ডরোথি পার্কারের একটি কবিতা-কণা–
By the time you swear you’re his,
Shivering and sighing,
And he vows his passion is
Infinite, undying,
Lady, make a note of this —
One of you is lying.
কবিতাটি আবৃত্তি করে দেখুন — লক্ষ্য করবেন, শেষ বাক্যের রক্তপাতের জন্য আগের কথাগুলির, বিশেষত প্রথম লাইনের নিশ্বাসঘন “you’re his” এর কতটা প্রয়োজন ছিল। রোমান্টিকতা ও সিনিকতার এই সংগম শিল্পে শিহরিত আবেগের অনির্বাণ উৎস। ডরোথি দেবী নিজে আরো বহু মাইক্রো-কবিতায় একই নিরাসক্ত রোমান্টিকতা প্রকাশ করে গেছেন — কিন্তু পার্কার নন, এই যৌথ-আবেগ-মৈথুনের “মম প্রিয়তম” শিল্পীরা হলেন ছোটগল্পকারেরা।
গী দে মোপাসাঁ, উদাহরণত। রবীন্দ্রনাথের মত, মোপাসাঁ ফরাসী ছোটগল্পের জনক ও গুরুদেব। মুড সৃষ্টির তুলনাহীন ক্ষমতা (Two Little Soldiers), ডিটেইল-এর প্রকাশময় ব্যবহার (Boule de Suif), মনভেদী অন্তর্দৃষ্টি (That Pig of a Morin), আমসত্বসুলভ বিশুষ্ক রসবোধ (A Sale) – – এসব গুণ ছাপিয়ে তার তুণের ব্রহ্মাস্ত্র ওই যা বলেছি আগে — রোমান্টিকতা ও সিনিকতার দ্বন্দ্ব। কোথাও স্পষ্ট (Clare de Lune), কোথাও প্রচ্ছন্ন (Madmoseille Fifi) — সর্বত্র উপস্থিত।
এর উৎকষ্ট উদাহরণ Une partie de campagne নামে একটি গল্প। গল্পটা এরকম। প্যারিসের একটি পরিবার — (দোকানদার) বাবা, মা, দিদিমা, উদ্ভিন্ন যৌবনা মেয়ে, এক ম্যাড়মেড়ে যুবক (যে কিনা দোকানের সহকারীও) — সপ্তাহান্তিক ভ্রমণে বেরিয়েছে সারাটা দিন প্যারিসের বাইরে গ্রামাঞ্চলে কাটানোর লক্ষ্য নিয়ে। ঘুরতে ঘুরতে সীন নদীর ধারে ভদ্রস্থ একটি রেস্টুরেন্ট দেখতে পেয়ে সেখানেই দিনটা কাটাবার সিদ্ধান্ত হয়। গ্রাম্য গা-ছাড়া পরিবেশ — লোকাল দুই তরুণ রেস্টুরেন্ট অঙ্গনে এমনিই ঘুরঘুর করছে। একটা পর্যায়ে মধ্যাহ্নভোজন পরবর্তী আধঘুমন্ত পুরুষদের ও সর্বক্ষণই ঘুমন্ত দিদিমাকে রেখে মা-মেয়ে এই দুই বন্ধুর নৌকায় চেপে সীন-ভ্রমণে বেরোয়, এক নৌকোয় মা ও একটি ছেলে, অন্য নৌকোয় মেয়েটি ও আরেকটি ছেলে। তারপর…দ্বিতীয় নৌকাটি এক নদীতীরে থামল, গাছের ছায়া, পাপিয়ার ডাক….। যারা আগের লাইনটি পড়ে সন্দেহ করছেন যে কাহিনীটি এরপর চমচম-চটচটে রোমান্টিকতায় পর্যবসিত হবে, তারা এই প্রবন্ধের প্রথম অনুচ্ছেদ দুটি পড়েননি। সরাসরি গল্পটাই বরং পড়ে ফেলতে পারেন এখান থেকে।
