লিখেছেন – নির্মিতব্য

কম বেশী আমরা সবাই জীবনের কোন এক সময়ে কমিকস্‌ পড়েছি, বিশেষ করে ছোট্টবেলায় পড়ার বই এর তলে লুকিয়ে লুকিয়ে! চাচা চৌধুরী, পিংকি, বিল্লু এগুলো আমাদের এই দক্ষিণ এশিয় চরিত্র; অন্যদিকে টিনটিন, এসট্রিক্স ইউরোপিয়ান চরিত্র; আর মারভেল আর ডি.সি. কমিকস এর প্যান্ট এর উপর হাফ প্যান্ট পরা superhero কমিকস তো আছেই। প্রায় এই সবগুলো কমিকস্‌ এর উপর নির্ভর করে অনেক বিদেশী ব্যবসা সফল সিনেমা আমরা গত কয়েক বছর ধরে দেখে আসছি। অবশেষে আমার বহুল প্রতীক্ষিত, রঙ্গিন পাতার 2D টিনটিন আসছে 3D পর্দায়। তাও আবার এই সিনেমা এর নির্মাতা হচ্ছেন স্টিভেন স্পিলবার্গ। যদিও ইউরোপবাসীরা গত দুই মাস আগ থেকে তাদের প্রেক্ষাগৃহে সিনেমাটি দেখে ফেলেছেন, কিন্তু আমার বর্তমান আবাস আমেরিকা, যেখানে টিনটিন এক অভিযানে ১৯৩১ ঘুরে গেছে, সেই আমেরিকাতে টিনটিন এর সিনেমা আসছে আগামীকাল ২১শে ডিসেম্বর! আমার শিশুকালের hero কে দেখব আরেকটা dimension যোগ করে, 3D তে।

অনেকে হয়তো ভাবছেন একটা কার্টুন চরিত্র কি করে একজন মানুষের হিরো বা আদর্শ হতে পারে! এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য এখন আপনাদের সবাইকে নিয়ে যাব টিনটিন এর কয়েকটি আন্তর্জাতিক ভ্রমণ কাহিনীর অংশ বিশেষে। টিনটিন এর নির্মাতা হলেন বেলজিয়ান এক অসাধারন শিল্পী যার ছদ্দনাম ছিল ‘হার্জ’। সর্বপ্রথম ১৯২৬ এ টিনটিন এর ভ্রমন কাহিনী শুরু হয়। আমরা বেশীর ভাগ পাঠক ১৯৩৪ পরবর্তী তরুন টিনটিন এর সাথে পরিচিত, যার পেশা হচ্ছে সাংবাদিকতা, সে একজন সৎ, মার্জিত এবং কর্মঠ টগবগে তরুণ যার রক্তে আছে অজানাকে জয় করার প্রবল ইচ্ছা। কিন্তু, ১৯৩৪ এর আগের টিনটিন লেখা হয়েছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে। বালক টিনটিন চরিত্রটি ছিল একটি হাতিয়ার মাত্র, যা ব্যবহার করা হয়েছিল বেলজিয়ান শিশুদের কমিকস্‌ এর নামে ডানপন্থি সোস্যাল ক্যাথলিক রাজনীতির সাথে পরিচয় করাতে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর হার্জ এর চিন্তাধারা তুমুলভাবে পরিবর্তিত হয় এবং এর প্রভাব পড়ে তরুণ টিনটিনের পরবর্তী সবকটি ভ্রমন কাহিনীতে। আজ পর্যন্ত টিনটিন প্রকাশিত হয়েছে ৫০টিরও বেশী ভাষায়, কিন্তু সব কমিকস্‌ পড়েও আপনি বলতে পারবেন না টিনটিন ইউরোপ এর কোন্‌ দেশ এর নাগরিক। এমনকি তরুণ টিনটিন এর ধর্মীয় কোনো আনুগত্যও তার কোনো কমিকস এ খুঁজে পাবেন না। যদিও টিনটিন কে দেখা গেছে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে সৌহার্দমূলকভাবে চলতে, এবং পথিমধ্যে যে কোন ধর্মীয় অনাচার এর উপর প্রতিবাদ করতে। এর কিছু উদাহরণ আরেকটু পরই পাবেন।

