এই পুরো প্রবন্ধটা উৎসর্গ করেছি বন্যা আহমেদ কে, যার বিবর্তন নিয়ে লেখালেখি, স্বতঃস্ফূর্ততা, ব্যক্তিত্ব্য সবই আমাকে মুগ্ধ করে, অনুপ্রাণিত করে…

অনেকদিন বাদে হলেও জেনেটিক মেমেটিক কো-এভোলিউশনের শেষার্ধ লিখে শেষ করলাম। প্রথমার্ধে দেখিয়েছিলাম “দ্য সেলফিশ জিন” এ রিচার্ড ডকিন্স কিভাবে উপস্থাপন করেছেন মিম তত্ত্বকে। যারা আগের পর্ব পড়েন নি তাদের জন্য জেনেটিক-মেমেটিক কো-এভোলিউশন-১

——————————————————————————————————————-

সেই আদিম মানুষ, যার শরীর আবৃত ছিল এক স্তর লোমে, খুঁজে খুঁজে পশু শিকারের জন্য বেছে নিয়েছিল ধারালো পাথর, পাথরে-পাথরে ঠোকাঠুকিতে জ্বালিয়ে ফেলেছিল অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, সে কি নিজেকে জিজ্ঞেস করেছিল, কেন আমি সবার চেয়ে আলাদা? কিংবা সুন্দরবনের শিকারী বাঘ, ক্ষুধা মেটাতে যে অভাবনীয় মাত্রার দ্রুতগতি আর শারীরিক শক্তিতে অনায়াসে ঘায়েল করে ফেলছে বুনো হরিণ, সে কি নিজের কাছে কখনো জানতে চেয়েছে, আমি কি করে এতো দ্রুত ছুটতে পারি? এই “আমি” বোধটি কি আসলেই উপস্থিত ছিল আমার আদিম পূর্বপুরুষের মাঝে বা শক্তিশালী বাঘের মস্তিষ্কে? এই প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর আমার জানা নেই। তবে এটুকু জানা আছে… মানুষ নিজেকে প্রশ্ন করেছে, আমি কে? কোথা থেকে এলাম, কিভাবে এলাম? আত্মপরিচয় সংক্রান্ত প্রশ্নোত্তর-পর্বের শেষে মানুষ এখন আছে ‘কেন আমি আলাদা?’ এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে।

সমস্ত জড়-পদার্থ, অনুজীব, উদ্ভিদ, প্রাণী সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা পরম করুণাময় ঈশ্বর, এই ধারণা সন্তুষ্ট করেনি বিজ্ঞানীদের, একদল সৃষ্টির রহস্য খুঁজেছে প্রাণরসায়নে, আরেকদল পদার্থবিজ্ঞানে। ডারউইন, ওয়ালেস, মেন্ডেল প্রাণ-রহস্যের প্রাচীন ধারণা ভেঙ্গে, বিতর্কের জোয়ার তুলে জন্ম দিলেন বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের, যার শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করছে আণবিক জীববিজ্ঞান। আমরা জানি, ডিএনএ, জিন, ক্রোমোসোম, নিউক্লিয়াস, কোষের সমন্বয়েই আমরা। গাঠনিক উপাদানগুলো এককোষী, বহুকোষী বা মানুষ সবারই এক। বিবর্তনের পথ ধরে একটি কোষ থেকে আমরা হয়েছি মানবপ্রজাতি। নিজেদের জন্ম ঠিকুজি জানার পর আমাদের ভাবনা, যদিও অনেক মিল আমাদের অন্য সব প্রাণী বা জীবের সাথে, মেনে নিলাম, বিবর্তিত হয়েছি একটি উৎস থেকেই, তবু আমরা অন্য সব প্রাণীর চেয়েও অনেক দিক থেকেই আলাদা… প্রাণিজগতে আমাদের নিকটতম আত্মীয় শিম্পাঞ্জীর সাথে দৈহিক দিক থেকে অনেক মিল থাকলেও অমিলও প্রচুর। আমাদের বুদ্ধিমত্তা সন্দেহাতীতভাবে উন্নত! মানব প্রজাতি প্রকৃতির অধীন হয়তো এখনও, কিন্তু প্রকৃতিকেও এখন মানব প্রজাতির নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে।ইচ্ছেমত শীত-বর্ষা আনতে পারিনা, কিন্তু বরফ ঢাকা অঞ্চলেও ঘরের মধ্যে আমরা সহনীয় উষ্ণতা বজায় রাখার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছি। আমরাই পারি, আর কোন প্রাণী নয়। কেন?

