“আপনে যখন মনে করলেন, কোনো বই পইড়্যা ফেলাইলেন, নিজেরে জিগাইবেন যে-বইটা পড়ছেন, নিজের ভাষায় বইটা আবার লিখতে পারবেন কি না। আপনের ভাষার জোর লেখকের মতো শক্তিশালী না অইতে পারে, আপনের শব্দভান্ডার সামান্য অইতে পারে, তথাপি যদি মনে মনে আসল জিনিসটা রিপ্রোডিউস না করবার না পারেন, ধইর‍্যা নিবেন, আপনের পড়া অয় নাই।”

“যদ্যপি আমার গুরু” বইতে এই লাইনটা হল আমার প্রথম হারিয়ে যাবার জায়গা, আমার যে তেমন কিছুই পড়া হয়নি এই কথাটা উপলব্ধি করার জায়গা। প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক সম্পর্কে আর এই বইটা সম্পর্কে এতদিন শুনেছি অনেক কথা, আব্দুর রাজ্জাককে আমার জানা আর অবাক মানা সবই গুটিকয় বন্ধুর মুখে। আব্দুর রাজ্জাক নামটা বলতেই সেই বন্ধুদের কেমন যেন হারিয়ে যাওয়া দেখে এতদিন বুঝতাম উনি নিশ্চয় খুবই বড় মাপের মানুষ, কিন্তু এই বই থেকে বুঝেছি তিনি কতটা অধরা। যারা ভাবছেন যে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক নিয়ে কথা বলতে আমার এই লেখা, তাদেরকে বলছি- মোটেই না। উনাকে আমি এখনো বুঝিনি আর এক বই পড়ে উনাকে বোঝাও দুরুহ আর আমার মনে হয়না তাকে পুরোপুরি বোঝারও আমার দরকার আছে। শুধু তিনি যে ধরাছোয়ার কতটা বাইরে এটা উপলব্ধি করাটাই এই মুহূর্তে আমার জন্য যথেষ্ট। আমি লেখাটা লিখতে বসেছি ওই প্রথম লাইনটার জন্য। পরখ করতে “যদ্যপি আমার গুরু” বইটা আমার পড়া হয়েছে কিনা।

পুনশ্চঃ যারা এই লেখায় আহমদ ছফা ও আব্দুর রাজ্জাককে পেতে চাইবেন তারা হতাশ হবেন, আসল কথা হল আমি খুবই অলস ও দুর্বল স্মৃতিশক্তির মানুষ। বইটি পড়ার পর ঐ লাইনটা এক্সপেরিমেন্ট করে দেখার যে জোশটা আমার মাঝে এখন আছে তা আর এক ঘন্টা পরেই থাকবেনা, মনেই থাকবেনা যে আমি কাজটা করতে চেয়েছিলাম। তাই লিখছি।

বইটায় আগাগোড়া যা চোখে পড়ে তা হল লেখকের সততা। ভূমিকাতেই আহমদ ছফা বলে দিয়েছিলেন, তার উদ্দেশ্য ছিল আব্দুর রাজ্জাকের সমগ্র ব্যক্তিত্ব স্পর্শ করার চেষ্টা করা, নিজের সমস্ত অক্ষমতাকে পুরোপুরি স্বীকার করে নিয়ে। স্থানে স্থানে যেখানে ব্যক্তি আহমদ ছফা প্রবল হয়ে উঠেছেন সেখানে উপযুক্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষন সরবরাহ করার হয়েছে অত্যন্ত যত্নের সাথে। এর পেছনে বক্তব্য উপস্থাপনা নিয়ে আব্দুর রাজ্জাকের সংবেদনশীলতা হয়ত বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছে। আহমদ ছফা ও আব্দুর রাজ্জাকের প্রথম পরিচয়পর্বে দুজনের চরিত্রের যে তোব্রতা প্রকাশ পায় সেটা দেখে অভিভূত হয়েছি। আমার মনে হয়েছে আহমদ ছফার তেজ দেখেই আব্দুর রাজ্জাক তার প্রতি প্রথমবারের মত আগ্রহী হন, আর এই আগ্রহ জাগানোটাই ছিল আহমদ ছফার সবচেয়ে বড় সাফল্য আব্দুর রাজ্জাকের কাছাকাছি যাওয়ার পথে। কারণ পুরো বইতে আমি দেখেছি, প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক অপাত্রে খুব বেশি সময় বা এক কণা মনীষাও দিতে রাজি ছিলেননা। স্যার দেখেছেন বাঙালির জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিন সময়কে- পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ। বইয়ের মধ্য দিয়ে জেনেছেন সময়কে, অতীত ও বর্তমানকে।

