কয়েকটা মাছি কোথা থেকে উড়ে এসে স্বাগত জানালো সৌরভকে।
একপাল্লার জং-ধরা টিনের গেটটা দেয়াল ঘেঁষে কাৎ হয়ে পড়ে আছে। সৌরভ ভাঙা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছিলো। বাড়িটা ফাঁকা। সে পকেট থেকে চিরকুটটা বের করে আবার চোখ বুলালো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। পতিত গেটটার দিকে তাকালো। অতীত এসে হাজির। সে অনুভব করলো, অতীতের দরজা জানালা সব খুলে যাচ্ছে। সে সেগুলো খুলে যাবার আগেই এক রকম জোর করে বন্ধ করে দিলো। পা বাড়াতে গিয়ে সে দেখলো বাড়ির ভেতর আধো অন্ধকার। মনের ভুত ভেবে সে আবার থমকে দাঁড়ালো। বাড়ির দরজা জানালা সব খোলা। পা টিপে টিপে চলে এলো বারান্দায় । খোলা দরজা দিয়ে দেখতে পেলো, অনেকদিনের স্মৃতি-জড়ানো টেবিল আর চেয়ারগুলো আগের মত সেইভাবে রয়ে গেছে। এতদিনেও যেনো কেউ ছুঁয়ে দেখেনি। এই ভাবনা মাথায় এক পাক না ঘুরতেই কে যেনো তার বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে গিয়ে চেয়ারগুলোকে জড়িয়ে ধরতে চাইলো। আর তখনই তার নাক ও ঠোঁটের পাশ ঘেঁযে উড়ে গেলো কয়েকটা মাছি। বাম হাতটা ব্যাঙের মতো লাফিয়ে, শিকার না পেয়ে উত্তেজনায় কাঁপতে লাগলো। বাড়ির চারপাশে কি তবে শুধুই আবর্জনার স্তুপ? কিন্তু সে রকম কিছু তার চোখে পড়লো না। মাছি উড়ছে অগুনতি। সে আবারো উঁকি দিলো। কাউকে দেখতে পেলো না। বাহার কি তবে এখনো দোকান থেকে ফেরেনি? বাহার! বাহারই তো – বিড়বিড় করে বলে উঠলো সৌরভ। ওকে ভুলে যাওয়া কি খুব সহজ? মরে গিয়েও বেশ কিছুদিন সে বেঁচে থাকবে। তাকে মরতে দেবে না তার স্বজনেরা। সে এবার গলা খাঁকারি দিল, তাতে কোন কাজ হলো না। সহসা সৌরভের মনে হলো, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো, এটা একটা নাটকীয় রূপ নেবে। সবাই কি তাকে এখনো মনে রেখেছে? তাকে কি চিনতে পারবে? মুখের আদল তো অনেকটা পাল্টে গেছে। নিজের মুখে হাত বুলায় সৌরভ। পরিবর্তনের ভাষাটা বুঝতে চেষ্টা করে। একটা পিঁপড়ে তার পায়ের আঙ্গুলে জোর কামড় বসিয়ে দিলে, যতটা না সে ব্যথা পেলো তার চেয়ে বেশি ভয় পেলো। সে কিছুটা উদভ্রান্তের মত এদিক ওদিক তাকালো। আর তখনই তার মনে হলো কেউ যদি তাকে দেখে চোর ভেবে চিৎকার দিয়ে উঠে,তো ঘটনাটা কোনদিকে মোড় নেবে? সে পেছনে তাকিয়ে দেখলো, সদর দরজাটা খোলা কি-না। পকেট থেকে চিরকুটটা বের করে আবারো চোখ বুলালো। তার মুখোভাবে কিছুটা চাঞ্চল্য দেখা দিলো। সে অস্থিরভাবে চিঠিটা পকেটে রেখে, একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কয়েকটা পাতা ঝরে পড়লো তার পায়ের কাছে। পাতাগুলো অপরিচিত। আগে কখনো দেখেনি। একটা পাতা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখে, ফেলে দিলো। তারপর পাতাটার উৎসে তাকাতে গিয়ে দেখলো, গাছটা নতুন লাগানো। কোথাও একটা শব্দ হলো। মৃদু শব্দ। তবে ওইটুকু শব্দই স্তব্ধতা ভাঙার জন্য যথেষ্ট ছিলো। সৌরভের মনে হলো, কেউ জেগে উঠেছে। তার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেলো। নিজেকে শান্ত রাখার দ্রুত প্রস্তুতি চলে তার মধ্যে।
