লিখেছেনঃ অমল কৃষ্ণ রায়

1971

বাঁধন, প্রেয়সী আমার,
সময় বহে চলে নিরবধি – নিরলস, ক্লান্তিহীনভাবে । কারোই সুখে বা দুঃখে সে বুঝিবা মাথা ঘামায় না – সে নির্বিকার-, নিরাসক্তভাবে, নিরন্তর প্রবহমান অনন্তের প্রাণে । কবে তোমার কাছে শেষ চিঠিটা লিখেছিলাম সে তারিখটা আজ সঠিক মনে না থাকলেও মাস আর সনটা স্মৃতি থেকে আজও মুছে যায় নি – সে মাসটা ছিল এপ্রিল মাস আর সালটা ছিল ১৯৭১ সাল । এর মধ্যে কেমন করে দীর্ঘ চল্লিশটা বছর পার হয়ে গেল ! কোনো এক কালো রাত্রে তোমার কাছে চিঠিটা লিখেছিলাম – পরদিন ঘুম থেকে উঠেই আমাদের পলাশপুর বাজারের পাশের পোস্ট-অপিসের ডাকবাক্সে চিঠিটা পোস্ট করে আসি – তারপর দুপুর থেকেই সারা গ্রাম জুড়ে সেকি ভয়ঙ্কর তান্ডব ! সেদিনই মধ্যরাতে আমাকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হয় । কোথায় চলে গিয়েছিলাম, কেন চলে গিয়েছিলাম সে কথা গত চল্লিশ বছরেও তোমাকে জানানো হয়নি । অভিমানী মেয়ে ! তুমিও এতটা বছরে একবারের জন্যও তা জানতে চাওনি । তবে তুমি জানতে না চাইলেও সে কথা আজ আমিই তোমাকে জানাব – সেই কৈফিয়ত দিতেই আজ তোমার কাছে লিখতে বসেছি – তার আগে আমার একটা স্বপ্নের কথা দিয়ে তোমার কাছে এই পত্রলিখা শুরু করছি ।

স্বপ্ন কে না দেখে ? স্বপ্ন নিয়েই তো মানুষের জীবন – এই স্বপ্নের উপর ভর দিয়েই তো মানুষ বেঁচে থাকে – জীবনপথে এগিয়ে চলে ! মানুষ স্বপ্ন দেখে তন্দ্রায় – আবার গভীর নিদ্রায় – আর কত অদ্ভুতই না হতে পারে সেই স্বপ্ন ! কারণ সেই স্বপ্নদেখা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে । আবার কোনো কোনো মানুষ স্বপ্ন দেখে জাগরণে – সেই স্বপ্ন তার নিয়ন্ত্রিত স্বপ্ন – তার নিজের গড়া স্বপ্ন ! খুব ছোট বেলার কথা যদিও আমার বিশেষ মনে নেই তবে পরিণত বয়সে আমি নিদ্রায় কোনো স্বপ্ন দেখেছি বলে মনে পড়ে না – তাই আমার নিকট-আত্মীয় থেকে শুরু করে আমার প্রায় সকল বন্ধু-বান্ধবদের কাছেই আমি এক বিশেষ অদ্ভুত মানুষ হিসাবে পরিচিত ! মনে পড়ে আমি যখন হাইস্কুলে পড়তাম – হয়ত অনেককটা বন্ধুর সাথে একত্রে মিলে আড্ডা দিচ্ছি – এর মধ্যেই দেখা গেল আমি হঠাৎ করেই তাদের থেকে দূরে সরে গিয়ে আনমনে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি । এর জন্য আমার বন্ধুরা কেউ কেউ বোধ করি আমাকে মাঝে মাঝে পাগল ঠাওরাতেও দ্বিধা করেনি – তবে থাক সে কথা-আমি যে ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত গাইতে শুরু করেছি । আমার বিশেষ স্বপ্নটার কথা এবার তোমায় লিখছি : তুমি তো জানো মাধ্যমিক স্কুলের গন্ডি পার হয়েই আমি গ্রাম ছেড়ে রাজধানী ঢাকায় এসে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হই । পলাশপুরের নিভৃত মায়াময় পল্লীর কোল ছেড়ে হঠাৎ করে কোলাহলপূর্ণ মহানগরীতে এসে আমার কৈশোরোত্তীর্ণ-মন কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠলো । আমার গ্রামের বন্ধুদের জন্য, মা, ভাই আর বাবার জন্য মন যেন কেমন করে উঠত ! তবে আমার সৌভাগ্যই বলতে হবে যে ক্লাসে আমার কয়েকজন খুব ভালো বন্ধু জুটল – তাদের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু জাকির ।

তখন সবেমাত্র কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হয়েছি, জাকিরদের তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় জহির ভাইয়ের বিয়ে – আমরা জাকিরের দশ-বন্ধু ঢাকা থেকে ট্রেনে করে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে যাই এবং সেখান থেকে স্টিমারে যমুনা নদী পার হয়ে আবার ফুলছড়ি ঘাট থেকে ট্রেনে করে রংপুরের কুড়িগ্রামে গিয়েছি সেই বিয়েতে । জীবনে এই প্রথম আমাদের পলাশপুর গ্রাম থেকে অনেক দূরে গিয়েছি । বিয়ের তিনদিন পর জাকিরদের ধানমন্ডির বাড়িতে বৌভাতের অনুষ্ঠানে । সেদিন রাতেই আবার তাদের সেই বাড়িতে নব বর-বধুর বাসররাত্রি । সন্ধ্যায় তাদের বাড়িতে পৌঁছতেই জাকির আমাকে নিয়ে গেল তাদের বাড়ির দোতলার একটা ঘরে, সেটাতেই হবে ভাই আর ভাতৃ-বধুর ফুলশয্যা । ঘরখানা সাজানো হয়েছে মনোরম সাজে – অত্যন্ত কারুকার্যখচিত একখানা পালঙ্ক – তাজা ফুলের শয্যা – ঘরখানার চারিদিক ফুলে ফুলে ছাওয়া – আর সারা ঘরে নীলাভ বৈদ্যুতিক বাতি – এক স্বিগ্ধ স্বর্গীয় সৌন্দর্যে যেন ঘরখানা ভাসছে – আমার স্বপ্নিল চোখ দুটো মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেই ঘরে অনেকক্ষণ থেমে থাকলো – আর আমার মনে এসে এক নতুন স্বপ্ন বাসা বাঁধলো !

জানিনা সেই বিশেষ মুহূর্তটিতে আমার মনের রসায়নে কেমন করে কি ঘটে গেল – আমার উদ্ভিন্নযৌবনা মন তোমাকে নিয়ে এক স্বপ্নিল বাসর-ঘরের স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো – সে কথা তোমাকে কখনোই বলা হয়ে উঠেনি, আমি স্বপ্ন রচনা করতে শুরু করলাম যেদিন তোমার সাথে আমার মিলন হবে – যেদিন থেকে তোমার সাথে আমার একত্রে পথ চলা শুরু হবে সে দিনটিকে নিয়ে – আমাদের মধু-মিলনের বাসর শয্যাটি কেমন হবে সে স্বপ্নে আমি অনেক সময়েই আত্মমগ্ন হয়ে থাকতাম – কল্পনার ফানুস উড়িয়ে তোমাকে নিয়ে আমার মনের মনিকোঠায় সেই স্বপ্ন-বাসরের একটা অদ্ভুত সুন্দর ছবি আঁকলাম : আমাদের স্বপ্নের বাসরঘরটি হবে ছায়াঘন এক নিভৃত নীপবনে – যেখানে থাকবে একটি সুরম্য কুটির – কুটিরখানা হবে মাটির তৈরী – আর তার সাথে ছনের ছাওনি দেয়া চালা – সেই কুটিরের বাইরের দেয়ালের রংটি হবে ধূসর বর্ণের আর ভিতরের দেয়ালের রং আসমানী নীল – আমাদের মায়াবী-মিলনের কল্পনার আল্পনায় আঁকা । সারা ঘরে থাকবে আমাদের দুজনের জন্য যথেষ্ট বড় একখানা গোলাপে রাঙানো ফুলের শয্যা আর তার চারপাশে ঝোলানো তাজা রজনীগন্ধা । ঘরের মেঝেতে থাকবে আমাদের দুজনের বয়সের যোগফলের সমান সংখ্যক রেড়ির তেলের মাটির সেঁজুতি এবং ঘরটির সামনে দরজার সিঁড়ির দুপাশে থাকবে হাস্নাহেনার দুটি ঝোপ । আমাদের বাসররাত্রির রাতটি হবে শরতের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমার রাত – আমার পরনে থাকবে সাদা পাজামা আর হাতে কাজকরা হালকা নীল রঙের পাঞ্জাবি – আর তুমি পরবে হালকা গোলাপীরঙের একখানা জামদানি শাড়ি । তোমার হাতে থাকবে মেহেদির আল্পনা আর মুখমন্ডলে চন্দনের সাজ এবং কপালে একখানা বড় লাল টিপ । অনন্ত রাত্রির মধ্যে সেই একটি রাত হবে আমাদের দুজনের বর্তমানের আনন্দে আর ভবিষ্যতের স্বপ্নে-গাঁথা একখানা মায়াবী রাত ! কিন্তু হায় সেই স্বপ্ন দেখার কাল থেকে প্রায় চার যুগ পার হয়েও আমার সেই স্বপ্ন এখনো স্বপ্নই থেকে গেল !

