[স্বীকারোক্তি : ইতঃপূর্বে মুক্তমনায় ‘অস্পৃশ্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং একজন দাদাসাহেব’ শিরোনামে আট পর্বের একটি ধারাবাহিক লেখা দেয়া হয়েছিলো। যা মুক্তমনার ই-বুক আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে। সেটাতে ব্রাহ্মণ্যবাদী বৈদিক ধর্মের অনুশাসক গ্রন্থ মনুসংহিতকে ভিত্তি ধরে জঘন্য বর্ণাশ্রম প্রথায় অমানবিক অস্পৃশ্যতার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে এবং দলিত আন্দোলনের অমর ব্যক্তিত্ব ড. ভিমরাও আম্বেদকরের জীবন ও কর্মের উপর কিছুটা আলোকপাতের চেষ্টা করা হয়েছিলো। সেখানে প্রাসঙ্গিকভাবেই নারীকে মূল্যায়নের সামান্য কিছু নমুনাও উপস্থাপিত হয়েছিলো। তবে বর্তমান লেখাটায় মনুসংহিতার ঊৎস, প্রভাব ও তার দৃষ্টিতে নারীকে কিভাবে দেখা হয়েছে তাকে প্রাধান্য দিয়ে বিশদ আলোচনার চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে সচেতন পাঠকের কাছে কোথাও কোথাও পূর্বোল্লেখিত লেখাটার সামান্য কিছু বিষয়ের পুনরাবৃত্তি থাকতে পারে বলে মনে হতে পারে, যা বিষয়ের প্রয়োজন ও ধারাবাহিকতায় অনিবার্য ছিলো বলেই মনে করেছি।
ধর্মের কচকচানি বাদ দিয়ে স্রেফ নারীকে কোন্ উপজীব্যতায় দেখা হয়ে থাকে তার সাপেক্ষেই আসলে যেকোন ধর্মের প্রকৃত মানবিক-অমানবিক রূপটি উন্মোচিত হয়ে যায়। ফলে বর্তমান ধারাবাহিক লেখাটাতে বৈদিক ধর্মকে সেই আয়নায় প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, লেখাটা বাংলাদেশ নারী ও প্রগতি সংঘের নিয়মিত ষান্মাসিক জার্নাল ‘নারী ও প্রগতি’র ডিসেম্বর ২০১০ দ্বাদশ সংখ্যায় অখণ্ডভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ]

এটা কোন কথার কথা নয়
মানব সভ্যতার ইতিহাস আসলে ধর্মেরই ইতিহাস। সম্ভবত কথাটা বলেছিলেন দার্শনিক ম্যাক্স মুলার, যিনি প্রাচীন ভারতীয় দর্শন (Indian Philosophy) তথা বৈদিক সাহিত্য বা সংস্কৃতিরও একজন অনুসন্ধিৎসু বিদ্বান হিসেবে খ্যাতিমান। তবে যে-ই বলে থাকুন না কেন, সভ্যতার এক দুর্দান্ত বিন্দুতে দাঁড়িয়েও উক্তিটির রেশ এখনো যেভাবে আমাদের সমাজ সংস্কৃতি ও জীবনাচরণের রন্ধ্রে রন্ধ্রে খুব দৃশ্যমানভাবেই বহমান, তাতে করে এর সত্যতা একবিন্দুও হ্রাস পায় নি। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে তা অনেক বেশিই প্রকট। কেননা বর্তমান বিশ্বে এমন কোন সভ্যতার উন্মেষ এখনো ঘটেনি যেখানে মানুষের জন্ম মৃত্যু বিবাহ উৎসব উদযাপন তথা প্রাত্যহিক জীবনাচরণের একান্ত খণ্ড খণ্ড মুহূর্তগুলো কোন না কোন ধর্মীয় কাঠামো বা অনুশাসনের বাইরে সংঘটিত হবার নিরপেক্ষ কোন সুযোগ পেয়েছে আদৌ। ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির, গোষ্ঠির সাথে গোষ্ঠির, সমাজের সাথে সমাজের ইত্যাদি পারস্পরিক সম্পর্কের প্রেক্ষিতগুলো এখনো ধর্মকেন্দ্রিকতার বাইরে একচুলও ভূমিকা রাখতে পারে নি বলেই মনে হয়। এমন কি মানুষ হিসেবে আমাদের ব্যক্তি বা সামাজিক পরিচয়ের অন্তঃস্থ চলকগুলোও নিরেট ধর্মীয় পরিচয়েই মোড়ানো।
.
