মীরপুরের এই সোলেমান বস্তি হাজার হাজার ছন্নছাড়া মানুষের ঠিকানা- সাধের বসত বাড়ী। সোলেমান নামে এক দরদী বান্দা এই শহরে গরীব মানুষের থাকার জন্যে এই বস্তির পত্তন করেছিল সেই খান সাহেবদের আমলে। এখন সোলেমান নেই, কিন্তু তার নাম কামড়ে ধরে আছে বস্তিটা। রাজা না থাকলেও রাজত্ব বসে থাকে না। ঠিক সেই নিয়মেই সোলেমান মিঞার গন্ডা খানেক ছেলে সন্তানদের ভেতরে রাজত্ব ভাগ হয়ে গেছে। ভাগ-বাটোয়ারার নিয়ম তরিবত এখানে ঐ একটাই- জোর যার মুল্লুক তার। যার গায় জোর যত বেশী সে পেয়েছে ততবেশী সরস অংশটা। এখানে সবাই এসব শরিয়তে অভ্যস্ত, কিছুটা সন্তুষ্টও। এই বস্তির মানুষজন গোরাদের দুই রাজার শাসন দেখেনি, কিন্তু চার মহাজনের রাজত্ব দেখছে। চার মহাজন সোলেমান মিঞার চার যুবরাজ। তারা তাদের জান্নাতবাসী বাপজানের থেকে অনেক বেশী বুদ্ধিমান। এই রাজ্যের আমির-ওমরাহ, উজির-নাজির, কোতোয়ালদের সঙ্গে তাদের উঠাবসা আছে। ওনাদের কাছে তারা ‘রাজনীতি’ নামে অদ্ভুত একটা বিদ্যা শিখেছে এবং আরও শেখার পর্যায়ে রয়েছে। ওনারা বলেছেন- রাজনীতি হলো গিয়ে ফলিত বিদ্যা। এই বিদ্যা মাথার ভেতরে ভরে রাখলে হয় না- বাস্তবে করে দেখাতে হয়। বাপজানের এই বস্তিটাই এখন চার যুবরাজের ফলিত বিদ্যার পরীক্ষাগার। এই সব পরীক্ষা নিরীক্ষার ভেতরে বসবাস করছে অনেক মানুষের মত মোমেনা আর কোহিনূরও। সবার মত তারাও এই বস্তির মহাজনদের হরেক রকমের খাজনা দেয়। যেমন- ভাল পানির জন্যে, বিজলী বাতীর জন্যে, চুরি ডাকাতি না হওয়ার জন্যে খাজনা দেয় তারা মহাজনের লোকদের । মেয়েছেলেদের ইজ্জত আব্রু যাতে ঠিক ঠিক মত থাকে তার জন্যও পয়সা গুনতে হয়- কোহিনূর, মোমেনা সবাইকে গুনতে হয়। এই বস্তির নিয়ম কানুন বেশ কড়া। সবাইকে তা কড়ায় গন্ডায় মেনে চলতে হয়। এই সব শরিয়ত দিনে দিনে একটু একটু করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ছন্নছাড়া এই সব মানুষগুলোর ভেতরে। এই খানে সবচেয়ে লোকসানে থাকে মেয়েছেলেরা, বাচ্চারা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা, ল্যংড়া-পঙ্গুরা। রেওয়ারিশ কুকুর বিড়ালগুলোও থাকে মহা লোকসানের ভেতরে। অবহেলা তাদের গলার মালা -প্রতি প্রহরে চলার সাথি। এখানে যারাই ঠাই পেতেছে- সব প্রানীদের জীবন চলে প্রায় একই সমান্তরালে, রেল লাইনের মত। বেচে থাকটা এখানে সব থেকে বড় পাওয়া। এসব কিছুর সাথে সুন্দর মানিয়ে চলে সোলেমান বস্তির অগুনতি মেয়েছেলে আর বেটাছেলেরা। কোনকিছুর ধাক্কায় তারা মুখের হাসিটারে ধুলোর ভেতরে পড়তে দেয় না।