সুসান ব্ল্যাকমোরের প্রশ্ন ছিল, মানুষ কেন পৃথিবীর আর সব প্রাণী থেকে আলাদা? তার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা তিনি খুঁজে পেয়েছেন জিন-মিম কো এভোলিউশনে। তিনি প্রবল ভাবে আক্রান্ত হন মিমের মিমে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালে “দ্য মিম মেশিন” নামে একটি বই লিখে তীব্রভাবে মিম তত্ত্বের প্রতি সমর্থন জানান। এখানেই শেষ নয়, সুসান ব্ল্যাকমোর টেকনোলজিক্যাল এভোলিউশন নামে তৃতীয় একধরণের বিবর্তনের কথাও প্রস্তাব করে বসেন। টেডের উজ্জ্বল মঞ্চে তিনি খুব উত্তেজনার সাথে মিম তত্ত্বে তার অগাধ আস্থা এবং টেকনোলজিক্যাল মিম বা টিমের কথা উপস্থাপন করেন। ২০০০ সালের অক্টোবরেপ্রকাশিত সায়েন্টিফিক আমেরিকানের একটি সংখ্যায় মিমের ধারণার পক্ষে জোরালো সমর্থন দানকারী সুসান ব্ল্যাকমোরের বিভিন্ন বক্তব্যের বিপরীতে তিনজন বিজ্ঞানীর যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে… আমি সংক্ষেপে এখানে সেই প্রবন্ধের যুক্তি এবং যুক্তি খন্ডনগুলোই তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

মিম তত্ত্বের সমর্থনে TED এ প্রকাশিত সুসান ব্ল্যাকমোরের বক্তব্য দেখতে পারেন Susan Blackmore on memes and temes এ।

১৯৭৬ সালে রিচার্ড ডকিন্স তাঁর লেখা বই “দ্য সেলফিশ জিন” এ জেনেটিক এভোলিউশনের সাথে মেমেটিক এভোলিউশনের তুলনা করে যা তার পাঠকদের বলতে চেয়েছিলেন, তা হল, মহাবিশ্বে একমাত্র জিনেই এভোলিউশন সম্ভব তা নয়, অন্য কোন পরিবেশে হয়তো অন্য কোন ধরণের বিবর্তন ঘটা সম্ভব। যে জগতে কার্বন নেই, সেই জগতে কি প্রাণের অস্তিস্ত্ব থাকতে পারেনা? পারে হয়ত, কার্বন-ভিত্তিক প্রাণের বদলে অন্য কোন ধরণের প্রাণ, তাদের বিবর্তনও হবে অন্য রকম। তাঁর সেই পদক্ষেপটা ছিল অনেকটা এমন, মানুষের মনে জেনেটিক এভোলিউশন বিশ্বজগতের একমাত্র এভোলিউশন এমন ধারণা গেঁথে যাবার আগে এটুকু অনুধাবন করানো যে, অন্য ধরণের বিবর্তনও হতে পারে। বিবর্তন মানেই কেবল এবং কেবলমাত্র জেনেটিক বিবর্তন নয়। হয়তো আমাদের এই পৃথিবীতেই অন্য ধরনের বিবর্তন শুরু হয়েছে। তারপর একের-পর-এক জেনেটিক বিবর্তনের সাথে সাদৃশ্য দেখিয়ে গেছেন, যদিও তিনি জানতেন, যুক্তিগুলো মোটেও পাথর-কঠিন ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। কিন্তু এরপরও মেমেটিক্স নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ওখানেই থেমে থাকেনি, বরং তাতে জড়িয়ে গেছে ভাবনার ডালপালা।

