওয়ার অবস্থা ভাল নয় দেখে বিশেষ অতিথিদের সাথে নৈশভোজনও এক ঘন্টা আগে শুরু করা হলো। রাত আটটায় ভোজন পর্বের শেষ পর্যায়ে মনু এসে সংবাদ দিল একজন মেহমান জিনাতের বাবার সাথে দেখা করতে চান, তিনি ঘাটপাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। জিনাতের বাবা আহমদ আলী ঘাটপাড়ে এসে মেহমানকে চিনতে পারলেন না, বললেন-
– বেয়াদবি ক্ষমা করবেন, আমি আপনাকে তো চিনতে পারলাম না।
– বহুদিন, প্রায় পাঁচ ছয় বৎসর পূর্বে একবার দেখা হয়েছিল।
– কোথায়?
– ভারত চন্দ্র আই হসপিটাল এন্ড চিল্ড্রেন ক্লিনিক, মাচুয়া বাজার, কলকাতা, ওয়েষ্ট বেঙ্গল, মনে পড়েছে? আমি সেই হসপিটেলের সার্জন, ডঃ সুধীর চন্দ্র দেব।
– ডাক্তার বাবু! আরে এখানে দাঁড়িয়ে কেন, ঘরে আসুন ঘরে আসুন। এখানে কী ভাবে, কোথা থেকে?
– না ঘরে যাচ্ছিনা। গাড়িতে ড্রাইভার অপেক্ষা করছে। রাণীগঞ্জ গ্রামে আমার একমাত্র জীবিত পিসিমা ৮৫ বছর বয়সে আমাকে শেষ দেখা দেখতে চান বলে ডেকে পাঠালেন। এখানে এসে আপনাদের অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দেখলাম। দিনের বেলা আলোচনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। মেয়েটা বেশ বড় হয়ে গেছে মোটেই চিনতে পারিনি। রাতে ফেরার পথে এদিকেই যখন যাবো, ভাবলাম কাজী সাহেবের সাথে দেখা করে যাই। আপনার সাথে অবশ্য এর আগেও দেখা হয়েছে অনেক বার বাল্যকালে।
– কোথায়?
– এই বাড়িতে।
– ডাক্তার বাবু আপনি ঘরে আসুন, বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। জিনাতকে না দেখে যেতে পারবেন না, সে আপনাকে দেখলে ভারী খুশী হবে।
ঘরে যাওয়ার প্রয়োজন হলোনা, কাজী সাহেব ছেলের কাছে এসে বললেন- ‘তুমি একটু ঘরে যাও তো বাবা, অতিথিবৃন্দ বিদায় নেয়ার জন্যে তোমার অপেক্ষায় আছেন’। আহমদ আলী চলে যাওয়ার পর কাজী সাহেব বললেন-‘মেহমানকে চিনলাম না যে’? আগন্তক উত্তর দিলেন- ‘সুধীর চন্দ্র দেব, পিতা নবীণ চন্দ্র দেব, পিতামহ শ্রী ভারত চন্দ্র দেব’। মুহুর্তে কাজী সাহেবের বড় বড় চোখ দুটো জ্বলন্ত অগ্নিপ্রস্তরের আকার ধারণ করলো। তিনি মেরুদন্ড সোজা করে ক্রোধান্নিত ফনা তুলা কালনাগের মতো চেহারায় সুধীর বাবুর মুখোমূখি দাঁড়ালেন। বললেন-
– এখানে কী চাও সুধীর?
– কিছু ফেরত নিতে আসিনি কাজী সাহেব। একদিন দশ হাজার টাকা বন্ধকের বাড়িটা আমার বাবা বিশ হাজার টাকা দিয়ে ফেরত নিতে এসেছিলেন। এখন বাড়িটার দাম—
– সুধীর, তুমি সেচ্ছায় বেরিয়ে যাবে, না আমি—
– এর কোন প্রয়োজন হবেনা, বাড়ি ফেরত নিতে আসিনি, শুধু একটা কথা বলতে এসেছি। আপনি বক্তৃতায় বারবার বলেছিলেন- ‘দেশ স্বাধীন করে কী পেল এ দেশের মানুষ’? জনাব কাজী আলমদর আলী সাহেব, একাত্তুরে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আজ হাই স্কুলের গভর্ণিং বডির চেয়ারম্যান। এ দেশ থেকে আর কী চান?

ঠিক তখনই আকাশ ভেঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি নেমে আসলো। দৃষ্টি সীমানায় যতক্ষণ সুধীর বাবুর গাড়ি দেখা যায়, ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে কাজী সাহেব ততক্ষণ ঘাটপাড়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন।