আবুল কাশেম

ভূমিকা

উম হানী এবং নবী মুহাম্মদের মাঝে পরকীয়া প্রেমের বিষয়ে আলোকপাত করা অত্যন্ত জটিল এবং বিপদজনক। জটিল এই কারণে যে উম হানীর ব্যাপারে আধুনিক ইসলামী পণ্ডিতেরা কোন কিছুই জানাতে চান না। কারণ নবীর জীবনের এই অধ্যায় তেমন আনন্দদায়ক নয়। নবীর শিশু স্ত্রী আয়েশা, পালকপুত্রের স্ত্রী যয়নবের সাথে নবীর বিবাহ, এবং আরও অন্যান্য নারীদের সাথে নবীর যৌন এবং অ-যৌন সম্পর্কের ব্যাপার আজ আমরা বেশ ভাল ভাবেই জানতে পারি। তা সম্ভব হয়েছে আন্তর্জালের অবাধ শক্তির জন্যে। আজকাল এই সব নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে এবং আমরা নবীর জীবনের অনেক অপ্রকাশিত অন্ধকার দিকগুলি অবলোকন করতে পারছি। কিন্তু উম হানীর সাথে যে নবী আজীবন পরকীয়া প্রেম করে গেছেন—অগুনতি স্ত্রী ও যৌন দাসী থাকা সত্যেও—তা নিয়ে আজ পর্যন্ত তেমন উল্লেখযোগ্য কোন প্রবন্ধ লিখা হয় নি। উম হানী ছিলেন নবী মুহাম্মদের প্রথম এবং আজীবন প্রেম। ধরা যায় নবী উম হানীকে মনঃপ্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন এবং কোন দিন এক মুহূর্তের জন্য উম হানীকে ভুলেন নাই। ইসলামের প্রাচীন এবং নির্ভরযোগ্য উৎস ঘেঁটে এই রচনা লিখা হয়েছে যাতে নবী জীবনের এই উপাখ্যান দীর্ঘ জানা যায়। যেহেতু উম হানীর জীবন এবং নবীর সাথে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে কোন ইসলামী পণ্ডিত ইচ্ছাকৃত ভাবেই তেমন মাথা ঘামাননি তাই অনেক কিছুই অনুমান করে নিতে হয়েছে। জোরালো হাদিস এবং প্রাচীন জীবনীকারদের থেকে জানা তথ্যই হচ্ছে এই অনুমানের ভিত্তি। এই রচনাতে নবী মুহাম্মদের পরকীয়া প্রেমের অনেক প্রশ্নের উত্তর পাঠকেরা হয়ত পাবেন।

এই রচনা লিখা বিপদজনক এই কারণে যে ইসলামি জিহাদিদের কাছে নবীর জীবনের এই গহীন গোপনীয় ব্যাপার খুবই স্পর্শকাতর। যে লেখকই এই উপাখ্যান লিখবে সেই ইসলামী সন্ত্রাসীদের শিকার হবে তা বলা বাহুল্য।

উম হানীর এবং মুহাম্মদের সম্পর্কের সাথে আয়েশা, সওদা, মেরাজ, মক্কা বিজয় এবং আরও কিছু প্রসঙ্গ ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। কিছু প্রসঙ্গের পুনরাবৃত্তি করতে হয়েছে—উপায় ছিল না। ইসলামি কিতাবসমূহ যে পুনরাবৃত্তিতে ভরপুর,

উম হানীর পরিচয়

নবী মুহাম্মদ জন্মের পূর্বেই তাঁর পিতা আবদুল্লাহকে হারান। ছয় বছর বয়সে নবীর মাতা আমিনাও মারা যান (ইবনে ইসহাক, পৃঃ ৭৪)। মুহাম্মদের আট বছর বয়স পর্যন্ত উনাকে লালন পালন করেন নবীর পিতামহ আবদুল মুত্তালিব। আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর মুহাম্মদের ভরণ পোষণের ভার ন্যস্ত হয় চাচা আবু তালেবের উপর। আবু তালেব নবীকে নিজের সন্তানের মতই লালন পালন করেন আমৃত্যু পর্যন্ত।

আমরা ইতিহাস থেকে আবু তালিব সম্পর্কে যা জানতে পাই তা হল এই:

আবু তালেব অর্থ হল তালেবের পিতা। আবু তালেবের আপন নাম ছিল আব্‌দ মানাফ। তালেব ছিল তাঁর জ্যৈষ্ঠ পুত্র। আব্‌দ মানাফের হয়ত অনেক স্ত্রী ছিল, কিন্তু ইসলামের ইতিহাস ঘেঁটে তাঁর দুই স্ত্রীর নাম পাওয়া যায়। এঁরা হলেন—

ফাতেমা বিন্‌ত আসাদ। এঁর গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন চার পুত্র এবং তিন কন্যা। পুত্ররা হলেন—যথাক্রমে তালিব, আকিল, জাফর এবং আলী। আর কন্যারা হলেন—উম হানী, জুমানা এবং রায়তা (আসমা বিন্‌ত আবু তালেব) (ইবনে সা’দ, খণ্ড ১, পৃঃ ১৩৫)।

আবু তালেবের অপর স্ত্রীর নাম ছিল ইল্লাহ বা এলাহ্‌। উনার গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন এক পুত্র, তুলায়ক। এছাড়াও ইল্লাহ্‌র আগের স্বামীর ঔরসে জন্ম গ্রহণ করছিল আর এক পুত্র যার নাম ছিল আল হুয়েরেথ বিন আবু দুবাব (ঐ একই সূত্র)।

ইসলামের ইতিহাসে আব্‌দ মানাফের দুই ছেলে জাফর এবং আলী সম্বন্ধে প্রচুর তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু আকিল ও তালেব সম্বদ্ধে তেমন কিছু জানা যায় না। ইবনে সা’দ লিখেছেন তালেবকে বদর যুদ্ধে জোরপূর্বক যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়। কিন্তু তালেব যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন কি না তা পরিষ্কার নয়। কারণ বদর যুদ্ধে তাঁর মৃত দেহ কেউ পায়নি, আবার তাঁকে জীবিতও কেউ দেখেনি। ধরা যায় তালেব বদর যুদ্ধ থেকে পালিয়ে কোথাও চলে যান। এর পর থেকে আর কেউ তার খবর জানেনা—তালেব চিরকালের জন্য নিখোঁজ হয়ে গেলেন; তার কোন উত্তরসূরিও ছিল না (ইবনে সা’দ, খণ্ড-১, পৃঃ ১৩৫)।

আকিলের ব্যাপারেও কোন তথ্য পাওয়া যায় না। শুধু এইটুকু জানা যায় যে যখন নবী এবং আলী মদিনা চলে যান, আর জাফর যখন আবিসিনিয়ায় নির্বাসিত ছিলেন তখন আকিল আবু তালেবের মৃত্যুর পর সমস্ত পৈত্রিক সম্পত্তি নিজের হাতে নিয়ে নেন। কারণ নবী মুহাম্মদ যখন মক্কা জয় করেন তখন অনেকেই জিজ্ঞাসা করেছিলেন উনি আবু তালেবের গৃহে যাবেন কি না। উত্তরে মুহাম্মদ বলেছিলেন যে ঐ গৃহে যাবার তাঁর কোন ইচ্ছাই নাই—কারণ আকিল তাঁদের জন্য কিছুই রাখে নাই। বলা যায় যে নবী যখন মক্কায় বিজয় পতাকা নিয়ে প্রবেশ করলেন তখন হয়ত আকিল কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে যান। এই সময় উম হানী মক্কায় ছিলেন, এবং অনুমান করা যেতে পারে উম হানী তাঁর পিতার ভিটেমাটির দখল পান।

ধরা যায় উম হানী ছিলেন আবু তালেবের জ্যৈষ্ঠ কন্যা। উম হানীর অর্থ হচ্ছে হানীর জননী বা মা। উম হানীর নিজস্ব নাম নিয়ে কিছু অস্পষ্টতা আছে।

ইবনে ইসহাক (পৃঃ ৫৫৭) লিখেছেন উম হানীর নাম ছিল হিন্দ । ইবনে সা’দও (খণ্ড ১, পৃঃ ১৩৫) তাই বলেন।

এদিকে মার্টিন লিঙ্গস্‌ (পৃঃ ১৩৫) লিখেছেন উম হানীর নাম ছিল ফাকিতাহ্‌।সে যাই হোক, ইসলামের ইতিহাসে এই নারী উম হানী হিসাবেই অধিক পরিচিত।

মার্টিন লিঙ্গস্‌ লিখেছেন তালেব এবং নবী প্রায় একই বয়সের ছিলেন। বাল্য বয়সে নবীর সাথে জাফরের বিশেষ অন্তরঙ্গতা ছিল। এই সময় মুহাম্মদের বয়স ছিল ১২, আকিলের ১৩ আর জাফরের ৪। উম হানী ছিলেন মুহাম্মদের চাচাত বোন। অনুমান করা যায় উম হানী কিশোর মুহাম্মদের খেলার সাথী ছিলেন। এবং এই সময় মুহাম্মদ উম হানির প্রেমে পড়ে যান (লিঙ্গস্‌, পৃঃ ৩৩)।

যদি আমরা ধরে নেই যে উম হানী ছিলেন আবু তালেবের জ্যৈষ্ঠ কন্যা তখন আমরা অনুমান করে নিতে পারি যে উম হানীর বয়স নবীর বয়সের কাছাকাছি অথবা কিছু অল্প ছিল। অর্থাৎ, ১২ বছর বয়স থেকেই নবী মুহাম্মদ উম হানীর সাথে প্রেমে আবদ্ধ ছিলেন। এই প্রেম শুধু এক তরফা ছিল কি না বলা দায়, তবে এই রচনা সম্পূর্ণ পড়লে অনুমান করা যাবে যে উম হানীরও কিছু সাড়া ছিল মুহাম্মদের এই নিভৃত প্রেমের প্রতি।

