মানবজাতির মধ্যে এমন খুব কমই আছে, ‘ক্যান্সার’ শব্দটি শুনলে যার বুক কেঁপে ওঠেনা। ক্যান্সার বা কর্কটরোগ হল মৃত্যুর পরোয়ানা। একবার ক্যান্সার ধরলে পরে তার থেকে বেঁচে ফিরে আসাটা প্রায় দুষ্কর, চিকিৎসা সব সময়ে সম্ভব হয় না, আর হলেও যে সম্পূর্ণ রোগমুক্তি ঘটবেই এরকম কোন গ্যারান্টী নেই। কিন্তু কি এই ক্যান্সার? কেন সে এত বিধ্বংসী? ক্যান্সার কোন এক অসুখ নয়। এটি বেশ কিছু ধরণের অসুখের একটি সমষ্টি বিশেষ, যার সকলের মধ্যে অন্যতম সাধারণ লক্ষণ হল কতিপয় কোষের অনিয়ন্ত্রিত বন্ধনহীন বৃদ্ধি এবং বিভাজন। এই নিয়ন্ত্রণহীনতার ফলে অচিরেই কোষসমূহ তাদের আশেপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং সুস্থ কোষকলা বা টিস্যুকে ধ্বংস করে। ধ্বংসাবশেষে যখন আর কিছু থাকেনা, তখন ক্যান্সারগ্রস্ত কোষগুলো রক্ত বা লসিকা মারফত বাহিত হয়ে শরীরের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে – যাকে বলে ‘মেটাস্ট্যাসিস’ – এবং সেখানেও একইভাবে শরীরময় বিধ্বংসী কাজকর্মে ব্যাপৃত হয়। কোন কোন কোষ কেন ক্যান্সারগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তার সাধারণত দুটি কারণ মনে করা হয়। এক, পরিবেশগত, পরিবেশ থেকে আহৃত বিভিন্ন সিগ্‌ন্যাল কিছু কোষ-এর নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। দুই, জিনগত, কিছু জেনেটিক অ্যাবনর্মালিটি থাকলে পড়ে ক্যান্সার হবার প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে। এই জিনগত বিকৃতি অনেক সময়ে বংশপরম্পরায় চলে আসতে পারে।

ক্যান্সারের কথা সকলেই জানে এবং তার ফলাফল সম্পর্কে অবহিত। তাই আমার এই পোস্ট, শারীরিক ক্যান্সার নিয়ে নয়। মানবিকতা, সুস্থ মানসিকতা, জনজীবনের ওপরেও ঠিক একই রকম ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসে এক সামাজিক ক্যান্সার – তার নাম ধর্ম, বিশেষত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম। এর প্রভাব এবং ফলাফল সম্পর্কে অপেক্ষাকৃত কম লোকে জানে, এবং অনেকে জানলেও মেনে নিতে অস্বীকার করে। অনেকে আবার মনে করে, চোখ শক্ত করে বন্ধ করে, দুই হাতে কান চেপে বন্ধ করে, মুখে চিৎকার করে ‘লালালালালালালা’ আওয়াজ করলেই এর কুপ্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। দুঃখের বিষয়, সেভাবে কিছু হয় না। ধর্মের কুপ্রভাবকে লড়ে আটকানোর একমাত্র পন্থা হল জ্ঞান, বা নলেজ, এবং সম্যক অবগতি, বা অ্যাওয়্যারনেস।

