এত শীঘ্রই যে পশ্চিমী দেশে এরকম একটি গণ উত্থান মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি নি! নিউ ইয়র্ক শহরে এই আন্দোলনের জন্ম বলা যেতে পারে। সেপ্টেম্বর মাসের ১৭ তারিখ (২০১১ সন) প্রায় ১০০০ আপত্তিকারী জনতা রাস্তায় নেমে হাটতে হাটতে মার্কিন পূজীবাদের মক্কা ওয়াল স্ট্রীটের কাছে যে ‘জুকুটি পার্ক’ আছে সেখানে পৌছে। আপত্তিকারীদের প্রায় ১০০ জন কার্ডবোর্ড বাক্সদ্বারা কাচ্চা ঘর তৈরী করে সেখানে রাত কাটায়।

২৪ই সেপ্টেম্বর আবার আপত্তিকারী জনতা এবার ম্যানহাটনের আপ-টাউন হতে ওয়াল স্ট্রীটের দিকে আসতে থাকে হাতে প্লে-কার্ড নিয়ে। পুলিশ তাদের কয়েক জায়গায় বাঁধা দেয় এবং কিছু বিক্ষোভকারীদের গ্রেফতার করে। অক্টোবর মাসের ১ তারিখ হাজারের উপর বিক্ষোভকারীরা মিছিল করে ব্রুকলিন ব্রিজ যখন পার হচ্ছিল তখন পুলিশ তাদের বাঁধা প্রদান করে এবং ৭০০ জনের অধিক আপত্তিকারীদের গ্রেফতার করে। এই খবরটি খবরের কাগজে ও টিভিতে ফলাও করে হেড-লাইন হিসেবে প্রকাশিত হয়। তখন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে এই সামাজিক আন্দোলনকে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রীট’ বা ‘ওয়াল স্ট্রীট আধিকার কর’ এই নামে আখ্যায়িত করা হয়।

এর এক সপ্তাহের মধ্যে আমেরিকার প্রায় ২০-৩০ টি শহরে এই গণ আন্দোলন ব্যাং এর ছাতার মত ছড়িয়ে পড়ে। এই মাসের মাঝামাঝিতে এই আন্দোলনটি ইউরোপএর বেশ কয়েকটি দেশে ও দক্ষিণ আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে। কী ভাবে প্রবল বেগে এই গণ উত্থান — যার কোনো নেতা বা সংঘটন নেই — সেটি পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়লো সেটি ভাববার বিষয় বটে!

এক জরিপ মতে ১৪ই অক্টোবর খবরে বলা হয়েছে যে আমেরিকার ৫৪% সাধারণ জনতা এই সামাজিক আন্দোলনটিকে পূর্ণভাবে সমর্থন করে। আর বিক্ষোভকারীরা বলছে যে আমেরিকায় রাজনীতিবিদ ও পূজিবাদীদের সমন্বয়ে যে অদৃশ্য জোটটি তৈরী হয়েছে সেটি আজ আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দা ভাব সৃষ্টি করেছে তাদের লোভী আচরণের জন্য। জনগণও মনে করে যে এই মাত্রাধিক লোভের জন্য সারা আমেরিকায় আজ অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় ১৫ লাখ লোক চাকুরী হারিয়েছে এবং নয়া স্নাতকধারী যুবকরা চাকরী না পেয়ে মা-বাবার বাড়িতে বেকার বসে আছে। এরকমটি এর আগে কখনো আর হয় নি।

