[এই বছর গ্রীষ্মে এই কাহিনীটি মুক্তমনায় লিখছিলাম। অবশেষে শেষ হল। যাঁরা লেখাটি আগে দেখেন নি বা ভুলে গিয়েছেন তাঁদের পুরোনো পোস্টগুলোর লিঙ্কগুলো দিলাম। প্রথম থেকে পড়লে হয়তো কিছুটা গতিময়তা থাকবে যদিও ঐ পোস্টগুলোয় কিছু ভুল-ভ্রান্তি থেকে গিয়েছে। শেষ অংশটি বেশ বড়, কিন্তু না ভেঙ্গেই দিলাম। আশা করি লেখাটা আপনাদের ভাল লাগবে।]

১ম পোস্ট, ২য় পোস্ট, ৩য় পোস্ট, ৪র্থ পোস্ট, ৫ম পোস্ট, ৬ষ্ঠ পোস্ট,
সন ২০৩০
সপ্তম অধ্যায়

আমি কে? অনেকটা ঘোরের মধ্যে ভাবি, আমি যেই হই ক্যামেরাতে ছবি রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে, সেটা দেখলেই হবে। বাথরুমে আয়না আছে, সোফা থেকে উঠি। তখনি নিচে জেনেরাটর বন্ধ হয়ে যায়। তেল ফুরিয়ে গেছে। কি জন্য দিনের বেলা জেনেরেটর চালিয়ে রেখেছিলাম? নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করে। বিকেলের শেষ অপসৃয়মান আলোতে নিজের ঘরটাই চিনতে পারি না। কানু কুঁই কুঁই করে ওঠে। “ভয় পাস না, কানু,” বলি আমি। কিন্তু নিজে ভয় পাই। ভিডিও ক্যামেরাগুলো ব্যাটারিতে কিছুক্ষণ চলবে, তারপর? আমি টেবিলের ড্রয়ার খুলে দেয়াশলাই আর একটা মোমবাতি বের করি। ঘরের মাঝে কফি টেবিলটায় একটা প্লেটের ওপর মোমবাতিটা জ্বালিয়ে বসাই। মোমের মৃদু আলো ঘরটাকে আরো রহস্যময় করে তোলে। মোমের আলো আপাততঃ ঐ ক্যামেরাগুলোর জন্য যথেষ্ট হবে। দরজার বাইরে একটা আওয়াজ শুনি। দরজা খুলে দেখি বাইরে কেউ নেই, কিন্তু নিচ তলায় কারা যেন কথা বলছে। সিঁড়ির ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি, দুটি যুবক – তারা কথা বলতে বলতে উঠছে। আমি ভাঙ্গা ভাঙ্গা শুনতে পাই, “এই বাড়িতে কেউ নেই মনে হয়। এই দরজাটা ধাক্কা দিয়ে দেখ।”

এরা কে? ভাবি আমি। এই বিপর্যয়ের সময় এরা কি করছে? এদের কি ধারণা নেই পৃথিবীতে কি হচ্ছে? দ্বিতীয় তলার একটা ফ্ল্যাটের দরজায় লাথির শব্দ শুনি। দরজা সেই লাথিতে খুলল না। কিন্তু সেটা তাদের দরজা খোলার প্রচেষ্টা থেকে নিবৃত্ত করে না। ভীষণ আওয়াজ হতে থাকে। তাহলে ঐ ফ্ল্যাটে কি কেউ নেই? এরপর কি এরা ওপরে উঠবে? কাইয়ুম ভাইয়ের কথা ভাবি। কানুকে ঘর থেকে বাইরে বের করে আমার ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে দিই। কিন্তু দরজাটা যতটা আস্তে লাগাব ভেবেছিলাম তার থেকে জোরে লাগল, নিচে মনে হয় ওরা সেটা শুনতে পেল। “ওপরে লোক আছে,” এটুকুই শুনতে পেলাম। কানুকে নিয়ে আমি প্রায় দৌড়ে ওপরের তলায় উঠলাম। কাইয়ুম ভাইয়ের দরজা খোলাই ছিল। ঘরে ঢুকে পিছনে দরজাটা বন্ধ করে দিই। আমি ওনার প্রায় অন্ধকার ফ্ল্যাটে ঢুকে ফিসফিস করে বলি, “কাইয়ুম ভাই, আমি অমল।” কিন্তু প্রথম দৃষ্টিতে কাউকে বসার ঘরে দেখি না। বুকটা ধক করে ওঠে। উনি কি নেই, উনি কি চলে গেছেন? মানে অদৃশ্য হয়েছেন। তারপর আমাকে আশ্বস্ত করে শোবার ঘর থেকে ওনার গলার শব্দ ভেসে আসে, “অমল আমি এখানে, আসছি।”

আমি অপেক্ষা করি না। শোবার ঘরের দরজার কাছে যেয়ে মৃদু স্বরে বলি, “কিছু গুণ্ডা হয়তো বাড়িতে ঢুকেছে, ওরা ওপরে আসছে।” কাইয়ুম ভাই একটা মোমবাতি জ্বালাচ্ছিলেন, আমার কথাটা যেন বিশ্বাস করতে পারেন না। “কি বলছ, গুণ্ডা? এই সময়ে? ওরা কি কিছু জানে না?” আমরা দুজনে বসার ঘরে আসি। মোমবাতিটা মাঝের কফি টেবিলের ওপর রাখা হয়। দরজায় ইতিমধ্যে ধাক্কা পড়ছে।

“এই যে বাড়িতে কে আছে? দরজা খোল!” এরকম মিনিটখানেক চলে, তারপর কাইয়ুম ভাই উঠে যেয়ে দরজা খুলে দিলেন। কাজটা এত দ্রুত হল যে আমি বাধা দিয়ে ওঠার সময় পেলাম না। দুটি বছর পঁচিশ বয়েস হবে ছেলে ঘরে ঢুকে পড়ে। একটির হাতে ছোট পিস্তল। কাইয়ুম ভাইকে পিস্তল হাতে ছেলেটি হাত দেখিয়ে বসতে বলে।

“তোমরা কি চাও?” খুব শান্ত স্বরে কাইয়ুম ভাই জিজ্ঞেস করে। ছেলে দুটো ওনার দৃঢ় ও অবিচলিত কন্ঠে একটু ঘাবড়ে যায়। “আপনার ক্যাশ টাকা আছে?” পিস্তল-ছাড়া ছেলেটি বলে।

“আছে,” উত্তর দেন কাইয়ুম ভাই। “কিন্তু তার আগে তোমাদের জিজ্ঞেস করি, তোমাদের কি ধারণা আছে এই শহরে কি হচ্ছে?”

“কি হচ্ছে, মানে?” পিস্তল প্রশ্ন করে।

“তোমরা এতক্ষণ কোথায় ছিলে, আজ সারাদিন?”

“আপনি চুপ করুন, কথা বন্ধ করে বরং টাকাটা বের করুন।”

কাইয়ুম ভাই একটু ইচ্ছাকৃত ভাবেই জোর করে হাসেন। “টাকা? ও টাকা তোমরা নিয়ে যাও, ওতে কোন কাজ হবে না। আমি তোমাদের বলছি টাকাটা কোথায় রেখেছি। কিন্তু তার আগে আমাকে খালি এই প্রশ্নটার উত্তর দাও। তোমরা আজ সারাদিন কোথায় ছিলে?”

পিস্তল-ছাড়া পিস্তলের মুখের দিকে তাকায়, হয়তো ভাবে উত্তরটা দেয়া ঠিক হবে কিনা।

“আমরা আমাদের বাসায় ছিলাম,” পিস্তল বলে। বোঝা গেল পিস্তলই হচ্ছে সর্দার।

“কি করছিলে বাসায়, ঘুমাচ্ছিলে?” জিজ্ঞেস করেন কাইয়ুম ভাই।

ওদের কেউ উত্তর দেয় না। বোঝা গেল তারা ঘুমাচ্ছিল। “তাহলে তোমাদের বাসা এখান থেকে খুব দূরে হবে না। হয়তো তোমরা পাশের বাড়িতেই থাক।”

পিস্তল এবার অধৈর্য হয়ে পড়ে। “এসব ছেড়ে এখন টাকা দেখান।”

“অবশ্যই,” বলেন কাইয়ুম ভাই। তিনি যেন পরিস্থিতিটা খুব উপভোগ করছেন। “কিন্তু তার আগে তোমরা একটু কান পেতে শোন তো সামনের রাস্তা থেকে কোন আওয়াজ আসছে কিনা? চুপ করে শোন।”

কাইয়ুম ভাইএর কথার মধ্যে হয়ত কিছু ছিল, তারা দুজনে বাধ্য ছেলের মত শুনল, “শুনছ কিছু। এরকম সুমসাম নিস্তব্ধতা ঢাকা শহরে কখনো শুনেছ?” কিছুক্ষণ কেউ কথা বলে না। তারপর কাইয়ুম ভাই আবার বলেন, “তোমরা যখন ঘুমাচ্ছিলে, এই শহরে এই পৃথিবীতে একটা ঘটনা শুরু হয়েছে। কি হচ্ছে সেটা বোঝাতে গেলে একটু সময় লাগবে। শুধু এটুকু বলে রাখি তোমাদের জীবন এখন একটা ভীষণ সংকটের মুখে দাঁড়ানো। তোমরা যে কোন মূহুর্তে অদৃশ্য হয়ে যেতে পার।”

এদের দুজনের কাছে হয়তো কথাটা হাস্যকর মনে হয়। কিন্তু শহরের নিস্তব্ধতাকে তার অস্বীকার করতে পারে না। কিছুক্ষণ পরে পিস্তল-ছাড়া বলে, “সে যাই হোক, এখন টাকা কোথায় বলুন।”

কাইয়ুম ভাই বলেন, “টাকা আমার শোবার ঘরে আছে। একটা আলমারি আছে, সেটা খোলা। নিচে ডানদিকে প্রথম ড্রয়ারে কিছু টাকা আছে। কালই ব্যাঙ্ক থেকে তুলেছি। তবে আমি ঐ ঘরে যাব না। আমি তোমাদের ভালর জন্যই বলছি।” পিস্তল-ছাড়া বলে, “বেশী কথা বলবেন না।” এই বলে পিস্তলের মুখের দিকে তাকায়, পিস্তল তাকে ঐ ঘরে যাবার জন্য ইঙ্গিত করে। “কাইয়ুম ভাই, ওকে থামান,” আমি চিৎকার করি। কাইয়ুম ভাই অসহায় ভঙ্গীতে দু হাত তোলেন।

পিস্তল-ছাড়া যুবক শোবার ঘরে ঢোকে। আমি আতঙ্কে দুটো হাত মুঠি করে বসে থাকি। এই ছেলেটিকে শেষ বারের মত হয়তো দেখছি। আলমারির দরজা খোলার শব্দ শুনি। কিন্তু তারপর আর কিছু শোনা যায় না। ড্রয়ার খোলার শব্দের জন্য অপেক্ষা করি।

হেমন্তের শেষ। সূর্যের শেষ আলোটা বাইরে কোথাও ভেসে থাকে, তার বিচ্ছুরিত আলো খুব মৃদু হয়ে ঘরের আসবাবপত্রের ওপর পড়ে। দিনের গরম অদৃশ্য হয়েছে। মোমবাতিটা এখনো জ্বালানো হয় নি। এখনই সব কিছু অন্ধকার হয়ে যাবে।

“কি রে সবুজ, কি হচ্ছে?” পিস্তল বলে। কাইয়ুম ভাই দেখলাম চোখ বুঁজে আছেন। “সবুজ!” চিৎকার করে পিস্তল। কিন্তু কেউ উত্তর দেয় না। অন্ধকার গাঢ় হয়ে ওঠে। আমি বলি, “আমাদের আলো লাগবে। মোমবাতিটা জ্বালাতে দিন।” পিস্তল কথা বলে না, দেখলাম সে বেশ বিচলিত হয়েছে। মোমবাতি জ্বালাতে জ্বালাতে আমি বললাম, “আপনি বোধহয় কিছুই জানেন না। আমাদের বলারও সুযোগ দিলেন না। আমরা সবাই এক ভীষণ বিপদের সম্মুখে আছি। বলতে পারেন মানব জাতি এক বিপদের মধ্যে আছে। এ যাত্রা কেউ পার পাবে বলে আমার মনে হয় না।”

