আমার ঠোঁটকাটা স্বভাব আর রুক্ষ, রূঢ় এবং রাগী আচরণের কারণে এই জীবনে নিন্দে এবং গালমন্দ কম জোটে নি আমার। প্রাপ্য বলেই বেশ যত্ন করে সিন্দুকে ভরে রেখেছি আমি এই উপহারসামগ্রীগুলোকে। তবে, মজার বিষয় হচ্ছে যে, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে নিন্দের পাশাপাশি প্রশংসা এবং স্তুতিও পেয়েছি আমি প্রচুর। যদিও নিন্দার মতো এগুলো আমার প্রাপ্য নয় বলেই বিব্রতই থাকি সবসময়। যেহেতু প্রাপ্য নয়, সে কারণেই হাঁস যেমন গা ঝাড়া দিয়ে এক নিমেষেই ঝরিয়ে ফেলে গায়ের সমস্ত জল, আমিও সেরকমই গা থেকে খসিয়ে ফেলি প্রশংসার মাল্য তা শোনার অনতিবিলম্বেই। কিন্তু, এই হাঁস প্রাণী আমিও এক অন্ধবিশ্বাসীর কাছ থেকে অদ্ভুত এক প্রশংসা পেয়েছি, যাকে গা থেকে ঝাঁকি দিয়ে খসে ফেলানোর কোনো ইচ্ছেই নেই আমার। আমি নাকি ইচ্ছে করলেই বাংলা সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হতে পারি, এই হচ্ছে সেই একজনের দৃঢ় বিশ্বাস। 🙂 পৃথিবীতে কোনো ব্যক্তি কোনো উপন্যাস লেখার আগেই (ভবিষ্যতেও তিনি কোনোদিন কোনো উপন্যাস লিখবেন কি না কে জানে) এই ধরনের শ্রেষ্ঠত্বের প্রশংসা পেয়েছেন কি না, সে বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে আমার।


আমার প্রতি এরকম অন্ধবিশ্বাস থাকার কারণে এই লেখাটা উৎসর্গ সেই ব্যক্তিকেই করলাম। পরস্পরের পিঠ চুলকানি আর কি। সেই অন্ধবিশ্বাসীর নামটা জানার জন্য ব্যাপক কৌতুহল হচ্ছে আপনাদের, সে কথা আমি জানি। জানি বলেই বলছি। তাঁর নাম তামান্না ঝুমু, ডিজিটাল নবি হিসাবেই মুক্তমনায় খ্যাত তিনি।


‘পঞ্চাশ বছর এমন কোনো বয়স নয়’। গলায় সহানুভূতি ঢেলে ওয়ার্ডেন বলেন। ‘যুগ পালটে গেছে। আজকাল অনেক লোকই এ বয়সে নতুন চাকরি বাকরি নিচ্ছে’।

যুগ যে পালটে গেছে সেটা ঠিকই বুঝতে পারছি আমি। বিশ বছরতো আর কম সময় নয়। একটা মানুষের জীবনের তিনভাগের একভাগ। আমার জীবনের তিনভাগের একভাগও কেটে গেলো অন্ধকারগুহায়। শুধুই কী তিনভাগের একভাগ? বাকি সময়টা কি আর আগের মত যাবে? খুব সন্তর্পনে একটা দীর্ঘশ্বাসকে গোপন করি আমি।

ওয়ার্ডেনের মুখোমুখি টেবিলের অন্যপাশে একটা কাঠের চেয়ারে বসে আছি আমি। অগোছালো টেবিল। রাজ্যের কাগজপত্র ছিটানো রয়েছে তার উপরে। একপাশে ফাইলের স্তুপ। তার ওপাশে একটা আরামদায়ক চেয়ারে বসে আছেন ভদ্রলোক। ষাটের কাছাকাছি বয়স হবে। নাদুসনুদুস ভূড়িওয়ালা লোক। নাকের নীচে ঝাঁটার মত কাঁচাপাকা গোঁফ। চোখে ভারি ফ্রেমের বাইফোকাল চশমা। বেশ সুখী সুখী চেহারা। অনেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো। ওয়ার্ডেনের সামনে একটা খোলা ফাইল। আমার ফাইল হবে নিশ্চয়। ফাইলের মধ্যে একগাদা কাগজপত্র।

সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছে আজ আমার। যখন জেলে আসি, শুরুর দিকে প্রচণ্ড রকমের আতংকের মধ্যে দিন কাটতো আমার। প্রায় পাগলের মত দশা হয়েছিল তখন। বিশবছরকে অনন্ত সময় মনে হতো। একফোঁটা সতেজ বাতাসের জন্য দম বন্ধ হয়ে আসতো আমার। এক টুকরো মুক্ত আকাশের জন্য হাহাকার করতো বুকের ভিতরটা। মুক্তির জন্য কত রাত কত দিন গুমরে গুমরে কেঁদেছি। অথচ আজকে যখন সত্যিই মুক্তি পাচ্ছি, কোনো অনুভূতিই হচ্ছে না আমার। না আনন্দ, না দুঃখ, না উল্লাস, না বিষাদ। কিছুই নয়। শুধু একধরনের শূন্যতার বোধ হচ্ছে। কেন হচ্ছে তাও জানি না।

‘হতাশ হবার কিছু নেই। জীবনটাকে ঠিকই গুছিয়ে নিতে পারবা। হতাশার কারণে আবার ঝামেলায় জড়িও না। তার পরিণতি কী হয় তাতো জানো নিশ্চয়’। ওয়ার্ডেন তখনও বলে চলেছে

‘কী হয়?’ আনমনে বলি আমি। ওয়ার্ডেনের কথা খুব একটা মন দিয়ে শুনছি না আমি। আমার চোখে পড়ে রয়েছে পিছনের দেয়ালের দিকে। সেখানেও যে কিছু দেখছি, তাও নয়।

‘তুমি-ই প্রথম নও ডেভিড। এর আগেও আমি অনেককে এখান থেকে বিদায় দিয়েছি। বিদায় দেবার দুদিন পরেই তারা আবার এখানে এসে হাজির হয়েছে’।

মাথা নীচু করে আমার ফাইল পরীক্ষা করতে থাকেন তিনি। হঠাৎ করেই খুকখুক করে গলা পরিষ্কার করেন তিনি। আমার দিকে চোখ না তুলেই বলেন, ‘তোমার দেখি পরিবারও আছে ঢাকা শহরেই। তোমার স্ত্রীকেতো কখনো তোমার সাথে দেখা করতে আসতে দেখি নি’।

‘স্ত্রী ছিল একসময়। এখন নেই। সে কারণে দেখেন নি কখনও। দাগি আসামিদের স্ত্রী থাকে না’। নির্লিপ্ত গলায় বলি আমি

‘ও’। মিইয়ে যান তিনি

‘যে সোনাগুলো ছিনতাই করেছিলে …………’। প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করেন তিনি

‘কিসের সোনা? কিসের ছিনতাই? আমি কোনো ছিনতাইকারী নই।‘ গলায় তীব্র ঝাঁঝ এনে বলি আমি। শিরদাঁড়াটা সোজা হয়ে যায় চেয়ারে আমার।

আমার গলার ঝাঁঝে দমে যান তিনি। আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে চেয়ারে হেলান দেন। ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। উত্তেজিত হবার কিছু নেই। ভুলেই গিয়েছিলাম। সৎ মানুষ তুমি। সরকারি উকিল ফাঁসিয়ে দিয়েছে তোমাকে। তাই বিনা অপরাধে জেল খেটেছো।‘

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান তিনি। পাশে রাখা একটা বড়সড় ব্যাগ এগিয়ে দেন আমার দিকে। ‘এতে তোমার সব কাপড়চপড় আছে। পিছনের তালাবদ্ধ আলমারি খুলে একটা বাদামি রঙের মোটাসোটা খাম এগিয়ে দেন তিনি আমার দিকে। আমার জিজ্ঞাসু চোখ তাঁর দৃষ্টি এড়ায় না। ‘এর ভিতরে তেষট্টি হাজার টাকা আছে। জেলে তোমার উপার্জনের টাকা। এই টাকাটার উপরে ভর করেই তোমাকে দাঁড়াতে হবে। দয়া করে নষ্ট করো না এটা। বুঝেশুনে খরচ করো।‘

কোনো জবাব না দিয়ে টাকার প্যাকেটটা হাতে নেই আমি।

‘তুমি এখন মুক্ত। যেতে পারো।‘ টেবিলে দুই হাতের ভর রেখে চশমার উপর দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন।

কাপড়ের ব্যাগটাকে ডান হাতে তুলে নিয়ে দরজার দিকে ধীর পায়ে রওনা দেই আমি।

‘ছোট একটা বুদ্ধি দেই তোমাকে’। পিছন থেকে তিনি বলেন

হাঁটা না থামিয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাই তাঁর দিকে। ‘চুলে কলপ করে নিও। বুড়ো লোককে কেউ সহজে কাজ দিতে চায় না।‘ কোমল গলায় তিনি বলেন।

ওয়ার্ডেনের চোখের মায়াটা দেখতে ভুল হয় না আমার। ‘মনে থাকবে’। নরম স্বরে বলি আমি।

জেলখানার ছোট্ট দরজা দিয়ে মাথা নীচু করে বের হয়ে আসি আমি। বাংলা সিনেমার মত আমার জন্য কেউ বাইরে অপেক্ষায় নেই। জেলখানার গেটের দশহাত দূরে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাই আমি। সিগারেট খেতে খেতে নাজিমুদ্দীন রোডের দুইপাশকে দেখতে থাকি আমি। আগের চেয়েও অনেক ব্যস্ত হয়ে গেছে এই রোড। রিকশা, গাড়ি আর মানুষের যেন মেলা বসেছে। একটা ফাঁকা রিকশা দেখে হাত তুলে থামতে ইশারা করি আমি। ঘ্যাচ করে ব্রেক কষে প্রায় আমার গায়ের উপর এসে থেমে যায় রিকশাটা। আমি কোনো কথা না বলে রিকশায় উঠে বসি। রিকশাওয়ালা ঘাড় ঘুড়িয়ে বলে, ‘কই যাইবেন চাচা মিয়া’।

চাচা মিয়া সম্বোধনটা বুকের মধ্যে ধাক্কা হয়ে বাজে। বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাসকে বুকের ভিতরে আটকে ফেলি আমি। যে কোনো একটা ভাল হোটেলে নিয়ে চলো।

‘কেমুন হোডেলে যাইবেন? ফকিরাপুলের ওই দিকে কয়ডা হোডেল আছে। হররাত একশ টাহায় থাকবার পারবেন। চলবো?