হানী কি পুত্র না কন্যা? এই সরল প্রশ্নের উত্তর কোন জীবনীকার সহজ ভাবে দেন নাই। উইকিতে দেখা যায় হানীকে উম হানীর পুত্র বলা হয়েছে। কিন্তু এই তথ্যের কোন নির্ভরযোগ্য সূত্র নাই। আরবিতে হানী সাধারণতঃ মেয়েদের নাম হয়—তবে পুরুষের নাম হওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। যেমন বাঙ্গলাদেশে ‘শামিম’ ছেলে অথবা মেয়ে উভয়ের নাম হতে পারে।

উম হানী কবে মারা যান তার তথ্য ভাল ভাবে পাওয়া যায় না। তবে মুহাম্মদের মৃত্যুর পর উম হানী অনেক দিন জীবিত ছিলেন অনুমান করা যায়।

উম হানীর উপর নবীর আসক্তি

মুহাম্মদের জীবনী পড়লে বুঝা যায় যে উম হানীর প্রভাব মুহাম্মদের জীবনে ছিল অপরিসীম। মুহাম্মদ কোন দিনই উম হানীর প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা ভুলেন নাই। আমরা লক্ষ্য করি বাল্য বয়সের সেই প্রেমের উচ্ছ্বাস নবী কোন দিনই দমিয়ে রাখতে পারেন নাই। মুহাম্মদের জীবনী রচয়িতারা উম হানীর সাথে মুহাম্মদের প্রেমের ব্যাপারটা যে ভাবেই হোক এড়িয়ে যেতে চান—যার ফলস্বরূপ নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য এবং প্রচুর আজগুবি কাহিনী প্রচার করেন। মুহাম্মদ ছিলেন রক্ত মাংসের মানুষ। তাঁর মাঝেও ছিল অনেক কামনা বাসনা—ব্যর্থ প্রেমের আকুলতা এবং নিজের রিপু চরিতার্থ করার তীব্র অভিপ্রায়। জীবনীকারের যতই চেষ্টা করুন নবীর এই স্বাভাবিক বাসনাকে ধামা চাপা দিবার—মুহাম্মদ এবং উম হানীর জীবনের অনেক ঘটনার ফাঁক ফোঁকর থেকে অনেক সত্যই আমরা অনুমান করে নিতে পারি।

অনেক ইসলামী পণ্ডিতেরা উম হানীর সাথে নবীর প্রেমের ব্যাপারটা ধামা চাপা দিতে চান এই বলে যে মুহাম্মদ উম হানীকে নিজের ভগিনী হিসাবে জানতেন। প্রেম বলতে আমরা সাধারণভাবে যা বুঝি, অর্থাৎ দেহ এবং মনের সম্পর্ক—তা বিবাহ প্রসূতই হোক অথবা অন্য কোন ভাবে, তা ইসলামী পণ্ডিতেরা কোন ভাবেই স্বীকার করতে চান না। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে মুহাম্মদ চেয়েছিলেন উম হানীকে বিবাহ করে সংসার পাততে। বিবি খদেজার সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হবার আগে নবী চেয়েছিলেন উম হানীকে নিজের স্ত্রী বানাতে।

মুহাম্মদের জীবনী লেখক রডিন্সন লিখেছেন যে উম হানীকে বিবাহ করার জন্য নবী পিতৃব্য আবু তালেবের কাছে প্রস্তাব দেন। কিন্তু আবু তালেব তা নাকচ করে দেন। এর কারণ কি হতে পারে তা সম্বন্ধে অনেক কিছুই ভাবা যেতে পারে। যতটুকু জানা যায় এই সময় নিরক্ষর মুহাম্মদ ভেড়ার রাখালের কাজ ছাড়া আর কিছু করতেননা বা জানতেননা। হয়ত আবু তালেব চাননি এক ভেড়ার রাখালের সাথে তাঁর কন্যাকে সঁপে দিতে। আবু তালেব বেশ প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন—আমরা ধরে নিতে পারি আবু তালেব উচ্চ শিক্ষিত না হলেও নিরক্ষর ছিলেন না। তাই অনেক ভেবেচিন্তেই উনি হয়ত ঠিক করেছিলেন নিরক্ষর, সহায় সম্বলহীন, বেকার ভাতিজার সাথে উম হানীর বিবাহ শোভা পাবে না।

রডিন্সন লিখেছেন:

মুহাম্মদের সময় কেউ বেশী বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত থাকত না। সেই অনুযায়ী মনে হয় মুহাম্মদের বিবাহের বয়স অনেক পেরিয়ে গিয়েছিল। এর কারণ হয়ত দরিদ্রতা। অনেকে বলেন মুহাম্মদ আবু তালেবের কাছে উম হানীকে বিবাহের প্রস্তাব করলেন। বেদুঈন সমাজে চাচাত, মামাত খালাত, ফুফাতো ভাই অথবা বোনদের সাথে বিবাহ প্রচলিত ছিল। কিন্তু আবু তালেব এই প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন। এর কারণ হতে পারে যে আবু তালেব চাইছিলেন আরও যোগ্য পাত্রের হাতে কন্যার হাত সমর্পণ করতে। এর বেশ কিছুদিন পরে উম হানী বিধবা হয়ে যান। তখন হয়ত উম হানী চেয়েছিলেন মুহাম্মদ আবার তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। কিন্তু মুহাম্মদ এই ব্যাপারে আর আগ্রহী ছিলেন না। তা সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যে ভাল সম্পর্ক থেকে যায়। যে রাত্রে উনি স্বর্গ ভ্রমণে যান সেই রাত্রে উনি উম হানীর গৃহে ঘুমিয়ে ছিলেন (রডিন্সন, পৃঃ ৪৯)

উম হানীর সাথে এই ভাল সম্পর্ক বলতে কি বুঝায়?