একেবারে বহিরঙ্গের পরিচ্ছদে যে যেই রঙের আঁচড়ই লাগাই না কেন, এই আলগা পোশাকের ভেতরের নিজস্ব যত্নশীল শরীরটা যে আসলেই কোন না কোন ধর্মীয় ছকের একান্তই অনুগত বাধক হয়ে আছে তা কি আর স্বীকার না করার কোন কারণ সৃষ্টি করতে পেরেছে ? অন্তত এখন পর্যন্ত যে পারে নি তা বলা যায়। আর পারে নি বলেই আরো অসংখ্য না-পারার ক্ষত আর খতিয়ানে বোঝাই হতে হতে আমরা ব্যক্তিক সামাজিক ও জাতিগতভাবেও একটা ঘূর্ণায়মাণ বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে পড়ছি কেবল, বাইরের সীমাহীন সম্ভাবনায় পা রাখতে পারছি না সহজে। এবং একই কারণে আমাদের সমাজ-সংগঠন-চিন্তা বা দর্শনের জগতটাও অসহায়ভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে একটা স্থবিঢ় বা অনতিক্রম্য বিন্দুতে। বাড়ছে না আমাদের বৃত্তাবদ্ধতার আয়তন বা সংগঠিত করা যাচ্ছে না কোন সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডও। কিন্তু কেন তা ভাঙা সম্ভব হচ্ছে না ?
.
প্রশ্নের আকার যতো শীর্ণই হোক না কেন, ভাবগত অর্থে এতো বিশাল একটা প্রশ্নকে সামনে রেখে কোন একরৈখিক আলোচনা যে আদৌ কোন মীমাংসা বা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্যে একান্তই অকার্যকর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে আলোচনার কান ধরে টান দিলে হয়তো এমন অনেক প্রাসঙ্গিক প্রশ্নও সামনে চলে আসার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যাবে না যেগুলোর যথাযথ উত্তর অনুসন্ধানের মধ্যেই কোন না কোন সমাধানের বীজ লুকিয়ে থাকতে পারে। সে বিবেচনায় একেবারে নিশ্চুপ থাকার চেয়ে কিঞ্চিৎ হল্লাচিল্লা করায় সম্ভাব্য সুবিধা রয়েছে বৈ কি। তাই সমাজ সভ্যতা সংস্কৃতির বহুমাত্রিক স্রোতে অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে মানুষের লিঙ্গীয় (Gender) অবস্থান বা আরও খোলাশা করে বললে সামগ্রিক জনগোষ্ঠির অর্ধাংশ জুড়ে যে নারী তাঁর ভূমিকা, কার্যকর প্রভাব ও অবস্থান চিহ্নিত করতে গেলে অনিবার্যভাবেই প্রচলিত ধর্ম ও অনিরপেক্ষ ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রসঙ্গটি অনায়াসে সামনে চলে আসে। অনিরপেক্ষ বলা হচ্ছে এজন্যেই যে, আমাদের ধর্মীয় চেতনদৃষ্টি যে প্রকৃতপক্ষেই লিঙ্গ-বৈষম্যমূলক ও সুস্পষ্টভাবেই পুরুষতান্ত্রিক পরম্পরায় গড়ে ওঠা তা বোধ করি অস্বীকার করার উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে আলোচনার সূত্র ধরে আমরা নাহয় একটু খোঁজার চেষ্টা করে দেখি, কী আছে এই ধর্মতত্ত্বের পেছনে ?
.