অনেক ধার্মিক মধ্যপন্থী (রিলিজিয়াস মডারেট)-র বক্তব্য হল, ধর্ম তাদের একান্ত নিজস্ব জিনিস। তাদের অনুভূতির, তাদের চিন্তন-মনন-এর উপর ন্যস্ত তাদের ধর্মভাব। তারা কারও ক্ষতি জানতে করছে না, শুধু নিজেদের মত করে নিজের ঈশ্বর-এর আরাধনা করতে চায় – তাতে কারর কিই বা বলার থাকতে পারে? তারা এও বলে থাকে, যে ধর্মের নামে যারা অন্যের ক্ষতি করে, মারামারি কাটাকাটি করে, তারা সঠিকভাবে ‘ধর্ম’-এর অর্থ বোঝেনি, ইত্যাদি। অর্থাৎ কিনা, তাদের বোঝা যে ধর্মের রূপ, তাদের মাথায় রাখা যে ধর্মের ছবি, সেটাই আদতে ধর্ম নামে পরিচিত হবার যোগ্য; বাকি অন্যান্যরা বিপরীত কথা যা বলে সব ভুল। যুক্তিশাস্ত্রে এর নাম হলো, ‘নো ট্রু স্কটসম্যান‘ ফ্যালাসি বা অ/কুযুক্তি। মুশকিল হল, যেহেতু ঈশ্বর (ভগবান, গড, আল্লাহ, আহুরা মাজদা, গাইয়া, য়াহওয়ে, জিউস – বা অন্যান্য যে নামেই ডাকা হোক না কেন) নিজে নেমে এসে কখনোই বুঝিয়ে দিচ্ছে না, কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, তাই মধ্যপন্থীদের অপেক্ষাকৃত উদার ধর্মচেতনা আর মৌলবাদীদের অতিরক্ষণশীল, অনুদার, অসহিষ্ণু ধর্মব্যাখ্যা – দুটোর কোনটা একে অপরের থেকে বেশী গ্রহণযোগ্য, সেটা নির্ণয় করা নিতান্তই দুরূহ। কিন্তু কুপ্রভাব বা ফলাফলের দিক থেকে দুটোই সমান – দু’দিকেরই আসল উদ্দেশ্য হল মানুষের জীবনযাপনের উপর সর্বময় কর্তৃত্ববিস্তার।

কেন ধর্ম ক্যান্সার-গোত্রীয়? প্রথমত, পরিবেশের প্রভাব। কোন শিশু কোন ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়ে জন্মায় না। জন্মানোর পর থেকেই একটু একটু করে কাজে কর্মে, কথায় বার্তায়, আকারে ইঙ্গিতে মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় কোন একটি বিশেষ ধর্মের প্রতি আনুগত্য। এই আনুগত্য বহুসময়েই আসে চরম মূল্যে – সুকুমার বৃত্তিগুলোর অবদমন এবং অচিরেই বিনাশ; পরসহিষ্ণুতা, জ্ঞান অর্জনের স্পৃহা এবং প্রচেষ্টা, এবং সুস্থ ব্যালান্স্‌ড মানসিকতার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি।

দ্বিতীয়ত, অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি এবং প্রসার। ধর্ম (প্রকারান্তরে ধর্মীয় আবেগ বা ধর্মীয় অনুভূতি) কখনও আত্মনিমগ্ন থাকে না, সেরকমটা তার প্রকৃতির বহির্ভূত। কোন মানুষের ধর্মচেতনা কিছুতেই সেই মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চায়না। ধর্মভাব মাথায় জাগলে সেটা অচিরেই চায় ছড়িয়ে পড়তে, এক মাথা থেকে অন্য মাথায়, একের চিন্তা থেকে অন্যের চিন্তায়; সমমনস্ক মানুষের আবেগ অনুভূতির মধ্যে সূক্ষ্মভাবে প্রবিষ্ট হয়ে স্বল্পসময়ের মধ্যে দখল করে নিতে তার মস্তিষ্কের সমস্ত উচ্চতর কার্যাবলী (হাইয়ার নিউরাল ফাংশান্‌স) – বুদ্ধি, যুক্তি, বিবেচনা, সুস্থচিন্তা, নৈতিকতা সমস্তই তখন ছিটকে যায়, রয়ে যায় শুধু উন্মাদনা।