কি যেনো ওর নাম? সে মনে মনে স্মরণ করবার চেষ্টা করলো। পারলো না। দ্রুত স্মরণ করতে গিয়ে নামটা যেনো আরো দুরে সরে যাচ্ছিলো। তবে কি সে শেষ পর্যন্ত নিজের দেয়া নামটাই ভুলে গেলো। খুব রাগ হলো তার নিজের উপর। পরক্ষণে মনে হলো – নিজের দেয়া নাম স্মরণ করে আর কি হবে? রানু নিজেও তো মনে হয় ভুলে গেছে। শব্দটা বাতাসে হারিয়ে গেছে সেই কখন। কেউ আসেনি। আর কেউ না আসুক, রানুর তো আসবার কথা। পচা বাতাসের ঝাপটা এসে তার নাকে লাগছে। এখানে আসবার পর থেকে মাছিগুলো ক্লান্তিহীনভাবে তার চারপাশে উড়ছে তো উড়ছেই। সৌরভের হাতদুটোও সেজন্য অস্থিরভাবে ছন্দ কেটে কেটে উড়ছে বাতাসে। বাইরে যাবার আগে বাহার কি মাছিগুলোকে বাড়ির পাহারাদার হিসাবে রেখে গেছে? সৌরভ কি ফিরে যাবে? সে আবার পকেটে হাত ঢুকালো, চিঠিটার স্পর্শ পেয়ে মুর্হুতে সচল হয়ে উঠলো। হয়তো সবাই ঘুমাচ্ছে। বারান্দার এক কোণে একটা টোল, সৌরভ কোন কিছু না ভেবেই ওখানে গিয়ে বসে পড়লো। বাহার কি এখনো দোকানে?
নিশ্চয়ই টাকা গুনছে একমনে। অথবা প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। যেনো জবরদস্ত এক দার্শনিক। চোখের সামনে বুড়িগঙ্গা নদী, ৮৮’র বন্যার মত কলকলিয়ে ঢুকে পড়ছে টাকার স্রোত। আর দেখা হলেই ম্লান হেসে চিরায়ত ভঙ্গিতে বলতো, দোকানটা বিক্রি করে দেবো, ভাবছি।
সৌরভ বলতো, তা বিক্রি করে দিলেই পারিস।
মায়া, মায়া পড়ে গেছে দোকানটার ওপর। তা না হলে কবেই খতম করে দিতাম। তারপর খুব সযত্নে বুক পকেটে হাত ঢুকিয়ে চেক বইটার অস্তিত্ব অনুভব করে বলতো, পুরনো জিনিসের মায়া সহজে ছাড়তে পারি না। টাকা পয়সাই কি সব? বলে সে এমনভাবে তাকাতো যেনো তার চোখে কেবলি স্মৃতি আর মায়া। আর ওদিকে তার শয্যা-সঙ্গী অপেক্ষা করে করে বেঘোর ঘুমে। বাহার তার শয্যা-সঙ্গীর নাকের ডগায় হাত রেখে, মৃদু ধাক্কা দিয়ে, অনেকটা নিশ্চিত হয়েই, তার গোপন ড্রয়ার খুলে, চেক বইটার পাতা উল্টাতো একমনে। পাতা উল্টাতে উল্টাতে তার তৃপ্তি মিটতো না। চেক বইয়ের শূন্য পাতাগুলোতে একবার তার মায়ের, একবার তার বাবার ছবি ভেসে উঠতো। অনেক, অনেক খরচ করতে ইচ্ছে করতো মা-বাবার জন্য। পারেনি। আর তাই সে বউকে পাঠিয়ে দিত মা-র কাছে, আর নিজে চলে যেত বাবার কাছে। বউ বসে বসে একমনে তার শাশুড়ির হাত, পা, গা টিপে দিত। আর সে নিজে তার বাবার সামনে গিয়ে বসার আগে ঘুরঘুর করে, চোখে মুখে চমৎকার দুঃখ-ভাব, সে-মুহূর্তে তাকে দেখলে মনে হবে এ জগতে তার চেয়ে