[প্রয়াত পপসম্রাট ও মুক্তিযোদ্ধা আজম খান। অনেকে তার মুক্তিযুদ্ধটিকে ‘একাত্তরের বেহাত বিপ্লব’ হিসেবে চিহ্নিত করতে চান। আসলে কী তাই? কেমন ছিলো, এই শিল্পীর রণাঙ্গনের দিনগুলো? কী ছিলো তার দেশচিন্তা? যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশকেই বা কীভাবে দেখেছিলেন এই মুক্তিযোদ্ধা? দেশ ও সঙ্গীত নিয়ে কী ছিলো তার চিন্তা-ভাবনা? ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর একটি বার্তা সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে এই লেখককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আজম খান বলেছিলেন সেসব কথা। এরইভিত্তিতে চলতি স্মৃতিকথাটি লেখা হচ্ছে।]

এক। আমার নকশালাইট বড়ভাই মানব ৭০ দশকে যখন লম্বা চুল রেখে, বেল বটম প্যান্ট পরে, গিটার বাজিয়ে আজম খানের গান করতেন, তখন সেই শৈশবে পপ সম্রাট এই শিল্পীর গানের সঙ্গে পরিচয়। আরো পরে লংপ্লেয়ারে তার নানান হিট গান শুনেছি।

তাকে আমি সামনা – সামনি প্রথম দেখি ১৯৮৬ – ৮৭ সালে, এএইচসিতে পড়ার সময়। বুয়েটের মাঠে কনসার্ট হচ্ছে — গাঁদাগাদি ভীড়, গাঁজার ধোঁয়া, ‘গুরু, গুরু’ জয়োধ্বনী, আর তুমুল হট্টোগোলের ভেতর সেদিন শিল্পীকে ভাল করে চোখেই পড়েনি। তবু রাতে বন্ধুরা দল বেঁধে গান করতে করতে ফিরেছিলাম:

হাইকোর্টের মাজারে, কতো ফকির ঘোরে, কয়জনা আসলও ফকির?…

মুক্তিযুদ্ধের সময় আগরতলার রনাঙ্গণে তার মুক্তিযোদ্ধাদের গান গেয়ে শোনানোর কথা জানতে পারি ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে। তো, আজম খান সব মিলিয়ে আমার কাছে এক বিরাট আইকন।

শুধু মাত্র মুক্তিযুদ্ধকে ফোকাস করে শিল্পীর সঙ্গে কথোপকথনের জন্য আমি তার ফোন নম্বর খুঁজতে শুরু করি। এ পত্রিকা, সে পত্রিকার অফিসে খোঁজ করে কোথাও তার নম্বর পাই না।
আমার সাবেক কর্মস্থল দৈনিক যুগান্তরের বিনোদন পাতার এক সাংবাদিক আমাকে জানালেন, তিনি মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না। আর তার বাসার ল্যান্ড ফোনটিও অনেকদিন ধরে বিকল!

তবু লোকেশন জেনে হাজির হই এক বিকালে তার উত্তর কমলাপুরের বাসায়। একটি দাঁড় করানো জুতোর বাক্সর মতো লম্বালম্বি পুরনো একচিলতে দোতলা ঘর। সরু সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে দরজা ধাক্কাতে একটি মেয়ে বের হয়ে এসে বললেন, আঙ্কেল তো খুব অসুস্থ্য। আজ দেখা হবে না। আপনি কাল সকালে আসুন।

পরদিন সকালে আবার হামলা। এবার দরজা খোলা। নক করতেই সেই বিখ্যাত খনখনে গলা, কে রে?…

আমি উঁকি দিয়ে অনেকটা ঠেলেই ঘরে ঢুকে পড়ি। একটা সালাম ঠুকে ভয়ে ভয়ে বলি আগমেনর হেতু।

শিল্পী তখন একটি খাটে শুয়ে পা দুলাচ্ছেন। পরনে একটি সাদা টি শার্ট আর ট্র্যাকিং প্যান্ট। ফর্সা, লম্বা আর হাড্ডিসার ফিগারে সে সময়ের ৫৭ বছর বয়সেও তাকে সুদর্শন লাগে। সব শুনে তিনি বলেন, একাত্তরের কথা কেউ মনে রেখেছে না কি? আর তাছাড়া আমি তো যুদ্ধ শুরু করেছিলাম মাত্র, শেষ করতে পারি নি। আমার যুদ্ধ ভারতীয় সেনারাই তো শেষ করে দিলো!…

শুরু হলো আনুষ্ঠানিক কথোপকথন। মাঝে মাঝে বিছানার পাশে রাখা একটি গিটার ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেন। খুক খুকে কাশি দেখে বুঝি, তার শরীর বেশ খারাপ করেছে।…