সুসান ব্ল্যাকমোরের মতে, মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি অনুকরণ করা এবং সেকারণেই আমাদের মাঝে মিমের সঞ্চালন হয়, যা মানবপ্রজাতিকে আলাদা করেছে অন্য সব জীব থেকে।আমরা কবিতা লিখি, আমরা তত্ত্ব উপস্থাপন করি, আমরা রাতের আকাশে ঝিকিমিকি তারা দেখেই ক্ষান্ত হই না, স্যাটেলাইট, রেডিও ট্রান্সমিশন, টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে বসে থাকি আমাদের পৃথিবীর মত আরো আরো গ্রহ খুঁজতে, বুদ্ধিমান প্রাণীর খোঁজে। বলা বাহুল্য, বেঁচে থাকার জন্য আসলে আমাদের এইসমস্ত যোগ্যতার প্রয়োজন ছিল না। একথা নিতান্তই সত্য যে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকার জন্য আমাদের যতটুকু দক্ষতা বা যোগ্যতার প্রয়োজন ছিল, তার চেয়ে বেশি আছে আমাদের। এমআইটি’র প্রফেসর স্টিভেন পিঙ্কার তার “হাউ দ্য মাইন্ড ওয়ার্কস”এ বলেছেন, “As far as biological cause and effect are concerned,music is useless.” তাহলে কেন সংগীতের মাধুর্য্যে আমরা এমন বিহ্বল হয়ে যাই? কেন আমরা এর চর্চা করি? সুসান ব্ল্যাকমোরের মতে, একই কথা বলা যায় শিল্পকলা, দাবা বা গণিতের ক্ষেত্রে।সুসান ব্ল্যাকমোরের দাবি অনুসারে মিমের বিবর্তনের কারণেই মানব প্রজাতি এতোটা আলাদা অন্য সবকিছু থেকে, কারণ এই প্রাণীটি কেবল একধরণের বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় চলছে না, চলছে জেনেটিক এবং মেমেটিক বিবর্তনের ধারাবাহিকতায়। হালকা চোখে ভাবলে সুসান ব্ল্যাকমোরের দাবির সাথে সহমত না হয়ে পারা যায় না। কিন্তু একটু গভীর ভাবে দেখলে সহমত হতে গিয়েও দ্বিধা আসে বৈকি! দ্বিধার কয়েকটি কারণ দেখি…

অনুকরণ কেবলমাত্র মানুষেরই সহজাত প্রবৃত্তি নয়
মিমের সঞ্চালন ঘটে অনুকরণের মাধ্যমে। তাই মিম কি ব্যাখ্যা করতে গেলে আগে নির্ধারণ করতে হবে অনুকরণের সঙ্গা। মনোবিজ্ঞানীরা অনুকরণের সংজ্ঞা নিয়ে চিন্তিত, এর সবচেয়ে রক্ষণশীল মতবাদ যা ব্ল্যাকমোরের“মিম মেশিন” নামের বইতেই উল্লেখিত হয়েছে,

“The strictest definition states that imitation involves three complex stages: deciding what to imitate, transforming one point of view to another and producing a matched bodily action.”

এই সংজ্ঞা অনুসারে আসলে কোন প্রাণীই পাওয়া যাবে না,যা আসলেই মিমকে সঞ্চালিত করে, এমনকি মানুষও নয়। কিন্তু মিমের সংজ্ঞাটিকে একটু ছাড় দিলে হয়ত অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে। ব্ল্যাকমোরই এরচেয়েউদারভাবে দেখেছেন অনুকরণ আর মিমকে। যেমন, একটা গল্প যখন লোকমুখে ফেরে তখন আসলে প্রতিটা শব্দ একই রকম থাকেনা, প্রতিবার প্রচারিত হবার সময় শব্দ পরিবর্তিত হতে থাকে, কিন্তুযতক্ষণ সারমর্মটা একইরকম থাকে ততক্ষণ বলা যায়, মিমের সঞ্চালন হচ্ছে। তবুও ব্ল্যাকমোরেরমতে, কোন কিছু কেবল অনুকরণ করা হলেই মিমটি সঞ্চালিত হচ্ছে, তা বলা যাবে না। একটুকরো তথ্যকে মিম হয়ে উঠতে হলে তাতে তিনটি অতিরিক্ত শর্ত পূরণ করতে হবে।
১. সঠিকভাবে অনুকৃত হতে হবে।
২. অনেক সংখ্যক প্রতিলিপি তৈরী হতে হবে এবং
৩. প্রতিলিপিগুলোকে অনেক দীর্ঘসময়ের জন্য বিদ্যমান থাকতে হবে।