রডিন্সন আরও লিখেছেন:

আরবদের যৌন ক্ষুধা অতিশয় প্রবল। তলমুদ আইনজ্ঞ নাথন বলেছেন আরবদের মাঝে যৌন সম্ভোগের যে প্রবণতা আছে বিশ্বের আর কোন জাতির মাঝে তা নাই। পারস্যের যে বিশাল ক্ষমতার আধার, আর রোমানদের যেই বিশাল বিত্ত অথবা মিশরের যে মায়া ইন্দ্রজাল, আরবদের মাঝে সেই রকম হচ্ছে তাদের যৌন ক্ষুধা। এই আইনজ্ঞ আরও বলেছেন যে বিশ্বের যৌন ক্ষুধাকে দশ ভাগ করলে তার নয় ভাগ পড়বে আরবদের পাল্লায় আর এক ভাগ থাকবে বিশ্বের বাকী জাতিদের মাঝে। (রডিন্সন, পৃঃ ৫৪)

মুহাম্মদ কেন আরবদের মাঝে ব্যতিক্রম হবেন?

এদিকে ইসলামের বিশিষ্ট ঐতিহাসিক তাবারি লিখেছেন মুহাম্মদ উম হানীকে বিবাহের প্রস্তাব দেন, কিন্তু উম হানী তা গ্রহণ করলেন না—কারণ উম হানীর সাথে তাঁর শিশু ছিল (খণ্ড ৯, পৃঃ ১৪০)।

এই দুই ঘটনা কিছুটা পরস্পর বিরোধী হলেও আমরা অনুমান করতে পারি যে নবী উম হানীকে হয়ত দুবার বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন—প্রথমবার উম হানীর পিতা আবু তালেবের কাছে। সেই সময় মুহাম্মদ নিজেকে নবী বলে ঘোষণা দেন নাই; অর্থাৎ মুহাম্মদের বয়স অল্প ছিল, খুব সম্ভবত কুড়ি কিম্বা বাইশ। দ্বিতীয় বার উম হানীকে প্রস্তাব দেন আবু তালেবের মৃত্যুর পর, উম হানীর স্বামী যখন নিখোঁজ হয়ে যান (অনেকে, যেমন উপরে রডিন্সন লিখেছেন মারা যান) অথবা মুহাম্মদের প্রথম স্ত্রী খদেজার মৃত্যুর পর। মুহাম্মদ নিজেকে নবী বলে ঘোষণা দেন যার ফলে সমগ্র কুরাইশদের বিরাগভাজন হন। এই সময় মুহাম্মদের বয়স সম্ভবত ৫০ অথবা ৫১ হবে। কারণ খদেজা এবং আবু তালেব মারা যাবার অল্প কিছু সময়ের মাঝেই মুহাম্মদ বিধবা সওদাকে বিবাহ করেন আর আাবু বকরকে প্রস্তাব দেন তাঁর কন্যা আয়েশাকে বিবাহ করার। সামান্য সময়ের ব্যবধানেই মুহাম্মদ ছয় বছরের শিশু আয়েশাকে বিবাহ করেন।

অনুমান করা যায় মুহাম্মদের এই দুই বিবাহের ব্যাপারে উম হানী জ্ঞাত ছিলেন। তাই মুহাম্মদ উম হানীকে বিবাহের প্রস্তাব দিলে উম হানী আর এক সতীন হতে চাইলেন না। উম হানী স্বামী ছাড়া, এক সন্তানের মা হয়ে একা থাকা পছন্দ করলেন। কিন্তু মুহাম্মদের সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যেতে কুণ্ঠিত হলেন না। তার প্রমাণ আমরা দেখব নিচের অংশগুলিতে।

খদেজা মারা যাবার পর, উম হানীকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না করতে পারলেও মুহাম্মদ হাল ছেড়ে দিলেন না। আল্লাহ নবীর সাহায্যে দ্রুত এগিয়ে আসলেন। আল্লা পাঠিয়ে দিলেন আয়াত ৩৩:৫০ যে আয়াতে নবীকে বলা হল উনি ইচ্ছে করলেই উনার যে কোন চাচাত, ফুফাতো, মামাত, খালাত বোনদের সাথে যৌন কর্মে লিপ্ত হতে পারবেন বিবাহ ছাড়াই—শুধু এই হবে যে ঐ বোনদেরকে মদিনায় হিজরত করতে হবে। কিন্তু নবী অত বোকা ছিলেন না। তিনি জানতেন এই আয়াতের প্রতিফল কি হবে তাঁর অনুসারীদের মাঝে। তাই আল্লা তাঁকে জানিয়ে দিলেন যে এই অতি নিকট আত্মীয়দের সাথে বিবাহ বহির্ভূত যৌন-লীলার অনুমতি শুধুমাত্র নবীর জন্যই বহাল থাকবে অন্য মুসলিমদের জন্য নয়।