পিস্তল কিছুই বোঝে না। আমি এবার বললাম, “আপনার বন্ধু সবুজকে বোধহয় আর খুঁজে পাবেন না। আপনি নিজেই ও ঘরে যেয়ে দেখুন। আমরা এখানেই থাকব। সাহায্যের জন্য কাউকে ডাকা সম্ভব নয়। এই শহরে আমরা ছাড়া আর কেউ বেঁচে আছে কিনা জানি না।”

পিস্তল হাতে নিয়েই সেই যুবক কিছুটা ঘোরের মধ্যে শোবার ঘরের দিকে যেতে থাকে। আমি বললাম, “মোমবাতিটা নিয়ে যান, কিন্তু ঐ ঘরের ভেতর ঢুকবেন না। ঢুকলে আপনি এই জগত থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবেন।” পিস্তল আমাকে বিশ্বাস করে না, কিন্তু অন্য ঘরে ঢুকতেও সাহস পায় না। দরজার বাইরে থেকে মোমবাতিটা বাড়িয়ে ভেতরে কি আছে দেখার চেষ্টা করে।

কাইয়ুম ভাই পিস্তলের কার্যকলাপ অগ্রাহ্য করে আমাকে বলেন, “অমল, আমাদের জানতে হবে বাইরের জগতে কি হচ্ছে। আমার একটা খুব পুরোনো রেডিও আছে, ব্যাটারিতে কাজ করে। ব্যাটারির শক্তি হয়তো এখনও আছে। কিন্তু ছাদে যেতে হবে, এখানে কোন স্টেশন ধরা যাবে না।” এরপর পিস্তলকে কাইয়ুম ভাই ডাক দেন, “এই যে এদিকে এস, তোমার বন্ধুকে এখন আর পাওয়া যাবে না।” পিস্তল কিছুটা যন্ত্রচালিতর মতই আমাদের দিকে পা ছেঁচড়ে আসে। কাইয়ুম ভাই আবার বলেন, “জীবনে চুরি ও বাটপাড়ি মুখ্য হতে পারে না। জীবনটা খুব ছোট, আজ এটা আরো ছোট হয়ে গেছে। তোমার নাম কি?” “মন্টু,” অস্ফূট কন্ঠে বলে পিস্তল। “শোন মন্টু, তোমার তো মাথায় সেরকম কিছু আছে বলে মনে হয় না। তবুও মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শোন, এই লক্ষ লক্ষ লোকের শহরে হয়তো আমরা ক’জনাই এখন আছি। বাদবাকি লোকের কি হয়েছে আমি বলতে পারব না। তারা উধাও বা অদৃশ্য হয়েছে। এর বেশী কিছু বলা মুশকিল। কিন্তু ধরে নেয়া যায় তারা কোনদিন আর পৃথিবীতে ফিরবে না।”

“কি বলছেন, স্যার!” কাইয়ুম ভাই হঠাৎ স্যার হয়ে গেলেন। “কি বলছেন, আমার বাবা, মা, বোন, এরা তো এই শহরেই আছে। তারা কি বেঁচে নেই স্যার?” কেঁদে ফেলে পিস্তল।

“শোন মন্টু, তারা সব হয়তো বেঁচেই আছে। তুমি যদি বাঁচ তবেই না তাদের সঙ্গে তোমার দেখা হবে। আগে নিজেদের বাঁচাতে হবে। আমাদের হাতে সময় বেশী নেই, কিন্তু তোমাকে একটা নির্দেশ দিই, তোমার বাঁচা এটার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করছে।” অন্ধকারে মোমের আলোয় মন্টুর অশ্রভেজা মুখ দেখে মায়াই হল। একটু আগের ত্রাস এখন কত অসহায়।

“মন্টু, আমরা যতক্ষণ একসাথে থাকব, তুমি, আমি কাইয়ুম আর এই অমল, তুমি এক সেকেন্ডের জন্যও আমাদের দুজনকে চোখের আড়াল করবে না। যদি কর তবে আমরা অদৃশ্য হব। আর আমরা অদৃশ্য হলে তোমাকে দেখে রাখবার কেউ থাকবে না। তুমি বুঝলে ব্যাপারটা?” মন্টু মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।

“কাইয়ুম ভাই, আপনার কাছে হাতুড়ি আছে, ছাদের দরজায় একটা তালা আছে। সেটা ভাঙ্গতে হবে।” আমি বলি।

“হ্যাঁ হাতুড়িটা এখানে কোথায় যেন আছে। আমার চশমাটা লাগবে।” কাইয়ুম ভাই বলেন।

ভুলে গিয়েছিলাম। কাইয়ুম ভাই এখনো কারুর মুখ ঠিক মত দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু চশমা পাওয়াটা অবশ্যই দরকার। মন্টুকে বললাম, “আপনি একটা চশমা পান কিনা দেখুন তো, আমি এর মধ্যে হাতুড়ি খুঁজি। কিন্তু এই ঘরের মধ্যেই খুঁজতে হবে।” মন্টু দেখলাম বলা মাত্রই চশমাটা খুঁজে পেল। খুব ভাল চোখ, হয়তো ডাকাতি করতে করতে কোথায় কি জিনিস আছে সেটা এক নিমিষে দেখে নিতে পারে। আমি কিন্তু বসার ঘরে হাতুড়িটা পেলাম না। কানুকে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলাম। একটা ড্রয়ারে হাতুড়িটা খুঁজে পেলাম। বসার ঘরে ফিরে দেখি কাইয়ুম ভাই চশমা পড়ছেন। আমি তার কাছাকাছি গেলাম। চশমা পড়ে উনি সামনের দিকে তাকালেন, আমার মুখটা ওনার সামনেই ছিল। ওনার চোখ দেখলাম বিস্ফারিত হল। আমি বললাম, “আমি অমল।”

“হ্যাঁ, তুমি অমল। কিন্তু…” কথাটা শেষ করতে পারলেন না। “এখন এটা থাক, ওপরে যেয়ে বলবেন,” আমি বলি। “ঠিক আছে,” বলেন কাইয়ুম ভাই, “দেখ তো, আমার ট্রানজিসটর রেডিওটা পাওয়া যায় কিনা।” বসার ঘরের একটা তাকেই ছিল রেডিওটা। সুইচ টিপলাম, কাজ করল না। “ব্যাটারি লাগবে,” আমি বললাম। “এই টর্চটা থেকে খুলে নাও,” কোথা থেকে যেন একটা টর্চ কাইয়ুম ভাইএর হাতে এসেছিল। আমি টর্চ খুলে ব্যাটারি বের করে রেডিওওতে ভরে নিই। রেডিওটা মন্টুর হাতে দিই।

দরজা খুলে সিঁড়ির মুখে দাঁড়াই। অন্ধকার হয়ে এসেছে। আমি কানুকে পাশে নিয়ে প্রথমে উঠি। আমার পেছনে মোমবাতি হাতে কাইয়ুম ভাই, তার পেছনে মন্টু। ওপরের দরজার তালায় হাতুড়ি দিয়ে দুটো বাড়ি মারতেই সেটা ভেঙ্গে যায়।

অষ্টম অধ্যায়

আমরা সবাই ছাদে উঠে আসি। হেমন্ত হলেও শেষ বর্ষার কিছু কালো মেঘ দূরে দিগন্তে ভেসে থাকে, একটা উদাস করা হাল্কা গোলাপি আভা পশ্চিম দিগন্তে জুড়ে বিদ্যমান। পূব দিকে পূর্ণিমার বড় চাঁদ উঠছে। কিন্তু আর কোনদিকে কোন আলো নেই। শব্দও নেই। এক সীমাহীন নিস্তব্ধতা গতকালের কোলাহলে ভরা শহরকে ঢেকে রাখে, সেই কোলাহল অসহনীয় ছিল, কিন্তু আজ সব কিছুর বিনিময়ে সেই কোলাহল ফিরে পেতে দ্বিধা করব না। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি কিছু শব্দ শুনতে পাই। ঝিঁ ঝিঁর শব্দ, ব্যাং ডাকছে কোথায় যেন। ব্যাং? এই শহরে ব্যাং আর থাকার কথা নয়।

কাইয়ুম ভাই মন্টুর হাত থেকে রেডিওটা নিয়ে ছাদের মেঝেতে রাখেন। এফ এম কোন স্টেশনই পাওয়া যায় না। বিবিসি, ভয়েস অফ আমেরিকা বহু বছর হয় তাদের সর্ট ওয়েভ প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে। তবুও কেন জানি মনে হল একবার চেষ্টা করতে দোষ কি। বললাম, “১৩ মিটারে চেষ্টা করবেন।” কাইয়ুম ভাই বললেন, “তুমি দেখ।”

আমি ডায়ালটা নাড়ালাম। ১৩ মিটারে সব প্রচার কত বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে। আমি নিজে শুনি নি, তবে বাবা বলতেন তাঁরা ছোটবেলায় এই তরঙ্গে পৃথিবীকে শুনতেন। যান্ত্রিক আওয়াজ আসে, আমি রেডিওর এন্টেনাটা টেনে লম্বা করে দিই। হঠাৎ একটি পুরুষ কন্ঠে কিছু কথা ভেসে আসে। ইংরেজীতে – “এটা বিবিসি ওয়ার্ল্ড। আমরা এই চ্যানেলে পুনরায় প্রচার করছি।” স্টেশনটা কিছুক্ষণ নীরব থাকে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি। আবার কন্ঠটি ভেসে আসে, “বিবিসি ওয়ার্ল্ড। আমরা এই চ্যানেলে পুনরায় প্রচার করছি। মানব জাতি চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীণ।”

বেঁচে আছে। কিছু লোক এখনো আছে এই পৃথিবীতে। বিবিসি এই চ্যানালে আবার প্রচার করছে। নিঃসন্দেহে পৃথিবীর এই সঙ্কটে তাদের কিছু বলার আছে। “লন্ডন থেকে বলছি,” আবার ভেসে আসে সেই কন্ঠস্বর, “যারা এটা শুনতে পাচ্ছেন তাঁরা ইতিমধ্যে জানেন পর্যবেক্ষণের মূল্য। সচেতন ভাবে যারা পর্যবেক্ষিত হবেন তাঁরা অদৃশ্য হবেন না। ভিডিও ক্যামেরা, সিকিউরিটি ক্যামারা, ক্যামকর্ডার ইত্যাদি মাধ্যমে যারা রেকর্ড হবেন তাঁরাও অদৃশ্য হবেন না। গতকাল যে বিজ্ঞানীদের সাথে আমরা যোগাযোগ করতে পেরেছি তাঁরা এই সম্পর্কে মোটামুটি একমত হয়েছেন। অধ্যাপক টিমথি রিনকফের মতে একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গ প্রবাহ পৃথিবীর কক্ষপথ অতিক্রম করছে। যে সমস্ত জায়গায় প্রথম অদৃশ্য হবার ঘটনা ঘটেছে সেগুলিকে অবলম্বন করে অধ্যাপক রিনকফ সেই তরঙ্গের সঙ্গে পৃথিবীর বিক্রিয়ার একটি সমচ্ছেদ মানচিত্র তৈরি করেছেন। কিন্তু তিনি বলতে পারছেন না সেই তরঙ্গের শুধুমাত্র তড়িৎ-চুম্বকীয় বৈশিষ্ট্য আছে কিনা। অবশ্য এই প্রসঙ্গে আমরা পৃথিবীর অন্যান্য মানুষদের কাছ থেকে কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি। চিলি থেকে আমাদের সাংবাদিক রেচেল লাগুনা বলছেন একটি হাসপাতালের চারশো রুগী উধাও হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে নওশাদ নামে একজন রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। আমরা ওনার পুরো নাম জানি না। নওশাদের মতে পৃথিবীর বুকে এইরকম ঘটনা আগেও ঘটেছে, কিন্তু সেগুলো ছিল সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তাদের স্থায়িত্ব কাল খুব বেশীক্ষণ ছিল না।”