সব চেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার যে এই আন্দোলনের কোনো নেতা বা চক্র নেই আর এদের কোনো দাবি বা ম্যানিফেস্টো নেই। এরা কেবল এটাই প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করছে যে আমেরিকার বড় বড় ব্যাঙ্ক, ইন্সুরেন্স, মর্টগেজ কোম্পানীগুলো অত্যন্ত লোভী হয়ে উঠেছে গত ১০-১৫ বছরে। আর এরা লোভের বশবর্তী হয়ে যে কাউকে এরা ঋণ দিয়েছে আর সেই নিম্নমাণের ঋণের কাগজগুলো একত্রিত করে চড়া দামে বিক্রি করেছে ওয়াল স্ট্রীটে যার গালভরা নাম দিয়েছে ‘মর্টগেজ বেক্‌ট সিকিউরিটি’। এই সিকিউরিটিগুলো যখন খোলা বাজারে মার খেলো ২০০৭-২০০৮ সনে, তখন প্রেসিডেন্ট বুশ ছিল ক্ষমতায়। বুশ সরকার ট্রিলিয়ন (১০০০ বিলিয়ন) ডলার রাজভান্ডার থেকে এনে আমেরিকার বড় বড় ব্যাঙ্ক আর ইন্সুরেন্স কোম্পাণীগুলোকে দেউলিয়াকরণ হতে অব্যাহতি দেয়েছে। এই কাজটি যে বুশ সরকার ভাল করেনি তা জনগণ ভালই বুঝতে পেরেছিল তখন। কিন্তু সরকারের উপদেষ্টা আর অনেক অর্থনীতিবিদরা জনগণকে এই বলে ভয় দেখিয়েছে যে এই সব বড় বড় ব্যাঙ্ক আর ইন্সুরেন্স কোম্পাণীগুলো যদি চিৎপটাং হয় তবে জনগণ আর দেশের অবস্থা ভয়ানক শোচনীয় হয়ে পড়তে পারে।

কারা কারা এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছে এই পর্যন্ত? আমেরিকার লেবার বা শ্রম ইউনিয়ণ এগিয়ে এসেছে আরো এসেছে অগণ্য শিক্ষকমন্ডলী, কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা, আমেরিকার ডেমোক্রেটিক পার্টির অনেকে এই আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছে। বারাক ওবামাও সাধুবাদ জানিয়েছে জনগণের এই আন্দোলনের। ওপর পক্ষে, রিপাবলিকান পার্টির নেতারা আজেবাজে ভাষা ব্যবহার করে আপত্তিকারীদের বলেছে গুন্ডা বা ‘মব’, নৈরাজ্যবাদী, ইত্যাদী। আর মিট্‌ রোমনী যিনি প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী রিপাবলিকান পার্টি হতে তিনি বলেছেন যে, এরা উচ্চ বিত্তদের সাথে নিম্নবিত্তদের একটা ‘ক্লাস স্ট্রাগল’ বা বিবাদ বাধাবার চেষ্টা করছে।

যে ভাবে এই আন্দোলন দানাবেধে উঠছে তাতে আমার মনে হয় কিছু দিনের মধ্যে সারা পৃথিবীতে এই ‘ধণী-দরিদ্র’ ইস্যু নিয়ে একটা তোলপাড় হবে। শিল্পপতি সমাজের সাথে রাজনীতিবিদদের যে একটা ‘নেক্সাস’ বা বন্ধন আছে আর সেই বন্ধনটা উচ্চবিত্তদের পক্ষে যে কাজ করে সেটির কথা জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্স অনেক বছর আগেই উল্লেখ করেছেন।

আমার ধারণা এটা যে এই আন্দোলন বারাক ওবামার জন্য একটি সুখবর। ওবামা যে ২০১২ সনে ইলেকশনে প্রতিযোগিতা করবেন তখন তিনি এই আন্দোলনের সপক্ষে কথা বলবেন। ২০১৩-২০১৬ সন পর্যন্ত যদি ওবামা হোয়াইট হাউসে থাকতে পারেন তবে আমেরিকায় অনেক নয়া আইন পাশ হবে ওয়াল স্ট্রীটকে নিয়ন্ত্রিত রাখার জন্য।

এই গণ আন্দোলনকে বানচাল করা খুবই কঠিন কাজ হবে আর অন্যান্য দেশেও এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে – আর সেটিই আমার ধারণা। অধীর আগ্রহ নিয়ে আমদেরকে লক্ষ্য রাখতে হবে এই নয়া আন্দোলন কোন পথে পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে চলবে।