(লেখাটি দৈনিক ইত্তেফাকে ১০.১০.২০১১ সোমবারে প্রকাশিত হয়েছে। মূলটা ঠিক রেখে একটু এডিট করে দিলাম।আশা করছি নীতিমালার পরিপন্থী হয়নি কাজটা)

বিশ্বজুড়ে নারীদের হাতে মৃত্যু পরোয়ানা তুলে দিচ্ছে যে রোগগুলো তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে স্তন ক্যান্সার। বাংলাদেশের ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে ১৭% ই স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত। বিশ্বজুড়ে অক্টোবর মাসকে “স্তন ক্যান্সার সচেতনতা মাস” হিসেবে পালন করা হয়, এ মাসে আমেরিকায় সর্বত্র চোখে পড়ে ‘গোলাপি ফিতা’ যা স্তন ক্যান্সার সচেতনতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, অথচ বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক নারী প্রতি বছর স্তন ক্যান্সারের কারণে মৃত্যুবরণ করার পরও আমাদের দেশে স্তন ক্যান্সার নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যাপকতায় সচেতনতা কর্মসূচী দেখা যায়না। স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত সকল নারীরাই স্তন ক্যান্সারের উপসর্গ সম্পর্কে সঠিকভাবে অবগত না হবার কারণে, স্তন সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে অনীহার কারণে এবং নিজেদের ও পরিবারের মানুষের অবহেলার কারণে তাদের রোগকে প্রতিরোধযোগ্য পর্যায় থেকে মরণঘাতী পর্যায়ে নিয়ে যান। অনেক সময়েই সময়মত চিকিৎসা না নেয়ার কারণে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে শরীরের অন্যান্য অংশে এবং রোগীকে অপেক্ষা করতে হয় তিলে তিলে মৃত্যুবরণ করার জন্য। বিশ্বে প্রতি বছর ৫ লাখ নারী স্তন ক্যান্সারে মারা যায়। আর বাংলাদেশে প্রতি বছর এ রোগে আক্রান্ত হয় ২২ হাজার নারী এবং মারা যাচ্ছে ১৭ হাজার নারী। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন ৯০% ক্ষেত্রেই সচেতনতা ও সময়মত চিকিৎসা বাঁচিয়ে তুলতে পারে রোগীকে এবং দিতে পারে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন।

সাধারণত ৫০ বছরের বেশী বয়সীদের মধ্যে এই ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। ২৫ বছর বয়সের আগে সাধারণত স্তন ক্যান্সার হয় না৷ ৪০ ভাগ স্তন ক্যান্সার সাধারণত ৫০ বছর বা এর পরে হয়ে থাকে৷ পরিবারের নারী সদস্যদের মধ্যে (বিশেষত যেমন মা, বোন) স্তন ক্যান্সার বা অন্যান্য ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে, ইস্ট্রোজেন হরমোন (স্ত্রী হরমোন) বৃদ্ধি পেলে, ১২ বছরের আগে মাসিক শুরু হলে, মাসিক দেরীতে অর্থাৎ ৫০ বছর বয়সের পর বন্ধ হলে, ২০ বছরের আগে বিয়ে হলে, ৩০ বছরের পর প্রথম সন্তান জন্ম হলে, সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ালে, নিঃসন্তান থাকলে, বিড়ি-সিগারেট, তামাক সেবন, কম শারীরিক পরিশ্রম, দীর্ঘদিন উচ্চরক্তচাপ ও বহুমূত্র রোগ থাকলে, বেশি মোটা হলে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
স্তন ক্যান্সারের লক্ষণগুলো হল:
• স্তনের কোন অংশ চাকা চাকা হয়ে যাওয়া অথবা কোন লাম্প দেখা যাওয়া
• স্তনের আকার বা আকৃতির পরিবর্তন- যেমন বড় হয়ে যাওয়া বা ঝুলে যাওয়া
• স্তনবৃন্তের আকারে পরিবর্তন, স্তনবৃন্ত থেকে রক্ত বা তরল পদার্থ বের হওয়া
• স্তনবৃন্তের আশেপাশে রাশ বা ফুসকুড়ি দেখা যাওয়া
• বগলে ফুলে যাওয়া বা চাকা দেখা দেয়া
• স্তনের ভেতরে গোটা ওঠা বা শক্ত হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
এ ধরণের যেকোন লক্ষণ দেখা দেয়ার সাথে সাথে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। সাধারণত নারী মেনোপজের আগে স্তনের দুধ দানকারী টিস্যুসমূহ ঋতু শুরুর আগে আগে কার্যক্ষম হয়ে ওঠে। কোনো কোনো মহিলার ক্ষেত্রে স্তন হয় নরম অথবা বগলের কাছাকাছি জায়গায় স্তনে গোটার মতো হতে পারে। সাধারণত মহিলাদের ঋতু বন্ধের বছরখানেক আগে স্তনের এ ধরনের পরির্তন স্বাভাবিক। আবার মৃগীরোগ বা হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত মহিলাদের স্তনে এ সকল পরিবর্তন মাসে মাসে দেখা দিতে পারে এবং ঋতুচক্র শেষ হলেই স্তন আবার স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। কাজেই স্তন পর্যবেক্ষণের সবচেয়ে ভালো এবং উপযুক্ত সময় হচ্ছে প্রতি মাসে ঋতুচক্র শেষ হওয়ার ঠিক পরপর। এমনকি মহিলাদের মেনোপজের পরও প্রতি মাসের ওই একই তারিখে স্তন পর্যবেক্ষণ করা উচিত। তবে মনে রাখা জরুরি এ পর্যবেক্ষণ মাসে একবারের বেশি করা ঠিক নয়। এতে করে স্তনের ছোটখাট পরিবর্তন পরিষ্কার ও সঠিকভাবে লক্ষ্য করা যায় না।

নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা করার পাঁচটি ধাপ হলঃ

• প্রথমত শরীরের ওপরের অংশ অনাবৃত করে আয়নার সামনে দাঁড়াতে হবে। যে কোনো একটি স্তন একটি থেকে অপরটি আকারে বড় বা ছোট হতে পারে। এটি একেবারে স্বাভাবিক।

• এরপর সামনের দিকে ঝুঁকে লক্ষ করতে হবে স্তন দুটির একটি অপরটির চেয়ে ভিন্নভাবে দোলে বা নড়ে কি না। পরবর্তীতে দুটো স্তনই ধরে উপরের দিকে তুলে ধরতে হবে। এক্ষেত্রে লক্ষ্য করতে হবে স্তনের শীর্ষের চামড়ায় কোনো গর্ত বা খাঁজ সৃষ্টি হয় কি না।

• এরপর স্তন ধরে চাপ দিয়ে ছেড়ে দিয়ে কয়েক সেকেন্ড পরই পুনরায় চাপ দিতে হবে এবং এক্ষেত্রে লক্ষ্য করতে হবে স্তনের পুরো এলাকাজুড়ে কোথাও কোনো গর্ত, খাঁজ বা সমতল কিছু সৃষ্টি হয় কি না।

• পাশাপাশি অবশ্যই লক্ষ্য করতে হবে স্তনবৃন্ত দুটি ভিন্ন দুমুখী কিনা অথবা একটি আরেকটির চেয়ে ভেতরে ঢুকানো কি না।

• দু হাত মাথা বরাবর সোজা উঁচু করে ধরে লক্ষ করতে হবে। এ অবস্থায় স্তন দুটির যে কোনো একটির আকারে পরিবর্তন ঘটায় কি না।

পর্যবেক্ষণের যদি সব ক্ষেত্রেই উত্তর হ্যাঁ হয় তবে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।

নিজেদের স্তনের স্বাভাবিক পরিবর্তনগুলো মহিলাদের সবারই জানা প্রয়োজন। তাহলে অস্বাভাবিক কিছু হলে সহজে বোঝা যাবে। মাসিকের পূর্বে সাধারণত স্তনে ব্যথা এবং গুটি মনে হতে পারে। এ রকম অবস্থায় দুশ্চিন্তা না করে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়াই শ্রেয়। ডাক্তার আপনাকে পরীক্ষা করে দেখে প্রয়োজন হলে আরো কিছু টেস্টের ব্যবস্থা করতে পারেন। সাধারণত যেসব টেস্ট করা হয় সেগুলো হলো- মেমোগ্রাম, ফাইন নিডেল অ্যাসপিরেশন সাইটোলজি, আলট্রাসাউন্ড ইত্যাদি।