নওশাদের কথা শুনে আমি চমকিত হই। নওশাদ তাহলে বেঁচে আছে। “কাইয়ুম ভাই, এ আমার বন্ধু, আজ খুব ভোরেই আমার কাছে এসেছিল,” আমি বলি। কাইয়ুম ভাই হাত উঁচু করে আমাকে কথা বলতে বারণ করেন।

“নওশাদ ১৯৩০ সনে ভারতে একটি ট্রেনে ও ১৯৫৪ সনে আটলান্টিকের ওপর একটি বিমানের যাত্রীদের নিখোঁজ হবার ঘটনাকে বর্তমান ঘটনাবলীর সাথে যুক্ত করেছেন। নওশাদের রিপোর্টেই বলতে গেলে প্রথম পর্যবেক্ষণের কথাটা বলা হয়, অর্থাৎ কেউ যদি পর্যবেক্ষিত অবস্থায় থাকে তবে তার অদৃশ্য হবার সম্ভাবনা কম। উনি কোন এক অদৃশ্য তরঙ্গের সঙ্গে মানুষের স্বজ্ঞার বিক্রিয়ার কথাও বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই ঢাকার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে যায়। বর্তমানে পৃথিবীর কোন বড় শহরের সাথেই আমাদের যোগাযোগ নেই।”

ঘোষক আবার চুপ হয়ে যান। নওশাদ কি তাহলে শেষ রক্ষা করতে পারে নি? চাঁদের আলোয় অন্ধকার শহর ভূতুড়ে হয়ে ওঠে। এটা কি সম্ভব? কোটি কোটি লোক উধাও হয়ে যাবে। কেন জানি ভাবি, মহামারী থেকে মারাত্মক, কিন্তু মহামারীর মত ভয়াবহ নয়। ভয় বা দুঃখ কোনটাই যেন আমাকে ছোঁয় না। আমরা তিনজন ছাদে চুপ করে বসে থাকি। কাকাদের সাথে এর যোগাযোগ হল না, নমিতাদের সাথেও। ওরা কি আর আছে? আমিই বা আর কতক্ষণ থাকব?

“এটা বিবিসি ওয়ার্ল্ড। আমরা এই চ্যানেলে পুনরায় প্রচার করছি,” রেডিও আবার জেগে ওঠে, “পৃথিবী থেকে মানুষ দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। অদৃশ্য না হবার যে সমস্ত উপায় জানা গেছে সেটা হল ১. নিজেকে অন্যদের দিয়ে পর্যবেক্ষিত করা, ২. নিজেকে ক্রমাগত ভিডিও রেকর্ড করা, অথবা ৩. সচেতন ভাবে নিজের অস্তিত্বের কথা ভাবা। আপনারা যেহেতু এই প্রোগ্রামটা শুনছেন আমি ধরে নিচ্ছি কোন না কোন ভাবে আপনার ইতিমধ্যে এই তিনটির অন্ততঃ একটি উপায় ব্যবহার করেছেন।”

ঘোষক আবার কিছুক্ষণ সময় নেন। তারপর বলেন, “ইতিমধ্যে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বিজ্ঞানীদের মতামত একটা জরুরী সর্ট-ওয়েভ স্টেশনের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। আপনাদের খুব শীঘ্রই এই স্টেশনের নম্বরটা দেব। এই বিজ্ঞানীদের মতে একটি অদৃশ্য তরঙ্গ, যার প্রকৃতি আমাদের চেনা কোন বল বা ক্ষেত্রের প্রকৃতির মত নয়, মানুষের মস্তিষ্কের সাথে বিক্রিয়া করছে। এই তরঙ্গের সৃষ্টি কৃত্রিম হতে পারে, অর্থাৎ পৃথিবীরই কোন মানুষ এটা সৃষ্টি করতে পারে। তবে সেটার জন্য যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হবে তা একক ভাবে কেউ জোগাড় করতে পারবে না। এদিকে একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ফানিস লুকাসোপলাস নিতান্তই কাল্পনিক সম্ভাবনার কথা ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে মহাবিশ্ব সৃষ্টির ঠিক আগে, বিগ ব্যাং হবার আগের মুহূর্তে মহাবিশ্বের বস্তুসমূহ এমন ভাবে একে অপরের সান্নিধ্যে ছিল যে তারা একটি সুবিশাল মস্তিষ্ক তৈরি করেছিল। বিগ ব্যাং-এ সেই মস্তিষ্ক ধবংস হয়ে গেলেও মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রান্ডের মত একটি স্বজ্ঞা তরঙ্গ মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। কোয়ান্টাম জগতের বিভিন্ন অবোধ্য ঘটনা এই স্বজ্ঞা তরঙ্গ দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। লুকাসোপলাস নিজেও অবশ্য এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন। কিন্তু তিনি বলছেন, নিতান্তঃ ছক-কাটা ধারণার বাইরে চিন্তা না করতে পারলে এই সমস্যার সমাধান হবে না।”

আমি আকাশের দিকে তাকাই। পুরোপুরি অন্ধকার হয় নি এখনো। একটা নীলচে কালো, হাল্কা অথচ মহাশূন্যের শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত, রঙ পৃথিবীকে ঘিরে রাখে। আমার চোখ অদৃশ্য তরঙ্গ দেখতে পায় না। আমার চোখ শুধুমাত্র পৃথিবীর দৃশ্যমান সৌন্দর্য দেখতে পায়। আজ সেই সৌন্দর্যের পেছনের ভয়াবহতা চোখে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু মন তাতে শিহরিত হয়ে থাকে।

বিবিসির ধ্বনি ধীরে ধীরে অন্তর্হিত হয়ে যায়। তাই হবার কথা। ধীরে ধীরে সব ধ্বনি যেন হারিয়ে যায়। আকাশে তারারা ফুটে ওঠে। ঢাকার আকাশ এমন উজ্জ্বল আগে কখনো দেখি নি। পশ্চিম আকাশে জ্বলতে থাকে অভিজিত, রোহিণী, শ্রবণা, দেনেব। যতক্ষণ চাঁদ মাথার ওপর উঠে আসে ততক্ষণে সেই তারাগুলো ডুবে গেছে। হলদে লাল শনি দেখা দেয় পূব আকাশে। মন্টুকে কয়েক ঘন্টা আগেও চিনতাম না, মন্টু ডাকাতি করতে আমাদের বাসায় ঢুকেছিল, কিন্তু এখন – আকাশ ভেঙ্গে পড়ার আগে – তাতে কিছু এসে যায় না। আমরা তিনজন পিঠে পিঠ লাগিয়ে নিশ্চুপ বসে থাকি। কানুও যেন বুঝতে পারে ঘটনার ভয়াবহতা, সে সামনের পায়ে মুখ রেখে শুয়ে থাকে আমাদের পাশে। হেমন্তের রাত নাতিশীতোষ্ণ থাকে। পাশের বাড়ির লাগোয়া দেয়ালে একটা আম গাছ শত অগোছাল বাড়ি নির্মাণের মধ্যেও কেমন করে যেন বেঁচে ছিল, এখন তার ডালে বসা কাকগুলো হঠাৎ ডাকতে শুরু করে। সেই সাথে মনে হয় ঝিঁ ঝিঁ আর ব্যাঙ্গের ডাক থেমে যায়। কাকগুলোও পরিশ্রান্ত হয়ে থেমে যায়। আকাশে, বহুদূরে, একটা কৃত্রিম উপগ্রহ ভেসে যায়, সূর্যের আলোর প্রতিফলনে সেটা ঝলসে ওঠে। তার শান্ত সমাহিত গতিতে পৃথিবীর আতঙ্ক ধরা পড়ে না। আমরা তিনজন মানুষ আর একটি কুকুর মহাকালের শেষ পর্বের জন্য যেন অপেক্ষা করি।

আরো ঘন্টা খানেক পরে, চাঁদ তখন হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে, মঙ্গল উঠেছে পূবে, একটা নীল আলো আমাদের ওপর দিয়ে দ্রুত উত্তরে চলে যায়, নিঃশব্দে। খুব বেশী ওপরে ছিল না সেটা। আলোটা কিসের সঙ্গে যুক্ত ছিল তা বুঝতে পারি না। আমরা লাফ দিয়ে উঠে উত্তরের পাঁচিলের দিকে যাই। আলোটা ততক্ষণে মিলিয়ে গেছে। কিন্তু বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। এবার বহু উঁচুতে একটা নীল আলোর বিন্দুর ঝাঁক দেখা যায়। অনেক গুলো বিন্দু, একশোর ওপর হয়তো হবে। ধীরে ধীরে তারা উত্তরের দিগন্তে মিলিয়ে যায়। পৃথিবীর বুদ্ধিমান মানুষেরা কি তাহলে এই বিভীষিকার হাত থেকে বাঁচার উপায় খুঁজে পেয়েছে? ঐ নীল রঙ্গা বিন্দুগুলো কি যুদ্ধের বিমান? নাকি এই অদৃশ্য মারণাস্ত্র ঠেকানোর জন্য কোন নতুন এক্সপেরিমেন্ট? কি হতে পারে সেটা? আমরা একে অপরের দিকে তাকাই। কিন্তু আমাদের কথা বলার শক্তি যেন ছিল না। আমরা যেন বুঝতে পেরেছিলাম মানুষের তৈরি কোন কিছুই আজ আমাদের এই সঙ্কট থেকে উদ্ধার করতে পারবে না।

চাঁদ ডুবে গেলে অন্ধকার জাঁকিয়ে বসে। ভোরের আগে কিছুক্ষণের জন্য হাল্কা শীত নামে। পূবে আলো প্রায় ফুটছে এই সময় একটা শব্দ ভেসে আসে উত্তর থেকে। রাস্তার ওপর একটা ভারী জিনিসের শব্দ – ধীরে ধীরে শব্দটা জোরাল হয়। পাথরের পা দিয়ে হাঁটছে কেউ, থম, থম, থম। তারপর মনে হয় শব্দটা যেন আমাদের রাস্তায় হচ্ছে। সেই হাঁটায় আমাদের বাড়ি কাঁপে। আমরা দেয়ালের ওপর দিয়ে দেখার চেষ্টা করি, মাঝের বাড়িগুলোর জন্য কিছু দেখা যায় না। শব্দটা আরো জোরাল হয়ে ওঠে হাঁটার ছন্দে, কিন্তু পৃথিবীতে মানুষের হাঁটার শব্দ এরকম হয় না। আমি বলি, “আমাদের নিচে যেতে হবে। এই ছাদে আমরা একেবারেই নিরাপদ নই” আমার কথায় সবাই সায় দেয়, আমরা নিচে নেমে আসি। সিদ্ধান্ত হয় কাইয়ুম ভাইএর ফ্ল্যাটে ঢোকার। ততক্ষণে শব্দটা আমাদের বাড়ির সামনে এসে গেছে। আমরা দরজা বন্ধ করে বাইরের ঘরে সোফায় বসি।

নবম অধ্যায়

আমাদের বাড়ির সামনে এসে শব্দটা থেমে যায়। এত বাড়ি আছে, এখানেই থামল? এমন যেন যে শব্দ করছে সে বা সেটা জানে আমরা এখানে আছি। তাহলে আসলেই এই পাড়ায় আর কেউ নেই? নিচে গ্রীলের দরজা খোলার শব্দ শুনি। তারপর প্রায় মিনিট খানেক সব নিস্তব্ধ থাকে। ইতিমধ্যে আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। পাশের আমগাছে কাকেরা আবার হল্লা করে। তারপর সিঁড়িতে কারুর ওঠার শব্দ শোনা যায় – একটা ভারী যান্ত্রিক শব্দ। কিন্তু রাস্তার মত অত জোর শব্দ হয় না। আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকি। খুব ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে কেউ উঠছে। কি হতে পারে সেটা? এই ভয়াবহ সময়ে সেটা অবিচলিত ভাবে শহরের বুকে ভ্রমণ করছে, সেটাই কি মানুষের এই পরিণতির জন্য দায়ী। আমি কিছু ভাবতে পারি না। শব্দটা অন্য কোন তলায় না থেমে আমাদের তলায় উঠে আসে সরাসরি। সে কেমন করে জানে কোথায় আসতে হবে? কানু ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। ছুটে যায় দরজার কাছে। তারপর কি যেন হয়, মাথা নুইয়ে কুঁই কুঁই করে আমার পায়ের কাছে এসে বসে পড়ে।