ইউনিভার্সিটি অফ লুইসভিলের প্রফেসর লি অ্যালান ডুগাটকিনের মতে, বিহেভিয়্যরাল ইকোলজিস্ট হিসেবে তিনি প্রাণিজগতের মধ্য থেকে ডজন-ডজন উদাহরন দিতে পারবেন, যা সুসান ব্ল্যাকমোর প্রস্তাবিত মিমের শর্তগুলোকে পরিপূর্ণ করে।উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেছেন ব্ল্যাকবার্ডের কথা, শিকারী দেখলে ব্ল্যাকবার্ড চিৎকার করে বা লেজ নাচিয়ে সংগীদের সতর্ক সংকেত দেয়। কিন্তু ফেয়ারবার্ড শিকারী না হলেও তাকে দেখে মাঝে মাঝে ব্লাকবার্ড শিকারি দেখার ভান করে মিথ্যে সংকেত দিয়ে থাকে, যা অন্তত পক্ষে ৬টি ব্ল্যাকবার্ডের মাঝে সঞ্চালিতও হয়। এটিকে খুব দারুণভাবে ব্ল্যাকমোরের উদারভাবে সংজ্ঞায়িত মিমের দলে ফেলে দেয়া যায়। এসবের মাধ্যমে তিনি বলতে চেয়েছেন, প্রাণিজগতে মানুষই একমাত্র প্রাণী নয় যারা অনুকরণ করে এবং এর মাধ্যমে তথ্য সঞ্চালিত করতে পারে। তাই তাঁর দৃষ্টিতে জেনেটিক বিবর্তনের সাথে মেমেটিক বিবর্তনকে দাঁড় করিয়ে মানুষ অন্য সব প্রাণীর চেয়ে ভিন্ন হবার যে কারণ ব্যাখ্যা করা হচ্ছিল, তা শেষ অব্দি ধোঁপে টেকে না।

মিম তত্ত্ব সর্বদা প্রাকৃতিক নির্বাচন অনুসরণ করছে না
মানব সমাজের সাংস্কৃতিক বিবর্তন এবং সংস্কৃতির সাথে জেনেটিক বিবর্তনের যোগাযোগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন ইউনিভার্সিটি অফ লুইসভিলের অ্যান্থ্রোপলজিস্ট রবার্ট বয়েড এবং পপুলেশন বায়োলজিস্ট পিটার জে রিচারসন। তারা বলেন, সুসান ব্ল্যাকমোরের যুক্তি অনুসারে বিশ্বাস বা ধারণা হল মিম, যা একটি মানুষ থেকে অন্য মানুষে বিশ্বস্তভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছে জিনের মত করেই এবং সেই মানুষটির আচরণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে। তার মতে ধারণার বিবর্তনকে প্রাকৃতিক নির্বাচন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়, এবং সংস্কৃতির পরিবর্তন বা বিবর্তনকেও বোঝা যায় কোন্‌ মিমটি কত দ্রুত প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে। রবার্ট বয়েড এবং পিটার জে রিচারসনের মতে, সুসান ব্ল্যাকমোর অন্তত অর্ধসত্য এইদিক থেকে। জীববৈজ্ঞানিক ধারণাগুলো সংস্কৃতির বিবর্তন বোঝার জন্য নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যেখানে প্রতিলিপির বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, সেখানে জেনেটিক মিউটেশনের সাথে মেমেটিক মিউটেশনের তুলনা করলেও সে বক্তব্যের ভিত্তি নড়বড়েই মনে হয়। জেনেটিক মিউটেশন ঘটছে মিলিয়ন মিলিয়ন প্রতিলিপির একটি-দুটিতে, যেখানে মেমেটিক মিউটেশন প্রায় প্রতি দশটি প্রতিলিপিতেই একবার করে ঘটছে! সেক্ষেত্রে কোনভাবেই জেনেটিক মিউটেশনের সাথে মেমেটিক মিউটেশনের তুলনা করে মেমেটিক বিবর্তনের বিশ্বস্ততা দাবি করা যায় না। শুধু তাই নয়, সংস্কৃতির বিবর্তন বা মেমেটিক বিবর্তনে প্রাকৃতিক নির্বাচনও প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। প্রাকৃতিক নির্বাচন বলতে আমরা বুঝি, যে জেনেটিক গঠন প্রকৃতি থেকে বাড়তি সুবিধা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যালেলগুলোর চেয়ে সফলভাবে প্রকৃতির বুকে টিকে থাকে তাই। এই বাড়তি সুবিধাটুকু নিতে পারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটা জেনেটিক মিউটেশন বা রিকম্বিনেশনের কারণে সৃষ্টি হওয়া নতুন জেনেটিক কম্বিনেশনের কারণেই, কোন সচেতন সত্তা মিউটেশন বা রিকম্বিনেশনের পিছনের কারণ হিসেবে থাকে না। কিন্তু মেমেটিক মিউটেশন স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া ছাড়াও ঘটতে পারে। আঠারো শতকের বিজ্ঞানীদের চিন্তার কাঁধে ভর করে উনিশ শতকের বিজ্ঞানীরা সেইসব চিন্তাকে আরো উন্নত করেছে, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নয়, কঠিন সাধনা করে, তেমনি করে শতাব্দীর পর শতাব্দী বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলো উন্নততর হচ্ছে। এবং এই উন্নতির পিছনে মানবসত্তা সচেতন ভাবেই কাজ করছে। যখন কোন পরিবর্তনের পিছনে কোন সত্তা সচেতন ভাবে কাজ করে, তাকে আর যাই হোক, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে মেমেটিক মিউটেশন হচ্ছে, মেমেটিক এভলিউশন হচ্ছে বলা চলে না।