অসহায় আর কেউ নেই । তার দুঃখ একটাই, শুধু টাকার অভাবে মা-বাবার জন্য ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কিছু করতে পারছে না। তারপর বাবার ভাবগতিক বুঝে তার কাছে গিয়ে বসে পড়তো। বাবা তার বংশ গৌরব, আগের মতই বলে যেতো। এ পর্যন্ত কতবার বলা হয়েছে তা সে নিজেও জানতো না। আর বাহার মনোযোগী শ্রোতার মত কান খাঁড়া করে শুনে যেতো। সে এতটাই মনোযোগ দিয়ে শুনে যেতো, যে তার গলায় হঠাৎ খকখক শব্দ হতো। সে বুঝ তে পারতো রানু তার গলায় এবার কাঁটা হয়ে বিঁধে গেছে। সে বার কয়েক কাশি দিয়ে, ঢোক গিলে রানুকে পাকস্থলীতে পাচার করে দেবার চেষ্টা চালাতো। আর রানু কেমন না-ছোড় বান্দা, গলায় সে আটকে থাকবেই। বাহারের খুব রাগ হতো। কেন যে রানু সৌরভের সাথে পালিয়ে যায়নি, সে ভেবে পায়না। আশ্চর্য! মানুষের গায়ে আবার গণ্ডারের চামড়া হয়। হয়, হয়। এই রানু তার উদাহরণ। তা না হলে কবেই চলে যেতো। তা না করে, হলো কি-না খাঁচার পাখি। এবার পুষো। কে জানে তার অনুপস্থিতিতে বাড়িতে কি হয়? লেখাপড়ার নাম করে কোথায় যায়? শুধু মা আর বাবার জন্য, তা না হলে কবেই চালান করে দিতো। বাজারে কি আর তাদের পরিবারের জন্য পাত্রের অভাব? নিজেকে সান্ত্বনা দিতো এই ভেবে, এতটা দিন যখন সহ্য করলি মন, আর কয়েকটা দিন ধৈর্য ধর। রানুর ব্যাপারে তার মনে এই আক্ষেপ থেকে গেলেও, বড় ভাই এ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ায়, মনে মনে বড় শান্তি পেয়েছিলো। বাকি আছে দু‘জন, তারাও যাই যাই করছে। এ নিয়ে মা আর বাবার মনে বেশ আক্ষেপ। বাহার আকারে ইংগিতে জানিয়ে দিয়েছে, সে না খেয়ে মরে গেলেও বাপ-দাদার ভিটে মাটি ছেড়ে আন্য কোথাও যাবে না। গোপনে, যদিও সে একটা প্লট কিনে রেখেছে, শুধু বিপদ আপদের কথা ভেবে। তা করলেও তার বিশ্বাস বাবা তার মত পিতৃ-ভক্ত, অনুগত ছেলের নামেই বাড়িটা লেখে দেবে।
জলের নীচে জল-স্রোতরে গতি বুঝতে বুঝতে সৌরভের অনকদিন লেগে গিয়েছিল। সেই স্রোতের পাঁক একদিন ভেসে উঠলে বাহারকে সে নতুনভাবে দেখেছিলো। কোমল সদালাপী বাহা্রের অম্লান হাসির ভেতর থেকে সেদিন একেবারে নগ্নভাবে বেরিয়ে এসেছিলো লোভের এক দানব। দো‘তলা বাড়ির দ্বারা সে নির্ধারণ করে দিয়েছিলো সৌরভের অবস্থান। ওরকম একটা বাড়ি থাকলেই যেনো সৌরভ একজন মানুষ। সৌরভের নেই তো পথে নেমে আসো নীতি-কথা ছেড়ে, পথ ছেড়ে, বেরিয়ে আসো, পথই নিয়ে যাবে সাফল্যের ঘরে। এ না হলে সমাজে মূল্য নইে, আর মূল্য না থাকলে আজকের বাজারে কে কার খোঁজ নেয়?
মানুষ তাহলে সম্পত্তি?
আমি আর কি বলবো, বড় বড় পত্রিকায়, বড় বড় বিশেষজ্ঞরাই তো মানুষ না বলে, বলছে মানব-সম্পদ। তাহলে এতদিন ধরে চলে আসা আড্ডার ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠা সর্ম্পক কি র্অথহীন?