আমাদের দরজার সামনে আছে সে। অপেক্ষা করছে। যারা অদৃশ্য না হবার উপায় বার করেছে তাদের কি ভাবে অদৃশ্য করা যায়, বা পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া যায় তাই ভাবতেই বোধহয় এই ব্যবস্থা। দরজা সামান্য একটা তালা দিয়ে বন্ধ, সে কি দরজা ভেঙ্গে ফেলবে? মন্টু ভয়ে কাঁপে, আমি চেষ্টা করি আমার ভীতি ঢাকতে। ভাবি শেষটা আর কতই বা খারাপ হবে। আমার প্রিয়জনরা ইতিমধ্যে বিদায় নিয়েছে, আমারও সময় এখন শেষ হয়ে আসছে। তবুও, যাবার আগে, মানুষের যবনিকা নাটকের রহস্যের সমাধান কি তা জানতে আমি উদ্গ্রীব থাকি। তাই দরজার বাইরে যা আছে, তা আমাদের জীবনের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করলেও সেটা দেখতে চাই। কি হতে পারে সেটা? কিন্তু সে বা সেটা যেন আমার মনের কথা জানতে পেরেই অনেক সময় নেয়। আমার মনে হয় অন্ততঃ আধ ঘন্টা যেন কেটে গেল। ইতিমধ্যে আমরা একটি শব্দও উচ্চারণ করি না।

বাইরে সকাল পুরোদমে শুরু হয়ে যায়। কিন্তু শহর মানুষের কোলাহল বর্জিত থাকে। আমি দেখি কাইয়ুম ভাই অপেক্ষা করে এত ভয়ের মধ্যেও ঘুমে ঢুলে পড়ছেন, মন্টুর অবস্থাও ভাল না, আমরা সারা রাত ঘুমাই নি। এই সময়টা বিপজ্জনক। আমি চেষ্টা করি সচেতন থাকতে। আর কয়েকটা মিনিট। নিশ্চয় দরজার বাইরে যা দাঁড়িয়ে আছে সে সারাদিন অপেক্ষা করবে না। মনে হয় এক কাপ কফি হলে খারাপ হত না। কিন্তু লাইনে গ্যাস আছে কিনা সন্দেহ, স্টোভ জ্বলবে না। হঠাৎ মনে হয় কফি টেবিলটা কাঁপছে, একটা মৃদু চোখে প্রায় ধরা পড়ে না এমন কম্পন, কাইয়ুম ভাইএর দিকে তাকাই। মনে হল ওনার শরীর একটা তরঙ্গের মত ওঠা নামা করছে। কিন্তু আমার মনের এক কোণ থেকে কে যেন বলে, “অমল জেগে ওঠ, ঘুমিয়ে পড় না এখন।” আমি চোখ খুলে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। ঘুমিয়ে পড়ছিলাম আমি, আর আমরা সবাই বোধহয় অদৃশ্য হবার পথে যাত্রা করেছিলাম। কাইয়ুম ভাই জেগে ওঠেন।

তখনই একটা যান্ত্রিক ঘূর্ণনের শব্দ শুনি। একটা যন্ত্র বা লেজার জাতীয় জিনিস দরজার তালাটাকে প্রায় নিঃশব্দে দরজা থেকে আলাদা করে দিল। তালাটা নিচে সশব্দে পড়ে গেল। দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে যেতে লাগল। আমাদের আর করার কিছু ছিল না। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম আমরা এমন একটা শক্তির সম্মুখীণ যার বিপক্ষে আমরা অসহায়। পূব থেকে সূর্যের আলো সরাসরি দরজার ওপর পড়ে। ধীরে ধীরে দরজাটা স্বয়ংক্রিয় ভাবে যেন খুলতে থাকে, আস্তে আস্তে – যেন সেটা কোন যন্ত্রের সাথে যুক্ত। দরজাটা খুলছিল সহজ অনাবিল শ্লথ গতিতে, মনে হল পুরোপুরি খুলতে যেন এক যুগ অপেক্ষা করতে হবে। আমার হৃদযন্ত্র মনে হয় এখনই ফেটে যাবে। ঢোঁক গিলতে চাই, পারি না।

কিন্তু দরজাটা পুরো খুলে গেলে যা দেখি তাতে হৃদযন্ত্র থেমে যায় না, বরং হঠাৎ করেই খুব সাধারণ ছন্দে নেমে আসে। আমরা তাকে দেখতে পাই। একটি মেয়ে। নারী বলাই সঙ্গত। আমি তার বয়স প্রথমে ধরতে পারি না, পঁচিশ থেকে পঞ্চাশ? তার জাতীয়তা ধরতে পারি না, দেশী, বিদেশী কোন কিছুই যেন মিল খায় না। সূর্যের আলো তার মুখকে যেন দ্বিখণ্ডিত করে রাখে।

কানু মুখ তুলে তার দিকে তাকায়, কিন্তু টুঁ শব্দটি করে না। মুখ নামিয়ে নেয়।

সে পড়ে ছিল লাল জামা, কালো প্যান্ট। আমাদের দিকে তাকায় সে, তার হাত খালি ছিল, কি দিয়ে তাহলে সে দরজার তালাটা খুলল? আস্তে আস্তে ঘরে ঢোকে সে। আমরা বিস্ময়ে হতবাক ছিলাম। কিন্তু সে শুধু একবার আমাদের দিকে তাকিয়ে সোফার পাশ দিয়ে হেঁটে খোলা জানলার কাছে যায়, সূর্যর দিকে যেন তাকায়। তার দীর্ঘ ছ-ফুটের ওপর লম্বা দেহের হাঁটায় কোন দ্বিধা বা অসামঞ্জস্যতা ছিল না। তার মুখ ও ত্বকের কোন বর্ণনা দিতে পারব না, এমন যেন কেউ যেন আমার মস্তিষ্কের সেটা বিচার করার ক্ষমতাটা নিয়ে নিয়েছে। আমি বলতে পারব না তারপর কত সময় কাটল। মনে হল আমরা কোন সম্মোহণ ক্ষেত্রে বসে আছি যেখানে সময় সম্পর্কে সব ধারণা বিলুপ্ত হয়েছে। জানালার কাছে গিয়ে সে বাইরের রাস্তা দেখে আমাদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে।

তারপর অনেক সময় পরে, সূর্যের দিকে তাকিয়ে, সে বলে উঠে, “মহাবিশ্বের সৃষ্টির সাথে সাথে আলোক কণিকার সৃষ্টি হয়। ভরহীন এই কণিকার আমাদের জন্য কোন দায়িত্ব ছিল না। প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে সম্পণ্ন করতে সেই কণিকা যেমন সাহায্য করত, সে নিজে সৃষ্টি হত সেই প্রক্রিয়ায়। আলো বলতে সেই মহাবিশ্বে কিছু ছিল না। যতক্ষণ না মহাবিশ্বে স্বজ্ঞাসম্পণ্ন প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে ততদিন সেই ফোটোন কণিকার আলো সৃষ্টির কোন দায়িত্ব ছিল না।”

তার বাংলা ছিল পরিষ্কার, তাতে কোন টান ছিল না। আমরা আশ্চর্য হয়ে তার কথা শুনি। কিন্তু এই কথাগুলোর অর্থ কি?

“সেই আলোহীন মহাবিশ্বে সুপারনোভা বিস্ফোরিত হত এক দৃশ্যহীন ভাবে, নক্ষত্রের জন্ম ও মৃত্যুকে দেখবার কেউ ছিল না, কিন্তু ‘দেখা’ বলতেও কিছু ছিল না। আমি বলব না সেটা ছিল একটা অন্ধকার জগত, কারণ অন্ধকারকে বর্ণনা করতে আলোর প্রয়োজন। যতদিন না মহাবিশ্বে স্বজ্ঞার সৃষ্টি হয়েছে যে স্বজ্ঞা শব্দ, গন্ধ, স্পর্ষ, আলো, স্বাদ, বিষাদ, উৎফুল্লতা সৃষ্টি করতে পারে ততদিন মহাবিশ্বের রূপ হয়ত শুধুমাত্র গাণিতিক সমীকরণের মাধ্যমেই প্রকাশ করা সম্ভব।“

আমি চেষ্টা করি তার কথা বুঝতে। আমি মহাকালের এক সন্ধিক্ষণের সাক্ষী, কিন্তু সেই সাক্ষ্যের ভাষা বুঝতে আমার অসুবিধা হয়। তার পিঠ লম্বা কালো চুলে ঢাকা ছিল।

“কিন্তু অন্যান্য সব জগতের মত আমরা উদ্ভূত হয়েছিলাম কোটি কোটি বছর ধরে, সরল আদিম প্রাণ থেকে জটিল অনুভূতিতে। রক্তমাংসের মাঝে বিদ্যুৎ সঞ্চালনে সৃষ্টি হয়েছিল স্বজ্ঞার। কিন্তু তাতে আমাদের তৃপ্তি হল না। আমরা চাইলাম অমর হতে। আমাদের নরম নাজুক দেহকে আমরা বদলে দিতে চাইলাম। আমরা পরীক্ষা করলাম ইস্পাতের পা, ইস্পাতের হাত। ধাতব অঙ্গ। নানাবিধ পলিমার। কিন্তু মস্তিষ্ককে আমরা বহুদিন ছুইঁ নি। অবশেষে আমরা মস্তিষ্ককে বদলাতে চাইলাম। প্রথমে আমরা তাকে বিস্তৃত করলাম, আমাদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটল। ধীরে ধীরে সেই বিস্তৃত মস্তিষ্কে আমরা বসালাম ছোট বৈদ্যুতিক অংশ। সেই অংশগুলোর মাঝে কোন বোধ ছিল না। কিন্তু হাজার হাজার বছরের বিকাশে তারা আমাদের মস্তিষ্কের স্থায়ী অংশ হল। এমন সময় আসল যখন আমাদের দীর্ঘ জীবনের জন্য সেই যান্ত্রিক মস্তিষ্ক বেছে নিতে হল। সেই মস্তিষ্ক ততদিনে স্বজ্ঞার অধিকারী হয়েছে। সেই মস্তিষ্ক স্বাদ, গন্ধ, স্পর্শ, বর্ণ অনুভব করতে পারে। সেই মস্তিষ্ক ব্যথার তীব্রতা অনুভব করতে পারে। আমরা রোবট হয়ে গেলাম, আগে ছিলাম জৈবিক রোবট, তারপর হলাম অজৈবিক রোবট। ছিলাম রক্তমাংসের রোবট, হলাম যান্ত্রিক রোবট। এটা ছিল একটা ইচ্ছাকৃত পরিণতি। স্বজ্ঞাসহ রোবট। সেই যন্ত্র যে ধাতব ছিল এমন নয়, যখন যে প্রকৌশল আমরা সৃষ্টি করেছি তাই আমরা ব্যবহার করছি। হাজার হাজার বছর ধরে দীর্ঘজীবনের জন্য যখন যে পদ্ধতি প্রয়োজন আমরা তাই ব্যবহার করেছি। কিন্তু পৃথিবীর জৈবিক প্রাণী থেকে আমরা ভিন্ন ছিলাম না। কারণ স্বজ্ঞাই শেষ পর্যন্ত উচ্চতর প্রাণের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয়।”

আমাদের কোন ধারণাই ছিল না সেই নারী কি বলতে চাইছে। সে কি পৃথিবীর নয়? সেই কি রাতের সেই নীল আলোর বিন্দুতে পৃথিবীতে এসেছে?