মিম তত্ত্ব সাংস্কৃতিক বিবর্তনকে অতিসরলীকরণ করছে
রবার্ট বয়েড এবং পিটারজে রিচারসনের মতে, সংস্কৃতির পরিবর্তনকেমিউটেশনের চেয়ে রূপান্তরের সাথে বেশিতুলনা করা যেতে পারে, কারণ মিমকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিদ্বন্দ্বী মিমের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে হচ্ছে না। বরং প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই একই শব্দ বিভিন্ন এলাকার লোকদের মাঝে বিভিন্ন অর্থ প্রকাশ করতে পারে, ভিন্ন প্রজন্মের মানুষের কাছে ভিন্ন রূপে উপস্থাপিত হতে পারে। একই ইংরেজি শব্দ, একই বর্ণমালা, সমস্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ উচ্চারণ করে বিভিন্নভাবে। কোন দেশের মানুষের ‘ত’ উচ্চারণে সমস্যা, আবার কারোর ‘ট’ উচ্চারণে। অর্থাৎ ভৌগলিক অবস্থানভেদে, প্রজন্মভেদে বা বিভিন্নভাবে সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটছে। এবং এইসব রূপান্তর বিভিন্ন কারণে ঘটছে, কেবল মাত্র প্রাকৃতিক নির্বাচনের অনুরূপ মিউটেশনের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকে ব্যাখা করা সম্ভব নয়।

সাংস্কৃতিক প্রবাহ কেবল মাত্র অনুকরণের মাধ্যমে ঘটে না
ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের সাইকোবায়োলজিস্ট হেনিরী প্লটকিনের মতে, সুসান ব্ল্যাকমোরের মেমেটিক্সের ব্যাখায় দুইটি বড় রকমের সমস্যা আছে। প্রথমত সুসান ব্ল্যাকমোর বলতে চান, সংস্কৃতি মিমের সমস্টি ছাড়া আর কিছুই নয়, পাথরের হাতিয়ার ব্যবহারের মত সাধারণ ঘটনা থেকে শুরু করে জটিল সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো সবই মিমের একেকটি রূপ। দ্বিতীয়তঃ, মিমের সমস্টি বা সংস্কৃতি প্রবাহিত হয় কেবল অনুকরণের মাধ্যমে। হেনরী প্লটকিনের মতে সুসান ব্ল্যাকমোরের উভয় ধারণাই আসলে ভুল।