আড্ডায় কি আর পেট ভরে?
সৌরভ রাগে কাঁপতে থাকলেও ঠান্ডা গলায় উত্তর দিয়েছিলো, মানুষের দরিদ্রতা তো দুরের কথা, কৃত আপরাধগুলোর জন্যও মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করে লাভ নেই। এগুলো তোদের সভ্যতার ফসল।
অরণ্যে চলে গেলেই পারিস?
আমরা অরণ্যে চলে খুব সুবিধা হয়?
মুহূর্তে পাল্টে গিয়েছিল বাহার, একগাল হেসে উত্তর দিয়েছিল, পরীক্ষায় পাশ করেছিস।
মানে?
দেখলাম, আগের মতই আছিস কি-না?
আমাকে পরীক্ষা নেবার লাইসেন্সটা তোকে কে দিলো?
বাহার পরিবেশটাকে হাল্কা করার জন্য হাসতে হাসতে বলেছিলো, তোর দ্বারা হবে।
সৌরভের আর ইচ্ছে হয়নি, কথা বলতে। সে বেরিয়ে গিয়েছিলো। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছিলো, কে যেনো তার পাছায় একটা লেজ লাগিয়ে দিয়েছে। পাছায় হাত বুলাতে বুলাতে তার মনে হয়েছিলো, পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে এ তেমন কিছু নয়। রাস্তার ফুটপাতে পড়ে থাকা মাংসপিন্ডগুলোও তো বেঁচে আছে চিৎকার করে করে। তার মনে হলো, তাকেও ফুটপাতে বসিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু তার জন্য এত আয়োজনের প্রয়োজন নেই। তাকে বললে পরে হয়তো সে ব্যাপারটা ভেবে দেখতো। মৃত্যু নিয়ে তার তেমন কোন ভয় নেই। সে বারকয়েক মরতে গিয়েও পারেনি। ব্যর্থ হয়ে ভেবেছে, ওটা থাকুক ভবিষ্যতের জন্য, কোনো প্রয়োজনীয় মুহূর্তের শেষ সম্বল হিসাবে।
‘যে ব্যবস্থার অধীনে মানুষ, তা না পাল্টিয়ে, মানুষকে তার কৃত কুকর্মের জন্য দোষারূপ করে লাভ নেই‘ – এ কথাটা সব সময় যত্রতত্র বলে বেড়াতো সৌরভ। অথচ আজ সে ভুলে গেলো। সে মনে মনে ভাবলো, বাহার কি এতই শক্তিশালী ? মন থেকে সব ঝেড়ে মুছে পথ চলতে গিয়েও থমকে যেতো। কোনো কারণে বাহারের কথা মনে হলেই তার বমি আসতো।
খস করে একটা শব্দ হতেই সে উৎকর্ণ হয়ে তাকালো। না, কেউ নেই। সদর দরজার দিকে তাকালো, ওখানেও কেউ নেই। সবকিছু আগের মত স্তব্দ। রানুর অনেক গর্ব ছিলো তার মসৃন ত্বকের জন্য। তার ত্বকের পূজারী ছিলো অনেক। তারা ছিলো নিজেদের মধ্যে এক একজন দেবতা। তারা প্রতিযোগিতা করে রানুর শরীরের ভাঁজে ভাঁজে কবিতা রচনা করতো। পূজারীদের মধ্যে যিনি ছিলেন সবচেয়ে রূপবান আর বিত্তশালী, তার অবাধ যাতায়াত ছিলো রানুদের বাড়িতে। অন্যান্য দেবতারা দুর থেকে রানুর হাসি আর নৃত্য দেখে, প্রধান দেবতাকে অভিশম্পাৎ করতো, যেনো তার অকাল মৃত্যু হয়। রানু অতটা অনুদার ছিলো না, যতটা লোকে বলতো। প্রধান পুজারীর অনুপন্থিতিতে অন্যান্য দেবতাদেরও সে তুষ্ট করতো শুধু তার বাঁকা চাহনীতে। বাহার এসব দেখে অসম্ভব রকমের উদার হয়ে গিয়েছিলো। এই গোটা সময় সে ছিলো খোলামেলা জগতের প্রথম সারির একজন। কিন্তু কতদিন আর খোলামেলা থাকা যায়? একদিন সেও বিগড়ে গেলো। তাতে রানুর খুব একটা