দুই। যুদ্ধে গেলেন কেনো?… আমি জানতে চাই।

আজম খান বলেন, ১৯৬৮ টিতে ছাত্রাবস্থায় আমরা বন্ধু – বান্ধব মিলে গান করতাম। সেই সময় আমি গণসঙ্গীত শিল্পী গোষ্ঠি ‘ক্রান্তি’র সঙ্গে যুক্ত হই। ঢাকায়, ঢাকার বাইরে গান করতে গেলে পুলিশ নানা রকম হয়রানী করতো।

১৯৬৯ সালে গণঅভূত্থানের সময় দেশপ্রেম থেকে আমরা রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে অবরোধ তৈরি করতাম। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ভয়ে বাসায় টেঁকা যেতো না। সেই সময় বন্ধু – বান্ধব দল বেধে সিদ্ধান্ত নিলাম, ঢাকায় থাকলে এমনিতেই মরতে হবে, তার চেয়ে যুদ্ধ করে মরাই ভাল। তখন সবাই একসঙ্গে যুদ্ধে যাই।

আম্মাকে বললাম, আমি যুদ্ধে যাচ্ছি। আম্মা বললেন, যুদ্ধে যাবি, ভাল কথা, তোর আব্বাকে বলে যা। আব্বা ছিলেন সরকারি চাকুরে। ভয়ে ভয়ে তাকে বলালাম, যুদ্ধে যাচ্ছি। উনি বললেন, যাবি যা, তবে দেশ স্বাধীন না করে ফিরবি না! তার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। একটা সালাম দিয়ে যুদ্ধে যাই। তখন আমার বয়স ২১ বছর।

জানতে চাই, মাসটি মনে আছে?

শিল্পীর সরল জবাব, আরে না রে ভাই, যুদ্ধের সময় এতো মাস – তারিখ মনে রাখা সম্ভব নয়।… প্রথমে কুমিল্লা বর্ডার দিয়ে ত্রিপুরার আগরতলা যাই। সেখান থেকে মেলাঘরে মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের সেক্টরে মেজর এটিএম হায়দারের কাছে দু’মাস গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেই। কুমিল্লার সালদায় পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর সঙ্গে একটি সম্মুখ সমরে সাফল্যের পর আমাকে ঢাকার গেরিলা যুদ্ধের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলে চলেন, ১৯৭১ সালে ঢাকার মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা গ্রুপের সেকশন কমান্ডার হিসেবে আমি যাত্রা বাড়ি, ডেমরা, গুলশান, ক্যান্টনমেন্ট এলাকাসহ বেশ কয়েকটি সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করি, এ সব যুদ্ধের নেতৃত্ব দেই।

মুক্তিযুদ্ধের কোনো বিশেষ স্মৃতি?…এমন কৌতুহলের জবাবে আজম খান বলেন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জাকিরের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। ঢাকার গোপীবাগে একজন আহত মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচাতে গিয়ে সে পাকিস্তানী সেনাদের গুলিতে মারা যায়।… সে সময় জাকিরের মৃত্যূর খবর আমি গ্রুপের কাছে চেপে গিয়েছিলাম, নইলে তারা মনোবল হারাতে পারতো।

অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, এই তো সেদিন ফকিরাপুলে আমার গ্রুপের একজন মুক্তিযোদ্ধাকে দেখি, ফুটপাতে চা বিক্রি করছে! কি আর করবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যার ভেতর আছে, সে তো আর চুরি করতে পারে না!…

মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সরকারই তো মূল্যায়ন করেনি। এর পাশাপাশি অনেক বিপথগামী মুক্তিযোদ্ধা সে সময় লুঠপাঠ – ডাকাতি করেছে, বিহারীদের বাড়ি – জমি দখল করেছে, মা – বোনদের ইজ্জতহানী করেছে। অনেকে ডাকাতি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে মারাও গিয়েছে।

আমি নিজেও এ সব কারণে অনেক বছর নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দেই নি।…বিপথগামী মুক্তিযোদ্ধাদের কারণে জাতিও বহুবছর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্মানের চোখে দেখেনি।

আমি জানতে চাই, স্বাধীনতা বিরোধী — যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কী ভাবে সম্ভব?

‘অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন স্বাধীনতা বিরোধী – যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কঠিন হয়ে গেছে’ — কথা জানিয়ে শিল্পী বলেন, এখন রাজাকার, আল – বদর, আল – শামসরা সংগঠনিকভাবে অনেক বেশী শক্তিশালী। একজন গোলাম আজমের বিচার করলেই এদের ভিত্তি নির্মূল করা যাবে না। এদের যে বিস্তৃতি গত ৩৬ বছরে ঘটেছে, তাকে উৎখাত করা সত্যিই কঠিন। তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একদিন না একদিন হতেই হবে।