‘হ্যাঁ চলবে। ওইদিকেই নিয়ে চলো।‘ মৃদুস্বরে বলি।

ফকিরাপুলের দিকে এগিয়ে চলে রিকশা। দুপুরের তেজ কমে গিয়ে বিকেলের নম্রতা ফিরে আসছে ঢাকা শহর জুড়ে। বুভুক্ষের মত চারপাশের শহরটাকে গিলতে থাকি আমি। এই একটা শহরকেই চিনি আমি। এখানেই জন্মেছি আমি, এখানেই বড় হয়েছি। তারপর এখানেই কারাবাস। কে জানে, এখানেই হয়তো একদিন মৃত্যু হবে আমার। তারপর নারিন্দায় আজীবন বসবাস। একটা মাত্র শহরেই আমার সম্পূর্ণ জীবনচক্র। ভাবতেই হাসি পেয়ে যায় আমার।

আগের চেয়ে অনেক ব্যস্ত এখন ঢাকা শহর। চারপাশে বিশাল বিশাল দালান উঠেছে। এগুলো বিশবছর আগে ছিল না। রাস্তাগুলো আগের চেয়ে চওড়া হয়েছে। ব্যস্ততা বাড়লেও শহর যে আগের চেয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়েছে, সেটা চোখ এড়ায় না আমার। লোকজনের চোখেমুখে অভাব ভাবটাও অনেকখানি কেটে গিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে আগের চেয়ে বেশ সুখে শান্তিতেই আছে মানুষজন।

রিকশাওয়ালা ফকিরাপুলের একটা হোটেলের সামনে নামিয়ে দেয় আমাকে। দুইদিনের অগ্রীম টাকা দিয়ে একটা সিঙ্গল রুম বেছে নেই আমি। হোটেল বেয়ারা জোর করেই আমার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে রুম পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। ওকে পঞ্চাশ টাকা বখশিশ দিতেই কৃতজ্ঞতায় প্রায় আনুভূমিক হয়ে কুর্নিশের মত করে সালাম জানায় আমাকে। দরজা দিয়ে বের হতে গিয়েও আবার ফিরে আসে সে। জিজ্ঞেস করি, ‘কিছু বলবা?‘

‘স্যার, যদি কিছু লাগে তাহলে অধমকে স্মরণ কইরেন। বেডের মাথার কাছে একটা বেল আছে। ওটাতে টিপ দিলেই বান্দা এসে হাজির হবে।‘ হাত কচলে তেল চিটচিটে গলায় বলে সে।

‘কিছু লাগবে না আমার। তুমি এখন যেতে পারো।‘

‘সব ব্যবস্থায়ই এইখানে আছে, স্যার। শুধু বললেই হবে।‘ গলা নামিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের মত বলে সে।

কিসের ব্যবস্থা আছে বুঝতে অসুবিধা হয় না আমার। ‘কোনো ব্যবস্থা লাগবে না আমার।‘ কঠোর গলায় বলি। ‘কাল সকাল পর্যন্ত ঘুমোবো আমি। কেউ যেন ডিস্টার্ব না করে।‘

আমার কণ্ঠস্বরের কঠোরতা দেখেই হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে দ্রুতগতিতে প্রস্থান করে সে।

কাপড় চোপড় না খুলেই বিছানায় শরীরটাকে এলিয়ে দেই আমি। আরামদায়ক নরম বিছানায় শোয়ামাত্রই ঘুমের অতল রাজ্যে তলিয়ে যাই। কত কতকাল ঠিকমত ঘুমোই না আমি।

পরেরদিন দুপুরবেলা ঘুম ভাঙে আমার। তখনও ম্যাজম্যাজ করছে গা। যদিও পেটের মধ্যে ছুঁচো দৌঁড়োচ্ছে, তারপরেও আরামদায়ক বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না। জোর করে শরীরের আলস্যকে অবহেলা করি আমি। মেলা কাজ পড়ে আছে। আধাঘণ্টার মধ্যে হোটেল থেকে বের হয়ে আসি। পাশের একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে ভূনা ইলিশ আর খাসির মাংস দিয়ে পেটপুরে ভাত খেয়ে নিই।

হোটেল থেকে বেরিয়েই ওয়ার্ডেনের কথাটা মনে পড়ে যায়। একটা সেলুনে ঢুকে পড়ি আমি। নাপিত চুল কাটার আগে নিজের চেহারাটাকে ভালো করে খুটিয়ে দেখি। কাঁচাপাকা চুল আর খোঁচাখোঁচা সাদা দাঁড়িতে বয়স্ক একজন লোক মনে হচ্ছে আমাকে। জেলখানার সামনে রিকশাওয়ালা যে আমাকে চাচা সম্বোধন করেছিল তার জন্য মনে মনে ক্ষমা করে দেই তাকে। চুল দাঁড়ি কাটিয়ে চুলে কলপ করে নেই।

সেলুন থেকে বের হতেই খেয়াল হয় যে আজকে রোববার। গির্জায় যাওয়ার সুপ্ত একটা ইচ্ছা জাগে মনে। দীর্ঘদিন প্রার্থনা করি না আমি। জেলের প্রথম পাঁচ বছর ফাদার বেনেডিক্ট নিয়মিতই আসতেন আমাকে দেখতে। প্রতিবারই বিদায় নেবার আগে প্রার্থনা করতেন আমার জন্য। সেই প্রার্থনায় আমিও অংশ নিতাম। পাঁচ বছর পরে ফাদার বেনেডিক্ট আর আসেন নি কখনো। হয়তো মারা গিয়েছিলেন তিনি। আশির উপরে বয়স ছিলো ফাদারের। মরে যাওয়াটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক ব্যাপার। কাকরাইল খুব বেশি দূর নয় এখান থেকে। কিন্তু কঠোর হস্তে সেটাকে দমন করি আমি।

জেলে থাকতেই জেনেছি রোববারকে ছুটির দিন থেকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে এরশাদ সাহেব। চারিদিকের ব্যস্ততা দেখে তাই খুব একটা অবাক হই না আমি। একটা রিকশা নিয়ে বায়তুল মোকাররমে চলে আসি। একটা অংশ জুড়ে সেই আগের মতই বিদেশি স্যুটকেসে, ব্যাগের বেচাকেনা চলছে। দরদাম করে পনেরো শো টাকা দিয়ে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ব্রিফকেস কিনে ফেলি। ওখান থেকে নবাবপুর চলে আসি। হার্ডওয়্যারের দোকানে ঢুকে ছোট্ট একটা টর্চলাইট আর হাত খানেক লম্বা একটা শাবল কিনি। শাবলটাকে ব্রিফকেসের মধ্যে ভরি আর টর্চলাইটটাকে চালান করে দেই প্যান্টের পকেটে।

হার্ডওয়্যারের দোকান থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নেই। কোথা যাবো জিজ্ঞেস করলে বলি বাদামতলি ঘাটে।

‘স্যার মনে হয় কেরানিগঞ্জ যাইবেন?’ রিকশাওয়ালা শুধায়।

‘কীভাবে বুঝলে?’ পালটা জিজ্ঞেস করি আমি।

আমার বাড়ি কেরানিগঞ্জে। বাদামতলি ঘাট শুইনা অনুমান করছি নদীর ওইপারে যাইবার পারেন। কই যাইবেন কইলে আমিই আপনেরে লইয়া যামু। বাদামতলিতে নামনের দরকার নাই।

এবার আমার অবাক হবার পালা। ‘রিকশা কী আজকাল নদীতেও চলাচল করছে নাকি?’ সকৌতুকে বলি তাকে।

‘রিকশা নদীতে চলবো ক্যান স্যার?’ ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসে রিকশাওয়াল। আমার করা মজাটা বুঝতে পেরেছে। ‘ব্রিজ হইছে না। ব্রিজের উপর দিয়া উড়াইয়া নিয়া যামু আপনেরে।‘

এতক্ষণে রহস্য উদঘাটন হয় আমার। বুড়িগঙ্গার ওপরে তাহলে ব্রিজও তৈরি হয়ে গিয়েছে।

রিকশাওয়ালা তার কথা রাখার জন্যই কি না জানি না। সত্যি সত্যিই উড়িয়ে নিয়ে যায় আমাকে ব্রিজের উপর দিয়ে। ব্রিজ থেকেই চোখে পড়ে বুড়িগঙ্গার কালচে ময়লা জল। নদী নয়, যেনো বড়সড় ড্রেন একটা। এক সময় স্বচ্ছ জল ছিলো এখানে। বিয়ের আগে এবং পরে কতদিন কবিতাকে নিয়ে নৌকোয় চেপেছি আমি। বিকেলের স্নিগ্ধ আলোয় সদরঘাট থেকে নৌকোয় চেপে লালবাগ পর্যন্তও চলে গিয়েছি কখনো কখনো। নৌকো ছাড়তেই একদিকে কাত হয়ে জলের মধ্যে হাত ডুবিয়ে সুরেলা কণ্ঠে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুরু করতো কবিতা । তার আগে মাঝিকে বলতো, ‘মাঝি ভাই, আমি এখন রেডিও বাংলাদেশ হবো। আপনার কোনো আপত্তি নেইতো?’ মাঝি না বুঝেই হাসতো। গলার কাছে কিছু একটা উঠে আসে আমার। কষ্ট করে সেটাকে ফেরত পাঠাই আমি। মাথা ঝাঁকিয়ে স্মৃতিটাকে কবর দেই।