ক্ষতি হয়নি, যতটা হয়েছিলো সৌরভের আগমনে। স্কুল জীবনের বন্ধুকে পেয়ে বাহার জড়িয়ে ধরেছিলো তাকে। বাহারই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো, এই বলে, আমাদের ক্লাসের সেরা ছাত্র, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পরিচয় পর্বের পর সৌরভ তার ঝোলা থেকে একখানা সাহিত্য পত্রিকা বের করে বলেছিলো, এইজন্য আগমন, সাহায্য কর যাতে নিয়মিত বের করতে পারি।
বাহার অবাক হয়ে বললো, এই পথ ধরলি কবে? তোর তো এখন কোন এক কর্মকর্তা হয়ে যাবার কথা।
সেরকমই কথা ছিলো, ও পথে যেতে ভাল লাগেনি তাই এ পথ ধরেছি। এখন পুরনো সব বন্ধুদের বের করে এই পত্রিকা গছিয়ে দিচ্ছি।
যে দিনকাল পড়েছে, পত্রিকা পড়ার সময় কই? তুই ব্যক্তিগতভাবে চান্দা চাইলে দিতে পারি কিন্তু পত্রিকা বাবদ আমি পয়সা জলে ঢালতে পারবো না।
গত কয়েক মাসে পত্রিকা বিক্রি করতে গিয়ে নানান অভিজ্ঞতায় সৌরভ কৌশলী, বললো, আমার জন্য না হয় জলেই ফেললি, তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি কিছু চাই না।
মাথা নেড়ে বাহার বললো, ভেবে দেখবো, কথা দিতে পারছি না।
হয়তো যোগাযোগটা এখানেই থেমে যেতো। কিন্তু রানু এসে গেলো।
ভিন্ন জগতের, ভিন্ন মেজাজের সৌরভকে একটু নেড়ে চেড়ে দেখার খেয়াল চেপে গিয়েছিলো রানুর। সৌরভও কি এক নেশার ঘোরে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করলো বাহারদের বাড়িতে। বাহার না থাকলেও কোন সমস্যা হতো না। আড্ডা চলতো। রানু মনে মনে হাসতো। সৌরভটা কি বোকা? বাহার কি তাকে খাঁচায় বন্দী করার পায়তারা করেছিল? বাহা্র কোনকিছুই স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। ফলে সৌরভকে ঘিরেও গড়ে উঠেছিল সন্দেহের ছায়া। কিছুদিনের মধ্যে সৌরভকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলো। কিন্তু ফেলতে গিয়েই তা আটকে গেলো রানুর গলায়। সৌরভ চলে যাবার পর রানু টের পেয়েছিলো, কোথাও একটা গোলমাল হয়ে গেছে। পুরনো পুজারীদের কাছে গিয়েও সে আর আগের মত আনন্দ পায়নি।
বেশ কিছুদিন এদিক ওদিক ছুটাছুটি করলো সৌরভ। নিজের মনকে প্রবোধ দিতে চাইলো, এই বলে, আমি তো কাউকে ঠকাইনি। কিন্তু মন কি আর প্রবোধ মানে? সেও হিংস্র হয়ে উঠতে চেয়েছিলো। হয়ে উঠতে চেয়েছিলো দেবতাদের একজন। পারেনি। সে পথে চলার কথা ভাবতে গেলেই বড় অসহায় অসহায় বোধ করতো। প্রেম ভেঙে গেলেও একধরণের সুখ সে পেতে পারতো, হয়তো তাকে ঘিরেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেবার কথাও ভাবা যেতো। সে-সব না-হয়ে, হলো কি-না প্রতারিত। ভাবতেই তার মাথা গরম হয়ে যেতো। কিন্তু কাকে দোষ দেবে? কে এর জন্য দায়ী? এসব ভাবনা – তার উত্তজেনাকে প্রশমতি করতো। মন শান্ত হলে, তার মনে হতো, ভাবনায়, রুচিতে না মিললে, সেক্ষেত্রে মিলন না-হওয়া অনেক ভালো। টাকার পেছনে ছুটন্ত ভাইদের দেখে সেও নিজের অজান্তে তাদের পেছনে ছুটছে, যাদের আছে, তাদের চেয়ে বেশি। আর এই ছুটে চলা তার জীবনকে করেছে অনিশ্চিত।