“বহু হাজার বছর ধরে আমরা এইরকম ছিলাম। অজেয় ও অমর। সেখানে মৃত্যু ছিল না। প্রতিটি মস্তিষ্কের প্রতিলিপি প্রতি সপ্তাহে করে রাখা হত। কেউ দুর্ঘটনায় মারা গেলে, নতুন দেহে সেই প্রতিলিপিকে জুড়ে দেয়া হত। হত্যা বলে কিছু ছিল না, কারণ মৃতকে গচ্ছিত স্বজ্ঞা থেকে পুনর্গঠন করা যেত। শুধুমাত্র তারাই, যারা স্বেচ্ছা মৃত্যুকে বেছে নিত, তাদের আমরা ছেড়ে দিতাম। তারা তাদের স্মৃতি ও স্বজ্ঞা বিলোপ করে চিরতরে নিজেদের মুছে দিত। নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি ও তার সাথে আত্মিক বোধের বিকাশ সেটাও আমরা যথাযথ ভাবেই করেছিলাম, তার বিস্তারিত বর্ণনা দেবার সময় এখন নেই। শুধু বলব আমাদের সমাজে স্বাধীন চিন্তা ও ইচ্ছার মূল্য ছিল।”

তার জামার রংটা লাল ছিল। যে সমস্ত ঘটনা প্রবাহ তাকে এই ঘরে নিয়ে এসেছে তাতে কোন সন্দেহ ছিল না সে যা বলছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু আমি যদি বুঝতে পারতাম সে কি বলতে চাইছে। সূর্য আরো গাঢ় সাদা হয়ে উঠল উষ্ণতায়, কিন্তু তার শক্তিশালী ফোটনগুলো সেই নারীর ত্বক স্পর্শ করল না। সে একবার ঘুরেও তাকাল না। এমন যেন তার একটা কথা আমাদের বলার ছিল। যত তাড়াতাড়ি পারে সে সেটা বলতে চায়। সে জানত আমাদের সবার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে।

“এরকম ভাবে কত বছর গেল বলতে পারব না। আমরা আমাদের গ্রহের বাইরে অভিযানে বের হলাম। নিকটবর্তী গ্রহগুলো আমরা দেখলাম। সময় নিয়ে যখন আমাদের চিন্তা ছিল না, তাই মহাশূন্যের দীর্ঘ যাত্রাকে আমরা মেনে নিয়েছিলাম। আমরা মহাশূন্যের চরম শূন্যতায়ও চরম নিম্ন তাপমাত্রায় বাঁচতে পারতাম। হাজার হলেও জৈবিক থেকে যান্ত্রিক সত্তায় রূপান্তরণের কিছু সুবিধা আছে। আমরা কাছের নক্ষত্রগুলোয় গেলাম। কিন্তু কোথাও জীবনের সাক্ষাৎ পেলাম না। এমন না যে আমরা মহাবিশ্বে জীবন খুজঁছিলাম। আমরা জ্ঞান ও চিরায়ত এডভেঞ্চারের তাগিদেই সেই অভিযাত্রায় বের হয়েছিলাম। এর মধ্যে আমাদের সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছিল, কিন্তু ইতিহাসের স্রোতকে ততদিনে আমরা ভুলে গিয়েছিলাম।

“আমাদের দেহ ও মস্তিষ্ক যান্ত্রিক হলেও সেগুলো স্বয়ংক্রিয় ভাবে নিজেদের সারাতে পারত। মস্তিষ্ক এমন ভাবেই গঠিত ছিল যাতে সে নিজেকে ক্রমাগত পরিবর্তন করতে পারত। প্রথম থেকেই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম প্রাকৃতিক বিবর্তনে যে নতুন প্রজন্ম আসে তারা নতুন চিন্তা, নতুন সৃজনশীলতা নিয়ে আসে। আমরা চেষ্টা করেছিলাম আমাদের মস্তিষ্ক যেন সেভাবেই নিজেকে নতুন করে তুলতে পারে। অমর হবার পথে আমরা চেষ্টা করেছিলাম প্রকৃতির খামখেয়ালীপনাকে পুরোপুরি আয়ত্তে এনে পরিবেশের প্রতিটি প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করা। এতে আদিতে আমাদের সভ্যতার খুব বিকাশ হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা তাদের দীর্ঘজীবনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আরো দক্ষ যন্ত্র তৈরি করল যা কিনা আমাদের দেহের ও মস্তিষ্কের অঙ্গ হল। কিন্তু যত দিন গেল, আমাদের মস্তিষ্ক স্মৃতির ভারে ঝুঁকে পড়ল। যে সমস্ত সৃজনশীলতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হবার কথা সেগুলো সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও তাদের কাজে লাগানো গেল না। এরকম ভাবে কয়েক শো বছর গেল, কিন্তু আমরা বুঝতে পারলাম সভ্যতার অবক্ষয়। এর মধ্যে সিদ্ধান্ত হল আমাদের প্রৌঢ়রা স্বেচ্ছা অবসর নেবেন, অর্থাৎ তাদের চেতনাকে মস্তিষ্ক ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রাখা হবে। সেই চেতনাকে কয়েক হাজার বছর পর হয়তো আবার জাগরিত করা হবে। ইতিমধ্যে আমরা আমাদের মূল খুঁজতে চাইলাম। আমরা কি ধরণের জৈবিক পদার্থ থেকে উদ্ভূত হয়েছিলাম? কয়েক হাজার বছরের ব্যবধানে, সমাজনীতির নানা পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে পুরোনো ইতিহাসকে হারিয়ে ফেলেছিলাম।”

এরপর অনেকক্ষণ সে চুপ করে থাকে। এর পরের কথাগুলো কি হবে তাই হয়তো সে ভাবছিল। মানুষের ভাষা আয়ত্ত করে তাকে গুছিয়ে বলার প্রকৌশল ও স্বজ্ঞা তার মাঝে পুরোপুরিই ছিল। তারপর আমাদের দীর্ঘ উচ্চতার অনাহুত অতিথি ঘুড়ে দাঁড়াল। আমরা এতক্ষণ যেন একটা নির্দিষ্ট অশরীরী উৎসের ভাষায় অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। এইবার চমকে উঠলাম। তার চোখ ছিল উজ্জ্বল কালো, কালো ভুরু চোখের অগভীর কোটরকে এক দিকে আগলে রেখেছিল, তীক্ষ্ণ থুতনী এক ধরণের দৃঢ়তা প্রকাশ করছিল। সেই মুখে কোন যান্ত্রিকতা ছিল না। লাল জামাটা তার উন্নত বক্ষ ঢেকে ছিল, জামার কলার থুতনী পর্যন্ত ওঠানো ছিল। সে জানলা ছেড়ে নড়ল না, যেন সে জানত সে নড়লে তার গতি আমাদের মনে কতখানি ভীতির সঞ্চার করবে। একটা কালো প্যান্ট শেষ হয়েছিল কালো জুতোয়। সেই ভীতিকর পরিস্থিতিতেও আমি তার ফ্যাশন বোধকে বাহবা না দিয়ে পারলাম না। আমি আগেই বলেছি তার রংকে আমি বর্ণনা করতে পারব না। কিন্তু একটু ভাল করে দেখলে তার ত্বকে একটা ধাতব গুণ ছিল।

আমরা সম্মোহিতের মত বসে ছিলাম। তার মাথার পেছনে সূর্যের ছটা তাকে একটা দৈবিক রূপ দিয়েছিল। এবার সে যখন কথা বলল আমরা দেখলাম তার মুখ কেমন করে খোলে। তার ঠোঁট কাঁপছিল, নিঃসন্দেহে সেই পুরু ঠোঁট ধাতব ছিল না। ধাতব হতে হবে না, পলিমার হবে। আমি জানি না। এই দৃশ্যের কি কোন বাস্তবতা আছে? এই নারী কি সত্যিই আমাদের ঘরে আছে? কিন্তু উঠে গিয়ে তাকে হাত দিয়ে ধরে বাস্তবতা বিচার করার সাহস আমার ছিল না।

সে বলতে থাকল, “পুরোনো অনেক তথ্য আমাদের মাথার মধ্যেই থাকার কথা ছিল, কিন্তু আমাদের অজৈবিক মস্তিষ্কের বিবর্তনের ধারণাটা ছিল ভিন্ন। ধীরে ধীরে সেই মস্তিষ্ক কখন জৈব সব স্মৃতি বিসর্জন দিয়েছিল আমরা নিজেরাই বুঝি নি। সেটা ছিল যান্ত্রিক বিবর্তনের একটা ধাপ। অবশেষে যখন সেটা আমরা বুঝলাম তখন দেরি হয়ে গেছে। আমাদের বাঁচার একমাত্র উপায় হল আবার পুরোনো পথে ফিরে যাওয়া। কিন্তু এখন আমাদের মস্তিষ্কে নিউরন সঙ্কেত স্বজ্ঞা সৃষ্টি করে না, আমরা তাকে প্রতিস্থাপিত করেছি খুবই ক্ষুদ্র কোয়ান্টাম ন্যানো-গেটের সঙ্কেত দিয়ে। কিন্তু পুরোনো নিউরনে ফিরে যাবার কোন পদ্ধতি আমাদের জানা ছিল না। আমাদের কোয়ান্টাম স্বজ্ঞা হাজার হাজার বছরের বিবর্তনে সেই পথ পুরো বন্ধ করে দিয়েছিল।”

তার কথায় যে হতাশা ছিল তার অনুরণন আমার মাঝেও সঞ্চারিত হল। সে কথা বন্ধ করে কিছুক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর সে যেন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

“আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম অতীতে ফিরে যাবার। সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের খুঁজে বার করতে হবে এমন একটা সভ্যতার যা কিনা স্বজ্ঞা সৃষ্টির জন্য এখনো নিউরন সংকেতের ওপর নির্ভর করে। নতুন করে শিখতে হবে স্বজ্ঞার অর্থ। কিন্তু মহাশূন্য অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত, আমাদের গ্যালাক্সির ব্যাস এক লক্ষ আলোকবর্ষ। সেই বিশাল স্থানে কি করে কি করে আমরা খুঁজে পাব এমন একটি সভ্যতা যা কিনা মহাকাশে পা ফেলে নি? তাই এই গ্যালাক্সিকে অল্প সময়ে স্যাম্পেল করার জন্য আমাদের বিজ্ঞানীরা সৃষ্টি করল এক ধরণের অনুসন্ধানী তরঙ্গ। পৃথিবীর ভাষায় তাকে তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ বলা চলে, কিন্তু সেই তরঙ্গের মাঝে এক ধরণের পোলারাইজেশন বর্তমান যা কিনা স্বজ্ঞার সঙ্কেতের সঙ্গে বিক্রিয়া করে তার দিক বদলাতে পারে। বহুদিন আগে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম নিউরন সঙ্কেতে যে বোধের সৃষ্টি হয় তার জন্য একটা বিশেষ মাত্রার দরকার। সেই মাত্রার বোধটি বর্তমান পৃথিবীর বিজ্ঞানে নেই। আমি ঠিক বলে বোঝাতে পারব না সেটার কথা। অজস্র নিউরন সঙ্কেতে সৃষ্ট যে বোধ, সেই বোধের মাত্রার সঙ্গে সেই তরঙ্গ পরোক্ষ ভাবে বিক্রিয়া করতে পারে। আমরা যে তরঙ্গের তৈরি করেছিলাম সেটা সেই মাত্রাকে সৃষ্টি করে যে তড়িৎ-চুম্বকীয় ও কোয়ান্টাম ক্ষেত্রসমূহ সেগুলোকে স্যাম্পেল করতে পারে। তাছাড়া অনুসন্ধানী তরঙ্গটি এমন ভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিল যাতে সেটি উৎসমুখের সাথে কোয়ান্টাম ভাবে যুক্ত থাকে। অর্থাৎ সেই তরঙ্গ যদি হাজার আলোকবর্ষ দূরেও কোন স্বজ্ঞার সাক্ষাৎ পায়, তার উৎসে সে মূহুর্তেই সে একটি ব্যতিচার নকশা সৃষ্টি করবে। অর্থাৎ আমরা জানব আমাদের অনুসন্ধানী তরঙ্গ কোন এক ধরণের স্বজ্ঞার খোঁজ পেয়েছে। আমরা এর থেকে বেশী তথ্য জানব না, শুধু জানব যে সেই তরঙ্গটি পর্যবেক্ষিত হয়েছে।