কেরানিগঞ্জে আগের সেই গ্রাম্যভাব ছুড়ে ফেলেছে। চারিদিকে নগরায়নের সুস্পষ্ট চিহ্ন। একটু শংকিত হয়ে উঠি আমি। রিকশাওয়ালা ঠিক কোথায় নিয়ে যাবে তা জিজ্ঞেস করে। নিমতলি গ্রামের কথা বলি ওকে। কিছুক্ষণের মধ্যে নিমতলিতে নিয়ে আসে সে আমাকে। রাস্তার মোড়ে আমাকে নামিয়ে দিতে বলি। রিকশাওয়ালা পয়সা নিয়ে বিদায় নিতে পাশের চায়ের দোকানের দিকে এগিয়ে যাই আমি। সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাকে। চায়ের দোকানের চেয়ে ভালো জায়গা আর নেই এর জন্য।

আলো-আঁধারির খেলা শুরু হতেই চায়ের দোকান থেকে বের হয়ে আসি আমি। চলে যাই গ্রামের শেষপ্রান্তে। সুনসান নির্জনতা এখানে। আগাছার জঙ্গল এখনও সেই আগের মতই আছে। নগর এখনো তার আগ্রাসন চালাতে পারে নি এখানে। পকেট থেকে ছোট্ট টর্চলাইটটা বের করি। ওটাই এখন বাতিঘর হয়ে পথ দেখায় আমাকে। জঙ্গলের মধ্যের আঁকাবাঁকা পায়ে হাঁটা পথ দিয়ে কিছুদূর যেতেই চলে আসি কাঙ্ক্ষিত জায়গায়।

কোনো কালে এক প্রতাপশালী হিন্দু জমিদারের প্রাসাদ ছিলো এটি। দেশ বিভাজিত হতেই বিদায় নিয়েছেন তিনি। অপাঙতেয় হবার দুঃখে তার ফেলে যাওয়া প্রাসাদ এখন পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তুপে। স্থানীয় লোকজন ইট-কাঠ খুলে নিয়ে গিয়ে কংকাল বানিয়ে ফেলেছে একসময়কার তিলোত্তমা প্রাসাদটিকে।

টর্চের আলো ফেলে ফেলে সাবধানে এগোই আমি। অনেক পরিচিত জায়গাটাই সময়ের ব্যবধানে এখন অপরিচিত ঠেকছে আমার কাছে। ছোট্ট একটা শ্যাঁওলা পড়া ভাঙাচোরা দেয়াল আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। ওটাকে দেখেই স্বস্তি পাই। নাহ, ঠিক জায়গাতেই এসেছি। দেয়ালটাকে টপকে ওপাশে যেতেই ভাঙা ইটের স্তুপটা চোখে পড়ে। ঢিবির মতো হয়ে রয়েছে। চারপাশে ঘন হয়ে জন্মেছে বুনো ঘাসের দল।

একটুখানি ঘাড়টাকে ঘুরিয়ে বাদিকে তাকাই আমি। ঘন ঝোপে ছাওয়া একটা জায়গা চোখে পড়ে আমার। নিজের অজান্তেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় আমার। ওখানেই মাটির নীচে শুয়ে আছে জাক্কু। পলকের জন্য বিবেকে একটু খোঁচা লাগে আমার। মুহুর্তের মধ্যেই অবশ্য সামল নেই আমি। ধীরে ধীরে আটকে রাখা নিঃশ্বাসকে মুক্ত করে দেই। এ খেলার নিয়মটাই এমন নিষ্ঠুর ধরনের। হয় মারো, না হয়তো মরো। জাক্কুর চেয়ে একটু দ্রুতগতিতে চাল দিয়েছিলাম আমি। সে কারণেই বেঁচে আছি এখনো। তা না হলে ওর বদলে আমাকেই শুয়ে থাকতে হতো এখানে।

হাঁটু মুড়ে বসে দুহাত দিয়ে ভাঙা ইটগুলোকে সরানো শুরু করি আমি। সড়সড় করে কিছু একটা সরে যায় সেই শব্দে। সাপটাপ হবে হয়তো। ওদেরকে নিয়ে অবশ্য মাথা ঘামানোর সময় নেই আমার। বিশবছর আগের সময়কে খুঁজে ফিরছি আমি। ইটগুলো সরানো হতেই ঘাসবিহীন জমিন বের হয়ে আসে। ব্রিফকেসের মধ্য থেকে শাবলটাকে বের করি আমি। বৃষ্টির বুনো ভালোবাসার স্পর্শে নবপরিণীতা নারীর মতো কোমল এবং সিক্ত হয়ে আছে জমিন। শাবল দিয়ে কোপ দিতেই তার নরম বুকে ঢুকে যায় অনায়াসে সেটা। রক্তের মধ্যে টগবগে উত্তেজনা নিয়ে মন্থন শুরু করি আমি। দুই মিনিটের মধ্যেই মন্থন শেষ হয় আমার। কবরের মধ্যে যেমন কাফন মোড়ানো লাশ শুয়ে থাকে, ঠিক সেরকম করেই শুয়ে আছে হলুদ পলিথিনে মোড়া প্যাকেটটা। ক্ষীপ্র হাতে ওটা খুলতেই সোনালি বিস্কুটগুলো ঝিলিক দিয়ে উঠে। চোখের কোণে একবিন্দু অশ্রু কণা এসে জমা হয় আমার। ভেজা চোখে ওগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি আমি। আমার সমস্ত যৌবনের, নাহ শুধু যৌবন নয়, পুরোটা জীবনের দামে কেনা সোনালি সম্পদ।

আবেগকে সংবরণ করতে অবশ্য বেশি সময় লাগে না আমার। মুঠো মুঠো করে দ্রুতগতিতে সোনালি বিস্কুটগুলোকে চালান করে দেই ব্রিফকেসের মধ্যে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ডান হাতে হাতে তুলে নেই ব্রিফকেসটা। অসম্ভব রকমের ভারি হয়ে আছে ওটা। বিশবছর আগে বহন করতে কষ্ট হয় নি। কিন্তু এখন হচ্ছে। ব্রিফকেসের ওজনের সাথে ভারসাম্য রাখার জন্য বাদিকে হেলে গিয়েছে শরীরটা আমার। ওভাবেই জঙ্গল থেকে বের হয়ে আসি আমি। মোড়ের ধারের সেই চায়ের দোকানটার কাছে আসতেই ভাগ্যক্রমে একটা সিএনজি পেয়ে যাই।

সিএনজিতে চেপে প্যারিদাস রোডে চলে আসি আমি। এসময়টাতে আগে ঢাকা শহরের চোখ ঘুমোতে যাবার আগের মত নিমিলীত হয়ে যেতো। এখন দেখে মনে হচ্ছে যে, এ শহর বোধহয় বুড়ো মানুষের মতো চিরস্থায়ী নিদ্রাহীন রোগে ভুগছে। চারিদিকে মানুষজন গমগম করছে। সিনজি ছেড়ে দিয়ে হাঁটাপথ ধরি আমি। ছোট্ট একটা সরু গলি পেরিয়ে ভিতরের দিকে চলে আসি। হাজি সাহেবকে খুঁজে পাওয়াটা জরুরী আমার। সোনাগুলোর একটা ব্যবস্থা আজ রাতেই করতে হবে।

গলির মোড়ে রেষ্ট্যুরেন্টটা এখনও তেমনই আছে। আগের মতই অনুজ্জ্বল, সাদামাটা, ম্যাড়মেড়ে। ভিতরে ঢুকি আমি। কাউন্টারেই হাজি সাহেবকে এসময় পাবার কথা। কিন্তু না। হাজি সাহেব নয়, তার বদলে চকচকে চেহারার এক তরুণ বসে আছে কাউন্টারে। আমাকে কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় তরুণ। একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করি, ‘হাজি সাহেব কোথায়?’

আমার দিক থেকে চোখে সরিয়ে তরুণের চোখ নেমে আসে আমার বা হাতে ধরা ব্রিফকেসটার দিকে। গায়ে এখনও কেরানিগঞ্জের কাদার দাগ রয়ে গিয়েছে। নিজের অজান্তেই ব্রিফকেস ধরা মুঠোটা শক্ত হয়ে আসে আমার। প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশি সময়ই ব্রিফকেসটার দিকে তাকিয়ে থাকে তরুণ। ধীরে ধীরে ব্রিফকেস থেকে সরে উর্ধ্বমুখি হয় তরুণের দৃষ্টি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় আমার দিকে। ঠোঁটের কোণায় বাঁকা একটু হাসি ফুটে উঠে তার। আঙুল তুলে উপরের দিকে নির্দেশ করে সে। তারপর বলে, ‘বেহেশতে চলে গেছেন।‘

একটু দমে যাই আমি। এখানে আসলে সোনাগুলোর ব্যবস্থা করা যাবে সেই ভরসাটা ছিলো। হাজি সাহেব মারা যাওয়ায় সবকিছু গুবলেট হয়ে গেলো। এত টাকার সোনা নিয়ে চলাফেরা করাটা বিপদজনক। নিরাপদ আর কোনো জায়গা জানা নেই আমার। কোনো একটা হোটেলে ফিরে যেতে হবে আমার। ঠাণ্ডা মাথায় বসে পরবর্তী কী করণীয় ঠিক করতে হবে। হতাশ আমি নিঃশব্দে ঘুরে দাঁড়াই। বের হয়ে যেতে থাকি রেষ্ট্যুরেন্ট থেকে। পিঠের উপরে তরুণের খরতাপ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিটা অনুভব করতে পারি। কয়েক কদম গিয়েই কী মনে করে ধীর পায়ে ফিরে আসি আমি। তরুণ এখনও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক আমার দিকে নয়। তাকিয়ে আছে আমার ব্রিফকেসটার দিকে। ঠোঁটের কোণের বিদ্রুপের হাসিটা আর নেই। গম্ভীর হয়ে আছে। চিন্তিত। ঠোঁটের একপাশ দাঁত দিয়ে কামড়াচ্ছে।

আমি কাউন্টারের কাছে এসে দাঁড়াই। তরুণ নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এক ধরনের অলস সতর্কতা তার চোখে মুখে। বহুদিন আগে যে খেলাটা খেলতাম, সেটাই খেলবো এখন আমি। হাজি সাহেবের সাথে এই খেলা খেলার করার প্রয়োজন পড়তো না আমার শেষের দিকে। কারণ তিনি খুব ভালো করেই চিনতেন আমাকে। এখন মনে হচ্ছে দেখি কী হয়। শেষ চেষ্টা আর কী। বা হাত থেকে ডানহাতে সরিয়ে আনি ব্রিফকেসটা আমি। মুক্ত বা হাতটাকে উঁচু করে তুলে আনি বা গালের কাছে। ঠিক জুলফির নীচে। তিনটা আঙ্গুল দিয়ে গালটাকে হালকাভাবে চুলকোতে থাকি আমি। তারপর নিরীহ স্বরে জিজ্ঞেস করি, ‘বাথরুমটা কি একটু ব্যবহার করতে পারি?’