অনেকগুলো কাকের কা কা ধ্বনি শুনে চমকে তাকালো সৌরভ। এই প্রথম খেয়াল হলো পুরনো কূল গাছটা নেই। তার জায়গায় একটা নতুন জাতের গাছ। গাছটা সে চিনতে পারলো না। সে অনেক কিছুই চিনতে পারে না। যেমন পারেনি রানুকে চিনতে। বিদ্রুপ উপহাস এসব তার গা সওয়া হয়ে গিয়েছিলো। কেউ না জানুক, সে জানে তার প্রকৃতি। তাই শেষদিকে আর উপহাসকে গায়ে মাখেনি। অনেক না-পারার মধ্যেও, তার কল্পলোক ছিলো। আর এ কল্পলোকই এ পযন্ত তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কাকগুলো উড়ে যাবার শব্দে সে আবার সেদিকে তাকালো। গাছের পাতা ও ডালগুলো তখনো কাঁপছিলো। বাড়িটার দিকে আবারো তাকালো। বাড়টিা তো ঠিকই আছে, শুধু রঙচঙ। মূল বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন, রান্না ঘরের সামনে আনাজপাতির খোসা, কাগজের ছেঁড়া টুকরা দেখে মনে হলো, রান্নার কাজ চলছে। রানুর এমন কি হতে পারে, কাতর মিনতি জানিয়ে চিঠি দিয়ে বসলো? পকেট থেকে চিঠিটা বের করে আবারো চোখ বুলালো। কিন্তু কোথায় দেখা করবে কিছুই বলেনি। নাকি আবারো খোলস পাল্টালো। রানু কি আদৌ এ বাড়িতে আছে না অন্য কোথাও চলে গেছে? বিয়ে হয়ে যায়নি তো! তাই বা কেমন করে হয়? হলে নিশ্চয়ই তার কানে যেতো খবরটা। তার খুবই অবাক লাগলো, রানু এখনো তাকে মনে রেখেছে, ভেবে। বিপদে পড়লে হয়তো মানুষের চোখ কান অনেক খুলে যায়। সে বুঝতে পারে কার কাছে তার যাওয়া উচিত। রানুও কি তাকে বুঝতে পেরেছে? তা না হলে কবেই ভুলে যাবার কথা। কে জানে, হযতো বাড়ি বিক্রি করে সবাই অন্য কোথাও চলে গেছে। বাহার হয়তো নতুন আরেকখানা বাড়ি কিনেছে। আর তার চেক বইটা আগের চেয়ে আরো ভারি হয়ে উঠেছে।
তার হঠাৎ মনে হলো, এভাবে সারাদিন বসে থাকলে কোন কূল-কিনারা পাবে না। কিন্তু এতক্ষণ বসে ছিলো কেন? সরাসরি ঘরে ঢুকে গেলেই তো পারতো, ঠিক আগে যেমন হতো। একটা ছেদ পড়ে গেলে আর হয়না, সে ভেতরে যাবে কিনা ভাবলো, কয়েক মুহূর্ত,, আড়ষ্ট ভাবটা ঝেড়ে ফেলে সে উঠে দাঁড়ালো।
প্রথম ঘর পেরিয়ে দ্বিতীয় ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো, কেউ নেই। তৃতীয় ঘরের দরজার মুখে পা রেখেই আঁতকে উঠলো সৌরভ। একটা ক্ষীণ লাল স্রোত, জমে আছে মেঝের উপর। ভয়ে সে পিছিয়ে এলো। সৌরভ উবু হয়ে হাত রাখলো। আঙ্গুল দিয়ে ঘষে নাকের কাছে নিয়ে শুকলো। পরপর ২ বার। কিন্তু সে সনাক্ত করতে পারলো না, এটা কার রক্ত। তথাপি সে বিড়বিড় করে বলে উঠলো, না না, এটা কোন মানুষের রক্ত নয়। তার পরপরই সে দৌড়াতে শুরু করলো। দৌড়াতে গিয়ে হাত থেকে কখন যে চিরকুটটা উরে গেল বাতাসে, সে টেরই পেল না।
৯.৪.৯৫