“আমাদের কেন্দ্রীয় নক্ষত্র পৃথিবী থেকে ৩৬ আলোকবর্ষ দূরে। একটি লাল বামন নক্ষত্রের কাছাকাছি আমাদের সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে আমাদের প্রথম অনুসন্ধানী সঙ্কেত পৃথিবীতে পৌঁছায়। সেই সঙ্কেতের ভয়াবহ পরিণতি জানতে আমাদের বেশ কিছুদিন সময় লেগেছিল। পৃথিবীর সভ্যতার সেই ঊষালগ্নে নিশ্চয় পৃথিবীর অনেকেই উধাও হয়ে গিয়েছিল। অনেক পরে, মাত্র কয়েক শো বছর আগে, আমাদের বিজ্ঞানীরা আমাদের তরঙ্গের ভয়াবহতা নির্ধারণ করতে পারল। তখনই আমরা রওনা হলাম গ্যালাক্সির বিভিন্ন দিকে। পৃথিবী পৌঁছাতে দুশো বছর মত লাগল, আমরা মাত্র গতকাল রাতে পৌঁছলাম। দেরি হয়ে গেল।”

তার গলায় যে অনুশোচনা ছিল তার অকৃত্রিমতা নিয়ে আমার সন্দেহ ছিল না। আমি কল্পনা করলাম তার চোখে জল টলমল করছে।

“ইতিমধ্যে আমরা গ্যালাক্সির বিভিন্নদিকে স্বয়ংক্রিয় ছোট ছোট মহাকাশযান পাঠিয়েছিলাম, সেগুলো থেকেও সেই তরঙ্গ বিকিরিত হচ্ছে। গত কয়েক হাজার বছর ধরে মাঝে মধ্যেই তাদের প্রেরিত বিকিরণ একটি সমচ্ছেদে পৃথিবীকে অতিক্রম করে, সেই সমচ্ছেদে যারা দুর্ভাগ্যক্রমে সেই মুহূর্তে অবস্থিত ছিল – তারা যদি পর্যবেক্ষিত অবস্থায় না থাকত – তবে তারা অদৃশ্য হয়ে যেত। এর কিছু ঘটনা পৃথিবীবাসীরা জানে, কিন্তু অনেক ঘটনাই অজানা। দুঃখের বিষয় পৃথিবীতে আগত অনুসন্ধানী তরঙ্গকে এখনই বন্ধ করা যাচ্ছে না যদিও আমরা সব মহাকাশযান থেকে তরঙ্গ প্রচার বন্ধ করতে নির্দেশ পাঠিয়েছি। কিন্তু আমাদের সঙ্কেত শুধুমাত্র আলোর গতিতে চলতে পারে। সবগুলো মহাকাশযানে সেই নির্দেশ পৌঁছাতে অন্ততঃ আরো কয়েক শো বছর লাগবে। বেশ ক’টি মহাকাশযান থেকে সেই তরঙ্গ এখনো পৃথিবী অভিমুখে প্রচারিত হচ্ছে। পৃথিবীকে পুরো নিরাপদ হতে আরো চারশো বছর লাগবে। নিজেদের অজান্তে পৃথিবীর ক্ষতি করবার জন্য আমরা দুঃখিত।”

এই কথাগুলো বলে আমাদের আগন্তুক চুপ করে গেল। “দুঃখিত” কথাটি সে এমনভাবে বলল যেন সেটা বলার জন্যই সে পৃথিবীতে এসেছে। এখন মনে হল এতক্ষণ সে হয়ত তার মুখই খোলে নি। সে যেন আমাদের মনে তার কথাগুলো সঞ্চার করেছে। কাইয়ুম ভাই বলে উঠলেন, “আর পৃথিবীর অদৃশ্য হওয়া মানুষেরা তারা কোথায় গেল?” আমি ওনার সাহসকে মনে মনে বাহবা দিলাম।

কাইয়ুম ভাইএর কথা বুঝতে তার অসুবিধে হল। তারপর সে যেন বুঝল। “দুঃখিত, তারা আর ফিরে আসবে না, অন্ততঃ এই বিশ্বে। এটা সম্ভব যে তারা আর একটা বিশ্বে বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু আমাদের পক্ষে সেটা জানা কখনই সম্ভব হবে না।”

একটু চুপ থেকে সে আবার বলা শুরু করল, “সমান্তরাল জগতের কথা আমাদের বিজ্ঞানীরা বলেন, পৃথিবীর তথ্য-উপাত্ত দেখে বুঝলাম পৃথিবীরা বিজ্ঞানীরাও এই নিয়ে ভাবছে। প্রতিটি জিনিসেরই একটি তরঙ্গ-প্রকৃতি ও একটি কণা-প্রকৃতি আছে। সেই বস্তুটি যত ছোট হবে তার তরঙ্গ-প্রকৃতি তত প্রাধাণ্য পাবে। প্রকৃতির প্রতিটি কণার গতিকে যদি কোয়ান্টাম বা পৃথিবীর ভাষায় স্রোডিঞ্জার তরঙ্গ দিয়ে বর্ণনা করা যায়, তবে বলা যায় সময়ের সাথে সেই তরঙ্গের রূপান্তর হবে, সেই পরিবর্তিত তরঙ্গের একটি মাত্র শিখর থাকবে না, বরং অনেক কটি চূড়া থাকবে, এক একটি চূড়ার সম্ভাব্যতা এক এক রকম হবে। একটি কণাই যেন নিজেকে একটা বিশাল তরঙ্গে ভাগ করে নিয়েছে, সেই তরঙ্গের বিভিন্ন শিখরে কণাটির বাস্তবায়নের সম্ভাবনা বিভিন্ন। সেই তরঙ্গ যখন অন্যান্য বস্তুর সংস্পর্ষে আসে তখন তরঙ্গটি বস্তুকণায় রূপান্তরিত হয়। অন্য ভাষায় বলা যায় সম্ভাবনার স্রোডিঞ্জার তরঙ্গ আমাদের পরিচিত পরিমাপযোগ্য কণায় বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু আমি আগেই বলেছি সময়ের সাথে সাথে একটি তরঙ্গের পরিবর্তন হবে, একটি ইলেকট্রনকে শুরুতে একটি মাত্র চূড়া সম্পণ্ন তরঙ্গ দিয়ে বর্ণনা করলেও আস্তে আস্তে সেই তরঙ্গ বিস্তৃত হলে তার মাঝে অনেক চূড়া দেখা দিতে পারে। সেই তরঙ্গটি যখন অন্য বস্তু বাঁ ফোটনের সংস্পর্শে আসবে তখন এমন হতে পারে যে কণাটি সব শিখরেই বাস্তবায়িত হবে। আমাদের বিশ্বে একটি শিখরই কণা হয়ে ওঠে, কিন্তু এর মধ্যে অনেক ক’টি মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয় যার প্রতিটিতে এক একটি সম্ভাবনা বা এক একটি শিখর বা চুড়া কণায় রূপান্তরিত হয়। তবে এক একটি মহাবিশ্বে শুধুমাত্র একটি বাস্তবায়নই সংঘটিত হয়, অর্থাৎ একটি ইলেকট্রনই দেখা যায়।”

আমি তার কথা মনে হয় কিছুটা বুঝতে পারি। কাইয়ুম ভাই দেখি মাথা নাড়ছেন। মন হল তিনি ব্যাপারটা আমার থেকে ভাল অনুধাবন করছেন। আগন্তুক আবার বলে, “মহাবিশ্বকে আমরা যখন দেখি আমরা বস্তুতরঙ্গ অবলোকন করি না, জগৎ আমাদের কাছে বস্তুকণার সমষ্টি হিসেবে প্রতিভাত হয়। তরঙ্গ থেকে কণার রূপান্তরণ হয়তো অন্যান্য বস্তুকণা বা ফোটনের সঙ্গে বিক্রিয়ার ফলে হতে পারে। কিন্তু সেই রূপান্তরণের সময় প্রতিটি কণার বাস্তবায়নের সম্ভাবনা এক একটি জায়গায় এক এক রকমের। এই কণাসমূহ যদি এমন ভাবে বাস্তবায়িত হয় যা কিনা আমাদের সময়ের ক্রমান্বয়তা ধরে রাখতে সাহায্য করে তাহলে বলা যায় আমাদের মহাবিশ্ব সঠিক ভাবে পুনর্গঠিত হয়েছে। বলতে গেলে প্রতিটি মুহূর্তেই আমাদের সমগ্র মহাবিশ্বকে বাস্তবায়িত হতে হচ্ছে। আমাদের স্বজ্ঞা সেই বাস্তবায়নের ক্রমান্বয়তা ধরে রাখছে। এই পদ্ধতিতে শুধু একটি মহাবিশ্বই যা বাস্তবায়িত হবে এমন নয়, অসংখ্য মহাবিশ্ব তাতে সৃষ্টি হতে পারে। আমরা ক্রমাগতই সেই মহাবিশ্বগুলির মধ্যে এমন একটিকে বেছে নিচ্ছি যা কিনা আমাদের স্মৃতির বোধগম্যতা ও সময়ের ক্রমান্বয় অর্থময়তা ধরে রাখতে পারে।”

আমরা চুপ করে থাকলাম। আমগাছের কাকগুলো দু-একবার ডাকল। ওদের ডাক ছাড়া শহর থেকে অন্য কিছু শোনা যায় না। অসংখ্য মহাবিশ্বের মধ্যে আমি আমার যাত্রাপথ কল্পনা করলাম।

“দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের প্রেরিত অনুসন্ধানী তরঙ্গ সেই বাস্তবায়নের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। চেতনার ভিত্তিভূমি হিসেবে যে কোয়ান্টাম বা তড়িৎ-চুম্বকীয় ক্ষেত্র আছে, সেই ক্ষেত্রের ক্রমঃবাস্তবায়নকে সেই অনুসন্ধানী তরঙ্গ বাধাগ্রস্থ করছে। সেই তরঙ্গের সঙ্গে বিক্রিয়ার ফলে যে স্বজ্ঞা সৃষ্টি হচ্ছে তা যেন এই মহাবিশ্বের জন্য সঠিক নয়, এক ধরণের স্ববিরোধিতায় মানুষ যেন নিজেকেই বিলোপ করছে। যেহেতু সেই স্বজ্ঞা নিউরন সংকেতের সাহায্যে পুরো দেহের সাথে যুক্ত সেইজন্য সমগ্র দেহটাই এই বিশ্বে বাস্তবায়িত হচ্ছে না।”

এই বলে সে নিচের দিকে মাথা নামায়। কোন একটা গভীর চিন্তা যেন তাকে অধিকার করে রাখে। আমি তার ভুরু দেখতে পাই। মানুষ গভীর চিন্তা করলে যেমন ভুরু কোঁচকায় তার ভুরুও সেরকম কোঁচকানো ছিল। তারপর সে চোখ তুলে বলে, “অন্য মহাবিশ্বে কি তাহলে সেই দেহ গঠিত হচ্ছে? আমি সঠিক ভাবে জানি না, কিন্তু সেটা হবার সম্ভাবনা আছে। সেই মহাবিশ্বে নতুন বাস্তবায়িত স্বজ্ঞা যদি স্মৃতি ও সময়ের ক্রমান্বয়তা বজায় রাখতে পারে, তবে সেই মহাবিশ্বে সেই মানুষের জীবন এতদিন যেমন চলে এসেছে সেইভাবেই চলবে।” তার কালো চোখের মণি যেন সমুদ্রের মত গভীর ছিল, আমি তাতে ঘরের প্রতিফলন দেখলাম।

“কিন্তু স্বজ্ঞা তো কোন বস্তু নয় যে সেটার সঙ্গে আপনাদের তরঙ্গ বিক্রিয়া করবে?” কাইয়ুম ভাই প্রশ্ন করেন। আমি কাইয়ুম ভাইএর স্থিরতায় চমৎকৃত হই।