জুতোর ফিতে বাঁধা যায় অনুকরণ করে, কিভাবে বোলিং করতে হবে তা শেখা যায় অনুকরণ করে, কিন্তু এইগুলো সংস্কৃতির তেমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বহন করেনা। একজন মানুষ যখন একটা শোনা গল্প একটু পরিবর্তন করে নিজের মত করে আরেকজনকে বলছে, তখন আসলে সে যা বুঝেছে তাই বলছে। এই বোঝাটা সংস্কৃতির অনেকখানিই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বহন করে। একজন মানুষের সাথে কিভাবে কথা বললে সে বুঝবে, খুশি হবে বা আঘাত পাবে না, তা আসলে বুঝতে হয়। কেবল অনুকরণ করে তা করা যায় না। কোন অঞ্চলের মানুষের কাছে মূল্যবোধের পরিচায়ক কি, তা কোন অনুকরণের ব্যাপার নয়, অনুধাবনের ব্যাপার। রংপুর বা চট্টগ্রামের মানুষ সাধারণত খাবার শুরুতে ডাল খায়, আর যশোর অঞ্চলের মানুষ সাধারনত খাবার শেষে ডাল খায়। অনুকরণ করে চট্টগ্রামের মানুষ যেভাবে বেড়ে উঠবে, যশোরের মানুষ আরেকভাবে তা করবে। কিতু তাতে সংস্কৃতির আসলেই কিছু আসে যায় না। কিন্তু একটা শিশু ছোট থেকে বড় হতে হতে একটা সময় ঠিকই বুঝে যায়, পরিবার মানে বাবা-মা-ভাই-বোন সবাই মিলেমিশে একসাথে থাকা। পরিবার মানে একটা বন্ধন। মানুষ ভালোবাসার মত জটিল ব্যাপার অনুধাবন করতে পারে। বুঝতে পারে কার সাথে কিভাবে কথা বললে সে কথার অর্থ বুঝবে, খুশি হবে বা কষ্ট পাবে। এমনকি তার সামনে বসে থাকা মানুষটি ঠিক একটু পরেই কি বলতে পারে তাও মানুষ আন্দাজ করতে পারে। চুলের ফিতেটা কিভাবে বাঁধলে তাকে সুন্দর দেখাবে, তা জানে। কবিতায় কিভাবে শব্দের পর শব্দ সাজালে তা ছোঁয়ে যাবে অজস্র মানুষের হৃদয়, মনের অব্যক্ত কথা হবে প্রকাশিত, তা বুঝতে পারি আমরা। এইসব অনুধাবনের মাধ্যমেই আসলে প্রবাহিত হয় সংস্কৃতির প্রাণ। আমরা কেবল অনুকরণ করিনা, করি তার চেয়েও বেশি কিছু! যার ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য মেমেটিক্স যথেষ্ট নয়।

মিম তত্ত্বের পিছনে আছেন রিচার্ড ডকিন্স, ড্যানিয়েল ডেনেট এবং সুসান ব্ল্যাকমোরের মত কয়েকজন মহারথী। কোন তত্ত্বের পিছনে যেই থাকুক না কেন, তা যতক্ষণ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণযোগ্য নয়, তাকে গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকৃতি দেয়া যায় না। শেষটায় এসে মেমেটিক্স যদি তার গ্রহণযোগ্য ব্যাখা এবং প্রমাণসমেত নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে না পারে, তাহলে অন্য অনেক ভুল বৈজ্ঞানিক ধারণার মত একটি হিসেবেই ট্যাগ লেগে যাবে, যেগুলো কেবল ধারণাই ছিল, প্রমানিত হয়নি কোনদিন। কোয়ান্টাম ফিজিক্সের জন্মলগ্নে নীলস বোর-হাইজেনবার্গের বিরোধিতা করেছিলেন আইনস্টাইন, তবুও একসময় ক্লাসিক্যাল ফিজিক্সের বিরোধিতা সত্ত্বেও কোয়ান্টাম ফিজিক্স দাঁড়িয়ে গেছে, কারণ তাঁরা পেরেছিলেন কোয়ান্টাম থিওরীর গ্রহণযোগ্য ব্যাখা দিতে।

যখন মিম তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে এত প্রশ্ন তখন কিভাবে জিন-মিম কোএভোলিউশনের ধারণা গৃহীত হবে? আসলেই কি তবে জেনেটিক মেমেটিক কো-এভোলিউশন বলে কিছু আছে? নাকি পুরোটাই জেনেটিক এভোলিউশন? সুসান ব্ল্যাকমোর যতভাবেই মিম তত্ত্বের সাহায্যে মানুষের অন্য প্রাণীদের চেয়ে ভিন্ন হবার কারণ ব্যাখ্যা করুন না কেন, ব্যাখায় গলদ থাকলেও প্রশ্নটা কিন্তু বাতিল হয়ে যায় না। আসলেই তো সত্যি, আমরা অনুকরণ করি, অনুধাবন করি, আমরা সংস্কৃতির ধারা বহন করি, আমরা বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে দিনের পর দিন এগিয়েই যাচ্ছি। আমাদের মাঝে অবাধ তথ্য প্রবাহ আছে । আজকের আবিষ্কার ভবিষ্যতের আবিষ্কারের ভিত্তি হয়ে কাজ করতে পারছে। কিভাবে পারি? মিম নয়, তবে কি?