আজ এত বছর পর তোমার কাছে লিখতে বসে কত কথাই না মনে ভেসে আসছে । মনে পড়ছে তোমাকে দেখার সেই প্রথম দিনটির কথা । তখন আমি আমাদের গ্রামের বিদ্যাসুন্দর উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে পড়ি । সময়টা তখন আশ্বিনের শেষ দিক – শারদীয়া দুর্গাপূজার আর মাত্র কয়েকদিন বাকি । সেই বছর আমাদের গ্রামে অনেকগুলো পূজামন্ডপ তৈরী হয়েছে । আমাদের পাড়ায় আমাদের পাশের বাড়িটি অক্ষয়কুমার পোদ্দার মহাশয়ের বাড়ি – তাদের সাথে আমাদের পারিবারিক নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্ক । তাদের বাড়িতেও সেই বছর দুর্গাপূজা । বরাবর পূজার সময় যা হয় আমরা তখন খুশিতে মেতে উঠতাম – সে বারও আমি খুশিতে আন্দোলিত । সে বার আরো বেশি খুশি কারণ আমাদের একেবারে বাড়ির পার্শ্বেই পূজামন্ডপ । সেদিন পড়ন্ত বিকালে কয়েকজন বন্ধুর সাথে নদীর পাড়ে বসে ছিলাম । যদিও সে দিনটি ছিল আর সকল দিনের মতই একটি সাধারণ দিন কিন্তু পরে কেন জানি মনে হত সেদিনটি ছিল আমার জীবনের একটি বিশেষ বাঁক পরিবর্তনের দিন কারণ সে দিনই যে একটি পনর বছরের কিশোরের মনে লেগেছিল এক নতুন অভিজ্ঞতার দোলা । তখন সন্ধ্যে হয় হয় – পশ্চিমাকাশ অস্তগামী সূর্যের শেষ রক্তিম আভায় অপরূপ এক সাজে নিজেকে সাজিয়েছে । আমি মুগ্ধ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে আছি – এর মধ্যেই একখানা পালতোলা পানসি নৌকা এসে ধীরে ধীরে আমাদের নদীর ঘাটে ভিড়ল । দুইজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা আর একজন অনিন্দ্য সুন্দরী কিশোরী বালিকা সেই নৌকা থেকে পাড়ে এসে নামল – দিনান্তের সেই রক্তিম আভায় উদ্ভাসিতা সেই রূপবতী বালিকার প্রতি আমি মোহাবিষ্ট হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় কোনো চলচ্চিত্রের কল্প-কাহিনীর নায়কের মত মত ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম । বিনা বাক্যব্যয়ে সেই বালিকার পিছন পিছন হাঁটতে হাঁটতে তাদের গন্তব্যস্থলের দিকে ধাবিত হলাম । আশ্চর্য্যজনক হলেও সত্যি আমাকে অবাক করে দিয়ে তোমরা যে বাড়িটিতে গিয়ে উঠলে সেটি আমাদের সেই পাশের বাড়ি – অক্ষয়কুমার পিসেমহাশয় আর চারুলতা পিসির বাড়ি । মন আমার আনন্দে নেচে উঠল – আমার মস্তিষ্কে কি যেন এক অজানা অনুভূতির তরঙ্গ হিল্লোলিত হতে শুরু করলো । আমার অনভিজ্ঞ মন তখনও জানেনি এই অনুভূতির কি নাম !- তবে এর কিছুদিনের মধ্যেই অন্তরে অনুভব করলাম এই অনুভূতির নামই প্রেম – প্রথম দৃষ্টিতেই আমি নিশ্চিতভাবে তোমার প্রেমে পড়ে গেলাম । কলেজে প্রথম বর্ষে উঠেই আমাদের কলেজের দেয়াল পত্রিকায় একখানা নিবন্ধ পড়েছিলাম – সেই নিবন্ধের নাম ছিল “Falling in love at the first sight” । সেখনে জেনেছিলাম যে কোনো যুবক-যুবতী একজন আরেকজনকে দেখার সাথে সাথে যদি তাদের উভয়ের মস্তিষ্কের বিশেষ গ্ল্যান্ড থেকে একই সাথে কিছু বিশেষ স্নায়ু-হরমোন (neurohormones) যেমন অক্সিটোসিন, ভ্যাসোপ্রেসিন বা ডোপামিন ক্ষরিত হয় তাহলে তারা প্রথম দৃষ্টিতেই একে অপরের প্রেমে পড়ে যেতে পারে । আমার কেন জানি মনে হয় তোমার আমার ক্ষেত্রে এমনটিই বুঝি ঘটে ছিল তা না হলে সেই প্রথম দিন থেকেই কেন আমরা একে অপরের প্রতি এমন আকৃষ্ট হয়ে পড়ব। তোমার নিশ্চয় মনে আছে – সেই পূজার সময় যে কয়দিন তুমি তাদের বাড়িতে ছিলে আমি প্রতিদিন তাদের ওখানে যেতাম – পূজা দেখার নাম করে আমি তোমাকে দেখতে যেতাম । যে বালিকাটির সাথে মাত্র কয়েকদিনের পরিচয় তাকে মনে হত কতকালের আপন – প্রতিদিন সন্ধ্যায় যখন পূজা দেখতে যেতাম তুমি তখন অপরূপ সাজে সজ্জিতা হয়ে আমার পাশটিতে এসে দাঁড়াতে – দুর্গামূর্তিকে দেখার ছল করে আমি বাঁধন-মূর্তির দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকতাম । তারপর একসময় দেখতাম কখন চুপিসারে ঘর থেকে আমার জন্য দুধের সন্দেশ আর নারিকেলের নাড়ু নিয়ে এসেছ । ছোট বেলা থেকেই কতবারই তো দুর্গাপূজা দেখেছি কিন্তু সেই বারের মত এমন মুধুময় রোমান্টিক পূজার দিন আমার জীবনে আর দ্বিতীয়বার আসেনি । সে বারের পূজার সেই ক’টা দিন যেন কনকর্ড বিমানের গতিতে নিমেষেই অন্তর্হিত হলো ! তোমার নিশ্চয় মনে আছে তারপর পূজা শেষ হওয়ার কয়েকদিন পর তুমি চলে যাবার দিন আমরা দুজনেই লজ্জার মাথা খেয়ে সবার সামনেই কাঁদতে শুরু করে দিয়েছিলাম ।

তুমি চলে যাবার পর আমি মন খারাপ করে বসে থাকতাম । আমার মন খারাপ করার কারণ মা’র কাছে অজ্ঞাত ছিল না। মা আমাকে বলতেন “বোকা ছেলে” মন খারাপ করার কি আছে “বাঁধন” তো আবার কয়েকদিন পরই তোর চারুপিসির বাড়িতে বেড়াতে আসবে । যদিও জানতাম মা আমার মন ভালো করার জন্য এমনি এমনি এসব কথা বলছে তবু মায়ের কথার আশ্বাসে মনে একটু স্বস্তির বাতাস বইত । মনে পড়ে তুমি চলে যাবার প্রায় দুই সপ্তায় পর মার সাথে একদিন বিকালে চারুপিসির বাড়িতে বেড়াতে গিয়াছি । তুমি তো জানই তাঁরা আমাদের কোন আত্মীয় না হলেও তাদের সাথে আমাদের সম্পর্কটা ছিল আত্মীয়ের চেয়েও বড় । তাদের একমাত্র মেয়ে সুতপাদির বিয়ে হয়ে গেছে তা অনেক বছর আগে, আর তাদের কোন ছেলে না থাকতে অক্ষয়-পিসা আর চারু-পিসি আমাকে তাদের ছেলের মতই আদর করতেন । সেদিন মা’র সাথে তাদের উঠানে পা দেওয়ার সাথে সাথেই চারুপিসি মাকে বলছেন “ভালই হলো অর্ঘ্যকে নিয়ে এসেছ, আজই বাঁধনের মায়ের কাছ থেকে চিঠি এসেছে, বাঁধনের মা লিখেছেন এখান থেকে যাওয়ার পর থেকেই বাঁধন কেবল অর্ঘ্যের জন্য কান্নাকাটি করছে । হায়রে অদ্ভুত মানব হৃদয় ! এই কথা শুনার পর আমি অনেক লজ্জা পেলাম বটে কিন্তু আমার কিশোর-মনখানা খুশিতে নাচতে শুরু করলো । মাসি মাকে বলতে শুরু করলেন এই দুটোর বন্ধুত্ব নিষ্পাপ আর এই দুটোকে দেখতেও লাগে ভালো । এবার আমি সত্যিই লজ্জা পেলাম – এবং মাকে রেখেই এক দৌড়ে বাড়ি চলে গেলাম । মার সাথে সেদিন চারু-পিসির আর কি কি কথা হয়েছিল তা আমি জানি না তবে এর পর থেকে আমার বুঝতে কষ্ট হয়নি তোমার সাথে আমার হৃদয়জ সম্পর্কের ক্ষেত্রে গতানুগতিক প্রাচ্য-পারিবারিক বিধি নিষেধের অর্গল এসে দুজনের মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি ! এই প্রসঙ্গে বলে রাখি যে, যে কথা তোমাকে কোনো দিনই বলা হয়নি – ছোট বেলা থেকেই আমি ডাঃ লুৎফর রহমানের লিখা “উচ্চ জীবন “, মানব জীবন”, “মহৎ জীবন”, “ধর্ম জীবন” এই বইগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তাম – ঐগুলো পড়ে পড়ে আমি নিজেকে একজন আদর্শবান মানুষ হিসাবে গড়ার স্বপ্ন দেখতাম । মনে পড়ে সেই বইগুলোর কোনো একটাতে পড়েছিলাম ” একজন নারীর সাথে প্রেম করার অধিকার কেবল তারই আছে যে নিজেকে একজন সত্যের সৈনিক রূপে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে ” । আমি নিজেকে অনেকটা এর কাছাকাছি নিতে পেরেছিলাম বলেই বোধ হয় তোমার সাথে আমার এই গভীর ভালবাসার সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে পারিবারিক কোনো বাঁধাই আমাদের অন্তরায় হয়ে উঠেনি !