কহিনুরের কথা শুনে মোমেনা বুবুর হাসি যেন থামতে চায় না। গতর দোলায়ে দোলায়ে হাসে মোমেনা। বার হাত লম্বা আর পাঁচ হাত চওড়া একচালা ঘরের ভেতরে রাতের বেলা কুপির আলোতে বসে মোমেনা হেসে গলে গলে ঢলে ঢলে পড়তে থাকে। কোহিনুর ছুড়িটা সত্যি সত্যি বিরাট একখান বোকা মানুষ। একটু চালাক চতুর না হলে এই যুগে চলে? হাসতে হাসতে এক বার দম নেয় মোমেনা বুবু।
– তাইলে ব্যাটা জব্বর তোর গায়ে হাত চালাইলো? আর তুই কি করলি? ব্যাটা আধাবুইরা জব্বর।
আবার একখান বড় হাসি দেয় মোমেনা। কহিনূর ছুটি পেয়েছে দুই হপ্তার। খবরটা শুনেই কৌতুহলী হয়ে উঠে মোমেনা। মোমেনা আর কোহিনুর- মনে হয় যেন এক মায়ের পেটের সন্তান। তারা এক সাথে একই কাপড়ের কারখানায় কাজ করে- একই ঘরে থাকে একসাথে। তারা হলো মানিকজোড়। মোমেনার বাড়ী বরিশাল, আর কহিনূরের দিনাজপুর। মোমেনা বয়স্ক আর কোহিনূর পনের-ষোল বছরের মেয়ে- কাজের মেয়ে। কারখানায় কাজ করে দিন রাত, সপ্তাহে সাতদিন। কাজ তাকে করতেই হবে। বাবা-মা ছোট ছোট ভাই বোন, ওরা বাচবে কেমনে সে না খাটলে? ওরা বড় হলে সুদিন আসবে ধাই ধাই করে। মোমেনা বুবুও খাটে, তবে অত না। বয়স হয়ে গেছে, অত গতর খাটানী সইতে পারে না। শুক্রবারে ছুটি নেয়, রিক্সায় চড়ে সিনেমা দেখতে যায়। মোমেনা একটু সুখবাসী। পোলা মাইয়া গুলো বড় হয়ে গেছে। তারা যার যার মত কাজ কাম করে। স্বামী নাই- থেকেও নেই। কাজ কাম করা বউয়ের কথাবার্তা গায়ে গতরে জ্বালা উঠায়- একসঙ্গে তাই বেশী দিন থাকা হয় নি। এখন বয়স হইছে- স্বামীর সোহাগ ছাড়াই দিন রাত কেটে যায় তার। মাঝে মধ্যে পোলা মাইয়ারা খবর নিয়া যায়, দেখে যায়। এই ভাল। তার কোন দু:খ নেই। অনেক মিল অমিলের মধ্যেও মোমেনা আর কহিনূর দুই সহদরের মত থাকে, কথা বলে, দিন কাটায় রাত কাটায় একসাথে।

অনেকদিন পর কোহীনুর বাড়ী যাবে। বাড়ী যাবে বাবা মা ভাই-বোন সবাইকে দেখতে। দেখতে যাবে তার গ্রাম, মাঠ, ঘাট, চাতাল আর শুনবে মইশালদের গান। আরও এক কারনে তার দেশে যাওয়া, সেটা গোপনীয় হলেও জেনে গেছে মোমেনা বুবু। মোমেনার মুখে কথার খই ফোটে।
-শোন, ঐ জব্বর হইল এট্টা পাজী। ওর ঐ স্বভাবের কথা সবাই জানে- সব মাইয়ারা জানে। অরে ছারা ছুডি পাইবি না। আবার ছুডি পাইতে হইলে ও যা চায় তাতে তো রাজী অওনই লাগবো, নাকি? মনে করতো ছুডির জন্যে কতবার দরখাস্ত করছোস? কত বছর বারিত যাছ না জানোস? কৌশলডা এট্টু আমার থেইকা শিখা নিলে তিন-চার বছর অমন মা-বাপের মুখ না দেইখা ঢাহায় পইরা থাকতে হইতো না। বুচ্ছস?