দ্রুত বদলে যায় তরুণের চেহারা। চোখ দুটো বিস্ময়ে বিস্ফারিত হতে গিয়েও সামলে নেয় তড়িৎ গতিতে। ঘোড়েল ছেলে। অনেক ঘাটের জল খাওয়া। এবার সরাসরি আমার দিকে তাকায় সে। অনুচ্চ স্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘বড় না ছোটো?’

‘বড়।‘ হাফ ছাড়া গলায় বলি আমি।

তরুণের চোখে সমীহ জাগে। গলা উঁচিয়ে টেবিল পরিষ্কার করতে থাকা একটা অল্পবয়েসী কিশোরকে ডাকে সে। ছেলেটা কাউন্টারের কাছে আসতেই বলে, ‘এই যাতো স্যাররে বাথরুমের পথটা দেখায় দিয়া আয়।‘ অবাক হয়ে কিশোরটি আমার দিকে তাকায়। ওর দৃষ্টি একঝলক ঘুরে যায় আমার ব্রিফকেসের দিকে। তারপর দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলে, ‘আহেন আমার লগে।‘

স্বস্তির পাশাপাশি বেশ মজাও লাগে আমার। বিপজ্জনক খেলাটা সেই আগের মতই আছে। বিশ বছরেও পরিবর্তন হয় নি কিছু। ছেলেটাকে অনুসরণ করে রেষ্টুরেন্টের ভিতরের দিকে চলে আসি। কিচেন পার হয়ে পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে যাই আমরা। অন্ধকার একটা সরু গলি দিয়ে ছেলেটা নিয়ে আসে আমাকে একটা দোতলা দালানের পিছনের দিকে। আগে এটা একতলা ছিলো। পিছনের দিকে লোহার একটা দরজা। আস্তে করে তিনটা টোকা দেয় ছেলেটা দরজায়। একটু পরেই দরজাটা সামান্য খুলে যায়। সেখান দিয়ে মাথা বের করে কামানো মাথার পেটানো শরীরের বলিষ্ঠ এক যুবক। ছেলেটার সাথে ওর নিঃশব্দে চোখে চোখে কথা হয়ে যায়। আমাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে যুবক। তারপর অনন্তকাল পরে দরজাটা আরেকটু খুলে ধরে সে। প্রায় শোনা যায় না এমন স্বরে বলে, ‘আসুন।‘

আমি ভিতরে ঢুকতেই পিছনে দরজাটা বন্ধ করে দেয় যুবক। তাকে অনুসরণ করে বড় একটা রুমে চলে আসি। উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছে রুমটা। চারিদিকে টেবিল চেয়ার সাজানো। একপাশে বারটেন্ডারের কাউন্টার। বিশ বছরে এই রুমটার খুব সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে। দেয়ালগুলো একটু ঝলমল করছে। চেয়ার-টেবিলগুলো আগের চেয়ে চকচক করছে। এটুকুই। এর বাইরে বারটা সেই আগের মতই আছে।

কোণার দিকের খালি টেবিলের দিকে এগিয়ে যায় আমি। একটা চেয়ার টেনে দেয়ালের দিকে পিঠ দিয়ে বসি। ব্রিফকেসটাকে নামিয়ে রাখি পায়ের কাছে। কোনো ওয়েটার নেই এখানে। বারটেন্ডারই এগিয়ে আসে আমার দিকে।

এক বোতল হুইস্কির অর্ডার দেই। বারটেন্ডার চলে যেতেই চারিদিকটা সতর্ক চোখে পর্যবেক্ষণ করে নেই। বেশ বড়সড়ই রুম এটা। বেশ কিছু টেবিল সাজানো রয়েছে ঘরের চারপাশ জুড়ে। তবে বেশিরভাগই এখন খালি। মাত্র দুটো টেবিলে লোক দেখতে পেলাম। একটাতে দুজন লোক বসে প্রায় ঝুঁকে পড়ে পরস্পরের সাথে মাথা ঠেকিয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে। এদের মধ্যে একজন রবিউলের মত লিকলিকে রোগা। অন্যজনকে দিয়ে প্রফেশনাল রেসলিংও করানো যাবে। এমনই তার স্বাস্থ্য। আরেকটাতে জনাতিনেক স্ফূর্তিবাজ লোক বসে শরবতের মতন করে মদ গিলছে আর সান্তা ক্লজের মতো হোহো করে হাসছে। ঘরের এক কোণায় বুকের উপর দুইহাত ভাঁজ করে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে আমাকে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া যুবকটি। থেকে থেকে তার মাথা ক্যামেরার মত ঘুরে বেড়াচ্ছে রুমের মধ্যে থাকা লোকজনের উপর দিয়ে। সে যে বাউন্সার তা এক নজর দেখলেই যে কেউ বলে দিতে পারবে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেতে করে একটা হুইস্কির বোতল আর এক খালি গ্লাস নিয়ে আসে বারটেন্ডার। সাথে একটা কাঁচের মগ ভর্তি বরফের টুকরো। গ্লাসে কয়েকটা বরফের টুকরো নিয়ে বোতল থেকে হুইস্কি ঢালি ওতে। তারপর দীর্ঘ করে একটা চুমুক দেই গ্লাসে। হুইস্কি গলা দিয়ে নামতে মস্তিষ্কে গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটে আমার। দীর্ঘদিনের অনভ্যস্ত শরীরটা বিদ্রোহ করে বসে এই অনাহুত আক্রমণের বিরুদ্ধে। মনে হয় গলায় কী যেন আটকে গেছে আমার। দম বন্ধ হয়ে আসে। দমবন্ধকে ছোটানোর জন্যই হয়তো প্রবল কাশি শুরু হয় আমার। কাশির দমকে টেবিলের দিকে ঝুঁকে পড়ে মাথাটা আমার।

ঠিক তখনই কোমল কোনো হাত চাপড় দেয় আমার পিঠে। ‘বাচ্চা ছেলে নাকি? বড়দের জিনিস হজম করতে পারেন না যখন তখন খান কেন? দুদু খেলেইতো চলে।’ রিনরিন কন্ঠে বিদ্রুপ করে ওঠে মেয়েলি একটা কন্ঠ। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন দিকে তাকাই আমি। গলার কাছে নীলা বসানো হারটা চোখে পড়ে আমার প্রথম। তারপর উজ্জ্বল গৌরবর্ণের মরাল গ্রীবা। গ্রীবা ছাড়িয়ে অতঃপর গ্রীবার মালিককে দেখি আমি। মনে হচ্ছে যেন নীল সাগর থেকে উঠে আসা কোনো নীলপরি। মেয়েটার সারা গায়ে নীলের ছড়াছড়ি। নীল শাড়ির সাথে সামঞ্জস্য রেখে হাতাবিহীন লো কাট নীল ব্লাউজ পরেছে সে। শাড়ির আচলটা পর্বতশৃঙ্গদ্বয়কে ঢাকার বদলে সরু ফিতের মত করে চলে গিয়েছে তাদেরকে ভাগ করে দিয়ে। মেয়েটা তার সারা শরীরের নীলকে আরো উস্কে দিতেই যেন গলায় পরেছে নীলা বসানো হার আর কানে নীল রঙের পাথর বসানো দুল। নীলের এতো প্রাচুর্য দেখেই হয়তো, মেয়েটার অন্তর্বাসগুলোও নীল কি না, এরকম একটা বিচ্ছিরি চিন্তা এক মুহুর্তের জন্য খেলা করে গেলো আমার মাথায়।

পিঠে মেয়েটার চাপড় খেয়েই হয়তো কাশির দমকটা কিছুটা কমে আসে আমার। ‘অনেকদিন পরে খেলামতো তাই।‘ বিব্রত স্বরে বলি আমি। আমার পিছন থেকে সামনে চলে আসে মেয়েটা। বিধাতা অকৃপণভাবে যৌবনসুধা ঢেলেছে মেয়েটার সারা অঙ্গপাত্রে। সেই সুধার ভারেই যেন গুরুবক্ষা হয়েছে সে। নীল পর্দার নিরাপত্তা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে পয়োধরযুগল উদ্ধতভঙ্গিতে। সারা শরীরে অতলান্ত সমুদ্রের সুবিশাল সব ঢেউ তুলে আমার পিছন থেকে টেবিলের সামনে চলে আসে মেয়েটা। অনুমতি ছাড়াই সামনের চেয়ারে বসে পড়ে সে। আমার ডানদিকে দেয়ালে একটা স্লাইড ডোর আছে। দেয়ালের রঙের সাথে একই রঙ হবার কারণে চোখে পড়ে নি আমার। ওদিক দিয়েই নিঃশব্দে আমার ডানপাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো মেয়েটা আমার অজান্তে।

বাইশ তেইশ বছর হবে মেয়েটার বয়স। বাঙালি মেয়েদের তুলনায় গায়ের রঙ একটু বেশিই ফর্সা। শাড়ি পরার আর ভরাট শরীরের কারণে আরেকটু বেশি মনে হচ্ছে। মেয়েটাকে শাড়ি পরা দেখে একটু অবাকই লাগছে আমার। আজকে সারাদিনেও কোনো শাড়ি পরা অল্পবয়েসী মেয়ে চোখে পড়ে নি আমার। মেয়েরা আজকাল বোধহয় দাদি-নানি হওয়ার আগ পর্যন্ত শাড়ি-টাড়ি পরে না। আমাদের দেশে এই ধরনের স্লিভলেস ব্লাউজসহ শাড়ি পড়তো ষাটের দশকের সাহসী নারীরা। তারপর থেকেই কেন যেনো মেয়েদের মধ্যে ভয় ঢোকা শুরু হয়েছে। আর সেই ভয়ের সাথে পাল্লা দিয়েই মেয়েদের গায়ে পোশাক বাড়তে শুরু করেছে। এখনতো মনে হয় বাহারি রঙের বোরকাই মেয়েদের সবচেয়ে পছন্দের পোশাক।