এই প্রশ্নের উত্তর আসতে শুরু করেছে ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ এর মাঝে মিরর নিউরণের অস্তিত্ব প্রমানিত হবার পর থেকে। ১৯৯২ সালে প্রথম মিরর নিউরণের বর্ণনা জনসমক্ষে আসে। কিছু বিজ্ঞানীর মতে, মিরর নিউরণ হল সাম্প্রতিক কালে নিউরোসায়েন্সের আবিষ্কার গুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি। প্রাইমেটে মিরর নিউরণের অস্তিত্ব তো পাওয়া গেছেই, সেই সাথে কিছু পাখিতেও এই মিরর নিউরণ পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মানুষ যখন কোন কাজ করে, তখন তার মস্তিষ্ক থেকে একধরণের ব্রেইন সিগ্যনাল পাওয়া যায়, কিন্তু আশ্চর্যের হলেও সত্যি, মানুষ যখন কাউকে কোন কাজ করতে দেখে তখনও তার মস্তিষ্ক থেকে ব্রেইন সিগ্যনাল পাওয়া যায়। যে করছে এবং যে দেখছে, উভয়েই যেন এক সত্তার মত অনুভব করতে পারছে একই অনুভূতি। আর এই কারণেই, মা যখন কাগজে পেন্সিল দিয়ে লিখছে “অ”, তখন বাচ্চাটিও দেখছে, কিভাবে মা পেন্সিল ধরে, কিভাবে মা লিখে, কিভাবে মা কথা বলে। মা খুশি থাকলে কিভাবে হাসে, অখুশি থাকলে মুখটা কেমন দেখায়, কিসে মা খুশি হয়, কিসে সে অখুশি হয়। কোনটা করতে মা নিষেধ করে। এভাবেই মানুষ অণুকরণ করে, অনুধাবন করে, একজনের অনুভূতি আরেকজন বুঝতে পারে, পরস্পর পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।

প্রখ্যাত নিউরোসায়েন্টিস্ট ভি. এস. রামাচন্দ্রানের মতে এই মিরর নিউরণই হল অনুকরণ, অনুধাবন এবং ভাষার উৎপত্তির মূল কারণ। এই মিরর নিউরণই বহন করছে সংস্কৃতির ধারা। সংস্কৃতি প্রবাহিত হচ্ছে আমাদের অনুধাবন এবং স্মৃতিকে বাহন করে। অন্যান্য প্রাইমেটের তুলনায়, মানুষের মস্তিষ্কে মিরর নিউরণের সক্রিয়তা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। ফলশ্রুতিতে আমরা হয়ে উঠেছি অনন্য। আমরাই পারি নিত্য নতুন আবিষ্কারে মেতে উঠতে, সমাজ গড়তে, যোগাযোগ করতে, তথ্য প্রবাহ বহাল রাখতে, নিজেদের ভবিষ্যতের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে।

TED এ প্রচারিত ভি এস রামাচান্দ্রানের মিরর নিউরণ সংক্রান্ত পরিবেশনা দেখতে পারেনThe Neuron that shaped civilization by V.S. Ramachandran এ।

মিরর নিউরণ কোন ধারণা নয়, পরীক্ষিত সত্য, এখনো প্রতিদিন মিরর নিউরণ নিয়ে গবেষণা চলছে। এই মিরর নিউরণের উদ্ভব হয়েছিল অতীতের কোন এক সময়ে জেনেটিক মিউটেশনের কারনেই। আজকে যা মিম বলে আমরা জানি, তা আসলে জেনেটিক এভোলিউশনেরই ধারাবাহিকতা, এবং এর নিয়ন্ত্রণ এখনো জিনের হাতেই আছে। ১৯৭৬ সালে দ্য সেলফিশ জিন প্রকাশের সময় রিচার্ড ডকিন্স মিমকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তার প্রায় ১৬ বছর পর প্রথমবারের মত মিরর নিউরণের বর্ণনা পাওয়া যায়, যা মিম তত্ত্ব বা মেমেটিক এভোলিউশন বা জেনেটিক-মেমেটিক কো-এভোলিউশনের ধারণাকে বাতিল করে দেবার জন্য যথেষ্ট।

————————————————————————————————–
References:

1. Blackmore, S. The power of memes. Scientific American 283, 64-66, 68-71, 73 (2000).

2. Dawkins, R. The Selfish Gene. (Oxford University Press: 1976).

3. সুসান ব্ল্যাকমোর অন মিমস অ্যান্ড টিমস

4. দ্য নিউরন দ্যাট শেপড সিভিলাইজেশন

5. Wikipedia