আমরা আয়াত ৩৩:৫০ পড়ে নেই।

হে নবী। আপনার জন্য আপনার স্ত্রীগণকে হালাল করেছি, যাদেরকে আপনি মোহরানা প্রদান করেন। আর দাসীদেরকে হালাল করেছি, যাদেরকে আল্লাহ্‌ আপনার করায়ত্ত করে দেন এবং বিবাহের জন্য বৈধ করেছি আপনার চাচাতো ভগ্নি, ফুফাতো ভগ্নি, মামাতো ভগ্নি ও খালাতো ভগ্নিকে যারা আপনার সাথে হিজরত করেছে। কোন মুমিন নারী যদি নিজেকে নবীর কাছে সমর্পণ করে, নবী তাকে বিবাহ করতে চাইলে সে—ও হালাল। এটা বিশেষ করে আপনারই জন্য—অন্য মুমিনদের জন্য নয়। আপনার অসুবিধা দূরীকরণের উদ্দেশে। মুমিনগণের স্ত্রী ও দাসীদের ব্যাপারে যা নির্ধারিত করেছি আমার জানা আছে। আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল, দয়ালু। (অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দিন খান, তাফসীর মাআরেফুল কোরআন)

এই বাঙলা অনুবাদে যে কারচুপি আছে তা পরিষ্কার হয় যখন ইংরাজি অনুবাদ দেখা যায়। আল্লাহ ত সব মুসলিমদের জন্যই তাদের চাচাত, ফুফাতো, খালাত, মামাত বোনদের বিবাহ হালাল করেছেন। কাজেই এই আয়াতে নতুনত্বের কি আছে? দেখা যাক ইংরাজি অনুবাদ:

033.050

YUSUFALI: O Prophet! We have made lawful to thee thy wives to whom thou hast paid their dowers; and those whom thy right hand possesses out of the prisoners of war whom Allah has assigned to thee; and daughters of thy paternal uncles and aunts, and daughters of thy maternal uncles and aunts, who migrated (from Makka) with thee; and any believing woman who dedicates her soul to the Prophet if the Prophet wishes to wed her;- this only for thee, and not for the Believers (at large); We know what We have appointed for them as to their wives and the captives whom their right hands possess;- in order that there should be no difficulty for thee. And Allah is Oft-Forgiving, Most Merciful.

Hilali and Khan

33:50. O Prophet (Muhammad)! Verily, We have made lawful to you your wives, to whom you have paid their Mahr (bridal money given by the husband to his wife at the time of marriage), and those (captives or slaves) whom your right hand possesses whom Allâh has given to you, and the daughters of your ‘Amm (paternal uncles) and the daughters of your ‘Ammah (paternal aunts) and the daughters of your Khâl (maternal uncles) and the daughters of your Khâlah (maternal aunts) who migrated (from Makkah) with you, and a believing woman if she offers herself to the Prophet, and the Prophet wishes to marry her; a privilege for you only, not for the (rest of) the believers. Indeed We know what We have enjoined upon them about their wives and those (captives or slaves) whom their right hands possess, – in order that there should be no difficulty on you. And Allâh is Ever Oft¬Forgiving, Most Merciful.

আয়াত ৩৩:৫০ সম্পর্কে ইবনে কাসীর লিখেছেন:

মহান আল্লাহ বলেন: যারা তোমার সাথে দেশ ত্যাগ করেছে। হযরত উম্মে হানী (রাঃ) বলেন: “আমার কাছে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পয়গাম এলো। আমি আমার অপরাগতা প্রকাশ করলাম। তিনি তা মেনে নিলেন। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা এই আয়াতটি নাযিল করলেন। আমি তাঁর জন্য বৈধকৃত স্ত্রীদের মধ্যেও ছিলাম না এবং তাঁর সাথে হিজরতকারিদের অন্তর্ভূক্তও না। বরং আমি মক্কা বিজয়ের পর ঈমান এনেছিলাম। আমি ছিলাম আযাদকৃতদের অন্তর্ভূক্ত।“ তাফসীর কারকগণও একথাই বলেছেন। আসল কথা হল যারা মদীনায় রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে হিজরত করেছেন। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর কিরআতে রয়েছে।

এরপর মহামহিমাম্বিত আল্লাহ বলেছেনঃ কোন মুমিনা নারী নবী (সঃ)-এর নিকট নিজেকে নিবেদন করলে এবং নবী (সঃ) তাকে বিয়ে করতে চাইলে সেও বৈধ। এ আদেশ দু’টি শর্তের উপর প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ হে নবী (সঃ)! মুমিনা নারী তোমার জন্য বৈধ যদি সে নিজেকে তোমার নিকট নিবেদন করে যে, তুমি ইচ্ছা করলে তাকে বিনা মহরে বিয়ে করতে পার। (তাফসীর ইবনে কাসীর, পঞ্চদশ খণ্ড, অনুবাদ ডঃ মুহাম্মদ মুজীবুর রহমান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা থেকে প্রকাশিত, পৃঃ ৮২৯)

এবার আমরা তিরমিজি শরীফ থেকে একটা হাদীস পড়ব:

উম হানী বিন্‌ত আবু তালেব বর্ণনা করলেন: “আল্লাহর রসুল আমাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু আমি উনার কাছে মাফ চাইলাম। উনিও আমাকে আর পীড়াপীড়ি করলেন না। এর পর আল্লাহ (সর্ব্বোচ্চ) নাজেল করলেন (৩৩:৫০) [এইখানে পাঠকেরা উপরে উদ্ধৃত আয়াতটা পড়ে নিতে পারেন]। উনি (উম হানী) বললেন: ‘এটা এই জন্য যে আমি উনার জন্য আইন সঙ্গত ছিলাম না কারণ আমি হিজরত করি নাই। আমি তুলাকাদের মধ্যে একজন ছিলাম ‘।

[পাদটীকা ২। তুলাকার অর্থ হল ঐসব ব্যক্তি যারা মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহণ করেছিল] (জামি আত তিরমিজি, খণ্ড ৫, হাদিস নম্বর ৩২১৪, পৃঃ ৫২২; অনুবাদ লেখকের)

এই আয়াতের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা নিম্নলিখিত ধারণা করতে পারি।

খদেজা মারা যাবার পর উম হানীকে মুহাম্মদ বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। উম হানী তা নাকচ করে দিলেন। মুহাম্মদ বিবাহ করলেন সওদাকে আর বগদত্ত হয়ে থাকলেন আবু বকরের ছয় বয়সের শিশু কন্যা আয়েশার সাথে। এর পর মুহাম্মদ মদিনায় হিজরতের আয়োজন করলেন। চাইলেন উম হানীকে সাথে নিতে। তাই উম হানিকে আবার প্রস্তাব দিলেন বিবাহের। উম হানী রাজী হলেন না, হয়ত উম হানী চাননি সতিনদের সাথে মুহাম্মদের সংসারে ঢুকতে। আল্লাহ পাঠিয়ে দিলেন আয়াত ৩৩:৫০। মুহাম্মদ উম হানীকে জানালেন আল্লাহ তাঁকে অনুমতি দিয়েছেন যে চাচাত (অথবা ফুফাতো, মামাত, খালাত) বোন যেই তাঁর সাথে হিজরত করবে তাকে বিবাহ করতে পারবেন। উম হানি বললেন যে তিনি হিজরতে যাবেন না। তাই মুহাম্মদের স্ত্রী হতে পারবেন না।

মুহাম্মদ এবার আর এক কৌশল করলেন। আল্লাহ পাঠিয়ে দিলেন আয়াত ৩৩:৫০-এর বাকী অংশটুকু। মুহাম্মদ উম হানীকে জানালেন যে হিজরত না করলেও অসুবিধা নাই—কারণ আল্লাহ্‌ বলেছেন যে কোন মুসলিম নারী যদি নিজের ইচ্ছায় মুহাম্মদের সঙ্গ পেতে চায় মুহাম্মদ তাকে নিতে পারবেন—তার জন্য কোন দেনমোহর দিতে হবে না। কিন্তু উম হানী মুসলিম হতে চাইলেন না। তাই অগত্যা মুহাম্মদকে উম হানী ছাড়াই মদিনায় হিজরত করতে হল।

এখানে স্মরণ রাখা দরকার যে বর পক্ষ কনেকে দেনমোহর না দিলে অথবা তার প্রতিজ্ঞা না করলে কোন বিবাহ-ই ইসলামী আইন অনুযায়ী ন্যায় সঙ্গত নয়। তাই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে উম হানী যখন মুহাম্মদের কোন প্রস্তাবেই রাজি হলেন না তখন মুহাম্মদ এই ফাঁদ পাতলেন—অর্থাৎ উম হানীকে ইসলামী বিবাহ ছাড়াই তাঁর হেরেমে নিতে পারবেন।

এই প্রসঙ্গে মুহাম্মদের ফুফাতো বোন যয়নব বিন্‌ত জাহশের কথা উল্লেখ করা যায়। যয়নবের সাথে বিবাহ হয়েছিল মুহাম্মদের পালিত পুত্র যায়েদের সাথে। কিন্তু মুহাম্মদ যয়নবের রূপ দেখে তাকে বিবাহ করতে চাইলেন। যায়েদ যয়নবকে তালাক দিয়ে দিলে মুহাম্মদ যয়নবকে বিছানায় টেনে নিলেন—আরবেরা এই সম্পর্ককে ঢি ঢি করতে শুরু করলে মুহাম্মদ প্রচার করতে লাগলেন এই বিবাহে আল্লাহর অনুমতি আছে–আল্লাহ-পাক তাঁদের বিবাহ দিয়ে দিয়েছেন। যয়নব নবীর সাথে মদিনায় হিজরত করেছিলেন। তাই দেখা যাচ্ছে মুহাম্মদ আয়াত ৩৩:৫০ ঠিক মতই প্রয়োগ করে নিয়েছিলেন।

কিন্তু মদিনা চলে গেলেও এবং অগুনতি স্ত্রী ও যৌন দাসী থাকা সত্ত্বেও নবী তাঁর বাল্য প্রেম ভুলেন নাই। উম হানীর সাথে নবীর প্রেম যে উনার প্রথম প্রেম ছিল তাতে আমাদের সন্দেহ থাকে না। সেই প্রথম প্রেমকে নবী কোন দিনই তাঁর হৃদয় থেকে বিতাড়িত করতে পারলেন না।