ধর্মীয় অমানবিকতার আদিম ধারাটির নাম বৈদিক সংস্কৃতি
জগত জুড়ে ধর্মীয় সংস্কৃতির যে ক’টি প্রধান ধারার অস্তিত্ব এখনো বহাল রয়েছে তার মধ্যে সম্ভবত বৈদিক সংস্কৃতিই প্রাচীনতম। তার উৎস হচ্ছে বেদ (Veda), যা বর্তমান হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বিশ্বাস করা হয়। অথচ বহিরাগত একদল লিপিহীন বর্বর আক্রমণকারী শিকারি আর্য গোষ্ঠির দ্বারা এককালের আদিনিবাসী জনগোষ্ঠির মাধ্যমে গড়ে ওঠা সমৃদ্ধ প্রাচীন হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস হওয়া এবং এই ধ্বংসাবশেষের উপর ক্রমে ক্রমে গড়ে ওঠা আর্য সংস্কৃতির বিকাশের আর্যাবর্ত ধারাক্রমই মূলত এই বৈদিক সংস্কৃতি। যেখানে আর্যরা (Aryan) হয়ে ওঠে মহান শাসক আর আদিনিবাসী জনগোষ্ঠিটাই হয়ে যায় তাদের কাছে অনার্য বা শাসিত অধম, নামান্তরে দাস বা শূদ্র (Sudra)। তাই এই বৈদিক সংস্কৃতির ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের মধ্যেই একটি সভ্যতার উন্মেষ ও পর্যায়ক্রমে তার মাধ্যমে ধর্ম নামের একটি শাসনতান্ত্রিক ধারণার জন্ম ও আধিপত্য কায়েমের মধ্য দিয়ে এ ব্যবস্থার পরিণতি পর্যবেক্ষণ করলেই ধর্ম কী ও কেন- এ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় বলে বিদ্বানেরা মনে করেন। আর প্রতিটা ধর্মেরই যেহেতু অন্যতম প্রধান শিকার হচ্ছে নারী, তাই আধিপত্যবাদী পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক এই ধর্মের প্রত্যক্ষ আক্রমণে কিভাবে সামাজিক নারী তার পূর্ণ মানব সত্তা থেকে সমূলে বিতাড়িত হয়ে কেবলই এক ভোগ্যপণ্য চেতনবস্তুতে পরিণত হয়ে যায় তারও উৎকৃষ্ট নমুনা-দলিল এই প্রাচীন বৈদিক শাস্ত্রই। বয়সে প্রবীণ এই শাস্ত্রের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা ও সাফল্য থেকেই সম্ভবত পরবর্তী নবীন ধর্মশাস্ত্রগুলো তাদের পুরুষতান্ত্রিক শোষণের হাতিয়ারটাকে আরেকটু আধুনিক ও বৈচিত্র্যময় করে তার শাসন-দক্ষতাকেই সুচারু করেছে কেবল, খুব স্বাভাবিকভাবেই কোন মৌলিক মানবিক উন্নতি ঘটেনি একটুও। তাই সম্যক পর্যালোচনার খাতিরে আমরা এই বৈদিক শাস্ত্রের বিষয়-সংশ্লিষ্ট প্রসংগগুলো চয়ন করে এতদবিষয়ক কিছু প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা নেয়ার কিঞ্চিৎ চেষ্টা করে দেখতে পারি।
.
বৈদিক শব্দটি এসেছে ‘বেদ’ থেকে। ‘বেদ’ মানে হচ্ছে পবিত্র ও পরম জ্ঞান। ‘বেদ’ নামে সাধারণ্যে কোন একটি গ্রন্থবিশেষ বোঝালেও মূলত এটি প্রায় শতাধিক গ্রন্থের সমষ্টিই বোঝায়। যদিও বেদকে অপৌরুষেয় বলা হয়ে থাকে, অর্থাৎ বেদ মনুষ্যসৃষ্ট নয় বলে দাবী করা হয়, তবু সামগ্রিকভাবে এই শতাধিক গ্রন্থের সমষ্টিকেই ‘বৈদিক সাহিত্য’ বলা হয়। ভারতবর্ষীয় তথা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার সর্বপ্রাচীন সাহিত্য এটি। এখানে স্মর্তব্য যে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দুটো মূল ধারা রয়েছে- বৈদিক ও অবৈদিক। বেদ বহির্ভূত যা কিছু নিকৃষ্ট ও আদিম- ওই অবৈদিক জড়বাদী (চার্বাক) উপাদান সম্বলিত লোকায়ত ধারাটির গুরুত্ব সেকালে পারতপক্ষে স্বীকার করা হতো না। শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর অনুকূল ভাববাদী বৈদিক ধারাটিরই জয়জয়কার ছিলো। বৈদিক ধারার ধারক ও বাহক ছিলো ‘বৈদিক সাহিত্য’ নামের এক বিশাল শাস্ত্র-ভাণ্ডার। তাই বিষয় অনুসঙ্গ হিসেবে এ মুহূর্তে আমাদের লক্ষ্য হতে পারে এই বৈদিক সাহিত্যের কিছুটা সুলুক-সন্ধান করা, যেখানে সুকৌশলে এক আধ্যাত্মিক ভণ্ডামো আরোপ করে খুব সদম্ভেই নারী জাতিকে কেবলই ভোগ্যপণ্য ক্রিতদাসীতে পরিণত করে ফেলা হয়েছে ।
.