তুমি চলে যাবার পর থেকেই বার বার মনে হচ্ছিলো তোমার কাছে একটা চিঠি লিখি – তোমার কাছে আমার তোমার জন্য মন খারাপ লাগার অভিব্যক্তিগুলো ভাষায় ব্যক্ত করি । কিন্তু কি জানি এক সংকোচ, ভয়, আর লজ্জার বিহ্বলতা এসে আমাকে আষ্টে-পৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরল, অনেক চেষ্টা করেও এর থেকে কিছুতেই বের হয়ে আসতে পারছিলাম না । সেদিন মা’র সাথে চারুপিসির বাড়িতে গিয়ে পিসির সেই কথা শুনার পর থেকে মনে হলো যেন তোমার কাছে একটা চিঠি লিখার “ছাড়পত্র” পেয়ে গেলাম । সেদিনই রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমি চুপি চুপি পড়ার ছল করে হারিকেন শিখার মৃদু আলোকে আমার স্কুলের খাতার একখানা পাতা ছিঁড়ে তোমার কাছে প্রথম পত্র লিখতে বসলাম । কিন্তু এবার আরো বড় সমস্যা – তোমাকে কি সম্বোধন করব আর কি ই বা লিখব তার আদ্যোপান্ত কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না । কয়েক লাইন লিখি আর ছিঁড়ি – হায় ছিঁড়তে ছিঁড়তে এক সময় আমার খাতার সব কটা পৃষ্টাই শেষ হয়ে গেল – সে রাতে তোমার কাছে আর চিঠি লিখা হলো না । পর দিন মার কাছ থেকে আট আনা পয়সা নিয়ে বাজার থেকে আরো দুই খানা খাতা নিয়ে আসি । সেই রাতে আবার লিখতে বসে আরো পাঁচ-ছয় খানা পাতা নষ্ট করে তোমার কাছে আধ-পৃষ্ঠার একখানা চিঠি লিখি । জানিনা কি মনে করে তোমাকে সেদিন “প্রিয় বন্ধন” হিসাবে সম্বোধন করলাম, আর “তোমার জন্য আমার মন কেমন করে” এই কথাটা দশবার লিখলাম, আর লিখলাম “তোমাকে আবার দেখতে খুব ইচ্ছে করে”, আর খুব ভয়ে ভয়ে লিখলাম “আমার কচ্ছে তুমি চিঠি দিও, আমি তোমার চিঠির অপেক্ষায় থাকব” । পরদিন খুব ভয়ে ভয়ে মার কাছে এই চিঠিখানা পোস্ট করার অনুমতি প্রার্থনা করলাম – অবাক হবার মতই ঘটনা ঘটল – মা আমাকে বেশ খুশি মনেই সেই চিঠিটা পোস্ট করার অনুমতি দিলেন । আমি এক দৌড়ে চারুপিসির কাছ থেকে তোমাদের ঠিকানাটা এনে আর এক দৌড়ে পোস্ট-অপিসে গিয়ে সেখান থেকে একখানা খাম কিনে তোমার চিঠিখানা পোস্ট করি । তারপর শুরু হলো তোমার কাছ থেকে পত্রোত্তর পাওয়ার প্রতীক্ষা – এই প্রতীক্ষার যেন শেষ নেই – প্রতিটি দিনের প্রতিটি পল তোমার কাছ থেকে একটা উত্তর পাওয়ার প্রতীক্ষা ! দীর্ঘ প্রতীক্ষা আর অপরিসীম উদ্বেগের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে অবশেষে তোমার কাছ থেকে সেই বহু প্রতীক্ষিত পত্র এসে হাজির হলো । সেদিন সন্ধ্যায় বাবা বাড়ি আসার সময় পত্রখানা নিয়ে এসে আমার হাতে দিলেন – আমি লজ্জায় আরক্তিম হয়ে অস্বাভাবিক রকম অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম – মনে হচ্ছিলো কেন আমি তোমার কাছে পত্র লিখতে গেলাম – আর কেনই বা তুমিও আমার কাছে চিঠি পাঠালে । সেদিন লজ্জায় খাম থেকে তোমার পত্রখানা খোলার আর শক্তি সঞ্চয় করতে পারলাম না – আবার সেটি খুলতে না পারার যন্ত্রনায় সারারাত ঘুমাতেও পারলাম না । পরদিন স্কুলে যাওয়ার সময় তোমার চিঠিখানা সাথে নিয়ে গেলাম । স্কুল ছুটির পর সেদিন বন্ধুদের সাথে না গিয়ে একাকী বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম । বাড়ির পথে প্রকান্ড বড় বটগাছটার আড়ালে গিয়ে কেও যাতে কোনো ভাবেই না দেখতে পায় সেটা নিশ্চিত হয়ে আধো ভয় আর আধো লজ্জা মিশ্রিত এক অজানা উত্তেজনায় তোমার পত্রখানা খুললাম ! পত্রখানা পড়ছি আর কি এক ভয় আর বিহ্বলতায় আমার সারা শরীর কাঁপছে । তোমার সেই প্রথম চিঠির প্রথম কটা লাইন এখনো আমার মনে গেঁথে আছে, ” প্রিয় অর্ঘ্য, তোমার চিঠি পেয়ে আমার শরীর খুশিতে নাচছে – আর আমার মনে আনন্দের জোয়ার বইছে । আমি “বাঁধন” আজ থেকে তোমার “বন্ধন” হলাম” । তোমার সেই চিঠি পেয়ে আমি সে রাতে একটুও ঘুমাতে পারি নি । কেবল কি এক অজানা অনুভূতির খুশিতে সারারাত চটপট করলাম !!

তারপর থেকেই আমার যুবা-বয়সের প্রারম্ভে আর এক নতুন অধ্যায়ের আরম্ভ – আমার সেই জীবনে যেন কি এক সুরভিত সমীরণের হিল্লোল তরঙ্গায়িত হতে শুরু হলো । তোমার কাছে চিঠি লিখা আর তোমার কাছ থেকে চিঠি পাওয়া আমার এক অদ্ভুত নেশায় পরিনত হলো । তোমার কাছে চিঠিটা পোস্ট করেই তার উত্তরের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকতাম । তোমার কাছ থেকে চিঠি এলেই আমার মন ময়ূরী পেখম তুলে নাচতে থাকত – মন আনন্দ-জোয়ারে ভেসে চলত – বার বার তোমার চিঠিখানা পড়তাম – তোমার পত্রের প্রতিটি শব্দ থেকে নব নব আনন্দের উৎস খুঁজতাম – তোমার কাছ থেকে আর একটা পত্র না আসা পর্যন্ত তোমার পত্রখানা আঁকড়ে ধরে থাকতাম । তোমার কাছে আমি চিঠি লিখতাম আমার মনের সবটুকু রং মিশিয়ে – ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁচা বয়সের ভালবাসার অনুভূতি তোমাকে কত ভাবে লিখতে চেষ্টা করতাম – মাঝে মাঝে তোমাকে দীর্ঘ পত্র লিখতাম – মনে হলে আজ হাসি পায় একই কথা তোমাকে কতবার কতভাবে লিখে লিখেও মনে হত তোমাকে যা লিখতে চাই তা যেন কিছুতেই লিখতে পারছি না – এই ভাবে পত্র বিনিময়ের মধ্য দিয়েই তুমি কবে যেন আমার হৃদয়ের মাঝখানটায় এসে আসন গেঁড়ে বসলে !

