লিখেছেন – কফিল কাঙ্গাল।

মা-কালি যেমন রক্ত পছন্দ করে তেমনি ঈশ্বর, আল্লা এরাও ব্যতিক্রম নয়। নরবলি একটি আদমি প্রথা, যা থেকে কোন ধর্মেরই নিস্তার নেই। মা-কলির কথা বাদ। পশুর রক্তে ছাড়া ঈশ্বরও খুশি হতেন না, যার অনুকরণে মুসলমানেরা কোরবানী বা বলিদান প্রথা আজও চালু রেখেছে। বাইবেলের ওল্ড স্টেটামেন্ট বা ইহুদি ধর্মের মূল পুস্তক থেকে জানা যায়, ঈশ্বর বা গড আদম এবং তার বংশধরদের হুকুম দিয়েছিলো যেন তারা ঈশ্বরের খুশির জন্য হোমবলি (পশুবলি) উৎসর্গ করে। বাইবেল অনুসারে আদমের এক সন্তান কয়িন তার ছোটভাই হেবলকে খুন করে গুম করেছিলো (এটিই নাকি পৃথিবীতে সর্বপ্রথম মানুষ খুন)। ভাই ভাইকে খুন করার কারণ ছিলো, বড়ভাই কৃষিকাজ করতো আর ছোটভাই পশু পালন করতো। যখন তারা ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে হোমবলি দিতো তখন ঈশ্বর নাকি স্বর্গ থেকে আগুন ফেলে তা পুড়িয়ে গ্রহণ করতো। একবার যথাসময়ে তারা দু’ভাই দু’রকম মেঝ সাজিয়েছিলো। একভাই সাজালো তার চাষবাসকৃত ফলফলাদি, শাকসবজি দিয়ে আরেকভাই পশু বলি বা কোরবাণী দিয়ে। কিন্তু দেখা গেলো যে ভাই পশুবলি দিয়েছিলো তার বলি ঈশ্বর গ্রহণ করেছে, কিন্তু যে ভাই ফলমূল দিয়ে মেঝ সাজিয়েছিলো তারটা ওভাবেই পড়ে থাকলো। এতে রাগ করে কয়িন (যার মেঝ ঈশ্বর গ্রহণ করেনি) তার ছোটভাইকে খুন করে বালুচাপা দিয়ে লুকিয়েছিলো। তখন ঈশ্বর কয়িনকে ডেকে বলেছিলো তোমার ভাই কোথায়? কয়িন বলেছিলো, আমি কি জানি? উত্তরে ঈশ্বর বলেছিলো, তোমার ভাইয়ের রক্ত আমার নিকট ক্রন্দন করছে… ইত্যাদি। এতে দেখা যায় ঈশ্বর নিজেও রক্তপিপাসু ছিলো। ঈশ্বর ইব্রাহিমকেও তার নিজ পুত্রকে বলি দিতে বলেছিলো। ওল্ড স্টেটামেন্টের বহু স্থানে লিখিত আছে হোমবলির কথা। কিন্তু যতোদূর জানা যায় ঈশ্বর বা গড পছন্দ করতো পশুর রক্ত, মানুষের রক্ত নয়। সেটার অনুকরেন আল্লাও পশুবলির প্রথা চালু করেছে কিন্তু আল্লা চালু করলো দুটোই, একদিকে পশুর রক্ত অন্যদিকে মানুষের রক্ত। অর্থাৎ ইহুদিদের আদলে হোমবলি বা কোরবাণী অন্যদিকে পাপীদের মুন্ডুপাত ঘটিয়ে রক্তপান!
তবে যথার্থই বলেছেন মজিবুর রহামন ফকি (স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী), “ধর্ম মতে মুসলমানদের কোনো অকাল মৃত্যু নেই। তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর নির্ধারিত সময়েই মারা গেছেন। তাদের জন্য দুঃখ লাগতে পারে। তবে এটাই বাস্তব।” মাথামোটা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেনও বলেছিলো, “আল্লার মাল আল্লায় নিয়া গেছে।”

অতএব দুঃখ কিসের? হাতাশ কেন, আল্লা কাজ আল্লা করেছে, ৮ বাংলাদেশীর শিরোচ্ছেদ তে আল্লারই হুকুমে এবং যথানিয়মেই হয়েছে! যদি ইসলাম অন্য কোনভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ নাও হতে পারে তবে, মূর্খতায়, ঘৃণ্যতায়, হীনতায়, দীনতায, বর্বরতায়, জঘন্যতায়, হিংস্রতা… যে সর্বোৎকৃষ্ট তার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ যেখানে বহুলোকের সামনে আল্লার বান্দারা উল্লাসিত হয়ে মানুষ বলি দিচ্ছে। এটি তো সর্বোৎকৃষ্ট ধর্মের মহিমা! যে ধর্মের সিম্বল তরবারি সেই তরবারি যদি এমন কাজ না করে তবে ওই সিম্বল রেখে লাভ কি? খোদার সর্বশ্রেষ্ঠ শান্তির বাণী অনুসারে, শান্তির চি‎হ্ন যদি কাফের, অবিশ্বাসী, ইহুদি, নাছাড়ারা না-ই দেখলো তাহলে কিসের শান্তির ধর্ম?

শিরোচ্ছেদকৃত ব্যক্তিদের এক আত্মীয়র বরাত দিয়ে বিবিসি বলছে, “শুক্রবার এলেই তাদের আত্মা কেঁপে ওঠে।” মুসলিমদের নিকট শুক্রবার পবিত্র, অথচ এদিনেই তাদের আত্মা কাঁপে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আট বাংলাদেশীর শিরোচ্ছেদ ঘটনায় নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়েছে। তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বিগত কয়েক বছরে সৌদি আরবে এভাবে বহু মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। যাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশের অভিবাসী শ্রমিক। তাদের কাউকেই আÍপ সমর্থনের জন্য আইনজীবী দেয়া হয়নি। অপরাধের সাজা হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে আইনি কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, তাও জানানো হয় না অভিযুক্তদের।

অ্যামনেস্টির তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সনের (১০ মাসের মধ্যেই) ৫৮ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে । এর মধ্যে ২০ জনই বিদেশী নাগরিক। মানবাধিকার সংস্থাটি অভিযোগ করেছে, সৌদিতে বিচারের েেত্র কখনোই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা হয় না। তথ্য-উপাত্ত বিশেষণ করে তারা জানিয়েছে, ২০০৭ সালে ১৫৮ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে সৌদি সরকার। যাদের মধ্যে ৭৬ জনই বিদেশী নাগরিক। ২০০৮ সালে সেখানে মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা খানিকটা কমলেও তা ছিল ১২০ জন। এর মধ্যে বিদেশী নাগরিক ছিল ৪০ জন। ২০০৯ ও ২০১০ সালে মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৬৯ এবং ২৭ জন। এর মধ্যে বিদেশী ছিলেন ১৯ ও ৬ জন।

আল্লার সূরা-কালাম পড়ে প্রকাশ্যে পাঠাবলির ন্যায় মানুষ বলি দেওয়া আর হিন্দু দেবতাদের উদ্দেশ্যে নরবলি (যদিও এখন আর তা দেয়া হয় না) একই সূত্রে গাঁথা। এরই নাম আল্লার দেওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ জীবন বিধান! আল্লার জ্ঞান অসীম, তার ইচ্ছা ছাড়া গাছের পাতাটিও নড়ে না, আর তিনি যে বিধান দান করেছে, এর বিরোধিতা করা সীমিত জ্ঞানের (আল্লাওয়ালাদের বক্তব্যানুসারে) মানুষের উচিত নয়। পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে সবকিছুতেই আল্লার নির্দেশ থাকে, ৮ ব্যক্তিকে একসাথে শিরোচ্ছেদেও মানুষের মঙ্গল না থাকুক, আল্লার মঙ্গল অবশ্যই আছে; নতুবা আল্লা কেন এরূপ বিধান দান করেছে? অতএব এতে হাতশ হওয়া, অবাক হওয়া, দুঃখ করা ধার্মিকদের তো নয়ই; ইসলামিক দেশের নাগরিকদেরও উচিত নয়। এতে অবাক হবেন কাফেরগণ যারা ইসলামের দৃষ্টিতে দোযখবাসী। কারণ কাফেরগণ এরূপ জঘন্য হত্যার দৃশ্য কাউকে দেখাতে পারেন না, এ নিয়ে উল্লাসও করতে পারেন না।

শিরোচ্ছেদকৃতদের এভাবে মৃত্যু অর্থাৎ সময়মত, জায়গামত, আল্লার মাল আল্লা তার বিশ্বস্ত আজরাইল পাঠিয়েই তো ঘটিয়েছে। এতে ছিঃ! ছিঃ! কেন। যারা এর বিরোধিতা করছেন তারা তো আল্লারই বিরোধিতা করছেন। জন্ম দেবার পূর্বেই তো আল্লা নির্ধারিত করে রেখেছিলো এরা অভাবী বাংলাদেশে শ্রমিক হয়ে জন্মাবে, কাজের জন্য তার পবিত্র ও আশির্বাদের দেশ সৌদি যাবে, সেখানে গিয়ে হত্যা করবে এবং এভাবেই আমার আজরাইল তাদের শিরোচ্ছেদ করার হুকম দেবে আমার পবিত্র দেশের পবিত্র বান্দাদের।
আমার প্রশ্ন, এরা তো ইসলামিক শাস্তিভোগ করে মরলো। এবার কি খোদার রাগ পড়েছে? এ শাস্তিভোগের পর কি এরা সকলেই খোদার রাজ্যে যেতে পেরেছে নাকি আবারও এদের জন্য গোরাজব রয়েছে? যেহেতু এরা তাদের অপকর্মের শাস্তি ইসলামিক কায়দায় পেয়েছে সেহেতু তাদের বেহেস্ত যাওয়া বোধকরি খোদা ঠেকাবেন না। আমরা অন্তত এটুকু আশা খোদার কাছে করতে পারি। যদি গোরাজব থাকে তাহলে বলতেই হয়, খোদা নিরপেক্ষ ও ন্যায়বিচারক নয়!