তিনি আরো বলেন, স্বাধীনতার পর পরই এই বিচার হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু তা হয়নি, কারণ ভারত সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে পাকিস্তানী সেনাদের স্বসন্মানে পাকিস্তানে ফেরৎ পাঠিয়েছে। একই সঙ্গে এর পরের সরকারগুলো ক্ষমতার লোভে পাক সেনাদের সহযোগি যুদ্ধাপরাধীদের লালন – পালন করেছে।

কিন্তু তা না হয়ে ভারত যদি মুক্তিযুদ্ধে শুধু সহায়কের ভুমিকা পালন করতো, আমরা নিজেরাই যদি আমাদের যুদ্ধ শেষ করতে পারতাম, তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। নয় মাসে নয়, নয় বছর পরেও দেশ স্বাধীন হলে আমরা স্বাধীনতা বিরোধী – যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারতাম।

কিন্তু যুদ্ধাপরাধ কখনো তামাদী হয় না। তবে এদের বিচার বিলম্বিত হওয়ায় অনেক সাক্ষ্য – প্রমান সংগ্রহ করা এখন কঠিন হয়ে গেছে। তাই অনেক দেরীতে হলেও আন্তর্জাতিক আদালত বসিয়ে এর বিচার করা উচিত। এ জন্য সরকারের সদিচ্ছা ছাড়াও আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রয়োজন।

স্বাধীনতা বিরোধী – যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দায়িত্ব সৎ ও দেশপ্রেমিক সরকারকেই নিতে হবে। তবে যতদিন এটি জাতীয় দাবিতে পরিনত না হবে, ততদিন কোনো সরকারই এই বিচার করবে না।

তিন। এবার আমি পপ সম্রাটের গানের জগতে ফিরে আসি। সেখানেও আমার জিজ্ঞাস্য মুক্তিযুদ্ধ।

আমি জানতে চাই, আচ্ছা, আজম ভাই, মুক্তিযুদ্ধের পর ‘রেল লইনের ওই বস্তিতে’ বা ‘ফ্রাস্টেশন’ — ইত্যাদি গানে আপনার হতাশা ফুটে উঠছে কেনো? গানের ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল দিকগুলো কেনো প্রকাশ পায়নি?

শিল্পীর অকপট স্বীকারোক্তি, তখনকার প্রেক্ষাপটে এই সব গান করেছিলাম।… যে আশা নিয়ে আমরা যুদ্ধে গিয়েছিলাম, যুদ্ধের পর আমাদের সে আশা পূরণ হয়নি। পাকিস্তান আমলে ঘুষ – দুর্নীতি ছিল না। বাজারে সব জিনিষের একদর ছিল। আর যুদ্ধের পর ঘুষ – দুর্নীতি, কালোবাজারী, লুঠপাটে দেশ ছেয়ে গেল। সব জিনিষের দাম হু হু করে বাড়তে লাগলো। শুরু হলো ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষ। আর বঙ্গবন্ধু রক্ষীবাহিনী গঠন করে আরেকটি বড় ভুল করলেন। সারাদেশে শ্লোগান উঠলো — সোনার বাংলা শ্মাশান কেনো?… এই পরিস্থিতিতে তখন ওই সব হতাশার গান।

‘এখন কী নতুন প্রজন্মকে নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের গান, নতুন আশার গান শোনাবেন?’ এমন প্রশ্নের জবাবে হতাশা ছড়ায় শিল্পীর গলায়, এই প্রজন্মের কেউ তো মুক্তিযুদ্ধের গান শুনতে চায় না! এদের জন্য এই সব গান করে লাভ নেই। তারা তো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই জানে না।…তবু এখন দেশ গড়ার গান করছি। দেশের দুঃসময়ে আমাদের আমি এই প্রজন্মকে অন্য এক মুক্তির গান শোনাতে চাই। কারণ এ দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি, প্রগতিশীল চিন্তা – চেতনার মুক্তি এখনো আসেনি।…

চার। কথোপকথনের শেষ পর্যায়ে এসে হাজির হন তখনকার সহকর্মি ফটো সাংবাদিক ফিরোজ আহমেদ। বাসার সঙ্গের খোলা ছাদে একটি বাতাবি লেবুর গাছ।

ফিরোজ বললেন, আউটডোরে এখানেই ছবি ভাল হবে।

আমি বললাম, আজম ভাই, সাদা জামাটা বদলে নেবেন না কী? রঙিন জামায় ছবি ভাল আসবে।

তিনি শিশু সুলভ হাসি দিয়ে বললেন, দাঁড়াও একটা সবুজ জ্যাকেট পরে আসি… বেশ খানিকটা ফ্রিডম ফাইটার, ফ্রিডম ফাইটার দেখাবে!

শুরু হলো, আমাদের ফটো সেশন।…

ছবি: আজম খান ও আজম খানের সঙ্গে লেখক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/ফিরোজ আহমেদ।

সংযুক্ত: যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে যাওয়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর, দৈনিক কালের কণ্ঠ, ৬ জুন ২০১১।