একাদশ শ্রেণীতে উঠেই আমি যখন ঢাকায় চলে আসলাম তুমি তখন আমাদের গ্রামের রাধাকিশোরী উচ্চ-বালিকা বিদ্যালয়ে এসে নবম শেণীতে ভর্তি হলে । তোমার চারুমাসির সাথে আমাদের পারিবারিক মধুর সম্পর্কের সুত্র ধরে তুমি ক্রমে ক্রমে আমাদের পরিবারে আমার মা-বাবার সাথে এক ঘনিষ্ট সম্পর্কের বন্ধনে জড়াতে শুরু করলে । আমি ঢাকায় গিয়ে তোমাকে আরো বেশি করে চিঠি লিখতে শুরু করলাম । প্রতিটি চিঠি তোমার কাছে লিখতাম কতই না যত্ন করে কত সুন্দর সুন্দর কাগজে ! ঢাকার নিউ মার্কেটের একটা কাগজের দোকান থেকে সুন্দর সুন্দর খাম কিনে এনে সেই খামে তোমার নাম ঠিকানাটা লিখতাম রঙিন কলমে কতটা সময় ধরে আমার মনের সবটা মাধুরী মিশিয়ে ! তুমিও কতই না সুন্দর করে আমার কাছে চিঠি লিখতে – তোমার চিঠিগুলো কত যত্ন করে একটা বড় খামে সংরক্ষণ করতাম – আজও চল্লিশ বৎসর পর যক্ষের ধনের মত তোমার চিঠিগুলো আগলে রেখেছি – আজ সবগুলো চিঠি খুলে গুনলাম – সাত বৎসরে লিখা মোট ২৬৭ খানা চিঠি !

আমার আজও মনে করে মন শিহরিত হচ্ছে সেবার কলেজের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে অনেকদিন পর বাড়ি এসেছি । সেদিন বাড়ি ফিরে বিকালে গিয়েছি চারুপিসিদের বাড়িতে । ঘরে গিয়ে আমি চারুপিসিকে প্রণাম করে তাদের ঘরের চৌকিতে বসেছি – আমার দুচোখ তোমাকে খুঁজছে – হঠাৎ দেখি তুমি পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছ । চারুপিসি তোমাকে ডাকলেন কাছে আসতে – সেই অপরূপ সুন্দরী বন্ধন লজ্জারাঙ্গা মুখে আমার সামনে এসে দাঁড়ালে । অনেকদিন পর তোমার সাথে দেখা – তুমি এর মধ্যেই মনে হলো অনেক বড় হয়ে গেছ – দীপ্ত যৌবনের অনাবিল সৌন্দর্যের অযুত রেখাচিত্র তোমার দেহপটে প্রতিভাসিত – তুমি কিছু বললে না – আমিও মুগ্ধ নয়নে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে পলকহীন নেত্রে তোমার দিকে তাকিয়ে রইলাম – এমন ভাবানুভূতি আমার জীবনে এই প্রথম – তোমারও বুঝি তাই ! চারুপিসিই আমাদের এই সংকট থেকে রক্ষা করলেন – তিনি বললেন, ” বাঁধন, অর্ঘ্যের জন্য এক গ্লাস জল নিয়ে আয় “। সে বার একমাসের মত বাড়িতে ছিলাম – প্রায় প্রতিদিন হয় তুমি আমাদের বাড়িতে আসতে, নয়তো আমি চারুপিসিদের বাড়িতে যেতাম – তোমার সাথে আমার কত কথা হত ! এমনি করে আমাদের মনের অজান্তেই বোধ করি আমরা দুজনই একে অপরের একেবারে কাছের মানুষ হয়ে গেলাম । তোমার নিশ্চয় মনে আছে সে বার বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরে তোমার কাছে ২০ পৃষ্ঠার একখানা দীর্ঘ পত্র লিখেছিলাম – কিন্তু মজার ব্যাপার হলো আমাকে হার মানিয়ে তুমি পত্রোত্তরে আমাকে দিলে দীর্ঘ ২৩ পৃষ্ঠার একখানা চিঠি । তোমার সেইসব চিঠিগুলো আজ আমার বাঁচার অবলম্বন !!

সময় বহে চলে – মনে হচ্ছিল যেন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আরো এক ধাপ এগিয়ে এগিয়ে তোমার সাথে আমার হৃদয়ের সম্পর্ক বাড়তে লাগলো । এর মধ্যে তুমি মাধ্যমিক পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে বগুড়া সরকারী আযিযুল হক কলেজে এসে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হলে । আমি কলেজ ডিঙিয়ে ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্হাপত্যবিদ্যায় পড়তে শুরু করলাম । মনে পড়ে আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি – সামনে রোজার বড় ছুটি আসছে – তোমার কাছ থকে একখানা দীর্ঘ চিঠি পেলাম – খুবই সুন্দর হৃদয়গ্রাহী চিঠি – অত্যন্ত আবেগ আর ভালবাসা মিশিয়ে অনেকটা অনুনয়ের সুরে লিখেছ – সেই রোজার ছুটিতে বগুড়া থেকে তোমাকে সাথে নিয়ে তোমাদের বাড়িতে যেতে – পত্রে এও লিখেছ তোমার বাবা-মা বিশেষ ভাবে আমাকে নিয়ে যেতে বলেছেন । তোমার এই সহৃদয় আমন্ত্রণ পেয়ে আমার মন খুশির জোয়ারে ভাসতে শুরু করলো – কবে ছুটি হবে আর তোমার সাথে তোমাদের বাড়িতে যাব তার জন্য আমি একটি একটি করে দিন গুনতে শুরু করলাম – এই প্রতীক্ষার যেন শেষ হয় না । তারপর একদিন সেই দিন উপস্হিত হলো । বগুড়া থেকে তোমার সাথে তোমাদের বাড়িতে গেলাম । তোমার সেই একান্ত সান্নিধ্যে তোমাদের সেই বাড়িতে আগমন আমার জীবনের সুন্দরতম দিনের একটি দিন । তোমার বাবা-মা আর ছোট বোনটি কি যে আন্তরিকতায় আমাকে সেদিন তোমাদের বাড়িতে বরণ করেছিল সে কথা মনে হলে আজও শ্রদ্ধায় আর ভালবাসায় তাদের প্রতি আমার মাথা নত হয় । তোমাদের বাড়িতে কি যে ভালো লেগেছিল আমার জীবনের সেই কটা দিন – আর কি যে ভালো লেগেছিল তোমাদের সেই সুন্দর গ্রামখানি । আমি আজ মনে মনে চিন্তা করি – তোমাদের গ্রামখানি কি সত্যি এত সুন্দর আমার কাছে তাকে যত সুন্দর মনে হয়েছিল – নাকি তোমাকে এতটা ভালবাসতাম বলেই তোমাদের বাড়ি আর তোমাদের গ্রামখানি আমার কাছে এত ভালো লেগেছিল !! তুলসীগঙ্গা নদীর পাশে তোমাদের গ্রামখানি ছবির মত সুন্দর – একদিন তোমাদের সেই নদীতে আমি যখন স্নান করছিলাম – তুমি তীরে দাঁড়িয়েছিলে – আমি সাঁতরাতে সাঁতরাতে অনেকদূর চলে গিয়েছিলাম – সেটি দেখে তোমার সেকি খুশি !- সে কথা মনে হলে আজও আমার মন শিহরিত হয় ।

তোমাদের বাড়িতে বেড়ানোর সময়ের একটা কথা মনে পড়ছে । একদিন বিকালে তুমি, আমি আর আমাদের সাথে তোমার ষষ্ঠ শ্রেণীতে-পড়া বোনটি, ব্র্রীহি তুলসীগঙ্গা নদীর কুল ঘেঁসে হেঁটে হেঁটে একটা পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িতে এসে হাজির হলাম – অনেক পুরানো তবুও অদ্ভুত সুন্দর সেই বাড়িটি – বাড়িটির মধ্যখানে একখানা প্রকান্ড দীঘি আর তাতে দীর্ঘ একখানা সিঁড়ি সমেত শানবাঁধানো ঘাট – সেই ঘাটে আমরা সন্ধ্যাবধি বসেছিলাম আর কত কথা – একটি কথা এখনো ভুলিনি – তোমার নিশ্চয় মনে আছে – ব্র্রীহি আমাকে দাদাবাবু বলে ডাকত – সেদিন সেই দীঘির পাড়ে বসে আমি হেঁয়ালিবশে ব্র্রীহিকে জিজ্ঞেস করলাম এই ব্র্রীহি তুমি কেন আমাকে দাদা না ডেকে দাদাবাবু ডাক ? – সেদিন সেই সরলা বালিকার সেই সরল সত্য কথায় আমরা দুজনেই কিনা খুশি আর কতই না লজ্জায় আরক্ত হয়েছিলাম – তোমার নিশ্চয় মনে আছে – সে বলল ” মা বলেছে, একদিন আপনার সাথে বু-দিদির বিয়ে হবে” । ব্র্রীহি তোমাকে তখন বু-দিদি বলে ডাকত ।