সেটা কি ধরণের উন্মাদনা? সবচেয়ে বিষাক্ত, ক্ষতিকারক এবং ছোঁয়াচে ধরণের। যে উন্মাদনা কোন যুক্তি মানেনা, সাধারণ বুদ্ধি মানেনা; যে উন্মাদনা নির্ভরশীল একটি অদৃশ্য, অলীক, অনুপস্থিত, কল্পনাপ্রসূত ব্যক্তি বা বস্তুবিশেষ বা এনটিটি-র উপরে; যে উন্মাদনার দৃঢ় ধারণা যে সেই এনটিটি মানুষের কথা চিন্তা করে সমস্ত সৃষ্টির ইতিকথা লিখে গেছে কয়েকশ পাতার ধর্মপুস্তকের মধ্যে – এবং সেই অযাচিত ঐশী বাক্যসমূহ অক্ষরে অক্ষরে সত্য যদিও তাদের উৎস বা প্রোভেনেন্স পরীক্ষা করতে গেলে অনেক রকম গন্ডগোল ধরা পড়ে; যদিও অনেক সময়ই প্রত্যেকের নিজস্ব ধর্মপুস্তকটি অনুবাদের সংস্করণ অনুযায়ী বিভিন্ন রকম কথা বলে থাকে।

এ হোল সেই উন্মাদনা, যার বশবর্তী হয়ে একদল মানুষ নিশ্চিন্তে, নিশ্চুপে তাদের জীবনের সম্পূর্ণ দখল বা কন্ট্রোল তুলে দেয় এক বা একাধিক অন্য মানুষের হাতে, যারা নিজেদের ধর্মগুরু বা আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকে। এবং সেই সব ধর্মীয় নেতার অঙ্গুলিহেলনে বা মুখের একটা কথায় তারা মানবত্বকে শিকেয় তুলে, যুক্তি-বুদ্ধি জলাঞ্জলি দিয়ে নেমে পড়ে ঘৃণ্য, জঘন্য, হীন, পাশবিক আচরণ করতে। আর সেই সব আচরণে যোগদান করাটা খুবই সহজ, কারণ ধর্মের ছায়া থাকতে কাউকে তো নিজের কোন কাজের দায়িত্ব বা রেসপন্সিবিলিটি বহন করতে হয়না। ওই যে, আইনে একটা সুন্দর অজুহাত আছে – স্বল্পসাময়িক উন্মত্ততা, টেম্পোরারি ইনস্যানিটি; ধর্মের ক্ষেত্রে খুবই উপযোগী।

ধর্ম হল সেই উন্মাদনা যাকে যেন-তেন-প্রকারেণ প্রতিষ্ঠিত করতেই হয় যে সেই শ্রেষ্ঠ, সে-ই শেষ কথা। তাই বিভিন্ন মানুষের যদি ভিন্ন ভিন্ন ধর্মানুভূতি থেকে থাকে, ধর্মের ক্রিয়াকলাপ, আচার-ব্যবহার যদি আলাদা হয়ে থাকে, ধর্মের বাণী সম্পর্কে মতামত ভিন্ন হয়ে থাকে, তাহলে তাকে যেভাবেই হোক এক পথে নিয়ে আসতে হবে, এক মতে নিয়ে আসতে হবে। যে কোন মূল্যে। অবশ্য ধার্মিক লোকজনের কাছে সাধারণভাবে নিজের ধর্ম ছাড়া আর কোন কিছুর মূল্য নেই। নেই জীবনের মূল্য, নেই সভ্যতার মূল্য, নেই মানুষের মূল্য। আছে শুধু এক সর্ব আগ্রাসী উন্মাদনা। ভেবে দেখলেই পরিষ্কার হয়, যে এই উন্মাদনার উৎপত্তি বেশ সুপরিকল্পিত – কারণ উন্মাদনা থিতিয়ে পড়লেই মানুষ তখন চিন্তা করতে চায়, আর চিন্তা করলেই তো ধর্মের অসারত্ব ধরা পড়ে যাবে। তাই যুগে যুগে ধর্মীয় নেতারা এই উন্মাদনাকে জিইয়ে রাখবার আয়োজন করে এসেছে।