আগন্তুক বলে, “বস্তু বলতে আমরা যা বোঝাই স্বজ্ঞা সেটা নয়, কিন্তু স্বজ্ঞা একটা ভিত্তিভূমিতে তৈরি হয়, সেটা হল কোটি কোটি নিউরন বা সিনাপসের পারস্পরিক সংকেত দিয়ে। সেই কোটি কোটি সংকেতের আদান প্রদানের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় যে বোধ তাকে বস্তুজগতের মাত্রায় মাপা সম্ভব নয়। কিন্তু তার একটা অস্তিত্ব আছে, তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করলে আমাদের মহাবিশ্বের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে হয়। কিন্তু সেই বোধের অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ বা মাত্রা পৃথিবীর ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। আমরা যেটা পেরেছি সেটা হল একে অপরের সাথে যুক্ত জটিল তড়িৎ-চুম্বকীয় ক্ষেত্রসমূহের আকারের একটা প্রারম্ভিক সীমানা নির্ধারণ করা, সেই সীমার ওপরে বুদ্ধিমান স্বজ্ঞার আবির্ভাব হয়। অর্থাৎ চেতনাকে আমরা সরাসরি অনুধাবন করতে না পারলেও মস্তিষ্কের যে সমস্ত তড়িৎ-চুম্বকীয় ও কোয়ান্টাম ক্ষেত্র স্বজ্ঞাকে সৃষ্টি করে সেই ক্ষেত্রের মানচিত্রটা আমরা পরিমাপ করতে পারি। আমাদের প্রেরিত তরঙ্গ সেই তড়িৎ-চুম্বকীয় ও কোয়ান্টাম ক্ষেত্রের জটিল আকারের সঙ্গে যাতে বিক্রিয়া করতে পারে সেভাবেই নির্মিত ছিল। দুঃখের বিষয় সেই তরঙ্গ নির্দিষ্টভাবে স্বজ্ঞার ভিত্তিভূমির ক্ষেত্রকে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে সেই স্বজ্ঞার অধিকারী মানুষের দেহকণা এই মহাবিশ্বে বাস্তবায়িত হতে পারে না। যার ফলে সেই মানুষ অদৃশ্য হয়ে যায়।”

আমি এইবার তার কথা কিছুটা বুঝতে পারি। “কিন্তু অন্য মানুষ দিয়ে পর্যবেক্ষিত হলে সেই কণাসমূহের বাস্তবায়ন হবে?” আমি সাহস করে বলে উঠি। নওশাদের কথা মনে পড়ে। এই ঘটনাটা সে তো ঠিকই বুঝেছিল। নওশাদ বোধহয় আর পৃথিবীতে নেই।

সে আমার দিকে তাকায়, যেন আমার প্রশ্নের প্রশংসা করছে। সে বলে, “সৌভাগ্যক্রমে অনেকটা তাই, যদিও এটা আমাদের ইচ্ছাকৃত সৃষ্টি নয়। যারা পর্যবেক্ষণ করছে তাদের স্বজ্ঞার ক্ষেত্রসমূহের আকারের সাথে সেই তরঙ্গ বিক্রিয়া করলে মূল স্বজ্ঞার অধিকারী কণাসমূহের এই বিশ্বে ক্রমঃবাস্তবায়নকে আমাদের তরঙ্গ বাধাগ্রস্ত করতে পারে না। এমন যেন পর্যবেক্ষকরা সেই ধ্বংসাত্মক তরঙ্গকে ব্যস্ত করে রাখে। এর ফলে অনুসন্ধানী তরঙ্গের সময় হয় না তার শিকারের ক্ষতি করার। তাই কাউকে ক্রমাগত পর্যবেক্ষিত অবস্থায় রাখলে তার দেহের কণার ক্রমঃবাস্তবায়ন এই মহাবিশ্বে হতেই থাকবে, অনুসন্ধানী তরঙ্গের কোন অবকাশই হবে না তার স্বজ্ঞার ক্ষেত্রের সাথে বিক্রিয়া করার। পৃথিবীর তথ্যাবলীর মধ্যে দেখলাম কোয়ান্টাম zeno ক্রিয়া নামে একটি ঘটনার কথা বিজ্ঞানীরা আলোচনা করেছে। কোন কোয়ান্টাম ঘটনাকে ক্রমাগত পরিমাপের মধ্যে রাখলে সময়ের সাথে সেই ঘটনার বিকাশকে বন্ধ রাখা সম্ভব। যে কোন কোয়ান্টাম বিক্রিয়াকে দ্রুত পরিমাপ করে যেতে থাকলে সেই বিক্রিয়াকে খুব শ্লথ করে দেয়া যায়। এই ক্ষেত্রে আমাদের অনুসন্ধানী তরঙ্গ পর্বেক্ষকদের স্বজ্ঞা ক্ষেত্রের সাথে বিক্রিয়া করতে থাকবে। পরোক্ষভাবে পর্বেক্ষকদের স্বজ্ঞা ক্ষেত্র যেন অনুসন্ধানী তরঙ্গকে ক্রমাগত পরিমাপ করছে। এই পরিমাপ অনুসন্ধানী তরঙ্গকে অভীষ্ট মানুষের বা শিকারের স্বজ্ঞা ক্ষেত্রের সাথে বিক্রিয়া করতে দেবে না।”

আর একটু ভেবে সে যোগ করে, “আর একটি প্রক্রিয়ায় অনুসন্ধানী তরঙ্গকে ধোঁকা দেয়া সম্ভব। যদি কেউ সচেতন ভাবে নিজের অস্তিত্বর কথা ক্রমাগত ভাবতে থাকে। কোন স্বজ্ঞা নিজেকে কিভাবে অনুভব করে তা আমি বলতে পারব না, তবে নিজের অস্তিত্বের সম্পর্কে ভাবলে স্বজ্ঞার ভিত্তিভূমির তড়িৎ-চুম্বকীয় ও কোয়ান্টাম ক্ষেত্রের আকারের যে পরিবর্তন হয় তার সাথে অনুসন্ধানী তরঙ্গ বিক্রিয়া করতে পারে না। তাতে অনুসন্ধানী তরঙ্গের পোলারাইজেশন বদলায় না।”

“আর ভিডিও দিয়ে ছবি তোলা?” আমি প্রশ্ন করি।

“অনুসন্ধানী তরঙ্গের অভীষ্ট মানুষটির ছবি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্যামেরা দিয়ে ফাইলে তুলে রাখলে, সেই ফাইল ভবিষ্যতে কেউ সরাসরি দেখবে সেটার একটা সম্ভাবনা থাকে। আলো একটি বিন্দু থেকে আর একটি বিন্দুতে যাত্রা করলে তার সমগ্র পথ বা পথগুলো পূর্ব থেকেই জানে। অনুসন্ধানী তরঙ্গ ভবিষ্যতে ইতিমধ্যে ভ্রমণ করেছে এবং সেই ভবিষ্যতে যারা ছবি বা ভিডিওটা দেখবে তাদের স্বজ্ঞা ক্ষেত্রগুলির সাথে বিক্রিয়া করতে সে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, যার ফলে তার বর্তমানের অভীষ্ট শিকার বেঁচে যায়। অর্থাৎ ভবিষ্যতে কি হবে সেটা বর্তমান সময়ে তরঙ্গ কি ভাবে ব্যবহার করবে তা নির্ধারণ করে দেয়। পৃথিবীর অনেক মানুষই এই জিনিসটা বুঝতে পেরেছে, এই ঘরে যারা আছে তারাও এই পদ্ধতি ব্যবহার করেই অদৃশ্য হয় নি।”

আমি বলি, “কিন্তু আমি তো ক্রমাগত একটা ডিস্কে আমার ছবি তুলে যাচ্ছিলাম। ডিস্ক ভর্তি হয়ে গেলে পুরোনো ছবি মুছে তার ওপর আবার নতুন ভিডিও তুলছিলাম। অনুসন্ধানী তরঙ্গ নিশ্চয় জানত সেই মোছা ছবি ভবিষ্যতে দেখা হবে না। সে তো জানে কোন ছবিগুলো ভবিষ্যতে কেউ দেখবে না। তখন তো তার ওপর কোন “zeno” প্রক্রিয়া কাজ করার কথা নয়। তখন কেন আমি অদৃশ্য হলাম না?”

আমি তার মুখ দেখতে পাই না। কিন্তু মনে হয় সে যেন হাসে। ভিন গ্রহে কৌতুকের মাত্রা কি?

“প্রশ্নটা সঠিক। আসলে কোন মহাবিশ্বে ছবিটা দেখা হবে আর কোন মহাবিশ্বে ছবিটা দেখা হবে না সেটা অনুসন্ধানী তরঙ্গ জানে না। ছবিগুলো মুছে ফেলার আগেই অসংখ্য মহাবিশ্ব সৃষ্ট হয়েছে যেগুলোতে ছবি গুলো মুছে ফেলা হয় নি। অনুসন্ধানী তরঙ্গ ভবিষ্যতের সবগুলো মহাবিশ্ব স্যাম্পেল করতে চায়। এর মধ্যে কয়েকটি মহাবিশ্বে ছবিগুলো দেখা হবে। সেই মহাবিশ্বগুলিতে যারা ছবিগুলো দেখবে সেই দর্শকদের স্বজ্ঞা ক্ষেত্রের সাথে তরঙ্গ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার ফলে বর্তমানের অভীষ্ট শিকারের স্বজ্ঞা সেই তরঙ্গের হাত থেকে বেঁচে যায়।”

এত বিপর্যয়ের মধ্যেও তার ব্যাখ্যা শুনে আমার মাথা ঘুরতে থাকে। মনে হল অনুসন্ধানী তরঙ্গেরও যেন একটা চেতনা রয়েছে। কাইয়ুম ভাইএর চোখ দেখলাম উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, উনি এই ব্যাখ্যা আমার থেকে বেশী উপভোগ করেছেন। কিন্তু একটা বিরাট মহাজাগতিক দুর্ঘটনার সামনে আমরা অসহায়। ধীরে ধীরে আমাদের আগন্তুক জানালা ছেড়ে দরজার দিকে এগুতে থাকে। তারপর সে কানুকে দেখে। যদিও কানুর উপস্থিতি সম্বন্ধে সে আগেই সচেতন ছিল, তবু সে যেন নতুন করে তাকে দেখল। সে বলল, “পৃথিবীর মানুষ জানত না তারা কত সৌভাগ্যবান। তারা তাদের গ্রহ অন্য অনেক স্বজ্ঞাসম্পণ্ন প্রাণীর সঙ্গে ভাগ করে বাস করে। তাদের স্বজ্ঞা ক্ষেত্রের আকার মানুষের আকারের থেকে ভিন্ন তবে খুব ভিন্ন নয়। কিন্তু সেই আকারে অনুসন্ধানী তরঙ্গের পোলারাইজেশন বদলায় কিনা তা আমি জানি না”। দরজা পার হয়ে সে বলে, “এই সব কিছুর জন্য আমরা দুঃখিত। ভবিষ্যতে এরকম এর হবে না।” এই বলে সে সিঁড়ির দিকে যেতে থাকে। আমরা তার কথা শুনতে শুনতে হতভম্বিত হয়ে ছিলাম, এত দ্রুত যে সে চলে যাবে সেটা ভাবি নি।

সে যখন সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করেছে শুধুমাত্র তখনই আমি সম্বিত ফিরে পাই। “দাঁড়াও,” আমি চিৎকার করি, “দাঁড়াও।” ছুটে সিঁড়ির কাছে যাই। সে ততক্ষণে নিচে নেমে গেছে। “সিঁড়ির ফাঁক দিয়ে আমি জোরে চেঁচাই, “এখন কি হবে? মানুষ বাঁচবে কেমন করে?”

তার পায়ের শব্দ থেমে যায়। তার গলা শুনি, “এখন যেমন করে বেঁচে আছে।”

“কিন্তু তোমরা তো স্বজ্ঞার খোঁজে এসেছিলে? স্বজ্ঞা তো পেলে এখানে,” চিৎকার করি আমি। মরিয়া হয়ে থামাতে চাই তাকে। “সেই স্বজ্ঞা কি তোমাদের কাজে লাগবে না?”