মনে পড়ে সেই সালটা ছিল ১৯৬৮ সাল – তখন হেমন্তকাল – আমরা দুজনে কুয়াশা-ঢাকা ভোরে প্রায় দুই মাইল রাস্তা হেঁটে বগুড়ার ট্রেন ধরার জন্য বসন্তপুর থেকে শিমুলতলায় যাই, তারপর বগুড়ায় পৌঁছে সেখান থেকে ঘোড়ারগাড়িতে করে যাই আড়াই হাজার বছর আগের দূর্গ নগরী, একসময় বাংলার রাজধানী বলে খ্যাত ঐতিহাসিক পুন্ডবর্ধন বা বর্তমানের মহাস্থানগড় পরিদর্শনে । প্রথমেই আমরা যাই কালিদহ সাগর দেখতে, তারপর সেখান থেকে যাই করতোয়া নদীর তীরে শীলাদেবীর ঘাট দেখতে । তোমার কাছেই শুনলাম শীলাদেবী ছিলেন পরশুরামের বোন আর তারই স্মরণে প্রতিবছর সেখানে হিন্দুদের স্নান হয় আর একদিনের মেলা বসে । আমি স্থানটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দর্শনে মুগ্ধ হলাম এবং আমরা তৎক্ষনাৎ দুজনে মিলে ঠিক করলাম আমরা আবার একবার এখানে আসব মেলা দেখতে । সেখান থেকে আমরা গেলাম সম্রাট অশোক কর্তৃক নির্মিত ৪৫ ফুট উঁচু ১৭২টি প্রকোষ্ঠের বৌদ্ধ-স্তম্ভ দেখতে । তোমার কাছেই শুনলাম স্থানীয় লোকেরা এখন এটাকে বলে “বেহুলার বাসর ঘর” । স্বামীর প্রতি নিষ্ঠাবতী বেহুলার এই বাসরঘরের জায়গা পরিদর্শন করতে এসে আমি আনন্দে অভিভূত – তুমিও ততৈবচ ! আমরা দুজনে হাত ধরাধরি করে অনেকক্ষণ পাগলের মত সারা স্তম্ভ জুড়ে ঘুরে বেড়ালাম – তারপর সেই স্তম্ভের একেবারে চূড়ায় উঠে দুজনে হাতে হাত রেখে অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম – তারপর একসময় নীরবতা ভঙ্গ করে তুমিই প্রথম বললে – “অর্ঘ্য, তুমি বল আজ আমার হাতে হাত রেখে – যে আজ থেকে তুমি কেবল আমার” -আমি সেদিন সায়াহ্নের শেষ আলোয় নীল কাঁচের চুড়ি পরিহিত তোমার সুগোল কুসুমপেলব হাতে হাত রেখে বলেছিলাম – “বাঁধন, আজ থেকে তুমি আমার চির জীবনের “বন্ধন” । তুমি মুহুর্তে আমার দুটি হাত তোমার মুষ্ঠিবন্ধনে নিয়ে আমায় বললে “অর্ঘ্য, আজ থেকে তুমি আমার চির সখা – আমার প্রাণের প্রাণ – এই পতিভক্ত বেহুলার বাসর ঘর আমাদের এই শপথের সাক্ষী” । তারপর দিনান্তের শেষ রৌদ্রচ্ছটায় তোমার আনত আরক্তিম মুখের দিকে আমি অনিমেষ নেত্রে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম তা মনে নেই । তারপর আমাদের দুজনের মুখে আর কোনো কথা ফুটে নি – আরো অনেকক্ষণ বসে ছিলাম সময়-জ্ঞান বিস্মৃতি করে – অবশেষে দিনান্তে আমরা তোমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে আবার রওয়ানা দেই এবং বেশ রাতে এসে বসন্তপুরে পৌঁছি । জানিনা কি এক অনন্ত আনন্দে সে রাতে সারারাত ঘুমাতে পারিনি । পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমার ঘরে এসে তুমি আমাকে বলেছিলে তুমিও সে রাতে এক ফোঁটাও ঘুমাও নি !

তোমাদের বাড়ির সেই পনরটা দিন মনে হয় আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম দিন – তোমার মা আর তুমি মিলে আমাকে প্রতিদিন কি খাওয়াবে সেই নিয়ে তোমাদের প্রাণান্তকর চেষ্টা আমার জীবনের এক উজ্জ্বলতম ইতিহাস । আমি চলে আসার আগের দিন তুমি অনেক সময় নিয়ে কত যত্ন করে আমার কাপড়-চোপরগুলো আমার সুটকেসে ঘুচিয়ে দিলে । তবে এত আনন্দের মধ্যে বেদনার হিম-শীতল বাতাস বইতে শুরু করেছিল যেদিন তোমাদের বাড়ি থেকে চলে আসি । তোমার চোখ থেকে বইছিল অশ্রুর অঝোরে ধারা – আমিও কান্না রোধ করতে পারি নি – কথা ছিল পরের বছর বড় ছুটিতে আবার তোমাদের ওখানে যাব কিন্তু তা আর হলো না । সে কথা মনে হলে আজও মন বেদনায় ভারাক্রান্ত হয় ।

তোমার নিশ্চয়ই ১৯৬৯-৭০ সালের উত্তাল দিনগুলোর কথা মনে আছে । ‘৬৯ সালে আমি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, তুমি তখন গণিতে অনার্স পড়তে শুরু করেছ – সারা দেশে গণঅভ্যুত্থানের জোয়ার – জনতার আন্দোলনে শেখ মুজিব আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে জেল থেকে বের হয়ে এলেন । তারপর ৭০ সালে জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে দেশবাসীর মনে আশার সঞ্চার হলো – কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের নোংরা চক্রান্তে যখন সব কিছু বানচাল হয়ে গেল – তখন সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গ – ঢাকা এক মিছিলের নগরীতে পরিণত হলো । তখন আমি প্রায় প্রতিদিন তোমার কাছে চিঠি লিখতাম ঢাকার সব ঘটনা বর্ণনা করে । মনে পড়ে সেই ঐতিহাসিক ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের কথা – বন্ধুদের সাথে দলবেঁধে ঢাকার রেসকোর্সে ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ শুনতে গিয়েছিলাম । ব্রিটিশ ভারতের মুক্তি আন্দোলনের কথা কেবল বইয়ে পড়েছি কিন্তু সেই ভাষণ শুনার পর থেকেই আমাদের মনে যেন স্বাধীনতার জন্য এক নব উদ্দীপনার সঞ্চার হলো – সে রাতে সেই ভাষণকে কেন্দ্র করে তোমার কাছে একটা দীর্ঘ পত্র লিখেছিলাম । তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত বর্ষে – মনে তখন কত স্বপ্ন – আর কিছুদিন পরই আমি স্হাপত্যবিদ্যায় পন্ডিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে একটা খুব ভালো চাকরি করব – আর তোমাকে নিয়ে একটা স্বপ্নের ঘর রচনা করব – কিন্তু হায় কি থেকে কি হয়ে গেল। সেই বিভীষিকাময় ২৫ শে মার্চের কালো রাত্রের কথা মনে হলে এখনো মন আতঙ্কিত হয় – সেই রাতে রাজারবাগ পুলিশলাইন এবং পিলখানায় ইপিআর সদর দফতর সহ সারা ঢাকায় পাকসেনাদের নির্বিচার গণহত্যা শুরু হলে আমরা দলবেঁধে ঢাকা থেকে বের হয়ে যাই – তারপর বাড়ি ফিরে এসে সে কি প্রচন্ড অস্হিরতা – আমার পাড়ার বন্ধু মনোজ আর আলাউদ্দিনও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি চলে এসেছে – তাদের সাথে কত পরিকল্পনা – কত আলোচনা – এর মধ্যে একদিন তোমার চিঠি পেলাম – তুমিও তোমাদের বাড়িতে চলে গিয়েছ ।