এ কাহিনী নিয়ে ৪০ মিনিটের ছবি বানিয়েছিলেন ফরাসী ফিল্মমেকার জাঁ রেনোয়াঁ, যা হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। ফিল্মটি দেখবার আগে কাকতালীয়ভাবে গল্পটা তাজা তাজা পড়া ছিল, তাই রেনোয়াঁর ইন্টারপ্রেটেশন দেখবার ছিল একটা বাড়তি আগ্রহ — অনেকটা চিত্রনাট্য পড়ার পর ছবি দেখতে বসলে যেমন হয় (এই দ্বিতীয় ক্ষেত্রে চিত্রনাট্যের ডায়লগ ও অভিনয়ে ওই ডায়লগের ডেলিভারির প্রতিতুলনার উপর গিয়ে চোখটা পড়ে বেশি, ছবির অন্য দোষ-গুণের তুলনায়)।
ছবি ও গল্পের সম্পর্ক নিয়ে অনেক কথাই বলা যেতে পারে, কিন্তু একটা বিশেষ ব্যাপারে ফোকাস করা যাক প্রবন্ধ-দৈর্ঘের দিকে নজর রেখে। মোপাসাঁর এই গল্পকে সিনেমাটিক রূপ দেবার ক্ষেত্রে একটা বড় ফর্মাল অসুবিধা ছিল। গল্পে গ্রামের যুবক দুটির তেমন কোন চরিত্রচিত্রণ নেই। মূলত এরা টাইপ — গ্রামের সুদর্শন দুশ্চিন্তামুক্ত বিহঙ্গ ইত্যাদি — মেয়েটির বুর্জোয়া জীবনের অবরূদ্ধ রোমান্টিক কল্পনার যথোপযুক্ত পাত্র, এর বেশি কিছু না। গল্পের শেষের দিকে একটি ছেলের কিছু চরিত্রচিত্রণ সত্বেও মোটের উপর এটা সত্যি। চলচ্চিত্রে এটা কাজ করেনা — চারুলতা বিষয়ক তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধে সত্যজিৎ যেমনটা বলেছিলেন — সিনেমায় সবকিছুই যেহেতু একটা “কংক্রিট রূপ নেয়”, কাজেই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলিকে এভাবে টাইপ হিসেবে রেখে দেয়া সম্ভব না।
এখন, কংক্ট্রিক রূপ দিতে পারাটাই বড় কথা নয়, মূল কথা হল, এই ফর্মাল প্রয়োজনটাকে শৈল্পিক ভাবে ব্যবহার করা। কিছু ফিল্মমেকার এধরণের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে ব্যর্থ হন — গল্পের মূল পয়েন্টটা তাড়াতাড়ি বলে ফেলবার ব্যস্ত অধীরতা প্রয়োজনীয় ডিটেইলের কাজ করার সময় তাদের কোষ্ঠকাঠিন্যিক কষ্ট দিতে থাকে। অন্যদিকে, ওস্তাদ শিল্পী এই কাজটি করেন ভোজনরসিকের কই মাছের কাটা বেছে খাওয়ার মত করে — সেই ডিটেইলের প্রতি নজর, সেই তাড়াহুড়ার অভাব, সেই অসাধারণ সূক্ষ্মতা। আলোচ্য ছবিতে রেনোয়াঁ এই কাজটি করেছেন দুবন্ধুকে দুরকম চরিত্র দিয়ে — প্রথমজন বাচাল এবং লুইস প্রকৃতির, দ্বিতীয়জন গম্ভীর — তার চেহারা, কথা, সব কিছুতেই একটা ট্রাজিক-রোমান্টিক সুর। বোঝাই যাচ্ছে দ্বিতীয়জনের সাথেই ঘটবে মেয়েটির এনকাউন্টার, লুইস-জনের প্রাথমিক অতি-আগ্রহ সত্বেও — ফলে গল্পে আরেকটা মাত্রা যোগ হয়ে রসভাণ্ডার টই-টম্বুর। দারুণ!