ঘর কাপায়ে একটা অট্র হাসি দেয় মোমেনা। সেই হাসির ঝাপটায় কহিনূরের মনের ভেতরে হঠাৎ করে আগুন জ্বলে উঠে পাঠ খড়ির আগুনের মত দাউ দাউ করে। পাজী জব্বরের বিটকেলে হাতটা যেন তার সমস্ত শরীরে দুর্বৃত্ত-স্পর্শে রাশি রাশি ঘৃনা সব একত্র করে এনে মুখের ভেতরে ফেলে । তিতা থুথুতে মুখ ভরে যায়। ঘরের ঝাপিটারে সরায়ে সবটুকু থু থু সে ‘তারা বাজীর’ মত ছিটায়ে দেয় পচাঁ নর্দমার কাদার ভেতরে। বার মাস যে নর্দমা অবিরাম বয়ে চলে ছোট বড় পশুর পচা গলা মৃতদেহ, মলমূত্র অথবা অবৈধ ভ্রুন নিয়ে-হঠাৎ করে ঝাপি খুলে সেসবের কোন দুর্গন্ধ পায়না কোহিনূর সেই বহমান নর্দমার দেহে। থুথু ছিটায়ে মনটা তার কিঞ্চিত হালকা হয়। ‘মনটারে হালকা ফরফুরা রাখতেই হইবো। বাজান কইছে, মায় কইছে এবার বারিত গেলে বিয়া দিবো’- বিয়ের কথা স্মরনে আসায় মনটা ফুরফুরা হয় কহিনূরের। তারপরেও শরীরের কোথায় জানি চোরা কাটার মত একটা অশুচি শুয়ো পোকা ষোলপায়ে হেটে বেড়ায়। মনে মনে একবার গালি দেয়- ‘হারামজাদা জব্বর’।
-তয় যাউকগা পাজী জব্বরের কতা। তর মনডা খারাপ অইলো। কি কি জিনিস কিনলি ছোড ভাইডার লাইগা, বোনডার লাইগা? মা-বাজানের লাইগা কি নিলি?
‘মুখ-ব্যজার’ কহিনূরের মনটারে ভাল করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে মোমেনা বুবু। সে জানে কেন কহিনূরের মন খারাপ। কি করতে পারে সে? সবাই তো এই ভাবেই কাম করে। এসবের ভেতর দিয়েই সবাই মানায়ে চলে। সুপারভাইজার হইলো মালিক। তার উপরে যে, সেও মালিক। তারও উপরে আছে বড় মালিক। সবাই একই কিছিমের, একই আদলের । মালিকেরা এমন একটু আধটু করলে তাতে দোষের কিছু হয় না। কহিনুর নাবালিকা মাইয়া, কেমনে বুঝবে এই সব?