তখন এপ্রিল মাসের শেষ দিক – রেডিওতে প্রতিদিন স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনি আর আলাউদ্দিন আর মনোজের সাথে পরিকল্পনা করি – কি করা যায় – পাকসেনারা যখন সারা দেশে গণহত্যায় লিপ্ত তখন আমাদের মত এমন যুবকদের কি এইভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে মত বসে থাকা শোভা পায় ?- মনে কত কি চিন্তা – সেই সব বর্ণনা করে তোমার কাছে লিখলাম সেই রাতে আমার শেষ চিঠি । পরদিন সকালে চিঠিটা পোস্ট করে বাড়ি এসেছি – এখনো স্পষ্ট মনে আছে মা সেদিন দুপুরে খুব বড় কৈ-মাছের কালিয়া রেঁধেছিলেন – দুপুরের খাবার খেয়ে আমি বিছানায় গা হেলিয়ে চেগুয়েভারার উপর লিখা একটা বই পড়ছি – এর মধ্যেই আমাদের পাড়া জুড়ে চিৎকার- হৈ চৈ – আমাদের চিত্রা নদীতে পাক সেনাদের গানবোট দেখা যাচ্ছে । এই সংবাদে সমস্ত গ্রামের লোকজন এলোপাতাড়ি দৌড়াতে শুরু করলো । আমরাও গ্রাম ছেড়ে দূরে মাঠে চলে গেলাম । তারপর কয়েক ঘন্টা ধরে গোলাগুলির শব্দ । সেদিন পাকসেনারা গানবোট থেকে নেমে আমাদের গ্রামে অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে ৫৮ জন নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করে – শুধু নাই নয় – মধুমতি আর নবগঙ্গা নদীতে ঢুকে নদী তীরবর্তী গ্রামগুলির উপর ব্যাপক গুলিবর্ষণ করে অনেক লোককে হত্যা ও আহত করে । সেই সন্ধ্যায় আমাদের গ্রাম থেকে শত শত লোক ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় । আমার বাবা বাড়ি ছেড়ে যেতে কোনভাবেই রাজী হলেন না । সে সন্ধ্যায় আমরা তিন বন্ধু আলাউদ্দিন, মনোজ আর আমি মিলে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম এবং সেই দিনই মধ্যরাতে মা-বাবার কাছে একটা চিঠি লিখে রেখে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবার নিমিত্তে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম । প্রায় দুই দিন ধরে নৌকায় আর পায়ে হেঁটে অবশেষে ভারতের পশ্চিমবাংলার বেনাপোল সীমান্তের ওপারে একটা গ্রামে এসে পৌঁছলাম – সেখানে গিয়ে জানিনা কি মনে করে আমরা তিন বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য ভারতের ত্রিপুরার আগরতলায় যাব । সেখান থেকে পাঁচ দিন পাঁচ রাত ধরে মালবাহী ট্রাকে চড়ে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আমরা অবশেষে আগরতলায় এসে পৌঁছলাম । সেখানে যাওয়ার পর মনে হলো আমাদের বাড়ি আর তোমাদের বাড়ি থেকে আমরা অনেক দূর চলে এসেছি । সে যাই হোক সেখানে অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা মুক্তিসেনাদের প্রশিক্ষণ শিবিরের সন্ধান পেলাম এবং অতি অনায়াসেই আমরা তিনজন মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিলাম । আজ ভাবতে অবাক লাগে সেদিন দেশ প্রেমে এতটাই উদ্বুদ্ধ হলাম তোমার কথা, মা-বাবা আর ছোট ভাইটির কথাও প্রায় ভুলে গেলাম । সেখানে আগরতলা শহর থেকে বেশ দূরে এক দুর্গম পাহাড়ের পাদদেশে ভারতের উত্তর প্রদেশের দেরাদুনের ক্যাপ্টেন জি, এস, রাওয়াতের অধীনে প্রায় দেড়মাস ধরে চলল আমাদের গেরিলা প্রশিক্ষণ । প্রশিক্ষণ শেষে জুনমাসের শেষের দিকে আমদেরকে পাঠানো হলো ২নং সেক্টরের অধীন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া-কসবা-গঙ্গাসাগর সাব-সেক্টরে । সেখানে ক্যাপ্টেন মো: আইন দ্দিনের নেতৃত্বে প্রায় সাতমাস ধরে যুদ্ধ করেছি ।

মন তখন দুর্বৃত্ত পাকসেনাদের খতম করার নেশায় মত্ত – কতক্ষণে দেশকে শত্রুমুক্ত করব – মাথায় শুধু একটায় চিন্তা – সেই সময়টা আমার জীবনের একটা অদ্ভুত সময় । আমাদের এই গেরিলা বাহিনী গঙ্গাসাগর-এলাকায় কয়েকটা সন্মুখ সমর ও গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহন করে অনেক পাকসেনাকে হত্যা করেছি – কিন্তু সেই সাথে সেই সকল যুদ্ধে আমার অনেক সহ-যোদ্ধাকেও হারিয়েছি । একদিনের কথা খুব মনে পড়ছে – সন্মুখ যুদ্ধে আমাদের পাঁচ জন মুক্তিযোদ্ধা মারা গেল – আমার বন্ধু আলাউদ্দিনের পায়ে গুলি লাগলো – আমি কোনভাবে বেঁচে গেলাম – সেই রাতে মন কেমন জানি এক অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠেছিল – তোমার কথা, আমার মা-বাবা আর ছোট ভাইটির কথা খুব মনে পড়ল । কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদেরকে যে মন খারাপ করতে নেই – নইলে দেশকে মুক্ত করবে কে – আমাদের উপরে যে দেশকে মুক্ত করার গুরুদায়িত্ব অর্পিত । আজও মনে পড়ে পরের দিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে – “পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল ” আর কবিগুরুর সেই গান “ও আমার দেশের মাটি তোমার পায়ে ঠেকাই মাথা ” এই গান দুখানি শুনে মনে যেন এক নব উদ্দীপনার সঞ্চার হলো । মনে মনে ভাবতাম যেদিন দেশ শত্রু মুক্ত করে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরব তখন বাবা-মা তাদের মুক্তিযোদ্ধা ছেলেকে নিয়ে কত গর্ব করবে আর তোমার কাছে যখন যাব গর্বে আমার বুকটা ভরে উঠবে – যেদিন তোমার সাথে ঘর বাঁধব তুমি মাথা উঁচিয়ে সবার কাছে বলবে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার সাথে তোমার বিয়ে হচ্ছে । এমনি আরো কত স্বপ্ন মনের ভিতর ঘুরে ফিরে । এই ভাবে প্রায় সাত মাস যুদ্ধের পর ‘৭১ এর ১০ ডিসেম্বর আমাদের যুদ্ধ-এলাকা মুক্ত হলো – আমরা সব মুক্তিসেনারা দোল বেঁধে ঢাকায় গেলাম – ১৬ ডিসেম্বর সেই ঐতিহাসিক বিজয় মিছিলে যোগ দিলাম – ঢাকা থেকে তোমার জন্যে আর আমার মা’র জন্য দুইখানা বাংলাদেশের পতাকা কিনলাম উপহার দিতে ।

সেইদিন ছিল ২২ শে ডিসেম্বর । দেশের জন্য সাতমাস যুদ্ধ করে মাতৃভূমিকে শত্রু মুক্ত করে আমার গর্ভধারিণীর জন্য একবুক ভালবাসা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম । কিন্তু বাড়ি এসে দেখলাম এখানে শ্মশানের স্তব্ধতা – বাবা আর ছোট ভাইটির দিকে তাকিয়ে বুঝতে কষ্ট হয়নি যে ভয়ঙ্কর একটা কিছু ঘটে গেছে । হায় ! আমার মা- এই পৃথিবীতে যে ছিল আমার সবচেয়ে আপন তিনি আমাদের ছেড়ে জীবনের অপর পাড়ে চলে গেছেন ! অস্ত্র- হাতে যুদ্ধ করে দেশ-জননীকে শত্রু-মুক্ত করলাম আর জীবন-যুদ্ধে আমার জন্ম-জননীকে হারালাম । বাবার কাছে শুনলাম মা’র মৃত্যুর করুন কাহিনী । প্রথম দিকে বাবা বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে রাজী না হলেও শেষে তারা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন । আমার ছোট ভাইটিকে নিয়ে বাবা-মা বেনাপোল সীমান্তের কাছেই এক শরণার্থী শিবিরে গিয়ে আশ্রয় নেন । সেখানে গিয়ে অস্বাস্হ্যকর পরিবেশে মা কলেরায় আক্রান্ত হন এবং প্রায় বিনা চিকিৎসায় তিনদিনের মাথায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন । বাবা আর ছোট ভাইটির দিকে তাকিয়ে আমি আঁতকে উঠি, তারা প্রাণে বাঁচলেও ছোট ভাইটি শুকিয়ে কঙ্কাল-প্রায় আর বাবার বয়স যেন এর মধ্যে কত বেড়ে গেছে !! গত সাতমাস ধরে যে আমি ছিলাম এক বীর সাহসী যোদ্ধা সেই তার মা’কে হারানোর বেদনায় হলো নিস্তেজ প্রায়।

বাড়ি ফিরে আরো শুনলাম আমাদের পাড়ার আলিম চাচার মেয়ে যে ছিল তোমার সহপাঠি আর প্রিয় বান্ধবী সেই রোখসানাকে আমাদের গ্রামেরই আলবদর কমান্ডার রজবআলী পাঞ্জাবিদের হাতে তুলে দিয়েছিল । নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমাদের এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা তাকে উদ্ধার করেছিল বটে কিন্তু তার জঠরে তখন পাক দস্যুদের বর্বরতার বীজ প্রোথিত – দেশ শত্রু-মুক্ত হবার মাত্র দুইদিন পূর্বে রোখসানা আত্মহত্যা করলো । আলিম চাচা আর আম্বিয়া চাচীকে আমি যখন দেখতে গেলাম তাঁরা তখন দুজনেই মেয়েকে হারানোর শোকে পাগল-প্রায় ।