এবং সবচেয়ে যেটা মারাত্মক, সেটা হল ধর্মের এহেন প্রসার থেকে অব্যাহতি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। মুশকিল হল এই যে যুক্তি, বুদ্ধি, বিবেচনাকে বজায় রাখানোর জন্য কোন প্রতিষেধক বা ভ্যাক্‌সিন নেই। আমাদের ধর্ম-ভিত্তিক, বা আরও ভালভাবে ব্যাখ্যা দিতে গেলে, ধর্মের-আতিশয্য-ভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় শৈশবাবস্থা থেকেই পদে পদে বোঝানো হয় যে ঈশ্বরের ধারণাটা অলীক কল্পনা নয়, ধর্ম একটি উপকারী এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। এই মিথ্যার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসাটা খুব সহজ হয়না অনেকের পক্ষেই। এবং সেভাবেই এক মানুষের থেকে অন্য মানুষে, এক জেনারেশন থেকে অন্য জেনারেশন-এ ধর্ম সংক্রামিত হয়।

ক্যান্সারের মতনই, ধর্ম সভ্যতার বিনাশকারী। সেই কারণেই স্বনামধন্য সাংবাদিক, লেখক ও নাস্তিক ক্রিস্টোফার হিচেন্স বলছেন, “রিলিজিয়ন পয়জন্‌স্‌ এভরিথিং” (ধর্মের বিষাক্ত স্পর্শ সব কিছুকে বিনষ্ট করে); আমার কথা না যাচাই করে শোনার বা আমল দেওয়ার প্রয়োজন এক্কেবারেই নেই। চোখ তুলে তাকিয়ে সমসাময়িক পৃথিবীর দিকে দেখলেই প্রতীতি জন্মাবে। মানবতার পরিপন্থী যত ঘটনাসমূহ ঘটেছে – বেশীদূরে যাবার দরকার নেই, বিগত দশ বছর বা দুই দশকের দিকে দেখলেই হবে – তার প্রায় প্রত্যেকটির কোন না কোন ধর্মীয় অংশ বা কম্পোনেন্ট রয়েছে, সরাসরি বা পরোক্ষভাবে। ধর্মের ছোঁয়া লেগে যেই মূহুর্তে সুস্থ বুদ্ধিবৃত্তি এবং যৌক্তিকতার বিনাশ ঘটে, সেখানেই যে মানবতার পতন ঘটবে, তাতে আর আশ্চর্য কি?

এই লেখাটার পরিপ্রেক্ষিতে আজ বড় বেশী করে মনে পড়ছে জন লেননের লেখা ইম্যাজিন গানটির অসাধারণ লাইনগুলো। খুবই ইচ্ছে হওয়ায় নিজের মত করে অনুবাদ করলাম গানটির। মানগত ফারাকের জন্য অবশ্যই লেনন-এর কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

ভেবে দেখো, স্বর্গটা নেই
– সহজ কথা সহজ করে –
নরক নিচে নেইকো মোদের
শুধুই আকাশ মাথার ‘পরে
ভেবে দেখো, মানুষ যত
বাঁচছে, আজ-কে বাঁচার তরে।

ভেবে দেখা নয়তো কঠিন –
দেশ বিদেশের নেই সীমানা
মারা-মরার নেই তো কারণ
ধর্মেরও আজ নেই জমানা
শান্তিতে তাই বাঁচছে মানুষ
আজ কোন আর নেই যে মানা।

বলতে পার, স্বপ্ন দেখছি।
নই তো আমি একলা সে জন
হয়ত তুমিও জুড়লে এসে –
ধরার সেদিন এক প্রাণ মন।

মনে কর, পারবে যদি,
জমায় না কেউ বিষয়-আশয়
লোভ বা ক্ষুধার নেই প্রয়োজন
ভাইচারাতেই মানুষ যে হয়।
ধরার মাটির সমাংশ ভাগ –
মানুষ-মানুষ সুখেই রয়।

বলতে পার, স্বপ্ন দেখছি।
নই তো আমি একলা সে জন
হয়ত তুমিও জুড়লে এসে –
ধরার সেদিন এক প্রাণ মন।