রচনাকালের পরম্পরা ও প্রকৃতি অনুযায়ী ‘বেদ’ চারটি- ১) ঋগ্বেদ, ২) সামবেদ, ৩) যজুর্বেদ, ৪) অথর্ববেদ।
এই প্রতিটি বেদের চারটি অংশ:
ক) ‘সংহিতা’ বা সংগ্রহ- গান, স্তোত্র, মন্ত্র প্রভৃতির সংকলন।
খ) ‘ব্রাহ্মণ’- গদ্যে রচিত একজাতীয় যাগযজ্ঞ-বিষয়ক সুবিশাল সাহিত্য।
গ) ‘আরণ্যক’- অরণ্যে রচিত একজাতীয় সাহিত্য, বিশ্ব-রহস্যের সমাধান অন্বেষণই তার প্রধান উদ্দেশ্য।
ঘ) ‘উপনিষদ’- আক্ষরিক অর্থে গুহ্য-জ্ঞান, দার্শনিক তত্ত্বের বিচারই এর প্রধান বিষয়বস্তু। এই উপনিষদকে ‘বেদান্ত’ সাহিত্যও বলা হয়।
.
বেদের সংহিতা ও ব্রাহ্মণ অংশকে কর্মকাণ্ড, আরণ্যককে উপাসনাকাণ্ড এবং উপনিষদকে জ্ঞানকাণ্ড বলা হয়। রচনাকাল ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে প্রত্যেকটি অংশের মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে বলে স্বীকৃত। বৈদিক সাহিত্যের বহু প্রাচীন অংশই বিলুপ্ত হয়েছে। তবুও যা টিকে আছে তাও আকারে সুবিশাল।
.
বেদের কাল
বেদের সুক্ত বা সংহিতাগুলো অতি প্রাচীনকালে দীর্ঘ সময় নিয়ে রচিত হয়েছে। অর্থাৎ তা কোন একক ব্যক্তির রচিত নয়। বংশ পরম্পরাক্রমে তা মুখে মুখে রচিত হয়েছে এবং শ্রুতির মাধ্যমে তা সংরক্ষিত হয়েছে। তাই বেদকে শ্রুতি গ্রন্থ্ও বলা হয়। বেদের রচনাকাল নিয়ে মতভেদ থাকলেও ধারণা করা হয় খিস্টপূর্ব ২০০০ বা ২৫০০-তে এর রচনাকাল শুরু এবং রচনা সম্পন্ন হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৭৫০ থেকে ৫০০-এর মধ্যে। সুনির্দিষ্ট কোন সন-তারিখের হিসাব করা সম্ভব না হলেও গবেষকদের স্থির সিদ্ধান্ত এটুকু যে, গৌতম বুদ্ধের পূর্বেই এ-সাহিত্যের রচনা ও সংকলন সমাপ্ত হয়েছিলো। এই দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় বহু শতাব্দির ব্যবধানের কারণেই বেদের প্রথম দিকের রচনাগুলোর সাথে শেষের দিকের রচনাগুলোর উদ্দেশ্য, ভাব ও দৃষ্টিভঙ্গিতে বিস্তর পার্থক্য তৈরি হয়ে গেছে। প্রথম দিকের রচনা সুক্তগুলোর মাধ্যমে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক সত্তা যেমন অগ্নি, নদী, বাতাস, সোম (এক জাতীয় লতা)-কে দেবতা জ্ঞান করে লিপিহীন আদিম পশুপালক জনগোষ্ঠির চাওয়া-পাওয়ার লক্ষ্য নিবদ্ধ ছিলো। এবং তা নিবিষ্ট ছিলো কোন যজ্ঞরূপ আয়োজনের মধ্য দিয়ে দৈনন্দিন ইহলৌকিক জীবনযাত্রার সাধারণ ধনসম্পদ ভোগের কামনার মধ্যে। বা কোন গোত্র-প্রধান ইন্দ্রের প্রতি নিজেদেরকে রক্ষার আবেদনে। ফলে তাকে অনেকটাই আদিম টোটেম উপজাত বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। যেমন-

‘উপঃ নঃ সবনা গহি সোমস্য সোমপাঃ পিব। নোদা ইদ্রেবতো মদঃ।।’
হে সোমপায়ী ইন্দ্র! আমাদের অভিষবের নিকট এস, সোমপান কর; তুমি ধনবান তুমি হৃষ্ট হলে গাভী দান কর। (মণ্ডল ১। সুক্ত ৪। ঋক ২)।