তখনো তোমার কোনো খবরই জানি না । রোখসানার কথা শুনে আমার মন তোমার জন্য কি জানি এক ভয়ঙ্কর আতঙ্কে আতঙ্কগ্রস্ত হলো । তবু মনে কোনো অশুভ চিন্তার প্রশ্রয় দিলাম না । বাড়ি ফিরার তিনদিন পরই পাগলের মত তোমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম । সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্হা তখন বিচ্ছিন্ন । প্রায় দুইদিন ধরে বিভিন্ন বিকল্প পথে তোমাদের বসন্তপুরে এসে পৌঁছলাম । অন্তরের ভিতর লুক্কায়িত অনুভূতি হয়ত তোমাকে দেখে মাকে হারনোর বেদনা হবে কিছুটা প্রশমিত । কিন্তু হায় ! তোমাদের বাড়ির আঙ্গিনায় প্রবেশ করার আগ মুহূর্ত পর্যন্তও আমি কল্পনাও করতে পারিনি যে আমার জন্য এমন ভয়ঙ্কর বেদনা অপেক্ষা করে আছে । তোমার মা-বাবা দুজনেই যেন হয়ে গেছেন পাথর, তোমার সদা উচ্ছ্বল ছোট বোনটি হয়ে গেছে নিশ্চল – তোমাদের বাড়িতে শ্মশানের নীরবতা – আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না – কারো মুখে কোনো কথা নেই ! আমার দুচোখ তখন তোমাকে খুঁজছে । তোমাকে কোথাও না দেখে আমার মন একটা ভয়ঙ্কর কিছুই কল্পনা করলো ! কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার মত সাহসও আমি পাচ্ছিলাম না । এর মধ্যে তোমাদের পাশের বাড়ির অনন্যা মাসি এসে আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেলেন – তিনি আমাকে ধীরে ধীরে শুনালেন সেই ভয়ঙ্কর আর নিষ্ঠুর কাহিনী । তোমরা মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে নৌকা করে করতোয়া নদী দিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলে – মাঝপথে তোমাদের নৌকা পাকসেনাদের হাতে পড়ে – আর এই নর-পিশাচরা তোমাকে ধরে নিয়ে যায় – তোমার বাবা মা আর বোন মাঝপথ থেকে আবার বাড়ি ফিরে আসে । তোমার মা পাগলিনী-প্রায়, তোমার বাবা সব ডর-ভয় উপেক্ষা করে পাগলের মত তোমাকে সেই এলাকায় খুঁজতে থাকেন কিন্তু হায় কোনো ভাবে তোমার আর কোনো সন্ধানই পায় নি । আজও মনে হলে আমি পাগল হয়ে যাই – এই কথা শুনার পর আমি যে এলাকা থেকে পাক-জল্লাদরা তোমাকে ধরে নিয়ে যায় আমি সেখানে যাই একটা পিস্তল হাতে নিয়ে সেই এলাকার রাজাকারের কমান্ডারের সন্ধানে – কিন্তু হায় মে মাসের ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য ডিসেম্বর মাস যে অনেক বিলম্বিত – সেই এলাকার রাজাকার কমান্ডার তখন নিহত । সেই এলাকার কত মুক্তযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করলাম – কিন্তু কেহই তোমার কোনো সন্ধান দিতে পারল না !!

সাতমাস যুদ্ধের সময়ে যে ছিল অকুতভয় – ঝড়-ঝঞ্জা-ভয়-আশঙ্কা কোনো কিছুই যাকে বিচলিত করতে পারেনি সেই আমি বাড়ি ফিরে এসে তোমাকে আর মা’কে হারিয়ে ভয়ানক মানসিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলাম । কয়েকটা মাস আমার ঘোরের মধ্যে কাটল – এই জগৎ-সংসারের সব কিছুই যেন কেমন এলোমেলো মনে হতে লাগলো । কিন্তু জগতের এই অন্তহীন চলমান ধারায় কোনো কিছুই বুঝি থেমে থাকে না । সময় নামক ঔষুধের মহিমায় আমিও একদিন অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেলাম । এই স্বাধীন দেশের নতুন নামের বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেলাম আমার অসমাপ্ত পড়া সমাপ্ত করার জন্য । ১৯৭৩ সালে আমি সেখান থেকে স্হপতি হয়ে বের হয়ে এলাম – এবং কিছু দিনের মধ্যে ভাগ্যে একটা ভালো চাকরিও জুটল । কর্মসূত্রে গত ৩৭ বৎসর যাবৎ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল সহ পৃথিবীর অনেক দেশেই যাবার সৌভাগ্য হয়েছে । অর্থ, সম্মান, খ্যাতি জীবনে অনেক মিলেছে – তোমাকে তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে আমার এই পত্র আর দীর্ঘতর করব না । একটা সংসার পাতার হাতছানি অনেকবারই নানাভাবে জীবনে রেখাপাত করেছে । কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে খানিকটা অস্বাভাবিক মনে হলেও আমার বলতে এতটুকু দ্বিধা নেই তোমার নিখাদ ভালবাসার স্মৃতি আমার মন-প্রাণ সবসময়েই ভরে রেখেছে – স্বপ্নে নিরন্তর তোমাকে নিয়ে আমার স্বপ্ন বাসর রচিত হয়েছে – সেখানে অন্য কারুর প্রবেশ ছিল অসম্ভব প্রায় ।

এতটা বছর ধরে তোমার মা-বাবার সাথে আমার সব সময়ই যোগাযোগ ছিল । তোমার ছোট বোনটির বিয়ে হয়েছে এক ডাক্তার ছেলের সাথে এবং অনেকদিন যাবৎ তারা আছে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে আর আমার ছোট ভাইটি অনেক বছর আগে চলে গিয়েছে নিউজিল্যান্ডে । বেশ কয়েক বছর হলো তোমার বাবা-মা আর আমার বাবা গত হয়েছেন । আমাদের প্রতিবেশী তোমার চারুমাসিরা ৭১ সালে দেশ ছেড়ে সেই যে ভারতে চলে গেলেন আর এই দেশে ফিরে আসেন নাই । আমার বন্ধু আলাউদ্দিন আর মনোজ দুজনেই এখন ক্যানাডার স্হায়ী বাসিন্দা । দীর্ঘ চাকুরী জীবন শেষে আমি মাস ছয়েক হলো অবসর নিয়েছি । তোমাকে জানাতে ইচ্ছে করলো – আমি আবার আমাদের পলাশপুরের বাড়িতে ফিরে এসেছি । এখানে যদিও আমার আপনজন বলতে আর কেহই নেই তবু কেন জানি আমার শৈশব- কৈশোরের স্মৃতি বিজড়িত আর তোমার সাথে আমার বয়:সন্ধিক্ষণের নিবিড় ভালবাসার স্মৃতি-গাঁথা এই মাটির টানে এই পলাশপুরেই ফিরে এলাম । তুমি জেনে হয়তবা খুশি হবে এই মাত্র কয়েক দিন হলো আমি এখানে খুব সুন্দর একখানা মাটির ঘর তৈরী করিয়েছি – তবে এই ঘরের দেয়ালের বাইরের রংটি ধুসর নয় – ঘন কালো – কিন্তু ঘরের ভিতরের দেয়ালের রংটি ঠিকই আসমানী নীল । ঘরে ঢোকার মুখে দরজার দুইপাশে আমি দুটি হাস্নাহেনার গাছ লাগিয়েছি । একদিন যখন এই হাস্নাহেনার গাছ দুটি বড় হবে – গাছ ভরে হাস্নাহেনার ফুল ফুটে চারিদিকে মৌ মৌ গন্ধ ছুটাবে তখন শরতের শুক্ল পক্ষের রাতে আমার সেই ঘরে যাবার সিঁড়িতে বসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তোমার মুখটা কল্পনা করব আর মনে মনে নতুন স্বপ্ন গড়ব !!