নারীদের নিজেদের স্তন সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। আমাদের দেশের নারীরা নানা কারণে নিজেদের এ ধরণের রোগ সম্পর্কে এমনকি স্বামীকেও বলতে চাননা, অন্য কাউকে তো নয়ই। যেহেতু মেয়ে ও মায়ের মাঝে এধরণের ব্যাপারে খোলাখুলি আলোচনা বেশি হয়ে থাকে তাই তাদেরকেই পরস্পরের খেয়াল রাখতে হবে, পরিবারের সদস্যদের বিশেষ করে স্বামীদেরকে স্ত্রীদের প্রতি যত্নশীল হতে হবে এবং সহজ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে দুজনার মাঝে যাতে জীবন সঙ্গিনীর কষ্টগুলো সহজে ও দ্রুত জানা, বোঝা ও সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া যায়। ক্যান্সার ধরা পড়লে ঘাবড়ে না গিয়ে সুচিকিৎসা নিতে হবে। চিকিৎসককে সবকিছু খুলে বলা উচিত। কারণ তিনিই স্তনের পর্যবেক্ষণ সর্বোৎকৃষ্ট উপায়ে করতে সক্ষম। মনে রাখতে হবে চিকিৎসকের কাছে সময় নিয়ে সবকিছু খুলে বলার মানে কারো সময় নষ্ট করা নয়। সতর্ক ও আন্তরিক হলে এ রোগের প্রতিরোধ ও আরোগ্য সম্ভব। পরিবারের সকলকে রোগীর পাশে থাকতে হবে, তাকে বোঝাতে হবে এ রোগ আরোগ্য হওয়া সম্ভব, তাই মৃত্যুর আগেই শতবার মৃত্যুবরণ করা কোন কাজের কথা নয়। অদম্য জীবনস্পৃহার কাছে যমদূতও হেরে যেতে পারে যদি মনে থাকে আশা, থাকে আপন মানুষের সাহচর্য।

স্তন ক্যানসার সচেতনতা মাস উদযাপনের অংশ হিসেবে রাজধানীর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল বিনা মূল্যে স্তন ক্যান্সার শনাক্ত করার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিনা মূল্যে যেকেউ এ সেবা গ্রহণ করতে পারবে। মাসব্যাপী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটি দল হাসপাতাল ভবনের নিচতলায় এ কার্যক্রম পরিচালনা করবে। স্বাস্থ্য পরীক্ষার পাশাপাশি মেমোগ্রাম, আলট্রাসনোগ্রাম, এফএনএসি, বায়োপসি এসব প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা কম খরচে করা যাবে। আন্তর্জাতিক স্তন ক্যান্সার সচেতনতা মাস উদযাপন উপলক্ষে মিরপুর আহছানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালে ১ অক্টোবর থেকে মাসব্যাপী স্তন ক্যান্সার সচেতনতা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত বিনামূল্যে সেবা কার্যক্রম প্রদান করা হবে। যে সমস্ত মহিলা স্তন সমস্যা ও ক্যান্সার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন তাদের এ সেবা প্রদান করা হবে। ডা. নাহিদ সুলতানা, ডা. শারমিন হোসেন ও ডা. সেলিনা পারভিন মাসব্যাপী এ সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। এছাড়া উক্ত মাস উপলক্ষে ৩০% সাশ্রয়ী মূল্যে আল্ট্রাসনোগ্রাম, মেমোগ্রাম, এফএনএসিসহ ব্রেস্ট স্ক্রিনিং-এর সুবিধা প্রদান করা হবে। আহছানিয়া মিশন কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিলা হোস্টেল ও কলেজগুলোতে ক্যানসার বিষয়ে সচেতনতামূলক সভা করবে। এ বিষয়ে আরো তথ্য জানতে ০১৭১৮৫৯৪৬৮২, ০১৭১৫৩৩৬৩০৪, ০১৭৪৪৬৬৬৭৭৭ নম্বরগুলোতে যোগাযোগ করা যাবে।

স্তন ক্যান্সার নামক দানবকে রুখতে সচেতন হোন, সচেতন করুন, জীবনের জন্য এগিয়ে আসুন আজই।শুধুমাত্র ট্যাবুর কারণে যারা এরকম একটা মরণঘাতী রোগ সম্পর্কে কথাবার্তা বলতে চাইবেননা তারা একটু কষ্ট করে গুগল ইমেজে ব্রেস্ট ক্যান্সার বা স্তন ক্যান্সার লিখে সার্চ দিয়ে দেখেন। ছবিগুলো এতই ভয়াবহ যে এখানে দেয়ার মত সাহস করতে পারলামনা। আমাদের অর্থহীন লজ্জা কি আমাদের নিজের, মা, বোন,বান্ধবীসহ সকল আপনজনের জীবনের ঝুঁকির চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়াবে? এরকম ভয়ঙ্কর অবস্থার স্শিকার হতে হবে?

(ছবিগুলো দিতে চাইনি কিন্তু সাইফুল ভাইয়ের কথায় মনে হল আসলেই ছবিগুলো দিলে ভয়াবহতা বুঝে মানুষের সচেতন হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকবে। তাই দেখতে ভয়াবহ হলেও দিলাম।)
তাই নিজে জানুন ও অন্যকে জানান, নিরাপদ হোন নিরাপদ করুন, সচেতনতা সৃষ্টি করুন।