টিনটিন তার সব অভিযানে নিয়ে গেছে তার পোষা কুকুর, ‘স্নোয়ি’কে। স্নোয়ি একদম তার নাম এরই মত। একদলা তুষারের টুকরো। সে তার মনিবের মতই বুদ্ধিমান, লড়াকু, loyal। কিন্তু মাঝে মাঝে একটু তরল পানীয় পেলে স্নোয়ি লোভ সামলাতে পারে না। কলকাতার আনন্দ প্রকাশনী টিনটিন এর official বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করে। জানি না কেন তারা অনুবাদ করার সময় স্নোয়ি এর নাম পাল্টে রাখে কুট্টুস! কি জানি হয়তো original ভাষাতে ‘স্নোয়ি’ এর নাম ‘স্নোয়ি’ না। যাক! টিনটিন এর আরেক বন্ধু, সুযোগ পেলেই মাতাল হয়ে যাওয়া সমুদ্র পাগল captain Haddock। এই চরিত্রটি আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বদরাগী। সে খুব অল্পতেই রেগে যায়, আর রেগে গেলে পুরাদ্দমে অসম্ভব মজাদার সব creative গালি শুরু করে। টিনটিন কিন্তু কখনোই অতি সহজে রাগে না, কিন্তু তার হরহামেশা দেখা হয় সমাজের সবচেয়ে নীচু মানের মানুষের সাথে, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সাথে। অনেক সময় মনে হয় টিনটিন এর মনের ক্ষোভ প্রকাশিত হয় তার সহ সঙ্গীদের মাধ্যমে; কুট্টুস/স্নোয়ি আর হ্যাডক এর মাধ্যমে।

কথা অনেক হলো, এবার যাই বই এর পাতায়। নিচে একটি উদাহরণ হল, Cigars of the Pharaoh অভিযানের, যেখানে টিনটিন একটি ভুল বুঝাবুঝি থামাতে এগিয়ে আসে-

এখানে ‘রাস্তাপপুলস’ খুবই হোমড়া-চোমড়া লোক, কিন্তু টিনটিন তার সাথে ভাব না দেখালেও, স্নোয়ি কিন্তু ঠিকই উত্তর দিচ্ছে, “তো তুমি বিশাল বড় কেউ, তাতে কি হয়সে।” যদিও স্নোয়ি এখানে কথা বলছে, কিন্তু কেউ তার কথা শুনতে পায় না, শুধু পাঠকরাই বুঝতে পারছে! আমার কাছে সব সময় এজন্য মনে হয়েছে স্নোয়ি যেন টিনটিন এর মন এর কথা গুলো বলে। কারণ ভদ্র টিনটিন কিন্তু কখনোই কারও সাথে বাজে কথা বলে না।

তাই বলে টিনটিনকে দুর্বল ভাববেন না, টিনটিন শক্তের শক্ত, নরমের নরম। নীচের দুইটি উদাহরণ হলো যেখানে টিনটিন কোন কিছুর পরোয়া না করে দুর্বলের সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে; প্রথমটি চীন এর কোনো রাস্তায় The Blue Lotus অভিযানে-

আর নীচের উদাহরণটি পেরুতে, টিনটিন এর Prisoners of the Sun অভিযানের-

আমাদের নিজেদের সমাজেই আমরা প্রতিনিয়ত এরকম অনাচার দেখি। টিনটিন আমাকে শিখিয়েছে কখনো দুর্বলের উপর অন্যায় সহ্য না করতে, সব সময় অন্যায় এর কালো হাত থামাতে। যদিও এর জন্য অনেকবার টিনটিনকে এই দুষ্টু লোকদের সাথে মারামারি করতে হয়েছে, আর মাঝে মাঝে হাসপাতালো যেতে হয়েছে। তারপরো, এই পাগল সাংবাদিক বিশ্বের আনাচে-কানাচে যখনি অত্যাচার এর সম্মুখীন হয়েছে, থামিয়েছে, প্রথমে কথায়, না হলে আক্রমণ করে।

কিন্তু আমরা লড়াকুর মত সবসময় অন্যকে কথা শুনাতে উঠেপড়ে লেগে থাকি। টিনটিন এর অনেক রাগই প্রকাশ হয় চোখের ভাষায়। যেমন নীচের উদাহরণে মনে হয় টিনটিন এই স্বার্থপর মহিলাকে কিছু বলেনি, হয়তো ইনি একজন বয়স্ক মহিলা তাই!

তাই বলে মনে করবেন না টিনটিন অভিযানে আমাদের মত কারও গায়ের রক্ত গরম হয় না। ভুলে গেলে চলবে না ক্যাপ্টেন হ্যাডোক এর কথা। তার মনের মত না হলে গলা ফাটিয়ে চারপাশ বড় সরগরম করে তুলে। যেমন ধরুণ, নীচের একটি দৃশ্যে Red Rackham’s Treasure এ হ্যাডক ক্ষেপে গেচ্ছে একদল গুপ্তধনলোভী মিথ্যে উত্তরাধিকারীদের উপর;

