বই কিনে কেউ কোনদিন দেউলিয়া হয়নি, তবে অনেক সময় ঠকে

গ্রামে জন খাটা নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। জন মানে কৃষি মজুর। সারাদিন ক্ষেতে খাটাবে এবং বিনিময়ে পেট ভরে দুই বেলা খাওয়াবে ও কিছু টাকা দেবে। এক বোকা, ত্রিসংসারে যার কেউ নেই সে পেটে ভাতেই খাটে। নগদ টাকা চায় না। খাটেও মন ও শরীর দুটোই লাগিয়ে। কাজেই তাকে সবাই কাজে নিতে চায়।
সে এক গৃহস্থের ক্ষেতে বেশ কয়েকদিন যাবৎ খাটছে। অন্য এক মতলববাজ গৃহস্থ তাকে ভুলিয়ে বালিয়ে নিতে চাচ্ছে। তাকে জিজ্ঞেস করছে—- তোকে কখন কখন খেতে দেয়?
বোকারাম উত্তর দিল, সকালে আর বিকালে।
মতলববাজ গৃহস্থ্ শব্দকে বেশ দীর্ঘ করে উচ্চারণ করল, এ- ই – স -কা -লে –আ- র -সে –ই- বি- কা -লে?
বোকা বলল, হ, এর লাইগ্যা ঐ রাইতে আবার খুদা লাগে।
এবার সেই মতলববাজ গৃহস্থ দ্রুতলয়ে সকালে ও বিকালে শব্দ দুটোকে উচ্চারণ করে বলল, আমার ক্ষেতে কাজ করলে তোকে সকাল বিকাল সকাল বিকাল খেতে দিব।
বোকারাম তাৎক্ষণিক প্রস্তাব দিল, কালকাত্তেনে আপনের কামঐ করমু।

আমি বই কেনার বেলায় এরকম দুয়েকবার বোকারাম হয়েছি। যদিও ছোটবেলা থেকে সৈয়দ মুজতবা আলীর “বই কিনে কেউ কোনদিন দেউলিয়া হয়নি” জেনে আসছি, বিশ্বাসও করি, চর্চাও করি, তবে অনেক সময় ঠকেছি। ঐ বোকারামের মত ঠকেছি। আর ঠকলে নাকি বাপকেও বলতে হয় না। কিন্তু আমি আজ একটু আধটু বলতে চাই।
যদিও যে সব বই কিনে ঠকেছি সেগুলোর নাম বলা যাবে না শত্রুতা বাড়ানোর ভয়ে, তবে বইয়ের ধরণ বা প্রকার বলে একটি উদাহরণ দিব।
অন্য পণ্যের মত বই নয়।অন্য পন্যের বিজ্ঞাপনে উদ্ধুদ্ধ হয়ে কিনে ঠকলেও ব্যবহার করে ফেলি বা নিজের পছন্দ না হলে যার পছন্দ তাকে দিয়ে দিই, বেশি খারাপ মাল হলে ফেলেও দেওয়া যায়, কিন্তু বই তো একবার পড়ে ফেললেই এর ব্যবহার শেষ হয়ে যায় না। আমি বই শুধু একবার পড়ার জন্য কিনি না। পড়ি, অনেক বই
একাধিকবার পড়ি, অন্যকে পড়তে দেই, অনেক সময় অন্যের বই পড়েও পরে অনেক বই কিনি সংগ্রহে রাখার জন্য।
বই কিনতে গেলে কয়েক পাতা পড়ে বা ফ্ল্যাপের কথা পড়েও বই কিনি। অন্যের কথায় বই কিনি। কোন আলোচনা সমালোচনা পড়ে বই কিনি। রেফারেন্স পড়েও বই কিনি।

২০১০ সালের বই মেলায় ঘুরছি। আমার ছেলে ফোন করে একটি বইয়ের নাম দিয়ে বলল,বইটি কিনো। দুইজন নামকরা লেখক মিলে একটি উপন্যাস লিখেছেন।
বইটির মূল্য অন্যান্য বইয়ের তুলনায় বেশিই। হাতে নিয়ে দেখতেও ভালই লাগল। ছেলের প্রতি পুর্ণ আস্থায় কিনে ফেললাম।