স্যারের যে ব্যাপারটায় আমি রীতিমত মুগ্ধ হয়েছি তা হল এক কথায় যেকোন বিষয়ে মতামত দেয়া যা আপাতদৃষ্টিতে একপেশে এবং অধিকাংশ মানুষের কাছে অগ্রহণীয় মনে হতে পারে, কিন্তু তাতে আছে গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয়। আমরা রবীন্দ্রনাথ বলে অজ্ঞান হয়ে যাই কিন্তু তিনি অল্প কথায় রবীন্দ্রনাথের যথাযথ মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছিলেন,

“রবীন্দ্রনাথ বড় লেখক, মানুষ হিসাবে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর কিংবা তাঁর মতো মানুষদের ধারে কাছেও আসতে পারেন না। বড় লেখক এবং বড় মানুষ এক নয়। বড় লেখকদের মধ্যে বড় মানুষের ছায়া থেকে। বড় মানুষরা আসলেই বড় মানুষ। লেখক কবিরা যা বলে সেরকম আচরণ না করলেও চলে। হের লাইগ্যা প্লেটো তার রিপাবলিক থ্যাইক্যা কবিগো নির্বাসনে পাঠাইবার কথা বলছিল।”

তার এই বক্তব্য এমনকি আহমদ ছফাও বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতে পারেননি। এমনভাবেই তিনি মানুষের সাথে কথা বলতেন, কি বেঙ্গল সমাজের নেচার, কি হেনরি কিসিঞ্জার, শেখ মুজিব বা মাওলানা ভাসানীর নেচার- সকল বিষয়ে তার এরকম খুব সূক্ষ্ণ ও সংক্ষিপ্ত মতামত ছিল যা যেকোন যৌক্তিক মানুষকে ভাবাত উত্তর দেয়ার আগে। এই “naïve, simple, precise and straight forward” ব্যাপারটা আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে।

বাংলা একাডেমীর বৃত্তিতে আহমদ ছফার “The growth of middle class in Bengal as it influenced its literature, society and economics from Eighteenth to Eighteen Fifty Eight”(অসমাপ্ত) টপিকের থিসিসে আব্দুর রাজ্জাক স্যার ছিলেন আনুফিসিয়াল সুপারভাইজার। তরুণ ছফা যখন বুঝতে পারছিলেননা কিভাবে শুরু করবেন তখন স্যার শব্দ করে হেসে তাঁর পিএইচডি সুপারভাইজার হ্যারল্ড লাস্কির কাছ থেকে একই প্রশ্নের যে উত্তর পেয়েছিলেন তাই বললেন। লাইব্রেরি দেখিয়ে দিয়ে লাস্কি বলেছিলেন,

“My boy, go and soak!”

আর এই “সোক” করার মানে হল,

“প্রথম লাইব্রেরিতে ঢুইক্যাই আপনার টপিকের কাছাকাছি যে যে বই পাওন যায় পয়লা একচোটে পইড়া ফেলাইবেন। তারপর একটা সময় আইব আপনে নিজেই পাইবেন আপনের আগাইবার পথ।”

এই পথ খোঁজাই আহমদ ছফার পিএইচডি শেষ করতে না পারার “কাল” হয়েছিল! ছফা রাজপথের সন্ধান পেয়ে গলিপথে আর হাটলেননা। লাস্কির বাতলানো পথে আজীবন চলেছিলেন রাজ্জাক স্যার এবং আমার ধারণা তিনি এই কথা আহমদ ছফার মত খুব সামান্য কিছু মানুষের কাছেই বলেছিলেন যাদেরকে তার “সুপাত্র” বলে মনে হয়েছিল।