যদিও হ্যাডক মোড়লের মত অকারণে সবসময় চিৎকার করে না, কিন্তু মাঝে মাঝে তার মেজাজ একটু সহজেই ভড়কে যায়। টিনটিন যখন তিব্বত গেল তার এক নিখোঁজ বন্ধুর সন্ধানে, তখন হ্যাডক কে নেপালী ভাষায় ঝাড়ি খেতে হয়েছিল রাগ সামলাতে না পারার কারণে-

শুনেছি যাদের নাকি বেশী মাথা গরম তারা একবারে ঠেকে শিখে না, বেশ কবার উল্টো ঝাড়ি খেলে তারপর দীক্ষা হয়-

টিনটিন পড়তে গিয়ে একটা যেটা বোধ হল, বাংলাদেশে যে গৎবাঁধা সমস্যা সেগুলো অন্য উন্নয়ণশীল দেশেও আছে। রাজধানী সুন্দর সাজানো গুছানো, বড় বড় অট্টালিকা, কিন্তু অর্থনৈতিক অবস্থা বেহাল। মানুষের মৌলিক চাহিদাই মেটে না। কিন্তু টিনটিন অভিযানে কোন গরীব দেশকে দেখাতে গেলে সাধারণত একটি কাল্পনিক শহরের কথা বলা হয়, টিনটিন এর অনেক কাহিনীতেই San Theodoros নামক এক দেশের কথা বার বার আসে, কিন্তু এমন দেশ বাস্তবে নেই! নীচে দেখতে পাচ্ছেন এই দেশের রাজধানী Tapiocapolis-

তাই বলে হার্জ সবসময় কল্পকথার পিছে লুকিয়ে থাকেন নি। টিনটিন যখন আমেরিকা আসে তখন তার অভিযানের এক ভাগে Red Indian দের এলাকায় চলে যায়। আর বেপক হট্টগোলের মাঝে ধুম করে Red Indian দের মাটিতে আবিষ্কৃত হয় কালো সোনা, খনিজ তেল। নামমাত্র মূল্যে আদিবাসীদের জমি নিয়ে নেওয়া হয়। এই তেল যেখানে, সৈন্য সেখানে। তেল নিয়ে power play টিনটিন এর আরও অনেক কাহিনীতেই পাওয়া যায়।

টিনটিন তার অভিযানের কারণে অনেক জায়গায় গেছে। কাহিনীগুলো বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি তাই ধর্মীয় গোড়ামীর অনেক উদাহরণ আছে টিনটিন-এ। ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদীরা তখনো এত মাথা চাড়া দিয়ে উঠে নি, তাই তাদের না পাওয়া গেলেও আরবীয় শেখরা যে দাস ব্যবসা মনের আনন্দে করছে, নিরীহ হজ্ব যাত্রীদের দাস হিসেবে বিক্রী করছে তার উদাহরণ এবং হ্যাডক এর প্রতিউত্তর নীচে-

আমার নিজের সবচেয়ে মজা লাগে নিচের অংশটি, The Shooting Star এ যখন একটি বিশাল উল্কাপাতের কারণে পৃথিবী ধ্বংস হতে নেয় তখন আবির্ভাব হয় এক পাগল prophet এর, যার ঘ্যানঘ্যানময় ধর্মীয় ভাষণ থামাতে হয় এক বালতি পানি মাথায় ঢেলে দিয়ে-

আগেই বলেছিলাম হার্জ এর লেখা এবং কমিকস্‌ নানান সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে, সবসময় উনি তার মন মানুসিকতার উন্নয়ণ করে গেছেন যার প্রকাশ ঘটেছে তার কমিকস-এ। একসময় Black লোকদের বিরুদ্ধে ভুল এবং বিরূপ ধারণা ছিলো বলেই হয়তো প্রথম দিকের টিনটিনে তাদের আঁকা হতো খুব দৃষ্টিকটু ভাবে। নীচে টিনটিন The Broken Ear এ ছদ্মবেশ নিয়েছিল একজন আফ্রিকান হিসেবে-

কিন্তু কালের সাথে সাথে টিনটিন শেষের দিকের অভিযানগুলো আরও তথ্যবহুল হয়েছে, মজার হয়েছে। আমি মাঝে মাঝে চিন্তা করি হার্জ টিনটিনকে একবিংশ শতাব্দীর কোন্‌ কোন্‌ আন্তর্জাতিক ঘটনার মধ্যখানে নিয়ে যেতেন। দুঃখজনক হল, এই শিল্পী আমার জন্মের আগেই মারা গেছেন। কিন্তু তার কমিকস্‌ থেমে থাকে নি। টিনটিন এর আরো কিছু অভিযান বের হয়েছিল। কিন্তু কোনটাই “হার্জ এর আঁকা দুনিয়া” এর মত আমার মনে সাড়া জাগাতে পারে নি।