বস্তি আর কারখানা। কারখানা আর বস্তি। এমন করতে করতে চার চারটা বছর কেটে গেছে কহিনূরের। বাড়িতে যেতে পারে নি কহিনূর। বাপজান অবশ্য প্রত্যেক বছর এসে দেখে গেছে ‘কামাইসুদ’ মেয়েকে। প্রত্যেকবার সাথে করে পোটলা বেঁধে নিয়ে এসেছে পিঠা-পুলি-খাবার থেকে শুরু করে দুনিয়ার মাল-সামান- যেন পুরা রায়পুর গ্রামডারে বাইন্ধা আনতে চায় বাপজান। ভাই-বোন আর মায়েরে দেখা হয় নাই তার অনেক বছর। ছুটি নিয়ে দেশে গেলে পেট চলবে কেমন করে, দিন যাবে কিভাবে? ওদিকে আবার দরখাস্ত করেও ছুটি মেলে না। ছুটি না পাওয়াটা অনেকটা শাপে বর হয়। সে যেন একটা লম্বা দড়ি, যার একদিকে আছে ছুটি আরেকদিকে বাচা-মরা। দুই দিকের টানাটানিতে ছিড়ে যেতে বসেছিল সে। বাড়ী যাওয়ার ছুটিটা পাওয়া যেন তার মহাপ্রাপ্তি হলো। অনেক কষ্ট পেশিতে পেশিতে জমা হয়ে আছে তার। গায়ে গতরে এত বছর শুধু লম্বাই হয়েছে সে। যত কাজ করেছে তত দুর্বল হয়েছে- ক্ষয়ে গেছে সস্তা শ্রমে। শরীরের সব শক্তি লোনা জল হয়ে ঝরে গেছে মাংশপেশীর ছিদ্র দিয়ে। অজস্র চাহিদা আর অভাবের ভেতরে বাড়তি শ্রম সাচ্ছন্দ্য আনতে পারেনি এক বিন্দু। শুধু মাংশ পেশী ক্ষয়ে ক্ষয়ে হাড়ের সাথে সেটে আছে। তার মত আরও অনেক অস্তিচর্মসার লিকলিকে কহিনূরেরে ঘুরিয়ে চলেছে শিল্পের চাকা। বড্ড বেশী দায় তারা কাঁধে তুলে নিয়েছে শুধুই ক্ষুধার জ্বালায়।

রেলগাড়ীর লোহার চাকা ঘড় ঘড় ঘুরেছে বহুক্ষন। যতটা দ্রুত চলার কথা সেভাবে চলতে পারেনি। তারা অলস- ‘কামচোর’ রেলগাড়ী। বাসও কেমন জানি অলসের রাজা- কুড়ের বাদশা। ঘাটে ঘাটে লোক তোলে আর নামায়। এমনি ভাবে ট্রেন আর বাস করতে করতে অবশেষে মধ্যরাত্রির কিছু পরে কহিনুর দিনাজপুর শহরে গিয়ে পৌছে। দীর্ঘ পথের ক্লান্তি মুহুর্তে কোথায় জানি উড়ে যায় কর্পূরের মত। এই শহর তার। এই স্থান তার অতি আপন, অতি পরিচিত প্রিয়জনের মত। মনটা আরও বেশী ফুরফুরা হয়ে যায় কিশোরী কহিনূরের। আর বেশীদূর নয় তার বাড়ী। দিনাজপূর থেকে আরও অনেকে তার সহযাত্রী হয় বীরগঞ্জ যাবে বলে। একা একটাই মেয়েছেলে বাসের যাত্রী-আর সব ব্যাটাছেলে। কারও সাথে তেমন কথা হয় না। হয়তো কথা হওয়াটা ঠিক নয়। এটাই একধরনের নিয়ম। রাত এখন অনেক – দুইটা অথবা তিনটা হবে। এক সময় বীরগঞ্জে সব যাত্রী ঢেলে দিয়ে চলে যায় খালি বাস। যাত্রীরাও চলে যায় যার যার ঠিকানায়। কিন্তু একা মেয়েছেলেটা দাড়িয়ে থাকে পথের চৌমাথায় রিক্সা কিংবা অন্য কোন জানের অপেক্ষায়। রায়পুর এখান থেকে বড়জোর দুই মাইল হবে। বাপজানের সাথে কতবার এই বীরগঞ্জের হাটে হেটে হেটে এসেছে কহিনূর। খুবই চেনা তার এই হাট, এই বাট, এই রাস্তার চৌমাথা। একবার ভাবে বালিকা, হাটা ধরলে কেমন হয়- ঘুমন্ত মানুষগুলোরে অবাক করে দেয়া যেত। কিন্ত সাহস হয়না হাটার। কারন চলতি পথে হিংস্র জীবজন্তর থেকে বুদ্ধিমান মানুষের ভয় থাকে বেশী- একথা ভাল করে জানে কিশোরী।