দুই রাত জেগে ছেলে বইটি পড়ে বলল, মা, বইটি কিনতে বলা ঠিক হয়নি। ভাল লাগেনি।
নিজেও পড়লাম। তেমন কিছু পেলাম না। বইটির সমাপ্তিতে দুইজনে যেন মিলতে ও মিলাতে পারেননি।এত নামকরা লেখকদ্বয়ের বইয়ের চরিত্র সৃষ্টি, পটভূমি ও গাঁথুনির ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি। বইটি কাউকে আর পড়তে দিইনি। আমি চাইনি যে এ নামকরা লেখকদ্বয়ের ভাবমূর্তি একটুও ক্ষুণ্ণ হোক। তাছাড়া ,আমি এমন বই কাউকে পড়ার জন্য সুপারিশ করতে চাই না যা পড়ে আমার মনোনয়ন নিয়ে মনে প্রশ্ন উঠুক। বইটি নতুন হলেও সেলফের সামনে রাখিনি, কারণ এ বইটি দেখলেই ঠকেছি মনে করে বিরক্ত লাগত।

এমন অনেক বই আমাকে ঠকিয়েছে। নাকি লেখকরাই ঠকিয়েছে!বুঝতে পারছি না।


অনুক্রম

২৬ এপ্রিল ২০১১। ডান কাঁধের অসহ্য ব্যথায় সকাল থেকেই অস্থির। ঢাকায় সরকারী ডাক্তার দেখানো গেলেও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে হলে বিকেল বা সন্ধ্যার প্রাইভেট হাসপাতালে যেতে হবে। সরকারী হাসপাতালে এম বি বি এস, বিশেষজ্ঞ সবার একই দক্ষতা। সরকারী সময়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা রোগীকে সাধারণ দক্ষতায়ই দেখেন। নিজস্ব সময়ে তাদের বিশেষজ্ঞ মতামত। তা ও আবার এ মতামতে যন্ত্রের সাহায্য
লাগে। পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া কিছু বলতে পারেন না। যাহোক, সকালেই ফোন করে ঠিক করেছি সন্ধ্যা সাতটায় আমার নির্ধারিত সময় । অনুক্রম সাত। যথাসময়ে গিয়ে
শুনি, উনি দেরিতে এসেছেন কাজেই আমাকে অন্তত এক ঘন্টা বসতে হবে। উনি যে দেরিতে আসবেন তা কোন রুগীকে জানানোর মত কোন দায়বোধ উনি অনুভব করেননি। যদিও মোবাইল ফোনের যুগ বলে আমরা দাবি করি। অথচ অনুক্রম নেওয়ার সময় মোবাইল নম্বরও দিতে হয়েছে।
অগত্যা ব্যথা নিয়ে আমার মত অনেকে বসে আছে। তবে রোগী ও সহায়তাকারীদের চেয়ে চেয়ারের সংখ্যা কম। রোগীর সহায়তাকারীদের কেউ কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কেউ টিভিতে আই পি এল এর খেলা দেখতে অন্যত্র গিয়ে বসে আছে।সিরিয়েল এগিয়ে আসলো কি না ও রোগীর খবর নিচ্ছেন একটু পরে পরে এসে।
আমি আমার সীট রেখে দাঁড়াই উঠি। উঠার সময় হাতের ব্যাগটা চেয়ারে রাখতে ভুলি না চেয়ার বেদখলের ভয়ে। উল্লেখ্য যে কাঁধের ব্যথা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার কোন সমস্যা নেই। ব্যথাও সকালের চেয়ে কম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে বলেই চেয়ার দখল। অফিসের দায়িত্বে কাল একটা টিমের সাথে ঢাকার বাইরে যাব বলে আজই ডাক্তার দেখাতে এসেছি। ঢাকা বাইরে গিয়ে ব্যথা আরও বেশি হলে নিজের ও টিম মেম্বারদের ভোগান্তি বাড়বে।
এরই মধ্যে একজন রুগী বোরখা পরা ও সাথে সহায়তাকারী কোলে বাচ্চা আরেক বোরখা পরিহিতা ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হলেন। রুগীর মেয়ে বা ছেলের বউ হবে।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে ডাক্তারের টাকা দেয়া, ব্যায়াম শেখাসহ কিছু আনুসঙ্গিক কাজ করতে হয় সবাইকে।