আহমদ ছফার আব্দুর রাজ্জাকের সকল বিষয়ে জানাশোনা এবং সূক্ষ্ণ ও সংক্ষিপ্ত মতামত দানের ক্ষমতায় অভিভূত হয়ে তাজমহলের সাথে তুলনা করেছিলেন যার প্রতি কখনো ক্লান্তি আসেনি, এই মানুষটির সম্মোহনী শক্তির কারণেই তাকে ছফা তুলনা করেছিলেন সক্রেটিসের সাথে। ছফা যখন শিল্প বিপ্লব নিয়ে পড়তে গিয়ে পাগলের মত একের পর এক পড়ে যাচ্ছিলেন টয়েনবি, মেনটো, পি.এন হেক্সটারের বই তখন স্যার খুব সিরিয়াসভাবে ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চ অর্থনীতির নানা পর্যায় সম্পর্কে তথা একোনমিক্স বিষয়টা সম্পর্কে আগ্রহ জাগিয়ে তুলছিলেন, ছফার কোন লেখা পছন্দ না হলে তা নিয়ে নীরব থেকে কথা বলতেন টলস্টয়ের “ওয়ার এন্ড পিস” নিয়ে- যা থেকে ছফা ক্লু পেয়েছিলেন যে স্যার চাইছেন তিনি যেন “ওয়ার এন্ড পিস”এর মত বড় কোন কাজে হাত দেন, যার ফলশ্রুতিতে ছফার অনুবাদ করেন মহাকবি গ্যেটের “ফাউস্ট”, যে অনুবাদটি নিয়ে স্যার এতই উচ্ছসিত ছিলেন যে তার কাছে যেই আসত তাদেরকে পড়ে শোনাতে বলতেন ছফাকে- এসবই প্রমাণ করে স্যার ছফার মাঝে সম্ভাবনা দেখেছিলেন এবং এ সম্ভাবনা ও প্রতিভা দিয়েই ছফা স্যারের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন অবাধ প্রশ্রয় আর অঢেল স্নেহ। আব্দুর রাজ্জাক স্যার কর্মী ছিলেননা, ছিলেন সাধক, তিনি সেখানেই কথা বলেছেন যেখানে কাজ হয়েছে, উলুবনে মুক্তো ছড়ানো তার অপছন্দ ছিল বলেই ছফা যখন বঙ্কিমচন্দ্রের কিছু ভুল চিন্তাকে ডিফেন্ড করে পুস্তিকা রচনা করেছিলেন তখন সেটাকে প্রয়োজনে সময় নষ্ট বলেই আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি যৌবনে ট্রটস্কির “থিয়োরি অব পার্মানেন্ট রেভোল্যুশন” এর বাংলা এবং অবনী ন্দ্রনাথ ঠাকুরের “বাংলার ব্রত” ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। আমি দুটোর একটাও পড়িনি, কিন্তু আহমদ ছফার মনে হয়েছে যে মানুষ যৌবনে এই দুই বইয়ের অনুবাদ করেছেন তার পক্ষে নাকি মামুলি বিষয়ে কাজ করা অসম্ভব ছিল- এটাকেই ছফা স্যারের কোনকিছু না লেখার যৌক্তিকতা হিসেবে দেখেছেন। এ সম্পর্কে আমার কোন মন্তব্য নেই, কিন্তু আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি, আব্দুর রাজ্জাকের কথা ও চিন্তার মাঝে এই ধরণের বড়ত্বের ছাপ আমি পেয়েছি।

এ বইতে আহমদ ছফার শক্তির চরম বিকাশ আমি দেখতে পাই চিত্রশিল্পী সুলতানকে মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে। ছফা যখন দেখলেন সুলতানের বিশ্বমানের ছবিগুলো নিয়ে কোন কথা না বলে শিল্পবোদ্ধারা একরকম “কন্সপিরেসি অব সাইলেন্স” করছেন তখন অধ্যবসায়ী এই মানুষটি চিত্রকলা সম্পর্কে রাত-দিন পড়াশোনা করে, সে সম্পর্কে মতামত দেবার “যোগ্য” হয়ে ‘বামগ্লার চিত্রঐতিহ্য এবং সুলতানের সাধনা’ নামে একটি পঞ্চাশ পৃষ্ঠার দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখে সাময়িকীতে ও পুস্তিকা আকারে মানুষের কাছে পৌঁছাতে থাকেন- প্রচারিত হয় সুলতানের মহিমা। এমন “পাগলামি” দেখে বিস্ময়ে হতবাক হওয়া ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিলনা।
আর শিল্পী সুলতানকে নিয়ে ছফার বলা একটা কথাই মনে হয় যথেষ্ট হবে,