চেয়ারে বসেই ঘাড় ঘুরিয়ে নিঃশব্দে হাত ইশারা করে মেয়েটা বারটেন্ডারকে। ওর সাবলীল ভাবভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখানে নিয়মিতই আসে সে। বারটেন্ডারও এসে একটা খালি গ্লাস দিয়ে যায় আমাদের টেবিলে। আড়চোখে চারপাশে তাকাই আমি। এরকম একটা সুন্দরী মেয়ে বারে এসে বসার পরও কারো মধ্যেই সামান্যতম কোনো উত্তেজনা নেই। সুঠামদেহী বাউন্সার এখনও তার জায়গাতেই সটান দাঁড়িয়ে রয়েছে। অন্য খদ্দেররাও যার যার নিজের কাজে মগ্ন। একটু অবাকই লাগে আমার।

‘কীভাবে খেতে হয় শিখিয়ে দিচ্ছি আমি।‘ গ্লাসের দিকে হাত বাড়ায় মেয়েটা। কয়েক টুকরো বরফ ফেলে হুইস্কি ঢালে তাতে। তারপর আমার দিকে বেশ খানিকটা ঝুঁকে পড়ে সে। নিজের অজান্তেই আমার চোখে চলে যায় মেয়েটার গলায়। ফর্সা গলার নিচে বুকের উপর উজ্জ্বল হয়ে ফুটে আছে নীলাটি। নীলা পেরিয়ে আরো নীচের দিকে নেমে যায় আমার দৃষ্টি। ঝুকে বসার কারণে মসৃণ শ্বেতকপোত দুটো খাঁচার বাধন ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসার পায়তারা করছে। নিরাবরণ নিখুঁত এবং নিটোল দুটো নীলপদ্মের কারণে বুকের নির্জনে কোথাও নিঃশব্দে দামামা বেজে উঠে আমার। ঢোক গিলি আমি। দ্রুত চোখ সরিয়ে নেই সুকঠিন সম্মোহন থেকে। আমার অবস্থা দেখে মজা পায় মেয়েটি। সারা চোখেমুখে কৌতুক খেলা করছে তার। খিল খিল করে হেসে উঠে। ইচ্ছা করেই কাধ ঝাঁকিয়ে আচলটাকে সরিয়ে দেয় আরেকটু। ঝুঁকে আসে আরো। বিড়াল যেভাবে ইঁদুরকে নিয়ে খেলে, আমাকে নিয়েও সেভাবে খেলায় মেতে উঠেছে মেয়েটা।

হাতের ভরা গ্লাসটা মার দিকে বাড়িয়ে দেয় মেয়েটা। আমারটাও আমি তুলে ধরি। চিয়ারস করে সে। তারপর আস্তে করে রক্তরাঙা ঠোঁটে ছোঁয়ায় আলতো করে। ছোট্ট একটা চুমুক দেয় সে। তারপর বলে, ‘ঠিক এভাবে খেতে হবে শুরুতে। তাড়াহুড়ো করা চলবে না।‘ মেয়েটার দেখাদেখি আমিও ছোট করে চুমুক দেই।

‘এইতো গুড বয়। দ্রুত শিখে গিয়েছেন। আপনাকে দিয়ে হবে।‘ সপ্রশংস চোখে তাকায় সে। মুখে প্রশ্রয়ের হাসি। মাথার মধ্যে চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে আমার। এই মেয়েটাই কি কন্টাক্ট? কন্টাক্ট হলে কাজের কথায় আসছে না কেনো। ঢোকার পর থেকে এখন পর্যন্ত একবারো আমার ব্রিফকেসের দিকে তাকায় নি মেয়েটা। শুরু থেকেই খুনসুটি করে চলেছে। এদের সাথে আগেও কাজ করেছি আমি। এই তারল্য আগে কখনো দেখি নি। সরাসরি কাজের কথাতে নেমে যায় এরা।

‘সুন্দরী শিক্ষক হলে সবাই-ই দ্রুত শেখে। আমিও শিখছি।‘ হালকা গলায় বলি আমি। রক্তের মধ্যে তারল্য অনুভব করছি। এলকোহলের নাকি হরমোনের কারণে ঠিক বুঝতে পারছি না।

‘ওমা মা, আপনিতো দেখছি ভালোই পাম দিতে পারেন। মেয়ে পটানোর ওস্তাদ।‘ চোখ মটকে বলে সে।

‘কই আর পটাতে পারলাম।‘ কৃত্রিম উদাসস্বরে বলি আমি।

‘হয়তো পটেই আছে, আপনি জানেন না। যে রকম হাঁদুরাম আপনি।‘ ক্যামেরার শাটারের মত চকিতে বা চোখ টিপ দেয় মেয়েটা। মুক্তোর মতো দাঁত বের করে হাসছে।

‘হাঁদুরাম বলেইতো ডাসা পেয়ারার দিকে শুধু তাকিয়েই থাকি। কামড় বসাতে পারি না।‘ বিশ্ববেহায়া এরশাদের মতই হাভাতে ভাবে আমি তাকিয়ে থাকি মেয়েটার বুকের দিকে।

‘এই যে মশাই, মেয়েদের বুকের দিকে ওভাবে তাকাতে নেই। চোখের পর্দা করেন। নাহলে কিন্তু চোখ গেলে দেবো সুঁই দিয়ে। কানা হয়ে ভিক্ষে করতে হবে তখন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে।‘ কৃত্রিম রোষে চোখ মটকে বলে মেয়েটা।

‘সুঁই গেথে আর কী হবে। এই সৌন্দর্যের ঝলকে এমনিতেই কানা হয়ে গিয়েছি আমি।‘

‘হ, কইছে।‘ জিভ বের করে ভেংচি কাটে মেয়েটা। একটানে আঁচলটাকে বুকের উপর টেনে আনে সে। ঢাকা পড়ে যায় বুনো সৌন্দর্য। হতাশা নেমে আসে আমার চোখে। আমার অবস্থা দেখে ঠোঁট বাকিয়ে হাসে সে। সামনের দিকে ঝুঁকে এসে ষড়যন্ত্রকারীদের মত ফিসফিস করে বলে, ‘উপরে রুম আছে। চলেন যাই। এতই যখন কানা হবার শখ। ওখানেই না হয় করে দেবো সেটা। তারপর কানা হয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করবেন গান গেয়ে গেয়ে।‘ সুর করে গান ধরে সে অনুচ্চ কণ্ঠে, ‘দ্বীনের নবী মোস্তফায়………।।‘ গান শেষ করতে পারে না মেয়েটা। নিজের স্থূল রসিকতায় নিজেই হেসে গড়িয়ে পড়ে।

উপরে যাবার প্রস্তাবে ইতঃস্তত করি আমি। আমার কন্টাক্ট যে কোনো মুহুর্তে এসে যাবে। সোনাগুলোর একটা ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না মনে। আবার ভিন্ন চিন্তাও খেলা করছে মনে। উপরে গেলে ক্ষতি নেই। এটা নিরাপদ জায়গা। সোনাগুলো আমার সাথে রুমে নিরাপদেই থাকবে। কাল না হয় কন্টাক্টের কাছে গচ্ছিত রাখা যাবে ওগুলোকে।

‘কই চলো, যাবে না?’ আদুরে গলায় টেনে টেনে বলে মেয়েটা। আপনি থেকে এক লহমায় তুমিতে নেমে এসেছে মেয়েটা। আমার ইতঃস্তত অবস্থা দেখেই কি না জানি না। কাধ ঝাঁকি দেয় মেয়েটা। খসে পড়ে আঁচল। অর্ধনগ্ন শুভ্র কপোত দুটো উঁকি দেয় নীল রঙের বাসা থেকে। ক্ষুধাতুর চোখে লোভীর মতো তাকিয়ে থাকি আমি সেগুলোর দিকে। সামনের দিকে বিপজ্জনকভাবে সেগুলোকে ঠেলে দেয় মেয়েটা। টেবিলের উপর রাখা আমার হাতটা ধরে ফেলে। চোখ দুটো বিদ্যুৎ শিখার মতো নাচছে। সেখানে সুস্পষ্ট আমন্ত্রণ। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। আমার হাতটা তখনও ধরে রয়েছে। নাচের ভঙিতে অর্ধবৃত্তের মত পাক খায় সে। তারপর মদির কণ্ঠে আবারো আহবান জানায়, ‘এসো।‘

এই সর্বগ্রাসী আমন্ত্রণকে রোখা রক্তমাংসের কোনো পুরুষ মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। চেয়ার থেকে উঠে পড়ি আমি। আমাকে উঠতে দেখে ঝকঝকে মুক্তোদানাগুলো বের হয়ে আসে প্রসারিত ঠোঁটের ফাক দিয়ে। পকেট থেকে চারটে পাঁচশো টাকার নোট বের করে টেবিলের উপর রাখি। তারপর মুক্ত হাতটা দিয়ে তুলে ব্রিফকেসটা তুলে নেই আমি। আমার হাতটাকে মুঠোবন্দি করে রেখেই স্লাইড ডোর খুলে ভিতরে নিয়ে আসে মেয়েটা আমাকে। স্লাইড ডোরের ওপাশেই সিড়ি। গায়ের সাথে লেপ্টে আসে মেয়েটা। শরীরের নরম তুলতুলে ছোঁয়া পাই। কতদিন, কতদিন এই ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত আমি। কারাগার শুধু জীবনের এক তৃতীয়াংশই কেড়ে নেয় নি আমার। আমার পুরো যৌবনটাকে গিলে ফেলেছে সে।

কোমল স্পর্শে শরীরের রক্ত নদীতে বান আসছে আমার। বান নয়, যেনো প্রবল কোনো সুনামি। সাগরতলের তেজি কোনো আগ্নেয়গিরির রুদ্ররোষে জন্মেছে সে। তারপর ক্ষ্যাপার মতো ছুটে চলেছে উপকূলের উদ্দেশ্যে। সবকিছুকে লণ্ডভণ্ড করে দেবার জন্য।

সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় নিয়ে আসে আমাকে সে। করিডোরের দুপাশ দিয়ে সারিসারি কামরা। দোতলাটা মনে হয় বোর্ডিং হাউজ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। একটা কামরার সামনে এসে আমার হাত মুক্ত করে দেয় মেয়েটা। ব্লাউজের ভিতরে হাত গলিয়ে বের করে আনে চাবি। দরজাটা খুলেই আমাকে টেনে নিয়ে রুমের ভিতরে নিয়ে যায় সে। পরিপাটি করে সাজানো একটা ডাবল বেড রয়েছে রুমের মধ্যে। একপাশে একটা ড্রেসিং টেবিলও চোখে পড়ে। ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দেবার জন্য ঘুরে দাঁড়ায় সে। এই সুযোগে ব্রিফকেসটাকে বিছানার নীচে চালান করে দেই আমি।

দরজা বন্ধ করে গ্রীবা উঁচিয়ে বিজয়ীর ভঙিতে তাকায় সে আমার চোখে। আদুরে বিড়ালের মত বিড়ালহাঁটা হেঁটে এসে গলা জড়িয়ে ধরে আমার। নরম তুলতুলে কম্পমান কবুতরের বাচ্চাগুলো এসে লেপ্টে যায় আমার বুকে। গলাটাকে একটু উঁচু করে লাল টুকটুকে ঠোঁট দুটোকে এগিয়ে দেয় আমার দিকে। চোখবন্ধ হয়ে গিয়েছে মেয়েটার। মাত্র চারইঞ্চি দুরত্বের এই প্রলোভনকে সামলানো এখন আমার জন্য অসম্ভব কাজ। মেয়েটার রসালো অধরের দিকে ধীরে ধীরে নেমে আসতে থাকে আমার ঠোঁটগুলো। নিঃশ্বাস গাঢ় হয়ে উঠেছে আমার। নাকের কাছে আমার নিঃশ্বাসে গরম হলকা পড়তেই চোখ খোলে মেয়েটা। মুখটাকে একপাশে সরিয়ে নেয় সে। নিশানাচ্যুত হয়ে তীব্র হতাশায় মুখ বিকৃত হয়ে যায় আমার। সেটা দেখেই ফিক করে হেসে দেয় সে। চোখে মুখে কৌতুক খেলা করছে তার। আমাকে ছোট্ট একটা ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে বিছানার দিকে ছুটে যায় সে। আমার দিকে মুখ করে বিছানায় বসে সে। দুইহাত বিছানার উপর রেখে আস্তে আস্তে করে পিছন দিকে হেলে যায় সে। বিস্রস্ত আঁচল মাটিতে লুটোচ্ছে। উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে মাখনের মত মসৃণ তলপেট, কাস্তের মত তীক্ষ্ণ বাকশোভিত সরু কোমর। ঢেউয়ের দোলায় শরীরটাকে দোলাচ্ছে মেয়েটা। পুরুষ মানুষকে উত্যক্ত করার, উত্তপ্ত করার সমস্ত অস্ত্রভাণ্ডার নিয়ে জন্মেছে এই মেয়ে। ঠোঁট গোল হয়ে গিয়েছে শিসের দেবার ভঙিতে। মুখের ভিতরে জিহ্বা সক্রিয়।। গালের বাপাশে এসে ভিতর থেকে চাপ দিচ্ছে। মার্বেল পুরে থাকার মত করে ফুলে উঠেছে এ পাশটা। ফুলে উঠা অংশটা আবার স্থির থাকছে না সবসময়। ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন ঘটছে তার। চোখের কোণায় ঝিলিক দিচ্ছে বিদ্যুতশিখা। পতঙ্গের জন্য মরণনেশার মাতাল আহবান সেখানে।

আর সহ্য হয় না আমার। রক্তের নেশায় সুন্দরবনের ক্ষুধার্ত শার্দুল যেমন লাফিয়ে পড়ে শিকারের উপর, ঠিক সেভাবেই আমি ঝাঁপ দেই মেয়েটার উপর।

মাথায় তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে ঘুম ভাঙে আমার। জানালা গলে একফালি কড়া সূর্যের আলো এসে পড়েছে আমার গালে। এর উত্তাপেই হয়তো ঘুম ভেঙেছে। কোথায় আছি সেটা বুঝতে প্রথম কয়েক সেকেন্ড অসুবিধা হয় আমার। তারপরই বিদ্যুতের ঝিলিক দিয়ে সবকিছু মনে পড়ে যায়। কিছু একটার আশংকায় পাশ ফিরে তাকাই। না, মেয়েটা নেই। ধড়াশ করে উঠে বুকটা আমার। কেন যেনো মনে হয় যে বিপদ যা ঘটার ঘটে গিয়েছে। নগ্ন শরীরটাকে ঝাকুনি দিয়ে বিছানা থেকে নেমে আসি মেঝেতে। উঁকি দিয়ে তাকাই খাটের নীচে। আমার আশংকাকে সত্যি প্রমাণ করে সেখানে কিছু নেই। গায়েব হয়ে গিয়েছে ব্রিফকেসটা। আতংকে হিম হয়ে যায় শরীরটা আমার।

আমার পরনের কাপড়-চোপড় সব পড়ে রয়েছে মেঝেতে। দ্রুত ওগুলোতে শরীর গলাই আমি। দরজা খোলা রেখেই বের হয়ে আসি কামরা থেকে। সিঁড়ি ভেঙে স্লাইডিং ডোরের কাছে চলে আসি। খোলাই ছিলো ওটা। টান দিতে হা করে খুলে যায়। বারের মাঝখানে চলে আসি আমি। বারের আড়ালে নীচু হয়ে বসে কিছু একটা করছিলো গতকাল রাতের সেই বারটেন্ডার। শব্দ শুনে বের হয়ে আসে বারের আড়াল থেকে।

‘মেয়েটা কোথায়?’ পাগলের মতো জিজ্ঞেস করি তাকে।

‘কোন মেয়ে? কার কথা বলছেন।‘ শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করে বারটেন্ডার। সতর্ক চোখে আমাকে মাপছে।

‘কাল রাতে যে মেয়েটা আমার টেবিলে বসেছিলো। আমাকে নিয়ে উপরে গেলো।‘

‘আপনি ভুল করছেন। এখানে কোনো মেয়ে ছিলো না কাল রাতে। কাল রাতে কেনো, কখনোই কোনো মেয়ে আসে না এখানে। এটা পুরুষদের ক্লাব। মেয়েদের ঢোকা নিষেধ।‘ নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলে সে।

‘দেখো, কাল এখানে আমার টেবিলে মেয়েটা বসেছিলো। তুমি ওকে গ্লাস এনে দিয়েছিলে। আমরা দুজন একসাথে ড্রিংক করলাম। তারপর মেয়েটা আমাকে নিয়ে উপরে গেলো। রাতে ঘুমোনোর পরে মেয়েটা আমার ব্রিফকেস নিয়ে পালিয়েছে। ওতে আমার দামি জিনিসপত্র ছিলো। প্লিজ, বলো মেয়েটা কোথায়?’ কাতর অনুনয় ঝরে পড়ে আমার কণ্ঠে।

‘বলছিতো এখানে কোনো মেয়ে আসে না। খামোখা ঝামেলা করবেন না। কাজ করতে দিন আমাকে।‘ বারটেন্ডার ঘুরে চলে যেতে শুরু করে।

পিছন থেকে ওর কাপড় টেনে ধরি আমি। ‘মিথ্যেবাদী কোথাকার। মেয়েটা তোমাদের দলেরই কেউ হবে। আর এখন অস্বীকার করছো।‘

আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ায় বারটেন্ডার। দুচোখে আগুন জ্বলছে তার। চেচামেচি শুনেই হয়তো বারের পিছনের দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে কাল রাতের সেই বাউন্সার। হিম কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘কী হচ্ছে এখানে? এতো হইচই কীসের?’

‘এই বুড়া মিয়া বলছে, কাল রাতে সে নাকি কোন ছুকরির সাথে মৌজ করে ঘুমিয়ে পড়েছে। তারপর সেই ছুকরি তার টাকাভর্তি ব্রিফকেস নিয়ে পালিয়েছে। তার ধারণা, ওই মেয়ে আমাদের লোক।‘ বারটেন্ডার বলে। প্রচ্ছন্ন কৌতুক তার গলায়।

বারটেন্ডারকে অতিক্রম করে আমার দিকে এগিয়ে আসে বাউন্সার। এগিয়ে আসতে আসতেই আস্তিন গোটায় সে। আমার সামনে এসেও হাঁটা থামে না তার। বাধ্য হয়ে পিছু হটতে হয় আমাকে। গলার রগ ফুলে উঠেছে তার। আমার বুকে দুহাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে হিসহিস করে বলে, ‘ভাগ শালা। নইলে টেংরি খুলে হাতে ধরিয়ে দেবো।‘

আক্ষরিক অর্থেই আমাকে ঠেলতে ঠেলতে পিছনের দরজার কাছে নিয়ে আসে সে। এই দরজা দিয়েই কাল রাতে বারে ঢুকেছিলাম আমি। মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা করি আমি। চিৎকার করে অভিশাপ দিতে থাকি ওদের। প্রতিশোধ নেবার অর্থহীন সব কথাবার্তা বলি। আমার চিৎকার চেচামেচিকে উপেক্ষা করে দরজা খুলে ফেলে বাউন্সার। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডানহাতের আঙুলগুলোকে মুঠো করে সজোরে ঘুষি বসায় আমার পেটে। মনে হয় পাঁচ টনি কোনো ট্রাক গুঁতো দিয়েছে আমাকে। প্রচণ্ড বেদনায় পেট চেপে ধরে কুঁজো হয়ে যাই আমি। ওই অবস্থাতে কোমরে বড়াবড় সজোরে লাথি চালায় সে। লাথি খেয়ে ছিটকে গলিতে এসে পড়ি আমি। তীব্র যন্ত্রণায় রাস্তার উপরে কুঁকড়ে শুয়ে পড়ি।