রুগীর কোমড়ে ব্যথা মনে হল। দাঁড়াতে পারছেন না। সামনে শূন্য চেয়ার না পেয়ে হতাশও মনে হলো। তাছাড়া রুগীর সহায়তাকারী বাচ্চা কোলে, হাতে কাগজপত্রসহ রোগীকে ভালভাবে ধরতে পারছে না বলে বিব্রত ও অসহায়। আমি স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতিতেই এগিয়ে গিয়ে বললাম, আমি কি আপনাকে সহায়তা করতে পারি?
আমার চেয়ার দেখিয়ে বললাম, আপনি এখানে বসেন।
রুগীর বয়স আমার থেকে বেশি হবে না, তবে রোগে ও চুলে রঙ না লাগানোর জন্য বেশি বয়সী মনে হচ্ছিল। আমি তাকে ধরে আমার চেয়ারে বসানোর সহায়ক মনোভাবে রূগী ও রুগীর সহায়তাকারী যেন আঁৎকে উঠলেন এবং সাথে চোখে মুখে কিসের যেন প্রতিফলন! কৃতজ্ঞতার ? সন্দেহের? না, আমি তা পড়তে পারিনি।
উপস্থিত অন্যান্যরাও আমার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালেন। আমার অযাচিত সহযোগী মনোভাব হয়তো অন্যান্যদের কৌতূহলের কারণ।

ঐদিনই আমি হাসপাতালে গিয়েই দেখি আট দশ বছরের এক বাচ্চা নিয়ে এক মা অস্বস্তিতে একবার বসেন, আবার উঠেন, আরেকবার একটু আগে সিরিয়েল দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছেন আর এটেন্ডেন্ট হাসি মুখে তা প্রত্যাখান করছেন। পুরানো রুগী। রিপোর্ট দেখাতে এসেছেন।
এটেন্ডেন্টের উত্তর, আপনাকে কার আগে দেব? প্রত্যেকেই তো সমান। আমাকে দেখিয়ে বলল, উনাকে জিজ্ঞেস করেন তো উনি মানবেন কি না?
আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, মানবো। উনাকে দিয়ে দিন।
মহিলাটির চোখে যে কৃতজ্ঞতা দেখেছি তা ভুলবার নয়।
আমি কোন ত্যাগ করেছি বলে আমার মনে হয়নি। বাচ্চাটির আনচান মনোভাব দেখে আমি দ্বিমত করিনি। আজকাল একটু কিছু কেউ করে না। আবার কেউ একটু কিছু করলে অন্যে মহাখুশি।
আগে এসব ছিল জীবন যাপনের অপরিহার্য অংশ। এখন মহত্ব? মহত্ব, কর্তব্য, দায়িত্ব, দায় ইত্যাদি শব্দের সংজ্ঞা নির্ণয় বড় কঠিন বিষয়। একটা ডট জাতীয় কিছু করেই মনে করি, দাবি করি — মহত্বের পাতায় ‘লিখে রেখ এক ফোঁটা দিলেম শিশির’।
আমরা নিজের দায়িত্ব কর্তব্য অবহেলা করি সচেতনভাবে। কখনও অসচেতনভাবে বা কাকতালীয়ভাবে কারও উপকার করে ফেললে মনে হয় মহানুভব হয়ে গেলাম। মহত্বের সংজ্ঞা ক্রমেই সংকোচিত হয়ে যাচ্ছে।