মাথার ভেতরে অনেক রূপালী ভাবনা শত শত কল্পনা হয়ে পাখা ঝাপটায়। সেগুলো বড় বড় স্বপ্ন হয়ে ছোট চোখদুটোর দৃষ্টি শক্তিকে ঝাপসা করে দিতে চায় বালিকার। হঠাৎ বিকট এক শব্দে ব্রেক করে তার পায়ের কাছে এসে থামে টহল পুলিশের একটা গাড়ী। রেশমী স্বপ্নের পাখীগুলো আকস্মৎ উড়াল দেয়। ভাল করে দেখে কহিনুর -তার সামনে পুলিশের গাড়ী-আধুনিক পুলিশ, সেবক পুলিশ- রক্ষকও। নির্জনে মানুষের আগমনে তার সাহস বাড়ে, আবার ভয়ও পায়।
-এই তুমি এত রাইতে এহানে একা কি করতাছো? তোমার বারি কই? কোথায় থাক? চেহারা তো ভালই।
অনুসন্ধানী পুলিশের এতগুলো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না লিকলিকে বালিকা। শুধু পাজী জব্বরের চোখের ভেতরের পরিচিত সেই পঙ্গপালের নড়াচড়া পুলিশের চোখে দেখতে পেয়ে চমকায় কিশোরী। কাঁপা কাঁপা ভীত কন্ঠে বলে উঠে বালিকা, “মোর বাড়ী রায়পুর, স্যার।”
-আচ্ছা সে দেখা যাইবো। এখন থানায় চলো।
কর্মকর্তার নির্দেশ পালনে দুই-তিন জন তাগড়া জোয়ান টেনে হিচড়ে মেয়েছেলেটাকে গাড়ীতে তুলে নেয়।

নিরাপদ আস্থার ঘর থানা। সেবা দেওয়া আর সেবা নেয়ার স্থান থানা। মসজিদের মত পবিত্র ঘর থানা। সেখানে এসেও শেষ রক্ষা হ’লো না কিশোরী কহিনুরের। রাত্রীর শেষ প্রহর পর্যন্ত এক অপ্রাপ্ত বয়স্কার উপরে বিকৃত অনাচার থাবা বিস্তার করে থাকলো। কোতোয়ালেদের লালসাও মিটে গেল, আবার মসজিদের মিনারে ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাউম’ ঘোষনাও হয়ে গেল এক সাথে । সুবেহ সাদেকের আবছা অন্ধকারে দলিত মজলুমের সেই বুক ফাটা চিৎকার মিনারের উচ্চতাকেও ছাড়িয়ে গেল। ঘোলা রক্তশূন্য দৃষ্টিতে কি জানি কি দেখে প্রানে একটুখানি আশার পানি পেল কিশোরী। সামান্য কয়েক হাত দূরে ঐতো লাল দালান আদালত। থানার জীর্ন গবাক্ষের ভেতর দিয়ে একবার সেদিকে ঝাপ্সা চোখে তাকালো বালিকা। ঐতো বসে আছে ধর্মাবতার- ঘন ঘন কি এক হাতুড়ী ঠুকছে টেবিলে। মনে ক্ষীন এক আশা জাগলো বালিকার- বাঁচার আশা, জীবনের আশা অথবা একটিবার মাকে দেখার সাধ। দুরাচারে মথিত বিক্ষত শরীরে সবটুকু শক্তি জড় করে শেষ চিতকার ছুড়ে দিল সে বিচারকের দিকে প্রলাপে, অর্ধচেতনে। কিন্ত ধুসর নিরাশা ফিরে এলো প্রতিধ্বনি হয়ে তারই দিকে আবার লাল দালানের গায়ে ধাক্কা খেয়ে। ধর্মাবতার একবারও ফিরে তাকালেন না থানার সেই খল মঞ্চের দিকে। লাল দালানের