মক্কায় অবস্থানকালে এবং খাদিজাকে বিবাহ করার আগে মুহাম্মদ কি ভাবে উম হানীর সাথে মিলিত হতেন? নিচের কিছু হাদিস পড়লে অনুমান করা যায় যে, উম হানির গৃহে মুহাম্মদ প্রায়ই যাতায়াত করতেন।

এ ব্যাপারে দেখা যাক কয়েকটি হাদিস।

উম হানী বর্ণনা করলেন: “আমি নবীর সান্নিধ্যে বসে ছিলাম। এই সময় কেউ পানীয় কিছু নিয়ে আসল। উনি তা পান করলেন। তারপর আমাকে পান করতে বললেন। আমি পান করলাম। তারপর আমি বললাম: ‘আমি সত্যই পাপ করছি। আমার জন্য আপনি ক্ষমা প্রার্থনা করুন’। নবী বললেন: ‘কি হয়েছে?’ আমি বললাম; আমি যে রোজা (উপবাস) ছিলাম। এখন আমি তা ভেঙ্গে ফেলেছি।‘ উনি বললেন: ‘তুমি কি এমন রোজা রেখেছ যা ভেঙ্গে ফেললে আবার রাখতে হবে?’ আমি বললাম: ‘না’। উনি বললেন: ‘তাহলে তোমার কোন ক্ষতি নাই’ (জাইফ) । (জামি আত তিরমিজি, খণ্ড ২, হাদিস নম্বর ৭৩১, পৃঃ ১৭২; অনুবাদ লেখকের)

সিমাক বিন হার্‌ব বর্ণনা করলেন: “ উম হানীর এক সন্তান আমাকে বলল—আর সে ছিল সর্বাপেক্ষা ধার্মিক ব্যক্তি। তার নাম ছিল জা’দাহ্‌। উম হানী ছিলেন ঐ ব্যক্তির দাদীমা। সে তার দাদীমার কাছ থেকে শুনেছিল যে আল্লার রসূল উনার (উম হানীর) কাছে আসলেন এবং কিছু পানীয় চাইলেন। তিনি তা পান করলেন। তারপর উনি সেই পানীয় উম হানীকে দিলেন। উম হানী তা পান করলেন। উম হানী বললেন: ‘হে আল্লাহর রসূল! আমি যে রোজা ছিলাম। তখন রসূলুল্লাহ বললেন: “নফল (ঐচ্ছিক) রোজা নির্ভর করে রোজদারের উপর। সে চাইলে রোজাটা পূর্ণ করতে পারে, চাইলে ভাঙ্গতে পারে।” শুবাহ্‌ (আরেকজন বর্ণনাকারী) বললেন: ‘আমি তাকে (জা’দাহকে ) জিজ্ঞাসা করলাম: ‘তুমি কি এটা উম হানীর কাছ থেকে শুনেছ?’ সে উত্তর দিল: ‘না। আবু সালেহ্‌ এবং আমাদের পরিবারের সদস্যরা আমাকে এই ব্যাপারটা জানিয়েছেন। (জাইফ) (জামি আত তিরমিজি, খণ্ড ৫, হাদিস নম্বর ৭৩২, পৃঃ ১৭৩; অনুবাদ লেখকের)

উম হানী বিন্‌তি আবু তালেব বর্ণনা করলেন: “আল্লার রসূল আমার ঘরে আসলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার কাছে কি কিছু আছে?’ আমি বললাম, ‘না, শুধুমাত্র এক টুকরো শক্ত রুটি আর সির্কা ছাড়া।‘ তিনি উত্তর দিলেন: ‘তাই নিয়ে এস, কারণ যে গৃহে সির্কা থাকে সেই গৃহে মসল্লার অভাব থাকে না।‘ (হাসান) (জামি আত তিরমিজি, খণ্ড ৩, হাদিস নম্বর ১৮৪১, পৃঃ ৫৩৩; অনুবাদ লেখকের)

এই সব হাদিস থেকে অনুমান করা যেতে পারে উম হানীর সাথে নবী প্রায়ই মিলিত হতেন, একান্ত নিভৃতে। এই সব ঘটনা খুব সম্ভবত: নবীর মদিনায় হিজরতের আগেই ঘটেছিল। ধরা যেতে পারে উম হানী হয়ত নবীর কাছাকাছি কোথায় থাকতেন। এমনও হতে পারে যে উম হানী গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। উম হানী যে নবীর খুব সান্নিধ্যে থাকতেন তাও কয়েকটা হাদিস থেকে বুঝা যায়।

ইবনে মাজা ও বায়হাকী রেওয়ায়েত করেন যে, উম্মে হানী (রাঃ) বলেছেন—নবী করীম (সাঃ) কা’বার প্রাঙ্গণে রাতে যে কেরাত পাঠ করতেন, তা আমি আপন গৃহে শুয়ে শুনতে পেতাম। (খাসায়েসুল কুবরা, খণ্ড ১, পৃঃ ১২৫)

আর এই হাদিস:

তায়ালাসী, ইবনে সা’দ তিবরানী ও ইবনে আসাকিরের রেওয়ায়েতে হযরত উম্মে হানী (রাঃ) বলেন: আমি নবী করীম (সাঃ)—এর পেটের দিকে তাকালে মনে হত যেন উপরে নীচে সাদা কাগজ জড়িয়ে আছে। (খাসায়েসুল কুবরা, খণ্ড ১, পৃঃ ১৩১)

এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যা শুধু উম হানীই নয় অন্য এক বিবাহিতা মহিলার সাথেও নবীর বেশ সখ্যতা ছিল। সেটা নিচের হাদিস থেকে জানা যায়।

যায়দ ইবনে আলী ইবনে হুসায়ন রেওয়ায়েত করেন: নবুওয়তপ্রাপ্তির পর রসূলুল্লাহ (সাঃ) হালাল নয়—এমন কোন মহিলার কোলে আপন মস্তক রাখেননি; কিন্তু আব্বাস পত্নী উম্মুল ফযলের কোলে তিনি মস্তক রেখেছেন। উম্মুল ফযল তাঁর মাথায় উকুন তালাশ করতেন এবং চোখে সুরমা লাগাতেন। একদিন তিনি যখন সুরমা লাগাচ্ছিলেন, তখন তাঁর চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু রসূলুল্লাহর (সাঃ) গণ্ডদেশে পতিত হল। হুযুর (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন: তোমার কি হল? উম্মুল ফযল বললেন: আল্লাহ তা”আলা আপনার ওফাতের খবর আমাদের দিয়েছেন। আপনার পরে কে আপনার স্থলাভিষিক্ত হবে—একথা বলে গেলে ভাল হত। হুযুর (সাঃ) বললেন: আমার পর তোমরা নিগৃহিত ও অবহেলিত বিবেচিত হবে। (খাসায়েসুল কুবরা, খণ্ড ২, পৃঃ ১৫৪)

বলা বাহুল্য শারিয়া আইন অনুযায়ী এই ধরণের আচরণ একবারেই বে আইনী। দেখা যাচ্ছে মুহাম্মদ নিজের রচিত আইনের থোড়াই পাত্তা দিতেন।

মদিনায় যেয়ে নবী লুট তরাজ, ডাকাতি এবং জিহাদে মনোনিবেশ করলেন। কিন্তু উম হানীকে ভুললেন না। যখন লুটের মাল ভাগ হত নবী উম হানীকে কিছু ভাগ দিয়ে দিতেন। ওয়াকেদি লিখেছেন যে মুহাম্মদ খায়বারের লুটের মালের কিছু অংশ উম হানীকে দিয়েছিলেন। এখানে বলা প্রয়োজন খায়বার ছিল মদিনার ইহুদীদের এক বিশাল বাসস্থল। মদিনার শস্যভাণ্ডার এই খায়বার ইহুদীদের হাতেই ছিল। নবী অতর্কিতে খায়বার আক্রমণ করেন, প্রচুর খাদ্যশস্য পেয়ে যান, যা উনি উনার নিকট আত্মীয়দের মাঝে বিতরণ করেন।

আল ওয়াকেদি লিখেছেন:

খায়বার লুটের পর মুহাম্মদ আশী ওয়াসাক খেজুর এবং বিশ ওয়াসাক যব দিলেন তাঁর প্রত্যেক স্ত্রীকে। এ ছাড়াও নবী উম হানী বিন্‌ত আবু তালেবকে দিলেন তিরিশ ওয়াসাক যব [তিনশত কিলোগ্রামের কিছু বেশী]। (আল ওয়াকেদী, পৃঃ ৩৪২)

অনুমান করা যায় উম হানী বেশ কষ্টের সাথে সংসার চালাতেন। তাই মুহাম্মদ প্রেরিত এই সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। উম হানীর স্বামী যে তাঁর সাথে থাকতেন না এও তার প্রমাণ হতে পারে।

উম হানী যে নবীর দেহের খুব সন্নিকটে থাকতেন তা বুঝা যায় উম হানী যখন নবীর দেহের বর্ণনা দেন, বিশেষত্ব উম হানী দেখা যায় নবীর পেটের চামড়ার ধরণ খুব ভালভাবে জানতেন। উম হানী ছাড়া নবীর এইরূপ উলঙ্গ দেহের এই বর্ণনা আর কারও কাছ থেকে পাওয়া যায় না—এমনকি নবীর অগুনতি স্ত্রীদের কাছ থেকেও নয়।

উম হানী বলতেন, “আমি আল্লাহর রসুলের চাইতে সুন্দর হাসি আর কারও মুখে দেখি নাই। আর আমি যখনই আল্লাহর রসূলের পেট দেখতাম তখনই আমার মনে পড়ে যেত। [এই খানে কিতাব আল মাগহাযির ইংরাজি অনুবাদক ব্র্যাকেটে লিখেছেন: উম হানী এখানে নবীর ত্বকের ভাঁজের কথা বলছেন—অর্থাৎ নগ্ন পেটের] আমি মক্কা বিজয়ের দিনে উনার মাথায় চারটি বেণী বাঁধা দেখেছি। (আল ওয়াকেদী, পৃঃ ৪২৭)

চলবে (২য় পর্বে)…