‘শালা বুঢঢা বদমায়েশ। মাগি নিয়ে মৌজ করার শখ এখনো যায় নাই।‘ দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিস করে বলে সে। তারপর দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দেয় আমার মুখের উপরে।

পেট চেপে ধরে ধীরে ধীরে উঠে বসি আমি। তীব্র ব্যথায় কেপে কেপে উঠে শরীরটা। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। মনে হচ্ছে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে ছোট্ট কোনো ডিঙিতে শুয়ে আছি আমি। কেউ আমাকে দোলাচ্ছে প্রবলভাবে। উবু হতে হড়হড় করে বমি করে ফেলি পাশের ড্রেনটাতে। রক্তমিশ্রিত লাভাস্রোত বেরিয়ে যায় আমার শরীর থেকে। বমি হতে একটু সুস্থির লাগে। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াই আমি। বন্ধ দরজাটার কাছে গিয়ে তীব্র আক্রোশে দমাদম লাথি চালাই। সেই সাথে অশ্রাব্য সব গালিগালাজ বেরিয়ে আসে আমার মুখ থেকে। আশে পাশের বাড়ি থেকে কৌতুহলী কিছু মানুষ জানালা খুলে দেখার চেষ্টা করে কী হচ্ছে এখানে। আমার লাথি খাবার পরেও দরজা খোলে না। শক্ত দরজা। একটু পরে নিজেই ক্লান্ত হয়ে যাই আমি। নিঃস্ব, রিক্ত এবং পরাজিত একজন মানুষ আমি। তীব্র হতাশা কান্নার রূপ নেয়। বন্ধ দরজার পাশে দুহাতে মুখ ঢেকে বসে হু হু কান্নায় ভেঙে পড়ি আমি।

কতক্ষণ ওভাবে কেঁদেছি জানি না। হঠাৎ করেই দেখি আমার চারপাশে জটলা তৈরি হয়ে গিয়েছে। বুড়োমত একজন মানুষ আকুল হয়ে কাঁদছে এর মধ্যে নিশ্চয়ই দর্শনীয় কিছু আছে। ভীড় দেখেই সচকিত হই আমি। বসা থেকে উঠে দাঁড়াই। একটা আধভাঙা ইট তুলে নেই হাতে। তারপর প্রবল আক্রোশে সেতাকে ছুড়ে দেই বদ্ধ দরজার উপরে। চিৎকার করে অভিশাপ দিতে থাকি। কিছুটা ভয় কিছুটা বিস্ময়ের সাথে লোকজন আমার কর্মকাণ্ড দেখতে থাকে। তাদেরকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ধীরে ধীরে বের হয় যাই গলিটা থেকে। মাথাটা ঝুকে থাকে বুকের কাছে।

কতক্ষণ শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি জানি না। কোন রাস্তা দিয়ে ঘুরেছি তাও জানি। ক্লান্তিতে যখন পা আর চলছেন না তখনই আচমকা সচকিত হই আমি। অবাক হয়ে দেখি আওয়ার লেডি অব গুড ফেইথ গার্লস স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। অবচেতন মন আমাকে আমার অজান্তেই পরিচিত জায়গাটাতে নিয়ে এসেছে। মাইনোরিটি হওয়াটা সবসময়ই খারাপ না। খ্রিস্টান হবার কারণে আর ফাদার বেনেডিক্টের কল্যানেই এই স্কুলে চাকরি পেয়েছিলো কবিতা। যতদূর জানি কবিতা এখনও এই স্কুলেই আছে। কিছুটা দ্বিধান্বিত অবস্থাতেই গেটের দিকে এগিয়ে যাই। গেট বন্ধ। মেয়েদের স্কুল বলেই হয়তো। ফিরে আসতে গিয়ে কী মনে করে আস্তে করে দরজায় টোকা দেই আমি। ওপাশ থেকে কোনো সাড়া আসে না। হতাশ হয়ে যখন ফিরে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছি, ঠিক তখনই ক্যাচক্যাচ করে বড় গেটের সাথে লাগানো ছোট্ট দরজাটা খুলে যায়। খাকি পোশাক পরা দারোয়ান লাঠি হাতে বেরিয়ে আসে সেখান দিয়ে শরীর ভাজ করে। রোগা পটকা চেহারা দারোয়ানের। তোবড়ানো গাল। নাকের নীচে বিশাল গোঁফ রেখেছে চেহারাটা ভয়ংকর করার উদ্দেশ্যে। চোখ দুটো লাল।

‘কারে চান।‘ আমাকে অবাক করে দিয়ে অত্যন্ত আদবের সাথে বলে দারোয়ান।

‘ক্রিস্টিনা গোমেজ কী আছেন? তার সাথে একটু দেখা করতে চেয়েছিলাম।‘

‘কবিতা আফারে খোঁজেন? তিনিতো ডে শিফটের এসিস্ট্যান্ট হেডমিস্ট্রেস। এগারোটার সময় আসবেন।‘

‘ও।‘ ম্লানমুখে ঘুরে দাঁড়াই আমি।

‘আপনে কি তার আত্মীয়?’ পিছন থেকে জিজ্ঞেস করে দারোয়ান।

হ্যাঁ না কিছুই বলি না আমি। এর উত্তর যে আমি নিজেও জানি না। চলে যেতে থাকি পরাজিত মানুষের মত।

‘এই রাস্তার শেষে ডানদিকে মোড় নিয়েন। তারপর চারটা বাড়ির পরেই একটা লাল ইটের দোতলা বাড়ি আছে। বাড়ির সামনে একটা পেয়ারা গাছ আছে। কবিতা আফা দোতলায় থাকেন।‘

কৃতজ্ঞচিত্তে দারোয়ানের দিকে তাকাই আমি। তারপর এগিয়ে চলি তার নির্দেশিত পথ ধরে। সামান্য রাস্তা। সেটুকু অতিক্রম করে কবিতার বাড়ি খুঁজে পেতে একটুও সমস্যা হয় না আমার। ওর ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আবারো দ্বিধায় ভুগি আমি। কাজটা কী ঠিক করছি। কবিতা এখন আর কেউ নয় আমার। অন্যের বউ। এতো বছর পরে আমার আগমনকে নিশ্চয়ই ভালো চোখে দেখবে না কবিতা বা তার স্বামী। তার স্বামী? খচ্চরটা আমার বন্ধু ছিলো। কী রকম বিশ্বাসই না করতাম রুহুলকে আমি। প্রথম প্রথম কবিতা আমাকে দেখতে আসতো রুহুলকে সাথে করেই। কবিতার ওই দুঃসময়ে আমার বন্ধু হিসাবে সেই তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো। আমাকে প্রায়শই আশ্বস্ত করতো এই বলে যে, ‘দোস্ত, চিন্তা করিস না। বৌদি আর তোর বাচ্চা জলে পড়ে নাই। আমি রুহুল আছি। জান দিয়া আগলায়া রাখুম ওগোরে।‘ জলে পড়ে নি ঠিকই, কিন্তু কুমিরের পাল্লায় যে পড়েছে সেটা বোঝা গেলো অল্প কদিনের মধ্যেই। শুরু হয়েছিলো কবিতার অনিয়মিত আমাকে দেখতে আসার মধ্য দিয়ে। প্রথম দিকে প্রশ্ন করলে নানান ধরনের কৈফিয়ত দিতো। শেষে একদিন কৈফিয়ত দেবার ভয়েই কি না কে জানে কবিতা আমাকে দেখতে আসা বন্ধ করে দিলো। কানাঘুষায় নানান কথা শুনতাম। বিশ্বাস করতাম না। কবিতা কোনোদিন আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে এই ধারণা আমার মনের মধ্যে কখনই আসতে পারে নি। অনেকদিন কবিতা না আসাতে একদিন ফাদার বেনেডিক্টকেই চেপে ধরলাম। প্রথমে এটা-সেটা বলে এড়িয়ে যেতে চাইলেন। শেষে যখন দেখলেন যে, আমি কারাগারের শিকে মাথা ঠুকে কাঁদছি, তখন আমার কাধে হাত রেখে শান্তস্বরে বললেন, ‘বাছা, পৃথিবীটা দুদিনের। আমরা সবাই ঈশ্বরের কাছে ফিরে যাবো একদিন। যীশুর ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে উঠবে আমাদের জীবন। এই জীবনের তুচ্ছ ভালোবাসা না পাবার আক্ষেপ মনে করে রাখতে নেই। যে গিয়েছে তাকে তার মত থাকতে দাও। পৃথিবীটা মায়ার জগত। কেউ কাউকে ইচ্ছা করলেও বেঁধে রাখতে পারে না। তুমি শান্ত হও।‘

শান্ত হবার পরিবর্তে কারাগারের শিক ধরে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ি আমি।

আস্তে করে কবিতার ঘরের দরজায় টোকা দেই আমি। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজার কাছে পায়ের শব্দ পাই। কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে ওখানে। বুকের মধ্যে হৃদস্পন্দন অনুভব করি। ‘কে?’ নারীকণ্ঠে প্রশ্ন করে কেউ। গলাটা চেনা চেনা লাগে। কবিতা কী? প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকি আমি। একটু পরেই খুট করে দরজা খুলে যায়। মধ্য বয়সী এক নারী গলা বাড়িয়ে দেয়। চোখ-মুখ কুঁচকে আছে বিরক্তিতে। ঝাঝালো গলায় বলে, ‘কাকে চান?’ প্রথমে ভেবেছিলাম কবিতার মা। একটু পরেই ভুল ভাঙে আমার কবিতার মা নয়, আমার সামনে কবিতাই দাঁড়িয়ে আছে। যে তরুণী বধুকে রেখে আমি জেলে গিয়েছিলাম, সে এখন মধ্যবয়স্ক একজন নারী। কবিতার কানের দুইপাশের চুলে পাকন ধরেছে। মাথার সামনের দিকটাতেও দুই চারটা শুভ্রকেশ সগৌরবে ঝিলিক দিচ্ছে। চেহারার ধারালো ভাবটা আর নেই। দুপাশে চর্বি জমে তা এখন ভোঁতা, গোলাকার। চোখের কোণের বিদ্যুতশিখা নিভে গিয়েছে। তার বদলে অনন্ত শূন্যতা সেখানে। ছিপছিপে শরীরটা এখন চর্বিবহুল, স্থূল। কুলকুল করে বয়ে যাওয়া দুরন্ত গতির সেই ঝরনা এখন পরিণত হয়েছে শান্ত, সমাহিত হ্রদে।

আমাকে চিনতে সময় লাগে না কবিতার। তীব্র ভয়ের ছাপ পড়ে তার চোখে। ‘ওমা’ বলে দুই পা পিছিয়ে যায়। স্থির হয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকি আমি। আমার অনাক্রমাণত্মক বিধ্বস্ত চেহারা দেখে ধীরে ধিরে ভয়ের ছাপ মুছে যায় চোখ থেকে কবিতার। ক্ষণিকের জন্য খুশির একটা ঝিলিকও চোখে পড়ে আমার। আশ্চর্য! বিশ্বাসঘাতিনীর মনের গভীরে কোথাও না কোথাও ঠিকই রয়ে গিয়েছি আমি। দ্রুত সামলে নেয় কবিতা নিজেকে। দরজা পুরো খুলে দিয়ে শান্তস্বরে বলে, ‘এসো।‘

সামান্য ইতস্তত করি আমি। অনুচ্চস্বরে বলি, ‘রুহুল?’