“সুলতানকে কেনো আমি অসাধারণ একজন মানুষ বলে মনে করতাম, এতদিনে তার একটা কারণ আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি। সুলতান প্রফুল্লের মতো একজন মাঝ-বয়েসী অশিক্ষিত মানুষের মনেও শিল্পী হওয়ার বীজ বুনে দিতে পেরেছিলেন। এমন তো আর কাউকে দেখিনি!” উল্লেখ্য, প্রফুল্য ছিল চল্লিশোর্ধ বয়সের একজন কাঠমিস্ত্রী যে তার গুরু সুলতানের দেয়া ভরসা “এঁকে যাও” সম্বল করে রঙ তুলি ছাড়াই পাগলের মত ছবি এঁকে যেত এবং যার ছবিকে দূর থেকে সুলতানের ছবি বলে ভ্রম হত- কাছে এল অবশ্য অন্য কথা।

আমার সবচেয়ে শ্রদ্ধা জেগেছে যেকোন টপিকে স্যারের জানাশোনার পরিধি, কথা বলার ধরণ আর জ্ঞান পিপাসা উপলব্ধি করে। অন্যদের মুখে স্যারের কথা শুনে আমার মনে হত তিনি উদাসীন, কাঠখোট্টা ধরণের মানুষ, কিন্তু বই পড়ে বুঝলাম মানুষকে ভালোবাসার আবেগও ছিল তার অবাক করার মত। তা না হলে পছন্দের মানুষের কথা বলতে বলতে তাদের মৃত্যুর বা ভালোবাসার কথা স্মরণ করে চুপ হয়ে যাওয়া সম্ভব হতনা। স্যারের জীবনের শেষ সময়গুলোর কথা যখন পড়েছি, তিনি ভাবনা চিন্তার ধার না ধেরে নিজের যাকিছু বলার তা অনর্গল অক্লান্তভাবে বলে যেতেন, রেখে যেতে চাইতেন ছফার মাঝে সেই আকুতি ছফার মত আমাকেও গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। স্যার বই লিখে গেলে আমরা কতটুকু উপকৃত হতাম জানিনা, কিন্তু মলিন ছেড়া কাপড় পরা এই মানুষটি- যিনি প্রভাবিত করেছেন দেশ বিদেশের বাঘা বাঘা সব মানুষদের, হয়েছেন শিক্ষকদের শিক্ষক- এর প্রভাব চোখে পড়ার মত বিস্তৃত না হলেও অভাবনীয় রকমের গভীর, যেটার দরকার ছিল বাঙালিদের। দরকারী এই মানুষটি যিনি প্রজন্ম প্রজন্মান্তরেরও অগ্রসর ছিলেন, নীরব প্রভাব ফেলেছিলেন দেশের প্রতিটি টার্নিং পয়েন্টে।

যা লিখলাম তা আমার কথা, যদি কারো একটুও আগ্রহ জেগে থাকে বইটির প্রতি এবং প্রফেসর রাজ্জাকের প্রতি তাহলে আমি বলব, বইটি খুবই ভাল মানের এবং আহমদ ছফা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন ভূমিকায় বলা কথাগুলোর প্রতি সৎ থাকতে। বইয়ে যে ব্যাপারটা একটু অপূর্ণতা লেগেছে তা হল বক্তব্য প্রায়ই অসমাপ্ত থেকে গেছে বা মূল জায়গা থেকে সরে গেছে। তবে যদি এমরা মানুষের কথা বলার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া লক্ষ্য করি তাহলে কিন্তু দেখা যাবে এমনটাই হয় যেকোন কথোপকথনের ক্ষেত্রে, কথা অসমাপ্ত থেকে যায়, নতুন কথা উঠে আসে, কথা অন্যদিকে আগায় বা নীরবতায় পর্যবসিত হয়। শেষে শুধু এইটুকু বলতে চাই, “go and soak” ধারণাটি এবং আমার লেখার শুরুর লাইনগুলো বেশ ভালভাবেই আমাকে প্রভাবিত করেছে।

(স্যার প্রথমবার আহমদ ছফার লেখা পড়ে ইঙ্গিত করেছিলেন দীর্ঘ আবেগসর্বস্ব কথা ব্যবহার না করার প্রতি। এই কথার সাথে একমত হলেও আমি সবসময়েই এই কাজ করি, স্বভাবদোষ!)