উপর বিরাট এক অবিশ্বাস প্রশ্ন বোধক চিহ্ন হয়ে আটকে গেল কিশোরীর কপালে। আর কোন আশা নেই। মৃত মানুষের মত ঘোলা চোখে ধোয়াশা দৃষ্টি তার। সময় প্রায় শেষ। অন্তিম সন্দেহটুকু তার চোখে- তবে কি জজ সাহেবও—? আজব এক প্রশ্নের বোঝা নিয়ে মারা গেল কিশোরী। দিনের আলোর সাথে সাথে সবকিছু পরিস্কার হয়ে গেল সবার কাছে। বিরাট এক ইতিহাস সৃষ্টি করে ফেললো পুরা রায়পুর গ্রামের মানুষ- না খাওয়া অভাবী মানুষ। ছয়দিন ধরে যুদ্ধ হলো পুলিশে আর মানুষে। মানুষ মরলো এক দুই করে আটজন। তা মরুক। প্রতিশোধ চাই- অসন্মানের প্রতিশোধ, রক্তের প্রতিশোধ। সাতচড়ে রা করে না যে ভুখা মানুষেরা, তারা ইতিহাস সৃষ্টি করলো- সময়ের পিঠে বড় একখানা আচড় কেটে দিল। সে ইতিহাস শব্দে শব্দে বাধা পড়ে গেল গায়েনদের দরাজ গলায়। সময়ের গাড়ী, সে কি বসে থাকে? সে চলে গাড়ীয়াল ছাড়াই অবিরাম। সারা দুনিয়ায় সে গাড়ী চাউর করে দেয় কোতোয়াল-বাদশাদের কৌটিল্য আজব যন্ত্রকৌশলে। দরদি গাড়ীয়াল, মৈশালদের ভরাট কন্ঠে কিশোরী কহিনূরের কাহিনী রূপকথা হয়ে এখনও যখন রায়পুরের আকাশে বাতাসে এ গ্রামের মানুষের বীরগাথা ঢেলে দেয়, তখন ঘরের বউ-ঝিরা কুলায় চাল ঝাড়া থামিয়ে, ঢেঁকিতে পারানি থামিয়ে একবার ভাল করে কান পেতে শুনে নেয় সেসব। মৈশালের কন্ঠে আওয়াজ ওঠে:
কন্যারে, সোনার কন্যা ঘুমাস না তুই আর,
তোর কারনে রক্তে ভাসে একোন পারাবার।
মিথ্যা দিয়া সত্য ঢাকে রাজা-বাদশা উজিরে,
তোরে সাজায় নষ্ট মাইয়া, এত বল কার পাঁজরে?
গায়ে হলুদ, বিয়া-সাদী এখনও তোর বাকী
জাগরে কন্যা, উঠরে কন্যা আর দিসনা ফাকী।
বলৎকারে জীবন নিল কন্যারে তোর নমরুদে,
তোর কব্বরে বাতি দেব, করবে কি আর হার্মাদে?

গাড়ীয়ালদের সে গীত আর শুনতে পায় না কহিনুর। শুনতে পায় তার মা, তার বাবা। দূর দুরন্ত থেকে বীর কন্যার বাবাকে মানুষ জন দেখতে আসে। তাদের সামনে নীরবে অশ্রুমোচন করে কন্যার বাবা। লোকেরা সান্তনা দেয়, “আমনে কানবেন না, ভাইঙ্গা পইড়বেন না।”

গর্বিত বাবা শব্দে শব্দে কাঁদে- কাঁদে আর বলে, “না না আমি কানমু কেনে? আমার মাইয়া হাজার বছরের ঘুমন্ত মানুষ গুলোরে জাগাইছে। এই গেরামডারে জাগাইছে। আমার কন্যা হইলো বাপের বেটী।”
দিন যায়, তারপরে আরও দিন যায়, বীর কন্যা কহিনুরের কবর হয়ে যায় রায়পুরের তীর্থ ভূমি।

[রক্ষক পুলিশের যৌন নির্যাতনে নিহত বীরকন্যা ইয়াসমিনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে]
[প্রকাশ থাকে যে, দীর্ঘ নয় বছর আইন-যুদ্ধের পর মহামান্য আদালত বিচার দেয় মৃত ইয়াসমিনকে। নিজেকে প্রশ্ন করি বার বার- অবস্থার বিশেষ কোন পরিবর্তন হয়েছে কি আজও?]