“না।” তার উত্তর ছিল অতটুকুই। সংক্ষিপ্ত।

“কিন্তু এত মানুষ উধাও হল, হয়তো মারা গেল, তার কোন দায়িত্ব তোমরা নিচ্ছ না? তোমাদের নিজেদের সত্তা বলে কি কিছু আছে?”

আমি নিচে নেমে আসি। কানুও আমার সাথে সাথে আসে। সে বাইরের গ্রিলের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার দিকে সোজাসুজি তাকায় সে, অপলক দৃষ্টিতে বলে, “দায়িত্ব আমাদের আছে, কিন্তু এই মুহূর্তে কোন ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব নয়, কারণ তাতে যে মানুষেরা বেঁচে আছে তাদের ভবিষ্যত রক্ষিত হবে না। আমরা আবার ফিরে আসব, কিন্ত এখনই নয়।”

“কিন্তু তোমরা তো পৃথিবীর মত জীবনেরই খোঁজ করছিলে। এত দুর্ঘটনা, এত বিষাদ, এই সব সৃষ্টির পরে তোমরা হাতপা ঝেড়ে চলে যেতে পার না। তোমাদের দায়িত্ব আছে। আর আমাদের স্বজ্ঞাকেই বা কেন তোমরা অগ্রাহ্য করছ?”

আমার কোন কথাই যেন তাকে স্পর্শ করে না। সে বলল, “স্বজ্ঞার খোঁজ আমরা করছিলাম। কিন্তু পৃথিবীতে এসে আমরা সিদ্ধান্ত পালটেছি। আমরা জানি না এই ধরণের স্বজ্ঞা আমরা খুঁজছিলাম কিনা। আমাদের এই নিয়ে আলোচনা করতে হবে, আমরা চারশো বছর পরে ফিরে আসব। আমরা ফিরে আসব, কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের গ্যালাক্সির অন্য গ্রহে যেতে হবে যেখানে অন্য জীবন আছে। পৃথিবীর মত তাদের জীবনও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এই গ্রহে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে তার জন্য আমরা ক্ষমা চাইছি।”

এই বলে সে গেটের ওপাশে চলে যায়। সিঁড়ির শেষ ধাপ থেকে গেটে পৌঁছাতে আমার পাঁচ সেকেন্ডও লাগে না। কিন্তু রাস্তায় বেড়িয়ে তাকে আমি দেখি না। আমার পেছনে কাইয়ুম ভাই ও মন্টু নেমে আসে। রাস্তার শেষ প্রান্তে একটা ভারি ধাতব শব্দ শুনি। এত দ্রুত সে কেমন করে এত দূরে চলে গেল? সেই শব্দে রাস্তা কাঁপে। আমরা তিনজন যতটুকু সম্ভব ততটুকু জোরে সেদিকে ছুটি। মন্টু আর কাইয়ুম ভাইকে ফেলে আমি আর কানু ছুটি। শব্দটা ধীরে ধীরে দূরে চলে যেতে থাকে। আমার দুপাশে পড়ে থাকে নিস্তব্ধ বাড়িগুলো, রাস্তায় ছড়ানো ছিটানো কিছু গাড়ি, কিছু রিকশা। এই সকালে আলোর মধ্যেও এই শহর রাতের নিকষ কালো আঁধারের পেছনে যেন অদৃশ্য থাকে। আমার শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে।

দেরি হয়ে গেল। আমাদের ভিন গ্রহের আগন্তুকের পদশব্দ দূরে মিলিয়ে যেতে থাকে। রাস্তাটা শেষ হয়েছিল একটা ছোট মাঠে। মাঠ বলা সঙ্গত হবে না, এই শহরে ফাঁকা জায়গা বলে কিছু নেই। এক চিলতে জমি কোন কারণে সবার চোখ এড়িয়ে গেছে, তার মধ্যে কিছু ঘাস, কিছু আবর্জনা। সেখানে পৌঁছে আমি ওপর দিকে তাকালাম, একটা খুব সূক্ষ্ম গাঢ় নীল রেখা আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। কোন শব্দ নেই। কিছুক্ষণ পরে সেই নীল আকাশের নীলের সঙ্গে মিলে যায়। কি ধরণের মহাকাশযান শব্দ করে না? মাঠে পড়ে ছিল একটা লাল জামা, কালো প্যান্ট, কালো জুতো।

আবার আকাশের দিকে তাকাই, সূর্য চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। কিন্তু তার মাঝেও দেখি কিছু উজ্জ্বল প্রতিফলন, ঝাঁকে ঝাঁকে ছোট ছোট মহাকাশযান পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গবদ্ধ বিন্যাস আমার কাছে মনে হয় মহাবিশ্বের কোন উচ্চতর উদ্দেশ্যের প্রতিফলন। তাদের কাজ শেষ হয়ে গেছে, তারা পৃথিবীর বেঁচে থাকা মানুষদের কাছে তাদের কাজের জন্য ক্ষমা চেয়েছে। এই প্রথমবারের মত একটা বিশাল শূন্যতা আমাকে গ্রাস করে। একটা রহস্যের উত্তর আমি পেয়েছি, কিন্ত সেই উত্তর আমাকে পৃথিবীর পরিণতিকে মেনে নিতে সাহায্য করে না। সেই উত্তর পাবার পর ভবিষ্যতের কাছ থেকে আর কিছু আশা করার নেই। আমার প্রিয়জন, আত্মীয় ও বন্ধুরা সবাই চলে গেছে। চারশো বছর পরে লাল বামন নক্ষত্রের অধিবাসীরা ফিরে আসবে। সে অনেক সময়, মানব সভ্যতা কি ততদিন বাঁচবে?

এর মধ্যে কাইয়ুম ভাই ও মন্টু এসে পৌঁছান। আমরা তিনজন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি যতক্ষণ না মহাকাশযানগুলো দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। তারপর কাইয়ুম ভাই মাঠে পড়ে থাকা কাপড়গুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, “জীবনে সবই অলীক।”

আমি হাসি। বলি, “এমন কি ভাষাটাও।”

“হ্যাঁ,” বলেন কাইয়ুম ভাই, “যে সভ্যতা সময়কে জয় করতে পারে, পৃথিবীর ভাষা নানাবিধ উৎস থেকে তার রপ্ত করতে কতক্ষণ? কিন্তু অমল, তাদের এত সুন্দর ফ্যাশন বোধ কোনখান থেকে আসল?”

আমি মাথা নাড়াই। জানি না। কাইয়ুম ভাই আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন, তারপর বলেন, “তুমি হয়তো জানো, অমল, তোমার মুখ বদলে গেছে। তুমি আর অমল নেই।”

আমি সেটাই আন্দাজ করছিলাম। নওশাদের ফোন না পেলে আমি পৃথিবীতে থাকতাম না। আমি অদৃশ্য হতে শুরু করেছিলাম, তাতে হয়তো আমার মুখ বদলে গেছে। কিন্তু আমার কিরকম মুখ হয়েছে সেটা ভাবতে চাইলাম না। নতুন পৃথিবীতে না হয় আমার নতুন জন্মই হল।

“কোথায় যাবে এখন?” জিজ্ঞেস করেন কাইয়ুম ভাই। কোন দ্বিধা ছাড়া আমি উত্তর দিই, “আমি যাচ্ছি পূবে। ভিসা পাসপোর্ট লাগবে না। পৃথিবী আমার জন্য উন্মুক্ত।”

“তা হবে না, অমল। মানুষের সাহায্য ছাড়া এই মহাবিশ্বে তুমি চলতে পারবে না। অন্ততঃ আগামী চারশো বছর। তোমাকে কে দেখে রাখবে?”

দশম অধ্যায়

২০৫০:

শেষাবধি তাই হল। মুক্ত হয়েও আমরা মুক্ত হতে পারলাম না। বরং উলটো হল। পৃথিবী কাঁটাতারে কাঁটাতারে ভাগ হল। কাঁটাতারের দৃশ্যমান সমচ্ছেদে পৃথিবী দুরকমের হল। পৃথিবীতে যে কয়েকটি মানুষ তখনও ছিল তারা নিজেদের দিনরাত ২৪ ঘন্টা পর্যবেক্ষণে রাখল। প্রাইভেসি বলতে আমরা যা বুঝি তা লুপ্ত হয়ে গেল। কাঁটাতারের সীমানায় সতর্কবাণী থাকল, “এর বাইরে কোন ধরণের পর্যবেক্ষণ করা হয় না। যাঁরা এই সীমানার বাইরে যাবেন তাঁরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করবেন।” তবুও রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষ এডভেঞ্চারের খোঁজে নিজেকে ক্যামেরায় রেকর্ড করতে করতে সেই কাঁটাতারের সীমানা পার হয়ে যেত। তাদের অনেকেই ফিরে আসত না।

বেঁচে থাকা মানুষেরা একটা সুযোগ পেয়েছিল, কিন্তু সেটা তারা কাজে লাগাতে পারল না। পৃথিবীর মানচিত্র বদলাল না। পর্যবেক্ষণের সুযোগ নিয়ে কিছু মানুষ তাদের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করল। সব দেশই এক ধরণের টোটালিটারিয়ান ব্যবস্থার মধ্যে চলে গেল। পৃথিবীর অরাজকতা ও অত্যাচার থেকে বাঁচতে আমি একদিন কাঁটাতারের বাইরে চলে গেলাম। কাঁটাতারের বাইরের পৃথিবী উন্মুক্ত ছিল, সেখানে ভিসা পাসপোর্ট লাগে না। কিছু ডাকাতের দল ঘুরে বেড়াত বটে, কিন্তু ক্যামেরার ব্যাটারি ফুরিয়ে যাবার ভয়ে বেড়ার আশেপাশেই থাকত। তাদের এড়ানো আমার জন্য কঠিন ছিল না। ততদিনে কানু মারা গেছে। কাইয়ুম ভাইও চলে গেছেন। আমি একাই পৃথিবী ঘুরলাম, আঙ্কোর ওয়াট থেকে সেরেংগেটির প্রান্তর। নিজেকে বাঁচাতে কয়েকটি সৌর ব্যাটারি চালিত ভিডিও ক্যামেরা ব্যবহার করতাম। আমি জানি একদিন ঐ ক্যামারগুলো কাজ করবে না, কিন্তু ততদিনে আমার পৃথিবীর অনেকটাই দেখা হয়ে যাবে।

আমাদের জ্যোতির্বিদরা আকাশে সেই লাল বামনটি খুঁজে পেয়েছিল, কিন্তু সেটার থেকে জীবনের কোন সঙ্কেত তারা পেল না। মহাকাশের শূন্যতা সেই সভ্যতার সব চিহ্ন যেন শুষে নিত। তবুও মহাবিশ্বের মাঝে মানুষ জীবনের যে অর্থ খুঁজত তা হয়তো সেই লাল বামন সভ্যতার আগমনে কিছুটা হলেও পেয়েছিল। কিন্তু এর জন্য তাকে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। উল্কাপিণ্ড, আগ্নেয়গিরি, ভূমিকম্প, সমুদ্র, সূর্যের কঠিন উত্তাপ মানুষকে পৃথিবীর বুক থেকে এমন ভাবে সড়িয়ে দিতে পারে নি। তবুও সেই বিভীষিকার মধ্যেই আমি চিন্তা করি সেই দিনটির কথা যেদিন এক লাল জামা পড়া নারীবেশী ভিন গ্রহবাসী আমাদের শহরে এসেছিল। অনেক রাতেই আমি আমার ক্যাম্পের আগুনের পাশে বসে আকাশের দিকে চেয়ে থাকি, আমি অপেক্ষা করি সেই উজ্জ্বল নীল মহাকাশযানের ঝাঁকের জন্য। এক নীরব নিসঙ্গ মহাবিশ্বে একটি শূন্য শহরের মাত্র তিনটি মানুষের জন্য তারা এক দূতকে পাঠিয়েছিল। সে বলেছিল, “আমরা দুঃখিত।” অনুসন্ধানী তরঙ্গের অদৃশ্য সমচ্ছেদে আফ্রিকার এক নিঃসঙ্গ প্রান্তরে কম্পমান আগুনের শিখার পাশে বসে আমি নতুন দূতের জন্য অপেক্ষা করি।

শেষ