‘ও নেই, এসো তুমি।‘

ভিতরে ঢুকি আমি। ছিমছাম পরিপাটি করে সাজানো কবিতার ড্রয়িং রুম। আগের মতই গোছানো সে। আমার অগোছালো আচরণ নিয়ে কতই না ঝগড়াবিবাদ হয়েছে একসময় আমাদের। কবিতা সারাদিন ধরে ঘর গুছিয়ে রাখতো। আর আমি ফিরে এলে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তা আমার নোংরা ভাগাড়ে পরিণত হতো। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতাম আমার পরনের কাপড় চোপড়। কবিতা সেগুলোকে গুছিয়ে রাখতে রাখতে রাগে গজগজ করতো আর বলতো, ‘নবাবপুত্তুর এসেছেন রাজ্য জয় করে। সবকিছু এখানে সেখানে ছুড়ে ফেলছেন সেই আনন্দে। বাড়িতে আমি দাসী আছি ওনার খেদমতের জন্য।‘ ওর রাগে গজগজ চেহারা দেখে হো হো হাসিতে ফেটে পড়তাম আমি। পিছন থেকে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে রাগে লাল হওয়া গালে টকাশ করে চুমু খেয়ে বলতাম, ‘এখন নবাবপুত্রের অন্য খেদমতের প্রয়োজন। সেজন্য সুন্দরী দাসী চাই।‘ রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুকরণে হেড়ে গলায় গাইতাম, ‘এসো হে সুন্দরী এসো এসো‘। কবিতা মুখ ঝামটা দিয়ে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতো।

‘এই রকম ইঁদুর পঁচা ঘামের গন্ধওয়ালা কারো কাছে যাই না আমি। যাও গোসল করে এসো।‘ আহা! কী অপরূপ আনন্দের সময়ই না গেছে একসময় আমাদের।

‘কোথায় গেছে রুহুল? কাজে?’

‘না, ও নেই।‘

‘নেই মানে?’

‘নেই মানে নেই। আমাকে চুষে ছিবড়ে খেয়ে আঁটি বানিয়েছে। তারপর ফেলে পালিয়েছে অন্য মেয়ের সাথে।‘ তিক্ত কণ্ঠে বলে কবিতা।

চোয়ালের হাড়গুলো শক্ত হয়ে যায় আমার। ‘কবে?’ জিজ্ঞেস করি আমি।

‘বিয়ের এক বছরের মাথাতে।‘

‘আমার কাছে আসো নি কেনো?’

‘কোন মুখে যাবো তোমার কাছে? নষ্টা বলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে না আমাকে। তোমার সাথে প্রতারণা করেছি আমি। শয়তানটা মিষ্টি মিষ্টি কথায় ফুসলেছে আমাকে। খাঁটি সোনা রেখে নকলের লোভ করেছি আমি। ঈশ্বর আমাকে পাপের শাস্তি দিয়েছে।‘ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে কবিতা। আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকে।

গভীর ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে ওঠে আমার হৃদয়। এইতো আমার কবিতা, আমার ভালোবাসার সাথী। একদিন কী পাগলের মতই না ভালোবাসতাম এই মেয়েটাকে আমি। ধীর পায়ে আমি এগিয়ে যাই কবিতার দিকে। আস্তে করি হাত রাখি ওর মাথায়। চুলের মধ্যে বিলি কাটি। আমার স্পর্শ পেয়ে বাধ ভাঙে কবিতার। আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে সে। কান্না জড়ানো গলাতে বলে, ‘ডেভিড, আমাদের ছেড়ে আর যেও না কোথাও। আমরা বড় অসহায়। আমাদেরর আগলে রাখো প্লিজ।‘

কবিতার চুলের মধ্যে আমার হাতটা স্থির হয়ে যায়। আমার বুক থেকে ওর মুখটাকে সরাই আমি। তারপর ব্যগ্রস্বরে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করি, ‘আমার মেয়ে, আমার ছোট্ট সোনাপাখি মামণিটা কোথায়?’
চোখে অশ্রু নিয়েই হাসে কবিতা, ‘আছে, আমার কাছেই আছে। তোমার মামণি এখন আর ছোট্ট নেই। অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। লম্বায় আমাকেও ছাড়িয়েছে।‘

অনাবিল আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠি আমি। হাসছি। কতদিন পরে আনন্দে হাসছি আমি। আনন্দে চোখ দুটো ভিজে গিয়েছে আমার। সব, সবকিছু ফিরে পেয়েছি আমি। হারিয়ে যাওয়া ব্রিফকেসের জন্য আর কোনো আফসোস নেই আমার।

‘জানো মাণিক, তোমার মেয়ে না তোমার মতই দেখতে হয়েছে। স্বভাবেও তোমার মতই। একগুঁয়ে আর জেদী। কোনো কথা শুনতে চায় না আমার। তুমি এসেছো, এবার ওকে আচ্ছা করে বকে দিও। আমি বকলে উলটো আমাকে বকে দেয়।‘ হড়হড় করে আদুরে গলায় কথা বলে চলেছে কবিতা।

কবিতার মাথার উপর দিয়েই চোখ যায় আমার। বুক শেলফের উপরে সযত্নে রাখা ফ্রেমে বাধানো একটা ছবি। কবিতার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আমি এগিয়ে যাই ছবিটার দিকে। বিশ বছর আগের তোলা ছবি। বলধা গার্ডেনে হাঁটু মুড়ে বসে আছি আমি। আমার ঘাড়ের উপরে বসে আছে তপতী। দুই পা আমার দুই কাঁধের উপর ছড়ানো। ছোট ছোট হাত দুটো দিয়ে মুঠো করে ধরে আছে আমার চুল। আমার মাথায় নরম থুতনি রেখে সীমাহীন আনন্দে ফোকলা মুখে হাসছে বুড়িটা। পরম মমতায় ছবিটাতে হাত বুলাই আমি। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করি বেলুনের মত ফোলা ফোলা নরম গাল, রেশমের মতো পাতলা চুলগুলো আর কচি কচি আঙুলসহ নমনীয় হাত দুটোকে। ঝুঁকে পড়ে আদর করে আলতো চুমু খাই গালে, কপালে, চুলে।

‘এতো বেলা হয়েছে, তোমার মেয়ে এখনও পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। আলসের আলসে হয়েছে। দাঁড়াও ডাকছি ওকে।‘ পিছন থেকে কবিতা বলে।

পেটের মধ্যে গুড়গুড় করে ওঠে আমার। আমার রক্তমাংস, আমার সন্তান, একমাত্র সন্তান।

‘এই তপু, ওঠ, আর কত বেলা পর্যন্ত ঘুমাবি। দ্যাখ কে এসেছে।‘ চিৎকার করে মেয়েকে ডাকে কবিতা। বুকের মধ্যে সুগভীর তৃষ্ণা নিয়ে ব্যগ্র চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকি আমি।

একটু পরেই শোয়ার পোশাকে চোখ ডলতে ডলতে ঘরে ঢোকে তপতী। চুল অবিন্যস্ত। চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে ঘুম জড়ানো গলায় বলে, ‘কী হইছে মা? ঘরে আগুন লাগছে নাকি? এই সাত সকালে কুইচ্চা মুরগির মত কককক করে চেচিয়ে পাড়া মাথায় না তুললে তোমার বুঝি চলে না।‘

আরো কিছু কড়া কথা হয়তো বলতো মাকে সে। ঘরের মধ্যে আমাকে দেখে থেমে যায় তপতী। আতংকিত একটা চিৎকার বেরিয়ে আসে তার গলা দিয়ে। মুখের উপর হাত চাপা দিয়ে সেটাকে কোনো মতে আটকায় সে। চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে আছে অজানা ভয়ে।

‘চিৎকার করছিস ক্যানরে পাগলি? বাইরের লোক না। ইনি তোর বাবা। এতদিন পর ছাড়া পেয়েছে জেল থেকে।‘ উচ্ছ্বসিত আবেগে মেয়েকে বলে কবিতা।

মায়ের কথা শুনে চমকে উঠে তপতী। মুখে হাতচাপা দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। ডাগর দুটো চোখে ভয়, বিস্ময়, হতাশা, গ্লানি, অপরাধবোধ আর সুগভীর যন্ত্রণার পরিষ্কার চিহ্ন ফুটে উঠে।

প্রচণ্ড ধাক্কায় চোয়াল ঝুলে পড়েছে আমার। ঘরোয়া পোশাকে হলেও চিনতে একবিন্দুও ভুল হয় নি তাকে আমার। রাতের সেই মেয়েটিই। নীলা বসানো মুক্তোর হারটা এখনো ঝুলছে গলায়। ঘোলা চোখে স্থবির হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকি আমি। ক্ষণিকের তরে মনে হয় নীলাটা যেনো বিদ্রুপ আর উপহাস করছে আমার সাথে।

মাথার ভিতরে ভয়ংকর একটা বিস্ফোরণ ঘটে আমার। সেই বিস্ফোরণে পুরো পৃথিবীটাই দুলে উঠে।