‘স নো দূরাচ্চাসাচ্চ নি মর্ত্যাদঘায়োঃ। পাহি সদমিদ্বিষবায়ুঃ।।’
হে সর্বত্রগামী অগ্নি! তুমি দূরে ও আসন্ন দেশে পাপাচারী মানুষ হতে আমাদের সর্বদা রক্ষা করো। (মণ্ডল ১ সুক্ত ২৭ ঋক ৩)।
‘আ নো ভজ পরমেষবা বাজেষু মধ্যমেষু। শিক্ষা বষ্বো অন্তমষ্য।।’
পরম অন্ন ও মধ্যম অন্ন আমাদের প্রদান কর, অন্তিকস্থ ধন প্রদান কর। (মণ্ডল ১ সুক্ত ২৭ ঋক ৫) ইত্যাদি।

আর শেষের দিকের এসে রচিত সুক্তগুলোয় একধরনের পারলৌকিক ধারণার উপস্থিতি দেখা যায়। অর্থাৎ তাদের আদিম অগভীর বিশৃঙ্খল চিন্তাসূত্রের মধ্যে ততদিনে আরো উন্নত কল্পনার একটা শৃঙ্খলা তৈরি হয়ে গেছে। যেমন-

‘যত্রে যমং বৈবস্বতং মনো জগাম দূবকম্। তত্ত আ বর্তয়ামসীহ ক্ষয়ায় জীবসে।।’
তোমার যে মন অতি দূরে বিবস্বানের পুত্র যমের নিকট গিয়েছে, তাকে আমরা ফিরিয়ে আনছি, তুমি জীবিত হয়ে ইহলোকে এসে বাস কর। (মণ্ডল ১০। সুক্ত ৫৮। ঋক ১)।

উল্লেখ্য, এই কাল্পনিক পারলৌকিক ধারণাই যে ধর্ম ব্যবস্থার প্রধানতম হাতিয়ার হয়ে পরবর্তীকালের মানবসংস্কৃতিকে বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিংবা তুলনামূলক আরেকটু উন্নত চিন্তার উপস্থিতি দেখতে পাই, যখন বলা হয়-

‘কিয়তী যোষা মর্যতো বধূয়োঃ পরিপ্রীতা পন্যসা বার্ষেণ। ভদ্রা বধূর্ভবতি যৎসুপেশাঃ স্বরং সা মিত্রং বনুতে জনে চিৎ।।’
কত স্ত্রীলোক আছে, যে কেবল অর্থেই প্রীত হয়ে নারীসহবাসে অভিলাষী মনুষ্যের প্রতি অনুরক্ত হয়? যে স্ত্রীলোক ভদ্র, যার শরীর সুগঠন, সে অনেক লোকের মধ্য হতে আপনার মনোমত প্রিয় পাত্রকে পতিত্বে বরণ করে। (মণ্ডল ১০ সুক্ত ২৭ ঋক ১২)।

অর্থাৎ তখন একটা সুস্পষ্ট সামাজিক কাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে যেখানে অর্থের বিনিময়ে ভোগ-উপভোগ বা অন্যদিকে নিরাপদ পরিবার গঠনের নীতিবোধ বিরাজ করতে শুরু করেছে সামাজিক আবহে। এই তুলনামূলক পার্থক্যগুলো উপলব্ধি করতে এখানে স্মর্তব্য যে, বেদজ্ঞ পণ্ডিতদের মতে প্রাচীন ঋগ্বেদের মোট দশটি মণ্ডলের মধ্যে সর্বশেষ দশম মণ্ডলের সুক্তগুলো বেদের পূর্ববর্তী নয়টি মণ্ডলের সার্বিক আবহের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। অর্থাৎ ধারণা করা হয় আরো বহুকাল পরে হয়তো উপনিষদ যুগে এই দশম মণ্ডলটি ঋগ্বেদে সংযোজিত হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য বেদসংহিতা গ্রন্থেও ঋগ্বেদের বহু শ্লোকের পুনরুক্তি রয়েছে। সম্ভবত পরবর্তীকালের ধর্মীয় উপজগুলো এভাবেই কথিত বেদাশ্রিত হয়ে আগ্রাসী ধর্মরথকে তার উদ্দেশ্যমূলক গতিপথে বেগবান করতে সহায়তা করেছে। তাৎক্ষনিক অবস্থায় হাতের সামনে যা চোখে পড়লো উদাহরণ হিসেবে তা-ই উদ্ধৃত করা হলো। বেদে এ ধরনের উদাহরণ ভুরি ভুরি রয়েছে।
.
(চলবে…)
[*] [২য় পর্ব]