আজ ২০১১ সালের ১লা ডিসেম্বর, আর পনের দিন পরই বিজয় দিবস । প্রতি বছর এই মাসটা এলেই বিজয়ের আনন্দ আর আপনজন হারানোর তীব্র বেদনার এক অদ্ভুত মিশেল অনুভূতি মনকে প্রচন্ড ভাবে আন্দোলিত করে । আজ থেকে চল্লিশ বৎসর পূর্বে ১৯৭১ সালের ২২ শে ডিসেম্বর এক বুক আনন্দ আর আশা নিয়ে বিজয়ের লাল-সবুজ পতাকাটা সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম কিন্তু মাকে আর তোমাকে হারিয়ে একটা তীব্র যন্ত্রণা সারা অন্তর আচ্ছন্ন করলো । কেন সেই এপ্রিল মাসে বাড়ী ছেড়ে চলে যাবার পর তোমার কাছে না গিয়ে কেবল দেশের কথা চিন্তা করে ভারতে চলে গেলাম, সেখানে গিয়ে তোমার কোন খবর না নিয়ে, মা, বাবা, ভাইটির কথা চিন্তা না করে কেবল দেশের কথা ভেবে পাগলের মত মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলাম, এ প্রশ্ন এখনো মনে প্রচন্ড আঘাত করে । আজ এতটা বছর পর ভাবি মুক্তিযুদ্ধ আমাকে কি দিল – একটা নতুন দেশের জন্ম হলো বটে – তবে যেমন একটা দেশের স্বপ্ন নিয়ে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম এই দেশকি সেই দেশ ??????- সেই একাত্তর সালে যারা এই দেশেকে লক্ষ লক্ষ নিরীহ, নিরপরাধ মুক্তিকামী মানুষের রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছিল, যাদের হাতে তোমার আর রোখসানার মত অসংখ্য নারী অপমানিত, লাঞ্ছিত, নির্যাতিত, নিহত হয়েছিল সেই নরপশু-জল্লাদদের দোসর আলবদর, আলশামস আর রাজাকারদের এখন দেশে কত দৌরাত্ম । শুনেছিলাম রাজাকারদের কমান্ডার সেই আলবদর রজবআলী যে নাকি রোখসানা এবং আমাদের এলাকার আরো অনেক মেয়েকে পাকিস্তানী নরপশুদের হাতে তুলে দিয়েছিল সে এখন ঢাকায় একজন প্রতিষ্ঠিত জামাত নেতা । দেশ এমন ভাবে চলতে থাকলে কে জানে একদিন হয়তবা সে মন্ত্রীও হবে । এই সকল কথা চিন্তা করে এখন নিজের মনেই ধিক্কার আসে । পাকিস্তানী নর-পিশাচদের হাত থেকে তোমাকে রক্ষা না করতে পারার যন্ত্রণা, শরণার্থী শিবিরে মায়ের মৃত্যুর অনুশোচনা আমাকে পাগল করে তোলে ।

আজ তোমার কাছে এই চিঠি লিখছি সুদীর্ঘ চল্লিশটা বছর পর । সময় নামক মহৌষধির মহিমায় অন্তরের ক্ষতের কিছুটা উপশম হয়েছে বলেই বোধ হয় তোমার কাছে এই খোলা চিঠি লিখার কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করতে পেরেছি । যুদ্ধ থেকে বাড়ী ফিরে সারা বাংলায় তোমাকে পাগলের মত খুঁজেছি – যেখানেই গণ কবরের সন্ধান পেয়েছি পাগলের মত ছুটে গিয়েছি – তোমার কঙ্কালের একটু ছোঁয়া পাওয়ার আশায় – কিন্তু হায় ! সেই ইচ্ছা আমার আজও পূরণ হয়নি, সব কঙ্কালই যে দেখতে প্রায় এক !!! তবে আমি আজও তোমায় খুঁজি আর আমার এই খোঁজা বুঝি কোনদিনই শেষ হবে না :

আমি আজও স্বপ্ন দেখি তোমাকে নিয়ে
প্রতিদিন – প্রতিক্ষণ – প্রতি পলে,
এই স্বপ্ন পৃথিবীর সবকটি রং দিয়ে সাজানো স্বপ্ন,
তুমি আছ কোনো এক জাহ্নবীর তীরে
এক মায়াবী কুঞ্জবনে,
যেখানে সব বিচিত্র বর্ণের প্রজাপ্রতিরা
তোমাকে সারাক্ষণ ঢেকে রাখে তাদের রঙিন পাখায়,
সোনার সব হরিণীরা তোমাকে আলিঙ্গন করে অসীম মায়ায়,
সেথায় তোমার সমস্ত শরীর – আপাতমস্তক আবৃত থাকে
আমার সোনালী -স্বপ্নিল ভালবাসার আবরণে,
সেখানে তুমি রানী-আমার স্বপ্নের রানী,
আমার রঙিন ভালবাসার
আল্পনায় আঁকা নবোঢ়া,
তোমাকে নিয়ে আমি স্বপ্নে ভাসি প্রতিদিন-
সকালে, মধ্যাহ্নে অপরাহ্নে, আর সায়াহ্নে,
আবার গভীর রজনীতে গভীর ভালবাসায়।
তোমাকে আমি প্রতিক্ষণ স্বপ্নে দেখি,
আর প্রতি পলে অনুভব করি তোমার নিখাদ ভালবাসা।
তুমি আছ আমার মনো-জগতের প্রতি পরতে পরতে,
সেখানে তুমি অবিনাশী, অব্যয় ও অক্ষয় ,
সেখানে তুমি সব কিছুর ঊর্ধ্বে ,
এই পৃথিবীর সকল দস্যু, বর্বর আর পিশাচদের ধরা ছোঁয়ার বাহিরে।
সেখানে কারো কামনার বহ্নি তোমাকে স্পর্শের অতীত,
কারণ সেখানে তোমার সমস্ত কায়া আর মন
আমার অত্যন্তিক ভালবাসার বর্মে মোড়ানো,
এই আবরণ ভেদ করে তোমাকে কলুষিত করে
এই সাধ্য কার ???????

আমি আজও কল্পনা করি তুমি এখনো আমার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছ । আমিও তোমার সাথে শেষ দেখা হবার পর থেকে চল্লিশটা বছর যাবৎ তোমার দেখা পাওয়ার জন্য একাকী পথ চলছি – আমি যে বড়ই ক্লান্ত, বাঁধন ! জানি না এভাবে একাকী আরো কতদিন আমাকে এই পৃথিবীতে পথ চলতে হবে । আমার জন্য তোমার এই দীর্ঘ প্রতীক্ষার জন্য আমি তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থী বাঁধন – পারলে আমাকে ক্ষমা করো প্রিয়তমা ! আজ হঠাৎ করেই যে বাক্সে তোমার লিখা ২৬৭ খানা চিঠি সংরক্ষিত আছে সেখানে হাত দিয়ে আনমনে একখানা চিঠি এনে খুললাম – চিঠিখানার উপরে তারিখ লিখা – ১৪ ই মার্চ, ১৯৬৮ ইং – চিঠির এক জায়গায় তুমি লিখেছিলে ” অর্ঘ্য, যদি কোনো দিন কোনো কারণে তোমার কাছ থেকে আমি অনেক দূরে চলে যাই সেদিন তুমি কি করবে ?” আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে তার প্রত্যুত্তরে আমি লিখেছিলাম – “বাঁধন, আমার প্রাণের প্রাণ, আমি তোমার জন্য চির জীবন অপেক্ষা করতে থাকব !” । বাঁধন, আমি আমার কথা রেখেছি – আমি তোমার দেখা পাবার জন্য এখনো অপেক্ষা করে আছি – তোমার সাথে আমার মধু-মিলনের জন্য, তোমার সাথে আমার সেই স্বপ্নের বাসর ঘর রচনার জন্য যদি অনন্তকালও অপেক্ষা করতে হয় তবু আমি তাই করব !!

সব শেষে আমার প্রাণের দেবতা গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একখানা কবিতার অংশ বিশেষ দিয়ে তোমার কাছে এই পত্র লিখা শেষ করছি :

সব চেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয়-
সে আমার প্রেম,
তারে আমি রাখিয়া এলেম
অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশ্যে।
পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে
কালের যাত্রায়।
হে বন্ধু, বিদায়।

ইতি – ১লা ডিসেম্বর, ২০১১ খ্রীষ্টাব্দ,
তোমার চির সখা অর্ঘ্য

(পাদটীকা: ১৬ই ডিসেম্বর, ২০১১ সাল – আমাদের মহান ঐতিহাসিক “বিজয় “-এর ৪০তম বার্ষিকী । বাংলাদেশের ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাঙালির গর্বের বিষয় । এই মুক্তিসংগ্রাম এই গল্পের কাহিনীর মত অসংখ্য রক্তঝরা হৃদয়-বিদারক করুণ কাহিনীর সমন্বয়ে গড়া এবং অগনিত মানুষের আত্মত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত । এই স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন, যারা নির্যাতিত লাঞ্ছিত অপমানিত হয়েছেন, যারা তাদের আপনজন হারিয়েছেন, বা যারা দুঃসহ বাধা -বিপত্তি সত্বেও শত্রুর বিরুদ্ধে সন্মুখ সমরে বা গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের সকলের প্রতি লেখকের গভীর শ্রদ্ধা, সমবেদনা ও ভালবাসা । পরিশেষে বলি, এই গল্পটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অযুত সত্যকাহিনীর পটভূমিকায় রচিত হলেও এই গল্পের পাত্র-পাত্রীরা এবং তাদের নামগুলো লেখকের কল্পনা-প্রসূত । দৈবক্রমে বাস্তবের সঙ্গে তাদের কোন হুবহু মিল ঘটে থাকলে তা নিতান্তই কাকতালীয় ! – লেখক)