এই সমস্যার সমাধান ও বাকি ছবিটার সাফল্যের পর ক্লাইম্যাক্সটা কিভাবে দেখাবেন রেনোয়াঁ, এটা ছিল শেষ প্রশ্ন — কারণ এই ক্লাইম্যাক্সে শিল্পীর দায়িত্ব অত্যন্ত সূক্ষ্ম একটি মুহূর্তকে ধারণ করা। একাজ মোপাসাঁ কিভাবে করেছেন, রেনোয়াঁ কিভাবে করেছেন, কি তাদের পদ্ধতির মিল বা বেমিল — তার বর্ণনা করার আমার ইচ্ছাও নেই, সাধ্য নিয়েও সন্দেহ আছে। যাদের এই মুহূর্তে ছবি বা ফিল্মের কোনটাই পড়বার বা দেখবার সুযোগ নেই, তাদের জন্য ওই মূহুর্তটি ধরবার জন্য ডরোথি পার্কারের চেয়ে মহত্তর এক বাঙালী কবির ঘাড়ে দায়িত্ব দিয়েই শেষ করছি —
একটি চুমুর দ্বিধা থরথর চূড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী;
একটি নিমেষ দাঁড়ালো সরণী জুড়ে,
থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি।
ভাল লাগল পোস্টটা, ছোট, কিন্তু রেশ থেকে গেল। দায়িত্বও ঘাড়ে পড়ল, মুভিটাও দেখতে হবে, গল্পটাও পড়তে হবে 😉
সব পাঠক ও মন্তব্যকারীদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি 🙂
ছবিটা দেখা হয়নি তাই ছবি নিয়ে মন্তব্য করতে পারছি না। তবে আপনার লেখার গাঁথুনি বরাবরের মতই অসাধারণ।
চমৎকার লেখা!
এধরনের লেখা আরও চাই!
একজন কবি তাঁর নিজের মতো করে সব কিছু কল্পনা করে নিতে পারেন। এক্ষেত্রে কবি স্বাধীন।
আর একজন ছবি নির্মাতা কল্পনাকে সিনেমা বন্দী করতে পারেন। এক্ষেত্রে তিনি হন সফল।
ভালো লাগলো “পার্টি দ কম্পানে”র আলোচনা। ছবিটা এখনও দেখিনি, দেখে নেব শীঘ্র।
ভালো থাকবেন (Y)
রেনোয়া ক্যামেরা দিয়ে চলচ্চিত্রতো বানাতেন না যেন কবিতা লিখতেন। এরকম কবিতার মত চলচ্চিত্র এখন আর তৈরি হয় না। ওই যুগ এখন বিগত।
এই ছবিতে জ্যাঁ রেনোয়া নিজেও ছোট্ট একটা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
আমি মনে করি যে , রোমান্স ও সিনিসিজম একে অন্যের মাঝে বসবাস করে এবং পর্যবেক্ষক নির্ধারন করেন কোনটা রোমান্স এবং কোনটা সিনিসিজম। একটা গল্পকে চিত্রনাট্যে রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে একজন চিত্রকারকে অনেকগুলি প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে হয়। চিত্রনাট্যের প্রতিটি অংক রূপালী পর্দায় চিত্রায়নযোগ্য হতে হয়। অন্যদিকে বইয়ের গল্পের লেখকদের এ সমস্যা নেই কারন রূপালী পর্দার স্হলে সেখানে জায়গা করে নেয় পাঠকদের মস্তিষ্ক প্রসুত কল্পনার জাল।
একটা ভাল চিত্রনাট্যে টেনশন তৈরী করার পর পরিচালক ক্লাইমেক্সে যেতে পারেন অথবা শেষ পর্যন্ত সাসপেন্স বজায় রাখতে পারেন। “পার্তি দ কাম্পানিয়া” ছবিতে এ দুইকে ছাপিয়ে কাহিনীর সিনিসিজমটাই মূখ্য হয়ে আমার চোখে ধরা দেয়।