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান একে বর্বর আইন বলেছেন। আইন ও শালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান সুলতানা কামালও কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন। কিন্তু তারা কি ভুলে গেছেন, এটি সম্পূর্ণরূপে আল্লার দেওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ জীবন বিধান। বরং এ বিধান যেসব ইসলামিক দেশে মান্য না করে তারা কোরান-হাদিসের বিরুদ্ধে কাজ করে। কারণ কোরানের বাণী তো আল্লারই বাণী। কোরানের বাণীর বিরোধিতা করা, কোন মুসলমানের উচিত নয়। যারা একে বর্বরতা বলেছেন তারা স্বয়ং আল্লার বিরুদ্ধেই অন্যায় করছেন!
মাত্র ক’দিন পূর্বে সৌদি এক মহিলা গাড়ি চালিয়েছেন বলে তাকে ১০ ঘা বেত্রাঘাতের রায় দিলো ইসলামি আদালত। এর কিছুদিন পূর্বে ইরানে এক ব্যক্তি ক্ষুধার তাড়নায় সামান্য রুটি চুরি করেছে বলে তার স্পাইনাল কট কেটে দেওয়ার রায় দিয়েছে সেখানকার ইসলামিক আদালত। এসবই তো খোদার রায়। ইসলামি আদালত তথা ইসলামের রক্ষকগণ তো খোদার রায় (তা যতো বর্বরই হোক না কেন) প্রয়োগ করবেই, এতে অবাক হবার বা একে বর্বর আইন বলা আর আল্লাকে অস্বীকার করা কি এক কথা নয়?
হত্যার বদলে হত্যা, হাতের বদলে হাত, চোখের বদলে চোখ… এসব তো আর অন্য কোন ধর্মে পাওয়া যায় না, কেবলমাত্র সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মেই রয়েছে, অতএব একে ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নেই। ইসলামিক আইন যদি বর্বর আইন হবে তাহালে ইসলাম ধর্মটাও তো বর্বর হয়ে যাবে! তাই নয় কি? এ আইন স্বয়ং নবী অনুসরণ করেছে, কথিত আছে, পেয়ার নবী তার একহাতে তরবারি অন্য হাতে কোরনা নিয়ে আল্লার এতো বড় সাম্রাজ্য গড়ে গেছে, তার অনুসারীরা একই পদ্ধতিতে আরো বাড়িয়েছে, একি মিথ্যা হতে পারে। খোদা যা করে মঙ্গলের জন্যই করে। রাজ্য দখল করো, লুটপাট করো, পরনারী আটক করে ভোগ কর, এসব শিক্ষা তো আর বিফলে যেতে দিতে পারে না খোদার বান্দারা। আল্লা নিজে তার পেয়ারা নবীর কাছে এ আইন নাযেল করেছে, একে মিথ্যা বলার সাহস কার? অতএব যেসব ইসলামিক দেশে এসব আইন চালু নেই, সেসব দেশ নিজেদের ইসলামি বিশ্বের, ইসলামি উম্মার সমর্থক বলে দাবি করতে পারে না। তাদের উচিত অতি শীঘ্র এমন আইন আরো বেশি বেশি চালু করা। তবে আর যাই বলি না কেন, ইসলামি আইনের একটি ভালো দিক আমি দেখতে পাচ্ছি। যা আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এ আইনটি চালু হলে এদেশের রহমান গংসহ বড় বড় রাজনীতিবিদ, আমলা এবং বড় বড় ব্যবসায়ী, এককথায় দুর্নীতিবাজাদের হাত, পা, চোখ, কান এমনকি শিরোচ্ছেদ হতেই থাকতো, ওদের দাপট কমতো, যদিও দেশ পঙ্গু দিয়ে ভরে যাতো, তথাপিও ভালো হতো। অতএব, “হে বিশ্বাসগণ! অবিশ্বাসীদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটবর্তী তাদের সাথে যুদ্ধ কর এবং তারা তোমাদের মধ্যে কঠোরতা দেখুক…।” সূরা ৯:১২৩।